8 March 2020

পাঁচিল

মানিকতলার মদেরগলি বস্তি অঞ্চল। পাশেই একটা বন্ধ রঙ কারখানার পাঁচিল, রাত নামলেই সেখানে মদ-জুয়াসহ নানা অসামাজিক কাজকর্ম শুরু হয়ে যায়। সেখানেই ঘুপচি অন্ধকারে, নর্দমার অস্বাস্থ্যকর দুর্গন্ধে, বাস করে কয়েকটা গরিব পরিবার। শ্যামল দাস ভ্যান চালায়। ওখানেই একটা দরমার ছোট্ট ঘরে একমাত্র ছেলে অরুনকে নিয়ে ও থাকে। শ্যামলের বউ মারা গেছে বেশ ক'মাস হল। কি রোগে মরেছে, তা অবশ্য কেউ জানে না। খুব জ্বর হত, কাশি হত, সঙ্গে রক্তও উঠত। চিকিৎসার জন্য শ্যামল বৌটাকে নিয়েও গিয়েছিল হাসপাতালে। কিন্তু বেড নেই বলে, ওরা বাইরেই ফেলে রেখে দিয়েছিল বেশ ক'দিন। সেভাবে কোন চিকিৎসাই হয়নি। তারপর যা হয়, আর কি। একদিন রাতে শেষে শ্বাসকষ্ট শুরু হতে, অবশেষে ভেতরে ওয়ার্ডে বৌটার ঠাঁই হয়েছিল। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরী হয়ে গেছে, আর বাঁচানো যায়নি। ছেলেটার তখন মাত্র তিন কি চার বছর বয়স। সেই থেকেই বড় কষ্টে মানুষ। শখ-আহ্লাদ তো দূরের কথা, ছেলেটাকে কোনদিন ভাল করে খেতে, পরতে পর্যন্ত দিতে পারেনি শ্যামল। অথচ ওর সরল নির্ভীক চোখে তখন অনেক প্রশ্ন, অনেক স্বপ্ন। ‘বাবা, বাবা ,ওই পাঁচিলটার ওপারে কি আছে?’ ‘পাঁচিলের ওপারে? ওখানে সব বড়লোকদের বাড়ি আছে। বড় বড় গাড়ি আছে ,অ—-নে---ক টাকা আছে।‘ ‘আমি যাব ওখানে ।‘ ‘না বাবা, ওখানে আমাদের যাওয়া মানা।‘ ‘কেন বাবা, আমরা কি করেছি?’ ‘আমরা যে গরিব লোক। আমরা খেতে পাই না, ময়লা ছেঁড়া জামা কাপড় পরি,ঝুপড়ি ঘরে থাকি।‘ ‘সেই জন্য?’ ‘হ্যাঁ, বাবা। তাই সরকার পাঁচিল তুলে দিয়েছে। বড়লোক আর গরিব লোকদের আলাদা করে দিয়েছে।‘ ‘আমরা কোনদিন বড়লোক হতে পারব না?’ ‘কি জানি? আমি তো পারলাম না। তুই কি পারবি ?’ ‘হ্যাঁ বাবা, আমি বড় হয়ে অনেক বড়লোক হব, ঠিক তোমার মত।‘ ‘দুর বোকা, সে বড়লোক নয় রে। আমি বলছি অনেক টাকা থাকলে যে বড়লোক হওয়া যায়, তার কথা।‘ ‘অ---নে---ক টাকা?’ ‘হ্যাঁ, অনেক।‘ ‘আমারও অনেক টাকা থাকবে। আমিও বড়লোক হব।‘ ‘পারবি? ঠিক পারবি?’ ‘হ্যাঁ। আমি না পাঁচিলটা টপকে ওপারে যাব। ওপারে কি আছে আমি দেখব।‘ ‘না রে অরুণ, ওপারে যেতে দেবে না আমাদের। ওপারে আকাশ ছোঁয়া বাড়ি, পাখির মত হাওয়া গাড়ি, সুন্দর সুন্দর জামা কাপড় পরা লোকজন,ফুলের বাগান ,কত দোকানপাট,মনোহারি সব ব্যাপার। আমাদের ঢুকতেই দেবে না।‘ ‘কিন্তু আমি ঠিক যাব বাবা, তুমি দেখো। একদিন রাতে আমি পাঁচিলটা টপকাবই, কেউ দেখতে পাবে না।‘ ‘তুই অত উঁচু পাঁচিল টপকাতে পারবি? ওরা যদি  দেখে ফেলে? গুলি চালায়? যদি তোকে ধ’রে খুব মারে? যাস না অরুন।’ ‘আমার গায়ে গুলি লাগবেই না। এক লাফ দিয়ে নেমেই ছুট  লাগাব। ওরা  ধরতেই পারবে না।‘ ‘মনে হচ্ছে, তুই পারবি রে। একটু বড় হলে তবে চেষ্টা করিস।‘ বাবা-ছেলে উদাস ভাবে পাঁচিলের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে একসঙ্গে কত কি আকাশ পাতাল ভাবে, কত স্বপ্ন দেখে। এইভাবেই দিনগুলো চলছিল। একদিন পাশের রামকৃষ্ণ মিশনের সন্ন্যাসীরা, বস্তিতে কিছু নরনারায়ন সেবার কাজে এসেছিলেন। হঠাৎ অরুনের দিকে ওদের চোখ পড়ে গেল। অরুন তখন একটা পুরোনো কাগজের ঠোঙা খুলে মন দিয়ে পড়ার চেষ্টা করছে। দেখেই এক মহারাজ ওকে কোলে তুলে নিয়েছিলেন। শ্যামলের অবস্থা জেনে, ওরা অরুনের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন। ঐ মহারাজই ছিলেন পাশের রামকৃষ্ণ মিশন স্কুলের হেডস্যার। তিনি জেদ করে অরুণকে স্কুলে ভর্তি করে নিলেন, বিনা পয়সায়। শ্যামলের বুক থেকে যেন একটা বড় দুশ্চিন্তার বোঝা নেমে গেল। অনেক কষ্টে জমানো টাকাগুলো দিয়ে ও পরের দিনই, অরুণকে স্কুলের জামা-প্যান্ট-ব্যাগ-বই-খাতা সব কিনে দিল। অরুন স্কুলে যেতে শুরু করল। শ্যামল দু'চোখ ভরে দেখত, ওর কোন বাজে নেশা নেই, ছেলেটাই ওর সব। বেশ কয়েক বছর পরের কথা। মহারাজের আশাকে সত্যি প্রমাণ করে, অরুণ মাধ্যমিকে নবম হল। ভ্যানওয়ালার ছেলের এই সাফল্যে , একটা বস্তিঘরের ছেলের না হারিয়ে গিয়ে জীবনে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার বীরত্বে অভিভূত হয়ে সমস্ত সবাই ওকে আনন্দে জড়িয়ে ধরলেন। খুশি হয়ে, মহারাজই ওকে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ভর্তি করে দিলেন। শ্যামল আবেগে বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। ওদের বস্তিতে আগে কখনো এমন হয়নি। ভ্যান চালিয়ে আর ক'টাকা হয়! ধারফের করে, নানা জায়গা থেকে সাহায্য চেয়ে ও ছেলের উচ্চশিক্ষার জন্য টাকা জোগাড় করতে লাগল। তবে শরীরেও আর সেই আগের মত জোর নেই। সারাক্ষণ ঝিমুনি লাগে। মহারাজ জানতে পেরে শ্যামলকে আস্বস্ত করলেন, অরুণের সমস্ত খরচ ওরা বহন করবেন। শ্যামলের ধড়ে প্রাণ এল। 'অরুন দাস কে?' 'আমি ফাদার।' 'তুমি মাধ্যমিকে নবম হয়েছ? কনগ্রাচুলেশন্স।' 'থ্যাঙ্ক ইউ স্যার।' 'তোমার নম্বরই কলেজের নতুন স্টুডন্টদের মধ্যে সেরা। এই কলেজেও রেকর্ড হায়েস্ট!' 'ও, তাই বুঝি?' 'হ্যাঁ। কে পড়ান তোমায়?' 'কেউ না স্যার। নিজেই পড়ি।' 'বাহ্। তা তোমার বাবা কি করেন?' 'বাবা তো ভ্যান চালান।' 'অ্যাঁ! ভ্যান চালান!' 