27 October 2020

ক্যানভাস

বর্ধমান শহরের কাঞ্চননগর গ্রাম। সেখানে রয়েছে দেবী দূর্গার এক বহু পুরোনো মন্দির, যা খুবই জাগ্রত বলে শোনা যায়। প্রতি বছর দূর্গাপুজোর সময় সেখানে আঠেরো দিন ধরে বিশাল ধুমধাম করে পুজো হয়। অনেক দূর দূরান্ত থেকে মানুষজন দেখতে আসে। শোনা যায় বর্ধমানরাজ চিত্রসেন নাকি মায়ের স্বপ্নাদেশ পেয়ে এই মন্দির সতেরোশো পঞ্চাশ সালে তৈরি করেছিলেন। এত প্রাচীন এই মন্দিরের অবস্থা এখন জরাজীর্ণ হলেও, ইদানিং কিছুটা যত্নের ছাপ পড়েছে। মন্দিরের ভেতরে রয়েছে দেবী দূর্গার অষ্টধাতুর মূর্তি। সারা বছর স্থানীয় পুরোহিত স্বপন ভট্টাচার্য্যই এই মন্দিরের দেখাশোনা, পুজোআচ্চা করেন। দূর্গাপুজো এগিয়ে আসছে। গ্রামের পুজো কমিটির মিটিং ডাকা হল। কর্তাব্যক্তিরা সবাই হাজির, ঠাকুরমশাইকেও ডাকা হয়েছে। শ্যামল সামন্ত গ্রামের সবচেয়ে গণ্যমান্য লোক। যেমন তার আর্থিক প্রতিপত্তি, তেমনি লোকবল। প্রচুর জমিজমা ছাড়াও ট্রাক্টার, ডাম্পার পর্যন্ত রয়েছে, মাসে হেসেখেলে লাখখানেক টাকা রোজগার। মন্দিরের সামনের যে চাতালটায় বসে মিটিং হচ্ছে, সেটাও তিনিই বানিয়ে দিয়েছেন। মন্দিরের বাইরেটা ঘিরে গ্রিলের দরজা পর্যন্ত তারই পয়সায় করা। পুজো নিয়ে এখনও শেষ কথা তারই। শ্যামলবাবু বললেন, 'এবার পুজোয় ভাবছি আঠেরো দিনই ভোগ রান্না হবে, গোটা গ্রামের লোক এসে প্রসাদ খেয়ে যাবে। কারো বাড়িতে আর রান্নাবান্না করার দরকার নেই। কি বলেন পঞ্চাননবাবু ?' পঞ্চাননবাবু গ্রামের সবচেয়ে বয়োঃজ্যেষ্ঠ, খুবই সম্মানীয় মানুষ, স্কুলশিক্ষক ছিলেন। তিনি বললেন, 'সে তো ভালই। তবে অনেক খরচের ব্যাপার যে।গোটা গাঁয়ের লোকের প্রসাদের ব্যবস্থা করা কি চাট্টিখানি কথা? অত রান্নাই বা কে করবে?' 'ও আপনাকে কোন চিন্তা করতে হবে না। ঠাকুরমশাইকেই দায়িত্ব দিয়ে দিচ্ছি। ঠাকুরানি আছেন। ওনার সঙ্গে বাড়ির মেয়ে বউরাও হাত লাগাবে। ও সব ঠিক হয়ে যাবে। কি ঠাকুরমশাই?' শ্যামলবাবু ভটচাজবাবুর দিকে তাকান। ভটচাযবাবু বললেন, 'হ্যাঁ, সে ঠিক আছে। কিন্তু যদি অনুমতি দেন, একটা কথা বলব?' 'বলে ফেলুন', শ্যামলবাবু বললেন। 'মানে, বলছিলাম কি, এতদিন ধরে তো পুজো। এতরকম জোগাড়-যন্তর। সব একা একা আর পেরে উঠি না, বয়স হচ্ছে তো। যদি আমার ছেলেটাকেও আমার সঙ্গে রাখি, তাহলে বড় ভাল হয়। ও তো বড় হয়েছে, আমাকে বেশ সাহায্য করতে পারবে।' 'ও,এই ব্যাপার! এ তো ভাল কথা। তা আপনার ছেলের নামটা কি যেন?' 