ধর্মতলা যাব বলে ট্যাক্সিতে চেপেছিলুম সিঁথির মোড় থেকে। কি কুক্ষণেই না সেদিন, সেই ট্যাক্সিওয়ালাটা আমার ডাকে সাড়া দিয়েছিল, কে জানে ! ট্যাক্সিতে ওঠার পরেই শুরু হল সেই অবাঙালী ট্যাক্সিওয়ালার উৎপাত। প্রথমেই আমাকে দু’তিনটে ওষুধের স্ট্রিপ ধরিয়ে দিয়ে বলল, ‘দেখুন তো, এগুলো কিসের ওষুধ ? ব্যথা কমবে?’ আমি দেখেটেখে কিছুই বুঝতে পারলুম না ।বললুম ‘কোথায় ব্যথা?’ সে বলল ‘এই ,মুখে হাতে পায়ে ।খুব লেগেছে দু’একদিন আগে।‘ আমি বললুম ‘কি করে লাগল?পড়ে গেছলেন বুঝি?’সে নির্বিকার ভাবে বলল ‘না না, হেভি মারপিট হয়েছিল একজনের সঙ্গে ।‘ শুনে দমে গেলুম,বাপরে কি ডানপিটে ছেলে। না ঘাবড়ে বললুম ‘ওষুধগুলো কে দিয়েছে?’ সে বলল ‘একটা ওষুধের দোকানে।ঠিকই দিয়েছে,না?’ আমি আর বেশি কথা বাড়াতে চাইছিলুম না। বললুম ‘হ্যাঁ,ঠিকই দিয়েছে নিশ্চয়ই।আমার ঠিক জানা নেই।‘ একটু পরে বুঝেছিলুম, মারপিট করাটা ঐ ট্যাক্সিওয়ালাটার একটা সহজাত প্রবৃত্তি ছিল। যাইহোক ওষুধগুলো ফেরত দিয়ে, আর বেশি সহমর্মীতা না দেখিয়ে, নিজের কাজে মন দিলুম। সেও স্ট্রিপ থেকে একটা ওষুধ ছিঁড়ে মুখে দিয়ে,জলের বোতল থেকে জল খেতে লাগল ট্যাক্সি চালাতে চালাতেই, বেশ কায়দা টায়দা করে।নিজেই বিড়বিড় করে বলতে লাগল ‘ধুর শালা,এর চেয়ে দু ‘বোতল দারু খেয়ে নিলেই,ব্যাথা ট্যাথা সব পালাত।‘ আমি তার কথায় বিশেষ কান দিলুম না,বেশ টেনশন হচ্ছিল,কার পাল্লায় পড়লুম রে বাবা।ট্যাক্সিটা স্বাভাবিকের থেকে বেশ জোরেই চলছিল।আমি একটু ভয়ও পাচ্ছিলুম,সত্যি সত্যি ব্যাটা দারু খেয়েই ট্যাক্সি চালাচ্ছে না তো! বোতল থেকে কি খেল,কে জানে? যা হোক, টালা ব্রিজের ওপর জ্যামে দাঁড়াতে, পাশের আর এক দেশোয়ালী ট্যাক্সিওয়ালা তাকে সাবধান করে বলল ‘কি ভাই, এত জোরে, তাড়াহুড়ো করে চালাচ্ছ কেন?’ কথাটা সে ঠিকই বলেছিল । কিন্তু আমার ট্যাক্সিওয়ালা সেসব বুঝলে তো! সে উল্টে তাকেই ধমক দিয়ে বলল ‘নিজের চরকায় তেল দাও গে, আমি ঠিকই চালাচ্ছি।‘ এরপর আসল খেলা শুরু হল। সেন্ট্রাল এভিনিউতে উঠে আমার ট্যাক্সিটা আর একটা প্রাইভেট গাড়িকে ওভারটেক করতে গিয়ে তার সঙ্গে একটু ঘষা লাগিয়ে ফেলল। আর পালাবে কোথায়, ওই গাড়িটাও একে তাড়া করে আসতে লাগল,সঙ্গে অশ্রাব্য গালিগালাজ।ভয়ের চোটে এও ঊর্ধ্বশ্বাসে পালাতে শুরু করল, হলিউড সিনেমার কার চেসিং কোথায় লাগে।আমি ওদিকে ইষ্টনাম জপ করছি। কিন্তু এটা কলকাতা শহর, পালাবে কোথায়! একটু পরেই একটা ক্রসিংয়ে দাঁড়াতেই হল। ব্যাস, আর যায় কোথায়।