13 May 2019

আমার রবিঠাকুর

এখনও সেভাবে রবীন্দ্রনাথ পড়িনি, বুঝিওনি। রবিঠাকুর মানে তো শুধু কবিতা, গান, গল্প বা নাটকই নয় - রবিঠাকুর আমাদের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন পরতে পরতে। জীবনের ওঠাপড়া, বড় হয়ে ওঠা, সুখ-দুঃখ সবেতেই রবিঠাকুর ওতপ্রোতভাবে মিশে আছেন। মনে হয়, এ যেন একটা গোটা জাতির চিরকালের বন্ধন, অন্তরের পরিচয়, কৃষ্টি ও সংস্কৃতি ।               মনে পড়ে ছোটবেলায় রেডিওতে ভেসে আসা রবীন্দ্রসঙ্গীত কানে ঢুকে, মর্মে পৌঁছে যেত, এমনই ছিল তার যাদু। একটু বড় হয়ে স্কুলে 'সহজ পাঠ' বইয়ে রবীন্দ্রনাথকে প্রথম পেলাম । তারপর  নানা  ছড়া, কবিতা দিয়ে মানুষটার সঙ্গে যাত্রা শুরু হল। বিভিন্ন গল্প, গান, নাটক, চিঠিপত্র ইত্যাদি দিয়ে আরো গভীরে প্রবেশ করলাম । বাবারই অফিসে আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় আবৃত্তি করলাম 'দামোদর শেঠ'। তখন আমার বয়স ছয় কি সাত। প্রথম হলাম। বাবা শিখিয়ে দিয়েছিলেন প্রয়োজনীয় মডুলেশনগুলো। পুরস্কার হিসেবে পেলাম রবীন্দ্রনাথের  প্লাস্টার অফ প্যারিসের ফ্রেমে বাঁধানো, হলুদ সেলোফেনে মোড়া পূর্ণাবয়ব ছবি। সেই পুরস্কার এখনও যত্ন করে তুলে রাখা আছে।              বাবার একটা সঞ্চয়িতা ছিল, মাঝে মাঝে পড়তাম, বাবা নিজেও পড়ে শোনাতেন। কখনও শীতের দুপুরের মিঠে রোদে, ছাদে বসে আলগা সময়গুলোয় বাবা-মা আর আমার সাথে থাকত রেডিও। কত অনুষ্ঠান, কত গান, কত নাটক । সন্ধ্যাবেলায় প্রায়ই লোডশেডিং হয়ে যেত, বাবা সেই বুশ ব্যারন রেডিওটা চালাতেন । লম্ফ বা হ্যারিকেনের আবছা আলোয় আমাদের তিনজনের ছায়া দেওয়ালে নড়েচড়ে উঠত আর রেডিওতে বাজত রবীন্দ্রনাথ । বাবা বুঝিয়ে দিতেন গানের এক একটা কথার মানে। তখন শিশুমনে সব বুঝতাম কিনা জানিনা, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ বোধহয় সেই শিশুকাল থেকেই আমাদের জীবনের এক অপরিহার্য অংশ  হয়ে গিয়েছিলেন । আজ পয়তাল্লিশ বছর বয়সে যখন রবীন্দ্রনাথের গান বা কবিতার এক একটা লাইন জীবনের পরম দুঃখ , আনন্দ বা অনুভবে স্রোতের মতো গলায় নেমে আসে, তার অর্থ জীবন দিয়ে বোধগম্য হতে থাকে, হৃদয়ের  গভীরে ঢুকে যেতে থাকে আর চোখ ভিজে যায় ; সেই মহানুভব, সেই দার্শনিকতা, সেই ব্যাপ্তি আর জীবনবোধ যখন ঘিরে ধরে, তখন বুঝতে পারি, ছোটবেলার সেই অনুভূতি কতটা সঠিক ছিল। মানুষের জীবনের শিশুকাল থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মনেপ্রাণে, রন্ধ্রে রন্ধ্রে এই  আমার রবীন্দ্রনাথ।            