6 April 2020

ছোটিয়া

হঠাৎ দিল্লিতে ট্রান্সফার হয়ে গেল অনীকের।ওর সফটওয়্যার কোম্পানি মাত্র তিন দিনের নোটিশ দিল, চলে যেতে হবে সল্টলেক সেক্টর ফাইভ থেকে নয়ডায়। কলকাতার ছেলে অনীক, বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে রোজ সন্ধ্যেয় একটু আড্ডা না মারলে ভাত হজম হয় না । সেখানে হুট করে একেবারে দিল্লি! একটু মুশড়ে পড়ল ও। কিন্তু চাকরি বড় বালাই, যেতে তো হবেই। বাড়িতে সবারই মন খারাপ। হয়তো মাসে একবার লং উইকেন্ডে বাড়ি আসতে পারবে, অবশ্য তারও ঠিক নেই, যাওয়া-আসার খরচে পোষাবে কি? দিল্লি পৌঁছে নয়ডায়, অফিসের কাছেই একটা গেস্ট হাউসে থাকার ব্যবস্থা করে দিল কোম্পানি। জয়েন করে কাজকর্ম বুঝে নেবার পরে,বস সৌভিকদা বলল, ‘অনীক, আজ তুই জলদি বাড়ি চলে যা ।কোম্পানির গেস্টহাউসে তো তোকে বেশিদিন রাখবে না! অফিসের কাছাকাছি দেখে একটা ঘরভাড়া খুঁজে নে এই ক’দিনে।‘ সৌভিকদাও বাঙালী, তবে অনেকদিন দিল্লিতে আছে ।মোটামুটি সব চেনে। ওই বলে দিল অনীককে, কোন এলাকায় বাড়ি ভাড়া কেমন ,কি সুবিধা-অসুবিধা, কত ভাড়া, খাবার ব্যবস্থা কি রকম ইত্যাদি। একজন দালালের নাম্বারও দিয়ে দিল, কৌশল বলে, দিল্লির লোকাল ছেলে।অনীক ফোন করতেই বলল ,’হাঁ, দাদা,বহোত বড়িয়া ঘর কিরায়েমে মিল জায়গা।হাম দিখা দেঙ্গে। সাথমে খানা ভি মিলেগা।‘ একদিন সকালে, দুজনে বাড়ি দেখতে বের হল। সবই এক কামরার ফ্ল্যাট টাইপের ।এখানে বাড়িভাড়ার প্রচণ্ড চাহিদা বলে, সব বাড়িওলাই এরকম খুপরী টাইপের ঘর আর অ্যাটাচ বাথরুম-কিচেন বানিয়ে বাড়িগুলোকে মডিফাই করে রাখে। বাড়ির বিভিন্ন তলায় এরকম অসংখ্য খুপরিতে অসংখ্য ভাড়াটে চাপাচাপি গাদাগাদি করে থাকে ,কারও একটু হাত পা ছড়ানোর উপায় নেই। দশ ফুট বাই দশ ফুট ঘর,তাতেই খাওয়া-শোওয়া-বসা সবকিছু ।এক চিলতে একটা বাথরুম আর হয়তো বা ততোধিক ছোট একটা কিচেন। পছন্দ হয় না অনীকের। নিজেদের কলকাতার বড় দোতলা বাড়িটায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অভ্যাস। এরকম ঘুপচি অন্ধকার ঘরে ও থাকবে কি করে? কয়েকটা এরকম দেখার পর, রেগেমেগে অনীক বলল ‘আমি এরকম ছোট ঘর চাইনা ।আরো একটু বড় খোলামেলা ঘর নেই?’ কৌশল হেসে বলল,’কোই বাত নেহি দাদা, চলিয়ে মেরা সাথ। কিরায়া লেকিন জাদা পড়েগা’। ‘নো প্রবলেম’ অনীক বলে দেয়।এবার বড় রাস্তা থেকে একটু ভেতরে একটা গলির মধ্যে, একটা আড়াইতলা বাড়িতে নিয়ে এল কৌশল ।