ওই প্রাইভেট গাড়িতে যারা ছিল, তারাও বেশ হাট্টা কাট্টা টাইপের ,ছোড়নেবালা নয়,এরই মত অবাঙালী।দু’জন সঙ্গে সঙ্গে সেই গাড়িটা থেকে নেমে ছুটে এসে,ট্যাক্সির দরজা খুলে একে বের করার জন্য টানাহেঁচড়া শুরু করল।বলছিল ‘কি করেছিস,দেখবি চল।কত ক্ষতি হয়ে গেল।‘ সঙ্গে উভয়ের গালিগালাজ,কেউ কাউকে ছেড়ে দেবার পাত্র নয়। শেষে দরজা খুলে টেনে হিঁচড়ে ট্যাক্সিওয়ালাকে নামাতে যেতেই,এও পায়ের কাছে আগে থাকতে লুকোনো একটা রেঞ্চ বের করে, ওদের সঙ্গে লড়তে লাগল।আমি নীরব দর্শক। কিন্তু ওরা দু’জন, আর এ একা ,পারবে কেন? ওরা টানতে টানতে একে রাস্তার ডিভাইডারের কাছে নিয়ে গিয়ে পেটাতে শুরু করল। সে এক ভয়ঙ্কর দৃশ্য, আমার ট্যাক্সিওয়ালা গাড়ি ছেড়ে রাস্তায় পড়ে মার খাচ্ছে আর আমি ট্যাক্সির পিছনে কিংকর্তব্যবিমূঢ় বসে আছি। রাস্তায় জ্যাম, সব গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়েছে।দেখতে দেখতে লোক জড়ো হতে শুরু করেছে। শুনতে পেলুম কে যেন ‘পুলিশ পুলিশ’ বলে ডাকছে। জানিনা পুলিশ এসে সেই ঝামেলা মিটমাট হবে কিনা ,কিম্বা হলেও কখন হবে।সেসব জানবার আমার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে ছিল না।আমি শুধু এই ঝামেলা থেকে যেভাবে হোক পরিত্রাণ পেতে চাইছিলুম। এই অবস্থায় বোকার মত ট্যাক্সিতে বসে থাকার কোন মানে হয় না। একে তো এই ট্যাক্সিতে ধর্মতলা পৌছোনোর বারোটা বাজল, এই ঝামেলা সহজে মেটার নয়। ওদিকে ধর্মতলা থেকে দুর্গাপুরের বাস ধরার দেরী হয়ে যাচ্ছে। সত্তর টাকা মতো ভাড়া উঠেছিল। সে যাকগে,ঠিক করলুম কেটে পড়ি।যদিও ভাড়ার টাকাটা মেরে দেবার মোটেও ইচ্ছে ছিল না,কিন্তু আর কিছু করারও ছিল না,বিশেষত যাকে ভাড়া দেবার কথা, সে তখন রাস্তায় চিৎপাত হয়ে শুয়ে মার খেতে ব্যাস্ত। অযথা ঝামেলায় কে ফাঁসতে চায়? দেখলুম, এই সুযোগ, সোজা রাস্তার দিকের দরজাটা খুলে ,হাতের ব্যাগটা নিয়ে নেমে পড়লুম।ধাঁ করে দু’তিনটে গাড়ির ফাঁক দিয়ে গলে বেরিয়ে, সোজা ফুটপাতে উঠে ভিড়ে মিশে গেলুম। হাঁটতে-হাঁটতে পেছন ফিরে বারবার দেখছিলুম, ঝামেলাটা কতদূর গড়াচ্ছে বা আদৌ থামার দিকে যাচ্ছে কিনা। ততক্ষণে রাস্তায় ভিড় জমে গেছে,কিছু বোঝা গেল না। অন্য একটা যা হোক বাস ধরে তড়িঘড়ি এলাকা ছাড়লুম। সেই ট্যাক্সিওয়ালাটার কি হল আর জানা হলনা ।মনে মনে বললুম,বেশ হয়েছে,যেমন কর্ম তেমনি ফল।মার খাওয়া ছাড়াও ওর সত্তর টাকা লোকসানটাকে ধরেই বললুম।
No comments:
Post a Comment