'অভিষেক' 'বাঃ বাঃ। খুব ভাল। তাহলে তাই হবে। তাছাড়া রান্না আর অন্যান্য যোগাড় যন্ত্রের জন্য ক্লাবের ছেলেরা তো আছেই। কি বলেন?' সবাই একপায়ে রাজি। শেষে সব ঠিকঠাক হয়ে গেল, পুজোর খরচের সিংহভাগই দেবেন শ্যামলবাবু। গণ্যমান্য বাকিরা মিলে বাকিটুকু। গাঁয়ের লোকের থেকে চাঁদাপত্র কোনদিনও নেওয়া হয়না এই পুজোয়। বাড়ি গিয়ে ভটচাজবাবু খুশি হয়ে গিন্নিকে ডেকে বললেন, 'শুনছ,এবার বড় করে পুজো হচ্ছে গো! আঠেরো দিনই ভোগ রান্না হবে। গ্রামসুদ্ধ সবাই খাবে। আর আমাদের তিনজনকেই অনেক দায়িত্ব দিয়েছে গো।' 'তাই নাকি? এ তো ভালো কথা। তো আমাদের কি কি দায়িত্ব দিয়েছে শুনি?' 'পুরো রান্নার দায়িত্ব তোমার, বুঝলে?' 'হ্যাঁ! আমার! আমি একা এত পারব কি করে?' 'আরে চিন্তা করছ কেন? সব হয়ে যাবে তাছাড়া তো গাঁয়ের মেয়ে বউরাও তোমাকে সাহায্য করবে।' ' দেখি, যা কোমরে বেদনা! তা আর কি বলেছে শুনি?' ' অভিও এবার থেকে আমার সঙ্গে মায়ের পুজোর দায়িত্বে থাকবে। ওদের বলে ক'য়ে ঢুকিয়ে নিয়েছি। আর চিন্তা নেই ছেলেটার, কি বল?' 'তাই নাকি? তা বেশ করেছ।' ভটচাজবাবু হেসে কিছু একটা বলতে যাবেন, তখনই অভিষেক ঘরের ভেতর থেকে পায়ে পায়ে বেরিয়ে আসে। পাশের গ্রামের স্কুলে ও ক্লাস নাইনে পড়ে। পড়াশোনাতে বরাবরই ভাল। কিন্তু বাপের মত পুজোআচ্চার ব্যাপারে ওর কোনদিনই মন নেই। এদিকে বাবা চান পুরুতগিরিটা ভাল করে ছেলে শিখে নিক, তাতে অন্তত রোজগারের একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে। কিন্তু অভিষেকের এসবে কোনো উৎসাহই নেই। ও খুব সুন্দর ছবি আঁকে,নিজেই শিখেছে। ও বড় হয়ে আর্টিস্ট হতে চায়, অনেক বড় আর্টিস্ট। যদিও ভীষণ লাজুক আর ঘরকুনো বলে, গাঁয়ের কেউই ওর এই বিশেষ গুণটা সম্পর্কে তেমন কিছু জানেই না। অভিষেক বলল, 'কেন বাবা? আমাকে এসবের মধ্যে কেন ঢোকাচ্ছ? পুজোর পরেই তো আমার ফাইনাল পরীক্ষা, জান না?' 'তুই থাম দিকি। এত কষ্টে একটা মওকা বুঝে, তোর একটা হিল্লে করে দিলাম, আবার বড় বড় কথা বলছিস?', রেগে বলেন ভটচাজবাবু। অভিষেক বলে, 'সারাদিন মন্দিরে থেকে, ওইসব আমি করতে পারব না। আমি পুজোআচ্ছা পারিনা।' 'পারিস না! ওগো, এ কি বলছে দেখ গো বামুনের ছেলে হয়ে! ছি, ছি, এ কথা বলতে পারলি? মার মন্দিরে পুজোর দায়িত্ব পেলি, কোথায় বর্তে যাবি, তা না।' স্তম্ভিত ভটচাজবাবু। 'আমার ওসব ভাল লাগে না বাবা।', অভিষেক আপ্রাণ বোঝাতে চেষ্টা করে। 'ভাল লাগে না! তো কি ভাল লাগে শুনি? ছবি আঁকতে, না? শুধু ছবি এঁকে তোর পেট চলবে নাকি?' চিৎকার করে ওঠেন ভটচাজবাবু। বাবা-মার বকুনি খেয়ে, মন খারাপ করে, শেষে চুপচাপ নিজের ঘরে ঢুকে যায় অভিষেক। এই ঘরটাই ওর কাছে মন্দির। চারিদিকে ছড়ানো রং-তুলি, ইজেল, ড্রইংয়ের খাতা আর দেওয়াল ভর্তি ওর আঁকা অসাধারণ সব পেন্টিং। পড়াশোনার বাইরে এটাই ওর নেশা, প্রাণমন