বাড়িওলা একতলায় থাকে, দোতলায় ছয় সাতটা ভাড়াটে থাকে। কিন্তু আড়াইতলাটা পুরো ফাঁকা। ঘরটাও বড়, তার সঙ্গে ছাদে যাবারও রাস্তা আছে। পাশেই একটা ভদ্রস্থ বাথরুম। কিচেন নেই ,তবে ছাদে হাবিজাবি ভর্তি একটা পরিত্যক্ত ঘর ও চাইলে ব্যবহার করতে পারে। ভাড়া বিশহাজার।‘বি-শ-হা-জা-র!‘ অনীক অবাক হয়। কিন্তু কিছু করার নেই ,দশহাজারী ঘরগুলো ওর একটাও পছন্দ হয়নি ।এটা তার চেয়ে বেশ ভাল, যদিও একটু গরম হবে, কিন্তু বেশ খোলামেলা ।উপরি পাওনা, গোটা ছাদটাও ব্যবহার করা যাবে ।ছাদে দাঁড়ালেই এক ঝলক ঠাণ্ডা হাওয়ায় উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। শেষমেষ এটাই পছন্দ করে ফেলল অনীক ।অনেক দরদাম করেও আঠেরোর নীচে কিছুতেই নামানো গেল না ।এইচআরএ যা পাবে তাতে পোষাবে না, না পোষাক ।ওর বেশ পছন্দ হয়েছে ঘরটা। তারপর পুরো ফার্নিশড। ফার্নিচার, খাট-বিছানা, বড় আলমারি, ওয়াশিং মেশিন,ফ্রিজ, টিভি পর্যন্ত,সবই আছে । বাড়িওলা ইউপিরই মানুষ,নাম রাজকুমার সিং। সব ফাইনাল হয়ে গেল। কাগজপত্র, অ্যাডভান্স ,সেলামি,কৌশলের কমিশন সব মিটিয়ে অফিস চলে গেল অনীক। সর্বক্ষণের ফাইফরমাস খাটার লোক মনুয়ার সঙ্গেও কথা হয়ে গেল। ভীষণ চটপটে ছেলেটা,বলে দিল দুপুরের মধ্যেই সব ঘরদোর সাফসুতরো করে রেখে দেবে। সকালে আর রাতে খাবারও পেয়ে যাবে ঠিক সময়ে ।অনীক তো মহা খুশি,অফিস যেতে সৌভিকদাও সব শুনে বলল ‘ভাল জায়গা ,কিন্তু খাবারের ব্যাপারটা ঠিক মতো বুঝিয়ে বলে দিবি। নইলে যা তেল মশলা দেবে, তোর মুখে রুচবে না।‘ যাহোক নতুন অফিসের পরিবেশ, নতুন কলিগ, কাজের দায়িত্ব সবকিছুর সঙ্গে মানিয়ে নিতে শুরু করল অনীক। বাড়ি ফিরতে ফিরতে সেই আটটা। তারপর চান-টান ক’রে টিভি চালিয়ে ব'সে, বাড়িতে আর বন্ধুদের সঙ্গে ফোনে একটু কথা বলত অনীক। লাঞ্চ তো অফিসেই করে,তারপর সারাদিন চা-কফি খেয়ে খেয়ে পেটের বারোটা বেজে গেছে।তাছাড়া অফিসে সাতটা বাজলেই ব্রেড পকোড়া বা সামোসা টিফিন বাঁধা।তাই এ সময়টা ও কিছু খেতনা। বিছানায় হেলান দিয়ে বসে টিভি দেখত। ঠিক সাড়ে ন’টায় ডিনার পৌঁছে দিত মনুয়া। দুটো মোটা রুটি, তড়কা আর রায়তা। খেয়েদেয়ে খবরের কাগজটা নিয়ে একটু নাড়াচাড়া করতে করতেই চোখে ঘুম চলে আসত, তারপর গভীর ঘুম। সেই সকাল আটটায় ঘুম ভাঙত। টয়লেট ক’রে, দাঁত মাজা হতেই ব্রেকফাস্ট এসে যেত।আলুপরোটা,দই,আচার আর চা। খেয়েদেয়ে চান করে জামাকাপড় পড়তে না পড়তেই, বাইরে অফিসের গাড়ির হর্ন।