আমি আবেগ ও অনুভূতিপ্রবণ,ভাবুক আর সৃষ্টিশীল।জীবনের চলা,ওঠাপড়া আর অভিজ্ঞতা নিংড়োনো এই সব লেখা ।এ আমার পাগল মনের নিঃশেষিত প্রকাশ।
22 April 2020
জন্মদিন
আজ সৈকতের জন্মদিন। তবে আজকাল আর এসবের খেয়াল রাখে না ও। জীবনটা তছনছ হয়ে গেছে। বাবা-মা দুজনেই মারা গেলেন, পিঠোপিঠি এক বছরের মধ্যেই। আর তার ক'দিন পরেই শ্রাবন্তীর সঙ্গে মিউচুয়াল সেপারেশনটাও হয়ে গেল। তাও এক বছর হতে চলল। তবে রুপা আসে মাঝে মাঝে, স্কুলের ছুটিতে। গোটা দিনটা ওর সঙ্গে কাটিয়ে, বিকেলেই ফিরে যায়। শ্রাবন্তীই ওকে পৌছে দিয়ে চলে যায়, কিন্তু নিজে ঢোকেনা এ বাড়িতে, নিয়ে যাবার সময়ও। দীর্ঘদিন বাক্যালাপ নেই দুজনের ।
আজ যে ওর জন্মদিন, সেটা অবশ্য ভোরবেলাতেই মনে পড়ে গেল সৈকতের। না, কেউই আজ এখনও বার্থডে উইশ করেনি। আর করবেই বা কে? এক রুপা ছাড়া। আসলে আজকাল বহু শপিং সাইটই জন্মদিনের মেসেজ পাঠায় সকাল-সকাল।ওর ব্যাঙ্ক, এমনকি ওর কোম্পানি পর্যন্ত। তারপর ফেসবুক খুললে তো বড় বড় করে জন্মদিনের শুভেচ্ছা। সুতরাং ভুলে থাকা আর হল না সৈকতের।
যা হোক জন্মদিন বলে কথা। কত যেন হল বয়সটা ? হিসেব করতেই সৈকতের ঠোঁটে একটা দুঃখ মেশানো হাসি ফুটে উঠল। এই একবছরে শরীরের বয়স যত না বেড়েছে, মনের বয়স বেড়েছে তার বহুগুণ। একা থাকার যন্ত্রণা নিয়ে এই একটা বছর কেটে গেছে বড় অনাড়ম্বরে, আরো কত বছর যে এইভাবে কাটাতে হবে!
সৈকত ভাবল, প্রথমেই মা বাবার ছবিতে গিয়ে একটা প্রণাম সেরে আসবে। যতদিন ওঁরা জীবিত ছিলেন, এটাই তো করত দিনের শুরুতে। ছোটবেলায় এই দিনটায় মা সক্কাল বেলায় ঘুম থেকে উঠিয়ে দিয়েই জন্মদিনের কথা মনে করিয়ে দিত। তারপর জড়িয়ে ধরে দু'গালে দুটো চুমু খেত, বাবাও। মা বলত,' যাও মুখ হাত ধুয়ে আগে বাবা মাকে প্রণাম করে নেবে।' সৈকতের মনটা খুশিতে নেচে উঠত, আজ স্পেশাল দিন। মা সেদিন দারুন দারুন সব রান্না করত। বাবা সকালেই এলাহি বাজার করে নিয়ে আসত। তারপর মা বানাত লুচি-আলুর দম আর বিকেলে কেক। বাবা এইদিনটা অফিস ছুটি নিত। দুপুরে নানা রকমের রান্না করে, দশটা বাটি সাজিয়ে, বড় কাঁসার পদ্মকাটা থালায় ভাত দিত মা। থালার ঠিক মাঝখানে বাটি উপুড় করে গোল শেপের ভাত। সবকটা পদ একটু করে টেস্ট করতেই হত সৈকতকে। মা বলত, 'কত কষ্ট করে সারাদিন ধরে রান্না করলুম, অন্তত একটু মুখে দিয়ে দেখ বাবা।' খেয়ে দেয়ে বাবা-মার সঙ্গে বেরোনো। হয় ছোটদের সিনেমা, নয়তো পার্কে ঘুরতে যাওয়া। এই সময়টাই ছিল ওর সবচেয়ে আনন্দের। ফেরার সময় নিউমার্কেটের বড় খেলনার দোকানে ওকে নিয়ে ঢুকত বাবা। ওর পছন্দের একটা দারুন খেলনা, তা সে যত দামীই হোক না কেন, কিনে দিত বাবা। বড় হয়ে যাবার পর আর কিছু থাক না থাক, সকালবেলা বাবা-মার চুমু আর প্রণামটা কিন্তু ছিলই।
বিয়ের পরে, পুরনো ট্র্যাডিশন বজায় রেখেছিল শ্রাবন্তীও, কোন কিছুতেই ছেদ পড়েনি, রুপা হবার পরেও নয়। সবাই মিলে কত কিইনা হত সারা দিনটাতে। হইচই ,আনন্দ, উপহার, দারুন দারুন খাবার, বিকেলে ঘুরতে বেরোনো, বড় রেস্তোরাঁয় ডিনার সারা ,একেবারে জমজমাট প্রোগ্রাম। শ্রাবন্তী সারপ্রাইজ গিফট দিত একটা। আশ্চর্য ব্যাপার, সৈকত যেটা ক’দিন ধরেই কিনব কিনব ভাবছিল, কিন্তু কোন না কোন কারণে কেনা হচ্ছিল না, সেটাই শ্রাবন্তী কিনে এনে হাজির করত। একটা সাধারণ স্কুলে পড়িয়ে, জমানো সব ক’টা টাকাই হয়ত সেদিন শেষ করে ফেলত ও। বাবা-মার ততদিনে বয়স হয়েছে, ওঁনারা আর কোথাও বেরোতে চাইতেন না। তবু সকালে উঠে ওঁনাদের প্রণাম করা দিয়েই দিনটা শুরু হত। শ্রাবন্তীর আবদারে ওই দিনটা ছুটি নিতেই হত সৈকতকে।