'হ্যাঁ স্যার।' 'আর মা?' 'মা তো অনেক ছোটবেলাতেই মারা গেছেন।' 'ও আচ্ছা, বোসো। আমি তোমার স্কলারশিপের ব্যবস্থা করব। তুমি আরো পড়বে তো?' 'হ্যাঁ স্যার, নিশ্চয়ই পড়ব। আমার বাবাও তো তাই চান।' 'কি চান?' 'এই যে আমি অনেক বড় হই, সফল হই।' 'বাহ, খুব ভাল। আমরাও সবাই তাই চাই।' 'থ্যাঙ্ক ইউ স্যার। আমিও আপ্রাণ চেষ্টা করব।' অরুন চিরকালই ভাল রেজাল্ট করে আসছিল, এবারেও তার কোন ব্যতিক্রম হল না। ওর পড়াশোনার আগ্রহ আর উন্নতি দেখে, ফাদার আর কয়েকজন স্যার মিলে ওকে স্পেশাল কোচিংয়ে ভর্তি করে দিলেন। ও ও ভীষণ পরিশ্রম করতে লাগল। মেধা আর অধ্যাবসায়ের জোরে, সকলের সব প্রত্যাশা পূর্ণ করে, ও ইঞ্জিনিয়ারিংয়েও চান্স পেল। ফাদার ওকে শিবপুর বিই কলেজে ভর্তি করে দিলেন। অরুণের বাড়িতে ওর বাবার সঙ্গে দেখা করতে এসে, ফাদারের তো চক্ষু স্থির। এরকম চরম দরিদ্র, নোংরা, ঘিঞ্জি বস্তির ঘরে এরকম প্রতিভাবান একটা ছেলে থাকতে পারে! উনি অবাক হলেন অরুণের জীবন সংগ্রামের কথা জেনে। তবে মহারাজ এ খবরটা জেনে যেতে পারেননি, তিনি মাত্র ক'মাস আগেই দেহত্যাগ করেছিলেন। 'অরুন, তুমি এত তাড়াতাড়ি প্রোগ্রামিংগুলো এত নির্ভুল কর কি করে বল তো!' 'স্যার করে করে হয়ে গেছে। মাথার ভেতর ওগুলো যেন ভেসে আসে।' 'হুঁ, তা তুমি কটা ল্যাংগুয়েজ জান?' 'দশটা স্যার।' 'অ্যাঁ? কি কি শুনি?' 'সি, সি প্লাস, জাভা, জাভিস্ক্রিপ্ট, পিএইচপি,রুবি,অবজেক্টিভ সি,পাইথন,এসকিউএল আর নোড জেএস স্যার' 'বাপরে। এর সব তো এখনো পড়ানোই হয়নি। তুমি শিখলে কি করে?' 'লাইব্রেরী থেকে বই নিয়ে পড়ে স্যার।' 'তুমি তো এই সেমিস্টারেও টপার হবে দেখছি। তা কোথায় থাক?' 'মানিকতলায় স্যার।' 'আরে মানিকতলায় তো আমিও থাকি। তোমার বাড়ি কোন পাড়ায়?' 'বাড়ি বা পাড়া কোনটাই নয় স্যার। আমি মদেরগলি বস্তিতে থাকি।' 'অ্যা!' আরো দু'বছর পরের কথা।অনেক লড়াইয়ের শেষে, অরুণ আজ কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেছে। কলেজের কনভোকেশন থেকে ও সেদিন অনেকগুলো  প্রাইজ নিয়ে ঘরে ফিরেছে। আজ ও নিজেকে প্রমাণ করতে পেরেছে। বাঙ্গালোরে বিশাল মাইনের একটা চাকরিও পেয়েছে, ক্যাম্পাস ইন্টারভিউ থেকে। ওরা বিদেশে পাঠিয়ে দেবে ক’মাসের মধ্যেই। আরো বিভিন্ন কোম্পানি থেকে বিভিন্ন লোভনীয় অফার আসছে, কিন্তু অরুণ সব অফার ফিরিয়ে দিয়েছে। ‘কেমন রেজাল্ট হল বাবা? পাস করেছিস?’ ‘হ্যাঁ বাবা, কলেজে আমি টপার।‘ ‘বা বা বা, এইতো চাই। আহা, আজ যদি তোর মা বেঁচে থাকত! তা কোন চাকরি টাকরি পেলি নাকি রে?’ ‘পেয়েছি তো অনেক। কিন্তু করবো না।