তাতেই ঢেলে দেয় ও। মনের আনন্দ বা দুঃখ সবেতেই ছবি আঁকাটাই ওর একমাত্র মুক্তির পথ। ওর আঁকার হাত দেখে, স্কুলের হেডস্যার শ্যামাপদবাবু ওকে কলকাতায় একটা বড় প্রতিযোগিতায় ছবি এঁকে পাঠাবার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। অর্গানাইজাররা ওই প্রতিযোগিতার প্রথম তিনজনকে বিশেষ এক্সিবিশনের সুযোগ করে দেবে আর কলকাতার আর্ট কলেজে আঁকা শেখারও ব্যবস্থা করে দেবে। সেই স্বপ্নেই এখন মশগুল অভিষেক। বড় ক্যানভাসটা কলকাতা থেকে হেডস্যারই আনিয়ে দিয়েছেন। খুব যত্নে সেটা তুলে রেখেছে অভিষেক, এবারে ওটাতেই ও আঁকা শুরু করবে। স্যার বলেছেন, 'আঁকার সময় শুধু চোখ আর হাত দিয়ে নয়, হৃদয় দিয়ে আঁকবি রে অভি, তাহলেই সে সৃষ্টি সার্থক হবে।' ওদিকে পুজোর প্রস্তুতি প্রায় সারা। চারিদিকে সাজো সাজো রব। ছোট একটা প্যান্ডেল বাঁধা হয়েছে, খাবার জায়গায় আলাদা প্যান্ডেল, আর এক কোণে ভোগ রান্নার ব্যবস্থা। বাজার দোকানও গ্রামের ছেলেরা মিলে প্রায় করে ফেলেছে, মহানন্দ চারিদিকে। পঞ্চাননবাবু ঘুরে ফিরে সব তদারকি করছেন, কোথাও যেন কোন ফাঁকি না থেকে যায়। গ্রামের ছেলেবুড়ো কচিকাঁচারা সব এদিক-ওদিক উঁকিঝুঁকি মেরে দেখে যাচ্ছে, সবারই উৎসাহ আগ্রহের শেষ নেই। পঞ্চাননবাবু ছেলেছোকরাদের মাঝেমধ্যেই ধমকাচ্ছেন, 'কিরে বিশে, এখনো প্রদীপ, ধামা কিছুই এল না?', 'এই শ্যামা, জলের জগগুলো সব এভাবে রেখেছিস কেন?', এইসব চলছে। ঠাকুরমশাই ভটচাজবাবু ধুপ-ধুনো আর যজ্ঞের কাঠের হিসেব মিলিয়ে নিতে নিতে, হেসে বললেন, 'বুঝলে পঞ্চাদা, এবার দেখবে কেমন আড়ম্বরে পুজোটা করি। ছেলেটাও থাকবে সঙ্গে, অনেক সুবিধে হবে।' পঞ্চাননবাবু বলেন, 'হ্যাঁ তা তো করবেই। এত বড় করে পুজো হচ্ছে, কত লোক দেখতে আসবে কত দূর দূর থেকে। শুনলাম টিভি থেকেও নাকি ছবি তুলতে আসছে।' সেদিন পঞ্চমী, রাত পোহালেই ষষ্ঠী। হঠাৎই ভোরবেলা কোথা থেকে হৈ হৈ, চিৎকার-চেঁচামেচি ভেসে এল। দাবানলের মত দুঃসংবাদটা ছড়িয়ে পড়ল চারিদিকে। মন্দিরের বাইরের লোহার গ্রিলের দরজা কাটা, মন্দিরের জানলা ভাঙ্গা। তড়িঘড়ি ঠাকুরমশাইকে খবর দেয়া হল। উনি মূল দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে দেখলেন, যা ভয় করা হয়েছিল ঠিক তাই। অষ্টধাতুর দূর্গামূর্তি আর লক্ষীমূর্তি দুটোই গায়েব। সবার মাথায় বজ্রাঘাত হল। পুজোর আগের দিন বিগ্রহ চুরি গেল। হায় হায় করে উঠল সবাই। সব আনন্দ-উৎসব তো তাহলে বন্ধ! কি হবে এখন? সারা বছরের সব অপেক্ষা শেষে এক মুহূর্তে এইভাবে ধূলিসাৎ হয়ে গেল! শোকের ছায়া নেমে এল সারা গ্রামে, ঘরে ঘরে অরন্ধন। থানায় খবর দেওয়া হল, পুলিশ কুকুর এল। কিন্তু