আমি আবেগ ও অনুভূতিপ্রবণ,ভাবুক আর সৃষ্টিশীল।জীবনের চলা,ওঠাপড়া আর অভিজ্ঞতা নিংড়োনো এই সব লেখা ।এ আমার পাগল মনের নিঃশেষিত প্রকাশ।
27 October 2020
অপারেশন আপসাইলন
2021 সালের পনেরোই মার্চ। নরওয়ের অসলো বিমানবন্দরের এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলারদের একেবারে হিমসিম অবস্থা। একের পর এক নামছে নানা দেশ থেকে আসা ফ্লাইটগুলো। বাছা বাছা সমস্ত পৃথিবী বিখ্যাত মানুষজনদের ডেকে আনা হয়েছে সেখানে।এসকর্ট করে তাদের নিয়ে গিয়ে, দ্রুত ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে আলাদা আলাদা চারটে ঘরে। বিমানবন্দরের লাউঞ্জের বিলাসবহুল সেই সব ঘর থেকে কাউকে বের হতে দেওয়া হবে না আগামী পনেরো দিন। মহামারি ভাইরাসের চারটে মাত্র ভ্যাকসিন এখনও পর্যন্ত তিনটি ট্রায়ালেই উত্তীর্ণ হতে পেরেছে। এবার তাদের সর্বশেষ পরীক্ষা হবে। সর্বসম্মতিক্রমে পৃথিবীব্যাপী চূড়ান্ত ট্রায়ালটিই হবে এই পনেরো দিন ধরে। এর ঠিক পরেই ঘোষণা করা হবে সফলতম ভ্যাকসিনটির নাম এবং এমনকি বাণিজ্যিকভাবে তা বিক্রিও শুরু হয়ে যাবে পৃথিবীময়। তাই সারা পৃথিবীর নজর এখন অসলোর দিকে।
চারটে আলাদা ঘরে, আলাদা ধরণের মানুষদের রাখা হবে, প্রতি ঘরে দশ জন করে। আলাদা ঘর ,আলাদা ভ্যাকসিন।নির্দিষ্ট ভ্যাকসিনের ডোজ দিয়ে, নির্দিষ্ট ঘরে তাদের ঢুকিয়ে দেওয়া হবে। ঘরে রয়েছে লুকোনো ক্যামেরা এবং মাইক্রোফোন। প্রতি মুহূর্তে নজর রাখা হবে তাদের শারীরিক অবস্থা, তাদের কথাবার্তা, চালচলন সবকিছুর উপর। আলাদা একটা কন্ট্রোল রুমও লুকোনো রয়েছে ওই লাউঞ্জের ভেতরেই, যেখানে অপারেটররা সর্বক্ষণ তাদের ভিডিও এবং অডিও রেকর্ডিং করে চলবে।
সমস্ত কুশীলবদের আসার সঙ্গে সঙ্গেই ভ্যাকসিনেশন পর্ব সারা হয়ে গেল। চারটি ঘরের কোন ঘরে কারা থাকবেন, তা আগে থেকেই ঠিক করা ছিল। প্রথম ঘরে থাকবেন পৃথিবী বিখ্যাত সব বিজ্ঞানীরা, নানা দেশের, নানা বয়সের। দ্বিতীয় ঘরটাতে থাকবেন দুনিয়ার প্রথম শ্রেণীর সমস্ত পর্নস্টারেরা। তৃতীয় ঘরটাতে থাকবেন পৃথিবী বিখ্যাত সমস্ত কবিরা। আর চতুর্থ ঘরটাতে সেরকম নামকরা কেউ থাকবেন না, শুধু বেশ কিছু পাঁড় মাতালদের এনে ঢুকিয়ে দেওয়া হবে। সেই সব মাতাল আর নেশাড়ুদেরও অবশ্য ধরে আনা হয়েছে পৃথিবী বিখ্যাত সব শুঁড়িখানার লিস্ট ধরে ধরে। সবার জন্যই থাকছে এলাহি খাওয়া-দাওয়া আর সমস্ত আধুনিক সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা। শুধু শর্ত একটাই, ঘর ছেড়ে বেরোনো যাবেনা এই ক'দিন। ঐ ঘরের মধ্যেই থাকা-খাওয়া-ঘুম। আর দুটো ব্যাপার, তাদের যে গোপনে ছবি তোলা হচ্ছে আর কথা রেকর্ড করা হচ্ছে সেটা তারা জানবে না আর এক ঘরের লোক অন্য ঘরের লোকের সঙ্গে যোগাযোগও করতে পারবে না, এমনভাবে নেটওয়ার্ক ব্লকিং করা আছে।
অপারেশন আপসাইলন শুরু হয়ে গেল।
(বাকিটা জানতে পুরো গল্পটা পড়তে হবে)
পরিত্যক্ত গাড়ির রহস্য
'হ্যালো.. মিস্টার সৌরনীল বসু বলছেন?'
'হ্যাঁ, বলছি বলুন।'
'ওসি রাঘব সোম একটু কথা বলবেন, ধরুন। স্যার এই নিন।'
লাইনটা ট্রানস্ফার করতেই ওপাশে চেনা গলা।
'কে সৌরনীল? আমি রাঘবদা বলছি।'
'আরে, রাঘবদা বলুন। এত সকাল সকাল কি মনে করে?'
'একবার এয়ারপোর্ট থানায় এখনই আসতে পারবে? আর্জেন্ট।'
'আরে নিশ্চয়ই পারব। কিন্তু কেসটা কি?'
'একটা গাড়ি। মালিক বেপাত্তা। এসো, তারপর সব বলছি।'
ফোনটা কেটে যায়। সৌরনীলের রেডি হতে ঠিক পাঁচ মিনিট লাগে। চা-জলখাবারের পাটটা এখন তোলা থাক, পরে দেখা যাবে। রাঘবদার আর্জেন্ট ফোন মানে নিশ্চয়ই জটিল রহস্য, পুলিশ কুলকিনারা পাচ্ছে না। বেশকিছু এরকম কেসের সুরাহা করে সৌরনীল এখন পার্টটাইম গোয়েন্দা। পুলিশের কোন না কোন বড়কর্তার ফোন আসে, নানা কেসের ব্যাপারে হেল্প করার অনুরোধ নিয়ে।
সৌরনীল বেরিয়ে পড়ে, এখন দারুণ দারুণ সব এসি ইলেকট্রিক বাস হয়েছে। ভাড়াটা একটু বেশি হলেও আরামে যাওয়া যায়। সেরকমই একটা বাস পেয়ে গেল সৌরনীল। দমদম এয়ারপোর্টের দু'নম্বর গেটের সামনেই থানা। কাছেই পার্কিং লট আর একটু দূরেই এয়ারপোর্টের মূল দরজা। থানায় রাঘববাবু ওর জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। 'চলো,পার্কিং লটে চল,দেখাই তোমায়।' বলে রাঘববাবু উঠে পড়লেন। হেঁটেই ওরা চলে এল পার্কিং লটে। রাঘববাবু নো এন্ট্রি টেপে ঘেরা ছাই রঙের একটা গাড়ির কাছে নিয়ে এলেন সৌরনীলকে। আরো কয়েকজন পুলিশ অফিসার রয়েছেন।
'দেখো, এই গাড়িটা।'
'ওরে বাবা, এ তো হেব্বি ঘ্যামা গাড়ি দেখছি, বিএমডব্লু।'
'হ্যাঁ, গত দু'সপ্তাহ ধরে এখানেই পড়ে আছে গাড়িটা। কে যে ফেলে গেছে বোঝা যাচ্ছেনা।'
'দু'সপ্তাহ! এতদিনে আপনাদের টনক নড়ল?'
'আর বোলো না। ঢাকা থাকায়, প্রথমে কেউ খেয়াল করেনি। অনেকসময়ই কোন ইন্টারন্যাশনাল ফ্লাইটের পাইলটের গাড়ি এখানে থাকে। সে হয়তো লম্বা সফরে রয়েছে বা কোথাও আটকা পড়ে গেছে। এখানকার স্টাফেরা সেরকমই কিছু ভেবেছিল।'
'তারপর?'
'প্রথম সন্দেহটা হল কাল। বিকেলে হঠাৎ কালবৈশাখী ঝড়ে গাড়ির ঢাকাটা উড়ে গিয়ে নম্বরটা বেরিয়ে পড়ল বলে।'
'ও, সেই জন্য? 'R-E-V-E-N-G-E' লেখা এরকম নাম্বার প্লেট আবার হয় নাকি?'
'সেটাই তো রহস্য। এরকম নম্বর প্লেট দেখেই সবার সন্দেহ হয়। তখনই খেয়াল হয়, যে দু'সপ্তাহ ধরে গাড়িটা পড়ে আছে, কেউ নিতে আসেনি। ব্যাস, থানায় খবর যায়।'
'তো কোন খোঁজ পেলেন নাকি?'
'কি খোঁজ পাব বলো। এরকম নাম্বার প্লেট আদৌ হয় নাকি? তারপর কে কার ওপর রিভেঞ্জ নিচ্ছে, সেটাই তো মাথায় ঢুকছেনা। পিলে চমকে গেছে সবার। এই নামে তো কোন গাড়ি রেজিস্ট্রেশন হতেই পারে না। তাই তুমি নিজেই একটু দেখো।'
'বুঝলাম। কিন্তু একটা জিনিস খেয়াল করেছেন? গাড়িটার একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল এবং সেটা কোন সাধারণ অ্যাক্সিডেন্ট নয়।'
(এরপর রহস্যের ঘনঘটা জানতে গেলে পুরো গল্পটা পড়তে হবে)
ক্যানভাস
বর্ধমান শহরের কাঞ্চননগর গ্রাম। সেখানে রয়েছে দেবী দূর্গার এক বহু পুরোনো মন্দির, যা খুবই জাগ্রত বলে শোনা যায়। প্রতি বছর দূর্গাপুজোর সময় সেখানে আঠেরো দিন ধরে বিশাল ধুমধাম করে পুজো হয়। অনেক দূর দূরান্ত থেকে মানুষজন দেখতে আসে। শোনা যায় বর্ধমানরাজ চিত্রসেন নাকি মায়ের স্বপ্নাদেশ পেয়ে এই মন্দির সতেরোশো পঞ্চাশ সালে তৈরি করেছিলেন। এত প্রাচীন এই মন্দিরের অবস্থা এখন জরাজীর্ণ হলেও, ইদানিং কিছুটা যত্নের ছাপ পড়েছে। মন্দিরের ভেতরে রয়েছে দেবী দূর্গার অষ্টধাতুর মূর্তি। সারা বছর স্থানীয় পুরোহিত স্বপন ভট্টাচার্য্যই এই মন্দিরের দেখাশোনা, পুজোআচ্চা করেন।
দূর্গাপুজো এগিয়ে আসছে। গ্রামের পুজো কমিটির মিটিং ডাকা হল। কর্তাব্যক্তিরা সবাই হাজির, ঠাকুরমশাইকেও ডাকা হয়েছে। শ্যামল সামন্ত গ্রামের সবচেয়ে গণ্যমান্য লোক। যেমন তার আর্থিক প্রতিপত্তি, তেমনি লোকবল। প্রচুর জমিজমা ছাড়াও ট্রাক্টার, ডাম্পার পর্যন্ত রয়েছে, মাসে হেসেখেলে লাখখানেক টাকা রোজগার। মন্দিরের সামনের যে চাতালটায় বসে মিটিং হচ্ছে, সেটাও তিনিই বানিয়ে দিয়েছেন। মন্দিরের বাইরেটা ঘিরে গ্রিলের দরজা পর্যন্ত তারই পয়সায় করা। পুজো নিয়ে এখনও শেষ কথা তারই।
শ্যামলবাবু বললেন, 'এবার পুজোয় ভাবছি আঠেরো দিনই ভোগ রান্না হবে, গোটা গ্রামের লোক এসে প্রসাদ খেয়ে যাবে। কারো বাড়িতে আর রান্নাবান্না করার দরকার নেই। কি বলেন পঞ্চাননবাবু ?'
পঞ্চাননবাবু গ্রামের সবচেয়ে বয়োঃজ্যেষ্ঠ, খুবই সম্মানীয় মানুষ, স্কুলশিক্ষক ছিলেন। তিনি বললেন, 'সে তো ভালই। তবে অনেক খরচের ব্যাপার যে।গোটা গাঁয়ের লোকের প্রসাদের ব্যবস্থা করা কি চাট্টিখানি কথা? অত রান্নাই বা কে করবে?'
'ও আপনাকে কোন চিন্তা করতে হবে না। ঠাকুরমশাইকেই দায়িত্ব দিয়ে দিচ্ছি। ঠাকুরানি আছেন। ওনার সঙ্গে বাড়ির মেয়ে বউরাও হাত লাগাবে। ও সব ঠিক হয়ে যাবে। কি ঠাকুরমশাই?' শ্যামলবাবু ভটচাজবাবুর দিকে তাকান।
ভটচাযবাবু বললেন, 'হ্যাঁ, সে ঠিক আছে। কিন্তু যদি অনুমতি দেন, একটা কথা বলব?'
'বলে ফেলুন', শ্যামলবাবু বললেন।
'মানে, বলছিলাম কি, এতদিন ধরে তো পুজো। এতরকম জোগাড়-যন্তর। সব একা একা আর পেরে উঠি না, বয়স হচ্ছে তো। যদি আমার ছেলেটাকেও আমার সঙ্গে রাখি, তাহলে বড় ভাল হয়। ও তো বড় হয়েছে, আমাকে বেশ সাহায্য করতে পারবে।'
'ও,এই ব্যাপার! এ তো ভাল কথা। তা আপনার ছেলের নামটা কি যেন?'
'অভিষেক'
'বাঃ বাঃ। খুব ভাল। তাহলে তাই হবে। তাছাড়া রান্না আর অন্যান্য যোগাড় যন্ত্রের জন্য ক্লাবের ছেলেরা তো আছেই। কি বলেন?'
সবাই একপায়ে রাজি। শেষে সব ঠিকঠাক হয়ে গেল, পুজোর খরচের সিংহভাগই দেবেন শ্যামলবাবু। গণ্যমান্য বাকিরা মিলে বাকিটুকু। গাঁয়ের লোকের থেকে চাঁদাপত্র কোনদিনও নেওয়া হয়না এই পুজোয়।
বাড়ি গিয়ে ভটচাজবাবু খুশি হয়ে গিন্নিকে ডেকে বললেন, 'শুনছ,এবার বড় করে পুজো হচ্ছে গো! আঠেরো দিনই ভোগ রান্না হবে। গ্রামসুদ্ধ সবাই খাবে। আর আমাদের তিনজনকেই অনেক দায়িত্ব দিয়েছে গো।'
'তাই নাকি? এ তো ভালো কথা। তো আমাদের কি কি দায়িত্ব দিয়েছে শুনি?'
'পুরো রান্নার দায়িত্ব তোমার, বুঝলে?'
'হ্যাঁ! আমার! আমি একা এত পারব কি করে?'
'আরে চিন্তা করছ কেন? সব হয়ে যাবে তাছাড়া তো গাঁয়ের মেয়ে বউরাও তোমাকে সাহায্য করবে।'
' দেখি, যা কোমরে বেদনা! তা আর কি বলেছে শুনি?'
' অভিও এবার থেকে আমার সঙ্গে মায়ের পুজোর দায়িত্বে থাকবে। ওদের বলে ক'য়ে ঢুকিয়ে নিয়েছি। আর চিন্তা নেই ছেলেটার, কি বল?'
'তাই নাকি? তা বেশ করেছ।'
ভটচাজবাবু হেসে কিছু একটা বলতে যাবেন, তখনই অভিষেক ঘরের ভেতর থেকে পায়ে পায়ে বেরিয়ে আসে। পাশের গ্রামের স্কুলে ও ক্লাস নাইনে পড়ে। পড়াশোনাতে বরাবরই ভাল। কিন্তু বাপের মত পুজোআচ্চার ব্যাপারে ওর কোনদিনই মন নেই। এদিকে বাবা চান পুরুতগিরিটা ভাল করে ছেলে শিখে নিক, তাতে অন্তত রোজগারের একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে। কিন্তু অভিষেকের এসবে কোনো উৎসাহই নেই। ও খুব সুন্দর ছবি আঁকে,নিজেই শিখেছে। ও বড় হয়ে আর্টিস্ট হতে চায়, অনেক বড় আর্টিস্ট। যদিও ভীষণ লাজুক আর ঘরকুনো বলে, গাঁয়ের কেউই ওর এই বিশেষ গুণটা সম্পর্কে তেমন কিছু জানেই না।
অভিষেক বলল, 'কেন বাবা? আমাকে এসবের মধ্যে কেন ঢোকাচ্ছ? পুজোর পরেই তো আমার ফাইনাল পরীক্ষা, জান না?'
'তুই থাম দিকি। এত কষ্টে একটা মওকা বুঝে, তোর একটা হিল্লে করে দিলাম, আবার বড় বড় কথা বলছিস?', রেগে বলেন ভটচাজবাবু।
অভিষেক বলে, 'সারাদিন মন্দিরে থেকে, ওইসব আমি করতে পারব না। আমি পুজোআচ্ছা পারিনা।'
'পারিস না! ওগো, এ কি বলছে দেখ গো বামুনের ছেলে হয়ে! ছি, ছি, এ কথা বলতে পারলি? মার মন্দিরে পুজোর দায়িত্ব পেলি, কোথায় বর্তে যাবি, তা না।' স্তম্ভিত ভটচাজবাবু।
'আমার ওসব ভাল লাগে না বাবা।', অভিষেক আপ্রাণ বোঝাতে চেষ্টা করে।
'ভাল লাগে না! তো কি ভাল লাগে শুনি? ছবি আঁকতে, না? শুধু ছবি এঁকে তোর পেট চলবে নাকি?' চিৎকার করে ওঠেন ভটচাজবাবু।
বাবা-মার বকুনি খেয়ে, মন খারাপ করে, শেষে চুপচাপ নিজের ঘরে ঢুকে যায় অভিষেক। এই ঘরটাই ওর কাছে মন্দির। চারিদিকে ছড়ানো রং-তুলি, ইজেল, ড্রইংয়ের খাতা আর দেওয়াল ভর্তি ওর আঁকা অসাধারণ সব পেন্টিং। পড়াশোনার বাইরে এটাই ওর নেশা, প্রাণমন তাতেই ঢেলে দেয় ও। মনের আনন্দ বা দুঃখ সবেতেই ছবি আঁকাটাই ওর একমাত্র মুক্তির পথ। ওর আঁকার হাত দেখে, স্কুলের হেডস্যার শ্যামাপদবাবু ওকে কলকাতায় একটা বড় প্রতিযোগিতায় ছবি এঁকে পাঠাবার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। অর্গানাইজাররা ওই প্রতিযোগিতার প্রথম তিনজনকে বিশেষ এক্সিবিশনের সুযোগ করে দেবে আর কলকাতার আর্ট কলেজে আঁকা শেখারও ব্যবস্থা করে দেবে। সেই স্বপ্নেই এখন মশগুল অভিষেক। বড় ক্যানভাসটা কলকাতা থেকে হেডস্যারই আনিয়ে দিয়েছেন। খুব যত্নে সেটা তুলে রেখেছে অভিষেক, এবারে ওটাতেই ও আঁকা শুরু করবে। স্যার বলেছেন, 'আঁকার সময় শুধু চোখ আর হাত দিয়ে নয়, হৃদয় দিয়ে আঁকবি রে অভি, তাহলেই সে সৃষ্টি সার্থক হবে।'
ওদিকে পুজোর প্রস্তুতি প্রায় সারা। চারিদিকে সাজো সাজো রব। ছোট একটা প্যান্ডেল বাঁধা হয়েছে, খাবার জায়গায় আলাদা প্যান্ডেল, আর এক কোণে ভোগ রান্নার ব্যবস্থা। বাজার দোকানও গ্রামের ছেলেরা মিলে প্রায় করে ফেলেছে, মহানন্দ চারিদিকে। পঞ্চাননবাবু ঘুরে ফিরে সব তদারকি করছেন, কোথাও যেন কোন ফাঁকি না থেকে যায়। গ্রামের ছেলেবুড়ো কচিকাঁচারা সব এদিক-ওদিক উঁকিঝুঁকি মেরে দেখে যাচ্ছে, সবারই উৎসাহ আগ্রহের শেষ নেই। পঞ্চাননবাবু ছেলেছোকরাদের মাঝেমধ্যেই ধমকাচ্ছেন, 'কিরে বিশে, এখনো প্রদীপ, ধামা কিছুই এল না?', 'এই শ্যামা, জলের জগগুলো সব এভাবে রেখেছিস কেন?', এইসব চলছে। ঠাকুরমশাই ভটচাজবাবু ধুপ-ধুনো আর যজ্ঞের কাঠের হিসেব মিলিয়ে নিতে নিতে, হেসে বললেন, 'বুঝলে পঞ্চাদা, এবার দেখবে কেমন আড়ম্বরে পুজোটা করি। ছেলেটাও থাকবে সঙ্গে, অনেক সুবিধে হবে।' পঞ্চাননবাবু বলেন, 'হ্যাঁ তা তো করবেই। এত বড় করে পুজো হচ্ছে, কত লোক দেখতে আসবে কত দূর দূর থেকে। শুনলাম টিভি থেকেও নাকি ছবি তুলতে আসছে।'
সেদিন পঞ্চমী, রাত পোহালেই ষষ্ঠী। হঠাৎই ভোরবেলা কোথা থেকে হৈ হৈ, চিৎকার-চেঁচামেচি ভেসে এল। দাবানলের মত দুঃসংবাদটা ছড়িয়ে পড়ল চারিদিকে। মন্দিরের বাইরের লোহার গ্রিলের দরজা কাটা, মন্দিরের জানলা ভাঙ্গা। তড়িঘড়ি ঠাকুরমশাইকে খবর দেয়া হল। উনি মূল দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে দেখলেন, যা ভয় করা হয়েছিল ঠিক তাই। অষ্টধাতুর দূর্গামূর্তি আর লক্ষীমূর্তি দুটোই গায়েব।
সবার মাথায় বজ্রাঘাত হল। পুজোর আগের দিন বিগ্রহ চুরি গেল। হায় হায় করে উঠল সবাই। সব আনন্দ-উৎসব তো তাহলে বন্ধ! কি হবে এখন? সারা বছরের সব অপেক্ষা শেষে এক মুহূর্তে এইভাবে ধূলিসাৎ হয়ে গেল! শোকের ছায়া নেমে এল সারা গ্রামে, ঘরে ঘরে অরন্ধন। থানায় খবর দেওয়া হল, পুলিশ কুকুর এল। কিন্তু চারদিকে খোঁজাখুঁজি করেও কোন সূত্র পেল না কেউ। ভটচাজবাবু তো একেবারে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন। সবার মনে একটাই প্রশ্ন, পুলিশ যা করার করছে, কিন্তু পুজোর কি হবে? বিগ্রহ ছাড়া তো আর পুজো হয়না। কেউ তো আর কখনও ভাবতে পারেনি, যে এভাবে বিগ্রহ চুরি হয়ে যেতে পারে! এত প্রাচীন অষ্টধাতুর জাগ্রত দূর্গামূর্তি শেষে চোরাবাজারে বিক্রি হয়ে যাবে? আসলে প্রতি সন্ধেয় আরতির পর, মন্দিরে তালাচাবি দিয়ে ভটচাযবাবু বাড়ি চলে যান। তাছাড়া কোন নাইট গার্ডের ব্যবস্থা নেই, জায়গাটাও নির্জন। তাই দুষ্কৃতীদের কাজটা সহজ হয়েছে। সব শুনে মন্দিরে চলে এসেছে অভিষেকও, ওরও মনটা খারাপ। পুরুতগিরি ওর পছন্দ না হলেও, বাবার সঙ্গে প্রায়ই মন্দির আসে। পুজো, আরতি, হোম এসব দেখে। টুকটাক সাহায্যও করে পুজোর কাজে, সবাই যেমন করে। আসলে জন্ম থেকে এই মন্দির আর দেবী দূর্গার মূর্তি ওদের হৃদয়ে স্থান পেয়েছে, ওর ঘরেও টাঙানো আছে দূর্গামূর্তির একটা ছবি। সেই দূর্গাপুজো হবে না! তাও পুজোর ঠিক আগের দিন! ব্যাপারটা মেনে নিতে পারছিল না কেউই। সকলে ভিড় করে মন্দির চত্বরে দাঁড়িয়ে রয়েছে, গ্রামের মেয়ে-বৌরা কান্নাকাটি করছে, শিশু থেকে বুড়ো সবার চোখে জল।
অভিষেক বাবাকে জিজ্ঞেস করল, 'বাবা, পুজো কি তাহলে আর হবে না?'
ভটচাজ বাবু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,'নাঃ, আর তো কোন উপায় দেখছি না। সব শেষ হয়ে গেল রে অভি।', বলে চশমাটা খুলে রুমাল দিয়ে চোখ মুছতে লাগলেন। কথাগুলো সহ্য করতে পারল না অভিষেক, এক ছুটে বাড়ি গিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা দিয়ে দিল।
সারাদিন আলাপ-আলোচনাতেই কেটে গেল, কোন সুরাহা বেরোল না। পুলিশ বলছে, তদন্ত চলছে। কয়েকজন অত্যুৎসাহী থানায় গিয়েছিল জানতে, থানা থেকে ভাগিয়ে দিল সবাইকে। মন্দিরের চাতালে জড়ো হওয়া কর্তা-ব্যক্তিরা নীচু গলায় নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছিলেন। পঞ্চাননবাবু বললেন, 'আমি তো ভাবতেও পারছিনা, আমাদের গ্রামের মন্দিরে এভাবে চুরি হতে পারে! কে করতে পারে চুরিটা বলুন তো?' সকলে চুপ। শ্যামলবাবু বললেন, 'যা হবার সে তো হয়েছে, এবার পুজোর কি হবে সেটা বলুন দিকি।' পোস্টমাস্টার সুবিমলবাবু খুব পন্ডিত মানুষ, সারাদিন মোটা মোটা বই পড়েন। তিনি বললেন, 'পুলিশ তো কিছু করতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না। অন্তত রাতারাতি মূর্তি উদ্ধার করার কোন আশা দেখছি না।' শ্যামলবাবু ব্যাজার মুখে বললেন, 'তাহলে আর কি হবে বলুন। পুজোর মুখে এরকম ঘটনা, আমার তো কিছু মাথায় আসছেনা।' বয়স্ক কয়েকজন বললেন, 'এ বড় অশুভ ঘটনা। দূর্গামূর্তি এত জাগ্রত ছিল এই গ্রামে, এখন কোন অঘটন না ঘটে।' শেষে সকলে চিন্তিত মুখে, ভয়ে ভয়ে বাড়ি চলে গেল। সবার মনে উদ্বেগ, বুকে ঝড়।
পরের দিন ষষ্ঠী, সকালে আবার পুলিশের এনকোয়ারি। ভটচাজবাবুকে আবার তালা চাবি খুলে দিতে বললেন ওসি। তালা খুলে ভেতরে ঢুকতে, মূল দরজার সামনে এসে সবাই বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল। মন্দিরের দরজার গায়ে, হেলান দিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখা রয়েছে বিরাট ক্যানভাসে আঁকা অবিকল দূর্গামূর্তিটার একটা ছবি। কোন পার্থক্যই করা যাচ্ছে না আসলটার সঙ্গে। সবাই তো অবাক, কে আঁকল এত সুন্দর ছবি! আর এখানে রেখে গেলই বা কখন! ছবিটা মন্দিরের ভেতরে নিয়ে যাওয়া হল। কোথায় রাখবেন ঠিক করতে না পেরে, ভটচাজবাবু ছবিটাকে শূন্য বেদীটার উপরেই রেখে দিলেন। লোকজন ততক্ষণে খবর পেয়ে, ভেঙে পড়েছে মন্দিরে। আসল মূর্তি যতদিন না পাওয়া যাচ্ছে, তার অবিকল প্রতিমূর্তিকেই পুজো করা হোক, সকলের এটাই দাবি, অন্যরাও তাতে মত দেন। দুঃখের মধ্যেও আনন্দের হিড়িক পড়ে যায় গ্রামে, মুখে মুখে রটে যায় 'পুজো হবে'। দ্বিগুন উৎসাহে ঝাঁপিয়ে পড়ে ছেলে-বুড়ো সবাই।
শ্যামলবাবু হেসে বললেন, 'ওফ্ , অবশেষে একটা ব্যবস্থা হল। মূর্তির বেদীটা খালি দেখতে, বড্ড কষ্ট হচ্ছিল।' সুবিমলবাবুও সায় দিয়ে বললেন, "হ্যাঁ, যা বলেছেন। শেষ পর্যন্ত যে পুজো হবে, এই ঢের। কি যে মনটা খারাপ হয়েছিল কাল থেকে, কি বলব।' শ্যামলবাবু বললেন, 'সে আর বলতে? কাল মশাই, সারারাত ঘুমই এল না ঠিকমত। কি যে কষ্ট, বলে বোঝাতে পারব না।' পঞ্চাননবাবু বললেন, 'শুধু আপনার নয় শ্যামলবাবু, গোটা গাঁয়ে কারো বাড়িতে কাল হাঁড়ি চড়েনি। ছেলে-বুড়ো কারো চোখের জল বাঁধ মানে নি।''ঠিক বলেছ', সুবিমলবাবু বলে ওঠেন, 'তা স্বপন, পুজোতে কোন সমস্যা নেই তো ?' ভটচাযবাবু বলেন, 'এই ছবিতেই পুজো হবে, কোন দোষ নেই। যতদিন না আসল মূর্তি উদ্ধার হচ্ছে।' পঞ্চাননবাবু বললেন, 'কিন্তু এত সুন্দর এই ছবিটা আঁকলই বা কে? আর এখানে রেখে গেলই বা কখন, সেটাই তো বুঝতে পারছিনা।'
ভটচাজবাবু কোন উত্তর দিলেন না। সব লোকজনের ভীড়ের মধ্যে খুঁজতে খুঁজতে, এক কোণে পাড়ার ছেলেছোকরাদের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা অভিষেকের দিকে নজর পড়ে গেল। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকাতেই, অভিষেক ফিক করে হেসেই মুখটা লুকিয়ে নিল। সেই হাসি তখন ফুটে উঠল ভটচাজবাবুর মুখে, চোখে জল। ঢাক বেজে উঠল মন্দিরের চাতাল থেকে।
স্যুইট নং ১১
একটা গাড়ি পড়েে আছে এয়ারপোর্টের পার্কিং লটে।নেমপ্লেটে লেখা REVENGE.জানা গেল গাড়িটা ফিল্মস্টার অনিরুদ্ধ চৌধুরীর।কিন্তু উনি কোথায়, কেউ বলতে পারল না।গাড়িটার কি অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল?সৌরনীল নিজে নিশ্চিত
কি যে হল ফিল্মস্টার ভদ্রলোকের?
সৌরনীল বলল, 'গাড়িটা অ্যাক্সিডেন্টের পর কে এত দূরে চালিয়ে নিয়ে এল, এটাই আমার অদ্ভুত লাগছে।'
'কেন? নিশ্চয়ই ওনার বা ড্রাইভারের কারো তেমন চোট লাগেনি, তাই চালিয়ে নিয়ে চলে এসেছেন।'
'সে তো হতেই পারে, কিন্তু এয়ারব্যাগগুলো তো চুপসোনো অবস্থায় এখনো লেগে আছে। এত তাড়া, যে পাল্টে নেওয়ারও সময় হল না!'
'তাইতো! ঠিক বলেছ। এটা তো আমি খেয়াল করিনি।'
'কিন্তু সবার আগে জানা দরকার, অ্যাক্সিডেন্টটা কোথায় হয়েছিল।' সৌরনীল হেসে বলল।
হঠাৎ হন্তদন্ত হয়ে বেশ উদ্ভ্রান্ত অবস্থায় হাজির হল অনিরুদ্ধ চ্যাটার্জীর ড্রাইভার তিনকড়ি পাত্র। ওকে জেরা করতে শুরু করলেন রাঘববাবু।
'অনিরুদ্ধবাবু কোথায়?'
'আজ্ঞে, উনি তো শুটিং করছেন।'
'কোথায়? ফোনে তো পাওয়া যাচ্ছে না!'
'দার্জিলিঙে।'
'লাস্ট কবে ওনার সঙ্গে তোমার দেখা হয়েছে?'
'আজ্ঞে দিন পনেরো আগে,দার্জিলিঙেই।'
'তারপর? তুমিই তো ওনার গাড়ি চালাতে। ওকে রেখে দিয়েই চলে এলে?'
'সাহেব যে আমাকে ট্রেনে চলে যেতে বললেন।' ঢোঁক গিলে বলল তিনকড়ি।
'তা গাড়িটা কই?'
'সাহেবের কাছে।'
'তাই নাকি? তা কবে ফিরলে তুমি?'
'গত মাসের সাতাশ আঠাশ তারিখ হবে।'
' তারপর আর ওনার কোন খবর পেয়েছ? বা ফোনে কথা হয়েছে?'
'না স্যার।'
'তাহলে তুমি কি করে জানলে যে উনি ওখানে শুটিং করছেন?' কড়া ভাবে বলেন রাঘববাবু।
'আমি না স্যার। মেমসাহেবই তো বললেন, উনি শুটিংয়ের কাজে ব্যস্ত আছেন। তাই..'
'আর তুমি? তুমি কিছু জানতে না?' ড্রাইভারকে ধমকান রাঘববাবু।
'আমি তো রোজই হাজিরাতে আসি হুজুর। সাহেব নেই বলে কিছুক্ষণ বসে থাকি। তারপর মেমসাহেব বলেন চলে যেতে, তাই বাড়ি চলে যাই।'
'আর সাহেবের গাড়ি যে এয়ারপোর্টের পার্কিং লটে পড়ে আছে সেটা জানতে না?'
'সে কি? গাড়ি নিয়ে সাহেব কলকাতা চলে এসেছেন? আমি জানতাম না তো। মেমসাহেবও তো বলেননি।'
'ন্যাকামি হচ্ছে? ঠিক করে বল, তোমার সাহেব এখন কোথায়?'
'জানি না স্যার। বিশ্বাস করুন।'
'দার্জিলিঙে আর কে কে ছিল তোমাদের সঙ্গে?'
'আর কেউ না স্যার।'
'সাহেবের গাড়ির অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল, সেটা জান?'
'কই জানি না তো?' হাঁকপাঁক করে উঠল তিনকড়ি।
'গাড়ি এখানে আর তোমার সাহেব দার্জিলিঙে শুটিং করছেন! যতসব গাঁজাখুরি বলতে এসেছ?', ধমকে উঠলেন রাঘববাবু।
'বিশ্বাস করুন স্যার।আমি কিচ্ছু জানি না, সত্যি বলছি।'
'আচ্ছা তোমার সাহেবের সঙ্গে মেমসাহেবের ফোনে কথাবার্তা হয়?'
'জানি না স্যার। তবে মেমসাহেব বললেন, সাহেব দার্জিলিংয়েই রয়েছেন। আমিও সেটাই বিশ্বাস করলাম।'
'ও তাই বুঝি? তা মেমসাহেবকেই বা ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না কেন? উনি কোথায় আছেন?'
'আজ্ঞে বাড়িতেই আছেন। লেক গার্ডেন্সে।'
আবার মিসেস চ্যাটার্জিকে ফোন লাগানো হল, কিন্তু এবারেও সুইচড অফ। 'নাঃ, বেরোতেই হবে দেখছি', বলে রাঘববাবু তিনকড়িকে গাড়িতে উঠতে বললেন। সৌরনীলকেও সঙ্গে যেতে অনুরোধ করলেন, ফেরার পথে ওর বাড়িতে নামিয়ে দেবেন। দুজন পুলিশ কনস্টেবলকেও তিনকড়ির ওপর নজর রাখার জন্য নিয়ে নেওয়া হয়। যেতে যেতেই রাঘববাবু ফোন করলেন দার্জিলিং থানার ওসি তাপস অধিকারীকে। উনি কনফার্ম করলেন যে ওখানে কোন শুটিং হচ্ছে না, আর ফিল্মস্টার অনিরুদ্ধ চ্যাটার্জীও ওখানে নেই। কলকাতা ফিরে গেছেন বেশ কিছুদিন আগে। রাঘববাবুর কপালে ভাঁজটা গভীর হল। পাশে বসা সৌরনীলকেও কথাটা ফিসফিস করে বললেন। সৌরনীলও বেশ অবাক হল। অনিরুদ্ধ চ্যাটার্জী যদি গাড়ি নিয়ে কলকাতা ফিরলেনই, তাহলে নিজের বাড়ি গেলেন না কেন? তিনকড়িকেই বা আগেভাগে ট্রেনে করে ফেরত পাঠিয়ে দিলেন কেন! আর তারপর গাড়িটা এয়ারপোর্টের পার্কিং লটে রেখে, নিজে বেপাত্তাই বা হয়ে গেলেন কেন? ওনার কোন বিপদ আপদ হয়নি তো? অ্যাক্সিডেন্টের ধাক্কা তো সামলে নিয়েছিলেন বলেই মনে হচ্ছে। কোন চোট লাগার চিহ্ন পর্যন্ত নেই গাড়ির ভেতরে, এয়ারব্যাগও খুলেছিল ঠিকঠাক। তারপর এতটা চালিয়ে নিয়ে চলেও এলেন। তবু ঘটনাগুলোর কোন থই পাওয়া যাচ্ছে না।
আর একটা বিষয় ভাববার। মিসেস চ্যাটার্জীই বা এতদিন ধরে কেন মিথ্যে বলেছিলেন, যে উনি দার্জিলিঙে শুটিং করছেন? কেনই বা উনি গোপন রাখছিলেন অনিরুদ্ধবাবুর রহস্যজনক অন্তর্ধান? ব্যাপারটা বেশ গোলমেলে।
লেক গার্ডেন্সের অভিজাত ফ্ল্যাট বাড়িটায় পৌঁছে, সৌরনীল আর রাঘববাবু তড়িঘড়ি উঠে গেলেন সাততলায়। দরজা নক করতে কাজের একটা মেয়ে দরজা খুলল। পাশে আরও একটা কাজের মেয়ে দাঁড়িয়ে। পুলিশ দেখেই ওরা ভয়ে দরজা ছেড়ে দিল। 'মিসেস চ্যাটার্জী কোথায়?', রাঘববাবু বলতে মেয়েটা একটু ঘাবড়ে গিয়ে বলল, 'মেমসাহেব ঘুমোচ্ছেন, ওনার শরীর খারাপ।'
'কি হয়েছে?'
'জানি না।'
'ডাক্তার দেখিয়েছিলে?'
'হ্যাঁ', বলে ডেস্কের উপর থেকে একটা প্রেসক্রিপশন নিয়ে ওনার হাতে দেয়। রাঘববাবু দেখলেন, সাইকোলজিস্ট ডঃ অসীম রায়ের প্রেসক্রিপশন, কলকাতার নামজাদা ডাক্তার। দেখা গেল, কিছু ঘুমের ওষুধ লিখে গেছেন। আরও অন্য কিছু নার্ভের ওষুধ।
'ম্যাডাম দিনে কতক্ষণ ঘুমোন?'
'এই চোদ্দো পনেরো ঘন্টা মত।'
'এখন কখন শুয়েছেন?'
'এই তো জলখাবার খেয়ে, ওষুধ খেয়ে শুলেন। এক ঘন্টাও হয়নি।'
'ও ঠিক আছে ,পরে ওনাকে ইন্টারোগেট করব। তোরা দুজন এখানে বোস।',বলে সোফাটা দেখিয়ে দেন।
ওদিকে সৌরনীল ততক্ষণে সব ঘুরেফিরে দেখে নিচ্ছে। বিশাল সাজানো ফ্ল্যাট, সবদিকে বৈভবের ছাপ সুস্পষ্ট। দুজন কাজের লোকই সব সামলায় বোঝা গেল।
রাঘববাবু জিজ্ঞাসা করলেন, 'তোদের সাহেব কোথায় জানিস কিছু?'
দুজন কাজের লোক একে অপরের দিকে মুখ চাওয়াচাওয়ি করে বলল, 'না স্যার, আমরা কিছুই জানিনা। মেমসাহেব বললেন সাহেব দার্জিলিংয়ে শুটিং করছেন।'
'সাহেব ফোন করতেন?'
'জানিনা, মেম সাহেব জানেন।'
'দার্জিলিং কবে গেছিলেন সাহেব?'
'গত মাসে।'
'আর কে গেছিলেন সঙ্গে?'
'আর কেউ না, সাহেব একাই নিজের গাড়িতে গেছিলেন।'
'ড্রাইভার কে ছিল, তিনকড়ি?'
'হ্যাঁ', দুজনে মাথা নেড়ে কাঠের পুতুলের মত বলে যাচ্ছিল। বোঝাই যাচ্ছে, শেখানো বুলি আওড়াচ্ছে।
'সাহেব কবে ফিরলেন কলকাতা?', ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করলেন রাঘববাবু।
'আজ্ঞে সাহেব তো এখনো ফেরেননি।'
'তাই নাকি? চল, তোদের থানায় নিয়ে যাচ্ছি।'
মেয়ে দুটো কেঁদেকেটে বলল, 'এর বেশি কিছু জানি না স্যার। আমাদের ছেড়ে দিন।'
'তোদের ব্যবস্থা পরে করছি।', বলে রাঘববাবু বেরিয়ে এলেন ঘর থেকে। সৌরনীল বলল,'চলুন রাঘবদা, ঘরগুলো আরো একটু ভাল করে দেখি।' সৌরনীল ঘুরেফিরে সব দেখতে লাগল। পুরনো কাগজ, ম্যাগাজিন রাখার তাকগুলো ঘেঁটে কি সব দেখল। জুতোর তাক দেখল, ফ্রিজ খুলে দেখল, বইপত্র, নোটপ্যাড, ওষুধের স্ট্রিপ এমনকি অনিরুদ্ধবাবুর আলমারি পর্যন্ত ঘেঁটে দেখল। তারপর চলে গেল ম্যাডামের বেডরুমে। পর্দা সরিয়ে বাইরে থেকে দেখল, ম্যাডাম খাটের এককোনে চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছেন। ঘর অন্ধকার, ফুলস্পিডে এসি চলছে। সৌরনীল মেয়েদুটোকে বলল ঘরের আলো জ্বেলে, এসি নিভিয়ে দিতে আর দরজা জানালা সব খুলে দিতে। ঘরটা একটু আলোকিত হয়ে স্বাভাবিক হলে, সৌরনীল ওদের ম্যাডামকে ডাকতে বলল। অনেক কষ্টে ম্যাডামকে ডেকে তোলা গেল। অত্যন্ত সুন্দরী মহিলা, কিন্তু চোখের তলায় চিন্তায় কালি পড়েছে। ঘুম চোখে উঠে উনি মেয়েদুটোকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করতে লাগলেন। তারপর পুলিশ দেখে একটু থমকে গিয়ে জড়োসড়ো হয়ে বসে রইলেন। 'নমস্কার মিসেস চ্যাটার্জী, আমরা এয়ারপোর্ট থানা থেকে আসছি, মিস্টার অনিরুদ্ধ চ্যাটার্জীর নিখোঁজ হবার তদন্ত করতে। একটু ঘরে ঢুকতে পারি?', সৌরনীল বলল। মিসেস চ্যাটার্জীর মুখের পেশিগুলো একটু যেন কেঁপে উঠল, একটু ধাতস্থ হয়ে বসে উনি বললেন, 'অনিরুদ্ধ নিখোঁজ কে বলেছে আপনাদের?' 'তাহলে উনি কোথায়? আপনি বলুন।', সৌরনীল বলল। 'উনি তো শুটিংয়ের কাজে দার্জিলিংয়ে আছেন', আবার সেই ভাঙা রেকর্ড বাজালেন ম্যাডাম।
'আর কত মিথ্যে বলবেন? আমরা খবর নিয়ে জেনেছি, উনি দার্জিলিং ছেড়ে গত মাসেই কলকাতা চলে এসেছেন। আপনি জানেন না?'
ভদ্রমহিলা একটু যেন চমকে উঠলেন। বললেন, 'না তো! আমাকে যে ফোনে বলল, ও দার্জিলিংয়েই আছে।'
'কবে কথা হয়েছিল আপনার সঙ্গে?'
'রোজই তো হয়। গতকালও হয়েছিল।'
'কই, দেখি আপনার ফোনটা।'
ম্যাডাম বালিশের পাশে থেকে বাধ্য হয়ে মোবাইলটা বের করে অন করে, লক খুলে, ওদের হাতে দিলেন।
'এ কি? এ তো দেখছি গত মাসের কুড়ি তারিখের পর থেকে কোন কল রেকর্ডসই নেই। কেন জানতে পারি?'
'আমি জানি না। আমার কিছু মনে থাকে না।', ম্যাডাম দিশাহারা হয়ে হিস্টিরিয়া গ্রস্থের মতো আচরণ করতে থাকলেন।
'তাহলে বললেন যে, উনি গতকালই ফোন করেছেন?', সৌরনীল ছাড়বার পাত্র নয়।
'আমি কিছু জানিনা, আমার শরীর খারাপ। আমাকে ছেড়ে দিন।', ভদ্রমহিলা পাগলের মত করতে লাগলেন। সৌরনীল এসব অভিনয় অনেক দেখেছে।বলল, 'আপনি ডাক্তার দেখিয়েছেন?'
'হ্যাঁ, ওনার ওষুধ খেয়েই তো ঘুমাচ্ছিলাম।'
'মিস্টার চ্যাটার্জী দার্জিলিং থেকে কবে কলকাতা ফিরলেন?'
'আমি জানি না।', এবার রেগে উঠে বললেন মহিলা। সৌরনীল বুঝল এ বড় কঠিন ঠাঁই। সঙ্গে মহিলা পুলিশও নেই, জোর করার উপায় নেই। কোনো প্রমাণও নেই ওনার বিরুদ্ধে, খালি একটা সন্দেহ। তার ওপর এরকম সাইকোলজিক্যাল পেশেন্ট। যখন-তখন পাগল সাজবে। বড় সেয়ানা মহিলা। এখন আর কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করে কোন লাভ হবেনা। তবু বলল, 'মিঃ চ্যাটার্জীর আর কোন নাম্বার আছে?'
'না'
'ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ করতেন?'
'ফেসবুক প্রোফাইল আছে একটা', গম্ভীরভাবে বললেন ভদ্রমহিলা।
'উনি যে এখন কলকাতায়, তা জানেন?'