স্কুলে আমার পাশে বসত প্রিয় বন্ধু সব্যসাচী। খুব মেধাবী আর রবীন্দ্রনাথের অন্ধ ভক্ত। কত শিখতাম দুজনে মিলে। স্কুলের কয়েকজন স্যার আপামর রবীন্দ্র অনুরাগী ছিলেন- অমলদা , দীনেশদা , সাধনদা। আমাদের জুড়ে দিতেন সেই রবীন্দ্র ফল্গুধারার সঙ্গে। বাংলা মিডিয়ামে পড়তাম তাও আবার রামকৃষ্ণ মিশনের মত স্কুলে, সেজন্য আমি ভাগ্যবান। রবীন্দ্রনাথকে না হলে এভাবে জানতে পারতাম না। স্যারেরা পড়াতেন আর আমাদের সামনে সেই অজানা রবীন্দ্র জগতের একের পর এক দরজা খুলে যেত। ক্লাসের জানলা দিয়ে দূরের নারকেল গাছের সারির দোল খাওয়া দেখতাম, কেউ বকত না। নীচু ক্লাসে 'আব্দুল মাঝির গল্প', পরে হাইস্কুলে 'রামকানাইয়ের নির্বুদ্ধিতা', 'কাবুলিওয়ালা' গল্প; কবিতার মধ্যে 'দীনদান', 'নববর্ষা' স্যারেরা যখন পড়াতেন, আমি ঢুকে যেতাম সেই জগতে। তার মানে, তার ব্যঞ্জনা, গভীরতা, সেই বয়সে হয়ত পুরোপুরি বোধগম্য হত না, কিন্তু গভীরে কোথাও যেন  দাগ কেটে যেত, একটা জমি তৈরি হয়ে যেত। বাবা আবৃত্তি করতেন 'দুই বিঘা জমি' বা 'পুরাতন ভৃত্য'। দেখতাম বাবার চোখে জল । বাবা বুঝিয়ে দিতেন লেখার গভীর অনুভূতির জায়গাগুলো। তখনই হয়ত ভাবতাম, একদিন রবীন্দ্রনাথ পড়ব, বুঝব। বাবা বলতেন "দেখবি সব কিছুতেই রবীন্দ্রনাথ জড়িয়ে আছেন"।              বাবার অসংখ্য বই ছিল, রবিঠাকুরের ওপর নানা বই- প্রবন্ধের। সেসব অতটা না টানলেও গল্পগুচ্ছ খুব টানল, আর গান। শুরু হলো গুনগুন করে গান গাওয়া, তারপরে গান শেখা। একদিন সেই সময়েই হাতে এল প্রথম প্রেমপত্র । তাতেও রবীন্দ্রনাথ। দুটি লাইন "আমার সকল রসের ধারা, তোমাতে আজি হোক না হারা।" তারপর "তোমারেই যেন ভালবাসিয়াছি শত রূপে শতবার, জনমে জনমে যুগে যুগে অনিবার ।" প্রেম তো হল, বড়ও হলাম। রবীন্দ্রগান আর কবিতায় নিজের বিভিন্ন চেতনাকে খুঁজে পেতে লাগলাম ধীরে ধীরে। বাবা লেখালেখি করতেন। বলতেন, "লিখতে গেলে রবীন্দ্রনাথকে এড়ানো অসম্ভব। ঠিক কোথাও না কোথাও ওনার প্রভাব এসে পড়বেই। নতুন কিছু লিখতে গেলেও দেখি, যাই লিখতে যাই তিনি আগেভাগেই তা অনেক সুন্দর করে লিখে বসে আছেন।" মেঘ ডাকলে আকাশ কালো করে বিদ্যুতের চমক দেখা গেলে, বাবা গুন গুন করে গাইতেন " গগনে  গরজে মেঘ, ঘন বরষা " বা "ঐ আসে ঐ অতি ভৈরব হরষে, জলসিঞ্চিত ক্ষিতিসৌরভরভসে, ঘনগৌরবে নবযৌবনা বরষা, শ্যামগম্ভীর সরসা "। বুঝতাম বাঙালীর সুখে-দুঃখে যে গান, সেই গান, সেই প্রাণের কথা, মনের কথা এইতো আমি পেয়ে গেছি। আমার চাই'ই রবীন্দ্রনাথ। যেমন না চাইতেও, উনি এসে পড়েন বাঙালীর অনুভবে। বাবা বলতেন, "যে বাড়িতে রবীন্দ্রনাথ আর বিদ্যাসাগরের ছবি দেয়ালে ঝোলানো থাকে না, তারা মানুষ নয়।"                   