কিন্তু আজ? আজ আর কেউ নেই, কোথাও নেই। আজ একা একা জন্মদিনটা হয়ে গেছে বড়ই জৌলুসহীন, বিরক্তিকর। আজও তাই অফিস ,আজও ক্যান্টিনের ঘ্যাঁট আর মাছের ঝোল । আউটিং,শপিং, গিফট তো কবেই বন্ধ হয়ে গেছে। সময় থাকতে যদি সংসারের ভাঙ্গনটা রোখা যেত! মেনে নিত না হয় আরো কিছু, পাল্টে নিত না হয় নিজেকেও। ভুল কি আর শুধরোনো যায় না? কিন্তু রূপা? ওকে কেন ছিনিয়ে নিল শ্রাবন্তী? রুপা তো সৈকতের চোখের মণি ছিল, কি দোষ ছিল মেয়েটার?
ফ্রেশ হয়ে একটা মোটামুটি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন পাঞ্জাবী পায়জামা পড়ে নিল সৈকত। আগে তো পাটভাঙ্গা নতুন পাঞ্জাবী পায়জামাই পড়ত এই দিনটায়। আগে থেকেই তা কিনে রাখা থাকত। ঠিক খেয়াল থাকত মার, পরে শ্রাবন্তীরও। আজ সেসব আর কোথায়? মা-বাবার ছবিতে ফুল দিয়ে প্রণামটা সেরে, আবার পাঞ্জাবী পায়জামা খুলে ফেলে, অফিসের জামাকাপড় পড়তে হবে। অফিস যাবার সময়ও হয়ে যাবে ততক্ষনে। ছুটি নিয়ে আর কি হবে? আজ আর পাঁচটা দিনের মতোই একটা সাধারন দিন। কাজের মেয়েটা জলখাবার বানিয়ে দেয় এসময়। রান্নাঘরে তারই ঠুংঠাং শব্দ।
প্রতিবারই নতুন এক একটা ভাবনা এসে ভিড় করে মা-বাবার ছবিটার সামনে এসে দাঁড়ালে। এবারও সেই একই। মা যেন কি একট বলতে চাইছে, বাবা যেন মৃদু হেসে আশীর্বাদ করছে। 'কি বলছ মা?’, কান পেতে শুনতে চাইল সৈকত । প্রণাম করে মাথাটা তুলে অনেক কষ্টে অনুভব করার চেষ্টা করল, গালদুটো কি একটু ভিজে লাগছে? বুড়ো বাবা-মা যেমন শেষদিকে ভিজিয়ে দিত জন্মদিনের সকালে হাম খেয়ে? নাঃ, কিন্তু তার বদলে স্পষ্ট শুনল, মা যেন বলছেন ‘বাবা, এই নে, পায়েসটুকু খেয়ে নে। আজ যে তোর জন্মদিন।‘ চোখটা ভিজে গেল সৈকতের। মা? পায়েস ?কোথা থেকে আসবে? সব শেষ হয়ে গেছে।
কিন্তু অদ্ভুতভাবে সৈকতের নাকে তখনই ভেসে আসতে লাগল পায়েসের সুগন্ধ। কোথা থেকে আসছে ?কি ব্যাপার? পিছন ঘুরতেই চমক। একহাতে পায়েসের বাটি আর অন্য হাতে প্রসাদী ফুল-মিষ্টি প্লেটে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রূপা। স্নান করে, শাড়ি পড়েছে বলে কত বড় দেখাচ্ছে। ‘একি তুই? কখন এলি?’ সৈকত অবাক। ‘এগুলো কি?’ রুপা খিলখিল করে হেসে বলল, ‘হ্যাপি বার্থডে বাবা। এই নাও, তোমার জন্য মা পাঠিয়ে দিয়েছে।‘ মা ? আরো একরাশ বিস্ময়। শ্রাবন্তী এখনো মনে রেখেছে?
রূপার হাত ধরে আবার মা-বাবার ছবিটার কাছে গেল সৈকত। মার মুখে তখন যেন এক চিলতে হাসি লেগে রয়েছে, বাবারও চোখ থেকে যেন একরাশ খুশি ঝরে পড়ছে। পাশে তাকাতে, সেই একই হাসিটা সৈকত দেখতে পেল রুপার মুখেও। মেয়ের গালে হাম খেয়ে ভিজিয়ে দিতে দিতে, সৈকতের মনে হচ্ছিল পৃথিবীতে বাবা-মা, ছেলে-মেয়ে এগুলো কোন আলাদা আলাদা সম্পর্ক নয়, সময়ভেদে মিলেমিশে সব এক হয়ে যায়।
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment