20 December 2019

সমনামী


“এই শুভদীপ ,এদিকে আয়”, মেয়েলি কন্ঠে চমকে উঠে, পিছনে ফিরল শুভদীপ। ফিরেই চমক, তাকে ডাকা হয়নি। ‘শুভদীপ’ বলে তরুণ যে ছেলেটি, সুন্দরী মেয়েটির ডাকে সাড়া দিয়ে তার কাছে হেঁটে গেল, সে আলাদা ।নন্দন চত্বরে ‘কলিখাতা’ বলে একটা লিটল ম্যাগাজিনের আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠান ছিল আজ,তাতে শুভদীপই ছিল প্রধান অতিথি। কবি হিসেবে ওর মোটামুটি ভালই পরিচিতি আছে, লিটিল ম্যাগাজিনগুলো তো বটেই ,নামী পত্র-পত্রিকাগুলোও নিয়মিত ওর লেখা চায়,ছাপে। এদেরই আমন্ত্রণে আজ ও এসেছিল, ভাষণও দিয়েছে। কবিতা নিয়ে কিছু তো বলতেই হয়,ওর যে জীবনটাই কবিতা। অনুষ্ঠানের শেষে এবার বাড়ি ফিরে যাবার পালা। ফুডস্টলগুলোর কাছে এসে শুভদীপের মনে হল এক কাপ চা না হলে যেন চলছে না। ঠিক তখনই এই কাণ্ড।চায়ে চুমুক দিতে দিতে, একটু থমকে দাঁড়াল ও। এই তরুণ শুভদীপ কিন্তু বেশ হ্যান্ডসাম, ওরই মতো উচ্চতা, রোগা, ফর্সা, গালে হাল্কা দাড়ি, চোখে সানগ্লাস, আকর্ষণীয় চেহারা। একটু দাঁড়িয়ে,শুভদীপের আরো একটু দেখতে ইচ্ছে হল নিজের সমনামীকে। যদিও ফেসবুক বা গুগল খুলে অনেক ‘শুভদীপ’ ও পেয়েছে, নামটাও খুব একটা বিরল নয়। এই ছেলেটা সেরকমই একজন হবে।ওর নিজের কম বয়সের কথা মনে পড়ে গেল, বেশ লাগছিল। হঠাৎ ছেলেটা বন্ধু বান্ধবীদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে সানগ্লাসটা খুলে বুকপকেটে রাখল। তখনই চমকে উঠল শুভদীপ, ছেলেটার সঙ্গে ওর চেহারায় ভীষণরকম মিল, ঠিক যেন কম বয়সের শুভদীপ। নিজেকে যেন আয়নায় দেখছিল ও। চা শেষ করে, একটু সরে এসে ,একটা বেঞ্চিতে বসে, ছেলেটাকে ভাল করে নিরীক্ষণ করতে লাগল। ছেলেটা জিন্সের প্যান্টের ওপর একটা কালো আর কমলা রঙের প্রিন্টেড পাঞ্জাবী পরে আছে,কাঁধে ঝোলা ব্যাগ, চোখ ফেরাতে পারছিল না শুভদীপ।বসে বসে ,বন্ধু- বান্ধবীদের সঙ্গে ছেলেটার কথা অল্পস্বল্প কানে আসতে লাগল। “কিরে বাড়ি যাবি কেন এখনই?” “না রে, মার শরীরটা খারাপ। একা আছে।“ “সত্যি,তোর মতো মাতৃভক্ত দেখা যায় না রে।“ “কি করব বল, ছোটবেলা থেকেই তো শুধু আমি আর মা। আর কে দেখবে মাকে?” “যা বলেছিস, তোর কপালটাই খারাপ”, আরেক বান্ধবী এসে বলে। “হ্যাঁরে শুভদীপ, তোর বাবা এখনও তোদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখে না?” “নাঃ, ডিভোর্সের পর থেকে আর কোন খোঁজই নেই।“ “কখনও আসে না? ফোনও করে না?” “নারে,ছাড় ওনার কথা।কোনদিন তো মাকে দেখেননি। ওনার থাকা না থাকা সমান।“ “আরে,ওকে আর সেন্টু খাওয়াস না তো, বেচারা এমনিতেই চাপে আছে।“ একজন বলে । ছেলেটা এবার একটা সিগারেট ধরায় ।ওর বন্ধু বান্ধবীরাও ধরায়।দু’টান দিয়ে আর এক বান্ধবীকে কাউন্টার দেয়, হাসি-ঠাট্টা চলতে থাকে। ছেলেটা একটু যেন উদাস হয়ে যায়,ওর মুখে কি কোন ব্যাথা ফুটে ওঠে? অন্য সবাই চুপ করে যায় । তখনই শুভদীপের চোখের সামনে ভেসে উঠল বিশ বছর আগেকার কথা, তখন ওর যৌবন। নন্দিনীর সঙ্গে সম্পর্কটা হঠাৎ আসা দমকা হাওয়ার মত ছিল। শুভদীপ তখন নিত্যনতুন সম্পর্কের নেশায় ছুটে চলেছে এক সম্পর্ক থেকে আর এক সম্পর্কে। ঠিক তখনই এক সময়ের কলেজবন্ধু নন্দিনীর সঙ্গে হঠাৎ দেখা ব্রিটিশ লাইব্রেরীতে। নন্দিনীর মধ্যে শুভদীপ কিছু একটা দামালপানা দেখেছিল, পেয়েছিল সেই সমস্ত, যা ও চায়,যা ওর নিজের অস্থির মনের গোপন কামনা বাসনার সঙ্গে মেলে।শুনেছিল নন্দিনীর অসুখী বিবাহিত জীবনের কথা,ওর স্বামীর অত্যাচারের কথা, শারীরিক মিলনে অনীহার কথা। দেরি করেনি শুভদীপ,তখন ও নিজেও ওর যৌবনের অদম্য চাহিদার জন্য নতুন পুতুল খুঁজছে। নন্দিনীরও সেই দুরন্ত হাতছানিকে এড়ানোর কোন উপায় ছিল না, চাহিদা ছিল দুজনেরই। নন্দিনীদের ফ্ল্যাটেই সুযোগমতো মিলিত হত ওরা,ওর স্বামী যখন অফিসে থাকত। ওর প্রেমে খুব একটা হৃদয় থাকত না, থাকত শুধু শরীর, শুধুই শরীর। নন্দিনী কিন্তু শুভদীপের থেকে আরও বেশি কিছু চাইত,শুধু শরীর নয়,একটা সঙ্গী চাইত,একটা বন্ধু চাইত।বলত,ওর কষ্টের কথা, স্বামীর উপেক্ষার কথা, ভালবাসা চাইত একটু, কাঙালীর মত। “শুভদীপ, তুমি আমাকে ভালোবাস? সত্যি বাস?” “কেন ভালবাসব না? এরকম কেন জিজ্ঞেস করছ?” “কি জানি! তুমি আমার সঙ্গে চিরকাল থাকবে তো ?চলে যাবে না তো, আমাকে আবার একা করে দিয়ে?” “ধুর, কি বোকার মতো বলছ?” “বোকা তো আমি বটেই,ভালবেসেছি যে।কিন্তু আমি জানি, তুমি শুধু তোমার বউকে ভালবাসবে। আমাকে ভুলে যাবে।“ “না গো, জীবনে ভালোবাসা ছাড়া কি শরীর আসে?” “কিন্তু আমি যে শুধু শরীর চাইনা শুভ, তোমার মনটাও চাই। তোমাকে পুরোপুরি চাই।“ “তা কি করে হবে? তোমার স্বামী আছে না ?” “আমি যদি ওকে ডিভোর্স দিয়ে দিই। আর পারছি না।“ শুভদীপের পুরোনো সব কথা আজ মনে পড়তে লাগল,ও আজও একা । তনুশ্রীর সঙ্গে বিয়েটা টেঁকেনি বেশিদিন, ছেলেপুলেও হয়নি ।ও জানে দোষ ওরই।ওর এই বহুগামীতার নেশা, কোন একক নারীতে সন্তুষ্ট না হতে পারা, স্বীকার করতে দেয় না সম্পর্কের চিরস্থায়ী মধুরতাকে। কিন্তু সেসব অস্থির দিনগুলো চলে গেছে, আজ পড়ে আছে শুধু প্রৌঢ়ত্বে দাঁড়ানো শুভদীপ। চুলে পাক ধরেছে, শরীরেও ভাঙন , মনটা তো দুর্বল হয়েছেই। এখন ও একটু থিতু হতে চায়। কিন্তু আজ আর উপায় নেই। যৌবনের নেশায় সম্পর্ক গুলো ভাঙতে ভাঙতে, জোর করে অগভীর ক্ষণস্থায়ী একটা মোড়কে ঢেকে রেখে আর প্রকৃত ভালবাসাকে ইচ্ছে করে অসংখ্যবার ছুঁড়ে ফেলে দিতে দিতে, তারা সব ধুয়ে মুছে আজ সাফ হয়ে গেছে, বড় দেরি হয়ে গেছে।যদি একটা সাথী থাকত, যদি একটা সন্তান থাকত, যদি নতুন ক’রে আবার সব ঠিকঠাক শুরু করতে পারত! আজকাল প্রায়ই আফসোস হয় শুভদীপের। ততক্ষণে ছেলেটাও রওনা দিয়েছে, বন্ধু-বান্ধবীদের বিদায় দিয়ে। ওকে দেখে আর কথাবার্তা শুনে এক অদম্য আকর্ষণে পিছনে পিছনে চলল শুভদীপও। ছেলেটা কে, দেখতে হবে। আধুনিক ছেলে, হয়তো শুভদীপেরই মত কবিতা লেখে। না হলে এই পত্রিকার অনুষ্ঠানে আসবে কেন ! একটু এগিয়েই ময়দান মেট্রো, শুভদীপকেও বাড়ি ফিরতে হবে মেট্রো করেই। যাবার কথা দমদম, স্মার্টকার্ড তো কাটাই আছে। ছেলেটার পাশের লাইনেই টিকিট কাটতে মিছিমিছি দাঁড়িয়ে শুনল,ছেলেটা যাবে শোভাবাজার। বুকটা ধ্বক্ করে উঠল। তবে কি? তবে কি? নন্দিনীর বাড়ি তো ওখানে নেমেই যেতে হয়। আর মায়ার বাঁধন এড়াতে পারেনা শুভদীপ। ওকে দেখতেই হবে শেষ পর্যন্ত। ছেলেটার পিছনে একটু দূরত্ব রেখে চলতে শুরু করে। প্লাটফর্মে একটু দূরে দাঁড়িয়ে ওকে লক্ষ্য করে যায়। ছেলেটা কাকে যেন ফোন করে। ওর মাকে নয়তো? ছেলেটা বলতে থাকে “এইতো, এসে গেছি।মেট্রোয় উঠছি। হ্যাঁ, হ্যাঁ, তুমি শুয়ে থাকো। ঠিক আছে,রাখছি।“ ফোনের কথাকটা কান খাড়া করে শোনে শুভদীপ। ফোনের ওপারে কি নন্দিনী?কি হয়েছে নন্দিনীর,অসুস্থ বলল। মনটা চঞ্চল হয়ে ওঠে। তবে কি ও যা ভাবছে, তাই? এই নন্দিনীর সেই সন্তান ? এইজন্যই একদম যৌবনের শুভদীপের সঙ্গে এত মিল। এ কি সেই?তাই কি নন্দিনী শুভদীপের নামটাকে জোর করে ধরে রেখেছে ছেলের মধ্যে? শুভদীপের বুকে হাতুড়ির ঘা পড়তে থাকে।ওর আবারও মনে পড়ে যায় পুরোনো সব কথা। “তুমি আমার হও শুভদীপ, আর কারও না।“ “সে তো ঠিক আছে। কিন্তু আমার বাড়িতে জানাতে হবে তো! বাবা-মাকে বোঝাতে হবে। দেখি ,সময় লাগবে ।“ “আমার জন্য এইটুকু করতে পারবে না? আমি কি শুধু তোমার সেক্সপার্টনার ?একটুও ভালবাস না আমাকে ?” “তোমার কি তাই মনে হয়? একথা বলতে পারলে?” “সত্যি! সত্যি ভালোবাস আমাকে?” “হ্যাঁ ,সত্যি।“ “তাহলে আমি যা চাইব, তা দিতে পারবে তো?” “কি চাও, বল। তুমি যা চাইবে,চলো এখনই ।“ “না গো ,আমি যা চাই তা কোন বাজারে পাওয়া যায় না।“ “মানে?” “আমাকে একটা বাচ্চা দেবে,শুভদীপ? আমার একটা বাচ্চা চাই।আমি মা হতে চাই।দেবে শুভ?“ কি উত্তর দেবে বুঝতে পারেনি শুভদীপ।শেষে ফেঁসে যাবে না তো ! জানাজানি হলে সমাজে মুখ দেখাতে পারবে না , ওর পরিবারের একটা সুনাম আছে। চাকরিটা তখন সবে পেয়েছে, বিয়ের কথাবার্তাও চলছে। কিন্তু কামনার আগুনে পুড়তে পুড়তে আগুপিছু কিছুই ভাবে নি ওরা।শুধু দুজনে, দুজনের শরীরের নেশায় ভেসে গিয়েছে। মিথ্যে প্রেমের সম্পর্কটা টিঁকে ছিল আরও কয়েক মাস। হঠাৎ একদিন নন্দিনী বলেছিল, ও মা হতে চলেছে। ততদিনে দুজনেই ছক কষে ফেলেছে এবং ওর স্বামীকে ভুলিয়ে এনে,নন্দিনীর চিত্রনাট্য রচনা করা হয়ে গেছে, যাতে ওর স্বামী কোন সন্দেহ করতে না পারে। ঠিক তখনই শুভদীপ বুঝে গেল, এই সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসার সময় হয়ে গেছে। সুতরাং সম্পর্কের শেষ করতে আর বিন্দুমাত্র দেরি করে নি ও। একটুও কষ্ট হয়নি,আসলে কোন আবেগ ভালবাসা ছিল না তো,তাই নন্দিনীকে ভুলে যেতেও ওর কোন অসুবিধা হয়নি। তারপর থেকে আর ওর কোন খবর, কোনদিনও নেয়নি শুভদীপ।মাঝেমাঝে অবশ্য একান্তে ওর কথা মনে পড়েছে ঠিকই,মনকেমনও হয়ত করেছে,কিন্তু ঐ পর্যন্তই। হঠাৎ ওর চিন্তার জাল ছিঁড়ে গেল। ট্রেন ঢুকছে। জুনিয়ার শুভদীপের কামরাতেই উঠতে হবে, নজর রাখতে হবে। কামরায় উঠে একটু দূরে থেকে ছেলেটাকে দেখে চলে শুভদীপ ।একটা অপত্য স্নেহ উঠে আসছে যেন অকারণে। হতে পারে,এ কেউ নয়। হতে পারে সেরকম কেউ নেই ।নন্দিনী বা তার কোন সন্তান, কেউ নেই। তবু ভাবতে ভাল লাগে। সেই দিনগুলোর কথা ভাবলে আজ শুভদীপের আর আগের মত রোমাঞ্চ লাগেনা,বরং আফসোস হয়। সে ভুল করেছে, সম্পর্কগুলো নিয়ে, ভালোবাসাবাসি নিয়ে, যৌনতা নিয়ে খেলা করে সে নিজেকেই সস্তা করে তুলেছে,নিজেকেই বঞ্চিত করেছে।সন্তানের মুখ দেখেনি আজও, স্ত্রীর সঙ্গে ডিভোর্স হয়ে গেছে বছর দশেক হল। কি পেয়েছে জীবনে? একটু থিতু হয়ে বসতে পর্যন্ত পারেনি,খালি দৌড়ে বেড়িয়েছে মিথ্যে মরীচিকার পেছনে।চোখটা ঝাপসা হয়ে আসে শুভদীপের,চশমাটা খুলে চোখদুটো একটু রগড়ে নেয়। তারপর ভালো করে দেখে জুনিয়র শুভদীপকে।কামরায়, চারপাশে সবাই মোবাইলে গেম খেলতে ব্যস্ত, কিন্তু এই ছেলেটা আর পাঁচজনের মতো নয়। এক কোণে দাঁড়িয়ে আজকের প্রকাশিত পত্রিকাটায় ডুবে আছে। কবিতাই এখন শুভদীপের সবকিছু, ওকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে। সম্পর্কের টানাপোড়েনে শেষ হয়ে যাওয়া একটা ব্যর্থ জীবনের হতাশার মধ্যেই হয়ত ওখানে ও কবিতার খোলা রাস্তায়, একটু মুক্তি খোঁজে। সব ব্যর্থতা,সব কষ্ট থেকে ছুটে বেরিয়ে আসতে চায়। শুভদীপ আজ একা, বড় একা। এই একাকীত্ব থেকে কবিতাই ওকে মুক্তি দেয়, শান্তি দেয়। আর কিছু নেই ওর এ পৃথিবীতে ।মনে হয় সুস্থ জীবনের প্রকৃত স্বাদ ও কোনদিনই পেল না,একটা সুন্দর সংসার ,সুখী জীবন, একটা সন্তান- সব ওর কাছে চিরকাল অধরাই থেকে গেল । আজ যৌবন ফুরিয়েছে, যা ছিল আজ সব নেগেটিভ,আলোর পথে এলনা। “আর একটু বোসো না শুভ,তুমি চলে গেলে আমি আবার একা হয়ে যাব।“ “না নন্দিনী,আজ যেতেই হবে।কাল সকালেই অফিসের কাজে টাটা যেতে হবে।“ “আবার আসবে তো!তুমি কিরকম যেন পাল্টে গেছ।“ “না,না,তা নয়।“ “আমায় কষ্ট দিও না ,শুভ। আমার জন্য তোমার একবারও খারাপ লাগে না?আমি কোন কিছু নই তোমার কাছে,না?” “তুমি তো মা হতে চেয়েছিলে,আমিও আমার কথা রেখেছি।আর কি চাও আমার থেকে?” “আর কিচ্ছু চাই না।তুমি আমাকে অনেক দিয়েছ,আমি সারাজীবনেও তোমার ঋণ শোধ করতে পারব না। শুধু আমাকে একা করে দিয়ে যেও না,আমি কোথায় মুখ লুকোবো বলো! তুমি ছাড়া আমার যে আর কেউ নেই।” “আমার কিছু করার নেই,নন্দিনী। একটু বোঝার চেষ্টা কর প্লিজ।“ “আমার কি হবে ,শুভ?আমার বন্ধু হয়ে অন্ততঃ থেকে যাও।তোমার কোন ভয় নেই,তোমার কোন ক্ষতি আমি জীবন থাকতে হতে দেব না।“ “জানি,আর আমিও তোমাকে সারাজীবন ভালবাসব।আবার আসব,কথা দিলাম।শুধু আজ আমায় যেতে দাও।“ “সবকিছু শুধু তোমার কথা মত হবে ,তাই না শুভ?আমার জন্য তোমার কোন সময় নেই,কথা বলারও না।শুধু যাবার তাড়া।“ বিশ বছর আগের এক দুপুরের এসব কথা ভেসে ওঠে শুভদীপের মনে। নন্দিনীকে ছেড়ে চলে আসার দিন ।নন্দিনী মনে হয় কিছু বুঝতে পেরেছিল ,ওকে কিছুতেই যেতে দিচ্ছিল না। শুভদীপের তখন ফেঁসে যাবার ভয় বড় হয়ে দেখা দিয়েছিল, সবে পাওয়া চাকরি ,ওদিকে নন্দিনী প্রেগনেন্ট ।ওর স্বামী ইম্পোটেন্ট, তক্ষুনি বেরিয়ে আসতে হবে এই সর্বনাশা সম্পর্ক থেকে। নন্দিনীকে স্বার্থপরের মত ছেড়ে এসে, কোনরকমে সেদিন শেষবারের মতো বাড়িটা থেকে পালিয়ে, বেরিয়ে এসেছিল শুভদীপ।কারণ, ততক্ষণে ও মনস্থির করে ফেলেছে, আর ফিরে তাকায়নি কোনদিনও। হঠাৎ ছেলেটা দরজার দিকে এগোতে, চিন্তায় ছেদ পড়ে শুভদীপের। শোভাবাজার এসে গেছে। আর মাত্র একটু সময়, তারপরেই সব পরিষ্কার হয়ে যাবে। মন্ত্রমুগ্ধের মতো ও অনুসরণ করতে থাকে ছেলেটাকে। স্টেশন থেকে বাইরে বেরিয়ে গ্রে স্ট্রিট ধরে সবে একটু গেছে, হঠাৎ ছেলেটা দাঁড়িয়ে পড়ে। তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে শুভদীপের মুখোমুখি হয়, ওর দিকে এগিয়ে এসে ওকে চার্জ করে। “কি ব্যাপার বলুন তো, আপনি কে? কেন আমার পিছনে পিছনে আসছেন?” শুভদীপ বুঝে উঠতে পারে না, কি বলবে। আমতা আমতা করে বলে “না, মানে আমি তো এখানেই থাকি।“ ছেলেটা শুভদীপের চোখের দিকে তাকায়, একটু গভীর দৃষ্টি দিয়ে ওকে খুঁটিয়ে দেখে। তারপর একটু নরম হয়। মৃদু হেসে বলে,”ও”। বলেই আবার হাঁটা দেয়।গলাটা শুকিয়ে আসে শুভদীপের। ছেলেটা কি বুঝতে পেরেছে? শুভদীপ দূরত্ব আরও বাড়িয়ে দেয়। শেষে হাঁটতে হাঁটতে ,শুভদীপ তাল রাখতে পারে না, পিছিয়ে পড়ে।ছেলেটা বেশ খানিকটা এগিয়ে গেছে।আর একটু জোরে হাঁটলে,হয়ত এখনও ওকে ধরা যাবে।কিন্তু শুভদীপ সে চেষ্টা করে না,বরং দাঁড়িয়ে পড়ে।সব চলায় যেমন একদিন থামতে হয়,সেরকমই। সে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল,'তুমি কে?কোথা থেকে আসছ?' আমি বললুম 'আমি অতীত থেকে আসছি,অন্য আলোয় যাকে দেখেছিলুম,তাকেই খুঁজছি।' সে বলল 'আলো তো নিভে গেছে এখানে,অনেক আগে।' আমি বললুম 'তাহলে অন্ধকারেই খুঁজি,এই তো! বেশ দেখা যায়।'