ব্যাস,তড়িঘড়ি ছুট। এ বাড়িতে আরো কিছু অফিসযাত্রী থাকে, তাদের আলাদা গাড়ি,সময়ও আলাদা। আলাপও হয়ে গেছে ক’জনের সঙ্গে যাতায়াতের পথে ।বাঙালি কেউই নেই , সব পাঞ্জাবি আর সাউথ ইন্ডিয়ান। যা হোক, মোটের ওপর খারাপ লাগছিল না অনীকের। আস্তে আস্তে নতুন শহর,চাকরি,একা থাকা, এসবের সঙ্গে মানিয়েও নিচ্ছিল। সমস্যাটা শুরু হল সপ্তাহখানেক পর থেকে ।সেদিন অফিস থেকে আগে ফিরে আসায় বেশ খিদে পেয়ে গেছিল অনীকের। ফ্রিজটা খুলে দেখে ভেতরে মাত্র একটা কেক পড়ে আছে, বাধ্য হয়ে সেটাই গলাধঃকরণ করল। অথচ ওর পরিস্কার মনে আছে কেক ছাড়াও একটা স্যান্ডউইচ আরেকটা কোকের ক্যান ক’দিন আগেই ও কিনে রেখে দিয়েছিল । অদ্ভুত ব্যাপার, এত ভুল তো হবে না। ও তো ফ্রিজ থেকে এর আগে কখনও কিছু বের করে খায়নি। তাহলে কেউ কি চুরি করে খেল? ইঁদুর-বিড়াল তো আর ফ্রিজ খুলে খেয়ে যাবে না, তাহলে? মনুয়া তো খাবার দিয়েই চলে যায়, আর তো কেউ আসেনি কখনো। ওর একটু খটকা লাগে। পরেরদিন বাথরুমে ঢুকে অনীক দেখে সাবান-শ্যাম্পু সব যেন বেশ কিছুটা করে কম লাগছে। এইতো কদিন আগেই কেনা ,এরই মধ্যে এতটা কমল কি করে!তারপর মাপা জল,চান ক’রে সেসব কে শেষ করে দেওয়াতে,ওর সেদিন আর চানই করা হল না। আরেকদিন ওর মনে হল ঘরের জিনিসপত্র, বিছানা বালিশ কেমন যেন এদিক ওদিক করা হয়েছে ।এভাবে তো ও রাখেনি। তবে কি ও না থাকলে কেউ ঘরে ঢুকে ওর ঘর-বাথরুম ব্যবহার করে? যাহোক মনের ভুল ভেবে, ক’দিন নিজেকে বোঝাল অনীক। তার পরেও একদিন বাড়ি ফিরে দেখে ফ্রিজের খাবার আর চানের জল দুটোই শেষ,এবার খাপ্পা হয়ে গেল অনীক। বাড়িওলা রাজকুমার সিংকে ডেকে জিজ্ঞেস করতে সে বলল “নেহি নেহি দাদা, কোই আপকা রুমমে ঘুসতা নেহি। অর ফির চাবি তো আপকেই পাসমে রহতা হে।‘ কাজের লোক মনুয়া সকালে আসতে, ওকেও জিজ্ঞেস করল অনীক। মনুয়াও স্পষ্ট জানাল যে, অনীক বাড়ি না থাকলে , কেউ এদিকে আসেই না, ঢোকা তো দূরস্থান ।তবে কেউ হয়তো ছাদে গেলেও যেতে পারে, কিন্তু অনীকের ঘরে তো তালা দেওয়া থাকে ,ঢুকবে কি করে?আর কেনই বা ঢুকবে?তাছাড়া এ পাড়াতে চোরের উপদ্রব নেই বললেই চলে। তাহলে? অনীক প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে পায়না। একদিন ব্যাপারটা ভাল করে বোঝার জন্য, ইচ্ছে করে ও একটা চিকেন প্যাটিস আর একটা চকলেট পেস্ট্রি কিনে ফ্রিজে রেখে দিল। পরের দিন দেখে, ঠিক যা ভেবেছে তাই।