9 April 2020

কবি না হলেও

রাস্তার বাঁকের মুখের বাড়িটার নাম ‘ওঁ শান্তি’, গৃহকর্তা হলেন সুখেন রায়। ভালমানুষ চেহারার মানুষটি সবসময় পিসিমার ভয়েই অস্থির হয়ে থাকেন আর রোজই কিছু না কিছু গুলিয়ে ফেলেন। এহেন সুখেন রায় একদিন একটা কবিতা লিখে ফেললেন।কিন্তু দুঃখের বিষয়, পিসিমা ঠিক জানতে পেরে গেলেন। ‘হ্যাঁরে সাখু, কি লিখছিলি রে সকাল থেকে?’বুকটা ধক করে উঠল সুখেনের। ‘ও কিছু না পিসিমা।‘ ‘কিছু না কি রে ?স্পষ্ট দেখলাম, লিখছিলি।দেখা বলছি।‘পিসিমার রক্তচক্ষু উপেক্ষা করার সাহস নেই। লেখাটা একটু পালিশ করবেন ভেবেছিলেন,তা আর হল না।ব্যাজার মুখে নিজের লেখা প্রথম কবিতাটা দেখাতেই হল। একটা নির্মল আনন্দ আর উত্তেজনায় ফুলে উঠেছিল বুকটা, সেসব এখন চুপসানোর যোগাড়। অপরাধীর মত মুখ করে পিসিমার হাতে খাতাটা তুলে দিলেন।পিসিমা ধমকে উঠলেন,’আমার চশমা নেই, পড়ে শোনা।‘ অগত্যা তাই শোনালেন। শুনতে শুনতে পিসিমার চোখমুখের রাগী রাগী ভাবটা দ্রুত পাল্টে একটা খুশি খুশি ভাব জেগে উঠল।সুখেন অবশ্য সেসব দেখতে পেলেন না।পড়া শেষ করে পিসিমার দিকে ভয়ে ভয়ে তাকাতেই,পিসিমার আবার সেই রাগীভাব ফুটে উঠল,কিন্তু আগের মত নয়।বললেন ‘সংসারের কাজকর্ম সব চুকিয়ে ফেললি তাহলে!অবশ্য করছিলিও যে কত !তা কবিতা ফবিতা না লিখে এবার একটু বাজারে বেরিয়ে পড় দিকি।’। মনটা খারাপ হয়ে গেল সুখেনের।কবিতা লেখা পৃথিবীতে যেন ঘোর অন্যায়, কাজ ফাজ না থাকলেই বোধ হয় শুধু লোকে কবিতা লেখে।আর রোজ রোজ অত বাজার করারই বা কি আছে?বাড়িতে তো মোটে জনাপাঁচেক প্রাণী।তার মধ্যে বাবা তো সারাদিন বই মুখে করে বসে আছে।সংসারের খবর রাখেনই না।যা মুখের সামনে ধরা হয় বিনা বাক্যব্যায়ে খেয়ে নেন। গিন্নি সারাদিন গানের ক্লাস নিয়েই ব্যাস্ত।তিনি তো নাওয়া খাওয়ার সময়ই পান না।আর একমাত্র ছেলে সাবু স্কুল থেকে ফিরেই কার্টুন চ্যানেল চালিয়ে বসে যায়।ওসব দেখতে দেখতেই খায়।কি খাচ্ছে সেদিকে হুঁশ থাকে না।পিসিমা নিজে তো নিরামিষ এক তরকারি ভাত আজ কত বছর ধরে খেয়ে আসছেন।তাহলে এত বাজার ,এত রান্না কিসের জন্য?ফালতু কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা খরচা।কিন্তু সেসব বোঝাবেন কাকে?পিসিমার এইরকম দোর্দন্ড প্রতাপ,বাড়ির লোকজনের এরকম উপেক্ষা,জীবনটাই নিমপাতা হয়ে গেল। সুখেনের ছেলে সাহেবের ওপর কিন্তু এত বাধানিষেধ,বকাঝকা,শাসণ কোনটাই নেই,তার সাতখুন মাফ।পিসিমা তাকে মাথায় তুলেছেন। এখন সুখেন কিছু বললেও সাবু মোটেই গ্রাহ্যি করে না,উল্টে ভয় দেখায় ‘ঠাকুমাকে বলে দেব কিন্তু।‘সুখেন চুপসে যান।ওদিকে গিন্নিও আজকাল পিসিমার ভয় দেখান।সেদিন সুখেন বলতে গেছিলেন ,’সারাদিন গানের ক্লাস না করে ছেলেটার দিকে একটু নজর দাও না।‘গিন্নি বললেন,’কেন,পিসিমা আছে তো।‘সুখেন আরও দু’এক কথা শোনাতে গিয়েছিলেন।গিন্নি তার আগেই বকে দিলেন,’সেদিন লুকিয়ে ছাদে সিগারেট খেয়েছিলে,সব জানি।পিসিমাকে বলে দেব নাকি?’ এরপর আর কথা চলে না।মানে মানে পালিয়ে এসেছিলেন। কেউ তাকে আর মানুষ বলেই মনে করে না।তার ওপর আবার পিসিমার ‘সাবু’ আর ‘সাখু’ ডাকদুটো কাছাকাছি হওয়ায় তিনি সবসময় বুঝে উঠতে পারেন না,প্রায়ই গুলিয়ে ফেলেন।ছেলেকে যা বলা হয়েছে,তা নিজে করতে গিয়ে বোকা বনে গিয়ে হাসির খোরাক হন।আবার তাকে যা বলা হয়েছে, তা ছেলের জন্য ভেবে বসে থেকে,ভয়ানক ঝাড় খান।কপালটাই খারাপ ,সব পুরো ঘেঁটে গেছে। শুধু একটু কবিতা লিখবেন ভেবেছিলেন,তাও কেউ হতে দিল না। মনের দুঃখে ডাস্টবিনে খাতাটার গতি করতে যাবেন,হঠাৎ পেছন থেকে কার ডাক,’বাবা সুখেন’। এই নামে এরকম ডাক !এ তো মা ডাকত।বিশ বছর আগে, শেষবার। ‘মা’ বলে ভুল করে ডেকে, পেছন ফেরেন সুখেন।দেখেন পিসিমা।‘খাতাটা ছিঁড়ে ফেলিস না সুখেন ।বড় ভাল লিখেছিস রে।তুই কবিতা লিখবি,যত খুশি লিখবি।কেউ তোকে বারন করবে না বাবা।‘এ কি!এ পিসিমা যে অন্য পিসিমা।সুখেন কি করবেন গুলিয়ে ফেলে, শেষে পিসিমাকে ঢিপ করে একটা প্রণাম করে ফেলেন। পিসিমাও আদরের সাখুকে বুকে জড়িয়ে ধরেন,দুজনের চোখেই তখন জল।

No comments:

Post a Comment