'না তো। ওর গাড়ি কোথায়, ও কোথায়, আমি কিচ্ছু জানি না। বললাম তো, আমার কিছুই মনে থাকেনা। ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমাই। আমাকে ছেড়ে দিন প্লিজ।', শেষ কথাগুলো এত মিষ্টি করে বললেন ভদ্রমহিলা, যে সৌরনীল আর কোন কিছুই বলতে পারল না। কিন্তু নিজের থেকে উনি গাড়ির কথা তুললেন কেন! সন্দেহটা নিয়েই বাধ্য হয়ে, ওরা উঠে ঘরের বাইরে বেরিয়ে এল। সৌরনীল রাঘববাবুকে বাইরে এসে চুপিচুপি বলল, 'রাঘবদা, আপনি এদিকটা দেখুন। আমি কালই একবার দার্জিলিং রওনা হয়ে যাই। আমার মনে হচ্ছে রহস্যের সূত্র ওখানেই রয়েছে। ওখানকার লোকাল থানায় একটু বলে দেবেন। অ্যাক্সিডেন্টের স্পটটাও দেখতে হবে। তাছাড়া উনি কোথায় কোথায় গেছিলেন, কি করেছিলেন, সাতাশে মার্চ তিনকড়িকে ট্রেনে চাপিয়ে দিয়ে তারপর কি করলেন, সব আমাকে পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসন্ধান করতে হবে। না হলে অনিরুদ্ধ চ্যাটার্জীর অন্তর্ধান রহস্যের কিনারা কিছুতেই করা যাবে না। কেসটার আগাপাশতলা কিচ্ছু বোঝা যাচ্ছে না।'
'ঠিক বলেছ সৌরনীল, বিদঘুটে কেস। তাহলে তাই কর, আমি ওখানকার ওসি তাপসদাকে সব বলে দিচ্ছি, কোন অসুবিধা হবে না। তুমি কালই চলে যাও।'
'কিন্তু এখানকার ব্যাপারটা? আমার মনে হচ্ছে ড্রাইভার তিনকড়ি আর কাজের মেয়েদুটো কেউ সত্যি কথা বলছে না। ওদের থানায় ডেকে আরো ইন্টারোগেট করতে থাকুন, নজর রাখুন। পালাতে যেন না পারে।'
'সে নয় হল। কিন্তু তুমি কি করে বুঝলে যে ওরা মিথ্যে বলছে?'
'পুরনো কাগজ রাখার তাকটা ভাল করে দেখে বুঝলাম, মার্চের কুড়ি থেকে সাতাশ কেউ এ বাড়িতে কাগজগুলো খুলেও দেখেনি। অনিরুদ্ধ চ্যাটার্জী না হয় ছিলেন না, কিন্তু মিসেস চ্যাটার্জী সে সময় কি করছিলেন, যে কাগজ পড়ারও সময় পাননি? অথচ তার পরের কাগজ গুলো সব পড়া বোঝা যাচ্ছে। আমার মনে হয় উনিও একই সঙ্গে দার্জিলিং গেছিলেন।আজ আমাদের দেখে ভালই অ্যাক্টিং করলেন।'
'তাহলে মিসেস চ্যাটার্জীকে আরেকবার বাজিয়ে দেখলেই হয়।'
'এখন না। এখন ওনাকে বিরক্ত করার দরকার নেই, তবে নজরে রাখুন। আর ওর মোবাইলের কল রেকর্ডস আর টাওয়ার লোকেশনগুলো আমাকে দেবেন।', বলে সৌরনীল বেরিয়ে লিফটের দিকে এগিয়ে গেল।
(এরপর রহস্যের ঘনঘটা জানতে পুরো গল্পটা পড়তে হবে)
2 August 2020
তুষাই
শীতের বিকেল, তখনও বেলা পড়ে আসেনি। বাড়ির বাগানে, তৈরী করা রকে বসেছিলুম। ছেলে আর মেয়ে দু’জনে এক ধারে ব্যাডমিন্টন খেলছে, গাছে গাছে ফুল ফুটেছে, চারদিকে বেশ আরামদায়ক পরিবেশ। সেই সবই দেখছিলুম। ভাবলুম, একটু চা হলে মন্দ হয় না। উঠতে যাব, তখনই একটা সাদা সেডান অ্যাপক্যাব এসে বাড়ির সামনে ঘ্যাঁচ করে দাঁড়াল।
কে এল ? গাড়ি থেকে প্রথমেই যে কমবয়সী ছেলেটি নামল, তাকে চিনি না।বাগানের গেটের কাছে এসে সে বলল, ’আমরা কলকাতা থেকে আসছি।এটা কি আপনার কোয়ার্টার?’ স্টিল প্ল্যান্টের এই কোয়ার্টারে, আমি অনেকদিন আছি।অনেকটা জমিতে একতলা বাংলোটা, সামনে পেছনে বাগান, প্রচুর বড় বড় গাছ।
যাই হোক, ছেলেটি কি কাজে আমার কাছে এসেছে,বোঝা গেল না। বললুম, ‘হ্যাঁ, বলুন?’ ছেলেটি সোজা গাড়ির পিছনের দরজাটা খুলে দিতেই, এক সাদা শাড়ি পরা পক্বকেশ বৃদ্ধা গাড়ি থেকে নেমে এলেন। দু’জনে আমার বাগানের দিকে উৎসুক ভাবে চেয়ে রইলেন। আমি তো তাদের কাউকেই চিনতে পারলুম না, অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলুম, ‘কাকে চাইছেন বলুন?’ ছেলেটি একটু লজ্জিত ভাবে বলল, ‘কিছু মনে করবেন না, আমার মা আপনাদের ঐ আমগাছটাকে একটু দেখবেন।‘ বৃদ্ধা ততক্ষনে গেটের কাছে এগিয়ে এসেছেন।আমি বিস্মিতভাবে গেটটা খুলে দাঁড়ালাম।
মহেঞ্জোদড়োর আয়না
(১)
-কি রে কোকো মন খারাপ করে বসে আছিস কেন?
'আরে বড় মামা তুমি? কখন এলে?', তড়াক করে লাফিয়ে ওঠে কোকো।
-কালই ফিরলাম চীন থেকে। কিন্তু তুই তো বললি না।মন খারাপ কেন রে?
- আর বোলো না, বাবা-মা খুব এক চোট বকল সকালবেলায়। অথচ আমার দোষই নয়।
- কেন রে কি করেছিলি?
- আরে বাবা দাড়ি কামানোর আয়নাটা, বাথরুমে এমন ভাবে ঝুলিয়ে রেখে চলে গেছে, কি বলব। আমি ঘুম চোখে দাঁত মাজতে যেতে, কিভাবে যেন হাত লেগে পড়ে ভেঙে গেল।
- ও এই ব্যাপার! সক্কাল সক্কাল আয়না ভেঙেছিস! এঃ হে , বাজে ব্যাপার করে ফেলেছিস।
- বাজে ব্যাপার কেন বলছ বড়মামা? মাত্র শ’খানেক টাকা তো দাম!
- আরে সেজন্য নয় রে। জানিস না, রোমে একটা পুরোনো কুসংস্কার আছে। আয়না ভাঙলে নাকি তার সাত বছরের জন্য ব্যাডলাক আসবে আর তা থেকে মুক্তি পেতে গেলে, সবকটা ভাঙা টুকরো কুড়িয়ে জড়ো করে, চাঁদের আলোয় উঁচু কোন গাছের নীচে পুঁতে দিতে হবে।
- তাই নাকি? কিন্তু মা যে সব টুকরোগুলো ঝাঁট দিয়ে ডাস্টবিনে ফেলে দিল, কি হবে এখন?
- আরে ধুর, তুইও না।
হা হা করে হেসে ফেলেন দীপাঞ্জনবাবু । ইতিহাসের প্রফেসর হিসেবে প্রেসিডেন্সি থেকে ভলান্টারি রিটায়ার ক'রে, যিনি এখন দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়ান নানা রিসার্চ ওয়ার্কে। আর্কিওলজি ওর নেশা। বিয়ে থা করেননি ,ঝাড়া হাত পা মানুষ। পঁচ্চান্ন বছরের এক তরতাজা যুবক যেন।
-সেরকম ভয় পেলে তো বাড়ি থেকে আয়নার পাটই চুকিয়ে দিতে হয় রে। সেকালে রোমান বড়লোকরা যেমন করত । বাড়িতে পুল বানিয়ে তার স্বচ্ছ জলে মুখ দেখত, বাড়িতে ভয়ে আয়নাই রাখত না । ওদের বিশ্বাস ছিল আয়নায় যে মুখ দেখা যায়, সেটা আসলে নিজের আত্মারই অংশ। তাই আয়না ভাঙলে আত্মারও ক্ষতি হয়। এমনকি কোন আয়না যদি আপনি আপনি পড়ে ভেঙে যায়, তাহলে সে বাড়িতে কারো মৃত্যু অবধারিত।
-ওরে বাবা, এত জানতাম না তো!
- আরে এসব তো কুসংস্কার।ছাড়। যা বুলিকে গিয়ে বলে আয় তো চা দিতে। সকালে প্লেনের চা টা ঠিক জুত হয়নি।
কোকো ক্লাস ইলেভেনে পড়ে , সাইন্স। স্কুলে বরাবরই ওর ভাল রেজাল্ট ছিল, এখন কলেজেও তার কোন ছেদ পড়েনি। পড়াশোনার চাপ ভীষণ, কলেজ থেকে ফিরে আবার টিউশন। শুধু সন্ধ্যেবেলায় ঘণ্টাখানেকের ছাড়, নিজের মোবাইলে ঐ সময় গেম খেলাটা ওর একটা নেশা। তবে বাবা-মা বলে দিয়েছেন ঘণ্টাখানেকের বেশি যেন ও গেম না খেলে, কিন্তু শুনলে তো!
- বড়মামা, তার মানে আয়না ভাঙলে রোমানরা ভাবত, আত্মারও আঘাত লাগে। কিন্তু আত্মা জুড়ত কি করে?
-ভাল বলেছিস। 'আত্মা জোড়া'। সেজন্যই তো প্রাচীন ভারতবর্ষের আয়নায় এসবের বালাই ছিল না রে।
- কিরকম?
-সিন্ধু সভ্যতায়, মহেঞ্জোদড়ো আর হরপ্পাতে আজ থেকে সাড়ে চার হাজার বছর আগে, ব্রোঞ্জ বা তামার তৈরী ছোট ছোট আয়না ব্যবহার হত, বুঝলি? হাত থেকে পড়ে ভাঙ্গার কোন ভয় নেই, কি বলিস?
- তাই নাকি, মেটালের আয়না?
-হ্যাঁ, তখন তো আর এদেশে কাঁচ আবিষ্কার হয়নি। কাঁচ তো আবিষ্কার হল তারও এক হাজার বছর পরে,মিশরে।
-হ্যা,সেটা আমিও পড়েছি।আর কাঁচের আয়না কবে আবিষ্কার হল গো বড়মামা?
-সে তো অনেক পরে, আঠেরোশো পঁয়ত্রিশ সালে। তার আগে বল, অঙ্ক করতে করতে, পাবজি গেমটা খোলা ছিল কেন রে তোর মোবাইলে? ভাবছিস কিছু বুঝতে পারব না, বড়মামার চোখকে ফাঁকি দিতে পারবি ভেবেছিস?
মিটমিটিয়ে হাসতে লাগলেন বড় মামা। মুচকি হেসে কোকো বলল, ' ঠিক ধরে ফেললে! তুমি কি, গোয়েন্দা নাকি গো ? পাঁপড় ভাজা খাবে তো, মাকে বলে এসেছি।'
বছরে মাত্র দু'বার কয়েক দিনের জন্য পাওয়া যায় বড়মামাকে, বাকি সময়টা দেশ-বিদেশ ঘুরতেই চলে যায়। বড়মামা এলে এ বাড়িতে সবচেয়ে খুশি হয় কোকো।আর মা তো 'দীপু' বলতে অজ্ঞান । কোকো যে পড়াশোনায় বরাবর এত ভাল, সেটা বড়মামাও জানেন। তাই ওকে এত ভালোবাসেন আর নতুন নতুন রিসার্চ ওয়ার্কের কথাও হোয়াটসঅ্যাপে প্রায়ই পাঠান। কোকো অধীর আগ্রহে, সারা বছর ধরে অপেক্ষা করে থাকে, বড়মামা কবে আসবেন। বড়মামা এলে দিনগুলো যেন দ্রুত শেষ হয়ে যায়, তাই কোকো ওনাকে কাছ ছাড়া করতেই চায় না।
একটু বাদেই মা চা নিয়ে এল, সঙ্গে পাঁপড়ভাজা আর কুচো নিমকি।
- হ্যাঁ রে দীপু, এবার ক'দিন থাকবি ইন্ডিয়াতে? একবারও ফোন করলি না তো আসার আগে!
-আরে, জানিয়ে আসলে কি এভাবে সারপ্রাইজ দেওয়া যেত? কোকো কেমন চমকে উঠল আমায় দেখে, সেটাই তো মজা।
- নে , এবার মামা ভাগ্নে হৈচৈ করে বেড়া। এবারে মাসখানেক থেকে যা না রে দীপু। ছেলেটা তো তোকে বেশি পায় না, আমাদেরও কত ভাল লাগে তুই এলে, জানিস তো। এবারে আর আগের বারের মত হুট করে পালাবি না কিন্তু।
- না রে পালাতে তো হবেই। এবার যাব ন্যাজকা লাইন নিয়ে রিসার্চ করতে।
-সেটা আবার কি রে?
'আমি জানি, পেরুর মরুভূমিতে বিশাল বিশাল সব জ্যামিতিক নকশা আর জীবজন্তুর ছবি আঁকা, যা শুধু আকাশ থেকেই বোঝা যায়।' কোকো চেঁচিয়ে বলে। মা চোখ গোল গোল করে তাকিয়ে বলে, 'নাও এবার তোমার তো হয়ে গেল, বড় মামা এসে গেছে। পড়াশোনার বারোটা বাজল বলে। পরে একবার আমার ঘরে আসিস রে দীপু, কথা আছে।', বলে মা চলে গেল।
(২)
বড় মামার সঙ্গে কোকোর মনের এত মিল, যে দুজনে প্রায় বন্ধুই হয়ে গেছে। তাছাড়া রহস্য ও গোয়েন্দা গল্পের প্রতি কোকোর দুর্নিবার আকর্ষণও এর একটা কারণ। বড়মামার কাছ থেকে পাওয়া যায় সত্যিকারের রহস্যের সন্ধান। ইতিহাস,বিজ্ঞান আরো নানা বিষয়ে এত জ্ঞান, আর এত সহজে সব গল্পের মাধ্যমে বুঝিয়ে দেন ।আর সেই সব গল্প শেষ হবার নয় ।
এই তো গতবার পুজোর সময়ে, বড়মামার সঙ্গে বাগবাজার সার্বজনীনের দুর্গাপুজো দেখতে গিয়ে বড়মামা বলল, 'বলতো, এই জায়গাটার নাম বাগবাজার কেন?'
-কেন আবার বাঘটাঘ বেরোত নিশ্চয়ই আগে।
-ধুর বোকা, এই যে এইখানে, যেখানে পুজোটা হচ্ছে, সেখানে আগে কি ছিল জানিস ? ক্যাপ্টেন চার্লস পেরিন সাহেবের বাগান। তিনি ছিলেন জাহাজ বিষয়ে পণ্ডিত। ওনার নিজেরও অবশ্য একটা জাহাজ ছিল, সেপটর বলে। সেই জাহাজে ক'রে পেরিন সাহেব নানা দেশে বাণিজ্য করে বেড়াতেন। তো পেরিন সাহেবের এই বাগান ছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর সাহেবদের শখের সান্ধ্য বেড়াবার জায়গা।
-তারপর? বাঘ কোথা থেকে এল?
-আবার বাঘ ? মারব এক গাঁট্টা । তো আর্থিক দুরবস্থার জন্য সতেরোশো বাহান্ন সালে সাহেবের বাগান নিলামে ওঠে , কলকাতার ম্যাজিস্ট্রেট হলওয়েল মাত্র আড়াই হাজার টাকায় কিনে নিলেন বাগানটা। কিন্তু তিনিও রাখতে পারলেন না বেশিদিন। সতেরোশো পঞ্চান্ন সালে ফোর্ট উইলিয়ামের সেনাধ্যক্ষ ফ্রেডরিক স্কট পঁচিশ হাজার টাকায় কিনে নিলেন বাগানটা। তারপর সেখানে একটা গান পাউডারের কারখানা চালু করলেন। এই যে বাগবাজার স্ট্রীট দিয়ে এলি, এর নাম তখন কি ছিল জানিস? 'গান পাউডার ফ্যাক্টরি রোড'। সিরাজের কলকাতা আক্রমণের সময় এই বাগানে বসানো হয়েছিল কামান, নবাবের আক্রমণ প্রতিহত করতে বেশকিছু সৈন্যও ঘাঁটি গেড়েছিল এখানে । তাদের জন্যই এখানে বসল বাজার ।আর বাগান বা বাগ থেকে এই বাজারটার নাম হয়েছিল বাগবাজার। বুঝলি ব্যাটা?
' এইবারে বুঝলাম', দেঁতো হাসি হেসে বলল কোকো।
-এবার বাগবাজারের আসলি জায়গায় যাব। রসগোল্লার স্রষ্টা নবীন ময়রার বাড়িও এখানে ছিল, সেটা জানতিস ?
-না তো! নবীন চন্দ্র দাসের রসগোল্লা ?
-তা নয় তো আর কি? চল চল, খিদে পেয়েছে।
এই হল বড় মামা। ঘুরতে ফিরতে কত কি গল্পচ্ছলে বলে চলেন,নতুন নতুন কত কি জানা হয়ে যায় । দোষের মধ্যে, বড় মামা মাঝে মধ্যে বিড়ি খান ।বলেন, 'বিড়ির ওপর কিছু নেই, বুঝলি? সারা পৃথিবী ঘুরলাম, কত সিগারেট- চুরুট-পাইপ- হুঁকো টানলাম, কিন্তু বিড়ি ইজ দ্যা বেস্ট।যা তো একটা দেশলাই নিয়ে আয় দেখি।' কোকো ছুটে রান্নাঘর থেকে দেশলাই এনে দিল। বড়মামা বললেন, 'এই যে দেশলাই, এর আবিষ্কারক কে জানিস?' কোকো যথারীতি চুপ।
-জন ওয়াকার। ভদ্রলোক সেই যুগে কত বড় মনের মানুষ ছিলেন, ভাব। জনসাধারণের খুব কাজে লাগবে, সেই বিশ্বাসে উনি দেশলাইয়ের কোন পেটেন্ট পর্যন্ত নেননি। অবশ্য নিলেও ভুবনমোহন নিয়োগীর কিছু যায় আসত না।
-ভুবনমোহন নিয়োগী আবার কে গো? জন ওয়াকারের রাইভাল?
-না রে! সে ছিল কলকাতার এক বনেদি বাবু। দশ টাকার নোট জ্বালিয়ে সিগারেট ধরাত। এক ধুতি দু'দিন পড়ত না । তাও আবার পাড় ছিঁড়ে পড়ত, যাতে কোমরে না লাগে। রোজ সারা বাড়ি, আদ্যোপান্ত গোলাপ জল দিয়ে ধোয়াতো।
কোকো হাঁ করে চেয়ে থাকে।
(৩)
বড় মামা মৌজ করে পাঁপড়ভাজা আর কুচো নিমকি চিবোচ্ছিলেন। মা ডাক দিয়ে গেছেন পার্সোনাল টকের জন্য। কোকো ঠিক করল বড়মামা নীচে যাবার আগেই, জিনিসটা ক্লিয়ার করে নিতে হবে। বড়মামার পাশে বসে ও বলল, 'তুমি যে গতবার চিলি না কোথায়, কিসব এক্সক্যাভেশনের কাজে যাবে বলেছিলে, সেটার কি হল, বললে না তো?'
-চিলি নয় তো! তার থেকে একটু দূরে, ইস্টার আইল্যান্ডে। মোয়াইগুলো তো ওখানেই খুঁড়ে বের করা হচ্ছিল।
-মোয়াই? সেটা আবার কি?
-দাঁড়া দাঁড়া, একদিনেই সব শুনতে চাইছিস?
বলতেই হঠাৎ লোডশেডিং হয়ে গেল।কোকো বলে উঠল, 'যাঃ,গেল।ব্যাস, নাও এবার।পাক্কা দু'ঘন্টা।আজকাল একটা ফেজ খুব যাচ্ছে,সকালের দিকে।'
-কি আর করবি,বল। টেসলার বাক্সগুলো পাওয়া গেলে অবশ্য এরকম আর কারেন্ট যেত না রে।
গল্পের গন্ধে কোকো চেপে ধরল, 'কেন গো, টেসলার সঙ্গে লোডশেডিং-এর কি সম্পর্ক? বল না।'
-জানিস না? ওয়্যারলেস বিদ্যুৎ আবিষ্কার করেছিল যে। কিন্তু ফান্ডের অভাবে কমপ্লিট করতে পারল না। তার ওপর,উনি মারা যাবার পরে ওর রিসার্চ ওয়ার্কের কুড়িটা বাক্সও কে ঝেড়ে দেয় । সেখানেই সম্ভবত ছিল তার ছাড়া বিদ্যুৎ পাঠানোর উপায়। আর যদি সেটা সম্ভব হত, সারা পৃথিবীর যেকোন জায়গা থেকে যেকোনো জায়গায় আজ বিদ্যুৎ পাঠাতে কোন অসুবিধেই হত না ।
'আর লোডশেডিংও হত না।', কোকো চেঁচিয়ে বলে ওঠে।বড় মামা হেসে বললেন, 'ছাড় ওসব। এবারে দিলখুশার চিকেন কবিরাজিটা কিন্তু খেতেই হবে, আজ বিকেলেই যাব। আর একটা গোপন ব্যাপার আছে, ওখানেই সব বলব। তার আগে বুলি কি বলছে শুনে আসি।'
বড়মামা উঠে পড়লেন। অগত্যা আবার পড়ার বই নিয়ে বসে পড়ল কোকো। বিকেলের অ্যাডভেঞ্চারে যেতে বাবা-মার পারমিশন পেতে গেলে, টাস্কগুলো সব শেষ করে রাখা দরকার। তছাড়া কলেজ যাবারও সময় হয়ে এল।
(৪)
দিলখুশার চিকেন কবিরাজিটা কাঁটা চামচ দিয়ে, পাক্কা সাহেবি কায়দায় কেটে, এক টুকরো মুখে পুরেই, বড় মামা 'হু হু' করে উঠলেন।
- কি হল গো, খুব গরম নাকি?
-আরে না না, গরম হবে কেন? এতদিন চীনেদের শুধু চাউমিন আর আধকাঁচা মাংস খেয়ে খেয়ে ,পেটে একেবারে চড়া পড়ে গেছিল রে। কতদিন যে এরকম খাইনি। আহা, কি টেস্ট ! অবশ্য দুপুরে তোর মার হাতের , মাছের মাথা দিয়ে পুঁইশাক, আলু-পোস্ত আর কচি পাঁঠার ঝোলটা ভালই খেলাম, বেড়ে বানিয়েছিল। তবে দিলখুশার চিকেন কবিরাজির জন্য চীন থেকে চলে এসে ঠিকই করেছি,কি বল। মনটা একেবারে হু হু করছিল।
-কি যে বল চীনের কাজ শেষ হয়েছে তো? তোমার কি যেন প্রোজেক্ট ছিল ওখানে? আলোর প্রতিবিম্ব নিয়ে, লিখেছিলে না?
- হ্যাঁ রে বাবা। তার আগে দিলখুশার এই বিখ্যাত আয়নাটা ভাল করে দেখ, দেওয়াল জোড়া। খাঁটি বেলজিয়াম গ্লাস, দুশো বছরের পুরোনো। এখন তো বিকেল সাড়ে চারটে বাজে।দেখ, আয়নার ওপর সূর্যের আলোটা প'ড়ে, রিফ্লেক্ট করে ওদিকের দেওয়ালে কিভাবে পড়েছে। দেখতে পাচ্ছিস?