পেস্ট্রিটা গায়েব। তারও পরের দিন দেখে প্যাটিসটাও নেই। আর একদিন ইচ্ছে করে, দুপুরে একবার বাড়ি ফিরেও পরখ করে নিয়েছে,না ঘর বন্ধ,ভেতরেও কেউ ঢুকে নেই।তাহলে? ঘরে চোর ঢুকে খাবার খেয়ে যাচ্ছে ,বাথরুমে ঢুকে সাবান-শ্যাম্পু মেখে চানও করে যাচ্ছে।অথচ ধরা যাচ্ছে না।ঢুকছেই বা কি ক’রে?এরপর ওর ওপর হামলা করলে বা চুরি-ডাকাতির মতলব করলে? ও তো একাই থাকে ,তাহলে ওর সেফটি কোথায়? অফিসে গিয়েই বস সৌভিকদাকে ব্যাপারটা জানাল সেদিন। সৌভিকদা বলল ‘তুই শিওর, তোর ঘরে কেউ ঢোকে? দরজা-জানলা ঠিকঠাক বন্ধ করে বেরোস তো?’ ‘হ্যাঁ গো, হান্ড্রেড পার্সেন্ট।‘ অনীক বলে। ‘আমি ভাল করে চেক করে দেখে, তবেই তোমাকে বলছি।‘ ‘তাহলে তো চিন্তার ব্যাপার রে। তবে, তুই ভয় পাস না,বুঝলি। আমি তোকে একটা বুদ্ধি দিচ্ছি। আমার কাছে একটা সিসিটিভি ক্যামেরা পড়ে আছে, অনেকদিন ইউজ হয় না। তোকে আমি কালই ওটা এনে দেব। তুই ঘরে লাগিয়ে রাখবি তো। সারাদিন কি কি হচ্ছে, সব জানতে পেরে যাবি।’সৌভিকদা বলে। খুব ভাল প্ল্যান। পরের দিনই অনীক ক্যামেরাটা এনে উঁচু একটা তাকের ওপর ফিট করে ফেলে। পরদিন অফিস বেরোবার সময়, সেটা অন ক’রে, দরজা বন্ধ করে বেরিয়ে পড়ে। সেদিন একটু তাড়াতাড়িই ঘরে ফেরে অনীক ।ঘরে ঢুকে দেখে, ঠিক তাই। বালিশ বিছানা যেভাবে রেখে গেছিল, সব একটু সরানো, নাটঘাট করা।পরিষ্কার কেউ তার খাটে শুয়েছে ।ফ্রিজেও খাবার যথারীতি কম।তাড়াতাড়ি তাকের ওপরের সিসিটিভিটা অফ ক’রে মেমোরি কার্ডটা বের ক’রে, ল্যাপটপে ঢোকায় ও। ভিডিওটা চালু হয়। সাদাকালো ভিডিও, কম আলোয় উঠেছে বলে একটু গ্রেনও এসেছে। কিন্তু সব বোঝা যাচ্ছে। একটু ফরওয়ার্ড করার পরেই হঠাৎ গায়ে কাঁটা দেয় অনীকের ।এ কি দেখছি ও। দেখে বড় আলমারিটা, যেটা সচরাচর ও ব্যবহারই করেনা, সেটার পাল্লাদুটো ফাঁক হয়ে গেল, ভেতর থেকে হামাগুড়ি দিয়ে একটা রোগাপাতলা মেয়ে বেরিয়ে আসল। এই মেয়েটা কোথা থেকে আলমারির ভেতর এল ! তারপর কখনো খাটে বসল, শুয়ে পড়ল, কখনো বা আয়নায় চুল আঁচড়াচ্ছে, একবার বাথরুমে ঢুকল, তারপর ফ্রিজ খুলে জল খেল, খাবার খেল, আবার খাটে কিছুক্ষণ শুয়ে রইল। তারপর বিকেল বিকেল আবার আলমারির ভেতর ঢুকে গেল। ও আসার কিছুক্ষণ আগেই।শেষদিকে অবশ্য মেমারি ফুল দেখাচ্ছিল। তবু যতটুকু দেখেছে,তাতেই ভয়ে গলাটা শুকিয়ে গেল অনীকের। মেয়েটা কে ?এত দুঃসাহস!