14 October 2019

অন্য প্রেম

ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করতে না করতেই, ক্যাম্পাস ইন্টারভিউতে কুনাল চাকরি পেয়ে গেল জামশেদপুরে একটা বড় কোম্পানিতে। কলকাতার দামাল ছেলেটা, চোখের জল ফেলতে ফেলতে বিদায় দিল পুরনো শহর, পুরনো বন্ধু-বান্ধব- আত্মীয়স্বজন ,এমনকি পুরনো প্রেমিকাকে পর্যন্ত। চার ঘণ্টা জার্নি করে রোজ রোজ তো আর বাড়ি ফেরা যায় না, মাসে দু’মাসে ছুটিতে, এক আধবার বাড়ি আসতে পারে বটে ,কিন্তু সবার সঙ্গে আগের সেই যোগাযোগটা কমে গেল। প্রতিবার ছুটির শেষে ওকে যখন আবার জামশেদপুরে ফিরে যেতে হত, বুকটা যেন ফেটে যেত। চোখে জল এসে যেত কুনালের। কিন্তু সময় থেমে থাকে না। মানুষকেও সব পরিস্থিতিতে মানিয়ে চলতে হয়। জামশেদপুরে আস্তে আস্তে মন বসতে শুরু করল কুনালের, কিছু নতুন বন্ধুও হল, তবে সবই কলিগ স্থানীয়। বেশকিছু বাঙালির বাস এখানে, তাছাড়া স্থানীয় মানুষজনও খারাপ নয়। তাদেরকেই আত্মীয় করে নেওয়া ছাড়া আর উপায়ই বা কি? মাঝেমধ্যে এক এক দিন বিকেলে, তাদের সঙ্গে জুবিলি পার্ক বা দলমা পার্কে ঘুরে আসাটাই ছিল একমাত্র মনকে তাজা করার উপায়। ততদিনে শম্পার সঙ্গে সম্পর্কটাও কিছুটা হালকা হয়ে এসেছে, চোখের বাইরে মানে সত্যিই মনেরও বাইরে। দিনগুলো কাটছিল বড় একঘেয়ে। হঠাৎই একদিন বিকেলে, কুণালের মোবাইলে একটা ফোন এল, অচেনা নম্বর থেকে। একটা মেয়ের গলা, মেয়েটা কাকে যেন খুঁজছে। ফোনটা কাটতে গিয়েও, কুণালের মনে হল, আরে মেয়েটার গলাটা তো বেশ মিষ্টি , কেমন যেন মাদকতাময়। -হ্যালো কনিকা? -কে বলছেন? -আপনি কে বলছেন? -আমি কুনাল। - কুনাল! ও সরি। এটা কোথায়? - জামশেদপুর। -ও, আমি ভাবলাম বোধহয় কণিকার নাম্বার। -না না, রং নাম্বার। -ও, ভুল হয়ে গেছে। আচ্ছা, রাখছি। -না না, ঠিক আছে। আপনার নামটা জানতে পারি? -ঝিমলি। ফোনটা ছেড়ে দেয় কুনাল। কিন্তু ঝিমলিকে ভুলতে পারে না। বেশ সুন্দর গলাটা ওর, ভালো কথাও বলতে পারে । কেমন দেখতে কে জানে? শেষকালে রং নাম্বারের সূত্রেই রাইট পার্টনার পেয়ে গেল দুজনে। মাঝেমধ্যেই কথাবার্তা হতে লাগল ওদের মধ্যে। সম্পর্কটা ধীরে ধীরে জমে উঠতে শুরু করল। ঘন্টার পর ঘন্টা ফোন, কখনো বা মেসেজের পর মেসেজ। ফেসবুক , হোয়াটসঅ্যাপ কোনটাই অবশ্য ঝিমলির নেই, ও থাকে মুর্শিদাবাদের এক অখ্যাত গ্রাম ভৈরবটোলায়। কিন্তু কিভাবে যেন, দুজনে দুজনের দুর্নিবার আকর্ষনে বাঁধা পড়ে গেল। ক্রমশঃ কুনাল আর ঝিমলি একে অপরের মনের মানুষ হয়ে উঠল, মেড ফর ইচ আদার যাকে বলে আর কি। প্রতিদিন বেশ ক'বার ফোনে কথা না বললেই নয়, প্রাণটা যেন আকুলিবিকুলি করে। কুনাল একদিন ঝিমলিকে বলল,'শুধুই কি আমরা ফোনফ্রেন্ড? আমি তোমাকে দেখতে চাই, মিট করতে চাই, সামনাসামনি । 'কেন? এই তো বেশ চলছে। এখন আমার দেখা করার প্রবলেম আছে।', ঝিমলি ওকে দমিয়ে দেয়। 'কিসের প্রবলেম?’ ,কুনাল অধীর হয়ে বলে। -তুমি বুঝবে না, আমার বাড়িতে খুব কড়াকড়ি । তুমি দেখা করতে এসেছ জানলে, সর্বনাশ হবে। আমাকে আর তোমাকে ফোন করতেও দেবে না। -ঠিক আছে, সামনে দেখতে না পাই, একটা ছবি অন্ততঃ পাঠাও, প্লিজ।তোমাকে যে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। -হুঁ, কিন্তু কিভাবে পাঠাব? -কেন? ফেসবুক বা হোয়াটসঅ্যাপে! ইউজ করতে শুরু কর এবার, কতবার তো বললাম। -ধুর, আমার ফোনে ওসব হবেই না। আমারটা যে স্মার্টফোন নয়। -তো একটা স্মার্টফোন কিনে নাও না! -না গো, অত সোজা নয় ।বাবা আমাকে কিনেই দেবেনা । বাবার সামান্য রোজকার, মিলে চাকরি করে। এই ফোনটা কিনে দিয়েছে এই ঢের। -আরে বাবাকে বলেই দেখ না,নইলে টিউশনির পয়সা জমিয়ে জমিয়ে কেন। -দেখি, অত সহজ নয়, সময় লাগবে। আমার জমানো টাকাতেই তো প্রতি মাসে রিচার্জ করি, ওটাও বাবা দেয় না। আমার কাছে স্মার্টফোন স্বপ্নই! -ঠিক আছে, ঠিক আছে ,কিন্তু আমাকে তোমার একটা ছবি পাঠাতেই হবে, আমার চাইই। প্লিজ, না বোলো না। তোমার কোন বন্ধুর মোবাইল থেকে অন্তত পাঠাও। -আচ্ছা দেখছি, দাঁড়াও, পরে বলছি। এইভাবেই চলতে থাকে, ছবি আর পাঠানো হয় না। কুনাল ততদিনে ঝিমলির প্রেমে পাগল, ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে দুজনে কত প্রাণের-মনের কথা হয়।কুনাল বুঝতে পারে ,ঝিমলি ঠিক ওর মনের মত, যেমনটি ও চায়।এক দুর্নিবার আকর্ষণে, ঝিমলির পিছনে দেহমন ঢেলে দেয় কুনাল। ওর জীবন এখন ঝিমলিকে ঘিরেই, বাড়ি ফেরার তাগিদও এখন আর ততোটা অনুভব করে না ও। কুনাল একদিন ভাবল, মুর্শিদাবাদে চলে যাবে। ঝিমলিকে নিজের মাইনের টাকা থেকে একটা স্মার্টফোন কিনে দেবে। কিন্তু ঝিমলি বারণ করে, পরে আসতে বলে। বাড়িতে নাকি সমস্যা হবে। কুনাল তখন ঝিমলির প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে, ঝিমলিও। কুনাল বুঝতে পারে না, এত যদি ভালবাসা, ঝিমলির দেখা করতে বা ফটো পাঠাতে তাহলে এত আপত্তি কিসের! একদিন হঠাৎ একটা ঘটনা ঘটে। কুনাল সেদিন ওর মোবাইল নাম্বারটা রিচার্জ করতে ভুলে গেছে, ব্যালেন্স নেই, আউটগোইংও বন্ধ। ওখানে ও একটা লোকাল নাম্বার নিয়েছিল, সেটা থেকেই তখন ও ঝিমলিকে ফোন করে। ওদিকে একজন ফোন তোলে ,কিন্তু ঝিমলির গলা নয়, এ গলা পুরুষালী।কুনাল কথা বলতে, মুহুর্তেই সেই গলা আবার ঝিমলিতে পরিণত হয় ।কথাবার্তা সেদিন আর সেরকম জমেনা। কুনাল একটু সন্দেহগ্রস্ত হয়। ওর কয়েকজন বন্ধুর ,কয়েকটা অদ্ভুত অভিজ্ঞতার কথা ওর মনে পড়ে যায়। ওরা হিজড়ের প্রেমে পড়েছিল। মেয়ের গলা নকল করে ওরা ছেলেদের ফাঁসাত। আর ওর বন্ধুরাও, কতবার মেয়ে ভেবে আসলে সেই হিজড়েদের মোবাইল রিচার্জ করে দিয়েছে বা অনলাইনে কোন গিফট কিনে পাঠিয়েছে। এইভাবে প্রেমের ফাঁদে পড়ে , অনেক টাকা ক্ষুইয়ে ওরা শেষমেষ বোকা বনে গেছল। দেখা করতে যাবার জন্য জোর করতেই, সব সম্পর্ক ঐসব হিজড়েরা কেটে দিয়েছে। এসব মনে পড়ায়, কুনাল ঝিমলির ব্যাপারটা নিয়েও একটু দ্বিধাগ্রস্ত হয়। এরকম কোন ফাঁদে ও নিজেও পা দিয়ে ফেলল না তো! ঝিমলির গলাটা কেমন যেন ছেলেদের মতো লাগল, হিজড়ে নয়তো! অন্য নম্বর থেকে ফোন আসাতে কি ওর আসল সহজাত গলাটা বেরিয়ে এসেছিল? ছবিই বা পাঠায় না কেন, দেখাই বা করেনা কেন! পরের দিনই , সন্দেহগ্রস্ত হয়ে, কুনাল এইসব প্রশ্নে প্রশ্নে জেরবার করে দেয় ঝিমলিকে। -তোমার গলাটা কাল ওরকম লাগছিল কেন? -কেন? কি রকম? -কিরকম আবার? তোমার গলা তো মেয়েদের মতো নয়! -মানে? কি বলছ ! -ঠিকই বলছি। আমি স্পষ্ট শুনলাম ছেলেদের গলা। -ও ওটা? আসলে আমার না কাল শরীরটা খুব খারাপ ছিল। গলাটাও বসে গেছিল ঠান্ডা লেগে। -থাক, মিথ্যে কথা কেন বলছ? -আমি মিথ্যে কথা বলি! তুমি একথা বলতে পারলে! -হ্যাঁ, পারলাম। তুমি আমার সঙ্গে ভালবাসার খেলা খেলছ, আমাকে ঠকাচ্ছ। -কি যা তা বলছ তুমি? কি খেলা খেলেছি তোমার সঙ্গে? - তুমি জান না? তুমি মেয়ে নয়, হিজড়ে। আমি যা বোঝার সব বুঝে গেছি। -কি বুঝেছ? তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? -মোটেই না। তুমি কেন আমার সঙ্গে এরকম অভিনয় করছ? আমাকে ফাঁসাচ্ছ? -অভিনয়! কি করেছি তোমার সাথে? কোনদিন কিছু সুবিধা নিয়েছি কি? তাহলে কেন এসব কথা বলছ! -না, মানে.. -আমি তোমাকে ভালোবাসি কুনাল। -ভালোবাসা! থাক, আমার বোঝা হয়ে গেছে। - কি বুঝেছ, শুনি? ঝিমলি কেঁদে ওঠে। কুনাল রেগে ফোনটা কেটে দেয়। কিন্তু তারপরেই ও একটু দোনামোনায় পড়ে যায়। ঠিকই তো, বন্ধুদের শোনা গল্পের মতো ঝিমলি তো কোনদিন কুনালকে মোবাইল রিচার্জ করতে বা কোন গিফট পাঠাতে বলেনি। তাহলে? কিন্তু সন্দেহটা ওর মনে গেঁথে যায়। আরো ভালভাবে পরীক্ষা করার জন্য কুনাল এবার ওর বন্ধু অনুপের সাহায্য চায়। অনুপ মুর্শিদাবাদের জিয়াগঞ্জে থাকে, ঝিমলিদের গ্রামটাও চেনে। দুদিনেই খবর পেয়ে যায় কুনাল, যা সন্দেহ করেছিল, ঠিক তাই।ওর করা ফোনও, কোন ছেলেই তুলেছে। তাছাড়া অনুপ বলে, ‘ওই এলাকায় প্রচুর হিজড়ে থাকে, ওরা তো এসবই করে, তুই জানতিস না? তুইও শেষে ওদের পাল্লায় পড়লি?’, অনুপ ব্যঙ্গ করে। কুনাল ভেঙে পড়ে। ছি,ছি, কি না কি ভেবে এসেছে এতদিনের ফোনফ্রেন্ডকে। কত মনের কথা বলেছে, হৃদয় দিয়ে ফেলেছে শুধু ওই সুন্দর গলার মোহে। এত যাকে ভালবেসে ফেলেছে, সে হিজড়ে! ঝিমলিকে নিয়ে এত স্বপ্ন দেখেছিল, সব ভেঙে চুরমার হয়ে গেল! ঝিমলি মেয়ে নয়! রাগে, অপমানে নিজের চূড়ান্ত হয়রানিতে বোকা বনে গিয়ে, দিকবিদিক জ্ঞানশুন্য হয়ে আবারও আর একটা অন্য নাম্বার থেকে ঝিমলিকে ফোন করে কুনাল। দেখে, যা ভেবেছিল ঠিক তাই, পুরুষকন্ঠ। বেশ দু’চার কথার পরে, নিজের পরিচয় দিয়ে, নিজের আসল গলা চেনায় কুনাল।রেগে চিৎকার করে ওঠে। -ছিঃ, ঝিমলি। তুমি এরকম? -কেন গো কি হয়েছে? -কি হয়েছে জান না! তুমি মেয়ে সেজে আমাকে দিনের পর দিন বোকা বানিয়ে চলেছ? -আমি তোমাকে বোকা বানাচ্ছি! কোনদিনও নয় কুনাল। -থামো। তুমি এতদিন ধরে আমাকে নিয়ে খেলা করলে! আমার ভালবাসা নিয়ে মজা করলে !ছি ছি! -কি বলছ তুমি! আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। প্লিজ রাগ কোরো না। আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচব না কুনাল। -চুপ করো। আজ থেকে আমি আর তোমার সঙ্গে কোন সম্পর্ক রাখতে চাই না, সব সম্পর্ক শেষ। - প্লিজ সোনা, আমাকে ভুল বুঝোনা প্লিজ। আমাকে ছেড়ে যেও না, আমি মরে যাব। -দূর হয়ে যাও আমার জীবন থেকে, মিথ্যেবাদী! ইনিয়ে বিনিয়ে কাঁদতে থাকে ঝিমলি, আবার মেয়েলি গলায়। ওর কি দুটো সত্ত্বা আছে নাকি? নাকি পুরোটাই অভিনয়? ট্রান্সজেন্ডার সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানেনা কুনাল। শুধু ওদের ঘৃণা করতে হয়, সেইটুকু জানে। ও মেয়ে নয়, তাই কুনালের আকর্ষণের আর একটুও অবশিষ্ট থাকে না। শরীর যেখানে নেই, সেখানে মন আসে কি করে? কুনাল ফোনটা কেটে দেওয়ার পর, ঝিমলি পাগলের মত বিছানায় ঝাঁপিয়ে পড়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে।মেয়েলি কান্না,ওর শাড়ি অবিন্যস্ত হয়ে যায়। শাড়ির ভেতর ওর শরীর, সেটা পুরো মেয়েলি নয়। কিন্তু মন? সেটাতো মেয়েরই ছিল। আর সেই ভালবাসাতেও কোনো ফাঁকি ছিল না। মনের তো আর ট্রান্সজেন্ডার হয়না!

কুসুম ফোটেনি

-নহরপুলের কাছে কি হয়েছে শুনেছিস?
-না তো! কি হয়েছে?
-রেপ হয়েছে রেপ,যা দেখে আয়।কত ফটো তুলবি,তুলে আয়।
-সে কি রে? তুই কি করে জানলি?
-আরে, মেয়েটাকে জঞ্জালের মধ্যে পড়ে থাকতে, আমিই তো প্রথম  দেখেছি,সেই সকালে।
-পুলিশে জানাস নি?
-ধুর!আমার কি! মরুক গে।
                   সত্যিই তাই। কারও কিছু না। বিক্রম শহরের কাছে, সেদিন ভোরে যখন ময়লা, ছেঁড়া জামাকাপড় পরা,বছর বারো তেরোর মেয়েটাকে জঞ্জালের গাদার মধ্যে দেখা গিয়েছিল, ভিড় জমে গিয়েছিল। কোথা থেকে এল মেয়েটা ,কিই বা হয়েছিল ওর? সবাই তো প্রথমে ভেবেছিল মেয়েটা বোধহয় মরেই গেছে। পরে দেখা যায় বেঁচে আছে, অল্প নড়ছে চড়ছে। সারা শরীরে অত্যাচারের ছাপ স্পষ্ট। কিন্তু হেলদোল হয়নি এলাকার বাসিন্দাদের। কোথাকার মেয়ে,কে তুলে নিয়ে গিয়ে রেপ করে ফেলে গেছে,কে জানে? পাশেই জিটি রোড, সারারাত ট্রাক যাবার কমতি নেই।চারিদিকে তো এরকম কত ঘটনার কথা শোনা যায়, কে কার খবর রাখে !রোগা-পাতলা অপুষ্ট শরীরের মেয়েটা কাতরাচ্ছে।আসলে মেয়ে তো,খেতে না পাক, ভগবানের দেওয়া শরীর আছে না! নিজে খাবার হতে বাধা কোথায়? চারপাশে এত লোলুপ দৃষ্টি। হায়রে, অভাগা দেশ। নিজের ঘরে বসে এই কথাগুলোই ভাবছিলেন চন্দ্রভূষণ, এলাকায় শিক্ষক হিসেবে তার খুব সুনাম আছে। চন্দ্রমাস্টার আর ভাবলেন না ,এভাবে চুপচাপ বসে সব দেখা যায়না। নিজের বন্ধু ও প্রতিবেশী সুদীপকে নিয়ে চলে গেলেন ভ্যাটের কাছে।
‘কি হল বল তো, কি করতে চাইছিস তুই ?’ সুদীপের গলায় বিস্ময় ।
-কি করব বুঝতে পারছিনা। কিন্তু এ তো চোখে দেখা যায় না। মেয়েটা মনে হচ্ছে বেঁচে আছে।
-সে তো দেখেছি। কিন্তু থানা-পুলিশের ঝামেলায় জড়াস না রে চন্দ্র। ফেঁসে যাব। রেপ কেস।
-তা বললে হয়! মেয়েটাকে এভাবে পড়ে পড়ে মরে যেতে দেব ?
-কি করবি তবে?
-চল, বলছি।
                  দুজনে গিয়ে হাজির হলেন জঞ্জালের স্তুপে। তখনও দর্শকসংখ্যা নেহাত কম নয়। মুখরোচক আলোচনা চলছে, ঘৃণায় তাদের দিকে একটা জ্বলন্ত দৃষ্টি ছুড়ে দিয়ে, পাশের চায়ের দোকান থেকে বোতলে করে একটু জল নিয়ে এলেন চন্দ্র। তারপর মেয়েটার পাশে বসে একটু একটু করে মুখে চোখে জলের ঝাপটা দিতে লাগলেন। ওর নিজের মেয়েও তো প্রায় এই বয়সীই, এমনি যদি ওর নিজের মেয়েটার হত? মেয়েটার কপালে হাত রাখলেন চন্দ্র, জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে, সারা শরীরে যন্ত্রণার ছাপ। জল দিতেই একটু যেন নড়ে চড়ে উঠল মেয়েটা। চন্দ্র বললেন,‘এই মেয়ে, তোর নাম কি? তোর কি হয়েছে?উঠে বসতে পারবি?’
                মেয়েটা গোঙানির মত একটু শব্দ করল। তারপর অস্ফুটে বলে উঠলো ‘পানি, পানি’। চন্দ্রমাস্টার মেয়েটার মাথাটা পরম মমতায় নিজের কোলে তুলে নিলেন ।ততক্ষণে আর একটা জলের বোতল নিয়ে এসেছে সুদীপ। সেই বোতল থেকে একটু একটু করে জল ঢেলে দিতে লাগলেন মেয়েটার ঠোঁটের ফাঁকে, তখনও সেখানে রক্ত শুকিয়ে রয়েছে। মেয়েটা অতিকষ্টে একটু ঠোঁট ফাঁক করে অল্প জল খেল, তারপর আবার যন্ত্রনায় কঁকিয়ে কেঁদে উঠল,  চোখের কোন দিয়ে দু’ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল,রক্ত-ধুলো-ময়লার মধ্যেই।
                ‘কোথায় যন্ত্রণা রে তোর মেয়ে?’, বলতেমেয়েটা নিজের নিম্নাঙ্গের দিকে একটা হাত অল্প তুলে দেখাল। লজ্জায় মাথা নিচু হয়ে গেল চন্দ্র-সুদীপের, সব বুঝতে পারলেন।হঠাৎ মেয়েটা কেঁদে উঠল ‘আম্মা, আম্মা’ করে, তারপর আবার বেহুঁশ হয়ে গেল।আস্তে আস্তে ওরা মেয়েটাকে আবার ওখানেই শুইয়ে দিলেন, চারপাশে ভ্যাটের দুর্গন্ধ।কিন্তু কি করা যাবে? চারপাশের মানুষগুলো তখন একটু তফাতে। ওদেরও কি লোলুপ দৃষ্টি,যেন চোখ দিয়ে খাচ্ছে সব।পারলে ওরাও ছিঁড়েখুঁড়ে খেত মেয়েটাকে। পারেনি, সুযোগ পায়নি বলে। মেয়েটার যে এই দশা করেছে,সেই নরপিশাচটার থেকে,আলাদা কিছু নয়। ঘৃণাভ’রে ওদের দেখে,চন্দ্রমাস্টার উঠে পড়লেন। ‘চল রে সুদীপ, থানায় যেতে হবে। একটা এফআইআর করা দরকার।‘
                (বাকিটা জানতে গল্পটা পুরো পড়তে হবে)