- হ্যাঁ, পড়ন্ত রোদ আয়নায় ছিটকে দেওয়ালে চৌকো চৌকো শেপ তৈরি করেছে। এতে অদ্ভুতের কি আছে?
- আছে রে আছে।চীনের 'টু কুয়ান চিং' আয়না না দেখলে,তুই সেটা বুঝতে পারবি না।
- কিরকম?
- শোন তাহলে, তুই যে আজ সকালে আয়নাটা ভাঙবি, সেটা আমি আগেই জানতাম।
- মানে?
- মানে আমি যে মুহূর্তে ইন্ডিয়ায় পা রাখলাম, সেই সময় থেকেই টু কুয়ান চিং- এর অভিশাপ আমাকে ফলো করে তোদের বাড়ি অব্দি চলে এসেছে ।
-কি বলছ, কিছুই বুঝতে পারছি না। টু কুয়ান চিং-ই বা কি ?
-আরে ওই জন্যই তো চীনে যাওয়া। প্রাচীন জাদু আয়নার খবরটা গতবছরেই পেয়েছিলাম আমেরিকান অ্যান্টিকুইটির জার্নালে। আয়নাটায় নাকি একটা অদ্ভুত রহস্যময় ঘটনা ঘটে, ঠিক বিকেল চারটের সময় ।আয়নায় সূর্যের আলো প'ড়ে রিফ্লেক্ট করে উল্টোদিকের একটা দেওয়ালে পড়ে, আর সেখানে রহস্যময় কি সব লেখা ফুটে ওঠে। যেটা আজ অব্দি কেউ প'ড়ে উঠতে পারেনি। ওরা ভেবেছিল আয়নার ভেতরের কোন নকশা ফুটে উঠছে, কিন্তু সেটা নয়। ওটা যে শুদ্ধ দেবনাগরী লিপি, সেটা আমি না গেলে ওরা জানতেই পারত না।
- তুমি বের করলে? বলো না কি লেখা ছিল ওখানে?
- বলছি বলছি, আরেকটা কাটলেট খাবি নাকি?
-না না ,আর পারব না, পেট আইঢাই করছে।
- এই হল তোদের নিয়ে মুশকিল। আমার তো বাবা তোর মত অত পুঁচকে পেট নয়। তিন মাস ঠিকমত খেতে পারিনি রে। দিল্লি এয়ারপোর্টে নেমে ভাবলাম, বেরিয়ে গিয়ে, সি আর পার্কের বিরিয়ানীটা খেয়ে আসি। কিন্তু সে আর হল না, আর তাছাড়া অত সকালে বিরিয়ানীই বা কে বানাবে! কপালটাই খারাপ। কলকাতার কানেক্টিং ফ্লাইট ধরার লাইনে গিয়ে দাঁড়াতে হল, মাত্র আধঘন্টা হাতে ছিল যে।
-এঃ হে, চীনে তোমার খুব খাওয়া দাওয়ার অসুবিধে হয়েছে তাহলে বল।
- সে আর বলতে।আচ্ছা চল, বরং ফেরার সময় একবার মিত্রকাফেতে ঢুঁ মেরে আসব, ফাউল কাটলেটটা এখনো আগের মতই বানায়। দেরি করলে কিন্তু শেষ হয়ে যাবে। নাকি গোলবাড়ির কষা মাংস খাবি? সে অবশ্য এখনো দেরি আছে। চাচার হোটেলটা অবশ্য খোলা, মাটন কাবাবটা চেখে দেখব নাকি?
-ওফ্ । তোমার খালি খাই খাই। এবার খাওয়ার কথাটা বন্ধ করে, চীনের আয়নার কথাটা বলবে?
- ও, আচ্ছা, আচ্ছা।যা হোক, ওরা তো কেউ পড়তে পারল না লেখাটা, তখন আমাকে ডাকল। আসলে আয়নাটার কাঁচের পিছনে, দেবনাগরীতে গোলাকারে লেখাটা লিখেছিল। মন্ডুকা উপনিষদের মন্ত্র।অথচ বৌদ্ধদেরও মূলমন্ত্র। আমি গিয়েই পড়ে দিলাম।
- কি করে?
- কি করে আবার? আয়নায় রিফ্লেক্ট হয়ে লেখাটা উল্টো হয়ে পড়ছিল ।আমি তার উপর আরেকটা আয়না ধরে প্রতিবিম্বটাকে আবার সোজা করে ফেললাম ,আর তখন সেটা বেশ পড়া গেল।
-কি লেখা ছিল শুনি?
-ওঁ মণিপদ্মে হূঁ ।
- তার মানে?
- মানে হল, জ্ঞান একত্রিত করার অভ্যাসে অপবিত্র শরীর ও মনকে বিশুদ্ধ আলোকোজ্জ্বল রূপে পরিবর্তিত করা যায়।
- কিন্তু টু কুয়াং চিং-এর অভিশাপটা কি বললে না তো?
বড়মামা ঠোঁটে আঙুল চেপে বলল, 'চুপ,এখানে নয়।'
কলেজস্ট্রীট থেকে বাড়ি ফিরে, বড়মামা নিজের ঘরে গিয়ে, ব্যাগ খুলে একটা জার্নাল বার করে দিল কোকোকে। 'রেখে দে, পরে পড়িস। মোয়াই কি জানতে পারবি। তবে আগে, নিজের কলেজের পড়াশোনাগুলো ঠিকঠাক করবি, নইলে আর 'ওঁ মণিপদ্মে হূঁ' হতে হচ্ছে না।
(৫)
রাতে ডিনারের টেবিলে কোকো দেখে, বাবা মা আর বড়মামার মধ্যে দারুন আড্ডা জমেছে । ইস্ , আফসোস করে কোকো। থাকা হল না, কত কিছু শোনা হল না । কোকো যেতেই বাবা হেসে বললেন, 'এইতো কোকো এসে গেছে । বোস বোস,দীপুদা কি বলছে, শোন।'
'কাল তোর কলেজ আছে নাকি রে?', বড়মামা জিজ্ঞেস করলেন।
- কাল? কাল তো বিশ্বকর্মা পুজো।
- আর কোচিং?
- সে তো সন্ধ্যেবেলা। কেন বল তো?
-কাল তোতে আমাতে একবার মিউজিয়াম থেকে ঘুরে আসব ভাবছি। অরিজিৎ অনেকদিন ধরে বলছে।
- অরিজিৎ কে?
- আরে আমারই স্টুডেন্ট ছিল, অরিজিৎ বসু। মিউজিয়ামের ডাইরেক্টর।
-ওরেব্বাস্ ,দারুন হবে। কাল মিউজিয়ামে যাব আমি তোমার সঙ্গে।
'দাঁড়া, এত লাফাস না। চারটের মধ্যে ফিরতে হবে কিন্তু। পাঁচটায় তোর পড়া না?', বাবা বললেন। 'হ্যাঁ হ্যাঁ, ঠিক আছে।', কোকো ঘাড় নেড়ে বলে।
বাবা-মা মৃদু হাসেন। প্রশ্রয় ওদেরও আছে। আসলে ছেলেটা কলেজ-বাড়ি-কোচিং আর মোবাইলে আটকা পড়ে থাকুক,সেটা ওরাও চান না।বড়মামা এলেই ওর এই যে নানা বিষয়ে ইন্টারেস্ট জেগে ওঠে, দুজনে নানা বিষয়ে আলোচনা ক'রে অনেক কিছু নতুন শিখতে পারে, এটা তো ওরাও চান। জীবনে এসবেরও দরকার আছে, শুধু কারিকুলামের পড়ার বাইরেও জানা দরকার। দুনিয়াতে কত কিছু ঘটে যাচ্ছে, সেসবের পাঠ কোকো যে বড়মামার থেকেই পায়, সেটা ওরা জানেন।
- কাল আমরা কি দেখতে যাব মিউজিয়ামে?
-মহেঞ্জোদড়োর আয়না।
-ঐ তখন যেটা বলছিলে? মেটালের, পড়ে ভাঙবে না?
হা হা করে ঘরশুদ্ধু সবাই হেসে ওঠে।
(৬)
- ডিমের অমলেট করে দাওনা মা।
- না আজ ডিম খাবি না। আজ শুধু রুটি তরকারি।
- কেন? একটা ডিম খেলে কি হবে?
- না বলেছি না। রোজ এত ডিম খাওয়া ভাল নয়।
মাঝেমধ্যেই খাওয়া-দাওয়া নিয়ে কোকোর সঙ্গে মার এরকম তর্কাতর্কি লাগে। কোকোর বায়না আর মার বকুনি। 'কিরে, কি নিয়ে ঝামেলা হচ্ছে, শুনি?', বড়মামা চা খেতে খেতে এসে ঢুকলেন।
- দেখোনা, ব্রেকফাস্টে মা কিছুতেই ডিম দিতে চাইছে না।
- সে কি রে? ডিম খেতে দিচ্ছিস না? নরওয়ের রাজা জানলে, যে তোর ফাঁসি হয়ে যেত রে বুলি।
'কেন গো বড়মামা? কি হয়েছিল নরওয়েতে?', গল্পের গন্ধে উৎসাহ ঝরে পড়ে কোকোর গলায়।
- শোন তবে। একবার বহু বছর আগে, ওই বংশের কোন এক রাজার শরীর ভাল ছিল না, খাওয়ায় রুচি নেই। হেড শেফকে বললেন, 'একটা সিদ্ধ ডিম দাও।' কিন্তু কপাল খারাপ, সারা রাজবাড়ি তন্ন তন্ন ক'রে খুঁজেও, কোথাও ডিম পাওয়া গেল না। বাজারে চাকর-বাকরদের পাঠানো হল। তখন সব দোকান টোকানও বন্ধ হয়ে গিয়েছে। রাজার আর ডিমসিদ্ধ খাওয়া হল না।
-রাজা ভীষণ রেগে গেল নিশ্চয়ই।
-শোন না, সেইদিন থেকে হুকুম হল, প্রত্যেকদিন একটা করে সিদ্ধ ডিম যেন রাজার খাবার সময় হাজির থাকে। সেই নিয়ম আজও চলছে ।এখনকার রাজা হয়ত ডিমসেদ্ধ তেমন ভালবাসেন না, হয়ত রোজ খানও না, তবু তার খাবার তালিকায় ডিমসিদ্ধ থাকবেই।
'ও বাবা, ডিম নিয়ে এত!', হেসে বলে কোকো। মাও হেসে ফেলে বলেন,'নাও,খাও এবার ওমলেট। দাঁড়া, দু'জনকেই একটা করে ভেজে দিচ্ছি। দীপুর আশকারাতে ছেলেটা একেবারে মাথায় উঠল।' মা চলে গেলে, বড়মামা কোকোর কাছে এসে কানে কানে বললেন, 'এই আশকারা শব্দটা কোথা থেকে এসেছে জানিস?'
-না তো।
-এটা ফরাসি শব্দ। এর মানে মোটেও 'প্রশ্রয় দেওয়া' নয় ।
- তাহলে ? কি মানে?
- 'গুপ্ত বিষয়ের প্রকাশ'। সেটাই করব আজ।
(৭)
বড়মামা বিড়ি ধরাতে বারান্দায় চলে গেলেন। কোকো ভাবতে বসল, টু কুয়াং চিং আর মহেঞ্জোদড়োর আয়নার মধ্যে কি যোগসুত্র। বড় মামা কিছুতেই খুলে বলছেন না, কাল বারকয়েক জিজ্ঞেস করতেও এড়িয়ে গেছেন। আজ আবার মিউজিয়ামে যাওয়া হবে । আয়নাগুলোর মধ্যে কি এমন আছে? কি গুপ্ত জিনিসের প্রকাশ করবেন বলে গেলেন? নাঃ, কিচ্ছু বুঝতে পারছে না কোকো। এবার মাথাটাই বোধহয় খারাপ হয়ে যাবে। এমনিতে ওর বুদ্ধিতে ও নানা বিষয়ের গভীরে গিয়ে, শিখতে আর জানতে ভীষণ আগ্রহী। কাল রাতে ও প'ড়েও ফেলেছে বড় মামার লাস্ট রিসার্চ পেপারটা। ইস্টার আইল্যান্ডে বেশ কিছু বিশাল পাথরের মূর্তি রয়েছে । অদ্ভুত লম্বা টাইপের মুখ,আকাশের দিকে ওরা তাকিয়ে রয়েছে। সমুদ্রের ধারে সাজানো আছে সেগুলো।এগুলোকেই বলে মোয়াই। রাপা নুই বলে এক জনগোষ্ঠীর তৈরি, আজ থেকে হাজার বছরের পুরোনো। সবাই জানত এগুলো পাথরের মূর্তির মুখ, কিন্তু কেন যে এগুলো ওরা বানিয়েছিল, সেটা রহস্যই ছিল। বড়মামার টিম এক্সক্যাভেশন করে মূর্তির তলা খুঁড়ে দেখেছে, প্রত্যেকটা মূর্তির বাকি শরীরটা আছে মাটির নীচে, আর তারও তলায় এক বা একাধিক মানুষের মৃতদেহ রয়েছে। এখন মনে করা হচ্ছে মিশরের পিরামিডের মত, এই পাথরের মূর্তিগুলোও মৃত মানুষের কবরের উপর কোন বিশেষ বিশ্বাসে, সৌধ হিসেবে বানানো হত। গোগ্রাসে ও লেখাটা পড়েছিল কাল রাত জেগে,পড়ার বইয়ের মধ্যে লুকিয়ে। মোবাইলে গেম খেলা কাল থেকে মাথায় উঠেছে।
হঠাৎ বড় মামা বারান্দা থেকে এসে জিজ্ঞেস করলেন, 'হ্যাঁ রে কোকো, তুই বড় হয়ে কি হতে চাস?' 'আমি?', একটু ভেবে কোকো বলে, 'অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার।'
-তা ভাল। শোন, যেটা করবি সেটাই মন দিয়ে, অধ্যাবসায় নিয়ে করবি। কোন কাজই দুনিয়ায় ছোট নয়। 'নিয়ারা' কাদের বলে জানিস?
-কাদের? জানিনা তো!
-বউবাজার অঞ্চলে সোনা-রুপোর গয়না তৈরি হয়,জানিস তো। সেখানে রাস্তায় ধুলো, নোংরা,নর্দমার পাঁক, সবের মধ্যেই সোনার ছোট ছোট কণা পাওয়া যায়। সেজন্য সে সবই বিক্রি হয়, নানা রেটে। কিছু লোক সেসব কিনে নিয়ে, দিন রাত ওগুলো ঘেঁটে , বহু খেটে, সোনার কণা খুঁজে বের করে। ওদেরই বলে নিয়ারা। রোজকার মন্দ হয়না রে, কপাল ভাল থাকলে মাঝে মাঝে বড় মাপের কণাও জুটে যায়, আর তাহলে তো এক রাতেই একজন বড়লোক।
(৮)
মিউজিয়ামে গিয়ে তো কোকোর চক্ষু চড়কগাছ । বড়মামার সুযোগ্য ছাত্র অরিজিৎবাবু, নিজের ঘরে ওদের দারুন খাতির ক'রে বসালেন। বড়মামাকে যে উনি কি অসম্ভব শ্রদ্ধা করেন, তা সেদিনই বোঝা গেল। 'কি খাবেন বলুন স্যার, কফি বলি?' বড়মামা বললেন, 'নাঃ,কিচ্ছু খাব না। তোমার সিন্ধু সভ্যতার ক্যাটালগটা দেখাও তো একটু, তারপর মহেঞ্জোদড়োর আয়নাটাও একবার দেখব।' অরিজিৎবাবু কাকে যেন স্টোর রুমে পাঠালেন। বড় মামা বলে চললেন 'জানিস কোকো,সবাই ভাবত, চীনের মতো সিন্ধু সভ্যতার লিপিও বোধহয় লোগোগ্রাফিক। মানে, এক একটা শব্দ, এক একটা ছবি দিয়ে বোঝানো। কিন্ত এই সেদিন সুজান রাডেলিয়া রিসার্চ করে জানাল, যে আসলে এটা একটা অ্যালফাবেটিক লিপিই, হায়ারোগ্লিফিকের মত।' বলতে বলতেই এসে গেল ক্যাটালগগুলো। ওরা বসে বসে, ক্যাটালগের পাতাগুলো উল্টেপাল্টে দেখতে লাগল । অনেকগুলো সিলমোহরের ছবিও দেখল, যেখানে বেশ কিছু লিপি ক্ষোদাই করা আছে। কিছুক্ষণ বাদে বাক্সে করে আয়নাটাও এসে গেল।অরিজিৎবাবু বললেন, 'স্যার,এটাই মহেঞ্জোদড়োর আয়না।আপনি কি এ নিয়ে এখন কোন রিসার্চ ওয়ার্ক করছেন নাকি?' আয়নাটা খানিক্ষণ উল্টেপাল্টে দেখে, তারপর কোকোকেও সেটা দেখতে দিলেন ,বড়মামা। অরিজিৎবাবুর কথার উত্তর না দিয়ে বললেন,'এই ধরনের আয়না এখনও এ দেশে তৈরি হয়, জান কি? মাত্র কয়েকটা পরিবার হাতে ক'রে তৈরী করে।' 'আরানমুলা কানাড়ির কথা বলছেন কি স্যার?' অরিজিৎবাবু বলেন।'ঠিক বলেছ',খুশি হয়ে হাসেন বড়মামা।কোকো অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,'সেটা আবার কোথায় গো?' বড়মামা বললেন, 'কেরালায়। হাই টিন ব্রোঞ্জের পাতলা ছোট পাত ঢালাই ক'রে, পালিশ করে , পেতলের ফ্রেমে আটকে আয়না বানায় ওরা।' 'ওরাও কি সিন্ধু সভ্যতার লোকেদের থেকেই আয়না বানাতে শিখেছিল?',কোকো না বলে পারে না। 'খুব ভাল প্রশ্ন করেছিস, তোর হবে। আমারও এই প্রশ্নটা মাথায় এসেছিল। যেটুকু জেনেছি,তাতে মনে হয় ওরা সিন্ধু সভ্যতার মানুষদেরই পরের প্রজন্ম । দু'হাজার বছর আগে, সিন্ধু সভ্যতা ধ্বংসের পরপরই, মানুষ সিন্ধু নদীর এলাকা থেকে চলে এসে, দক্ষিণ ভারতের কেরালায় বসবাস করতে শুরু করেছিল।' 'কেরালার এই আয়নাগুলো এখনো পাওয়া যায়?', কোকো উৎসাহে বলে। 'পাওয়া যাবে না কেন? কিনতেও পারিস আমাজনে, তবে প্রায় হাজার পাঁচেক টাকা দাম।'
'এবার আসল জিনিস দেখাব। অরিজিৎ, তোমার ঘরের, ওই কোনটায় বেশ সূর্যের আলো এসে পড়ছে, ওখানে সবাই চল।', বড়মামা বললেন। সবাই গুটিগুটি ওদিকে গেল। বড়মামা ব্যাগ থেকে দু'তিন রকম শিশি, কাঁচ, কাপড়, ব্রাশ এসব বার করে টেবিলটার উপর রাখলেন। 'এবার দেখ, এই মহেঞ্জোদড়োর আয়নাটার উপরের দিকটা আর একেবারেই মসৃণ নেই, সূর্যের আলো পড়ে দেখ, ওই দিকের দেওয়ালে অদ্ভুত সব দাগ তৈরি হয়েছে। কি হয়েছে তো?' 'হ্যাঁ', ওরা বলে।
সেটা হল, এই আয়নার ওপরে তৈরি বিভিন্ন দাগের রিফ্লেকশন। এত বছর ধরে আয়নাটার প্রচুর করোশন হয়েছে। যদি কিছু লেখা খোদাই করা থাকত, তাহলে সেটারও রিফ্লেকশন দেওয়ালে পড়ত,অবশ্য উল্টো হয়ে।
'আর একটা আয়না ধরলেই, লেখাটা সোজা হয়ে যেত। তাই না?' কোকো মাঝে বলে ওঠে। -ঠিক। এবার দেখ, আমি কি করি। এই আয়নাটার ওপর এই বিশেষ ধরনের আঠাটা ঢেলে দিলাম। ভয় নেই অরিজিৎ, আয়নাটার কোন ক্ষতি হবে না। পরে পরিস্কার কাপড় দিয়ে মুছে নিলেই হবে। এইবার এই দেখ, এই আঠা দিয়ে আমি এর ওপর এই কাঁচটা বসিয়ে দিলাম। এবার কি দেখছিস বলত?
-এ কি ! এ তো পুরো মুখ দেখা যাচ্ছে!