চারদিকে খোঁজাখুঁজি করেও কোন সূত্র পেল না কেউ। ভটচাজবাবু তো একেবারে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন। সবার মনে একটাই প্রশ্ন, পুলিশ যা করার করছে, কিন্তু পুজোর কি হবে? বিগ্রহ ছাড়া তো আর পুজো হয়না। কেউ তো আর কখনও ভাবতে পারেনি, যে এভাবে বিগ্রহ চুরি হয়ে যেতে পারে! এত প্রাচীন অষ্টধাতুর জাগ্রত দূর্গামূর্তি শেষে চোরাবাজারে বিক্রি হয়ে যাবে? আসলে প্রতি সন্ধেয় আরতির পর, মন্দিরে তালাচাবি দিয়ে ভটচাযবাবু বাড়ি চলে যান। তাছাড়া কোন নাইট গার্ডের ব্যবস্থা নেই, জায়গাটাও নির্জন। তাই দুষ্কৃতীদের কাজটা সহজ হয়েছে। সব শুনে মন্দিরে চলে এসেছে অভিষেকও, ওরও মনটা খারাপ। পুরুতগিরি ওর পছন্দ না হলেও, বাবার সঙ্গে প্রায়ই মন্দির আসে। পুজো, আরতি, হোম এসব দেখে। টুকটাক সাহায্যও করে পুজোর কাজে, সবাই যেমন করে। আসলে জন্ম থেকে এই মন্দির আর দেবী দূর্গার মূর্তি ওদের হৃদয়ে স্থান পেয়েছে, ওর ঘরেও টাঙানো আছে দূর্গামূর্তির একটা ছবি। সেই দূর্গাপুজো হবে না! তাও পুজোর ঠিক আগের দিন! ব্যাপারটা মেনে নিতে পারছিল না কেউই। সকলে ভিড় করে মন্দির চত্বরে দাঁড়িয়ে রয়েছে, গ্রামের মেয়ে-বৌরা কান্নাকাটি করছে, শিশু থেকে বুড়ো সবার চোখে জল। অভিষেক বাবাকে জিজ্ঞেস করল, 'বাবা, পুজো কি তাহলে আর হবে না?' ভটচাজ বাবু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,'নাঃ, আর তো কোন উপায় দেখছি না। সব শেষ হয়ে গেল রে অভি।', বলে চশমাটা খুলে রুমাল দিয়ে চোখ মুছতে লাগলেন। কথাগুলো সহ্য করতে পারল না অভিষেক, এক ছুটে বাড়ি গিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা দিয়ে দিল। সারাদিন আলাপ-আলোচনাতেই কেটে গেল, কোন সুরাহা বেরোল না। পুলিশ বলছে, তদন্ত চলছে। কয়েকজন অত্যুৎসাহী থানায় গিয়েছিল জানতে, থানা থেকে ভাগিয়ে দিল সবাইকে। মন্দিরের চাতালে জড়ো হওয়া কর্তা-ব্যক্তিরা নীচু গলায় নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছিলেন। পঞ্চাননবাবু বললেন, 'আমি তো ভাবতেও পারছিনা, আমাদের গ্রামের মন্দিরে এভাবে চুরি হতে পারে! কে করতে পারে চুরিটা বলুন তো?' সকলে চুপ। শ্যামলবাবু বললেন, 'যা হবার সে তো হয়েছে, এবার পুজোর কি হবে সেটা বলুন দিকি।' পোস্টমাস্টার সুবিমলবাবু খুব পন্ডিত মানুষ, সারাদিন মোটা মোটা বই পড়েন। তিনি বললেন, 'পুলিশ তো কিছু করতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না। অন্তত রাতারাতি মূর্তি উদ্ধার করার কোন আশা দেখছি না।' শ্যামলবাবু ব্যাজার মুখে বললেন, 'তাহলে আর কি হবে বলুন। পুজোর মুখে এরকম ঘটনা, আমার তো কিছু