7 October 2019

তেরো তারিখ শুক্রবার

সৌরদীপের অফিস একটা প্রাচীন বিশাল সরকারি বাড়িতে।সবাই বলে ‘লালবাড়ি’। বাড়িটার  এখন সম্পূর্ণ রিনোভেশন চলছে। সবকিছু কালের যাত্রায় আজ জীর্ণ,ভঙ্গুর। তাই ভেঙেচুরে সারানোর সঙ্গে সঙ্গে, পুরনো ঐতিহ্যবাহী বাড়িটাকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচানোরও একটা চেষ্টা চলছে।এ এক বিশাল কর্মযজ্ঞ। বেশিরভাগ অফিসই অন্য বাড়িতে সরানো হয়ে গেছে, মাত্র কয়েকটা অফিস এখনো কোনরকমে টিমটিম করে চলছে। তার মধ্যে সৌরদীপদের এডুকেশন ডিপার্টমেন্টও আছে। চারিদিকে ঠকঠকাঠক ভয়ানক শব্দের মধ্যেই, কাজ করে চলেছে গুটিকয়েক মানুষ । অবশ্য সকলেই নতুন ঝাঁ চকচকে অফিসে শিফ্ট হবার দিন গুনছে। ক্যান্টিন,টি -স্টল  সবই প্রায় বন্ধ। বিশাল বাড়িটাকে এখন আর চেনাই দায় ,চারদিকে ভাঙা রাবিশ, কড়ি-বরগা-দরজা-জানলা, লোহার গ্রিল, পুরোনো ফার্নিচার ,নানা রকম জিনিসপত্র, হাবিজাবি সব ভর্তি।
 সেদিন একটু তাড়াতাড়িই বাড়ীর পথে পা বাড়িয়েছিল সৌরদীপ।কাল শনিবার ,পরশু রবি, পরপর দুদিন ছুটি। ভেবেছিল সুচেতাকে নিয়ে ঘুরে আসবে বর্ধমানে নিজেদের দেশের বাড়ি থেকে, দুদিনের জন্য। সবে বাড়ি ফিরে জুতোটা খুলে, ঘরে ঢুকেছে, অমনি ফোন। ওরই কলিগ তনু। ‘কিরে, কি হলো আবার?’, সৌরদীপের মনে শঙ্কা। আগে বেরিয়ে পড়েছে বলে বস আবার গাল পাড়ছে না তো! তনুর গলায় তখন উৎকণ্ঠা। ‘শোন, একটা ব্যাপার হয়ে গেছে ।সকাল থেকে সরখেলবাবুকে দেখেছিলি তুই?’ ‘না, মানে একবার মনে হচ্ছে দেখেছিলাম।কেন কি হয়েছে?’ ‘আরে সেটাই তো, আমিও তো দেখেছি সকালে, টয়লেটে যাবার  সময়।‘ ‘হ্যাঁ,তো কি হয়েছেটা কি,বলবি তো?’ সৌরদীপের গলায় উদ্বেগ। ‘আর বলিস না।সরখেলবাবুকে পাওয়া যাচ্ছে না।‘ ‘পাওয়া যাচ্ছে না! মানে?’ ‘মানে বলছি। তুই একবার এখনই অফিসে ফিরে আয়।‘ ‘কি?আবার এক ঘন্টা বাস জার্নি করে অফিস যাব! ইয়ার্কি পেয়েছিস?’ ‘ না রে,  কেসটা সিরিয়াস ।সবাই খুঁজছে, চলে আয় তাড়াতাড়ি’, বলে ফোনটা কেটে দেয় তনু।
সৌরদীপের মেজাজটা খিঁচড়ে যায়। কাল সকালে বর্ধমান যাবার বাস ধরার আছে। গোছাগুছি সব বাকি। এর মধ্যে আবার কি এক উটকো ঝামেলা হল! কিন্তু তনুর গলায় কিছু একটা ছিল, একটা অশুভ ইঙ্গিত ।মনটা কুডাক দিল সৌরদীপেরও। কি হল অফিসে,অদ্ভুত কান্ড! সরখেলবাবুকে  পাওয়া যাচ্ছে না কেন?কোথায় গেলেন অফিস থেকে! এই তো সামনের মাসেই ওনার রিটায়ারমেন্ট। নিপাট, অমায়িক ভদ্রলোক, সাতে-পাঁচে থাকেন না, পার্টি -পলিটিক্সের ধার ধারেন না, চাঁদাতে না বলেন না, চায়ের পয়সা বাকি রাখেন না, অযথা অফিস কামাই করেন না এমনকি চেয়ারে বসে ঢোলেনও না।শুধু একটাই সখ ভদ্রলোকের- খুব গ্যাজেট ভালোবাসেন।প্রায়ই নতুন কিছু না কিছু জিনিস এনে সবাইকে দেখান।তা সে স্মার্ট ওয়াচই হোক , নতুন ক্রেডিটকার্ড সাইজ মোবাইল  বা ম্যাগনেটিক পাজল্।সেই সরখেলবাবু বেপাত্তা!
 আধঘন্টাতেই উল্টোদিকের বাসে চেপে, অফিসে পৌঁছে যায় সৌরদীপ। গিয়ে দেখে এলাহি কান্ড। অফিসে ভেঙে পড়েছে সমস্ত ডিপার্টমেন্টের লোকজন।বস উৎকন্ঠিত হয়ে এদিক ওদিকে ছুটে বেড়াচ্ছেন আর ফোন করছেন। সেকশনাল হেড তো থানায় ফোন করেছেন ,সবাইকে বলছেন ’একটু খুঁজে দেখুন না, ভদ্রলোক কোথায় গেলেন!’ খোঁজা তো যথেষ্ট হয়েছে গত এক-দেড় ঘন্টায়। সৌরদীপ চলে গেল ওনার চেয়ারের কাছে। চেয়ার থেকে ঝুলছে ওনার ব্যাগ, যেমন রোজ ঝোলে । টেবিলের ওপর ওনার চেনা টিফিন ক্যারিয়ারটাও  দিব্যি সাজানো  রয়েছে। তার পাশে খোলা রয়েছে ওনার ফাইলপত্র , এমনকি ফাইলের উপর ওনার পেনটাও খোলা অবস্থায় পড়ে রয়েছে।বোঝাই যাচ্ছে ,হঠাৎ কোন কারণে উঠে গিয়েছিলেন। সব যেমনকার তেমন আছে,শুধু মানুষটাই নেই।অবাক কান্ড।
সবাই বলাবলি করছিল, সকালে যেমন আসেন তেমনটিই এসেছিলেন, ঠিক দশটায়, ইন সাইনও করেছেন। গেটে দুজন দারোয়ান সবসময় থাকে।তারাও ওনাকে নেমে যেতে দেখেনি। ওরা তো প্রত্যেককে চেনে, নাম জানে ।এখন লোকজন কমে যাওয়ায়, ওদের পক্ষে হিসেব রাখা আরো সহজ হয়েছে।তাহলে সরখেলবাবু গেলেনটা কোথায়? অফিসের প্রতিটা ঘর খোঁজা হয়েছে, প্রতিটা বাথরুমও , এমনকি স্টোররুম ,রেকর্ডরুম পর্যন্ত বাদ যায় নি। কোথাও নেই সরখেলবাবু। সবাই সবদিক খুঁজেছে,ওনার মোবাইলে ফোন করলে খালি বেজে যাচ্ছে ,সবার মনে উৎকণ্ঠা। এদিকে পুলিশ এসে গেছে, জয়েন্ট সেক্রেটারিও হাজির,  মিসিং ডায়েরিও করা হয়েছে।
 হঠাৎ ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে ছুটে আসে পিওন তপা।চিৎকার করে বলে ‘পাওয়া গেছে। সবাই এদিকে এসো।‘ ওর দেখানো আঙুলের দিকে লক্ষ্য করে, সবাই হুড়মুড় করে ছুটে চলে। সিঁড়ি দিয়ে নামার বদলে উপরে উঠতে থাকে তপা।আরে! উপরে কেন!ওখানে তো কাজ চলছে রিনোভেশনের। লাল রিবন দিয়ে ঘেরা,ডেন্জার ট্যাগও লাগানো রয়েছে। ওখানে কি করতে গেছলেন উনি! সিঁড়িটা ঘোরার মুখেই পাওয়া যায় সরখেলবাবুকে। মাটিতে বসে আছেন ,কিছু পুরোনো ফার্নিচার,হাবিজাবির মধ্যে, বিস্ফোরিত চোখ। বোঝাই যাচ্ছে দেহে প্রাণ নেই।উল্টো দিকের দেওয়ালে টাঙানো একটা বহু পুরোনো ,বন্ধ গ্র্যান্ড ফাদার  ক্লকের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন তিনি। যেন খুব ভয় পেয়েছেন, বা শক পেয়েছেন কিছু দেখে।ডাক্তার এসে দেখে গেল ,বললো হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যু। সৌরদীপ অবাক হয় ,সব ঠিক যেন স্বাভাবিক নয়,ও কিছু একটা  রহস্যের আঁচ পায়।এদিকে সবার মধ্যে ফিসফাস চলতে থাকে, এত জায়গা থাকতে, নিজের চেয়ার ছেড়ে, এখানে কি করছিলেন সরখেলবাবু, কারও কাছেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হয় না।
(রহস্যের জাল বিস্তার জানতে পুরো গল্পটা পড়তে হবে)

13 September 2019

অস্তিত্ব

অর্ণব আর স্বাতীর তিন বছর হল বিয়ে হয়েছে, কিন্তু এখনও ওদের যেন হনিমুন ফেজ।একটু সুযোগ-সুবিধে আর অফিসে ক’দিন ছুটি পেলেই, ওরা দুজনে বেরিয়ে পড়ে রোমান্টিক আউটিংয়ে। অর্ণব কদিন হল একটা নতুন এসইউভি কিনেছে। ক’দিন ধরেই প্ল্যান করছে, কোথাও একটা গাড়িটা নিয়ে লংড্রাইভে বেরিয়ে পড়তে হবে।আর সুযোগটাও সেরকম হঠাৎই এসে গেল ।শুক্রবার পনেরোই আগস্ট পড়াতে টানা তিন দিন ছুটি । ক’দিন ধরেই স্বাতীও বায়না করছিল ‘চলনা , অনেকদিন ধরে কোথাও যাওয়া হয়নি।‘ ‘সেকি গো! এইতো দু’মাস আগেই দীঘা থেকে ঘুরে এলে।‘ ‘ধুর,দীঘায় গিয়ে গিয়ে পচে গিয়েছে। কোন অফবিট জায়গায় চলনা যাই। দু’ দিনের জন্য।‘ ‘দাঁড়াও দেখি, সেরকম কোন জায়গা খুঁজে পাই কিনা।‘ বেশি খুঁজতে হল না, ওদের ফ্যামিলি ফ্রেন্ড সুকল্যানরা কদিন আগেই ঘুরে এসেছিল পুরুলিয়ার বড়ন্তি থেকে।সুকল্যান রসিয়ে রসিয়ে বলল ‘লেকের ঠিক সামনেই কটেজগুলো,বুঝলি? শুধু নীল জল চারিদিকে, দারুন জায়গা। বিকেলে লেকের সামনে দুজনে চেয়ার নিয়ে বসে, যখন পকোড়া আর চা খাবি, দেখবি বিশাল লেকের পিছনে, বড় বড় পাহাড়ের আড়ালে সূর্যাস্ত হচ্ছে, আর তার সাতরঙা আলো ছড়িয়ে পড়ছে চারিদিকে।‘ ওর বউ সুস্মিতাও টিপ্পনি কাটল, ’বুঝলি স্বাতী,ওখানে তোদের রোমান্স আরো জমে উঠবে।‘ সত্যিই ওদের রোমান্স যেন শেষ হবার নয়,আর বর্ণনা শুনে জায়গাটাও ওদের মনে ধরল। স্বাতী তো এক পায়ে খাড়া।অর্ণবও বলে উঠল, ’আরিব্বাস,দারুন তো,নেক্স্ট ট্রিপ তাহলে বড়ন্তি’ । বর্ষাকাল, খুব একটা ভিড়ভাট্টা নেই বলে,সুকল্যানের বলে দেওয়া কটেজই খালি পাওয়া গেল।ব্যাস,শুধু গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়া। দুর্গাপুর থেকে তো মাত্র তিন ঘন্টার রাস্তা। রাস্তাঘাটও এখন অনেক ভাল হয়েছে আগের থেকে, গাড়িটাও চলছিল ভালই। স্পিডটা ষাট সত্তর থেকে খুব একটা নামাতে হয়নি কোথাও ।তাছাড়া সকাল সকাল বেরিয়ে পড়েছিল বলে, রাস্তার ভিড়ভাট্টা একটু কমই ছিল।নতুন গাড়ি,ছবির মতো সুন্দর রাস্তা, সিডিতে বাজছে লেটেস্ট গান,অর্ণবের পাশে বসে স্বাতীর মনটা তখন একদম উড়ু উড়ু। আর একটুখানি, তা হলেই তো সেই নীল জলের হাতছানি। হঠাৎ আকাশ কাল করে বৃষ্টি নামল। গাড়িটা তখন যাচ্ছে, দুপাশে ঘন জঙ্গলের মধ্য দিয়ে। রাস্তা মোটামুটি ফাঁকা, জোরে শব্দ করে বাজ পড়ছে মুহুর্মুহু আর গাছগুলো অসম্ভব দুলছে ঝড় বৃষ্টির দাপটে। কোথাও থামার উপায় নেই ,কোন আশ্রয়ও নেই ধারেকাছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হোটেলে পৌঁছতে হবে, তবেই মঙ্গল। এতক্ষণ জিপিএস, নেট সব কাজ করছিল, রাস্তা দেখাচ্ছিল। হঠাৎই দুর্যোগে নেটটা বিগড়ে গেল আর জিপিএসও সাহায্য করা বন্ধ করে দিল। পথনির্দেশ ছাড়া অর্ণব দিশেহারা হয়ে পড়ল, এই বৃষ্টিতে সোজা চালিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোন উপায়ও নেই। ভুল পথে যাচ্ছে কিনা সেটা বোঝাও সম্ভব নয়। এই ফাঁকা রাস্তার মাঝখানে দাঁড়ানোটাও সেফ নয়। এদিকে সামনের কাচ ঝাপসা হয়ে এসেছে বৃষ্টির তোড়ে, রাস্তাতেও জলের স্রোত। হঠাৎই অর্ণব দেখতে পেল ঠিক সামনেই রাস্তা জুড়ে একটা লরি কোনাকুনি বেঁকে দাঁড়িয়ে রয়েছে। আর কাটিয়ে নেবার মত সময় বা জায়গা নেই, গাড়ির স্পিডও যথেষ্ট। তবু প্রাণপণে চেষ্টা করল অর্ণব, স্বাতী চিৎকার করে উঠল ভয়ে, ব্রেক ধরল না। একটা ভয়ঙ্কর আওয়াজ, আর তারপরই কাল অন্ধকার। আর কারো কিছু মনে নেই । হসপিটালের বেডে শুয়ে, তিনদিন পর প্রথম জ্ঞান ফিরল অর্ণবের। সারা শরীরে,মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা, ঘাড় ঘোরাতেও পারছে না ।অস্পষ্ট, কেমন যেন ঘোলাটে দৃষ্টি,আর আশপাশ থেকে প্রতিধ্বনির মত কিছু শব্দ কানে আসতে লাগল। এরকম কয়েকবার জ্ঞান আসা-যাওয়ার শেষে যখন ইনজেকশনের ডোজটা একটু কমে এসেছে হঠাৎই হুট্ করে সাড় ফিরল অর্ণবের। ও বুঝলো হসপিটালের বেডে শুয়ে আছে, এখন মোটামুটি দেখতে পাচ্ছে, সিস্টারের কথাগুলোও অল্প কানে আসছে । ‘কি মিস্টার ব্যানার্জি, আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন ?’ অর্ণবকে তাকাতে দেখে সিস্টার বারবার জিজ্ঞেস করতে লাগল। যন্ত্রণা সত্বেও অল্প ঘাড় নাড়ল অর্ণব। সারাদিনে আস্তে আস্তে ওর সারা শরীরে সাড় ফিরল। মাথায় ব্যান্ডেজ, সারা শরীরেও, অনেকগুলো অপারেশন হয়েছে ।তবে প্রাণে বেঁচে গেছে ।অর্ণবের তখনই বিদ্যুৎ গতিতে সব মনে পড়ে গেল। গাড়ির অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল ,ও বেঁচে আছে, স্বাতীর কি হল? খুব ভয় হতে লাগল । ডাক্তার রুটিনমাফিক ওর সঙ্গে নানা কথা বলে যেতে লাগলেন ।তখনই ধীরে ধীরে অর্ণব বলে উঠল ,’স্বাতী কোথায়?’ ‘ও,আপনার মিসেস?’ডাক্তার বলে ওঠেন,’উনি ভাল আছেন,এই হসপিটালেই ভর্তি আছেন,এই তো পাশের ওয়ার্ডেই।‘ উত্তরটা শুনে ধড়ে প্রাণ এল ওর,যাক স্বাতী বেঁচে আছে।অর্ণব তখনই যেতে চেয়েছিল ওকে দেখতে ।ডাক্তার, নার্স দুজনেই হেসে বলল , ’পাগল হয়েছেন? কতগুলো অপারেশন হয়েছে জানেন? আপনাকে এখনও বেশ ক’দিন শুয়ে থাকতে হবে ।আপনার স্ত্রী ভাল আছেন।ক’দিন পর দেখতে যাবেন।একদম চিন্তা করবেন না।‘ সেদিনটা এরকম করেই কাটল, ওষুধ-পথ্য-যন্ত্রণা। কখনও বা একটু ভাল থাকা, কখনও আবার সব ভুলভাল হয়ে যাওয়া, দুঃস্বপ্নে চেঁচিয়ে ওঠা। অর্ণবের বাবা-মা সবাই এসেছেন, সঙ্গে সুকল্যান-সুস্মিতাও। তখনই ভাল করে জানল, সেই ভয়ঙ্কর অ্যাক্সিডেন্টের কথা, কি বরাৎজোরে দুজনে প্রাণে বেঁচে গেছে, স্থানীয় আদিবাসীরাই ওদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে গেছে,তারপর রেফার হয়ে এই বড় হাসপাতালে, দুর্গাপুরে। স্বাতীরও বাবা-মা-ভাই সবাই এসেছেন, এখনও জ্ঞান ফেরেনি ওর। পরদিনই অর্ণবের কাতর অনুরোধে, স্ট্রেচারে শুইয়েই অবশেষে ওকে নিয়ে যাওয়া হল স্বাতীর বেডের কাছে। সেখানে বসে রয়েছে স্বাতীর বাবা-মা- ভাই ।সবাই ওকে দেখে, কেমন যেন একটা রাগী রাগী মুখ করে তাকিয়ে থাকল।অর্ণবের অন্য দিকে খেয়াল নেই, দ্রুত যেতে চায় স্বাতীর কাছে। অবশেষে দেখতে পেল ওকে, কিন্তু এ কি? স্বাতীর সারা শরীরে ব্যান্ডেজ, মাথায়- মুখে পর্যন্ত, শরীরের কোথাও একটুও জায়গা ফাঁকা নেই। ওর এখনও জ্ঞান ফেরেনি, অবস্থা ভাল নয়। অপরাধীর মত মুখ করে তাকিয়ে থাকে অর্ণব,চোখ জলে ভেসে যাচ্ছে।স্বাতীর বাবা-মার দিকে তাকাল, তারা সেভাবে কথা বলল না ওর সঙ্গে। একরকম জোর করেই অর্ণবকে ফিরিয়ে আনা হল নিজের বেডে। এই রকম করেই ক’টা দিন পার হয়ে গেল।ক’দিন পরে, অর্ণব তখন মোটামুটি অনেকটাই সুস্থ, খুব তাড়াতাড়ি সেরে উঠছে ,শুধু প্লাস্টার আর ব্যান্ডজ সারা শরীরে। এখনও হাঁটতে পারে না,তবে নিজে নিজেই হুইল চেয়ার নিয়ে,দিনের মধ্যে দু’তিন বার চলে যায় স্বাতীর বেডের কাছে। ওর জন্য স্পেশালি বলে দেওয়া আছে সিস্টারদের, কেউ ওকে ফিমেল ওয়ার্ডে যেতে আটকায় না। স্বাতীর এখনও জ্ঞান ফেরেনি ,মাল্টিপল ইঞ্জুরি, অনেক কাটাছেঁড়া হয়েছে ওর শরীরটা নিয়ে, চেনাই যাচ্ছে না । প্রতিদিন প্রথমবার যখন হুইলচেয়ারে বসে স্বাতীকে দেখে, চোখের জল সামলাতে পারে না অর্ণব। ডক্টর বলেছেন, সব ঠিক আছে, শুধু জ্ঞান ফিরে আসার অপেক্ষা। আর কত অপেক্ষা করবে অর্ণব! কি থেকে কি হয়ে গেল ওদের সুখের জীবনটায়, অর্ণব ভাবে। এইভাবে ভগবান ওদের সুন্দর সংসারটা ছারখার করে দিতে পারল! স্বাতীর বাবা মা আজকাল ওর সঙ্গে একটু আধটু কথা বলে। ওরাও বুঝেছে এটা একটা অ্যাক্সিডেন্ট, অর্ণবের কোন দোষ ছিল না। স্বাতীর ভাই সুমনও মাঝে মাঝে আসে অর্ণবের বেডের কাছে, কথা বলে যায়। ‘অর্ণবদা, এখন কেমন আছ?’ ‘অনেক ভাল রে।কবে যে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারব।‘ ‘ ঠিক পারবে,চিন্তা কোরো না।’ ‘ আরে চিন্তা আমাকে নিয়ে করছি না। তোর দিদির জ্ঞান ফেরা নিয়েই টেনশন হচ্ছে রে ।‘ ‘ডাক্তাররা তো নানা রকম চেষ্টা করছে, বলছে শিগগিরই জ্ঞান ফিরবে ।‘ ‘কে জানে,আমার তো মনে হচ্ছে এই হাসপাতলে আর বেশি কিছু হবেনা । কলকাতার বড় নার্সিংহোমে নিয়ে যাব ভাবছি ।‘ ‘বাবাও তো তাই বলছিল। কালই তো কথা বলছিল আর একজন নিউরোলজিস্টের সঙ্গে।‘ ‘ হুঁ, আমিও কয়েক জায়গায় ফোনাফোনি করেছি ।সুকল্যাণকেও বলেছি কথা বলতে।‘ ‘এখান থেকে ছাড়বে ?’ ‘কেন ছাড়বে না?একটু শিফ্ট করার মতো হলেই নিয়ে যাব। ওনারা বন্ডে রিলিজ দেবেন বলেছেন ।‘ ‘কিন্তু অর্ণবদা,একটা জিনিস লক্ষ্য করেছ......’ ‘কি জিনিস রে?’ ‘দিদির.....না ,থাক ।পরে বলব।‘ ‘কি ব্যাপার বল না,লুকোচ্ছিস কেন?’ ‘না গো,আমি ঠিক শিওর নই,পরে বলব।‘ অর্ণব আর কিছু জিজ্ঞেস করে না।স্বাতীকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় ওর আজকাল ভাল ঘুমও হয় না।বেশির ভাগ সময় চুপ করে বসে ঝিমোয়।ও এখন একা বাথরুমে যেতে পারে, যদিও মাথাটা ঘোরে, পায়ে অসহ্য যন্ত্রণা। মোবাইল ব্যবহার করতেও শুরু করেছে। সিমটা রি-অ্যাক্টিভেট করে, একটা নতুন মোবাইল দিয়ে গেছে সুকল্যান। সেদিন অর্ণব অনেকটা ভাল ,ডাক্তারও বলেছেন, দু’দিন পরেই ওরা চাইলে স্বাতীকে কলকাতার বড় নার্সিংহোমে নিয়ে যেতে পারে। জলের মত টাকা খরচ হয়ে যাচ্ছে, আরও হবে।বড় বড় নার্সিংহোমে এইসব কেসে, একটা পরিবার সর্বস্বান্ত হয়ে যেতে পারে,সব জানে অর্ণব, তবু কুছপরোয়া নেহি।শুধু কোমা থেকে বের করে আনতেই হবে স্বাতীকে,স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে হবে। এইসব দুশ্চিন্তাতেই কাটছিল অর্ণবের দিনগুলো। হঠাৎই একটা অচেনা নাম্বার থেকে এক সন্ধ্যায় ফোন আসল অর্ণবের। ‘হ্যালো’ বলতেই, ওপাশ থেকে একটা ভীষণ ভারী আর গম্ভীর গলা শোনা গেল ‘আপনি কি মিস্টার অর্ণব ব্যানার্জি বলছেন?’ ‘হ্যাঁ ,বলুন।‘ অর্ণব বলে। ‘আপনি কি এখনও হাসপাতলে আছেন?’ লোকটা জিজ্ঞেস করে। ‘হ্যাঁ ,আপনি কে বলছেন?’ ‘সেটা জেনে কি হবে ?’ লোকটা একটু অভদ্রের মত ধমক দেয়। ‘যা বলছি মন দিয়ে শুনুন।‘ লোকটা বলে চলে । ‘আপনার মিসেসের নাম তো স্বাতী ব্যানার্জি,তাই না?’ ‘হ্যাঁ’ অর্ণবের গলায় বিস্ময়। ‘আপনার মিসেস কোথায় ?’ ‘কেন? আমার পাশের ওয়ার্ডেই ,ট্রিটমেন্ট চলছে ।কিন্তু আপনি কে?’ ‘হাঃ হাঃ হাঃ’ ,লোকটা বিশ্রিভাবে অনেকক্ষণ হাসে। রাগে গা জ্বলে যায় অর্ণবের। কে লোকটা ,কেন এতসব জিজ্ঞেস করছে, ফোনটা কেটে দেবে নাকি! ঠিক তখনই হাসি থামিয়ে, শীতল কন্ঠে, গম্ভীর গলাটা কাটা কাটা শব্দগুলো বলে,’ মিস্টার ব্যানার্জি ,পাশের ওয়ার্ডে যাকে আপনি আপনার স্ত্রী বলে ভাবছেন, চিকিৎসা করাচ্ছেন, তিনি আপনার স্ত্রী স্বাতী ব্যানার্জি নন, আপনার স্ত্রী অ্যাক্সিডেন্টের দিন স্পটেই মারা গেছেন। পনেরো তারিখ।‘ অর্ণবের শিরদাঁড়া দিয়ে একটা যেন ঠান্ডা স্রোত নেমে যায় ,কি বলছে লোকটা! ‘কি বলছেন যা তা? কে আপনি?’ অর্ণব চিৎকার করে ওঠে। কিন্তু তখনই ফোনটা কেটে যায়। উত্তেজিতভাবে অর্ণব আবার ওই নম্বরটাতে ঘুরিয়ে ডায়াল করে, কিন্তু ফোনটা বেজে যায় ,কেউ ধরে না। অর্ণবের বুকটা হাপরের মতো ওঠানামা করে। পাশের বেড থেকে সিস্টার অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করেন , ‘কি হল অর্ণববাবু, কি হয়েছে? এত রেগে গেছেন কেন?’ অর্ণবের কানে কোন কথা ঢোকে না, দেয়াল ধরে ধরে কোনক্রমে ও স্বাতীর বেডের দিকে যেতে চেষ্টা করে। ওকে সাহায্য করতে আসে একজন সিস্টার,ও সাহায্য নেয় না, পাগলের মত ছুটে যেতে চায় স্বাতীর ওয়ার্ডে,দু একবার পড়ে যায়,আবার ওঠে,সুমন ওকে ধরে। স্বাতীর কাছে গিয়ে ও অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে দেখে, বোঝার চেষ্টা করে ওটাই স্বাতী তো! হুমড়ি খেয়ে স্বাতীকে ছুঁতে চেষ্টা করে। পাগলের মত চিৎকার করে ডাকে ‘স্বাতী,স্বাতী,সাড়া দাও।‘ সবাই ওর দিকে ছুটে আসে, ওকে ধরে ফেলে। অর্ণব চিৎকার করতেই থাকে।ওর মনে হয়,ব্যান্ডেজে ঢাকা স্বাতীর মুখটা যেন একটু অন্যরকম না! আর ঠিক তখনই স্বাতীর প্রথমবারের মত, সাড় ফিরে আসে। ঠোঁটটায় যেন একটু হালকা হাসি খেলে গিয়ে,তখনই আবার মিলিয়ে যায়। অর্ণব হাসিটা চিনতে পারে।

31 August 2019

বাপ্পা আর ভোরবেলার কাক

সেদিন কাকভোরেই ছাদে উঠেছিল বাপ্পা। ক'দিন ধরে এত গরম পড়েছে, যে ভোর হতে না হতেই ঘুম ভেঙে যাচ্ছে। তারপর আর শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করে না। এখন স্কুলে গরমের ছুটি, তাই সকালটা একটু ধীরেসুস্থে কাটাতে পারে বাপ্পা। নইলে এখন তো বাড়িতে হুড়োহুড়ি পড়ে যাবার সময়। দাঁত মেজে, চোঁ চোঁ করে হরলিক্স খেয়ে, জামা-প্যান্ট- জুতো-মোজা ঝটপট পরে নিয়ে, ব্যাগ-জলের বোতল-টিফিন নিয়ে ছুটেমুটে স্কুলের বাস ধরতে ছুটতে হয়। আর তার সঙ্গে রয়েছে মার সমানে তাড়া লাগানো। সেসব থেকে এখন ক'দিন মুক্তি, হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে বাপ্পা। কিন্তু অভ্যাস যাবে কোথায়? সেই সাতসকালেই উঠে পড়ছে ঘুম থেকে। কিন্তু এ সময় বাড়ির বাকি সকলের ঘুম ভাঙানো বা বিরক্ত করা মানা, বেদম বকুনি জুটবে। তাই ব্রাশে টুথপেস্ট লাগিয়ে, বাপ্পা সোজা ছাদে উঠে যায়। এটাই বাড়ির মধ্যে ওর সবচেয়ে পছন্দের জায়গা, ঠান্ডা হাওয়ায় শরীরটা জুড়িয়ে যায় এসময়। সেদিন সকালে ছাদে উঠে দেখে তুলকালাম কান্ড। দুটো কাকের বাচ্চা ছাদের পাঁচিলে বসে খুব মারামারি লাগিয়েছে। তারস্বরে 'কা' 'কা' করে ডেকে, ডানা ঝাপটিয়ে, পা দিয়ে লাথালাথি করে সে কি হুটোপুটি। দরজার চৌকাঠে বসে তাই দেখে বাপ্পা। কিছুক্ষণ পরে মারপিটটা অবশেষে থামে ,আর সবটুকু পেস্ট গিলে ,সাদা ব্রাশ নিয়ে নীচে নেমে আসে বাপ্পা ।সত্যি, কাকগুলো যা ঝগড়ুটে, বলার নয়। কেন যে ওদের এত মারপিট লাগে কে জানে? তবে কাকেদের নিয়ে চিন্তা করার আর অবকাশ পাওয়া যায় না, বাবা মুড়ি-বিস্কুট খেয়ে পড়তে বসার হুকুম করেন। কিন্তু পড়তে বসেও ওর মন ছুটে যায় এদিক-ওদিক। কোথায় পিঁপড়েরা লাইন দিয়ে চলেছে, টিকটিকিটা ঘুলঘুলি থেকে মুখ বাড়াচ্ছে, জানলার বাইরে আমগাছটার পাতাগুলো দুলছে, দূরে নীল আকাশে সাদা মেঘ ভেসে চলেছে-এখনই যেন ভারতবর্ষের ম্যাপ হয়ে যাবে, এসবই দেখে। ওদিকে শুনতে পায় পাশের বাড়ির মৌদি হারমোনিয়াম নিয়ে গলা সাধছে, সাধনকাকু অ্যা অ্যা করে জিভ ছুলছে, গলিতে পাঁউরুটিওলা হেঁকে যাচ্ছে, নীচে রাস্তার কলে বালতি পাতার শব্দও পাওয়া যায়। হঠাৎ কোত্থেকে একটা বাচ্চা কাক উড়ে এসে জানলার পাশটাতে বসল। সেই কাকটা নাকি! সেই যে ছাদে যেটা খুব ঝগড়া করছিল! অবশ্য সব কাকই দেখতে একইরকম লাগে, শুধু দাঁড়কাকগুলোকে একটু আলাদা করে চেনা যায়। অবশ্য দাঁড়কাক আর আসে কই এ তল্লাটে! চারদিকে শুধু এই পাজি আর চোর কাকগুলোর দৌরাত্ম্য। হঠাৎ কাকটা একবার 'কঃ' করে অদ্ভুত স্বরে ডাকল। কি বলতে চাইছে ও? কাকটা বসে বসে, একবার বুকে মাথা গুঁজছিল আর একবার বাপ্পার দিকে তাকাচ্ছিল। যেন বলছিল, "সরি ভাই, সকালে রাগের মাথায় একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলেছি, ক্ষমা করে দাও এবারের মত।" কিন্তু তখনই বাপ্পার ভাবনার সুতো ছিঁড়ে গেল। "কি পড়ছ বাপ্পা, শব্দ পাচ্ছি না কেন?" বলে বাবার হাঁক শুনেই ও প্রকৃতিবিজ্ঞান চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে পড়তে শুরু করে দিল। কয়েকদিন পরের কথা, বাপ্পার সেদিন মনটা খুবই খারাপ। একে তো দুদিন পর পর বৃষ্টি হয়ে, আকাশ এখনও গোমড়া মুখ করে আছে, তার ওপর জমা জলে লাফালাফি করে পা ভেজানোর জন্য মার একচোট বকুনিও শুনতে হয়েছে। ওদিকে আবার ছাদে জল সোক করে, ঘরে জল পড়া নিয়ে মা আর বাবার মধ্যে একপ্রস্থ ঝগড়াও শুরু হয়ে গেছে। বাবা-মার ঝগড়া হলে বাপ্পার খুবই মন খারাপ লাগে। কে ঠিক আর কে ভুল ও ঠিক করতে পারে না,মনে হয় দুজনেই ভুল। তখন ওর নিজেকে খুব একা মনে হয়। মনে হয়, বাবা-মা এরকম তুচ্ছ কারণে এত ঝগড়া করে কেন? তার চেয়ে চুপচাপ সব শুনে গিয়ে বিজ্ঞের মত ঘাড় নাড়তে পারে না? ক্লাসে ও যেমন করে। তাহলেই তো মিটে যায়! তবে মন খারাপটা বেশিক্ষণ থাকে না ,পাড়ার বন্ধুরা সব হৈ হৈ করে খেলতে আসে। তাদের সঙ্গে একতলায় ক্যারাম ,টেবিল টেনিস খেলা নিয়ে মেতে যায় ও। হঠাৎ বাবার ডাক আসে, এক্ষুনি বাজারে যেতে হবে কিসব কিনতে আর ছাদ সারানোর মিস্ত্রিরও খোঁজ করতে হবে। কি আর করা! অনিচ্ছা সত্বেও বন্ধুদের বিদায় দিয়ে বাবার সঙ্গে রাস্তায় বেরোতেই হল। হাঁটতে হাঁটতে কিছুদূর যাবার পর বাজারের ঠিক মুখেই, হঠাৎ একটা ভিখিরি হাত পাততে, বাবা ভিক্ষে না দিয়েই চলে গেল। বাবার সঙ্গে রাস্তায় বেরোনোটা নতুন নয়, আর বাবারও ভিখিরিদের পয়সা না দেওয়াটাই স্বভাব। কিন্তু এই ভিখিরিটা যেন একটু অন্যরকম, একটা ওরই বয়সী ছেলে, খালি পায়ে, খালি গায়ে সাদা কাপড়ের থান পরে, ভিক্ষে চাইছিল। বলছিল ওর বাবা নাকি মারা গেছে, কিছু সাহায্য করতে। বাবা তো সেসব পাত্তাই দিল না, ছেলেটার পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেল, তারপর বাপ্পাকে বলতে লাগল, "এসব ফলস্ , জানিস তো। ওর বাবা মারা গেছে না ছাই, পয়সা পাওয়ার জন্য এসব ওদের নিত্যনতুন কায়দা, একদম বিশ্বাস করবি না ।" কিন্তু বাপ্পার কেমন যেন লাগল , ও জানে ভারতবর্ষে গরিবের সংখ্যা কত বেশি, কি তাদের কষ্ট। তাদের সবাই কি এমন অভিনয় করে? বাপ্পার বারবার মনে হচ্ছিল, আহা রে, এই ছেলেটা সত্যিই খুব গরিব ছিল আর সত্যিই ওর বাবা মারা গেছে। ওর টাকার নিশ্চয়ই খুব দরকার, সবার ওকে সাহায্য করা উচিত ছিল। কিন্তু এখন কি হবে, সবাই যদি ওকে এরকম ভুয়োভিখিরি ভাবে আর ভিক্ষে না দেয়! ও কি তাহলে একটাও টাকা পাবেনা! বাবার ওপরও বাপ্পার খুব রাগ হয়। মনে পড়ে, বাবা ভিখিরিদের সম্পর্কে বলেছিল, "এত লাখ লাখ ভিখিরি রোজ রোজ ভিক্ষে চাইলে কি আর দেওয়া যায় রে! তাই, ভিখিরি দেখলেই মাথায় হাতটা ঠেকিয়ে, নমস্কার করে চলে যাই। মানে হল, মাফ কর বাবা, আমি দিতে পারব না। অথচ দিচ্ছি না বলে তুমি কিছু মনেও করতে পারবে না। ওই যে কপালে হাতটা ঠেকালুম, ওটাই রীতি।" বাপ্পাকে অবশ্য কখনো এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হয়নি। ওর থেকে সাধারণত কেউ ভিক্ষে চায় না। শুধু একবার দল বেঁধে সব বন্ধুরা স্কুল থেকে ফেরার সময়, রাস্তার মধ্যে একটা বুড়ো ভিখিরি ভিক্ষে চেয়েছিল। বাপ্পার কেমন একটা লজ্জা করেছিল, ওর কাছে একটাও টাকা না থাকায়। যা সামান্য টাকা থাকে, সেদিনই সব খরচা করে ফেলেছে টিফিনে আইসক্রিম খেতে গিয়ে। তাছাড়া রোজ মা'ই তো ওকে নিতে আসে স্কুল থেকে, শুধু সেদিন তাড়াতাড়ি ছুটি হয়েছিল বলেই, বন্ধুরা মিলে একসঙ্গে বেরিয়ে পড়েছিল। ওর বেস্টফ্রেন্ড সাত্যকি ভিখিরিটাকে বলেছিল, " আমাদের কাছে টাকা নেই।" কিন্তু অজয় যখন পকেট থেকে পাঁচ টাকার একটা কয়েন বের করে বুড়ো ভিখিরিটার কাঁসিতে রেখে দিয়েছিল, ভিখিরিটা মাথায় হাত তুলে আশীর্বাদ করে বলেছিল, "রাজা হও বাবা,রাজা হও।" অজয়কে সেদিন এত ভাল লেগেছিল বাপ্পার, খানিকটা যেন শ্রদ্ধাও এসে গিয়েছিল। ঈষৎ ঝুঁকে পড়ে, একটা অ্যালুমিনিয়ামের বাটিতে কিছু চাল আর কটা কয়েন নিয়ে, বুড়োটার হেঁটে যাবার দৃশ্যটা আজও মনে পড়ে বাপ্পার। কিন্তু আজ? আজ এ কি হল! বারবারই ওর মনে হচ্ছিল সবাই ভুল করছে, সবাই ভুল বুঝছে ,বাবাও ভুল করল । বাবা ভাল করে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে দেখলই না, ওর সব কথাও শুনল না, তাহলেই বুঝতে পারত, ছেলেটার সত্যি কথাই বলছে। স্কুলের সামনের বুড়ো ভিখারিটা তো তবু কিছু পেয়েছিল, কিন্তু ছেলেটার হাতে তো কোন কাঁসি দেখেনি ,ও তো তবে কিছুই ভিক্ষে পায়নি! এসব ভাবতে ভাবতে বাবার সঙ্গে বাপ্পা একসময় বাড়ি এসে গেল । পরদিন ভোরবেলা, ঘুম ভেঙে গেল একদল কাকের চিৎকারে। তড়িঘড়ি করে ঘুম চোখেই ছাদে উঠে গেল বাপ্পা। দেখল ডিস এন্টেনা আর কেবলের তারে পা আটকে, একটা কাক খুব ছটফট করছে, কিছুতেই ছাড়াতে পারছে না। আর একদল কাক, তার জন্য খুব ব্যস্ত হয়ে 'কা' 'কা' করে ডাকছে আর ওড়াউড়ি করছে , কখনো মাথার ওপর উড়ছে, কখনো এন্টেনায় বসছে, আবার কখনো এধারে ওধারে উড়ে যাচ্ছে, এইসব চলছে। বাপ্পা আসতে ওকে দেখে কাকগুলোর চেঁচামেচি আরও যেন বেড়ে গেল, যেন বাপ্পাকে ওরা বলছে "একটু হেল্প কর, ভাই।" কিন্তু এখন সদর দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে, তড়িৎ কাকুদের বাড়ি যাওয়া যাবে না, বকুনি খেতে হবে। তারপর আবার মনে হচ্ছে, তড়িৎ কাকুরা বোধহয় আজ বাড়িতেই নেই। সুতরাং নিরুপায় হয়ে বাপ্পা ওদের কান্ড কারখানাই দেখতে লাগল। দেখে সঙ্গীকে বাঁচানোর জন্য কাকগুলোর কি ভীষণ উৎসাহ-উদ্দীপনা। তারের ওপর বসা দু'চারটে কাকের এলোমেলো ওড়াউড়ি আর পা আটকে যাওয়া কাকটার আপ্রাণ চেষ্টায়, ভীষণ ভাবে দুলতে লাগল তারগুলো। আর তাতেই একসময় কিভাবে যেন কাকটার পা-ও মুক্ত হয়ে গেল ঐ তারের ফাঁস থেকে। কাকটা মুক্তি পেয়ে ,খানিকটা উড়ে অন্য একটা বাড়ির পাঁচিলের ওপর বসে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। ধীরে ধীরে চেঁচামেচি,ওড়াউড়ি সব খানিকটা শান্ত হয়ে গেল। ওদিকে আরেক বিপদ, মা খুব রেগে গিয়ে নীচ থেকে চেঁচাচ্ছে। ভোরবেলা উঠেই দাঁত না মেজে, ছাদে উঠে গেছে বাপ্পা, আর এতক্ষণ সময় ফালতু নষ্ট করেছে বলে। মার গলাটা শুনতে ভাল লাগছে না, সিঁড়ি দিয়ে চটপট নেমে আসল ও। সেদিন টুথ ব্রাশে পেস্ট লাগাতে লাগাতে বাপ্পা ভাবছিল, আচ্ছা একটা কাক বিপদে পড়ায় বাকি সব কাক ছুটে সাহায্য করতে আসতে পারে, কিন্তু মানুষ বিপদে পড়লে লোকে একটা টাকা দিয়েও সাহায্য করতে চায় না কেন? দাঁত মাজতে গিয়ে বাপ্পার পেস্টটাকে কেমন যেন তেঁতো মনে হল। বাপ্পা তখনই ঠিক করল, ওর জমানো সব টাকাগুলো নিয়ে কাল আর একবার বাবার সঙ্গে বাজারে গিয়ে খুঁজে দেখবে, গরিব ছেলেটাকে পাওয়া যায় কিনা। ওর মন বলছিল, নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে।

21 August 2019

রুট থ্রি

পাড়ায় রবিবারের ক্যারামের আসর,ডবলসে খেলা চলছে।দু’গেম আমরা হেরেছি,এবারেরটা জিততেই হবে।নিলে ম্যাচ হারলে,পরের ছ’মাস সর্বত্র আওয়াজ খাওয়া বাঁধা। হঠাৎ আমার পার্টনার শুভদার মোবাইলে একটা ফোন এল। শুভদা একটু আড়ালে সরে গিয়ে কি সব কথাবার্তা চালাতে লাগল, দু-একবার “কি বলছেন বুঝতে পারছি না” কথাটাও শুনলুম যেন ।সে সবে বেশি নজর ছিলনা, তখন আমার দান। ঘুরে যখন আবার শুভদার দান এল তখনও ও ফোনে বোঝাতে ব্যস্ত, “আপনি কি চাইছেন ,ঠিক বুঝতে পারছি না”। নাড়ু একটু  গুন্ডা প্রকৃতির,রেগে বলল “এই শুভদা কার ফোন?কি বলছে?” শুভদা হাতদুটো উল্টে বোঝাল ও কিছুই বুঝছে না, আর সঙ্গে সঙ্গে নাড়ুর হাতে ফোনটা চালান করে দিল। নাড়ু ফোনটা কানে দিয়ে,”কে বে?” বলতে গিয়েও পুরো শেষ করে উঠতে পারল না,বরং ওর চোখ মুখ উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। কিন্তু তার পরেই উত্তর দিতে গিয়ে তোতলাতে লাগল, “না মানে আপনি ঠিক কা-কাকে চাইছেন ব-ব-বলুনতো?” মনে হল,ওপাশ থেকে দুর্বোধ্য কিছু শুনে,সেসব ওর মাথার ওপর দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। ও এবার ফোনটা আমার হাতে দিয়ে মুক্তি পেল। ততক্ষণে শুভদাকে “কে রে?কে ফোন করেছে?”, জিজ্ঞেস করতে শুভদা বলেছে “আমি চিনিনা ,রং নাম্বার হবে ।“ যাইহোক আমি উৎসাহ ভরে ফোনটা কানে নিতেই শুনলুম, সুন্দর নারীকন্ঠে, সুমিষ্ট টানে কেউ তখনও বলে চলেছে “এটাও জানেন না?” আমি তো আগের কথা কিছুই শুনিনি।  মেয়েটিকে বললুম, “কি বলছেন আরেকবার বলবেন কি?” ওপাশ থেকে রেগেমেগে, কাটা কাটা কটা কথা কানে এল, “কি আবার বলব, কতবার তো বললাম, রুট থ্রির ভ্যালুটা কি হবে, বলে দিন না,মনে আসছে না! আমার কাছে ক্যালকুলেটর নেই।“ আমি তো হতভম্ব হয়ে গেলুম। অজানা অচেনা কেউ ফোন করে রুট থ্রির ভ্যালু, এই ক্যারামের আসরে জিজ্ঞেস করতে পারে, এটা আমার ধারনারও বাইরে ছিল। যাই হোক   ভ্যালুটা মুখস্থ ছিল, ফট করে বলে দিলুম, ওয়ান পয়েন্ট সেভেন থ্রি টু।শুনে মেয়েটি উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ল, খুশিতে ডগমগ হয়ে বলেই ফেলল,” ওহ, বাঁচালেন। থ্যাঙ্ক ইউ, থ্যাঙ্ক ইউ, আই লাভ ইউ সুইটহার্ট ,মুয়াঃ।“ শেষে একটা চুমুর শব্দ এবং তৎক্ষণাৎ ফোনটা কেটে গেল। বলাবাহুল্য, শেষের কথাগুলো আর চুমুর শব্দটা বিশ্বাস করতেও কষ্ট হচ্ছিল। সবার কাছে হিরো বনে গেলুম, যারা সঠিক উত্তর দিতে পারেনি তারা আমার উপর অযথা ঈর্ষায় জ্বলেপুড়ে মরতে লাগল। নাড়ুতো রেগেমেগে বলেই ফেলল “ওঃ, এই ব্যাপার, এ তো আমিও জানতাম, খুব ক্রেডিট নিলি, না?” বলে আমার দিকে কটমট করে তাকাতে লাগল। আমি তো এদিকে তখন হাওয়ায় ভাসছি ,চোখ মুখ লাল ।কাউকে কিছু বলতেও পারছি না,মেয়েটা আমাকে কি বলেছে। বললে, মেরে হয়ত আমারই চামড়া গুটোনো হবে। ওদিকে মনের  খুশিটাও চেপে রাখতে পারছি না,কলেজের ভাইভাতে এক্সটারনালের প্রশ্নের ঠিক উত্তর দিয়ে কখনও এরকম নির্মল আনন্দ হয়নি,হবেও না। ক্যারাম খেলা তো মাথায় উঠল, সহজ শটগুলোও মিস করে ফেললুম। ম্যাচ  গোহারান  হেরে, শুভদার গালাগাল শুনতে হল,কারও কারও বক্রোক্তিও।
খেলা শেষে ক্যারামবোর্ড তুলে সবাই যখন যে যার বাড়ি যাচ্ছে, চুপি চুপি শুভদাকে বললুম, “শুভদা ,কার ফোন এসেছিল গো, একটু নাম্বারটা দাও না!” শুভদা এমনিতেই এইরকম ম্যাচ হেরে চটে ছিল।আমার উৎসাহ দেখে তিরিক্ষি মুডে বলল ,”কেন রে, কি করবি নাম্বার নিয়ে ?কাকুকে বলব নাকি?” এরপর আর কথা চলে না। বিরস বদনে বাড়ি ফিরে এলুম। কিন্তু তখনও কানে সেই কথাগুলো, মিষ্টি সুরের মতো বাজছিল “আই লাভ ইউ সুইটহার্ট,মুয়াঃ।“