ওর ঘরে ওর সঙ্গেই বাস করে , আর ও জানতেও পারেনি! দুরু দুরু বুকে উঠে দাঁড়াল অনীক।আজ একটা হেস্তনেস্ত করেই ছাড়বে। হাতে নিল একটা পর্দার রড, যদি আত্মরক্ষায় কাজে লাগে।একা একা ভয়ও করছে। কোনরকমে মনে সাহস সঞ্চয় ক’রে, পা টিপে টিপে বন্ধ আলমারিটার কাছে গেল ও, তারপর এক টানে পাল্লা দুটো হাট করে খুলে দিল। লাঠিটা বাগিয়ে ধরল। কিন্তু এ কি? ভেতরে তো কেউ নেই। ফাঁকা আলমারি। ভেতরে অবশ্য একজন থাকার মত যথেষ্ট জায়গা আছে, হাওয়া-বাতাসও ঢুকবে ।কিন্তু সেই মেয়েটা কোথায় গেল? এইমাত্র যে সিসিটিভি ফুটেজে দেখল ঢুকতে! ভোজবাজির মত উবে গেল নাকি? টেনশনে ঘামতে শুরু করল অনীক। তবে কি অন্য কিছু? প্রেতাত্মা, অশরীরী ? গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল।আর ভাবতে পারেনা অনীক ।এতদিন একাই শুয়েছে ঘরটাতে, কিছু জানত না বলে। কিন্তু আজ এই ভিডিও ক্লিপ দেখার পর ,এই ভূতের ভয় নিয়ে আর ও কিছুতেই শুতে পারবে না এই ঘরে। দরজাটা খুলে তাড়াতাড়ি চিৎকার করে ডাকে মনুয়াকে।মনুয়া ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে আসে, ‘কেয়া হুয়া দাদা, ইতনা চিল্লা কিউ রাহে হো?' অনীক আর মেয়েটার কথা খুলে বলতে পারে না মনুয়াকে ।কি জানি, কি মনে করবে। ব্যাচেলার ছেলে, একা থাকে ।ঘরের মধ্যে একটা মেয়ে ঢুকে পড়েছে জানলে, কেলোর কীর্তি হবে, লজ্জার একশেষ। শুধু বলে,কেউ ওরে ঘরে ঢুকেছে। শুনে, দুজনে মিলে তোলপাড় করে খোঁজে গোটা ঘরটা ।খাটের তলা, ওয়াশিং মেশিনের ভেতর পর্যন্ত। কেউ নেই কোথাও। তাহলে? রাতটা আর ঘরে থাকতে পারে না অনীক। কয়েকটা জরুরী জিনিস নিয়ে সোজা নেমে আসে দোতলায়। সোফাটার উপরই সেদিন শুয়ে পড়ল ও, ডিনার করতেও আর রুচি হল না। পরের দিন ঘুম একটু দেরিতেই ভাঙল অনীকের। আসলে রাতে নানা দুশ্চিন্তা, বদস্বপ্ন আর ভুতের ভয়ে-অস্বস্তিতে ঘুমোতে পারেনি ঠিকমতো। ভোরের দিকে একটু ঘুম এসে গেছিল, সকালে তাই উঠতে পারেনি। আজ আর অফিস যাওয়ার টাইম নেই, ইচ্ছেও হল না ।গাটাও ম্যাজম্যাজ করছে ,মনে নানা দুশ্চিন্তা। বাড়িটা ছেড়ে দিতে হবে, এইসব উটকো ঝামেলা নিয়ে কে বাস করবে? বাড়িওলা রাজকুমারজি এসে জানতে চাইল কাল কি হয়েছিল?কে ঢুকেছিল ঘরে? অনীক বেশি কিছু বলতে পারে না, প্রমাণ ছাড়া কি বলবে?তাছাড়া ভিডিও ফুটেজের মেয়েটার কথাটা বলতেও সংকোচ হয়। ওদিকে ঘরটা ছেড়ে দিলে এরকম বড়সড় ঘরই বা পাবে কোথায়?অতগুলো টাকাও জলে যাবে। কি যে করবে ?