‘ ‘করবি না! তাহলে কি করবি?’ ‘দেখি, আমি অন্য কিছু করব ভাবছি ।‘ ‘দ্যাখ, চাকরি পেলে সংসারটা ভাল ভাবে চলত। এত পড়াশোনা করলি। কত কষ্টে ধার দেনা করে তোকে পড়ালাম। এবার অন্তত—’ ‘তুমি চুপ করো তো বাবা। জানো না, তোমার বেশি কথা বলা বারণ?‘ ‘ছাড় তো বারণ। কোন ডাক্তার আমাকে আর ভাল করতে পারবে না।‘ ‘কেন এরকম বলছ, বাবা। তোমাকে আমি ভাল করে তুলবোই।‘ ‘না রে, কেউ পারবি না। তোর মার অসুখ আমারও হয়েছে, আমি জানি।‘ ‘না, তুমি কিচ্ছু জানো না। তুমি ছাড়া আমার আর কে আছে, বাবা?‘ ‘অরুন, একটা কথা বলবি?’ ‘বলো।‘ ‘তুই চাকরি করবি না কেন রে?’ ‘চাকরি করে কি হবে? সেই তো একই কাজের গন্ডিতে আটকে থাকা আর খালি ক’টা টাকা রোজকার করা। কিন্তু আমার স্বপ্ন? সেটার কি হবে ?’ ‘তাহলে কি করবি রে? বলনা। আমার তো আর বেশিদিন নেই, মরার আগে জেনে যাই।‘ ‘আমি একটা স্কুল খুলব, ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে। বস্তির ছেলেমেয়েদের ফ্রিতে পড়াবো। কাউকে চায়ের দোকানে বা ইটভাঁটায় খাটতে দেব না, বরং স্কলারশিপ দেব। তারা সবাই পড়তে আসবে আমার স্কুলে। অনেক অনেক  বড় হবে।‘ ‘তাই? তাহলে তো দারুন ব্যাপার হবে রে। কিন্তু সে তো অনেক টাকার ব্যাপার। তুই পারবি তো? অত টাকাই বা পাবি কোথায় ?’ ‘সে ঠিক জোগাড় হয়ে যাবে। তুমি ভেবোনা ।‘ ‘তারপর কি করবি?’ ‘তারপর? তারপর আমরা সবাই মিলে পাঁচিলটা ভেঙে ফেলব। এটাই আমাদের প্রথম কাজ হবে, আমার অনেক দিনের স্বপ্ন ।‘ ‘পারবি ভাঙতে? পারবি?’ ‘পারতেই হবে বাবা। নাহলে ওপারে যাব কি করে?‘ ‘সবাইকে নিয়ে ওপারে যাবি অরুণ, এই বস্তির সবাইকে নিয়ে।‘ ‘হ্যাঁ, বাবা। সবাইকে নিয়ে যাব। তোমাকেও।‘ ‘আমাকেও? কিন্তু আমি কি অত দিন---’ ‘আমাদের কলেজের বেশ কিছু প্রফেসর আর এক্স স্টুডেন্টরা রাজি হয়েছে। তারা আমার সঙ্গে থাকবে। কিছু এনজিও স্পন্সর করতেও চাইছে। আমার অনেক বন্ধুও সাহায্য করবে বলেছে। আমি স্কুলটা করবোই বাবা। আর মার নামে একটা ফাউন্ডেশনও করব। ফ্রিতে মেডিকেল ইনসিওরেন্স করে দেব বস্তির সবার জন্য। বিনা চিকিৎসায় কেউ আর মরবে না। পরে একটা মাইক্রোফিন্যান্স স্কিম আনারও প্ল্যান আছে। টাকা পয়সার অভাবে যাতে কারো স্বপ্ন ধ্বংস না হতে সারে।' ‘অরুণ, মনে হয় এবারে আমি শান্তিতে চোখ বুঁজতে পারব। আর আমার কিচ্ছু চাওয়ার নেই।‘ বাবা-ছেলে দুজনের চোখই খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। পাঁচিলটা ভাঙতে শুরু করেছে, একদিন ওটা থাকবেই না। ওরা এক সঙ্গে স্বপ্ন দেখতে থাকে।

No comments:

Post a Comment