15 August 2019

ইতি বন্যা

প্রিয় নির্ঝর, (২৪ শে এপ্রিল) তোমার সঙ্গে কথা কি দিয়ে শুরু করব বুঝে উঠতে পারছি না। সেদিন তুমি প্রথম আমাকে ভালবাসা জানালে, আমি কলেজ থেকে ফেরার পথে, সারাটা রাস্তা বাসে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে তোমার কথাই ভাবছিলাম, কখন যে বাড়ির স্টপ এসে গেছে খেয়ালই নেই। কিন্তু তোমার কথা কি যে ভাবছিলাম, সেটা আমি নিজেও জানিনা ।আমি সত্যিই বোধহয় তোমাকে ভালোবেসে ফেললাম। তোমার মুখটাই খালি ভাবি, সবসময় সেটা আমার চোখের সামনে ভাসছে। কখন সেই ভাসমান অস্পষ্ট মুখটা আমার সামনে এসে স্থির, স্পষ্ট হয়ে আমার সঙ্গে কথা বলবে,সেই অপেক্ষাতেই আছি। আনমনে বসে বসে কখনও আমি নিজেই জানিনা, কোন রাজ্যে হারিয়ে যাই।অথচ ইচ্ছে না থাকলেও আবার সেই স্বপ্ন রাজ্য থেকে বাস্তবে ফিরে আসতেই হয়। তুমি জানতে চেয়েছিলে আমার হবি কি। কি জান? তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকা। তুমি বল, 'হাঁ করে তাকিয়ে দেখার মত কি আছে?' কিন্তু তুমি জানো না ,যদি তুমি আমার চোখ দুটো দিয়ে নিজেকে দেখতে, তবে অনুভব করতে পারতে। এটা বলে বোঝানো যায় না। তোমার সঙ্গে থাকলে আমি নিজেই যেন কোথায় হারিয়ে যাই। সময়, অসময় কিছুই মানতে ইচ্ছে করে না। মনে হয় ঘড়ির কাঁটা যদি একই জায়গায় থেমে থাকত, তবে বড় ভালো হত। কিন্তু ঘড়ি তো আর কোনদিন কারো সাথে প্রেম করেনি ,তাই সে আর কি বুঝবে? সেই জন্য নিরুপায় ভাবেই তোমাকে বিদায় দিয়ে বাড়ি চলে আসতে হয়। সেই সময়টা আমার খুব কষ্ট হয়, মনে হয় ইস কাল যদি আবার দেখা হত, কি ভালই না হত! কি ন্তু হয় না। বাড়ি ফিরে মনে হয়, কেন তুমি আমার সামনে নেই? কিন্তু শেষ পর্যন্ত মেনে নিতে হয়। আবার কবে তোমাকে দেখতে পাব, তখন থেকেই সেই অপেক্ষা শুরু হয়ে যায়। সেদিন তুমি বাইরে চাকরি নিয়ে চলে যাবে শুনে, জানো তো আমার বুকের ভেতরে যেন নিমেষে একটা কালবৈশাখী ঝড় ছুটে চলে গেল। সেই ঝড়ে সব কিছু যেন তছনছ হয়ে গেল। অবশ্য কিছুক্ষণ পরেই সেই ঝড় থেমে গেল, আমি আবার নিজেকে সামলে নিতে চেষ্টা করলাম। আমার চোখের সামনে যে মুখটা সব সময় আনাগোনা করছে ,সেই মুখটাই আমাকে সব ঝড় সামলে উঠতে সাহায্য করেছে ।সেটা যে কার ,তা নিশ্চয়ই তোমাকে আর বলে দিতে হবে না। কেন যে এরকমটা হয়, কে জানে? তুমি জানো, সেদিন বাড়ি ফেরার পর থেকে সব সময় তোমার শরীরের একটা গন্ধ, নিজের মধ্যে অনুভব করছি। এই গন্ধটা আমায় সব সময় মনে করিয়ে দিচ্ছে তোমার অস্তিত্ব।তুমি যেন আমার আশেপাশেই লুকিয়ে আছ, তুমি যেন আমাকে জড়িয়ে ধরে বসে আছ। এই অনুভূতিটা আমাকে একটা দারুন, পাগল করে দেওয়া আবেশ আর আনন্দ এনে দেয়। তোমাকে ছেড়ে থাকতে ইচ্ছে করে না তো, মনে হয় সব সময় শুধু তোমার পাশেই বসে থাকি। কিন্তু উপায় কি বল? অনিচ্ছা সত্ত্বেও তোমাকে ছেড়ে ফিরতি বাসে উঠে পড়তে হয়। ( ১৭ই মে) যদি তুমি রাগ কর, তাহলে তুমিই বলে দিও সেই রাগ ভাঙানোর জন্য কি করতে হবে। আমি সেটাই করব। সেদিন তোমার জন্য অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হল, ঐ সময়টা যে আমার কি বিচ্ছিরি ভাবে কেটেছে, তা তুমি যদি বুঝতে। তোমার জন্য অপলক দৃষ্টিতে অপেক্ষা করতে করতে আমার এই চোখ দুটোর ভবিষ্যতে যে কি অবস্থা হবে, তা আমি নিজেই ভেবে পাচ্ছি না। সেদিন তোমার ওপর খুব রাগ হয়েছিল, ভেবেছিলাম আর কথা বলব না। মনের ভেতর অনেক কথা ছুটোছুটি করতে করতে, একটা বড় অভিমান জমাট বেঁধে উঠছিল। কিন্তু কি আশ্চর্য, তোমাকে দেখামাত্রই সেই সব রাগ-অভিমান কোথায় যে চলে গেল, আমি জানতেও পারলাম না। আচ্ছা, এরকম কেন হয় বলতো? সেদিন তুমি যখন বললে, বাইরে যাবে ক'দিনের জন্য, আমার মনের ভেতরটা যে কি একটা হয়ে গেল, সেটা আমি ছাড়া কেউ বুঝবে না। তোমার সঙ্গে দেখা করে বাড়ি এসে, মনটা খুব খারাপ হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, আবার কবে দেখা হবে। আজকে আরো একটু বেশিক্ষণ তোমার কাছে থাকলে পারতাম, কেন থাকলাম না! মনে হল রবিবারের পর যদি শুক্রবার হত, তবে খুব ভাল হত। তোমার সঙ্গে দেখা হবে না ,এটা যেন আমি ভাবতেই পারি না। অবশ্য সবকিছু তো আমার ভাললাগার ওপর চলবে না, যেটা প্রয়োজন, সেটা করতেই হবে। এই কটা দিন আমার কাছে খুব দীর্ঘ সময় বলে মনে হয়েছে। কলেজের গেটের কাছে বাঁ ধারে, ইউক্যালিপটাস গাছটার নীচে তুমি আমার জন্য অপেক্ষা করতে। আমিও গেটের বাইরে এসেই তোমাকে সেখানে খুঁজতাম। অভ্যাসবশত সেদিনও তেমনই খুঁজেছিলাম, কিন্তু মনে পড়ে গেল আজ যে তোমার সঙ্গে দেখা হবে না। তুমি অনেক দৃরে আছ। তুমি না থাকলে আমার সব কিছু কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে, মনটা বাইরে ছুটে বেরিয়ে আসতে চায়, আর কোথা থেকে চোখের কোণে এক ফোঁটা জল জমে। অবশ্য তোমাকে না দেখলেও আমার মনের আয়নায় তোমার ছবি সব সময় ঘোরাফেরা করছে ।তুমি আমার সামনে না থাকলেও, প্রতিনিয়ত তোমার ছবিটা আমার কাছেই থাকে। তোমাকে আমি যতটা ভালোবাসি, আমার মনের আয়নার সেই ছবিটাকেও আমি ততটাই ভালোবাসি। সে তো সবসময় আমার কাছে থাকে, তাই না? সুখের দিনে যেমন জড়িয়ে ধরে, দুঃখ কষ্টেও ঠিক তেমনই ভরসা যোগায়। জানো তো, তুমি যদি চুপচাপ কোন কথা না বলেও, শুধু আমার পাশে বসে থাক, সেটাও আমার কাছে ভীষণ আনন্দের হয়। তুমি আমার পাশে থাকলে দুনিয়ায় কোন কিছুই আর একঘেয়ে বলে মনে হয় না। তুমি যখন আমার দুষ্টুমিতে রেগে গিয়ে, মাঝে মাঝে বল, আগে যদি জানতে তাহলে আর আমার পাল্লায় পড়তে না, আমার মনে ভয় হয়, তুমি কথাগুলো সত্যি সত্যি তোমার মন থেকে বলছ না তো? (২রা জুন) মাঝে মাঝে দেখি, সমাজের মেকি নিয়মের বাঁধনগুলো আমাদের সুন্দর সম্পর্কে এক চরম অনিশ্চয়তার জন্ম দেয়। সেসব দেখে লজ্জা নয়, ভীষণ দুঃখ হয়। সেই দুঃখের কথা ভেবে কি লাভ? যা হবে, দেখা যাবে। সেদিকে না তাকিয়ে, বরং চলো, আমরা সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথের দিকে তাকাই। যে পথ কোন একদিন আমাদের দুঃখ নিশ্চয়ই দূর করতে পারবে। আমাদের দেখা হবার থেকেও তোমার সেটেলমেন্টটা আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ। যদি এমন সময় আসে, যখন তোমাকে একদিনও দেখতে পাব না, তখনও তো আমাকে দিনগুলো কাটাতে হবে। তাই এখন থেকেই অল্প অল্প করে সহ্য করার ক্ষমতাটা বাড়াতে চাইছি, যাতে সেই দুঃসময়ে এটা আমাকে সাহায্য করে। অবশ্য আমি জানি, সেই দুঃখ আমাকে কোনদিনও পেতে হবে না, তুমি আছ তো। তুমি আমাকে কতটা ভালবাসো, তার প্রমাণ আমি কোনদিনও তোমার থেকে চাইনি। শুধু তুমি মুখে যতটুকু বল, সেটাই আমার কাছে সব। ক'দিন তোমার সঙ্গে দেখা হয়নি বলে, সময়টা যে কিভাবে কেটেছে, কি বলব! যেন আর কাটতেই চাইছে না। মনে হচ্ছে, এখন যদি পাঁচ মিনিটের জন্যও তোমাকে সামনে পেতাম, তাহলে খুব ভাল হত। আমার মনে হচ্ছে আমার বুকের ভেতর অনেক কথা জমা হয়ে রয়েছে, যেগুলো তোমাকে এখনই জানাতে খুব ইচ্ছে করছে। কিন্তু কি জানো, যখনই তুমি আমার সামনে আস, তখন আর বলার মত কিছুই পাই না। এই যে বাজে দিনগুলো কাটছে, এগুলো আবার সুন্দর করে দিতে পার একমাত্র তুমিই, যেদিন তুমি আমার সামনে আসবে। সেই দিনটাকে তাড়াতাড়ি আমার কাছে পাঠিয়ে দাও না, আমি যে অপেক্ষা করে বসে আছি। আজ আর কোন কিছুতেই মন বসছে না, শুধু তোমারই কথা ভাবছি। মনটা শান্ত করার জন্য শেষ পর্যন্ত তোমার ছবি দেখি, তোমার লেখাই পড়ি। তারপর দেখি তো এই মন বাধ্য মেয়ের মত আমার কথা শোনে কিনা। (১৩ই জুলাই) তোমাকে ছেড়ে আসতে খুবই খারাপ লাগছিল সেদিন, মন বলছিল আবার কবে দেখা হবে, কে জানে? এখন তো সত্যিই তোমার সঙ্গে আর বেশি থাকা হবে না, তুমি তো সকালে বেরিয়ে যাবে আর ফিরবে অনেক রাতে, তারপর ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পড়বে। আমার কথা হয়তো আর মনেই পড়বে না। আমি কিন্তু আমার ঘরে বসে বসে, তোমার কথাই মনে মনে ভাববো, আর সপ্তাহের সেই ছুটির দিনটার অপেক্ষায় থাকব, আর তোমার দেওয়া সেই মধুর স্পর্শ সারাদিন অনুভব করব। এছাড়া আমার আর কিই বা করার আছে, বল? তুমি চাকরি পেয়েছ ভেবে খুবই আনন্দ হয়েছিল। সে আনন্দ ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না ।আবার অন্যদিকে সেই রকমই কষ্ট পেয়েছিলাম, কারণ তোমার সঙ্গে আর বেশি দেখা হবে না। অবশ্য এই কষ্টটা সহ্য করা যায় ,কারণ এর মধ্যে এক নতুন দিনের আশা লুকিয়ে আছে। তুমি বলেছিলে, কাজের শেষে বাড়ি ফিরে তুমি দেখবে ,আমার দুটো চোখ তোমার অপেক্ষায় রয়েছে। আপাতত এটা সম্ভব না হলেও, আমার এই চোখদুটো অপেক্ষা করে থাকবে ,সারা সপ্তাহের শেষে ক্লান্ত অবিশ্রান্ত সেই মানুষটার জন্য ,যাকে আমি ভীষণ ভীষণ ভালোবাসি ,ভীষণ ভীষণ চাই। প্রথম প্রথম তোমায় না পেলে, খুব খারাপ লাগবে, তারপর ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে যাবে ।তোমার বুকের মধ্যে থাকতে পারলে খুবই ভালো লাগে, কিন্তু একটু খারাপ লাগে যে তোমার মুখটা দেখতে পাচ্ছি না। তাই হাঁপিয়ে উঠি, আর তোমার অজান্তেই তোমার সামনে এসে দাঁড়াই। যদি এমনটা হত যে, তোমার বুকের মধ্যে থেকেও একই সঙ্গে তোমার মুখটাও দেখা যাবে, তাহলে সত্যি বলছি আমি ঐ সুন্দর জায়গাটা ছেড়ে আর বাইরে বেরিয়ে আসতাম না ।আমার এই ইচ্ছেটা জানিনা ,কবে সফল হবে! তুমি সেদিন খুব সুন্দর চাঁদ দেখে আমার কথা ভেবেছিলে, জানোতো ওই চাঁদটা আমিই ছিলাম ।তোমাকে দেখব বলে এসেছিলাম, কিন্তু তুমি আমাকে খুব একটা পাত্তাই দিলে না, তাই অনেকটা রাগ করে চলে গেলাম। তুমি কিন্তু তোমার কারখানার ঐ যন্ত্রের পাল্লায় পড়ে, চাঁদ দেখতে ভুলে যেওনা । আসলে ঐ চাঁদই আমার বার্তাবাহক হয়ে, তোমার কাছে আসে, সে আমি যতই দূরে থাকি না কেন। তোমাকে বেশি দিন না দেখলে মনের ভেতরটা কেমন যেন হাঁসফাঁস করতে থাকে, তুমি যখন আমাকে নিয়ে ভাবতে থাক তখন আমার ভীষণ ভাল লাগে, মনে হয় মা-বাবার পরো আরো কেউ একজন আছে যে আমাকে ভালবাসে আর আমার কথা ভীষণ ভাবে। কিন্তু তাই বলে তুমি আমার জন্য দুশ্চিন্তা কোরো না। আমি ঠিক আছি, তোমার জন্যই ঠিক আছি। (১৭ই আগষ্ট) তুমি সেদিন ইচ্ছে করে আমার সঙ্গে দেখা করনি ,আমার কাছে আসনি ।আমি ভেবেছিলাম বোধ হয় তোমার কোন অসুবিধা আছে। কিন্তু তুমি যে আমাকে ইচ্ছা করে এইভাবে কষ্ট দিতে পার, এ কথা ভাবলেই আমার মনের ভেতরে কি যে হয়ে যাচ্ছে, সেটা কেউ অনুভব করতে পারবে না। তোমার থেকে সাময়িক দূরত্ব সহ্য করতে পারলেও, তোমার কাছ থেকে চিরদিনের মত দূরে সরে যাওয়াটা আমি কিছুতেই সহ্য করতে পারব না। আর যাতে দূরে সরে যেতে না হয়, তুমি তারই চেষ্টা করবে, এটাই ভেবেছিলাম। কিন্তু তুমি তো আমাকে শাস্তি দিচ্ছ, অনেক দূরের কেউ হয়ে গিয়েছ। সবাই বলে কাঁদলে মন হালকা হয়, কিন্তু আমার মন কিভাবে হালকা হবে ,আমি নিজেই জানিনা। তুমি ঠিকই বল, আমি যা কিছু করি, সব চূড়ান্ত এবং অসম্ভব। আসলে আমি নিজেই একটা পাগলী তো, তাই। আমাকে কষ্ট দিয়ে তুমি সফল হয়েছ, এবার তো তোমার শান্তি। যাক, এ কথা আমি এখন বুঝতে পেরেছি যে, আমি তোমাকে চূড়ান্ত এবং অসম্ভব ভালোবেসে ফেলেছি। মনে হচ্ছে তুমি আমাকে ভুলে থাকতে পারলেও, আমি তোমাকে কখনো ভুলে থাকতে পারব না ,চেষ্টা করেও পারব না। আর ভুলতে চাইও না। তাই তুমি যেন আর আমাকে এরকম কষ্ট দিও না। আমার কাছের চেনা মানুষটাকে, আমি আবার ফিরে পেতে চাই, কি ফিরে আসবে তো? আমার অস্থির মনের কষ্টের কথা, আমি তোমাকে বলব না তো, আর কাকে বলব বল? সে তুমি আমাকে যত দূরের লোক ভাবার চেষ্টাই কর না কেন। আমি যে তোমাকে আমার ভীষণ কাছের লোক ভাবি। তুমিও আমার মন রাখার জন্য কখনো কিছু বোলো না, তোমার মনে সত্যিই যা আছে, সেটাই বোলো। আমার মনে হয়, তুমি যেন আর আগের মত নেই। তুমি একবার শুধু মন থেকে বল, তুমি আমাকে ভালবাসো, তাহলেই হবে। অনিশ্চয়তা তো জীবনে আছেই, তার পেছনে আমরা হয়তো আগে ছুটছিলাম, আর এখন না হয় হাঁটছি। অবশ্য সে তো তোমার ইচ্ছেতেই। আমি জানি, সেই অনিশ্চয়তা আছে বা থাকবে,তবু মনের কোণে কোণে সব সময় তুমিই জেগে আছ। তোমার সঙ্গে যখন দেখা না হয়, খালি দিন গুনতে থাকি, দিনের পর দিন। আবার কবে দেখা হবে। তোমাকে হারানোর কথা ভাবলেই মনে নানা দুশ্চিন্তা চলে আসে, তারপর সেই চিন্তায় আমার আর কিছুই ভাল লাগেনা। প্লিজ, তুমি আমার সেই চেনা মানুষটা হয়ে ফিরে এসো, হারিয়ে যেওনা গো, সেই আগের মত ফিরে এসো না! জানো, সেদিন ফোনে, বাড়িতে মাকে বললাম, মা তোমার কাছে যাব। মা তখন বলল, চলে আয়। তখনই আমার মনে কি যে হল, কে জানে? আমার মনে হল, আমি তোমাকে ছেড়ে, তোমাকে না দেখে, থাকব কি করে ?জানো তো, মাঝে মাঝে তোমার কথা মনে হলে, মনটা এত খারাপ হয়ে যায়, তখন আর আমার কোনকিছুই ভালো লাগে না। তখন শুধু তোমার মুখটাই আমার মন খুঁজতে থাকে। (২৮শে সেপ্টেম্বর) তুমি নিজেই বল ,আমার কষ্ট তোমার সইবে না ,আর তুমিই আমাকে এমন ভাবে কষ্ট দিচ্ছ! আমার সাথে দেখা করনি, কিন্তু ফোন তো করতে পারতে! আর তুমি জানো, তোমার ফোনের অপেক্ষায় আমি কিভাবে বসে থাকি। তবু কেন তুমি ফোন করলে না? তুমি কি আবার আগের মত আমাকে শাস্তি দিচ্ছ? আসলে তোমাকে ভুলে যাবার কথা আমি ভাবতেই পারি না ।আমি জানি তোমাকে হয়তো কোনদিন ভুলতেই হবে, কিন্তু সেটা আমার মন কখনোই অত সহজে মেনে নিতে পারবে না। আর তোমাকে ভুল বুঝতে, আমার মন কোন সময় চায় না, তোমাকে যে আমি ভীষণ বিশ্বাস করি। কিন্তু তুমি? তুমি কেন এত সহজে আমাকে ভুল বুঝে, আমার ওপর রেগে যাও? সেটা যে আমাকে ভীষণ ভীষণ কষ্ট দেয়, তুমি কেন বোঝ না? আমিও হয়তো কখনো এমন কোন কথা বলে ফেলি, যাতে তুমি কষ্ট পাও, কিন্তু আমি সেটা না বুঝে বলি। আমি যখন পরে সেটা বুঝতে পারি, তখন আমারও ভীষণ কষ্ট হয়, আর নিজের উপরই নিজের রাগ হয়। কিন্তু তুমি কি আমাকে একটুও মানিয়ে নিতে পারো না? জানো, এই কদিন আমি কতটা কষ্ট পেয়েছি? কাউকে ভালবাসলে হয়ত এরকমই কষ্ট পেতে হয় ।আরো বেশি কষ্ট কেন পাচ্ছি জানো, ভয় হচ্ছে তুমি হয়ত সত্যি সত্যি আমার কাছ থেকে অনেক অনেক দূরে হারিয়ে যাচ্ছ। সত্যিই কি তুমি হারিয়ে যাচ্ছ? তুমি যদি আমাকে সত্যিই ভালোবাসো, তবে আর এমন ভাবে কষ্ট দিওনা। যদি কষ্ট আমাকে পেতেই হয়, তবে একেবারেই পাব। এরকম বারবার কষ্ট আমি আর সহ্য করতে পারছি না। তুমি এভাবে আমাকে ভুলে চলে যেওনা, আমার কি কোন মূল্যই নেই তোমার কাছে? অথচ, আমি যে তোমার কথা ছাড়া আর কারো কথা ভাবতেই পারি না। তোমার সঙ্গে অনেকদিন দেখা হবে না, এ কথা ভাবতেই ভীষণ খারাপ লাগছে ।একদিকে অনেকদিন পর বাড়ি যাব ভেবে আনন্দ হচ্ছে, আবার অন্যদিকে তোমাকে ছেড়ে থাকতে হবে ভেবে মন খারাপ লাগছে। কি করে যে এতগুলো দিন তোমাকে না দেখে কাটাব, ভাবতেই পারছি না । অনেকদিন পর মাকে দেখব, বাবাকে দেখব,অনেক বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হবে, সেটা ভেবেই মনটা এখনই ছুটে চলে যাচ্ছে, কিন্তু ওখানে গিয়ে পৌঁছানোর আগেই আবার ফিরে আসছে, কারন কি জান? মনের সবচেয়ে বড় অংশটাই যে তোমার কাছে পড়ে আছে, তাই আমি ওখানে থাকলেও আমার মন পড়ে থাকবে এখানেই, তোমার কাছে। তুমি তো বললে পাঁচ বছর পরে আমি তোমাকে সব সময়ের জন্য পাব ,কিন্তু আমার যে একটা ভয় হচ্ছে, আমার বাড়ির লোক কি আমাকে পাঁচ বছর অপেক্ষা করতে দেবে? হয়তো না, বড়জোর তিন কি চার বছর হতে পারে ,তারপর কি হবে ?অবশ্য তুমি তো তোমার উত্তর বলেই দিয়েছ, অন্য কাউকে বিয়ে করে নিতে। কিন্তু আমি তো তা পারবো না। অন্য কাউকে বিয়ে করব বলে তো আর তোমাকে ভালোবাসিনি। কিন্তু তোমার কাছে কি এ ছাড়া অন্য আর কোন উপায় নেই? চার বছরের মধ্যে তুমি কি কিছুই করতে পারবে না? কিছু একটা করো প্লিজ, যাতে তোমাকে হারাতে না হয় । তুমি যেমন কি সুন্দর, নির্বিকার ভাবে বলে দাও, অন্য কাউকে বিয়ে করে নিতে ,আমি কিন্তু সেটা বলতে পারি না বা ভাবতেও পারি না। কেন সেটা আমি নিজেও জানিনা। আমি জানি তো, আমার চেয়ে অনেক ভাল মেয়ে তুমি পাবে, কিন্তু তবুও এই মন মানতে চায় না। আসলে খুব স্বার্থপর কিনা, নিজের ছাড়া অন্য আর কারো কথা ভাবতে পারি না। জানো তো, আজকাল আমার না তোমাকে খুব কাছে পেতে ইচ্ছে হয়। মনে হয়, তুমি যদি আমাকে হাত ধরে টেনে নিয়ে তোমার বুকে একটু জড়িয়ে ধরতে, ঠিক আগের মত। কিন্তু তুমি তা কর না। আমি তো তোমাকে এত দূরে সরে যাবার কথা বলিনি, আমি অতিরিক্ত কিছু পছন্দ করি না ঠিকই, কিন্তু তাই বলে তুমি আমাকে ছোঁবেই না, সেটা তো কখনো বলিনি। আর তুমি তো অতিরিক্ত কিছু কর না। আমি জানি তুমি অন্যদের মত নও, সেই জন্যই তো তোমাকে ভালবেসেছি। আমি তোমার মত কবিতা লিখে, অত সুন্দর ভাবে মনের ভাব প্রকাশ করতে পারি না। আমি খুব সাধারণ মেয়ে, জীবনটাকেও সাধারণভাবে দেখি। তার গভীরে গিয়ে না বলা কোন কথা আমি কোনদিন খুঁজে পাইনি। আমার শুধু একটাই ভয়, তোমাকে মনে পড়লে কি সারাজীবন শুধু বুকে আর আশেপাশে খুজে বেড়াতে হবে? আমি তো তোমাকে সব সময় আমার চোখের সামনে দেখতে চাই। (১৫ই অক্টোবর) তুমি যত সহজে বলেছ, তোমাকে ভুলে যেতে, সেটা আমার পক্ষে অতটা সহজ নয়। আসলে আমি তো তোমাকে ভুলে যাবার মনোভাব নিয়ে ,তোমাকে ভালবাসিনি। কখনো একথা মনে স্থান দিইনি, ভেবেছি তুমি আমার। আর এও মেনে নিয়েছি, ভাল যখন বেসেছি ,তখন কষ্ট পেতেই হবে। হাজার চেষ্টা করলেও সেই কষ্ট কম হবে না। তোমার থেকে আমি জোর করে কখনো কিছু পেতে চাইনি, কোন দাবীও করিনি। আমি ভাবছি ,তাহলে তুমি হঠাৎ কারও জীবন নষ্টের কথা ভাবছ কেন? যার জীবন, তাকেই ভাবতে দাও না। তুমি কি অনেক পাল্টে গেছ? তুমি কি আমাকে দূরে সরিয়ে দিতে চাইছ? আমি কিন্তু তোমাকে আমার অনেক কাছের মানুষ হিসেবে পেতে চাই, অবশ্য সেটা জোর করে নয় ।অপেক্ষার ফল কি হবে সেটা আমিও জানি না,তুমিও জানো না। এটা তো নতুন নয় ,এটা প্রথম দিন থেকেই আমি জানি। তাই বলে, ভয় পেয়ে, পিছনে ফিরে যাব ? এইভাবে হার মেনে নেব? আমার মনে অনেক কষ্ট উঠে আসছে, বুক ফেটে কান্না উঠে আসছে ।সেই কান্না কাকে দেব? সত্যি তোমাকে ভোলার মতো পরিস্থিতি এলে, অবশ্যই কষ্ট সহ্য করে ভোলার চেষ্টা করব, কিন্তু তুমি আমাকে ভুল বুঝো না কখনো। তুমি বলতে, আমার কষ্ট তুমি সহ্য করতে পারবে না। তাই তুমি ভুল বুঝলে আমি ভীষণ কষ্ট পাব। অনেক উল্টোপাল্টা কথা মাথায় আসছে,কেন কে জানে? কিন্তু কাউকে তো বলতে হবে। তোমাকে ছাড়া আর কাকে বলব? এত দিন পেরিয়ে গেল তবুও আমি তোমাকে সঠিকভাবে চিনতে পারলাম না। তুমি মাঝে মাঝে এমন অচেনা হয়ে যাও, যে তুমি যে আমার ,সেটা ভাবতেই আমার কেমন যেন অবাক লাগে। আমি তোমার থেকে বেশি ভালবাসা চাই না, আগে যেমনটি ছিলে, তেমনটি হলেই হবে। তখন তো তোমাকে দেখতে পেতাম, কাছে পেতাম। আর এখন তুমি কেমন যেন আমাকে এড়িয়ে যেতে চাও। আমি বুঝতে পারছি না, আমি কি এমন দোষ করেছি যার শাস্তি আমাকে এইভাবে পেতে হচ্ছে! যদি শাস্তি দিতেই হয় তবে একেবারেই দিয়ে দাও। জানো তো, আমারও একটা মন আছে। এইভাবে আমার মনটাকে বারবার ভেঙে দিও না, পরে হয়তো কোনদিন আর জোড়াই লাগবে না। আমি তো তোমাকে ভালোবাসতেই চেয়েছিলাম আর সারা জীবন তোমার ভালবাসা পেতেই চেয়েছিলাম ।তোমার যদি সম্মতি না থাকে ,স্পষ্ট ভাবে জানিয়ে দাও। সবার তো আর সব আশা পুরন হয় না !তাহলেও,আমি কিন্তু তোমাকেই ভালবাসব। যদি তুমি আমাকে ভুলে যেতে বল, তখন প্রচন্ড একটা ঝড় আমার ওপর দিয়ে বয়ে যাবে জানি, সেই ঝড় যদি সহ্য করতে পারলাম তো ভাল, আর যদি না পারি, তাতে তোমার কোন দোষ নেই, সে আমারই অক্ষমতা। বুঝতেই পারছি, তোমার কাছে আমার চাওয়া পাওয়ার কোন দাম নেই। তাইতো, আমি কে? একদিন দেখা হয়েছিল, এতদিন গল্প করেছ, ঘুরেছ, সেটাই যথেষ্ট,কি বল? (১৯শে নভেম্বর) তুমি তো সম্পর্ক শেষ করে দিতে চাইছ, আমি কিন্তু সেটা ভেবে প্রথম দিনে তোমার কাছে আসিনি। আসলে আমি তো তোমার কাছে বেশি কিছু চাইনি, একটু সময় শুধু, বিভিন্ন কাজের মধ্যে যতখানি সম্ভব হয়। আমাকে কি সত্যি সত্যি একেবারে ভুলে গেলে? তুমি আমাকে যা শাস্তি দিলে ,আশা করি আর কোন মেয়ে যেন এমন শাস্তি না পায় ।আমি তো সেই সব মেয়েদের মত সস্তা নই, তাই কষ্টটা বেশি পাই, সেরকম হলে তো আর কষ্ট পেতাম না। এখনো মনে হচ্ছে তুমি হয়তো আমাকে ভুলে যাবে না, কয়েকদিন আগের কথা ভেবেই এখনো মনে আশা হয়। আজ তোমার মুখটা বারবারই আমার সামনে ভেসে আসছে ,আমি ভালভাবেই বুঝতে পেরেছি তুমি আমাকে ভুলে গেছ। আর কাউকে তো মনের কথা বলা যাবে না কোন দিন, তাই শেষ কথাগুলো তোমাকেই বলছি ।বুঝতে পারছি তুমি আমার কাছ থেকে অনেক অনেক দূরে সরে যাচ্ছ, তাই তোমার সব কথা আমার একে একে মনে পড়ে যাচ্ছে, আমাদের আগের সেই সব সুন্দর দিনগুলো তো সহজে ভুলতে পারব না, সেগুলো বারবারই আমার মনকে খোঁচা দিয়ে যাচ্ছে। মানুষ সবকিছুই ধীরে ধীরে ভুলে যায়, একটু সময় লাগে শুধু। সবাই কত প্রিয়জনদের হারায়, সাময়িকভাবে তারা হয়তো ভেঙে পড়ে, কিন্তু ক'দিন কেটে গেলে আবার তারা তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে। মাঝে মাঝে সেসব কথা যখন মনে হয়, তখন খারাপ লাগে ঠিকই, কিন্তু মানিয়ে নিতে বাধ্য হতে হয়। আমারও তেমনি হাজার খারাপ লাগলেও, মেনে নিতেই হবে। তুমি ভাবছ, আমি কিরকম, তোমার পেছনে লেগেই রয়েছি! তুমি তো ছেড়ে চলে যেতেই চাইছ, তাও আমি ছাড়তে চাইছি না। আসলে আগে তো কাউকে এভাবে ভালোবাসিনি আর ভালোবাসা কি জিনিস সেটা অনুভবও করিনি, তাই এই ভালোবাসা জিনিসটাকে মন থেকে সরিয়ে দিতে একটু কষ্টই হচ্ছে, প্রথম প্রেম তো। আমাদের আগের প্রত্যেকটা দিনের কথা এখন প্রতি মুহূর্তে মনে পড়ছে আর দু চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসছে। সেই জল রোধ করার ক্ষমতা আমার নেই। তুমি আবার ভেবোনা, আমি চোখের জলের কথা মনে করিয়ে দিয়ে, তোমাকে ফেরত আনার চেষ্টা করছি। আসলে এরপর তো আর কখনো তোমায় কিছু বলতে পারব না, তাই। সেসব দিন যে চলে গেছে, ভাবতেও কষ্ট হচ্ছে, মেনে নেওয়া তো দূরের কথা। তবু, মেনে যে নিতেই হবে। (২রা ডিসেম্বর) তুমি ভাবছ, একে না করে দিলাম, তবুও কেন আমার পেছনে পড়ে আছে ।আসলে আমি যা কষ্ট পেলাম, সেটা তো আর কাউকে জানাতে পারব না, তাই যে কষ্ট দিল তাকেই বলছি। খুব আনন্দে তুমি এখন নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছ ,তাই না? তোমাকে যে আমি বিরক্ত করেছি যার জন্য তুমি অশান্তিতে কষ্ট পেয়েছ, তার হাত থেকে তো এবার নিস্তার পেলে। সত্যি, তোমার আজ নিশ্চিন্ত হবারই সময়, তুমি সফল হলে। তুমি আজ যা করলে বা বললে, সেটা হয়ত আরো কয়েক মাস আগেও বলতে পারতে ,তখনই হয়ত বুঝতে পেরেছিলে আমি কেমন। আমাকে যে তোমার আর ভাল লাগে না সেটা তো তখন থেকেই শুরু, বুঝতে পেরেও হয়তো ভেবেছিলে আরো কয়েকটা মাস কাটিয়ে দিই না কেন, এরপর কলেজ থেকে বেরিয়ে গেলে তো আর এমনিই দেখা হবে না। আমি দেখ কি বোকা, আমি বুঝতেই পারিনি যে আমার জন্য তুমি বিরক্ত,বীতশ্রদ্ধ হয়ে যাচ্ছ। আসলে খুব বোকার মতো ভালোবাসি তো, কখনো আগুপিছু ভাবিনি।আমি যে কোনদিন তোমার পছন্দের মত নই, হতেও পারব না, সেটা বোঝার সাধ্য কোথায় আমার ?যা হোক,এবার যাকে পছন্দ করবে সে নিশ্চয়ই তোমার উপযুক্ত হবে, তোমাকে মানিয়ে নিতে পারবে। আমি তো জানি, আমি কোন খারাপ ছেলের পাল্লায় পড়িনি, যে আমাকে নিয়ে খেলা করবে ।সত্যিই তুমি আমাকে নিয়ে খেলনি, কিন্তু আমার মনটাকে নিয়ে খেলেছ। তোমার জন্য আমি আমার অনেক চোখের জল ফেলেছি, অনেক রাতের ঘুম নষ্ট করেছি। কিন্তু আমি জানি এর কোন মূল্য নেই ,এসব শুধু এই অবাধ্য মনটার জন্য। যাই হোক, আমি আজও তোমার কাছে কোন দাবি করব না, জোর করব না। শুধু নীরবে চলে যাব। তোমার আমার শেষ দেখা হয়ে গেছে, আর কোনদিন দেখা হবে কিনা জানিনা, দেখা হলে হয়ত কথাই বলবে না। এই ক’দিনে আমি তোমার কত কাছে চলে এসেছিলাম, আর তোমার কয়েকটা কথাতে অনেক অনেক দূরের হয়ে গেছি। এখন থেকে আর তোমাকে বিরক্ত করব না, তোমাকে দেখার জন্য ,কথা বলার জন্য হাঁ করে বসেও থাকব না ।থাকবে হয়ত অন্য কেউ, সে তোমার পছন্দের হবে নিশ্চয়ই। সবাই বলে স্মৃতি সততই সুখের, কিন্তু আমার এই স্মৃতি আমাকে কোন সময় সুখ দেবে না, বরং দুঃখই দেবে। আজকে অনেকক্ষণ ধরে কেঁদেছি, তারপর দেখছি মনটা একটু হালকা হয়েছে। জানো, এই ভাবেই আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে, কি বল? আমাকে যেমন থেকে মন থেকে মুছে ফেলেছ, তেমনই এই কথাগুলোকেও মুছে ফেলো, চিঠিটাকে টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলে দিও। ইতি বন্যা

13 July 2019

ছোটবেলার ছোট কথা

ছোটবেলার কথা মনে পড়ে ।মায়ের সঙ্গে স্কুল থেকে ফেরার কথা ,সেই সরকারপাড়ার ঢালু রাস্তা, সেইসব পুকুর ,পুকুরে বাবার সঙ্গে সাঁতার শেখাও মনে পড়ে। পুরোনো পাড়া, রাস্তাঘাট, বাড়িঘর মনে পড়ে । মামা বাড়িটা তো আজ আর নেই, শুধু মনে পড়ে মামা বাড়ির বড় ঘরটায় খাটে শুয়ে শুয়ে আধো অন্ধকারে জেগে ঘুমিয়ে স্পষ্ট দেখতে পেতুম ,পাতলা কাচের পদ্মফুল ল্যাম্পশেডের থেকে বিচ্ছুরিত নীল ছায়ালোক বেরিয়ে এসে, কত স্বপ্ন সৃষ্টি করছে। শুধু মাঝে মাঝে রাস্তা দিয়ে লরি যাবার শব্দে স্বপ্ন ভেঙে যেত। বিকেল হলেই একছুটে ছাদে বা নিচের উঠোনে। কত বড় বাড়ি ,কত ঘর, কত শরিক। বড় রহস্যে ঘেরা ছিল দিনগুলো ,বড় প্রাণময় ছিল ।নানা ঘটনা মনে পড়ে একবার মল্লিকা মাসির হাত ধরে স্কুল থেকে ফেরার সময়  কেন জানি না খুব বায়না করেছিলুম, বুড়ির মাথার পাকা চুল কিনে দিতে হবে ।মল্লিকা মাসির কাছে তো আর বেশি পয়সা থাকত না, সেই বা কি করবে! বাধ্য হয়ে বেচারা আঁচলের খুঁট থেকে গুনে গুনে জমানো কয়েনগুলো বের করে সেই বুড়ির মাথার পাকা চুল আমাকে কিনে দিল। আমিও লাফাতে লাফাতে মাসির হাত ধরে বাড়ি ফিরে এলুম। সেই মাসি ছিল বড় বিশ্বাসের ,বড় আপনার।
আর একবার  দেখেছিলাম সরলাবুড়ির কয়লার ঝুড়ি বইতে খুব কষ্ট হচ্ছে ,ভারে একেবারে বেঁকে গেছে শরীরটা।আমার দেখে খুব কষ্ট হয়েছিল। এগিয়ে গিয়ে সেই ঝুড়ি নিজে বয়ে দিয়েছিলাম। বুড়ি খুশি হয়ে বলেছিল “বাবা, তুমি রাজা হও।“ খুব বেশি হয়ত উপকার করে যেতে পারিনি, সেই কয়লা বিক্রি হয়ে তার সেদিন ভাত জুটবে কিনা, তারও খোঁজ নিইনি ,তবুও ওই যে তার এক গাল ফোকলা হাসি আর আশীর্বাদ পেয়ে, ভালোবাসাটা  বুঝতে পেরেছিলাম।
পাড়ার দুর্গাপুজোর কথা মনে পড়ে। পুজোর শেষ দিকে আনন্দের সঙ্গে সঙ্গে একটা মন খারাপও মিশে থাকত। বিস্ময়ে দেখতুম পুজোকে আর ঠেকিয়ে রাখতে পারছি না ।হাতের মুঠো আলগা হয়ে যাচ্ছে, পুজো শেষ হয়ে যাচ্ছে।আর সত্যিই শেষ হয়ে গেল। সপ্তমী ,অষ্টমী, নবমী ,দশমীও।শেষ বেলায় ভাসান, শেষটুকু আনন্দ।তারপর ? আমাদের খালি প্যান্ডেল ,খালি বেদি ,প্যান্ডেল থেকে ডেকোরেটরের লোকেরা কাপড় খুলতে শুরু করেছে, ইলেকট্রিশিয়ানরা লাইট খুলে নিচ্ছে, এসব দেখে সহ্য করতে পারতুম না ।পুজো শেষ ।সেই বোধ হয় প্রথম দুঃখের অনুভূতি ।কিন্তু শৈশবে সেই যে ষষ্ঠীর ভোরে  মামাবাড়ির তক্তাপোষে শুয়ে হঠাৎ ঢাকের বাজনা শুনে ঘুম ভেঙে যাওয়া আর প্রচন্ডতম বাস্তবকে মনে পড়ে যাওয়া - আজ থেকে পুজো ।আমার আর সেই পুজো নেই, অফিসে ছুটি নেই, বন্ধুদের সঙ্গে তেমন যোগাযোগ নেই, গোলাপি চুড়িদারের সেই মাতন আর নেই, সেই দিন চলে গেছে। ।শুধু পুজো এসে গেছে ,সেই আনন্দটুকু আজও একই রকম আছে ,দুর্গাপুজো রয়ে গেছে।
স্কুল লাইফের কথা মনে পড়ে, ক্লাস ফাইভে পড়া পর্যন্ত ,স্কুলে পশুপতিদা ছিলেন ছাত্রদের খুব প্রিয় ।তিনি ছিলেন সবার শুধু শিক্ষক নন, বাবাও বটে। এতটাই আপনজন ছিলেন, আমরা তাকে 'তুমি' করে বলতাম। সস্নেহে গালে দাড়ি ঘষে দিতেন তিনি। কোলে করে আদর পর্যন্ত করতেন। ছোটবেলার সেই স্মৃতি এখনও আমার চোখে ভেসে ওঠে। তাকে দেখে তথাকথিত শিক্ষকের ছবি মুছে যেত আমাদের মন থেকে , সেখানে ভেসে উঠতেন পরমাত্মীয়, ভালোবাসার আধার পশুপতিদা।সেই স্যারই একদিন সাংসারিক কলহে বিপর্যস্ত হয়ে, আত্মহত্যা করলেন ।স্কুলে তার মৃতদেহ এনে রাখা হল। আমার শুধু মনে আছে সেই সেদিনের শোকমিছিলের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে গেট অবধি চলে এসেছি, দারোয়ান বাচ্চাদের বের হতে দেবে না ,আর আমার বন্ধু সুশোভন বলে উঠেছে "হ্যাঁ রে ,স্যারকে কি ওরা পুড়িয়ে দেবে?" সেই কথাটুকুর মধ্যে যে ব্যাথা ছিল, যে বেদনাভরা আকুতি ছিল ,তা আর কখনো দেখিনি।সে ভালবাসা ছিল একেবারে নিখাদ। ছোটবেলার কথা মনে পড়লেই মনটা খুব চঞ্চল হয়ে ওঠে।

25 June 2019

পলাশ আর পাখি

           খড়্গপুরের কাছেই নারায়ণগড় থানার যমুনা গ্রাম। তারই পোস্ট অফিসে বদলি হলুম পোস্টমাস্টার হিসেবে। তখন আমার ঝাড়া হাত-পা, বিয়ে থা হয়নি। প্রত্যন্ত, অখ‍্যাত, অজানা সব গ্রামে পোস্টিং নিতে তাই বেশ ভালই লাগত। জায়গাটাও চেনা হত। শহুরে ছেলের গ্রামের প্রতি টান তো থাকবেই, চাকরিটা যেন সেই ভালোবাসাকেই ঝালিয়ে নেবার একটা সুযোগ এনে দিল।
           এপ্রিলের মাঝামাঝি তল্পিতল্পা গুটিয়ে রওনা দিলুম। ট্রেন থেকে নেমে ,ভ্যান রিক্সা করে ঘন্টাখানেকের রাস্তা।পোস্ট অফিস বলতে একটা টিনের চালার ঘর, তারই পাশে তেমনই অবস্থা পোস্টমাস্টারের কোয়ার্টার। ভ্যান থেকে নেমে চোখ জুড়িয়ে গেল , চারিদিকে সবুজে সবুজ ।ঠিক যেমনটি চেয়েছিলুম।
 যাইহোক ,দায়িত্ব বুঝে নিয়ে, নিজের কোয়ার্টারখানা তাড়াতাড়ি গুছিয়ে ফেললুম, জিনিস তো মাত্র কটা বই আর বিছানাপত্র। নিঝুম পাড়াগাঁ, লোকজন কমই আসে পোস্ট অফিসে। স্টাফ বলতে বয়স্ক পিয়ন বামাপদবাবু। বেশ রসিক মানুষ ,নানা গল্পে দুজনের সময় কেটে যায়। বিকেলে নারায়ণগড় থেকে ডাকের গাড়ি এলে সব চিঠিপত্র বুঝিয়ে, পোস্ট অফিস বন্ধ করে, তবে বাড়ি আসি।বামাপদবাবুও  সাইকেল নিয়ে ফিরে যান বারো মাইল দূরে নিজের বাড়িতে।
          এই ভাবেই চলছিল বেশ। আস্তে আস্তে বুঝতে পারলুম, গ্রামটার বেশিরভাগ লোকই গরিব আর জাতপাত রয়েছে ভীষন ।ব্রাহ্মণরা তথাকথিত নিচু জাতের লোধা- শবর -হরিজনদের  ছোঁয় না, থাকেও সব আলাদা আলাদা পাড়ায় ,অদৃশ্য একটা লাইন টানা রয়েছে সবখানে।  গ্রামে কারো বিয়েতে সব জাতের লোককে নেমন্তন্ন করা হলেও, ব্রাহ্মণ কায়স্থদের জন্য আলাদা বসার জায়গা নির্দিষ্ট করা থাকে। সেখানে নিচু জাতের বসার অধিকার নেই।এমনকি পুজোতে পর্যন্ত এই নিচু জাতের লোকগুলোর কোন স্থান নেই ,ছোঁয়া দিলেই সব ফেলা যাবে ,এমনই ভয়ঙ্কর ঘৃণার  পরিমন্ডল। লোধা-হরিজনদের বাচ্চারা খেলতে পারে না উঁচু জাতের বাচ্চাদের সাথেও, তারা থাকে একধারে ।সে ঘরের বউদের পুজোয় ফল কাটতেও দেওয়া হয় না, বলা হয় তাতে নাকি দেবী 'কুপিত' হবেন, সব অপবিত্র হয়ে যাবে। জাতের নামে একতরফা ঘৃণা, পাল্টা ঘৃণা ।
 এছাড়া, মোটের ওপর গ্রামটা খুবই সুন্দর। ফাঁক পেলেই বেরিয়ে পড়ি এদিক-ওদিক। সবাই খুব খাতির করে, পোস্টমাস্টার বলে কথা ।জানিনা কোথায় থাকে ওদের জাতপাতের বিরোধ, নিজে মানিনাও কিছু ।তাই নিশ্চিন্তে মিশে যাই সবার সঙ্গে ।তবে, বুঝতে পারি কিছু সতর্ক চোখ সব দিকে নজর রাখছে ।গরিব নিচু জাতের মানুষগুলো মুখ বুজে সহ্য করে অন্যায় শ্রেণীবৈষম্য। আমি সব জেনে বুঝেও কিছু বলতে পারতুম না । মাসে একবার ছুটির দিনে, সঙ্গে আরও একটা কি দুটো ছুটি জুড়ে বাড়ি থেকে ঘুরে আসতুম। বেশ কেটে যাচ্ছিল দিনগুলো।
             একদিন পোস্ট অফিসে বসে মন দিয়ে কটা মানিঅর্ডার সই করে স্ট্যাম্প মারছি, বিকেলের ডাকে যাবে, হঠাৎ দেখি একটা রোগা বউ এক কোণে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে । 'কি চাই?' বলতে কোন উত্তর দিল না ।বামাপদবাবু নিজের সিট ছেড়ে গিয়ে, বউটাকে কি সব বুঝিয়ে দিতে সে মাথা নেড়ে ধীরে ধীরে চলে গেল। মনে হল ,যাবার সময় আঁচলের খুঁটে  চোখ দুটো একবার যেন মুছে নিল। বামাপদবাবু ফিরে আসতে জিজ্ঞেস করলুম ,'কে উনি?আপনার কেউ হন?' উনি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন' নাঃ ,ও তো বুদি পাতর। পাখির মা।' আমি অবাক হয়ে বললুম 'পাখি? কোন পাখি ?' উনি একটা কষ্টের হাসি হেসে বললেন ,'পাখি ওর মেয়ের নাম। মারা গেছে কয়েক মাস হল।' 'কিভাবে ?'আমার কৌতুহল দেখে শেষে উনি সেই করুন কাহিনী বলতে থাকেন। বাইরে কড়া রোদ, লোকজনও বিশেষ নেই। পাখির গল্প শুনতে থাকি আমি ।
            'পাখি ছিল হরিজন। থাকত ওর পিসির বাড়ি। যুবতী মেয়ে, পড়াশোনাও করেছিল। গ্রামের অলিখিত নিষ্ঠুর জাতপাতের বেড়া মানতে পারেনি সে।ভালোবেসে ফেলেছিল ব্রাহ্মণ যুবক পলাশকে ।পলাশও ভালবাসত পাখিকে ।ওদের প্রেম ছিল বেশ কয়েক বছরের ।একদিন দুজনের বাড়ি থেকেই জেনে গেল ওদের প্রনয়ের কথা। ব্যাস, আর যায় কোথায় ?উঁচু জাতের মানুষগুলো যাদের ঘৃনার চোখে দেখে, তার সঙ্গে প্রেম! ওদের এই সম্পর্ক কিছুতেই মেনে নিল না গ্রামের উঁচু সম্প্রদায়ের ক্ষমতাশালী মানুষগুলো ।ব্যাপক অশান্তি শুরু হয়ে গেল পলাশের বাড়িতে। হাড়ির মেয়ের সঙ্গে প্রেম! বউ করে আনলে দেবত্ব সম্পত্তি অপবিত্র হয়ে যাবে না? তাছাড়া ঘরে মা কালী রয়েছেন, অজাতের মেয়ের ছোঁয়ায়, ঠাকুরই তো চলে যাবেন। ওদের ওপর চলল নানা রকম অত্যাচার ,নির্যাতন। পাখির পরিবারকে একঘরে করে দেওয়া হল ।পলাশ ছোটবেলা থেকেই বাউন্ডুলে প্রকৃতির ,খড়গপুরে একটা হোটেলে চাকরি করে,ওর কোন কথাই কেউ শুনল না,জুটল অবর্ণণীয় অপমান।ঘটনার আগের দিন দুজনে মিলে গিয়েছিল একটা ভিডিও হলে সিনেমা দেখতে ,তারপর আর ওদের কেউ দেখেনি ।' বামাপদবাবু বোতল থেকে একটু জল খেয়ে, মুখটা মুছে, একটু থামলেন। আমার কৌতূহল তখন তুঙ্গে, 'তারপর?' আমি না বলে থাকতে পারি না। ‘ তারপর আর কি? সিনেমা দেখে, দুজনে গ্রাম থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার হেঁটে চলে যায় বাখরাবাদের দিকে। রেল লাইনের ধারে সেখানে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে ট্রেনের জন্য। পরদিন ভোরে ভুবনেশ্বরগামী প্যাসেঞ্জার ট্রেনের সামনে দুজনেই ঝাঁপিয়ে পড়ে। দুজনেই শেষ এক সঙ্গে। কিছুক্ষণ পরে যখন ওদের দেহ পাওয়া যায়, পাখির কপালে কেউ কেউ নাকি সিঁদুরের ফোঁটা দেখেছিল।'
            মনটা ভারী হয়ে গেল ওদের পরিণতি শুনে। মুখটা নামিয়ে নিলুম কি এক লজ্জায়। দুপুরের খাবার সময় হয়ে গেছে, কিন্তু একটুও খেতে যেতে ইচ্ছে করছে না ।গলাটা কি রকম যেন টক টক হয়ে গেছে। জাতপাতের নিদারুণ পরিণামের কথা ভেবে বুকে একটা ভীষন কষ্ট উঠে আসছিল।
          বামাপদবাবু বলে চলেন, 'এখানেই শেষ নয় বুঝলেন? লাশ কাটা ঘরে পাশাপাশি শুয়ে ছিল পলাশ আর পাখি। ওদের বাবা-মা-পরিবারের কাছেও ওরা হয়ে গিয়েছিল 'বেওয়ারিশ' প্রেমিক যুগল। জাত ধর্ম ভুলে ভালবাসার অপরাধে, সাত দিনেও কেউ নিতে আসেনি নিথর দেহ দুটো।কিরকম বাবা-মা দেখুনতো! নিজেদের সন্তানের দেহ নিতে এল না ,এত রাগ !' বামাপদবাবু ঘটনার কথা বলতে বলতে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন।
 'এত নিষ্ঠুর হতে পারে মানুষ!' আমি না বলে পারি না । 'বুঝলেন, গোটা গ্রামে কোন হেলদোল ছিল না ।উঁচু জাতের ছেলে নিচু জাতের মেয়ে কে ছুঁয়েছে ,মরেছে, বেশ হয়েছে। তখনও নাক শিঁটকোচ্ছে মানুষ। দুজনের শোকাতুরা মায়েরা যদি দেহ দেখে আরো শোকে বিহ্বল হয়ে পড়েন, তাই বডি, গ্রামে ঢুকতে দেওয়া হল না। বেঁচে থাকতে শাস্তি তো দিতে পারেনি , তাই মরার পর 'বেওয়ারিশ' করে সেই রাগ পুষিয়ে নেওয়া।পলাশের দাদা পিনাকী খালি রেললাইনে গিয়ে একবার দেহ সনাক্ত করেই চলে এসেছিল। ময়নাতদন্ত হল, তারপর রেল পুলিশের হেফাজত থেকে দেহ নিতে আর কেউ গেল না। টাকার অভাবে পাখির মৃতদেহও গ্রামে আনা যাবে না, বলে দিল ওর আত্মীয়রাও। দেড় হাজার টাকা ওদের কাছে অনেক টাকা ,গরিব পরিবার তো।' 'দেহ সৎকারও করল না?' আমার অবাক প্রশ্ন। 'না 'ক্ষীণ স্বরে বলেন বামাপদ বাবু। 'পুলিশের অনুরোধেও মৃতদেহ নেয়নি কেউ। সরকারি নিয়মে, বেওয়ারিশ লাশ দুটো, সাত দিন পরে অন্য সব ওইরকম লাশের সঙ্গে পুড়িয়ে দেওয়া হয়।' অসহায় কন্ঠে বলেন বামাপদবাবু 'এখনও আমরা কত পিছিয়ে আছি, না? ভালোবাসার কি নিদারুন শাস্তি, বলুন?' আমি স্তব্ধ হয়ে রইলুম।
            পোস্ট অফিস বন্ধের সময় হয়ে এসেছে, বাইরে রোদ পড়ে এসেছে। জানালার বাইরে দিয়ে চেয়ে থাকতে থাকতে মনে হল, দূরে কোন এক ফুলে ফুলে ভরা লাল পলাশ গাছে, কোন এক চঞ্চল পাখি হয়ত  ঠিক এখনই বসে , আমার দিকেই যেন তাকিয়ে আছে ।আমি  দেখতে পাচ্ছি না কেন?

23 June 2019

কখনও বলিস না

(আত্মহত্যাপ্রবণ কিশোর কিশোরীদের উদ্দেশ্যে লেখা)
         'চলে যাচ্ছি' বললেই হল নাকি? আরো কত দিন পড়ে আছে,কত মানুষ তোর মুখ চেয়ে আছে,  তাদের কি উত্তর দিবি ?'চলে যাচ্ছি' বললেই বা কে তোকে যেতে দিচ্ছে ?কেন চলে যেতে চাইছিস, থাক না আরো কটা দিন এই প্রিয় পৃথিবীতে।যেমন থেকে যাচ্ছে ছোট্ট পিঁপড়ে,লড়াকু পরিযায়ী পাখি বা জঙ্গলের পর জঙ্গল শেষ হয়ে গেলেও হাতিদের দলে আপ্রাণ থেকে যাচ্ছে ছোট্ট বাচ্চাটা। সেইরকমই থেকে যা না,আরও কটা দিন।
          প্লিজ ,এত তাড়াতাড়ি চলে যাস না। না হয়  থাকলই কিছু দোষের,কিছু ভুলের,কিছু না পাওয়ার।আরও কত কিছু তো করার আছে,কত কিছু দেখার আছে,কত কিছু জানার আছে। স্পেনের আলতামিরা  বা প্রিয় মানুষটার সাথে বাইকে লন্ডন যাত্রা না হয় ছেড়েই দিলাম ।এই যে এখন আকাশে বর্ষার মেঘ করেছে ,টুপটাপ বৃষ্টি হচ্ছে,আর বাইরে নিম গাছটার সবুজ সবুজ পাতার গা দিয়ে জলের ফোঁটাগুলো যেন একের পর এক মুক্তোর মত গড়িয়ে পড়ছে ,এসব কি সত্যিই দেখবি না তুই? এসব তো তোরই জন্য । শীতের শুরুতে আকাশটা যখন ঝকঝকে নীল হয়ে যায় আর মিঠে রোদে মনটা ভাল হয়ে যায়, যখন  রাস্তার ধারে একটা সদ্যোজাত ছাগল ছানা অকারণে তিড়িংবিড়িং  লাফায়  বা চরম অবজ্ঞায় নর্দমার কোণেও যখন সবুজ চারাগাছটা মেলে দেয় তার দৃপ্ত দুটো পাতা ,তখন মনে হয় বেঁচে থাকা কি সুন্দর।এই সুন্দর জীবন কি তোর জন্য নয় ?এসব কি আমাকে একা একাই দেখে যেতে হবে ? কতদিন ,আর কতদিন এভাবে 'চলে যাচ্ছি ' বলে চলে যাবি ?
           কিছুতেই তোকে চলে যেতে দেব না। তোরই জন্য যে এই খরার দেশে ,আজও কষ্টেসৃষ্টে সন্ধ্যেবেলায় জুঁইফুল ফোটে, গন্ধ ছড়ায়।তুই দেখবি না হাতে তুলে নিয়ে? সেই গন্ধ বুকে টেনে নিবি না ?তোরই জন্য পৃথিবীর কোন দূর যুদ্ধপ্রান্তে, কোন গরীব ঘরে অভুক্ত মা তার মুখের গ্রাস তুলে দেয় সন্তানের মুখে,তুই তা জানবি না? ভুল বুঝে চলে যাবি?ওরে,তোকে যে ভালবাসি আমরা,এ কথা কি বলে দিতে হবে?তুই কি বুঝতে পারিস না? মানুষে মানুষে এত হানাহানি, তবু সন্তানকে ,ভাইকে ,প্রিয় বন্ধুকে বুকে জড়িয়ে যে ভালোবাসা আর সারা জীবন পাশে থাকার যে না বলা কথা, চোখের একফোঁটা জল হয়ে অজান্তে নামে, তুই তা বুঝবি না? কিসের এত রাগ,দুঃখ, অভিমান ?
           এই যে বইয়ের মধ্যে থাকা শুকনো গোলাপ, কবেকার জমানো ট্রামের টিকিট, রাশিরাশি নিউজপ্রিন্টে শুধু তোরই কথা ,একলা দুপুরে স্বপ্নে সেই সব মন কেমন করা রাস্তা, ঠাকুমার পুরোনো বাক্স খুলে বেরিয়ে আসা ময়লা হয়ে যাওয়া ঠাকুরদার শেষ চিঠি, একা একা ছাদে বসে পূর্ণিমা রাতে সেই যে প্রথম কবিতা মনে আসা, আলমারি খুলে বাসি বেনারসির মধ্যে টাটকা চেনা গন্ধ, ঘেমো ভীড় বাসের হয়রানিতে হঠাৎ কানে এসে পড়া মান্না দের সেই গান বা  হঠাৎ খুঁজে পাওয়া রবিঠাকুরের  ছিন্নপত্র এগুলো কি কিছুই নয় রে? এসব তবে কার জন্য ?নাইবা হল সব পাওয়া,এই ছোট ছোট জিনিসগুলোই তো সব, এই ভালবাসার পৃথিবী ছেড়ে চলে যাস না।প্লিজ,যাস না।

20 June 2019

ফাইনের মান্থলি

                    বেশ কিছুদিন আগের কথা। তখন সবে চাকরি জয়েন করেছি,বর্ধমানে। আমি আর আমার স্কুল ফ্রেন্ড সুব্রত দুজনেই ডেইলি প্যাসেঞ্জারি করি। মান্থলি আছে, যে ট্রেন আগে পাই তাতেই তড়িঘড়ি উঠে পড়ি। বাড়ি ফেরার তাড়া ।টিটিরাও সবাই চিনে গেছে ,কেউ কিছু বলে না।সুব্রতর আবার সিগারেটের নেশা। ট্রেনের দরজার ধারে ,বাথরুমের আড়ালে বা ভেস্টিবিউলের ফাঁকে দাঁড়িয়ে ও সিগারেট খাবেই।সেটাও কেউ বিশেষ কিছু বলত না। সুব্রত বড়লোক ঘরের ছেলে, বাবার বিশাল ব্যবসা ।ডানহিল, বেনসন হেজেস  বা ফাইভ ফিফটি ফাইভ ছাড়া ধরাত না।
           তো সেদিন হয়েছে কি, এক নতুন টিটি উঠেছে ট্রেনে। আগে কখনো দেখিনি। দেখলাম ও দিক থেকে বেশ কয়েকজনকে ফাইন করতে করতে আসছে ।মনে হল, বেশ কড়া ধাঁচের। মেল ট্রেনে চড়ার মাশুল আদায় করছে ডেলি প্যাসেন্জার সবার থেকে, কারো কোন কথা শুনছে না। বুঝলাম কেসের কোটা ফিলাপ- এর ব্যাপার আছে,তেঁটিয়া মাল। এদিকে সুব্রত তখন সবে সিগারেটটা ধরিয়েছে , ভেস্টিবিউলের ফাঁকে দাঁড়িয়ে। দেখলাম ঝামেলা আছে, ফাইন করবেই। ওকে বলতেই আমাকে তাচ্ছিল্য করে সরিয়ে দিল। বলল 'কত বড় টিটির বাপ আছে দেখব,তুই ফোট তো।' আমি আর কি করি, চুপ করে মজা দেখছি।টিটি যথারীতি এসে সুব্রতকে ধমকে বলল ' কি ব্যাপার, ট্রেনে সিগারেট খাচ্ছেন! নোটিশ পড়েননি?'সুব্রত বিন্দাস, সিগারেটে সুখটান দিতে ব্যস্ত, পাত্তাই দিল না ।টিটি রেগে বলল'কি হল?দিন ফাইন দিন।একশো টাকা ফাইন।' সুব্রত সিগারেটের ধোঁয়াটা খুব কায়দা করে ছেড়ে,মেজাজে মানিব্যাগ থেকে একটা পাঁচশ টাকার নোট বার করে ,বাড়িয়ে দিল। টিটি টাকাটা নিয়ে, একগাদা খুচরো টাকা পকেট থেকে বার করে গুনে ফেরত দিতে যাচ্ছিল। সুব্রত ওনাকে  চমকে দিয়ে বলল, 'রেখে দিন দাদা, পুরোটাই রেখে দিন।মান্থলি।' সিগারেট নেভাবার নাম নেই,উল্টে সুব্রতর হাবভাবে সবাই বেশ একটা মজার খোরাক পেয়ে চেয়ে রইল ।টিটি একটু মিইয়ে গিয়ে অবাক হয়ে বলল 'মান্থলি!মানে?' সুব্রত গম্ভীর ভাবে বলল 'মানে কিছুই না, এরপর যতবার যাব, এ ট্রেনে এভাবেই সিগারেট খেতে খেতে যাব।তাই একেবারে মান্থলি কেটে নিলাম।বুঝলেন?' বোঝ ঠেলা।ফাইনের আবার মান্থলি!আশপাশের সব প্যাসেন্জাররা হো হো করে হেসে ওঠে। টিটি তো মহা অপ্রস্তুতে পড়ে যায়।পাঁচশ টাকার ব্যাপার,টাকা ফেরত দিতেও পারছে না,আবার ছেড়ে দিতেও পারছে না।মস্করাটা হজম করেই ব্যাচারা সুড়সুড় করে পরের কামরায় কেটে পড়ে।কামরায় তখন হাসির হুল্লোড়। আর কখনো সেই টিটি বাছাধনকে দেখিনি।