-হুঁ, এই হল টু কুয়াং চিং-এর আয়না। এজন্যই ওতে মুখ দেখাও যেত, আবার বিশেষ কোণে আলো পড়লে, পিছনের নকশা বা লেখাও দেওয়ালে প্রতিবিম্ব তৈরি করত। এটাই ঐ আয়নার রহস্য। মেটালের আয়নার উপর কাঁচ বসিয়ে আসলে ওগুলো বানানো হত। সিন্ধু সভ্যতার সময় এবং তারও আগে-পরে মেসোপটেমিয়া, চীন, রোম অনেক জায়গাতেই এরকম মেটালের পালিশ করা আয়না ব্যবহার হত। এক দেশ থেকে অন্য দেশে সেগুলো ব্যবসার মাধ্যমে ছড়িয়েও পড়ত। এবার দেখ, এই কোণে আমি সূর্যের আলোর ওপর আবার আয়নাটাকে ধরছি,দেখ তো সেই দাগগুলো আবার দেওয়ালে ফুটে উঠল কিনা।
কিন্তু সকলে অবাক হয়ে দেখল,আর তো সেই অদ্ভুত দাগগুলো দেওয়ালে ফুটছে না। তার বদলে, এবারে ফুটে উঠছে কিছু অদ্ভুত মানুষ, ত্রিভুজ, গাছের ডাল, মাছ এরকম সব চিহ্ন। 'সিন্ধু লিপি', চেঁচিয়ে উঠলেন অরিজিৎবাবু। বড়মামা মুচকি হেসে বললেন, 'ঠিক এটাই সন্দেহ করে চীন থেকে তড়িঘড়ি চলে এসেছিলাম। ছবি তোল, কোকো,ছবি তোল। অরিজিৎ তুমিও ছবি তুলে নাও। সুজানের রিসার্চ পেপারটা কালই ওই জন্য নেট থেকে ডাউনলোড করে নিয়েছিলাম। নাও, এবার লেখাটার মানেটা পড়ে ফেল তো অরিজিৎ।' বলে বড় মামা একটা প্রিন্টেড ডকুমেন্ট বের করে টেবিলে রাখেন। অরিজিতবাবু তাড়াতাড়ি আয়নায় রিফ্লেক্ট হওয়া লিপিটা, সুজানের সিন্ধু বর্ণমালার পাঠোদ্ধারের সঙ্গে মেলাতে থাকেন।
বড়মামা এবার কোকোর কাছে এসে ফিসফিস করে বললেন, 'চীনেম্যান দেখলেই বলবি কিন্তু, ডেঞ্জারাস। আমার পিছু ধাওয়া করতে পারে।' কোকোর মনে এদিকে তখন অনেক প্রশ্ন ভীড় করে এসেছে। ফিসফিস করে বলল, 'বড়মামা,চীনারা এখনো তোমাকে ফলো করবে কেন? ওখানে কি কিছু ঝামেলা হয়েছিল?' বাড়ি গিয়ে সব বলব, বলে বড়মামা আবার থামিয়ে দেন ওকে।
একটু পরেই অরিজিৎবাবুর মুখে হাসি ফুটে উঠল। এ তো লেখা আছে দেখছি, 'অন্তর অনন্য', পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। তার মানে অন্য আয়নাগুলোতেও এরকম কিছু লেখা আছে নাকি স্যার?' 'মনে হয় না,একমাত্র মহেঞ্জোদড়ো থেকে পাওয়া আয়নাগুলোতেই এরকম লিপি পাবে বলে আমার মনে হয়। তবু একবার দেখো অন্য আয়নাগুলোও। ন্যাশনাল মিউজিয়ামে কিছু আছে, সুব্রতকে জানিয়ে, আয়নাগুলোকে একবার এইভাবে দেখার চেষ্টা কোরো। তবে এই স্পেশাল সলিউশনগুলো আমি ছাড়া কেউ বানাতে পারবে না।', আয়না থেকে যত্নে সলিউশনগুলো সাদা কাপড়ে মুছে নিতে নিতে বললেন বড়মামা। 'তবে তোমরা কেউই একটা জিনিস লক্ষ্য করোনি,বোধহয়। কি রে কোকো,এই শেখালাম এতদিন ধরে ?' কোকো একটু ভেবে বলল, 'আয়নার প্রতিফলনে লেখাটা সোজা পড়া গেল, আর একটা আয়না দিয়ে ডবল রিফ্লেক্ট করার দরকার হল না। তার মানে লেখাগুলো আগে থাকতেই উল্টে লেখা ছিল।' 'ব্রাভো, এই না হলে আমার ভাগ্নে! আর সেই সঙ্গে ভাব, আমাদের দেশের সিন্ধু সভ্যতা, চীনের থেকে কতটা এগিয়ে ছিল সেসময়। ওরা বুদ্ধি করে, লেখাটা প্রথমেই রিফ্লেকশন করে লিখেছিল, যাতে একবারেই সহজে পড়া যায়। 'অন্তর অনন্য' না হলে কি আর এরকম হয় রে?', বড় মামা আর অরিজিৎবাবু দুজনেই হেসে ওঠেন।ফেরার সময় অরিজিৎবাবু ঢিপ করে বড়মামাকে একবার প্রণাম সেরে নেন।বলেন,'আপনি একজন জিনিয়াস স্যার।আমি আপনার নখের যুগ্যিও হতে পারলাম না।' বড়মামা হেসে অরিজিৎবাবুকে জড়িয়ে ধরে বলেন, 'সলিউশনগুলো রেখে গেলাম,জানিও কি লেখা পড়ে উদ্ধার করলে।'
(৯)
রাতে খাওয়া-দাওয়ার শেষে, কোকো ঘরে শুয়ে শুয়ে মোবাইলে ইউটিউব খুলে আরানমুলা কানাড়ি আয়না তৈরীর ভিডিও দেখছিল।সত্যিই কি চকচকে, পালিশ করা মেটাল, ব্রোঞ্জ বলে মনেই হয় না। ঠিক যেন কাঁচেরই মত পালিশ,অথচ স্বচ্ছ নয়।এই প্রতিবিম্বই হল সঠিক ছবি। কাঁচের আয়নায় নীচের তল থেকে প্রতিবিম্ব প্রতিফলিত হয়ে তৈরি হয়।মেটালের আয়নাতেই একমাত্র, ওপরের তল থেকে প্রতিবিম্ব তৈরী হয়। তাই কোন বিচ্যুতি বা বিকৃতি থাকে না। ওদিকে বড় মামা মিউজিয়াম থেকে ফিরে আসার পর থেকেই বেশ চুপচাপ। হাসিখুশি, হৈ হৈ করার ভাবটা কোথায় যেন উধাও। কোচিং থেকে ফিরে এসে থেকেই কোকো দেখছে। অথচ কারণটা কি পরিস্কার হচ্ছে না। তখনই ওর ঘরের দরজায় ঠকঠক করে শব্দ হল।কোকো সোজা হয়ে বসতেই দেখে বড়মামা। খুশি হয়ে ও বলল, 'বোসো বোসো।' 'বসতে পারব না রে', ফিসফিস করে বলল বড়মামা। গলির মুখে সন্ধ্যেয় বিড়ি কিনতে গেছি,দেখি একটা চীনে লোক রিস্কা করে এদিকেই আসছে। সঙ্গে সঙ্গে ভাগ্যিস আড়ালে লুকিয়ে পড়লাম। টু কুয়াং চিং-এর অভিশাপ ফিরে এসেছে, বুঝলি! এবার পালাতে হবে।' 'এরই মধ্যে চলে যাবে?' মন খারাপ হয়ে যায় কোকোর। 'কিন্তু ওরা জানল কি করে,তুমি এখানে আছ?',কোকো অবাক হয়ে জানতে চাইল।' মনে হচ্ছে তোর চীনা মোবাইলের পাবজি গেমের মধ্যে দিয়েই। নিশ্চয়ই ফিসিং অ্যাপ লুকোনো আছে, ডার্ক ওয়েবে সব তথ্য দিয়ে দিচ্ছে। শোন, তোকে একটা মেল পাঠালাম,বাবার ল্যাপটপে খুলে পড়বি।টু কুয়াং চিং এর জাদু আয়না সম্পর্কে সব জানতে পারবি।' 'না তুমি এত তাড়াতাড়ি যেতে পারবে না, আর ক'টা দিন থেকে যাও না! বাড়ির ভেতরেই থাক,তাহলে তো আর কেউ জানতে পারবে না।আর মোবাইলটা অফ করে আমি আলমারিতে তুলে রাখছি।', ছলছলে চোখে বলল কোকো। 'ওঃ, তোকে নিয়ে আর পারা গেল না ।', বাধ্য হয়ে চেয়ার টেনে বসে পড়লেন বড়মামা। 'আগের বারেও তোকে বলে যাওয়া উচিত ছিল,আসলে সেবারেও একটু তাড়াহুড়ো করে চলে যেতে হয়েছিল। তাই এবারে আর ভুল করলাম না। শোন, মন খারাপ করিস না।ক'দিনের জন্য যেতেই হবে মাল্টায়,পেরু যাওয়া এখন পোস্টপন্ড।' 'কিন্তু চীনে কি এমন হয়েছিল,যে ওরা এখান অব্দি ধাওয়া করে এল? কতবার জিজ্ঞেস করছি,বলছ না কেন?', কোকো অভিমান করে বলে। 'ওফ্ , বলছি রে বলছি। টু কুয়াং চিং-এর সেই আয়নাটায় আসলে দিনের বিভিন্ন সময়ে, সূর্যরশ্মির পড়ার কোনের ওপর নির্ভর করে, বিভিন্ন লেখা ফুটে উঠত। কিন্তু যে মিউজিয়ামে ওটা রাখা ছিল, সেই ঘরে শুধু চারটের সময়ই পড়ন্ত রোদ এসে পড়ত আয়নাটার ওপর একটা বিশেষ কোণে, তাই একটাই লেখা রোজ ফুটে উঠত। বাকি লেখাগুলো কিভাবে পড়তে হবে, সেটা শুধু আমিই জানি। ওরা কিছু একটা সন্দেহ নিশ্চয়ই করেছিল, তাই চীনা গুপ্ত সংগঠনগুলো আমার পেছনে এইভাবে লেগে পড়েছে। ওদের ধারণা, আয়নাটায় অমরত্ব বা টাইম ট্রাভেলের কোন মন্ত্র লেখা আছে। মেলটা পড়লেই সব জানতে পারবি। গুড নাইট। পরেরবার তোকে ম্যাঘট্যাব সম্পর্কে বলব।' বড়মামা চলে যায়। কোকো বসে বসে ভাবতে থাকে কথাগুলোর মানে। কিন্তু তার থেকেও বেশি একটা মন খারাপ উঠে আসছিল ওর বুক থেকে। হঠাৎ মোবাইলে একটা মেসেজ ঢুকতে, তাড়াতাড়ি সেটা খুলে দেখে আননোন নাম্বার দেখাচ্ছে।আর মেসেজটা হল,'ম্যাঘট্যাব ইজ প্রোহিবিটেড,ডোন্ট পোক ইওর নোজ,দীপাঞ্জন।' দেখেই ওর মনে পড়ে গেল,বড়মামা সেদিনই বলেছিলেন,মাল্টার ম্যাঘটাব হল একটা শব্দ প্রতিফলন আয়না।কোকো ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে দেখে,যাঃ,বড়মামা আগেই চলে গেছেন।চোখ ফেটে কোকোর তখন কান্না উঠে আসছিল।
তুতেনখামেনের চটি
মিশরের বালক ফ্যারাও তুতেনখামেনের সমস্ত পরিধেয়র প্রদর্শণী হবে কলকাতার ইন্ডিয়ান মিউজিয়ামে, মাত্র পনেরো দিনের জন্য।অঞ্জন আর অনির্বাণ ,দুই বন্ধু দেখতে গেল।অঞ্জনের পৈতৃক ব্যাবসা আর শখের গোয়েন্দা।অনির্বাণ ইতিহাসের প্রফেসর। মোটা কাচের প্রমাণ সাইজের সব শোকেসের ভেতর সাজানো ফ্যারাওয়ের পরিধেয় জিনিস সব। সিল্কের কাপড়ের স্কার্টের মত পোশাক যাকে বলে শেন্ডিট, চিতা বাঘের ছাল, সিংহের লেজ, খেপরেশ বা হেলমেট, ওসিরিস বা রাজদণ্ড, সোনার নকল দাড়ি, পেটিকোট ,দস্তানা,মোজা আর কারুকাজ করা চটি,বেশির ভাগই সোনার ।দেখে ওদের চক্ষু চড়কগাছ।তুতেনের মমির সঙ্গে থাকা ছোরাটা নাকি এক্সট্রাটেরেস্ট্রিয়াল।দুদিন পরে অনির্বাণ খবর দিল,তেনখামেনের চটি চুরি হয়ে গেছে।তার জায়গায় একটা সস্তার কোলাপুরি চটি সাজানো। ইজিপ্ট এমব্যাসি জেনে গেলে সর্বনাশ হয়ে যাবে, লজ্জায় মাথা কাটা যাবে দেশের। কায়রো মিউজিয়ামের অফিসারদের অনেক বলে-কয়ে সামলে রাখা হয়েছে। চটিটা না পাওয়া গেলে যে কি হবে! দেশের মান-ইজ্জত জড়িত।ওসি রাঘববাবু এসে বললেন, ‘আমাদের ডিটেকটিভ তো আছেই, তুমিও একটু দেখ অঞ্জন। তোমার ওপর আমার অনেক ভরসা আছে। জানো তো বেশি সময় নেই, হাতে মাত্র একটা দিন! কালকের আগেই চটিটা উদ্ধার করতে হবে। (অঞ্জন কি উদ্ধার করতে পারবে চুরি যাওয়া চটিটা?জানতে গেলে পড়তে হবে এই রহস্য গল্পটা)
লাল অ্যাম্বাসডরের রহস্য
শোভন বেশ সাদাসিধা ছেলে,বছর ত্রিশ-পয়ত্রিশ বয়স, কামারহাটি এলাকায় টোটো চালায়।বাড়িতে ওর বয়স্ক বাবা মা রয়েছেন, খুবই কষ্টেসৃষ্টে সংসার চলে।বাবা সামান্য একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে কাজ করতেন, শেষদিকে তারা মাইনেপত্রও ঠিকঠাক দিত না । তারপর তো একদিন লক আউটই হয়ে গেল বাবার কারখানাটায়। আর বিশেষ কিছু বকেয়াও বাবা পাননি। চাকরিটা গেল, তারপর এখানে ওখানে নানা ধান্দা, নানা ব্যবসার চেষ্টায়, বাবা বেশ কিছু টাকা বাজে খরচ করে ফেলেছিলেন। তাই এখন ওদের এইরকম অবস্থা। সব জমানো টাকা শেষ, মায়ের গয়নাগুলো পর্যন্ত । শোভন কিন্তু পড়াশোনাতে চিরকালই ভাল ছিল, গ্রাজুয়েশনও করেছিল কমার্স নিয়ে। কিন্তু আর বেশি দূর পড়তে পারল না, সংসারের হাল ধরতে হল। এই কষ্ট, এই অভাব আর ও চোখে দেখতে পারছিল না। শেষ যেটুকু জমানো টাকা ছিল, সব দিয়ে একটা টোটো কিনে রাস্তায় নামাল। এখন ওই সংসারের হাল ধরেছে, একটু একটু করে গোছাবার চেষ্টা করছে সব। নেশা ভাং,খারাপ অভ্যাস কিছুই ওর নেই,সৎ পথে থেকে,আপ্রাণ খেটে যেটুকু রোজকার হয়। কিন্তু কয়েক মাস হল, ওর একটা অদ্ভুত সমস্যা হচ্ছে ।কিছুদিন হল , প্রায়ই ভোরের দিকে ও একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখছে , কদিন পরপরই। প্রতিবারই স্বপ্নটা কিন্তু একই আর সেটা খুবই অদ্ভুত। ওর নাকি একটা লাল অ্যাম্বাসডর গাড়ি আছে । কোথায় আছে, ও নিজেই ভাল করে জানে না, খবরও রাখে না। অযত্নে পড়ে আছে গাড়িটা।এমন কি গাড়িটাকে সেখান থেকে নিয়ে আসারও ওর কোন গরজ নেই। অথচ গাড়িটা বেশ সুন্দর, ভাল অবস্থাতেই আছে। এই স্বপ্নটাই বারবার দেখে শোভন,ঘুরিয়ে ফিরিয়ে।
শ্যামলদার সঙ্গে টোটোস্ট্যান্ডে গল্প করার সময়, মাঝে মাঝেই স্বপ্নটার কথা বলে শোভন, ‘জান শ্যামলদা, আজ না আবার ওই একই স্বপ্নটা দেখলাম।‘ ‘আমাদের মনে যা গোপন ইচ্ছা থাকে, তাই আমরা স্বপ্নে দেখি। তুই এতবার স্বপ্ন দেখিস, তো একটা পুরোনো অ্যাম্বাসডর কিনে ফেলিস না কেন লোনে? সেকেন্হ্যান্ডের দাম তো আর বেশি নয়।‘ ‘সেসব জানি গো, কিন্তু স্বপ্নটার কোন একটা মানে নিশ্চয়ই আছে।’ ভাড়া নিয়ে শ্যামলদা চলে যায়। শোভন ভাবতে থাকে, ভাবতেই থাকে।
ক’দিন পরে আবারও স্বপ্নটা দেখল শোভন। এবার কিন্তু স্বপ্নের মধ্যে, লাল অ্যাম্বাসডরের সঙ্গে একটা দোকানের নামও দেখে। গাড়িটা ‘হোটেল নিরিবিলি’ বলে একটা দোকানের সামনে দাঁড় করানো রয়েছে। সাইন বোর্ডে পরিস্কার লেখা নামটা, নীচে লেখা রানিগঞ্জ। স্বপ্নটা ওখানেই ভেঙে যায়। ঘুম ভেঙে এবার একটু চিন্তায় পড়ে যায় ও, হোটেল নিরিবিলি কি রানিগঞ্জে সত্যিই রয়েছে? এতটা স্পষ্ট তবে ও স্বপ্নে দেখল কি করে! এর মানেটাই বা কি? সারাদিন অন্যমনস্কভাবে ও স্বপ্নটার কথাই ভাবতে লাগল। সেদিন দুপুরে শ্যামলদাকে বলতে, শ্যামলদা বলল, ‘রানিগঞ্জ? সে তো কয়লাখনি অঞ্চল। গেছিস নাকি ওখানে কখনও?’ ‘না গো,কস্মিনকালেও নয়। তবে আমার এক খুড়তুতো দাদা দুর্গাপুরে থাকে।‘ ‘কখনো যাসনি? তাহলে সেখানে ঐ ধাবাটার নাম তুই জানলি কি করে?’ ‘কি করে বলব?স্বপ্নে দেখলাম যে।‘ ‘হুঁ, কিন্তু বারবার এই স্বপ্নটাই দেখছিস কেন,সেটা জানা সত্যিই দরকার। যা না, একবার ঘুরেই আয় না ওখান থেকে। ওখানে তোর কিছু একটা হিল্লে হয়ে গেলেও যেতে পারে।‘
শোভন ঠিক করে ফেলল, ও যাবেই।এমন কিছু তো নয়,মাত্র চার-পাঁচ ঘন্টার রাস্তা। এভাবে আর পেরে ওঠা যাচ্ছে না। ওকে জানতেই হবে এই স্বপ্নের মানেটা কি , আর এর শেষই বা কোথায় ।এভাবে দিনের পর দিন চলতে পারে না, এই স্বপ্ন আর ক’বার দেখলে ও নিশ্চিত পাগল হয়ে যাবে। কেন? কেন? কেন? নানা প্রশ্ন ভিড় করতে থাকে ওর মাথার মধ্যে,ও উত্তর খুঁজে পায়না। এক রহস্য যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে ওকে, ও উপেক্ষা করতে পারে না। যা হোক, অনেকদিন তো কোথায় যাওয়া হয় না,রানিগঞ্জই সই।শেষমেষ একদিন ট্রেনে চেপে বসল শোভন, কিছু টাকা হাতে নিয়ে। কে জানে,ক’দিন থাকতে হয় ওখানে।
30 May 2020
সরলাবালা স্মৃতি লাইব্রেরী
রবিবার। সপ্তাহের এই একটা দিন, বৃষ্টির পরিচিত সবার সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। কিছু কথা বলবার অবশ্য সেভাবে কোন সুযোগ হয়না, লাইব্রেরিতে কথা বলা বারণ। ভেতরে ঢুকলেই, অসংখ্য প্রিয় বইয়ের সম্ভার, থাকে থাকে আলমারিগুলোতে সাজানো রয়েছে ।এর মধ্যে থেকে ,পছন্দসই বই বেছে নেওয়াটা সত্যিই কঠিন, কোনটা ছেড়ে কোনটা নিই।রবিবার নিয়ম করে, বৃষ্টির লাইব্রেরি যাবার আর একটা কারণ হল অয়ন, ওর সঙ্গেও দেখা হয় যে। আসার পথে কিছুটা সময় একসাথে পথ চলা , সাধারণ কিছু কথা হয়,ব্যাস। অয়ন কখনও তার নতুন কবিতা প'ড়ে শোনায়।কখনও বা কোন পত্রিকায় অয়নের লেখা ছাপা হলে , সবাই সেটা কাড়াকাড়ি ক’রে পড়ে। বৃষ্টি অবাক হয়ে শোনে।
বুদ্ধদেব গুহর 'বাবলি' উপন্যাসটা দুপুরে শু'য়ে শু'য়ে পড়ছিল বৃষ্টি । বই পড়তে পড়তে,ও এক নিজস্ব গোপন ভাবনার জগতে বিচরণ করে। উপন্যাসের কোন কোন চরিত্র যেন ও নিজে , আবার কোনটা যেন অয়ন। শুধু এই প্রেমের গল্পগুলো যদি বাস্তবেও সত্যি হত! যদি ওর দিকে অয়ন একটু ফিরে তাকাত! আর পাঁচজনের একজন করে নয়, যদি একটু আলাদা চোখে দেখত ! ওর বেস্টফ্রেন্ড শম্পা মজা করে বলে 'দিবানাপন'।এসব ভাবতে ভাবতেই, কখন যেন ওর চোখটা লেগে গিয়েছিল।
সেই সরলাবালা স্মৃতি লাইব্রেরি, সেই রোববার ।আজও সেই একই অবস্থা ,কোন আলমারি ছোঁয়ার উপায় নেই। আজ ও এসেছে, অয়নের লেখা বইটা নেবে বলে।অয়ন বসুর প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'রাতের বলভি', কেউ তুলে নেবার আগেই ওকে নিতে হবে। বৃষ্টি তিন দিন ধরে অপেক্ষা ক'রে রয়েছে, কবে রোববার আসবে, লাইব্রেরি খুলবে। তাই আজ সকাল-সকালই পৌঁছে গেছে লাইব্রেরিতে। লাইব্রেরি খুলতেই,ভিড় ঠেলে, প্রথম আলমারির কাছে গেল। সেখানে স্বপ্না, বুলিদি, শেখরদা সবাই বই খুঁজছে। ওদিকের আলমারিগুলোতে রাজা, অঞ্জন, শর্বরী আরো অনেকে। এরই মধ্যে, বৃষ্টি পাগলের মত খুঁজে চলেছে সেই বইটা।হঠাৎ ওর মনে হল, কেউ নিয়ে নেয়নি তো অয়নের বইটা? ভাবতেই হতাশ লাগল, আর খুঁজতে ইচ্ছে করল না। তিনটে আলমারি পরে শর্বরী দাঁড়িয়ে। ও’ও ঘেমে গেছে, তবু খুঁজে চলেছে ।না পেয়ে কেমন যেন কাঁদো-কাঁদো ভাব!