ভাবতে ভাবতে শেষে সৌভিকদাকেই ফোন করে অনীক। আজ না যেতে পারার কারণটা বলে আর বলে কালকের সমস্ত ঘটনা। শৌভিকদাও একটু চিন্তিত হয়, বলে চিন্তা করিস না, পুলিশকে জানাতে হবে। সিসিটিভি ফুটেজটা আমাকে হোয়াটসঅ্যাপে পাঠা তো।একা আর ঘরে যাবার সাহস নেই, কিন্তু বাথরুম তো যেতেই হবে ।বাধ্য হয়ে মনুয়াকে সঙ্গে নিয়ে, তবে ঘরে যায় অনীক। কাজকর্ম সেরে আবার দোতলায় ফিরে এসে, ভিডিওটা খুঁটিয়ে দেখে ও। পরিস্কার একটা দুবলা পাতলা মেয়ে, বছর কুড়ি-পঁচিশ বয়স। সৌভিকদাকে পাঠিয়ে দেয় ভিডিওটা। একটু পরেই সৌভিকদা ফোন করে।‘ঘরটা তুই ছেড়েই দে রে,অনীক।‘ ‘সেই তো ভাবছি। দেখলে ভিডিওটা?’ ‘হ্যাঁ দেখলাম। পরে বলছি তোকে। তুই বাড়িটা আজই ছেড়ে দে। আমাদের অফিসেরই তমাল যে বাড়িটায় থাকে, ওখানেই একটা ঘর খালি হয়েছে শুনলাম। তুই ওখানেই শিফ্ট করে নে।‘ ‘কিন্তু সৌভিকদা, মেয়েটা কে দেখতে হবে না? পুলিশে---‘ ‘ছাড় তোর পুলিশ ।এটা অন্য ব্যাপার। তোকে যা বলছি তাই কর।‘ সৌভিকদার গলায় কিছু একটা ছিল। অনীক ফেলতে পারেনা। লোকাল গার্জেন তো ওই, ওর কথা মতই সমস্ত কিছু করে অনীক।কিন্তু সৌভিকদা কি এমন দেখল? মনুয়াকে জলখাবার আনতে বলে ভিডিওটা আরেকবার চালায় অনীক। কিন্তু এবার যা দেখল, তাতে ওর ভয়ে অজ্ঞান হবার জোগাড় ।ভিডিও রেকর্ডিংটায় মেয়েটা এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাচ্ছে যেন অস্বাভাবিক বেশি স্পিডে। ঘরে কখনও বিছানা থেকে নেমে বাথরুমে,কখনও বা ফ্রিজ খুলে খাবার খেয়ে, জল খেয়ে, ফ্রিজ বন্ধ করে আবার খাটে ফেরত আসা, সব কিছু অস্বাভাবিক দ্রুততার সঙ্গে ঘটছে। অথচ ক্যামেরার স্পিড তো ঠিকই আছে ,টাইমও দেখাচ্ছে পাশে। তবে কি ও যা ভয় করেছিল তাই? অশরীরী আত্মার ব্যাপার? তাই যদি হয়, সিসিটিভি রেকর্ডিংই বা হল কি করে ?ভুতের কি ছবি ওঠে ?দেখতে দেখতে আরেকটা জায়গায় থমকে গেল অনীক।ওই জায়গাটা রিওয়াইন্ড করে বারবার দেখতে লাগল ও, যেখানে ফ্রিজ খোলার দৃশ্য ,সেখানে দেখা যাচ্ছে ফ্রিজ খুলতে, ফ্রিজের ভেতরের আলো আর তাকগুলো পর্যন্ত মেয়েটার শরীরের মধ্যে দিয়ে দেখা যাচ্ছে। মেয়েটা যেন ছায়া, মানব শরীর নয় ।মাথাটা ঘুরতে লাগল অনীকের, শিরদাঁড়া দিয়ে নেমে গেল একটা ঠান্ডা স্রোত ।ঠিক, সৌভিকদা এটাই দেখেছে ,এ সত্যিই ভুতুড়ে কারবার।আজই বাড়ি ছাড়তে হবে। যা দেখল এখানে তো আর থাকা যাবে না,টাকা লস হয় হোক। গায়ে কাঁটা দিল অনীকের,এ কার সঙ্গে ও থেকেছে এতগুলো দিন! কিন্তু একটা খটকা ওর গেল না। ভুতে কি ফ্রিজ খুলে প্যাটিস-পেস্ট্রি-স্যান্ডউইচ এসব খায়?