13 May 2019

আমার রবিঠাকুর

এখনও সেভাবে রবীন্দ্রনাথ পড়িনি, বুঝিওনি। রবিঠাকুর মানে তো শুধু কবিতা, গান, গল্প বা নাটকই নয় - রবিঠাকুর আমাদের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন পরতে পরতে। জীবনের ওঠাপড়া, বড় হয়ে ওঠা, সুখ-দুঃখ সবেতেই রবিঠাকুর ওতপ্রোতভাবে মিশে আছেন। মনে হয়, এ যেন একটা গোটা জাতির চিরকালের বন্ধন, অন্তরের পরিচয়, কৃষ্টি ও সংস্কৃতি ।               মনে পড়ে ছোটবেলায় রেডিওতে ভেসে আসা রবীন্দ্রসঙ্গীত কানে ঢুকে, মর্মে পৌঁছে যেত, এমনই ছিল তার যাদু। একটু বড় হয়ে স্কুলে 'সহজ পাঠ' বইয়ে রবীন্দ্রনাথকে প্রথম পেলাম । তারপর  নানা  ছড়া, কবিতা দিয়ে মানুষটার সঙ্গে যাত্রা শুরু হল। বিভিন্ন গল্প, গান, নাটক, চিঠিপত্র ইত্যাদি দিয়ে আরো গভীরে প্রবেশ করলাম । বাবারই অফিসে আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় আবৃত্তি করলাম 'দামোদর শেঠ'। তখন আমার বয়স ছয় কি সাত। প্রথম হলাম। বাবা শিখিয়ে দিয়েছিলেন প্রয়োজনীয় মডুলেশনগুলো। পুরস্কার হিসেবে পেলাম রবীন্দ্রনাথের  প্লাস্টার অফ প্যারিসের ফ্রেমে বাঁধানো, হলুদ সেলোফেনে মোড়া পূর্ণাবয়ব ছবি। সেই পুরস্কার এখনও যত্ন করে তুলে রাখা আছে।              বাবার একটা সঞ্চয়িতা ছিল, মাঝে মাঝে পড়তাম, বাবা নিজেও পড়ে শোনাতেন। কখনও শীতের দুপুরের মিঠে রোদে, ছাদে বসে আলগা সময়গুলোয় বাবা-মা আর আমার সাথে থাকত রেডিও। কত অনুষ্ঠান, কত গান, কত নাটক । সন্ধ্যাবেলায় প্রায়ই লোডশেডিং হয়ে যেত, বাবা সেই বুশ ব্যারন রেডিওটা চালাতেন । লম্ফ বা হ্যারিকেনের আবছা আলোয় আমাদের তিনজনের ছায়া দেওয়ালে নড়েচড়ে উঠত আর রেডিওতে বাজত রবীন্দ্রনাথ । বাবা বুঝিয়ে দিতেন গানের এক একটা কথার মানে। তখন শিশুমনে সব বুঝতাম কিনা জানিনা, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ বোধহয় সেই শিশুকাল থেকেই আমাদের জীবনের এক অপরিহার্য অংশ  হয়ে গিয়েছিলেন । আজ পয়তাল্লিশ বছর বয়সে যখন রবীন্দ্রনাথের গান বা কবিতার এক একটা লাইন জীবনের পরম দুঃখ , আনন্দ বা অনুভবে স্রোতের মতো গলায় নেমে আসে, তার অর্থ জীবন দিয়ে বোধগম্য হতে থাকে, হৃদয়ের  গভীরে ঢুকে যেতে থাকে আর চোখ ভিজে যায় ; সেই মহানুভব, সেই দার্শনিকতা, সেই ব্যাপ্তি আর জীবনবোধ যখন ঘিরে ধরে, তখন বুঝতে পারি, ছোটবেলার সেই অনুভূতি কতটা সঠিক ছিল। মানুষের জীবনের শিশুকাল থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মনেপ্রাণে, রন্ধ্রে রন্ধ্রে এই  আমার রবীন্দ্রনাথ।            স্কুলে আমার পাশে বসত প্রিয় বন্ধু সব্যসাচী। খুব মেধাবী আর রবীন্দ্রনাথের অন্ধ ভক্ত। কত শিখতাম দুজনে মিলে। স্কুলের কয়েকজন স্যার আপামর রবীন্দ্র অনুরাগী ছিলেন- অমলদা , দীনেশদা , সাধনদা। আমাদের জুড়ে দিতেন সেই রবীন্দ্র ফল্গুধারার সঙ্গে। বাংলা মিডিয়ামে পড়তাম তাও আবার রামকৃষ্ণ মিশনের মত স্কুলে, সেজন্য আমি ভাগ্যবান। রবীন্দ্রনাথকে না হলে এভাবে জানতে পারতাম না। স্যারেরা পড়াতেন আর আমাদের সামনে সেই অজানা রবীন্দ্র জগতের একের পর এক দরজা খুলে যেত। ক্লাসের জানলা দিয়ে দূরের নারকেল গাছের সারির দোল খাওয়া দেখতাম, কেউ বকত না। নীচু ক্লাসে 'আব্দুল মাঝির গল্প', পরে হাইস্কুলে 'রামকানাইয়ের নির্বুদ্ধিতা', 'কাবুলিওয়ালা' গল্প; কবিতার মধ্যে 'দীনদান', 'নববর্ষা' স্যারেরা যখন পড়াতেন, আমি ঢুকে যেতাম সেই জগতে। তার মানে, তার ব্যঞ্জনা, গভীরতা, সেই বয়সে হয়ত পুরোপুরি বোধগম্য হত না, কিন্তু গভীরে কোথাও যেন  দাগ কেটে যেত, একটা জমি তৈরি হয়ে যেত। বাবা আবৃত্তি করতেন 'দুই বিঘা জমি' বা 'পুরাতন ভৃত্য'। দেখতাম বাবার চোখে জল । বাবা বুঝিয়ে দিতেন লেখার গভীর অনুভূতির জায়গাগুলো। তখনই হয়ত ভাবতাম, একদিন রবীন্দ্রনাথ পড়ব, বুঝব। বাবা বলতেন "দেখবি সব কিছুতেই রবীন্দ্রনাথ জড়িয়ে আছেন"।              বাবার অসংখ্য বই ছিল, রবিঠাকুরের ওপর নানা বই- প্রবন্ধের। সেসব অতটা না টানলেও গল্পগুচ্ছ খুব টানল, আর গান। শুরু হলো গুনগুন করে গান গাওয়া, তারপরে গান শেখা। একদিন সেই সময়েই হাতে এল প্রথম প্রেমপত্র । তাতেও রবীন্দ্রনাথ। দুটি লাইন "আমার সকল রসের ধারা, তোমাতে আজি হোক না হারা।" তারপর "তোমারেই যেন ভালবাসিয়াছি শত রূপে শতবার, জনমে জনমে যুগে যুগে অনিবার ।" প্রেম তো হল, বড়ও হলাম। রবীন্দ্রগান আর কবিতায় নিজের বিভিন্ন চেতনাকে খুঁজে পেতে লাগলাম ধীরে ধীরে। বাবা লেখালেখি করতেন। বলতেন, "লিখতে গেলে রবীন্দ্রনাথকে এড়ানো অসম্ভব। ঠিক কোথাও না কোথাও ওনার প্রভাব এসে পড়বেই। নতুন কিছু লিখতে গেলেও দেখি, যাই লিখতে যাই তিনি আগেভাগেই তা অনেক সুন্দর করে লিখে বসে আছেন।" মেঘ ডাকলে আকাশ কালো করে বিদ্যুতের চমক দেখা গেলে, বাবা গুন গুন করে গাইতেন " গগনে  গরজে মেঘ, ঘন বরষা " বা "ঐ আসে ঐ অতি ভৈরব হরষে, জলসিঞ্চিত ক্ষিতিসৌরভরভসে, ঘনগৌরবে নবযৌবনা বরষা, শ্যামগম্ভীর সরসা "। বুঝতাম বাঙালীর সুখে-দুঃখে যে গান, সেই গান, সেই প্রাণের কথা, মনের কথা এইতো আমি পেয়ে গেছি। আমার চাই'ই রবীন্দ্রনাথ। যেমন না চাইতেও, উনি এসে পড়েন বাঙালীর অনুভবে। বাবা বলতেন, "যে বাড়িতে রবীন্দ্রনাথ আর বিদ্যাসাগরের ছবি দেয়ালে ঝোলানো থাকে না, তারা মানুষ নয়।"                   তারপর শুরু হল ক্যাসেট কেনা। রবীন্দ্রসঙ্গীতের ক্যাসেট কিনতাম কম। আধুনিক, হিন্দি গানের সুর ঝংকার টানত বেশী। বাবার কাছে বকুনি খেতাম। তবু বয়সটা ছিল কম, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে যোগসূত্রটা আলগা হতে বসেছিল। বয়সের উত্তাপে তখন ভাল লাগত মান্না দে, হেমন্ত, কিশোরকুমার, ম্যাডোনা। পাগল পাগল অবস্থা ।            হঠাৎ আমার প্রিয় বন্ধু বিশ্বজিৎ আমাকে দিল 'শেষের কবিতা ' শ্রুতিনাটক। শুনতে শুনতে অন্য রবীন্দ্রনাথকে আবারও খুঁজে পেলাম, বুঝলাম বাবা ঠিকই বলেছেন। রবীন্দ্রনাথ ছাড়া উপায় নেই। 'শেষের কবিতা'য় সৌমিত্রর সেই 'নির্ঝরিণী' আবৃত্তি, আমার জীবনের প্রতিদিনকার অংশ হয়ে গেল। খাতায় লিখে রাখতাম প্রিয় সব কবিতা, আবৃত্তি করতে চেষ্টা করতাম। ফ্যান হয়ে গেলাম জগন্নাথ- উর্মিমালার। কিনলাম 'রবিবার', 'শেষ চিঠি' শ্রুতিনাটক। আবার চমক, আবার রবীন্দ্রমোহ, উনি যে কত আধুনিক, সেদিন বুঝলাম। আমার জীবনে, মননে আবার জড়িয়ে গেলেন রবীন্দ্রনাথ। গানের  বা কবিতার এক একটা লাইন শুনে এক এক সময় খুব কষ্ট হত, ভীষণ কষ্ট । গলায় আটকে থাকত সেই কষ্ট । চোখের জল হয়ে তা কখনও বা নেমে আসত, আর তার সঙ্গে সেই সমগ্র অনুভূতিগুলোকে নিয়ে জড়িয়ে থাকতেন রবীন্দ্রনাথ। সেই সময়েই আমার কবিতা লেখার শুরু। খাতাগুলো ভরে উঠত নানা কবিতায়, ছড়ায়। সচেতন ভাবে চাইতাম সেসব যেন হয় রবীন্দ্র প্রভাবমুক্ত। কিন্তু ধীরে ধীরে বুঝলাম গভীরতা ও দার্শনিকতায় সেসব কথা রবীন্দ্রনাথ সত্যিই আগে বলে গেছেন। আরও সুন্দর করে বলে গেছেন। আমি দেখলাম, বাবার কথাই সত্যি।      এদিকে তখন গানও শিখছি, বেশ গাইতে পারি রবীন্দ্রসঙ্গীত। কারণে অকারণে আমার গলায় উঠে আসত সেই সব গান আর তার মানেটাও বোঝার চেষ্টা করতাম। তবে কিছু গান, বেশ মেয়েলি লাগত। ভাবতাম এরকম কেন ? পরে বুঝেছিলাম তার গভীরতা, তার দার্শনিকতা। সবার সব অনুভূতির একাত্মীকরণের নামই রবীন্দ্রনাথ। একই গানের, ভিন্ন পরিবেশে ভিন্ন অর্থ হৃদয়ঙ্গম হয়, দেখে  অবাক হয়ে যেতাম। মনে হত পুরোপুরি রবীন্দ্রনাথ বুঝতে, বোধহয় আরও কয়েকবার জন্ম নিতে হবে।            বিশ্বজিৎ এবার আমাকে দিল, তার এক দাদুর ছোট্ট একটা ডায়েরি, যাতে প্রতি পাতায় মুক্তোর মত অক্ষরে উনি লিখে গেছেন এক একটা কোটেশন। পাতায় পাতায় শুধু রবীন্দ্রনাথের গান বা কবিতার থেকে নেওয়া কয়েকটি করে লাইন। সে যেন আমার কাছে এক মহা মূল্যবান রত্ন হয়ে দাঁড়াল, তাকে নিয়েই কাটত দিনগুলো। নিজেও এক ডায়েরিতে লিখতে শুরু করলাম বিভিন্ন গান বা কবিতার ভালোলাগা সব লাইন । এভাবেই মরমে মরমে গেঁথে যেতে লাগলেন রবীন্দ্রনাথ।           তারপর বড় হয়েছি , কেরিয়ারের লড়াই চলছে,গান শোনাও গেছে কমে। রাস্তাঘাটে রবীন্দ্র সঙ্গীত কানে এসে পড়লে শুধু থমকে দাঁড়ায় পা। কই, হিন্দি গান শুনে কখনো তো এমন হত না? বুঝলাম, বাবা কেন মার মার করতেন চটুল গান শুনতে দেখলেই। সেদিন থেকেই আবার নতুন করে রবীন্দ্রনাথ পড়তে, রবীন্দ্রনাথকে জানা শুরু হল। আমি ঘুরে এলাম জোড়াসাঁকো আর শান্তিনিকিতন থেকে। মনে আছে, সেবার শান্তিনিকেতনের একটা গাছের নীচে, ভাঙা ইঁটের পাঁজায়, নিঝুম দুপুরে বসে থাকতে থাকতে আমি যেন এক অদ্ভুত ঘোরের জগতে চলে গেলাম। মনে হল, আমি যেখানে বসে আছি, কতদিন আগে রবীন্দ্রনাথ নিজেও বোধ করি এখানেই বসে থাকতেন, ক্লাস নিতেন, কবিতা লিখতেন। আমার জন্য কি কবির ঐটুকু ছোঁয়া এখনও বেঁচে আছে? কেউ যা জানে না, পায় না, কবির সঙ্গে সেই যোগাযোগটুকু এখানেই করে ফেলতে পারলাম? উনি কি জানলেন, আমি এসেছিলাম, কবির কথা ভেবেছিলাম, নিবিড়ভাবে তাঁর লেখা ভালবেসেছিলাম। এমনও কি হতে পারে না? তিনি তো আছেন।            রবীন্দ্র মিউজিয়ামে ঢুকে রবিঠাকুরের জীবন নিয়ে, কর্ম নিয়ে, পৃথিবীব্যাপী তার প্রভাব দেখে, আমার চোখ খুলে গেল। ওনার আঁকা ছবি, চিঠিপত্র এসব দেখে  মন ভরে গেল। একটা মানুষ, একটাই জীবনে এত কিছু করেছেন! কি দানবিক! বাবা সারাজীবনে যা পারেননি, আমি তা করে ফেললাম। সব জমানো টাকাগুলো দিয়ে কিনে ফেললাম সমগ্র রবীন্দ্র রচনাবলী। আর সেই সময়েই হঠাৎ অনেক দূরে চলে গেল, বিশ্বজিৎ। এই অল্প বয়সেই আমাকে একা ফেলে রেখে, সে চলে গেল না ফেরার দেশে। মেনে নিতে পারিনি ঘটনাটা, শুধু রয়ে গেল ওর চিঠিগুলো আর একসঙ্গে বড় হয়ে ওঠার অসংখ্য সব স্মৃতি, অসংখ্য ভাগ করে নেওয়া অনুভূতিগুলো। আর অবশ্যই রবীন্দ্রনাথ, যে রবীন্দ্রনাথকে সে আমায় চিনিয়েছিল। "তুমি রবে নীরবে, হৃদয়ে মম" গাইতে গেলে তাই আজও চোখে জল আসে।       রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে আমার ব্যক্তিগত অনুভূতির কোন শেষ নেই। আজও মনে পড়ে, সেদিন বিকেল, আমার প্রেম ভেঙে গেছে । শেষমেশ দেখা করে সব চিঠিচাপাঠি ফিরিয়ে দেবার দিন। দেখতে পেলাম হলদে শাড়ি পড়ে সে আসছে, চোখ মুখ অন্যরকম। অনেক কেঁদেছিল নাকি? সে এগিয়ে আসছে, বুকের কাছে ধরা আমারই উপহার দেওয়া 'শেষের কবিতা' বইটা। সে বলল, "মানুষটাই যখন চলে গেছে, তখন আর উপহারগুলো রেখে কি লাভ ?এই নাও, সব ফিরিয়ে দিলাম।" শেষের কবিতা বইয়ের প্রথম পাতায় আমারই লেখা কবিতার ধৃষ্টতা, ভেতরে অসংখ্য হাত চিঠি। সব কি ফিরিয়ে দেওয়া যায়? শেষ প্রেমিকা বাস ধরে চলে গেল। আমার হাতে থেকে গেল "শেষের কবিতা"। সেদিন সেই মুহূর্তে আমার গলায় নয়, মনে ভেসে আসছিল একটাই গান, “তবু মনে রেখো, যদি দূরে যাই চলে“। তারপর থেকে আজ অবধি যখনই গানটা গুনগুন করে গাই, আমার চোখে ভেসে ওঠে এক ধূসর বিকেলবেলা। জীবনের সবচেয়ে দামী সঞ্চয় অক্লেশে ফিরিয়ে দিয়ে, নিঃস্ব হয়ে বাসে চেপে চলে যাচ্ছে একটি মেয়ে, যে আর কখনও ফিরে আসতে পারবে না সেই ছেলেটার কাছে, যার চেয়ে বেশী ভাল কেউ কখনও বাসেনি তাকে।

3 May 2019

বটবৃক্ষ

অঞ্জন বাবা-মার একমাত্র সন্তান। তিনজনের সুখের সংসার ।ওকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছেন ওর বাবা সুপ্রতিম আর মা রেবা,অঞ্জনকে চোখের আড়াল হতে দেন না ।ছোটবেলা থেকেই তাই বাবা-মার শিক্ষা, ভালোবাসা ,আবেগ ,নির্দেশ এসবের সঙ্গে মায়ার বাঁধন ওর একটু বেশিই। ও জানে বাবা মা সব সময় ওর পাশে আছে এবং থাকবে ।         সেই অঞ্জনেরই একদিন হঠাৎ একটা বড় অ্যাক্সিডেন্ট হল।ও তখন ক্লাস ফোরে পড়ে ।বন্ধুর সঙ্গে বন্ধুর বাড়িতেই খেলতে গিয়ে, সিঁড়ি থেকে গড়িয়ে পড়ে গেল কয়েক ধাপ ।মাল্টিপল ফ্র্যাকচার, সঙ্গে কোমরের ভয়ঙ্কর চোট। জীবনে কোনদিনও নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবে কিনা সন্দেহ। নার্সিংহোমের বেডে শুয়ে থাকত অঞ্জন ।একের পর এক অপারেশন হবে ,জলের মতো টাকা খরচ হয়ে যাচ্ছে। অঞ্জনের চোখে জল, অজানা আশঙ্কা।ও কি আর নার্সিংহোম থেকে নিজের বাড়ি ফিরতে পারবে না?কোনোদিন কি হাঁটতে, স্কুলে যেতে, খেলতে পারবে না ?ওর ছোট্ট মনে সেদিন অনেক ঝড়। কিন্তু মাথার কাছে দাঁড়িয়ে সুপ্রতিম বাবু বললেন "তোর কিচ্ছু হবে না ,সব ঠিক হয়ে যাবে।" মা গালে চুমু খয়ে বললেন "সোনা আমার, সব ঠিক হয়ে যাবে দেখিস, একদম ভয় পাবি না।" বাবা-মার এই 'সব ঠিক হয়ে যাবে' কথাটা সেই দিন থেকে অঞ্জনের জীবনে সবচেয়ে বড় ওষুধ, সবচেয়ে বড় মনোবল হয়ে গেল। ও বিশ্বাস করেছিল সত্যিই সব ঠিক হয়ে যাবে ।আর তাই হল। বিখ্যাত নিউরোসার্জন এর ট্রিটমেন্ট ,সর্বশ্রেষ্ঠ নার্সিংহোমের যত্ন -অঞ্জনের অপারেশন সফল হল।তারপর অমানুষিক লড়াই,দাঁতে দাঁত চেপে অঞ্জনের নিজের পায়ে হাঁটার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম।দাঁড়াতে ওকে হবেই। কষ্ট হত খুব,চোখে জল এসে যেত ,তবু লড়াই থামেনি।জানত বাবা মা ওর পাশে আছেন।তাদের ভরসার মর্যাদা অঞ্জন দিতে পারবে না?একদিন,তখন ও নিজের পায়ে কয়েক সেকেন্ডের বেশি দাঁড়াতে পারে নাহাঁটা তো দূর,অসহ্য যন্ত্রণা। সেদিনই হঠাৎ দেখে ফেলেছিল মার চোখে জল,মুখটা লুকিয়ে নিলেন।লুকিয়ে কত কাঁদতেন কে জানে?।সারারাত জেগে দুজনে ওর পাশে বসে থাকতেন।একদিন শুনে ফেলেছিল করিডোরে পায়চারি করতে করতে বাবা যেন কাকে আড়ালে বলছেন “ আমি হেরে গেলাম রে।ছেলেটা....” ।সেদিন ওর মনে জেদ চেপে গেল।ছোট্ট বুদ্ধিতে এটুকু বুঝে গেল,আর কারো না হোক,বাবা মার জন্য ওকে সুস্থ হতেই হবে।কিছুতেই ওদের হেরে যেতে দেবে না।ওদের মুখে হাসি ফোটাতে হবে।ওদের তিনজনকেই লড়াইটা জিততে হবে।আর সত্যিই কয়েক মাস পরে বাড়ি ফিরে আসে ও, একেবারে সুস্থ হয়ে নিজের পায়ে হেঁটে। সেই থেকে অঞ্জনের নিজের থেকেও নিজের বাবা-মাই জীবনের সবথেকে বড় আশা ভরশা,ঠিক ভগবানের মতো ।       হায়ার সেকেন্ডারির রেজাল্ট খারাপ হয়েছিল অঞ্জনের। কোথাও চান্স পায় না উচ্চশিক্ষায়। কেরিয়ারটা শেষ হয়ে যাবে। বাবা সুপ্রতিমবাবু বুঝতে পারেন ওর উৎকণ্ঠা, মনোকষ্ট ।মা রেবাও অঞ্জনের মনের ঝড়ঝাপটা কমানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেন। কেউ ওকে বকাঝকা করেন না ।বাবা বলেন "চিন্তা করিস না ,তোর তো সাইন্সে ভালো নম্বর আছে ,আমি দেখছি কি করা যায়। তোর ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে যাবার দরকার নেই ,অন্য অনেক ভালো কোর্স আছে ।সব ঠিক হয়ে যাবে।" মাও হেসে ওর পিঠে হাত রেখে ওর মনে বল বাড়ান। বাবা-মার সমর্থন, ভরসা যোগানো ,ওর গভীর দুশ্চিন্তার মধ্যেও একটু আলোর রেখা হয়ে দেখা দেয়। জীবনের দুর্বিষহ দিনগুলোয় ওকে বাঁচতে শেখায়। একটু একটু করে ঘুরে দাঁড়াতে সাহায্য করে। "সব ঠিক হয়ে যাবে।"         ঘুরে সত্যিই দাঁড়িয়েছিল অঞ্জন। ডাটা সায়েন্টিস্ট হিসেবে আজ ও একটা ভালো কোম্পানিতে ব্যাঙ্গালোরে কাজ করে। মাঝেমধ্যেই বিদেশে যায় সেমিনারে বা ক্লাস নিতে।আজ ও প্রতিষ্ঠিত,আজ ও জানে জীবনে কিভাবে বারবার ঘুরে দাঁড়ানো যায়, ঘুরে দাঁড়াতে হয়। আর তার সব কৃতিত্ব ওর বাবা-মার।            ঠিক এই সময় অঞ্জনের জীবনে আবার একটা ঝড় আসে, সব এলোমেলো হয়ে যায়।বর্ণালীর সঙ্গে হঠাৎ ব্রেক আপ হয়ে যায়, পাঁচ বছরের সম্পর্কটা ভেঙে চুরমার হয়ে যায় ।বর্ণালীর এই হঠাৎ চলে যাওয়াটা ,মেনে নিতে পারে না অঞ্জন ।জীবনটা যেন ছারখার হয়ে যায় ।চোখে জল, একা উদ্দেশ্যহীন পথ চলতে চলতে হঠাৎই কলকাতায় ফিরে আসে ও,চাকরিটাও দুম করে ছেড়ে দেয়। মুখ গুঁজে, ঘর বন্ধ করে পড়ে থাকে, খাওয়া-দাওয়াও ঠিক মতো করে না। এবারেও কিন্তু প্রতিবারের মতোই পাশে পায় সেই বাবা-মাকে। বন্ধুর মতো বাবা এসে নানা কথায় ওকে ভোলানোর চেষ্টা করেন ঠিক ছোটবেলার মতো, মনটাকে আশা দিয়ে অন্য দিকে নিয়ে যেতে চেষ্টা করেন। অঞ্জন এখন বড় হয়েছে, বন্ধু বান্ধব হয়েছে, আলাদা জগত হয়েছে ।বাবা-মাকে আর তার আগের মত সেভাবে দরকার নেই। বাবা-মার সঙ্গে ছোটবেলার সেই বাঁধনটা এখন আর ততটা নেই, অন্তত রোজকার জীবনে।কিন্তু ও দেখল, ওর ধারনা বিশাল ভুল। বাস্তবে, আজও বাবা মা ওর জীবনের সবচেয়ে বড় আশাভরসা ,সবচেয়ে বড় অস্তিত্ব। বাবা অফিসে ছুটি নিয়ে ,ওর পাশে পাশে থাকেন ।মা নতুন নতুন রান্না ,নতুন নতুন গল্পের বই এনে দেন ,ছোটবেলার ছবি- ভিডিও দেখাতে থাকেন। নানাভাবে দুজনে, অঞ্জনের মনের আঘাতটাকে মলম দেবার চেষ্টা করেন। বাবা জোর করে একদিন ওকে বাইরে বের করে আনেন, মাঝে মাঝেই ও রাজি না হলেও আত্মীয়-স্বজন বন্ধু বান্ধবদের ডেকে এনে ওর সঙ্গে দেখা করান। ওর প্রিয় সব জিনিস কিনে আনেন, আগডুম বাগডুম গল্প করতে থাকেন,এমনকি ছোট্ট মনে করে একটা নতুন ক্যারামবোর্ড পর্যন্ত।     অঞ্জন সত্যিই ধীরে ধীরে কাটিয়ে ওঠে সেই অবসাদ। বাবা-মার সেই ঘিরে থাকা, আঁকড়ে থাকা ,পাশে থাকা আর চোখে চোখে একটাই কথা চব্বিশ ঘন্টা ধরে মুখে না বলেও বুঝিয়ে যাওয়া, "সব ঠিক হয়ে যাবে ।" তিন মাস পরে অঞ্জন চাকরি রিজয়েন করে।     এদিকে সুপ্রতিমবাবুর বয়স হচ্ছে, রেবাগিন্নিরও আজকাল কি একটা হয়েছে, একটুতেই দুর্বল হয়ে পড়ে,চোখের তলায় কালি পড়েছে ।ওদের শরীরে বয়স থাবা দিয়েছে বুঝতে পারে অঞ্জন, একটা অজানা ভয় এসে গ্রাস করে ওকে ।বাবা মাকে ছাড়া ও কি করে পারবে? কি করে বাঁচবে ?বাবা-মাও সেটা বুঝতে পারে ,অঞ্জনের বিয়ের তোড়জোড় শুরু হয় ।       এটা আর পাঁচটা সাধারণ মানুষেরই গল্প। বড় হয়ে ওঠার গল্প। আমাদের প্রত্যেকেরই জীবনের গল্প ।বাবা-মা-সন্তানের বাঁধন যুগে যুগে ,দেশে দেশে একইরকম ।কিন্তু জীবনের থেকে কিছুই বড় নয়, জীবন মানুষকে অনেক কিছু শিখিয়ে দেয়, মনের গঠন তৈরি করে দেয়, বোধ তৈরি করে দেয়। ছোট্ট শিশু ধীরে ধীরে ভবিষ্যতের  পিতায় পরিণত হয়।          কয়েক বছর পরের কথা।অঞ্জনের বিয়ে হয়ে গেছে, মেয়েও হয়েছে, অরুনিমা ।ওদের এখন সুখের সংসার। সুপ্রতিম- রেবা  যে শুধু ,অঞ্জনের বাবা মাই নন, ওর বৌ মৌসুমিকেও ওরা আঁকড়ে ধরেছেন, নিজের মেয়ের মত ভালবাসেন। আর অরুনিমা তো ওদের চোখের মনি। অঞ্জন-মৌসুমী অফিস বেরিয়ে গেলে ওরাই অরুনিমার সবচেয়ে কাছের এবং প্রিয় সঙ্গী, খেলার সাথী ।       হঠাৎই ঘটল ঘটনাটা।সামান্য কয়েকটা ব্লাড টেস্ট করাতে গিয়ে ব্যাপারটা যে এই দিকে ঘুরে যাবে, কেউ ভাবতেও পারেনি।অঞ্জনের মার ক্যান্সার ধরা পড়ে।সুপ্রতিমবাবু একেবারে ভেঙে পড়লেন। এতদিন বোঝা যেত না, এখন বোঝা গেল, ওনার নিজের শরীরেও ভেতরে ভেতরে অনেক অসুখ বাসা বেঁধেছিল। শুধু স্ত্রী-পুত্র-বৌমা আর নাতনিকে নিয়ে আনন্দে সংসারটা বয়ে যেত বলে কিছু বোঝা যেত না,বোঝার দরকার পড়েনি।শুধু অবিচল বটগাছের মত দাঁড়িয়েছিলেন ।এবার রেবার ক্যান্সার ধরা পড়ায় সংসারটা আবার যেন ছারখার হয়ে গেল। নার্সিংহোমের বিছানায় রেবা যেন মিশে গেছেন,সুপ্রতিমবাবু বাইরে বেঞ্চে সবসময় বসে থাকেন, কেবিনে ঢুকতে চান না। রেবা ডাকলেও না, অঞ্জন ডাকলেও না। সেদিন প্রথম  কেমো হবে, অঞ্জন ঘুমন্ত মার কপালে একটা ছোট্ট চুমু দিতে দেখল, মার চোখের কোণে জমে থাকা একটা জলের ফোঁটা গড়িয়ে পড়লো গাল বেয়ে।যেন ওর চুমুটুকুরই অপেক্ষা করছিল। ধীরে ধীরে বাইরে বেরিয়ে এল অঞ্জন। মাকে নিয়ে যাচ্ছে ডক্টর-সিস্টাররা ট্রলি করে। অঞ্জনের যেন হঠাৎ কি একটা হল, কোথা থেকে যে ও মনে এত বল পেল কে জানে? কিভাবে যেন ওর বয়সটা অনেক বেড়ে গেল ।ও বুঝলো এবার ওকেই হাল ধরতে হবে, কাউকে না কাউকে তো সংসারে বটবৃক্ষ হতেই হয়।        কেবিনের বাইরে সুপ্রতিম বাবু বসে আছেন ,কিছু কথা বলেন না, এমনি বসে থাকেন।এই কদিনে ওনাকে আরও বৃদ্ধ লাগে। অঞ্জন এসে বাবাকে ধরে তুলল, কাঁধে বন্ধুর মতো হাত রেখে শরীরে পুত্রের স্নেহস্পর্শে, অস্ফুটে ডেকে উঠল "বাবা,ওঠ,সব ঠিক হয়ে যাবে।" সেই ডাকে কি মায়া ছিল ,কি টান ছিল,কি ভালোবাসা ছিল কেউ জানে না। অঞ্জন আজ পুত্র নয়, যেন বাবা হয়ে উঠেছে। সুপ্রতিমবাবু অবাক হয়ে চোখ তুলে তাকালেন ।অঞ্জন দেখল, বাবা নয় এ যেন তার সন্তান, একে আগলে রাখতে হবে, মাকে আগলে রাখতে হবে ।অঞ্জনের সেই পরম মমতার আলিঙ্গনে সুপ্রতিম বাবুর চোখে ভেসে উঠল, একটা ছবি। একটা বাচ্চা ছেলে খেলতে খেলতে সিঁড়ি দিয়ে পড়ে গেছে ,প্রচন্ড যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে নার্সিংহোমের বেডে পড়ে রয়েছে, আর কে যেন সমানে বলে চলেছে "চিন্তা করিস না, সব ঠিক হয়ে যাবে,সব ঠিক হয়ে যাবে।“