এমন সময় গোরাদা এসে হাজির ।দু'হাতে অনেক বই । হঠাৎ তারই মধ্যে চোখটা আটকে গেল বৃষ্টির।ঐ তো বইটা, 'রাতের বলভি'! বলতে চাইল 'বৃষ্টি সরকার, কার্ড নাম্বার একশো সাত। আমি নেব...' কিন্তু তার আগেই শর্বরী বলে উঠল, 'আমি অয়ন বসুর বইটা নেব। কার্ড নাম্বার একশো তিয়াত্তর'। বৃষ্টি অবাক হয়ে চেয়ে থাকে শর্বরীর মুখের দিকে । ওর আর কোন বই নেবার নেই ।গোরাদা শর্বরীর কার্ডটা হাতে নিয়ে, বইটা ইস্যু করছে। অয়ন যেন হারিয়ে যাচ্ছে,লুঠ হয়ে যাচ্ছে ওর থেকে। সমস্ত লাইব্রেরির সবকটা বই যেন ওর দিকে বিদ্রুপ করে হেসে উঠল।কখন যে শম্পা এসে ওর হাত ধরল আর আলতো চাপ দিল, ওর মনে নেই ,বুকটা ভেঙে গেছে ।
স্বপ্নটা দেখতে দেখতে কেঁদেই ফেলেছিল বৃষ্টি ।স্বপ্ন তো নয়,দুঃস্বপ্ন। সেদিনের পর থেকে, অয়নের প্রতি বৃষ্টির অনুরাগ-আকর্ষণ-মোহ সবই যেন আরও বেড়ে গেল। লাইব্রেরি থেকে ফেরার সময়, বাড়ী ফেরার পথেই পড়ে বৃষ্টির বাড়ি। রাস্তার শেষটুকু, গল্প করতে করতে দু'জনে একসঙ্গে হাঁটে।অয়ন সাইকেলে চাপে না,হেঁটেই যায়।এক এক দিন ওর নতুন লেখা কবিতাও দেয় বৃষ্টিকে, বাকি সবাই অন্য পথে চলে যাবার পর।অয়নের মনে হয় বৃষ্টির সঙ্গে পথ চলার সময়টা এত কম কেন?সেই প্রথম,আর সেই শেষ। আর এগোল না ওদের অব্যক্ত প্রেম।অয়ন তো পড়াশোনাতে বরাবরই ভাল ছিল, ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করতে না করতেই, এক রবিবার সবার হইহুল্লোড়-আনন্দের মধ্যে বৃষ্টি জানতে পারল,অয়ন টাটায় একটা ভাল কোম্পানিতে, চাকরি পেয়ে গেছে। কোনদিনও ও বিদায় দিতে পারবে না অয়নকে। অয়নও তো কোনদিন মুখ ফুটে, কিছু বলেনি । শুধু 'ফিরে আসব' সেই ছিল অয়নের শেষ কথা, মিথ্যে কথা। আর কোনদিনও কেউ ফেরেনি।
বৃষ্টিরও জীবন অবশ্য থেমে থাকেনি, পিসির দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়ের হঠাৎ ভাল লেগে যায় ওকে, বিয়ের কথাবার্তা চলতে থাকে। অন্যদিকে কবি-লেখক হিসেবে তখন অল্পস্বল্প নাম করেছে অয়ন, যে অয়নের কবিতা, ওর মুখ থেকে শুনত,বা হাতে লেখা চিরকুট পেত, এখন সেসব কাগজের পাতায় পড়তে হয়।বৃষ্টির মনটা উদাস হয়ে থাকে। অবশ্য বৃষ্টি আর বেশিদিন অয়নের কথা ভেবে, চোখের জল ফেলবার সময় পেল না। ক'দিনের মধ্যেই ওর বিয়ের ব্যবস্থা পাকা করে ফেলল, দুই পরিবারের লোকজন ।অয়ন নামের অধ্যায়টা ধীরে ধীরে শেষ হয়ে গেল বৃষ্টির জীবনের বই থেকে। বিয়ের পরে সাউথ ক্যালকাটা থেকে ওর আর সরলাবালা স্মৃতি লাইব্রেরিতে আসাও সম্ভব হত না ।তাই লাইব্রেরিটাও ওর জীবন থেকে বাদ পড়ে গেল বরাবরের মত।
বছর দশেক পরের কথা ।অয়ন এখন যথেষ্ট নামকরা সাহিত্যিক।কত গল্প, উপন্যাস নিয়মিত প্রকাশ হয় বড় বড় সব পত্র পত্রিকায়।এ বছরই বেরোল ওর প্রথম উপন্যাস 'সরলাবালা স্মৃতি লাইব্রেরি', এক প্রথিতযশা পাবলিশিং হাউজ থেকে। অয়নের এই মহান কীর্তিতে উৎসাহিত হয়ে, ওর পুরোনো বন্ধুরা সবাই মিলে ঠিক করল ,ওকে একটা সংবর্ধনা দেবে। বইয়ের নাম যা, সেই সরলাবালা স্মৃতি লাইব্রেরিতেই অনুষ্ঠানটা হবে। অনুষ্ঠানের শেষে এক কপি বই, ইন্দ্রকে আলাদা করে দেয় অয়ন। বলে, 'বৃষ্টির কাছে পৌঁছতে হবে বইটা,পারবি?' এতদিন পরে বৃষ্টিকে কিছু দেওয়া,কিছু লেখা। সেই বৃষ্টি,যে ওর প্রথম যৌবনের, প্রথম প্রেমের মুগ্ধতা হয়ে, ঐ দিনগুলোতেই চিরকালের জন্য স্থির হয়ে রয়ে গেছে। অয়নের ভাল লাগা, ভালবাসা , আড়ালে লুকিয়ে বৃষ্টিকে দেখা,ওর না বলতে পারা অনেক কথা, জেগে ঘুমিয়ে সত্যি-স্বপ্ন-সবেতেই শুধু ছিল বৃষ্টি।অবশ্য, কোনদিন মুখ ফুটে বলতে পারেনি, তাই বৃষ্টিও জানতে পারেনি । আর সে সুযোগও পেল না বেশিদিন। বৃষ্টির বিয়ে হয়ে গেল হঠাৎই, বড় তাড়াতাড়ি। আসলে, নতুন চাকরি,নতুন শহরে নিজেকে খাপ খাওয়ানো, আর তার পরেই বৃষ্টিকে হারানো-সেইসময় সবকিছু এমন দ্রুত ঘটে যাওয়ায়, অয়ন ভীষণভাবে ক্ষতবিক্ষত হয়েছিল। বাঁধভাঙা ভালবাসা হারানোর যে কি যন্ত্রণা,সেটা তখন ও বুঝতে পেরেছিল। কিন্তু তখন বড় দেরি হয়ে গেছে।
অবশেষে একদিন বিকেলে হঠাৎ একটা ফোন এল অয়নের, ফেসবুক মেসেন্জার কল।নামটা দেখে 'বৃষ্টি সিনহা'।অয়ন তো অবাক এতদিন পরে, বৃষ্টির ফোন। তড়িঘড়ি দুরুদুরু বুকে ফোনটা রিসিভ করে । বলে,'আরে, তুমি? এতদিন পরে.....'।
(এরপর জানতে পুরো গল্পটি পড়তে হবে)
20 May 2020
নেওয়ারি খুলিরহস্য
সোহম তার বন্ধু ঋষিতকে গিফ্ট দেওয়ার জন্য অ্যান্টিক শপ থেকে একটি লাপিস লাজুলির খুলি কেনে।খুলিটা অদ্ভুত, উপরে নানারকম সংকেত খোদাই করা। ওদেরই আরেক বন্ধু সুমন্ত্র ওটা কেনার জন্য প্রলুব্ধ হয়ে ওঠে। ঋষিতের বাড়িতে খুলিটা নিয়ে নানা রকম অদ্ভুত ঘটনা ঘটতে থাকে ।ও ভয়ে খুলিটা ফেরত দিয়ে দেয় সোহমকে। সুমন্ত্র খুলিটার জন্য টাকা অফার করে, সোহম রাজি হয়না। মেজকাকাকে সোহম খুলিটা দেখায়। মেজকাও বলে নেওয়ারি লামাদের টোটেম এটা ,খুবই দামী এবং অদ্ভুত।রন্জনা লিপি ও সাংকেতিক মন্ত্রগুলো অন্ধকারে সবুজ আলোতে জ্বলে। নানা রকম টেস্ট করার ব্যবস্থা হয়।খুলিটার রহস্য বুঝতে দুজনে আপ্রাণ চেষ্টা করে। ফেরার পথে সোহমের একটা হুমকি ফোন আসে,গুন্ডাটা খুলিটা দিয়ে দিতে ব'লে। ট্যাক্সিতে উঠে ও বিপদে পড়ে। খুলিটার জন্য ট্যাক্সিওয়ালা আক্রমন করে।বাঁচতে ট্যাক্সি থেকে লাফ দিয়ে ও প্রাণে বেঁচে যায়।মেজকাকে বাঁচাতে, সে রাত ও মেজকার বাড়িতেই থেকে যায়।নানা সন্দেহজনক মানুষের উপস্থিতি, আশঙ্কাতে ওরা দুজনে সারারাত জেগে পাহারা দেয়।অনেক পড়াশোনা, নেট-বই ঘাঁটাঘাঁটিও ক'রে, বুঝতে পারে এটা তিব্বতি লামাদের তন্ত্র-মন্ত্রের আচার ব্যবহারে দেবতাকে নৈবেদ্য দেবার খুবই পবিত্র জিনিস। কিন্তু লামার খুলিটা কি পাথরের ভেতরে আছে,খটখট শব্দ হচ্ছে কেন নাড়ালে?আর খোদাই-করা লিপিগুলোর মাঝখানে একটা সাদা দাগ কেন ? লিপির পাঠোদ্ধারও করতে পারেনা কেউ। রেফার করা হয় লন্ডনের কোর্টাল্ড ইন্সটিটিউটে। পরের দিন আবার হুমকি ফোন আসে সোহমের । এবার সোহম বুঝে যায় যে ফোনটা সুমন্ত্র করছে।ও মাথা নত করে না,ওর এক সিআইডির বন্ধুকে ব্যাপারটা জানিয়ে দেয় ।মেজকার সঙ্গে সোহম যায় প্রথমে ইন্ডিয়ান মিউজিয়াম।সেখান থেকে ফেরার পথে গার্ড বলে আপনাদের ব্যাগটা একজন পাল্টিয়ে নেবার চেষ্টা করেছিল । আর্কিওলজিক্যাল সার্ভেতে থ্রিডি স্ক্যান ,কার্বন ডেটিং করতে যায়।কিউরেটর,আর্কিওলজিস্ট সবাই বলে খুলিটা দারুন মূল্যবান, মিউজিয়ামে ডোনেট করে দিতে ।স্ক্যানে ধরা পড়ে পাথরের খুলিটার মধ্যে আরও একটা সত্যি কারের মড়ার খুলি আছে। বৌদ্ধ লামার কি? কিন্তু পূর্ণবয়স্ক মানুষের খুলি এত ছোট হল কি ক'রে? কয়েকজন আড়ালে যেন ফলো করে ওদের।এরপর ওরা যায় ন্যাশনাল লাইব্রেরীতে ।সেখানে জানতে পারে এটা মেডিসিন বুদ্ধের মন্ত্রঃপূত খুলি। ওদিকে পুলিশের ধাতানি খেয়ে, সুমন্ত্র ফোন করে ক্ষমা চেয়ে নেয়। সোহম খুলিটা নিজের বাড়ি নিয়ে আসে ।তখনই শোনে ওর ছেলেকেও স্কুল থেকে কিডন্যাপ করার প্ল্যান করেছিল সুমন্ত্র। সোহম খুলিটার ওপর গোল সাদা স্পটটায় একটা কাঠের টুকরো দিয়ে আঘাত করতে 'ওঁ' শব্দ বের হয়। স্ক্যান রিপোর্ট বলে, এটা পাঁচশো বছরের পুরনো পূর্ণবয়স্ক লামার খুলি।কিন্তু খুলি বা দেহ ছোট করার কি গুপ্তবিদ্যা জানা ছিল নেওয়ারি লামাদের?ওদিকে, ঋষিত ফোন করে জানায় ওকেও হুমকি দিয়ে ফোন করেছিল কেউ। পরের দিন মেজকার বাড়িতে গিয়ে সোহম লন্ডন থেকে ডক্টর ব্যাংক্রফ্টের মেল পায়। লিপিটার পাঠোদ্ধার করে,জানা গেছে এই লিপি ওষুধ সংক্রান্ত। রোগ সংক্রমণ প্রতিরোধ করার জন্য বৈশর্য্যতন্ত্রের মন্ত্র খোদাই করা।একশো আট বার মন্ত্রপাঠ,খুলিতে আঘাত করে 'ওঁ' শব্দের প্রক্রিয়ার পর সেই মন্ত্রঃপূত জল পান করলে, ভাইরাল ফিভার সেরে যাবে ।সদবীর নিলামে দশ হাজার পাউন্ড দাম ওঠার কথা খুলিটার ।ব্রিটিশ মিউজিয়ামও চেয়ে পাঠায়। কিন্তু সোহম ইন্ডিয়ান মিউজিয়ামেই ডোনেট ক'রে দেয়। দেবার মুহূর্তে সুমন্ত্র ঘরে ঢোকে। বলে এতদিনেও আসল জিনিসটা ধরতে পারেনি কেউ।খুলিটা মাটি থেকে একহাত ওপরে রেখে, মাঝের গোল জায়গাটায় একশো আট বার আঘাত করে সুমন্ত্র। করতেই খট্ করে পাথরের খুলিটা আড়াআড়ি খুলে যায়,আর ভেতরের আসল লামার মন্ত্রঃপূত খুলিটা বেরিয়ে আসে।এটা দিয়েই প্রক্রিয়াটা করার কথা।সোহম বুঝতে পারে সুমন্ত্রও কম যায় না।ওদের মিটমাট হয়ে যায়।
3 May 2020
তোমার সঙ্গে একা
তুমি কথা বলছ না আমার সাথে , আমারও কিছু বলার নেই তোমাকে। শুধু নির্বাক তাকিয়ে থাকা ছাড়া। তুমি সুখী হয়েছ ? না ,জানতে চাইনি আমি। কি হবে জেনে? তখন যদি তুমিও সেই একই প্রশ্ন কর, কি বলব আমি? তার চেয়ে বৃষ্টির তোড়ে ভেসে যাক না অতীত। স্থান-কাল-পাত্র নিরপেক্ষ হোক না আমাদের অসীম শূন্যতার মিলন। শূন্যের সঙ্গে শূন্য যোগ দেওয়া ছাড়া,এ তো আর কিছু নয় ।
তোমার সঙ্গে কিছুটা সময়, সে যেন অনন্ত জীবন। এ যেন এক গভীর আত্মবীক্ষণের গ্লানি এনে দেয়। কি পেয়েছি, কি পাইনি, কি হতে পারত, হিসেবের সময় এটা নয়। এ শুধু তোমার সঙ্গে একা থাকার সময়, আমার সঙ্গেও।
গঙ্গার ধারে দু’জনে দাঁড়িয়ে আছি, সূর্য অস্ত যাচ্ছে ।শহরের ক্যানভাস আকাশের মায়াবী আলোয় ভরে যাচ্ছে। আমার বুকটাও ভরে উঠছে। শুধু অনেক বছর ধরে অপেক্ষা করার পর, শেষ তুলির টান বা শেষ কবিতার লাইন, আজ শেষবার সৃষ্টি করে নিঃশেষ হয়ে যাব আমি। আমার আর কিছুই বলার থাকবে না, তোমারও না। সূর্য ডুবে গেলে, সন্ধ্যার অন্ধকারে চারিদিক ডুবে যাবে। আমরা আবার যে যার পথে ফিরে যাব। আর হয়তো কোনদিন দেখা হবে না। শুধু থেকে যাবে কিছু স্মৃতি, দুজনে পাশাপাশি পথ হাঁটার সেই সময়টার কথা ভেবে অকারণ হাহুতাশ করবে একটা পাগল মন। সিগারেটের ধোঁয়ার মতো বের হয়ে আসবে সারা জীবনের আফশোস।
চারিদিকে ব্যস্ত মানুষের ভিড়, স্ট্রীটলাইট গুলো জ্বলে উঠল। নির্বাক সন্ধ্যাবেলায় প্রিয় কবিতার বইয়ের পাতা উল্টোচ্ছ তুমি। আমি তার শেষ কবিতা মনে মনে লিখে ফেলছি, আর কোনদিন কবিতা লিখব না। জীবন ঢেকে দিচ্ছে আমার এই তিরিশ বছরের সব না পাওয়ার অভিযোগ আর পরাজয়ের লজ্জাকে। তুমি সেই পরম নৈঃশব্দের আদরে,প্রশ্রয়ে, আমার সারা জীবনের সমস্ত কান্নাকে ধুইয়ে দিয়ে চলে যাচ্ছ এক অসীম জীবনবোধে।
যাবার আগে তুমি ফিরে তাকালে একবার। ঠিক যেমন ফিরে তাকিয়ে ছিলে কৈশোরের সেই প্রথম দেখার দিনটাতে। হাতে হাত ছুঁয়ো না, বড় শীত করে ।শুধু চোখের মিলনে আজ অনেক ইতিহাসের পাতা লেখা হয়ে গেছে,সেই আমার কাছে যথেষ্ট। অনেক মেঘ, মনকেমন করে উড়ে এসেছে, আশ্রয় না পেয়ে আবার ফিরে চলে গেছে ঘরভাঙ্গা পাখির মত। তুমিও চলে যাচ্ছ, ঠিক সেদিনের মত। সেই জেব্রাক্রসিং, সেই ট্রাফিক সিগন্যাল, চলন্ত বাস থেকে নেমে সেই উড়ন্ত চুমু লুফে নেওয়া ।রাস্তা পেরোলেই তুমি, কিন্তু পারলাম কি পৌঁছতে ? মাঝে বয়ে গেল কিছু গঙ্গার জল, কিছু ধোঁয়া-ধুলো-ঘামের গন্ধ,কয়েকটা নির্বোধ লাভলেটার আর একটা গোটা কলকাতা শহর ।জীবন কিছুই নেয়নি আমার থেকে, বরং অনেক ফিরিয়ে দিয়েছে। আমিও সেইসব নিয়েই আছি,তাই তোমার চলে যাওয়ার দিকে আর তাকিয়ে থাকব না। দীর্ঘশ্বাস? শুধু সেটাই হয়তো লুকোতে পারব না।আর তুমি? তোমার চোখের কোনও কি ভিজে উঠল একবার? তুমিও কি নিজেকেই বোঝাচ্ছ? আর তা জানার উপায় নেই ।ঠোঁটদুটো অস্ফুটে কিছু বলতে চেয়ে, কেঁপে কেঁপে থেমে যায়।
সমস্ত নৈঃশব্দ, সমস্ত সময় আর আমার ‘আমি’ কে নিয়ে কালো সন্ধ্যার ড্রপসিনের ওপারে চলে যাচ্ছ তুমি, একা।
27 April 2020
একটু মনকেমন
মাঝে মাঝে হঠাৎ হঠাৎ মন কেমন করে,অকারণেই
করে। আসলে পাগল মন তো, চোখে তাই জল জমে। কার কথা ভেবে,কে জানে? যাদের হারিয়েছি, যাদের
অনেক খুঁজেও আর পাইনি, হয়ত তাদের কথা ভেবেই। কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় একা ঘুরে বেড়াই,তাকে
খুঁজে পাই না। আকাশে মেঘ করে ,একটানা বৃষ্টি শুরু হয়, জল জমে রাস্তায়। রাস্তায় একা
আমি, লোকজন কম। পাশাপাশি,ঘেঁষাঘেঁষি সব বাড়ি, বড় আদরের মনে হয় সব,বড় চেনা যেন। কেউ
কি মুখ বাড়াবে কোন বাড়ির জানলা খুলে? কেউ কি আসবে উল্টো দিক থেকে হেঁটে? এত ভিড়ে
কোথায় খুঁজব তোমায়? তুমি তো জান না, এতদূর আমি চলে এসেছি, শুধু তোমায় খুঁজতে। তুমি
কিছু জানলেও না। আমি চলে যাচ্ছি, আর হয়ত আসব না কোনদিন এখানে। এই মনকেমনও মরে যাবে
একদিন ।তবুও কিছু কি থেকে যাবে?