মাথায় আসছেনা।' বয়স্ক কয়েকজন বললেন, 'এ বড় অশুভ ঘটনা। দূর্গামূর্তি এত জাগ্রত ছিল এই গ্রামে, এখন কোন অঘটন না ঘটে।' শেষে সকলে চিন্তিত মুখে, ভয়ে ভয়ে বাড়ি চলে গেল। সবার মনে উদ্বেগ, বুকে ঝড়। পরের দিন ষষ্ঠী, সকালে আবার পুলিশের এনকোয়ারি। ভটচাজবাবুকে আবার তালা চাবি খুলে দিতে বললেন ওসি। তালা খুলে ভেতরে ঢুকতে, মূল দরজার সামনে এসে সবাই বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল। মন্দিরের দরজার গায়ে, হেলান দিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখা রয়েছে বিরাট ক্যানভাসে আঁকা অবিকল দূর্গামূর্তিটার একটা ছবি। কোন পার্থক্যই করা যাচ্ছে না আসলটার সঙ্গে। সবাই তো অবাক, কে আঁকল এত সুন্দর ছবি! আর এখানে রেখে গেলই বা কখন! ছবিটা মন্দিরের ভেতরে নিয়ে যাওয়া হল। কোথায় রাখবেন ঠিক করতে না পেরে, ভটচাজবাবু ছবিটাকে শূন্য বেদীটার উপরেই রেখে দিলেন। লোকজন ততক্ষণে খবর পেয়ে, ভেঙে পড়েছে মন্দিরে। আসল মূর্তি যতদিন না পাওয়া যাচ্ছে, তার অবিকল প্রতিমূর্তিকেই পুজো করা হোক, সকলের এটাই দাবি, অন্যরাও তাতে মত দেন। দুঃখের মধ্যেও আনন্দের হিড়িক পড়ে যায় গ্রামে, মুখে মুখে রটে যায় 'পুজো হবে'। দ্বিগুন উৎসাহে ঝাঁপিয়ে পড়ে ছেলে-বুড়ো সবাই। শ্যামলবাবু হেসে বললেন, 'ওফ্ , অবশেষে একটা ব্যবস্থা হল। মূর্তির বেদীটা খালি দেখতে, বড্ড কষ্ট হচ্ছিল।' সুবিমলবাবুও সায় দিয়ে বললেন, "হ্যাঁ, যা বলেছেন। শেষ পর্যন্ত যে পুজো হবে, এই ঢের। কি যে মনটা খারাপ হয়েছিল কাল থেকে, কি বলব।' শ্যামলবাবু বললেন, 'সে আর বলতে? কাল মশাই, সারারাত ঘুমই এল না ঠিকমত। কি যে কষ্ট, বলে বোঝাতে পারব না।' পঞ্চাননবাবু বললেন, 'শুধু আপনার নয় শ্যামলবাবু, গোটা গাঁয়ে কারো বাড়িতে কাল হাঁড়ি চড়েনি। ছেলে-বুড়ো কারো চোখের জল বাঁধ মানে নি।''ঠিক বলেছ', সুবিমলবাবু বলে ওঠেন, 'তা স্বপন, পুজোতে কোন সমস্যা নেই তো ?' ভটচাযবাবু বলেন, 'এই ছবিতেই পুজো হবে, কোন দোষ নেই। যতদিন না আসল মূর্তি উদ্ধার হচ্ছে।' পঞ্চাননবাবু বললেন, 'কিন্তু এত সুন্দর এই ছবিটা আঁকলই বা কে? আর এখানে রেখে গেলই বা কখন, সেটাই তো বুঝতে পারছিনা।' ভটচাজবাবু কোন উত্তর দিলেন না। সব লোকজনের ভীড়ের মধ্যে খুঁজতে খুঁজতে, এক কোণে পাড়ার ছেলেছোকরাদের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা অভিষেকের দিকে নজর পড়ে গেল। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকাতেই, অভিষেক ফিক করে হেসেই মুখটা লুকিয়ে নিল। সেই হাসি তখন ফুটে উঠল ভটচাজবাবুর মুখে, চোখে জল। ঢাক বেজে উঠল মন্দিরের চাতাল থেকে।

No comments:

Post a Comment