অদ্ভুত তো! হঠাৎ সিঁড়ির ওপর থেকে হইচই শুনে চমক ভাঙল।বাড়িওলা রাজকুমার আর মনুয়া উপরে গেছিল সবকিছু খতিয়ে দেখতে, ওরাই চেঁচাতে চেঁচাতে নামছে। সঙ্গে ঘাড় ধরে নিয়ে আসছে একটা মেয়েকে। না, ভুত তো নয়,একটি জলজ্যান্ত মেয়েই বটে। মেয়েটা তারস্বরে কাঁদছে। কিন্তু ওরা টেনেহিঁচড়ে মারতে মারতে নামাচ্ছে মেয়েটাকে । অনীকের তো চক্ষুস্থির।আরে, এই তো সেই মেয়েটা,সেই রোগা-পাতলা চেহারা । একেই তো দেখেছে ভিডিওতে। কিন্তু এতক্ষণ কোথায় ছিল ও? ঘরে তো ছিল না। উত্তরটা মনুয়াই দিল ‘দাদা, ছত পর থি এ লেড়কি। ছত কি রসুইঘর তো আপ কভি ভি উপয়োগ নেহি কি।ইসলিয়ে আপকো পাতা নেহি চলা।ইয়ে লেড়কি ওহি পে ছুপকে রহি রইথি।অর আপকা কামরেমে ক্যায়সে ঘুসতি থি,ওভি পাতা চলা। আপহিকা টয়লেট কা খিড়কিসে, যো আপ কভি ঠিকসে বন্ধ নেহি করতে থে। এহি হে চোর দাদা,অব ইসে পুলিশমে দেনা পড়েগা।‘ মেয়েটা ততক্ষনে কেঁদেকেটে অনীকের পায়ে এসে পড়েছে। অনীক অবাক হয়ে দেখে মেয়েটাকে।সারা শরীরে অভাবের ছাপ,জটপড়া চুল, ময়লা রোগা চেহারা, ততোধিক ময়লা একটা জামা পড়ে আছে। হাড় ক’খানা দেখা যায়। আহারে, গরিব মেয়েটা খেতে,থাকতে পেত না। তাই এভাবে লুকিয়ে আসত ওর ঘরে ।ওর সামান্য ক’টা ফেলে যাওয়া খাবার খেয়ে, কাটাল কি করে এতগুলো দিন? মায়া পড়ে যায় অনীকের। ‘ভাইয়া, ভাইয়া ,ছোড় দিজিয়ে,মাফ কর দিজিয়ে’ বলে দেহাতি ভাষায় ইনিয়েবিনিয়ে কাঁদতে থাকে আর পায়ে পড়তে থাকে মেয়েটা।মনুয়া ওকে টেনে নিয়ে যেতে চায়, রাজকুমার সিং তো পুলিশে ফোন করতে যাচ্ছিল। অনীক ওদের দুজনকে থামায়।‘ছেড়ে দিন রাজকুমারজি।গরীব মেয়ে ,খেতে পায় না, পুলিশকে ডাকবেন না। কিছু তো চুরি ও করেনি,শুধু পেটের জ্বালায় ক’টা খাবারই তো খেয়েছে।‘ বাড়িতে এভাবে লুকিয়ে থেকে একটা মেয়ে এইসব কীর্তি করেছে, এটা রাজকুমার সিংয়ের ঠিক পছন্দ হচ্ছিল না। কিন্তু মেয়ে বলে কথা। সকলেই একটু থমকে যায়। অন্য ক’জন ভাড়াটেও এসে হাজির হয়। সবাই তো অবাক ঘটনার কথা শুনে। অনেকে আবার তির্যকভাবে অনীকের দিকেই তাকায়। অনীকও একটু অস্বস্তিতে পড়ে। কুড়ি-বাইশ বছরের একটা মেয়ে তারই ঘরে এতদিন আসা-যাওয়া করেছে, বাস করেছে তারই সাথে, খুবই লজ্জাজনক ব্যাপার। কে কি না শেষে ভাবে। ব্যাপারটা এখানেই ইতি হয়ে যাওয়া ভাল। ও মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করে ‘এই মেয়ে ,তোর নাম কি?’ ‘ছোটিয়া’ মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতে বলে। ‘বাড়ি কোথায়?এখানে কেন এসেছিলি?’ এসব জেরার উত্তরে, দেহাতি ভাষায় কাঁদতে কাঁদতে মেয়েটা যা বলে, তার সারমর্ম হল, রাস্তার ওপাশের বস্তিতে থাকত ওরা। বাবা দিনমজুর, মা নেই । ক’দিন আগে বাবা আর একটা মহিলাকে ঘরে এনে তুলেছে, আর দু’জনে মিলে মেরে, ওকে ঘর থেকে বের করে দিয়েছে ।ঘুরতে ঘুরতে ও পাশের বাড়িটাতে ঢুকে পড়েছিল। বাড়িতে তখন রিপেয়ারের কাজ চলছিল। ও আশ্রয়ের খোঁজ করছে দেখে দুজন মিস্ত্রি খারাপ উদ্দেশ্যে ওকে টানাটানি করেছিল।তখন ও ভয়ে, ছুটে ছাদে উঠে যায়, তারপর প্রাণ আর মর্যাদা বাঁচাতে পাঁচিল টপকে লাফ মেরে পড়েছিল লাগোয়া এই বাড়িটার ছাদে। সেই থেকে ছাদের ঘরেই লুকিয়ে থাকত, আর অনীক অফিস চলে গেলে বাথরুমের পিছনের দরজাটা, পাশের জানলা দিয়ে হাত গলিয়ে খুলে, ঢুকে পড়ত, তারপর সেখান থেকে অনীকের ঘরে ঢুকত । খিদে,তেষ্টার জ্বালায়, সারাদিন ওখানেই চান-খাওয়া করে আবার বিকেলে লুকিয়ে ছাদের ঘরে চলে যেত। কোনদিন অনীক হুট করে আগে এসে পড়লে, বাধ্য হয়ে ও লুকিয়ে পড়ত বড় আলমারিটার মধ্যে। সব শুনে অনীকের মনটা একটু হাল্কা হল। যাক বাবা, ভুত বা চোরের ব্যাপার নয়, এটুকু শান্তি। সবাই মিলে মেয়েটাকে ধরে নিয়ে গেল নিচে আর ওর থেকে কথা আদায় করে নিল ,আর কখনো এবাড়িতে যেন ও না ঢোকে। মেয়েটা ময়লা জামাটা দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে চলে গেল, একবার শুধু সিঁড়ির বাঁকে পিছনে ঘুরে,অনীকের দিকে তাকিয়ে বলল ‘থ্যাংক ইউ ভাইয়া।‘ বলেই চোখের আড়ালে চলে গেল।অনীক ভাবছিল কিসের জন্য ধন্যবাদ? ওর সঙ্গে ঘর শেয়ার করা, খাবার শেয়ার করা, বাথরুম শেয়ার করার জন্য ?না কি, পুলিশে না ধরিয়ে দেবার জন্য? মেয়েটা কোথায় যাবে, কি করবে,বাড়িতে ঢুকতে পারবে কিনা,এসব ভেবে মনটা একটু খারাপই হয়ে গেল অনীকের।একটু মায়াও পড়ে গেছে,’ভাইয়া’ বলে ডেকেছে যে । বাড়িটা তাহলে আর ছাড়তে হচ্ছে না। বরং যেন এক আপনজনের সংস্পর্শেই এই ঘরটার সমস্ত কোনাগুলো ভরে রয়েছে। সেই অনুভূতি জড়িয়ে থাকতে অনীকের আর কোনো অসুবিধা নেই । একটা মনোরম স্মৃতি থাকুক না ঘরটায়। ‘ছোটিয়া’ মৃদু হেসে ,মনে মনে বিড়বিড় করে উঠল অনীক।

No comments:

Post a Comment