মানুষ আর প্রকৃতি ,এই দুইকে চেনার, জানার শেষ নেই, এই নিয়েই তো পথ চলা।
পুরনো দিনের স্মৃতি নিয়ে আজকের আবেগ সেজে
ওঠে। কখনও, মনে হঠাৎ খুব ভালো লাগা এসে জড়ো হয়। ঠোঁটের কোণে একটু হাসি । ভোরবেলা আকাশ আলোয় আলোয় ধুয়ে যায়, নানা রঙে সেজে ওঠে । পাখিরা ডেকে ওঠে। আমার তো মনে হয় পৃথিবীর এত কালিমা
সত্বেও আজও ভোর হয়, শুধু পাখিদের মুখ চেয়ে। আর কেউ কিছু নয়, সব নিমিত্ত মাত্র। আসা
যাওয়ার এই ছোট্ট জীবনে, এই মনকেমন টুকুই শুধু নিজের, সেই নিয়েই বেঁচে থাকা।
যারা চলে গেছে, তারা আর আসবে না ।তবু
সেই স্মৃতিই তাড়া করে বেড়ায়, আজও। ছাদে উঠে খোলা হাওয়ায় দাঁড়াই।চারিদিকে অনেক
দূর অবধি দেখা যায়। কোন দিকে তোমার বাড়ি? কোন দিকে তার বাড়ি? তার? তার? খুঁজে পাওয়া
যাবে না জানি। শুধু খোঁজা, সেটার কোন শেষ নেই। সেইসঙ্গে একটু ভালোবাসা। ভালোবাসার তো আর কোন
শেষ নেই, একজনকে দিয়ে দিলে তা ফুরিয়েও যায় না ।এর সমুদ্রে প্রতিমুহূর্তে ঢেউ ওঠে,
পাড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে, ভাসিয়ে নিয়ে যায় । সেইসব নিয়েই রয়েছি আর কটা দিন,এর থেকে মুক্তি
নেই। এরা আমাকে ঘিরে রয়েছে, জড়িয়ে রয়েছে, পৃথিবীতে বেঁচে থাকার একটা মানে খুঁজে দিয়েছে।এতেই
আমি খুশি।26 April 2020
নো ম্যানস ল্যান্ড
আমার ছোটবেলার অনেকটা সময়ই কাটত মামাবাড়ি শোভাবাজার রাজবাড়িতে ।গ্রে স্ট্রীটের ধারে রাজা কালীকৃষ্ণ স্ট্রিট ,সেখানেই ছিল পেল্লায় মেজরাজার বাড়ি। বিশাল দোতলা বাড়ি ,কত শরিক, বড় উঠোন, নাচঘর, পড়বার ঘর, বিশাল ছাদ,বড় বড় অয়েল পেন্টিং,ঝাড়লন্ঠন,দামি দামি আসবাবপত্র ,আরও কত কি।বনেদি আদব-কায়দা,দারুন খাওয়া দাওয়া,আর হৈ হৈ-এর মধ্যেই আনন্দে কেটে যেত দিনগুলো।তবে সবচেয়ে আনন্দের ছিল, রহস্যময় সেই বাড়িটার কোণে কোণে আমার একলা দুপুরে ঘুরে বেড়ানো।আমার ছোটবেলার স্বপ্নময়,মায়াময় দিনগুলোর কত যে স্মৃতি এখানে রয়ে গিয়েছে, তার শেষ নেই। কৈশোরের কত কল্পনা আর ভাবনার রসদ ছিল এই বাড়ি। শুধু তো একটা বাড়ি নয়,এ ছিল আমার গোটা ছোটবেলাটাই।
আজ সে বাড়ি আর নেই।কালের নিয়মে যা হয় আর কি।ভগ্নপ্রায় বাড়িটা শরিকি বিবাদে,শেষে প্রোমোটারের লোলুপ হাতে গিয়ে পড়ল।তাই সে বাড়ি আজ ঝাঁ চকচকে চারতলা ফ্ল্যাটবাড়ি।ভেঙে ধূলিসাৎ হয়ে গেছে আমার ছোটবেলার স্মৃতিবিজড়িত বাড়িখানি ,সেইসঙ্গে সেই সব রহস্যময়,রোমাঞ্চকর দিনগুলোও।
মামাবাড়ির অনেক রহস্যের মধ্যে, একটা বড় রহস্য ছিল, সে বাড়ির লাগোয়া একটা সরু গলি।এতটাই সরু, যে একজনের বেশি দু’জন পাশাপাশি হাঁটা যায় না।মামাবাড়ির পাশেই যে দোতলা বাড়িটা নতুন উঠল, তাকে আমরা বলতুম ‘হলুদবাড়ী’, তার রঙের জন্য। তো সেই বাড়ি আর আমার মামাবাড়ির মাঝখানেই ছিল সেই সরু গলিটা। সেই ছিল আমাদের ছোটবেলার ‘নো ম্যানস ল্যান্ড’।
হলুদ বাড়িটা ওঠার আগে ওখানে একটা পোড়ো বাড়ি ছিল।আমি জানতাম সেটা ছিল ভুতের বাড়ি। সেই বাড়িতে থাকত এক ভয়ঙ্কর তান্ত্রিক, কি সব সাধনার জন্য, সে নাকি সাতটা মড়ার খুলি পুঁতে, বেদীতে বাঁধিয়ে রেখে দিয়েছিল। আমরা ছোটরা মাঝে মাঝেই সেসব দেখতে চাইতুম বলে,ওই গলিপথে যাবার একমাত্র রাস্তা, যেটা ছোটমামাদের রান্নাঘরের পিছন দিকে ছিল,সেটা দাদুরা কষে বন্ধ করে দিলেন।দরজাটাও আলমারি-টালমারি কিছু দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছিল।
তবু আমার উৎসাহের অন্ত ছিল না।বাইরের কলঘরের জানালাটা বন্ধই থাকত, কিন্তু বিশাল জানলাটার ফাঁকফোকর দিয়ে ওই গলিটা দেখা যেত।পরে যখন দোতলা বাড়িটা হল,তান্ত্রিকও পাশে কোথায় যেন পাট চুকিয়ে চলে গেল।তবুও,ওই বাড়ির লোকজনই কালেভদ্রে গলিটা ব্যবহার করত।আমার দাদুরা তাতে কোনদিন কোন অধিকার ফলায়নি,সে মাথাব্যথাও ছিল না।
শুধু কলঘরের জানলার ফাঁক দিয়ে দেখা যেত সেই নো ম্যানস ল্যান্ড, আমার ওয়ান্ডারল্যান্ড, সেই রহস্যময় গলি। শুনেছিলুম, গলিপথে বেরিয়ে আর একটা দরজা খুলে সরাসরি গ্রে স্ট্রীটে পড়া যেত ।যাহোক তান্ত্রিক , ভুত, মড়ার খুলি আর নিষিদ্ধ গলি-এসব আমার কিশোর মনে নানা উন্মাদনার সৃষ্টি করেছিল, উৎসাহের কোন অন্ত ছিল না।সে বয়সে কল্পনা আর বাস্তব কখনো কখনো মিলেমিশে একটা অদ্ভুত গল্পের জগৎ তৈরি করত।আমার ছোটবেলার একটা বড় অংশই ছিল ,এসব নিজস্ব কল্পনা আর ভাবনার স্রোতে ভেসে যাওয়া ।
একদিন কি কারণে যেন কলঘরের বড় জানলাটা খোলা হয়েছিল। আমি দেখে নিয়েছিলুম, যে ওই জানলা খুলে একজন অনায়াসেই বেরিয়ে পড়তে পারে গলিটাতে।ব্যাস আর যায় কোথায়! একদিন নির্জন দুপুরে সেই সুযোগটাই কাজে লাগালুম।মা ঘুমোচ্ছে দেখে, বাথরুমে যাবার নাম করে, নীচের কলঘরে ঢুকে হাঁসকল দিলুম।তারপর অনেক কষ্টে, কায়দা ক’রে জানলাটা খুলে ফেললুম।ব্যাস, আমার সামনে সেই রহস্যময় নো ম্যানস ল্যান্ড উন্মুক্ত হয়ে গেল।টুক করে লাফিয়ে নেমে পড়লুম। নীচে চারিদিকে ডাঁই করে রাখা জন্জাল, গোটা গলিটাই বেশ নোংরা,এখানে ওখানে আগাছা জন্মেছে, নুড়ি-পাথর পড়ে আছে।খিড়কি পথ বলে খুব একটা ব্যবহারই হয় না, পরিষ্কারও কেউ করে না। খেলার সময়, আমাদের ছাদ থেকে ক্যাম্বিস বল অবশ্য কয়েকবার পড়ে গিয়েছিল এই গলিটাতে,তবে আর ফিরে পাওয়ার কোন প্রশ্নই ছিল না। আজ এতদিন পরে সে কি আর খুঁজে পাওয়া যাবে? তবু ভাবলুম একটু খুঁজেই দেখি না।আর সেইসঙ্গে গলিটাও ঘুরে দেখা হয়ে যাবে, যদি রহস্যময় কিছু পাওয়া যায়। হঠাৎ দেখি একতলার একটা জানলা দিয়ে একটা দাড়িওলা বুড়ো জুলজুল করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।বুড়োটাকে দেখেই ভয়ে আমি পালিয়ে যেতে গেলুম। একে তো দুপুরে অ্যাডভেঞ্চারের নেশায় এক নিষিদ্ধ রাজ্যে ঢুকে পড়েছি, মনটা ভয়ে দুরদুর করছে, ওদিকে আবার ওরকম একটা বেঢপ বুড়ো আমাকে চুপচাপ দেখে যাচ্ছে,অথচ কিছুই বলছে না,কে রে বাবা। কিন্তু পরক্ষণেই ভাবলুম,ধুর, পাগল-টাগল হবে হয়তো। সাহসটা একটু বেড়ে গেল।
পালিয়ে না এসে আবার ঘুরেফিরে জায়গাটা ভাল করে দেখতে লাগলুম।অবশ্য খুঁজেপেতেও সেই সাতটা নরকরোটির চিহ্নও দেখতে পেলুম না ।তখনই দেখলুম এক কোণে কয়েকটা সিমেন্টের স্ল্যাবের আড়ালে একটা সুন্দর কাঠের বাক্স পড়ে আছে, তার মুখ আঁটা। যাহোক বল টল যখন খুঁজে পাওয়া গেলই না, ভাবলুম বাক্সটা একবার খোলার চেষ্টা করি, যদি কোন গুপ্তধন পাওয়া যায়।এই নোংরার মধ্যে বাক্সটা এলই বা কোথা থেকে? আসলে গোয়েন্দা আর অ্যাডভেঞ্চার গল্পের বইয়ের পোকা ছিলুম, রাতদিন সেসবই মাথায় ঘুরঘুর করত।বাক্সটাতে হাত দিতেই,বুড়োটা আমার দিকে কটমট করে তাকাতে লাগল, আর মুখটা লম্বাটে করে,দুলিয়ে দুলিয়ে অদ্ভুত একটা আওয়াজ করতে লাগল। এবার সত্যিই ভয় করতে লাগল।বুড়োটারই হবে হয়তো বাক্সটা, তাই ওরকম করছে। যাহোক, পরের বাড়িতে ঢুকে, পরের জিনিসে হাত দেওয়াটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে ভেবে ফিরে আসার সিদাধান্ত নিলুম।তাছাড়া বেশি সময়ও ছিল না হাতে।শিগগির না ফিরতে পারলে কপালে বেদম মার জোটার কথা। ওদিকে কলঘরের দরজা ধাক্কানোরও আওয়াজ পেলুম,মনে হয়। তড়িঘড়ি ফিরে এলুম।
লাফ মেরে জানলাটায় চেপে, আবার বাথরুমে ঢুকতে যাব, তখনই পেছন থেকে কে যেন বলে উঠল ‘যাঃ,চলে গেল। ওঃ হো, চলে গেল‘, আরো কি সব। সেই পাগলটাই বোধহয় ।তখন আর সেসব দেখার বা শোনার মতো সময় নেই, জানলাটা আগের মতো বন্ধ করতে না করতেই, বাইরে থেকে মার হাঁক শুনতে পেলুম, ‘সেই কখন বাথরুমে যাব বলে বেরিয়েছে,পাত্তাই নেই! কোথায় তুই?’ ‘বেরোচ্ছি’, বলে জানলাটা ঠেসে ঠিকঠাক বন্ধ করে, ভালো মানুষের মতো বেরিয়ে এলুম। মা হিড়হিড় করে টানতে টানতে নিয়ে চলল, সঙ্গে অজস্র বকুনি। দুপুরে আমার দুষ্টুমির চোখে ঘুম হচ্ছে না, বাবা এলে আজ বলতে হবে, চারিদিকে ছেলেধরা ঘুরে বেড়াচ্ছে, ইত্যাদি ইত্যাদি ।
যেতে যেতে তখনও ভাবছিলুম, ধুর বাক্সটার ভিতর কি ছিল দেখাই হল না।ইসস্, সত্যিই যদি গুপ্তধন থাকতো!
আজ সে বাড়ি আর নেই।কালের নিয়মে যা হয় আর কি।ভগ্নপ্রায় বাড়িটা শরিকি বিবাদে,শেষে প্রোমোটারের লোলুপ হাতে গিয়ে পড়ল।তাই সে বাড়ি আজ ঝাঁ চকচকে চারতলা ফ্ল্যাটবাড়ি।ভেঙে ধূলিসাৎ হয়ে গেছে আমার ছোটবেলার স্মৃতিবিজড়িত বাড়িখানি ,সেইসঙ্গে সেই সব রহস্যময়,রোমাঞ্চকর দিনগুলোও।
মামাবাড়ির অনেক রহস্যের মধ্যে, একটা বড় রহস্য ছিল, সে বাড়ির লাগোয়া একটা সরু গলি।এতটাই সরু, যে একজনের বেশি দু’জন পাশাপাশি হাঁটা যায় না।মামাবাড়ির পাশেই যে দোতলা বাড়িটা নতুন উঠল, তাকে আমরা বলতুম ‘হলুদবাড়ী’, তার রঙের জন্য। তো সেই বাড়ি আর আমার মামাবাড়ির মাঝখানেই ছিল সেই সরু গলিটা। সেই ছিল আমাদের ছোটবেলার ‘নো ম্যানস ল্যান্ড’।
হলুদ বাড়িটা ওঠার আগে ওখানে একটা পোড়ো বাড়ি ছিল।আমি জানতাম সেটা ছিল ভুতের বাড়ি। সেই বাড়িতে থাকত এক ভয়ঙ্কর তান্ত্রিক, কি সব সাধনার জন্য, সে নাকি সাতটা মড়ার খুলি পুঁতে, বেদীতে বাঁধিয়ে রেখে দিয়েছিল। আমরা ছোটরা মাঝে মাঝেই সেসব দেখতে চাইতুম বলে,ওই গলিপথে যাবার একমাত্র রাস্তা, যেটা ছোটমামাদের রান্নাঘরের পিছন দিকে ছিল,সেটা দাদুরা কষে বন্ধ করে দিলেন।দরজাটাও আলমারি-টালমারি কিছু দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছিল।
তবু আমার উৎসাহের অন্ত ছিল না।বাইরের কলঘরের জানালাটা বন্ধই থাকত, কিন্তু বিশাল জানলাটার ফাঁকফোকর দিয়ে ওই গলিটা দেখা যেত।পরে যখন দোতলা বাড়িটা হল,তান্ত্রিকও পাশে কোথায় যেন পাট চুকিয়ে চলে গেল।তবুও,ওই বাড়ির লোকজনই কালেভদ্রে গলিটা ব্যবহার করত।আমার দাদুরা তাতে কোনদিন কোন অধিকার ফলায়নি,সে মাথাব্যথাও ছিল না।
শুধু কলঘরের জানলার ফাঁক দিয়ে দেখা যেত সেই নো ম্যানস ল্যান্ড, আমার ওয়ান্ডারল্যান্ড, সেই রহস্যময় গলি। শুনেছিলুম, গলিপথে বেরিয়ে আর একটা দরজা খুলে সরাসরি গ্রে স্ট্রীটে পড়া যেত ।যাহোক তান্ত্রিক , ভুত, মড়ার খুলি আর নিষিদ্ধ গলি-এসব আমার কিশোর মনে নানা উন্মাদনার সৃষ্টি করেছিল, উৎসাহের কোন অন্ত ছিল না।সে বয়সে কল্পনা আর বাস্তব কখনো কখনো মিলেমিশে একটা অদ্ভুত গল্পের জগৎ তৈরি করত।আমার ছোটবেলার একটা বড় অংশই ছিল ,এসব নিজস্ব কল্পনা আর ভাবনার স্রোতে ভেসে যাওয়া ।
একদিন কি কারণে যেন কলঘরের বড় জানলাটা খোলা হয়েছিল। আমি দেখে নিয়েছিলুম, যে ওই জানলা খুলে একজন অনায়াসেই বেরিয়ে পড়তে পারে গলিটাতে।ব্যাস আর যায় কোথায়! একদিন নির্জন দুপুরে সেই সুযোগটাই কাজে লাগালুম।মা ঘুমোচ্ছে দেখে, বাথরুমে যাবার নাম করে, নীচের কলঘরে ঢুকে হাঁসকল দিলুম।তারপর অনেক কষ্টে, কায়দা ক’রে জানলাটা খুলে ফেললুম।ব্যাস, আমার সামনে সেই রহস্যময় নো ম্যানস ল্যান্ড উন্মুক্ত হয়ে গেল।টুক করে লাফিয়ে নেমে পড়লুম। নীচে চারিদিকে ডাঁই করে রাখা জন্জাল, গোটা গলিটাই বেশ নোংরা,এখানে ওখানে আগাছা জন্মেছে, নুড়ি-পাথর পড়ে আছে।খিড়কি পথ বলে খুব একটা ব্যবহারই হয় না, পরিষ্কারও কেউ করে না। খেলার সময়, আমাদের ছাদ থেকে ক্যাম্বিস বল অবশ্য কয়েকবার পড়ে গিয়েছিল এই গলিটাতে,তবে আর ফিরে পাওয়ার কোন প্রশ্নই ছিল না। আজ এতদিন পরে সে কি আর খুঁজে পাওয়া যাবে? তবু ভাবলুম একটু খুঁজেই দেখি না।আর সেইসঙ্গে গলিটাও ঘুরে দেখা হয়ে যাবে, যদি রহস্যময় কিছু পাওয়া যায়। হঠাৎ দেখি একতলার একটা জানলা দিয়ে একটা দাড়িওলা বুড়ো জুলজুল করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।বুড়োটাকে দেখেই ভয়ে আমি পালিয়ে যেতে গেলুম। একে তো দুপুরে অ্যাডভেঞ্চারের নেশায় এক নিষিদ্ধ রাজ্যে ঢুকে পড়েছি, মনটা ভয়ে দুরদুর করছে, ওদিকে আবার ওরকম একটা বেঢপ বুড়ো আমাকে চুপচাপ দেখে যাচ্ছে,অথচ কিছুই বলছে না,কে রে বাবা। কিন্তু পরক্ষণেই ভাবলুম,ধুর, পাগল-টাগল হবে হয়তো। সাহসটা একটু বেড়ে গেল।
পালিয়ে না এসে আবার ঘুরেফিরে জায়গাটা ভাল করে দেখতে লাগলুম।অবশ্য খুঁজেপেতেও সেই সাতটা নরকরোটির চিহ্নও দেখতে পেলুম না ।তখনই দেখলুম এক কোণে কয়েকটা সিমেন্টের স্ল্যাবের আড়ালে একটা সুন্দর কাঠের বাক্স পড়ে আছে, তার মুখ আঁটা। যাহোক বল টল যখন খুঁজে পাওয়া গেলই না, ভাবলুম বাক্সটা একবার খোলার চেষ্টা করি, যদি কোন গুপ্তধন পাওয়া যায়।এই নোংরার মধ্যে বাক্সটা এলই বা কোথা থেকে? আসলে গোয়েন্দা আর অ্যাডভেঞ্চার গল্পের বইয়ের পোকা ছিলুম, রাতদিন সেসবই মাথায় ঘুরঘুর করত।বাক্সটাতে হাত দিতেই,বুড়োটা আমার দিকে কটমট করে তাকাতে লাগল, আর মুখটা লম্বাটে করে,দুলিয়ে দুলিয়ে অদ্ভুত একটা আওয়াজ করতে লাগল। এবার সত্যিই ভয় করতে লাগল।বুড়োটারই হবে হয়তো বাক্সটা, তাই ওরকম করছে। যাহোক, পরের বাড়িতে ঢুকে, পরের জিনিসে হাত দেওয়াটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে ভেবে ফিরে আসার সিদাধান্ত নিলুম।তাছাড়া বেশি সময়ও ছিল না হাতে।শিগগির না ফিরতে পারলে কপালে বেদম মার জোটার কথা। ওদিকে কলঘরের দরজা ধাক্কানোরও আওয়াজ পেলুম,মনে হয়। তড়িঘড়ি ফিরে এলুম।
লাফ মেরে জানলাটায় চেপে, আবার বাথরুমে ঢুকতে যাব, তখনই পেছন থেকে কে যেন বলে উঠল ‘যাঃ,চলে গেল। ওঃ হো, চলে গেল‘, আরো কি সব। সেই পাগলটাই বোধহয় ।তখন আর সেসব দেখার বা শোনার মতো সময় নেই, জানলাটা আগের মতো বন্ধ করতে না করতেই, বাইরে থেকে মার হাঁক শুনতে পেলুম, ‘সেই কখন বাথরুমে যাব বলে বেরিয়েছে,পাত্তাই নেই! কোথায় তুই?’ ‘বেরোচ্ছি’, বলে জানলাটা ঠেসে ঠিকঠাক বন্ধ করে, ভালো মানুষের মতো বেরিয়ে এলুম। মা হিড়হিড় করে টানতে টানতে নিয়ে চলল, সঙ্গে অজস্র বকুনি। দুপুরে আমার দুষ্টুমির চোখে ঘুম হচ্ছে না, বাবা এলে আজ বলতে হবে, চারিদিকে ছেলেধরা ঘুরে বেড়াচ্ছে, ইত্যাদি ইত্যাদি ।
যেতে যেতে তখনও ভাবছিলুম, ধুর বাক্সটার ভিতর কি ছিল দেখাই হল না।ইসস্, সত্যিই যদি গুপ্তধন থাকতো!
22 April 2020
জন্মদিন
আজ সৈকতের জন্মদিন। তবে আজকাল আর এসবের খেয়াল রাখে না ও। জীবনটা তছনছ হয়ে গেছে। বাবা-মা দুজনেই মারা গেলেন, পিঠোপিঠি এক বছরের মধ্যেই। আর তার ক'দিন পরেই শ্রাবন্তীর সঙ্গে মিউচুয়াল সেপারেশনটাও হয়ে গেল। তাও এক বছর হতে চলল। তবে রুপা আসে মাঝে মাঝে, স্কুলের ছুটিতে। গোটা দিনটা ওর সঙ্গে কাটিয়ে, বিকেলেই ফিরে যায়। শ্রাবন্তীই ওকে পৌছে দিয়ে চলে যায়, কিন্তু নিজে ঢোকেনা এ বাড়িতে, নিয়ে যাবার সময়ও। দীর্ঘদিন বাক্যালাপ নেই দুজনের ।
আজ যে ওর জন্মদিন, সেটা অবশ্য ভোরবেলাতেই মনে পড়ে গেল সৈকতের। না, কেউই আজ এখনও বার্থডে উইশ করেনি। আর করবেই বা কে? এক রুপা ছাড়া। আসলে আজকাল বহু শপিং সাইটই জন্মদিনের মেসেজ পাঠায় সকাল-সকাল।ওর ব্যাঙ্ক, এমনকি ওর কোম্পানি পর্যন্ত। তারপর ফেসবুক খুললে তো বড় বড় করে জন্মদিনের শুভেচ্ছা। সুতরাং ভুলে থাকা আর হল না সৈকতের।
যা হোক জন্মদিন বলে কথা। কত যেন হল বয়সটা ? হিসেব করতেই সৈকতের ঠোঁটে একটা দুঃখ মেশানো হাসি ফুটে উঠল। এই একবছরে শরীরের বয়স যত না বেড়েছে, মনের বয়স বেড়েছে তার বহুগুণ। একা থাকার যন্ত্রণা নিয়ে এই একটা বছর কেটে গেছে বড় অনাড়ম্বরে, আরো কত বছর যে এইভাবে কাটাতে হবে!
সৈকত ভাবল, প্রথমেই মা বাবার ছবিতে গিয়ে একটা প্রণাম সেরে আসবে। যতদিন ওঁরা জীবিত ছিলেন, এটাই তো করত দিনের শুরুতে। ছোটবেলায় এই দিনটায় মা সক্কাল বেলায় ঘুম থেকে উঠিয়ে দিয়েই জন্মদিনের কথা মনে করিয়ে দিত। তারপর জড়িয়ে ধরে দু'গালে দুটো চুমু খেত, বাবাও। মা বলত,' যাও মুখ হাত ধুয়ে আগে বাবা মাকে প্রণাম করে নেবে।' সৈকতের মনটা খুশিতে নেচে উঠত, আজ স্পেশাল দিন। মা সেদিন দারুন দারুন সব রান্না করত। বাবা সকালেই এলাহি বাজার করে নিয়ে আসত। তারপর মা বানাত লুচি-আলুর দম আর বিকেলে কেক। বাবা এইদিনটা অফিস ছুটি নিত। দুপুরে নানা রকমের রান্না করে, দশটা বাটি সাজিয়ে, বড় কাঁসার পদ্মকাটা থালায় ভাত দিত মা। থালার ঠিক মাঝখানে বাটি উপুড় করে গোল শেপের ভাত। সবকটা পদ একটু করে টেস্ট করতেই হত সৈকতকে। মা বলত, 'কত কষ্ট করে সারাদিন ধরে রান্না করলুম, অন্তত একটু মুখে দিয়ে দেখ বাবা।' খেয়ে দেয়ে বাবা-মার সঙ্গে বেরোনো। হয় ছোটদের সিনেমা, নয়তো পার্কে ঘুরতে যাওয়া। এই সময়টাই ছিল ওর সবচেয়ে আনন্দের। ফেরার সময় নিউমার্কেটের বড় খেলনার দোকানে ওকে নিয়ে ঢুকত বাবা। ওর পছন্দের একটা দারুন খেলনা, তা সে যত দামীই হোক না কেন, কিনে দিত বাবা। বড় হয়ে যাবার পর আর কিছু থাক না থাক, সকালবেলা বাবা-মার চুমু আর প্রণামটা কিন্তু ছিলই।
বিয়ের পরে, পুরনো ট্র্যাডিশন বজায় রেখেছিল শ্রাবন্তীও, কোন কিছুতেই ছেদ পড়েনি, রুপা হবার পরেও নয়। সবাই মিলে কত কিইনা হত সারা দিনটাতে। হইচই ,আনন্দ, উপহার, দারুন দারুন খাবার, বিকেলে ঘুরতে বেরোনো, বড় রেস্তোরাঁয় ডিনার সারা ,একেবারে জমজমাট প্রোগ্রাম। শ্রাবন্তী সারপ্রাইজ গিফট দিত একটা। আশ্চর্য ব্যাপার, সৈকত যেটা ক’দিন ধরেই কিনব কিনব ভাবছিল, কিন্তু কোন না কোন কারণে কেনা হচ্ছিল না, সেটাই শ্রাবন্তী কিনে এনে হাজির করত। একটা সাধারণ স্কুলে পড়িয়ে, জমানো সব ক’টা টাকাই হয়ত সেদিন শেষ করে ফেলত ও। বাবা-মার ততদিনে বয়স হয়েছে, ওঁনারা আর কোথাও বেরোতে চাইতেন না। তবু সকালে উঠে ওঁনাদের প্রণাম করা দিয়েই দিনটা শুরু হত। শ্রাবন্তীর আবদারে ওই দিনটা ছুটি নিতেই হত সৈকতকে।
কিন্তু আজ? আজ আর কেউ নেই, কোথাও নেই। আজ একা একা জন্মদিনটা হয়ে গেছে বড়ই জৌলুসহীন, বিরক্তিকর। আজও তাই অফিস ,আজও ক্যান্টিনের ঘ্যাঁট আর মাছের ঝোল । আউটিং,শপিং, গিফট তো কবেই বন্ধ হয়ে গেছে। সময় থাকতে যদি সংসারের ভাঙ্গনটা রোখা যেত! মেনে নিত না হয় আরো কিছু, পাল্টে নিত না হয় নিজেকেও। ভুল কি আর শুধরোনো যায় না? কিন্তু রূপা? ওকে কেন ছিনিয়ে নিল শ্রাবন্তী? রুপা তো সৈকতের চোখের মণি ছিল, কি দোষ ছিল মেয়েটার?
ফ্রেশ হয়ে একটা মোটামুটি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন পাঞ্জাবী পায়জামা পড়ে নিল সৈকত। আগে তো পাটভাঙ্গা নতুন পাঞ্জাবী পায়জামাই পড়ত এই দিনটায়। আগে থেকেই তা কিনে রাখা থাকত। ঠিক খেয়াল থাকত মার, পরে শ্রাবন্তীরও। আজ সেসব আর কোথায়? মা-বাবার ছবিতে ফুল দিয়ে প্রণামটা সেরে, আবার পাঞ্জাবী পায়জামা খুলে ফেলে, অফিসের জামাকাপড় পড়তে হবে। অফিস যাবার সময়ও হয়ে যাবে ততক্ষনে। ছুটি নিয়ে আর কি হবে? আজ আর পাঁচটা দিনের মতোই একটা সাধারন দিন। কাজের মেয়েটা জলখাবার বানিয়ে দেয় এসময়। রান্নাঘরে তারই ঠুংঠাং শব্দ।
প্রতিবারই নতুন এক একটা ভাবনা এসে ভিড় করে মা-বাবার ছবিটার সামনে এসে দাঁড়ালে। এবারও সেই একই। মা যেন কি একট বলতে চাইছে, বাবা যেন মৃদু হেসে আশীর্বাদ করছে। 'কি বলছ মা?’, কান পেতে শুনতে চাইল সৈকত । প্রণাম করে মাথাটা তুলে অনেক কষ্টে অনুভব করার চেষ্টা করল, গালদুটো কি একটু ভিজে লাগছে? বুড়ো বাবা-মা যেমন শেষদিকে ভিজিয়ে দিত জন্মদিনের সকালে হাম খেয়ে? নাঃ, কিন্তু তার বদলে স্পষ্ট শুনল, মা যেন বলছেন ‘বাবা, এই নে, পায়েসটুকু খেয়ে নে। আজ যে তোর জন্মদিন।‘ চোখটা ভিজে গেল সৈকতের। মা? পায়েস ?কোথা থেকে আসবে? সব শেষ হয়ে গেছে।
কিন্তু অদ্ভুতভাবে সৈকতের নাকে তখনই ভেসে আসতে লাগল পায়েসের সুগন্ধ। কোথা থেকে আসছে ?কি ব্যাপার? পিছন ঘুরতেই চমক। একহাতে পায়েসের বাটি আর অন্য হাতে প্রসাদী ফুল-মিষ্টি প্লেটে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রূপা। স্নান করে, শাড়ি পড়েছে বলে কত বড় দেখাচ্ছে। ‘একি তুই? কখন এলি?’ সৈকত অবাক। ‘এগুলো কি?’ রুপা খিলখিল করে হেসে বলল, ‘হ্যাপি বার্থডে বাবা। এই নাও, তোমার জন্য মা পাঠিয়ে দিয়েছে।‘ মা ? আরো একরাশ বিস্ময়। শ্রাবন্তী এখনো মনে রেখেছে?
রূপার হাত ধরে আবার মা-বাবার ছবিটার কাছে গেল সৈকত। মার মুখে তখন যেন এক চিলতে হাসি লেগে রয়েছে, বাবারও চোখ থেকে যেন একরাশ খুশি ঝরে পড়ছে। পাশে তাকাতে, সেই একই হাসিটা সৈকত দেখতে পেল রুপার মুখেও। মেয়ের গালে হাম খেয়ে ভিজিয়ে দিতে দিতে, সৈকতের মনে হচ্ছিল পৃথিবীতে বাবা-মা, ছেলে-মেয়ে এগুলো কোন আলাদা আলাদা সম্পর্ক নয়, সময়ভেদে মিলেমিশে সব এক হয়ে যায়।
17 April 2020
কালো পেন
কালিপদবাবু ছাপোষা মানুষ, একটা ছোটখাটো প্রাইভেট কোম্পানিতে কেরানীর চাকরী করেন। বিয়ে-থা করেননি,একা মানুষ।থাকেন বাগবাজারের পৈর্তৃক বাড়িটাতে, আর থাকে এক ঘর ভাড়াটে। শরিকি বিবাদে দীর্ঘদিন বাড়িটাতে কোন রক্ষণাবেক্ষণ হয়নি, শুধু একটা দিক কোনমতে এখনো টিঁকে আছে।
ওনার শখের মধ্যে শুধু পুরোনো গ্রামাফোন রেকর্ড সংগ্রহ করা। খুঁজে-পেতে নানা পুরোনো রেকর্ড কিনে আনেন ওয়েলিংটন,সদর স্ট্রীট বা ফ্রি স্কুল স্ট্রীট থেকে। আজকাল বাইরে বেরোনো মানা বলে, সারাদিনই বাবার আমলের পুরোনো রেকর্ড-প্লেয়ারটায় সেসবই চালান। ভীমসেন যোশী,পাহাড়ী সান্যাল, গীতা দত্ত,পিট সিগার বা পালুসকরের গান তাকে নিয়ে যায় কোন না পাওয়া স্বর্গরাজ্যে।
আজ মাসের প্রথম দিন। মাইনে পেয়েই কালিপদবাবু ঠিক করলেন লেনিন সরণিতে একবার ঢুঁ মারবেন জামালউদ্দিনের দোকানে। যদি কিছু মণিমুক্তো পাওয়া যায় কম দামে। দু’ তিন হাজার টাকা খরচা করে দুর্লভ অ্যান্টিক রেকর্ড কেনার সামর্থ্য তার নেই। তবু চোখের দেখা । গিয়ে দেখেন জামালের দোকান সেদিন বন্ধ। ওরও বাপ ঠাকুরদার ব্যবসা, আজকাল সব পেনড্রাইভ, মোবাইল আর ইউটিউবের যুগ,তার ওপর লকডাউন। বিক্রিবাটা প্রায় নেই বললেই চলে।তবুও কি যে মায়া-ভালোবাসা জড়িয়ে আছে পুরনো দিনের স্মৃতি ঘিরে, ওই জানে, আর জানেন কালিপদবাবু ।
যা হোক চলেই যাচ্ছিলেন, হঠাৎ একটা ফ্যান্সি আইটেমের দোকানে চোখ পড়ল রাস্তায়। কত সুন্দর সুন্দর ঘড়ি,শোপিস, সিগারেট কেস, টর্চ, লাইটার, নানা রকম বিদেশি জিনিস থরেথরে সাজানো দেখে, বেশ লোভ লেগে গেল কালিপদবাবুর। একটা পেনের দিকে তার নজর পড়ল, হাতে নিয়ে বেশ পছন্দ হল। চকচকে কালো মেটালিক ফিনিশ, সঙ্গে গোল্ডেন টিপ আর হ্যান্ডেল। কিন্তু যেখানে চোখ আটকে গেল সেটা আর কিছুই নয়, কালোর ওপরে গোল্ডেন কালারে খোদাই করা ইংরেজিতে ‘কালি’ নামটা, তার নামের সঙ্গে তো বেশ মিলে যাচ্ছে। হতে পারে কোম্পানির নাম। দোকানীকে জিজ্ঞেস করতে বলল জাপানি পেন, দেড়শো টাকা দাম। কিন্তু ঐ চকচকে কালো রঙের পেন আর ঐ স্বর্নাক্ষরে লেখা ‘কালি’র মোহে ততক্ষনে পড়ে গেছেন কালিপদবাবু। দরদাম আর বেশি না ক’রে, পেনটি পকেটস্থ করলেন। মনটা তার বেশ প্রফুল্ল হয়ে গেল, এতদিনে মনের মত একটা পেন পেলেন। এমন একটা মহার্ঘ জিনিস যে হঠাৎ ক’রে এইভাবে হস্তগত হয়ে যাবে, তা তিনি ভাবতেও পারেননি।ঠিক করলেন, এবার থেকে এই পেনটাই সবসময় ব্যবহার করবেন, অফিসের কাজে হোক বা বাড়িতে শখের কবিতা লেখাতেই হোক ।
পাড়ায় ঢুকতেই হঠাৎ দেখা হয়ে গেল পুরোনো বন্ধু অনুপের সঙ্গে। ‘কি রে কালি, কোথায় গেছলি ?’ নিজেই এগিয়ে এসে কথা বলল অনুপ। একবার শ’পাঁচেক টাকা ধার নিয়ে আর এ তল্লাট মাড়ায়নি অনুপ, কথাবার্তাও হয়নি দীর্ঘদিন। পথে-ঘাটে দু’একবার দেখা হলেও এড়িয়ে চলত। সেই অনুপই আজ নিজে এসে পকেট থেকে পাঁচশো টাকা ফেরত দিয়ে দেঁতো হেসে বলল ‘কিছু মনে করিস না রে ভাই, সেই কবে থেকে তোকে টাকাটা দেব দেব করেও দেওয়া হয়নি। একটি মাস্ক -স্যানিটাইজারের স্টল দিয়েছি, ভালই চলছে।' ‘ তাই নাকি? ভালই করেছিস, তা আসিস একদিন বাড়িতে, যা দিনকাল পড়েছে আজ আছি, কাল নেই।‘ বলে এগোলেন কালিপদবাবু। বাড়িতে ঢুকতে গিয়েই চমক, একটা বড়সড় খাম এসে পড়ে আছে। খুলে দেখেন, সেই কবে একটা কবিতা পাঠিয়েছিলেন নামী পত্রিকায়, এতদিন কোন খবরই ছিল না। ভেবেছিলেন হয়তো মনোনীত হয়নি। হঠাৎ সেই পত্রিকাই আজ এতদিন পরে ছেপেছে কবিতাটা।আজকাল ই পত্রিকার যুগেও, এই পত্রিকাটি এই আবহেও ছাপা পত্রিকা বের করছে কষ্ট করে। পত্রিকার সঙ্গে একটা হাজার টাকার চেকও পাঠিয়ে দিয়েছে। পরপর এতগুলো প্রাপ্তিযোগে কালিপদবাবু একেবারে দিশাহারা হয়ে গেলেন, হাওয়ায় যেন তিনি ভাসছিলেন ।
বিকেলে ইজিচেয়ারে বসে, একটা কবিতা লিখে ফেলবেন ঠিক করলেন। মনটা আজ বেশ উড়ু উড়ু। কথারা ঝাঁক বেঁধে আসছে। তার ওপর নতুন পেন। পেনটা বের করেই খেয়াল হল, আচ্ছা পেনটা বেশ পয়া তো!
সবে ভাবটা এসেছে, দু-এক লাইন লিখেছেন, তখনই সবিতা আসে চা নিয়ে, সঙ্গে আজ পিঁয়াজি-মুড়ি। ওপাশে ভাড়া থাকে ওরা। সবিতার মা’ই মাঝেমধ্যে বিকেলে চা-টা পাঠিয়ে দেয়। তবে আজকাল এ বাড়ি ও বাড়ি মানুষ জনের যাওয়া আসা প্রায় বন্ধই হয়ে গেছে। ‘কিরে আজকে দারুন ব্যাপার যে, দে দে। হঠাৎ পেঁয়াজি ভাজলো তোর মা!’ বলেই ফেলেন তিনি। ‘না গো জেঠু, এতদিন আটকে থাকার পর আজ বাবা ফিরেছে না দিল্লি থেকে স্পেশাল ট্রেনে, তাই বাড়ির সবাই খুব খুশি। তোমার ছ’মাসের বাকি বাড়িভাড়াও পাঠিয়ে দিয়েছে মা। এই নাও।‘ বলে একটা খাম বাড়িয়ে দেয় সবিতা। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছেন না বাক্যহারা কালিপদবাবু। কি সব হচ্ছে আজকে! এত সব ভাল ভাল ব্যাপার একদিনেই ঘটছে কি করে? তিনি স্বপ্ন দেখছেন না তো? চিমটি কাটতে গিয়ে বিস্তর লাগল, বুঝলেন সব সত্যি। সবিতা চলে যেতে তিনি সকাল থেকে হয়ে যাওয়া ঘটনাগুলো ভাবতে লাগলেন। সবই তার পাওনা ছিল, কিন্তু আটকে ছিল। একদিনে সব একসঙ্গে হওয়াটা কি স্রেফ কাকতালীয়? ভাগ্যের চাকা হঠাৎ এইভাবে ঘুরে গেল? এই করোনা বাজারে? কালিপদবাবু আদর করে পেনটায় হাত বোলাতে লাগলেন, সঙ্গে পিঁয়াজিতে কামড়।
হঠাৎ দরজায় কে যেন কড়া নাড়ল। ‘কে?’ বলে গেঞ্জিটা পড়ে দরজাটা খুলতে গেলেন। ওদিক থেকে কে যেন বলে উঠল ‘আমি, মামা’। দরজা খুলে দেখেন বড়দির ছেলে সুবিমল। ওদের সঙ্গেই তো শরিকি মামলাটা চলছে। বাড়িটা এতদিন এভাবে পড়ে আছে, না বিক্রি হচ্ছে না সারানো যাচ্ছে। সেই সুবিমল এইসময়! ‘কিরে, কি ব্যাপার?হঠাৎ?’ ‘না গো মামা। এই এলাম আর কি। অনেকদিন আসা হয়না তো। তা বাড়িটার কি দশা হয়েছে গো?’ মাস্কটা ভাল করে নাকের ওপর টেনে নিয়ে সুবিমল বলে। ‘হবে না? কি করব বল। কোর্ট-কাছারি, মামলাতেই তো সব আটকে আছে, জানিস তো।‘ ‘সেই জন্যই তো এলাম মামা। আমরা মামলা তুলে নিয়েছি। এই নাও কোর্টের কাগজ। বাড়ি এখন থেকে তোমার, তুমি যা করবে।‘ সুবিমল এক নিঃশ্বাসে বলে কথাগুলো । ‘সেকিরে? হঠাৎ কি মনে করে! আয় আয় ঘরে এসে বোস।‘ মামার গলায় উৎফুল্লতা। ‘না গো মামা, ভেতরে আর ঢুকবো না, বাইরে থেকে আসছি। জানো, আমার চাকরিটা না চলে গেছে, কাকাও মারা গেল, কি যে হবে! তার মধ্যে আর এইসব মামলা-মোকদ্দমা ভাল লাগছে না। মা যতদিন বেঁচে ছিল, মাও তো চায়নি।‘ সুবিমল সব কাগজপত্র দিয়ে চলে গেল। এও হয় ! এ যে মেঘ না চাইতেই জল। বাড়ির মামলা তাহলে মিটলো। এবারে বাড়িটাকে মনের মত করে সারানো যাবে। তিনিই এখন মালিক, বিক্রিও করে দিতে পারেন, করলে অবশ্য বড়দিকেও ভাগ দেবেন, ওদের খুব খারাপ অবস্থা। অনেকদিন ধরে তেওয়ারি বলে একটা প্রোমোটার ছুঁকছুঁক করছে। তিনি ভাল করেই জানেন এ বাড়ি বিক্রি করলে কোটি খানেকের বেশি টাকা পাওয়া যাবে।
খুশিমনে কালিপদবাবু আবার ইজি চেয়ারটায় এসে বসেন। সামনে সাদা পাতাটা খোলা আর তার ওপর পেনটা রাখা। আর কবিতা লেখা হল না। আলগোছে পেনটাকে হাতে তুলে নেন তিনি, অদ্ভুত তো পেনটা! এটার মধ্যে কি জাদু আছে? কেনার পর থেকেই তো একের পর এক সুখবর! পেনটাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে থাকেন কালিপদবাবু ।
পরদিন সকালে কাজের মেয়ে কলি বারবার দরজা ধাক্কা দিয়েও কোন সাড়া পেল না। একা থাকে মানুষটা, কি হল! লোকজন ডেকে আনল সে, দরজা ভেঙ্গে ভেতরে ঢুকতেই খাটে শোয়া অবস্থায় কালিপদবাবুকে পাওয়া গেল। শরীরটা প্রানহীন, ঠান্ডা, অথচ মুখে কি সুন্দর একটা হাসির রেখা লেগে আছে। কেউ তো ভয়ে ঘরে ঢুকবে না, কি না কি রোগ হয়েছে। তবে ডাক্তার এসে দেখে বলল, ঘুমের মধ্যেই হার্টঅ্যাটাক। মৃত্যুকে যেন তিনি আলিঙ্গন করে নিয়েছেন খুশিমনে, হাসতে হাসতেই। ডান হাতে তখনও মুঠো করে কি একটা ধরা , কলি দেখে একটা কালো পেন। ইভিনিং স্কুলে পড়ে কলি,পেন সেও ভালবাসে। কৌতুহলবশতঃ চুপিচুপি পেনটা নিজের হাতে নিয়ে দেখে ওরই নাম লেখা আছে পেনটাতে ‘কলি’।অদ্ভুত তো! লোভ সামলাতে পারে না কলি। এ মাসের মাইনেটা গেল, কলি পেনটা ব্লাউজে গুঁজে বিলাপ করে কেঁদে ওঠে। ওদিকে ঘরে তখনও লং প্লেইং রেকর্ডটা কিসের যেন দুঃখে বিদীর্ণ হয়ে কেটে গিয়ে, বেজে চলেছে নজরুলের গাওয়া গানখানি ‘ঘুমিয়ে গেছে শ্রান্ত হয়ে আমার গানের বুলবুলি’।
9 April 2020
কবি না হলেও
রাস্তার বাঁকের মুখের বাড়িটার নাম ‘ওঁ শান্তি’, গৃহকর্তা হলেন সুখেন রায়। ভালমানুষ চেহারার মানুষটি সবসময় পিসিমার ভয়েই অস্থির হয়ে থাকেন আর রোজই কিছু না কিছু গুলিয়ে ফেলেন। এহেন সুখেন রায় একদিন একটা কবিতা লিখে ফেললেন।কিন্তু দুঃখের বিষয়, পিসিমা ঠিক জানতে পেরে গেলেন। ‘হ্যাঁরে সাখু, কি লিখছিলি রে সকাল থেকে?’বুকটা ধক করে উঠল সুখেনের। ‘ও কিছু না পিসিমা।‘ ‘কিছু না কি রে ?স্পষ্ট দেখলাম, লিখছিলি।দেখা বলছি।‘পিসিমার রক্তচক্ষু উপেক্ষা করার সাহস নেই। লেখাটা একটু পালিশ করবেন ভেবেছিলেন,তা আর হল না।ব্যাজার মুখে নিজের লেখা প্রথম কবিতাটা দেখাতেই হল। একটা নির্মল আনন্দ আর উত্তেজনায় ফুলে উঠেছিল বুকটা, সেসব এখন চুপসানোর যোগাড়। অপরাধীর মত মুখ করে পিসিমার হাতে খাতাটা তুলে দিলেন।পিসিমা ধমকে উঠলেন,’আমার চশমা নেই, পড়ে শোনা।‘ অগত্যা তাই শোনালেন। শুনতে শুনতে পিসিমার চোখমুখের রাগী রাগী ভাবটা দ্রুত পাল্টে একটা খুশি খুশি ভাব জেগে উঠল।সুখেন অবশ্য সেসব দেখতে পেলেন না।পড়া শেষ করে পিসিমার দিকে ভয়ে ভয়ে তাকাতেই,পিসিমার আবার সেই রাগীভাব ফুটে উঠল,কিন্তু আগের মত নয়।বললেন ‘সংসারের কাজকর্ম সব চুকিয়ে ফেললি তাহলে!অবশ্য করছিলিও যে কত !তা কবিতা ফবিতা না লিখে এবার একটু বাজারে বেরিয়ে পড় দিকি।’। মনটা খারাপ হয়ে গেল সুখেনের।কবিতা লেখা পৃথিবীতে যেন ঘোর অন্যায়, কাজ ফাজ না থাকলেই বোধ হয় শুধু লোকে কবিতা লেখে।আর রোজ রোজ অত বাজার করারই বা কি আছে?বাড়িতে তো মোটে জনাপাঁচেক প্রাণী।তার মধ্যে বাবা তো সারাদিন বই মুখে করে বসে আছে।সংসারের খবর রাখেনই না।যা মুখের সামনে ধরা হয় বিনা বাক্যব্যায়ে খেয়ে নেন। গিন্নি সারাদিন গানের ক্লাস নিয়েই ব্যাস্ত।তিনি তো নাওয়া খাওয়ার সময়ই পান না।আর একমাত্র ছেলে সাবু স্কুল থেকে ফিরেই কার্টুন চ্যানেল চালিয়ে বসে যায়।ওসব দেখতে দেখতেই খায়।কি খাচ্ছে সেদিকে হুঁশ থাকে না।পিসিমা নিজে তো নিরামিষ এক তরকারি ভাত আজ কত বছর ধরে খেয়ে আসছেন।তাহলে এত বাজার ,এত রান্না কিসের জন্য?ফালতু কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা খরচা।কিন্তু সেসব বোঝাবেন কাকে?পিসিমার এইরকম দোর্দন্ড প্রতাপ,বাড়ির লোকজনের এরকম উপেক্ষা,জীবনটাই নিমপাতা হয়ে গেল।
সুখেনের ছেলে সাহেবের ওপর কিন্তু এত বাধানিষেধ,বকাঝকা,শাসণ কোনটাই নেই,তার সাতখুন মাফ।পিসিমা তাকে মাথায় তুলেছেন। এখন সুখেন কিছু বললেও সাবু মোটেই গ্রাহ্যি করে না,উল্টে ভয় দেখায় ‘ঠাকুমাকে বলে দেব কিন্তু।‘সুখেন চুপসে যান।ওদিকে গিন্নিও আজকাল পিসিমার ভয় দেখান।সেদিন সুখেন বলতে গেছিলেন ,’সারাদিন গানের ক্লাস না করে ছেলেটার দিকে একটু নজর দাও না।‘গিন্নি বললেন,’কেন,পিসিমা আছে তো।‘সুখেন আরও দু’এক কথা শোনাতে গিয়েছিলেন।গিন্নি তার আগেই বকে দিলেন,’সেদিন লুকিয়ে ছাদে সিগারেট খেয়েছিলে,সব জানি।পিসিমাকে বলে দেব নাকি?’ এরপর আর কথা চলে না।মানে মানে পালিয়ে এসেছিলেন।
কেউ তাকে আর মানুষ বলেই মনে করে না।তার ওপর আবার পিসিমার ‘সাবু’ আর ‘সাখু’ ডাকদুটো কাছাকাছি হওয়ায় তিনি সবসময় বুঝে উঠতে পারেন না,প্রায়ই গুলিয়ে ফেলেন।ছেলেকে যা বলা হয়েছে,তা নিজে করতে গিয়ে বোকা বনে গিয়ে হাসির খোরাক হন।আবার তাকে যা বলা হয়েছে, তা ছেলের জন্য ভেবে বসে থেকে,ভয়ানক ঝাড় খান।কপালটাই খারাপ ,সব পুরো ঘেঁটে গেছে। শুধু একটু কবিতা লিখবেন ভেবেছিলেন,তাও কেউ হতে দিল না।
মনের দুঃখে ডাস্টবিনে খাতাটার গতি করতে যাবেন,হঠাৎ পেছন থেকে কার ডাক,’বাবা সুখেন’। এই নামে এরকম ডাক !এ তো মা ডাকত।বিশ বছর আগে, শেষবার। ‘মা’ বলে ভুল করে ডেকে, পেছন ফেরেন সুখেন।দেখেন পিসিমা।‘খাতাটা ছিঁড়ে ফেলিস না সুখেন ।বড় ভাল লিখেছিস রে।তুই কবিতা লিখবি,যত খুশি লিখবি।কেউ তোকে বারন করবে না বাবা।‘এ কি!এ পিসিমা যে অন্য পিসিমা।সুখেন কি করবেন গুলিয়ে ফেলে, শেষে পিসিমাকে ঢিপ করে একটা প্রণাম করে ফেলেন। পিসিমাও আদরের সাখুকে বুকে জড়িয়ে ধরেন,দুজনের চোখেই তখন জল।
Subscribe to:
Posts (Atom)