তারপর শুরু হল ক্যাসেট কেনা। রবীন্দ্রসঙ্গীতের ক্যাসেট কিনতাম কম। আধুনিক, হিন্দি গানের সুর ঝংকার টানত বেশী। বাবার কাছে বকুনি খেতাম। তবু বয়সটা ছিল কম, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে যোগসূত্রটা আলগা হতে বসেছিল। বয়সের উত্তাপে তখন ভাল লাগত মান্না দে, হেমন্ত, কিশোরকুমার, ম্যাডোনা। পাগল পাগল অবস্থা ।            হঠাৎ আমার প্রিয় বন্ধু বিশ্বজিৎ আমাকে দিল 'শেষের কবিতা ' শ্রুতিনাটক। শুনতে শুনতে অন্য রবীন্দ্রনাথকে আবারও খুঁজে পেলাম, বুঝলাম বাবা ঠিকই বলেছেন। রবীন্দ্রনাথ ছাড়া উপায় নেই। 'শেষের কবিতা'য় সৌমিত্রর সেই 'নির্ঝরিণী' আবৃত্তি, আমার জীবনের প্রতিদিনকার অংশ হয়ে গেল। খাতায় লিখে রাখতাম প্রিয় সব কবিতা, আবৃত্তি করতে চেষ্টা করতাম। ফ্যান হয়ে গেলাম জগন্নাথ- উর্মিমালার। কিনলাম 'রবিবার', 'শেষ চিঠি' শ্রুতিনাটক। আবার চমক, আবার রবীন্দ্রমোহ, উনি যে কত আধুনিক, সেদিন বুঝলাম। আমার জীবনে, মননে আবার জড়িয়ে গেলেন রবীন্দ্রনাথ। গানের  বা কবিতার এক একটা লাইন শুনে এক এক সময় খুব কষ্ট হত, ভীষণ কষ্ট । গলায় আটকে থাকত সেই কষ্ট । চোখের জল হয়ে তা কখনও বা নেমে আসত, আর তার সঙ্গে সেই সমগ্র অনুভূতিগুলোকে নিয়ে জড়িয়ে থাকতেন রবীন্দ্রনাথ। সেই সময়েই আমার কবিতা লেখার শুরু। খাতাগুলো ভরে উঠত নানা কবিতায়, ছড়ায়। সচেতন ভাবে চাইতাম সেসব যেন হয় রবীন্দ্র প্রভাবমুক্ত। কিন্তু ধীরে ধীরে বুঝলাম গভীরতা ও দার্শনিকতায় সেসব কথা রবীন্দ্রনাথ সত্যিই আগে বলে গেছেন। আরও সুন্দর করে বলে গেছেন। আমি দেখলাম, বাবার কথাই সত্যি।      এদিকে তখন গানও শিখছি, বেশ গাইতে পারি রবীন্দ্রসঙ্গীত। কারণে অকারণে আমার গলায় উঠে আসত সেই সব গান আর তার মানেটাও বোঝার চেষ্টা করতাম। তবে কিছু গান, বেশ মেয়েলি লাগত। ভাবতাম এরকম কেন ? পরে বুঝেছিলাম তার গভীরতা, তার দার্শনিকতা। সবার সব অনুভূতির একাত্মীকরণের নামই রবীন্দ্রনাথ। একই গানের, ভিন্ন পরিবেশে ভিন্ন অর্থ হৃদয়ঙ্গম হয়, দেখে  অবাক হয়ে যেতাম। মনে হত পুরোপুরি রবীন্দ্রনাথ বুঝতে, বোধহয় আরও কয়েকবার জন্ম নিতে হবে।            বিশ্বজিৎ এবার আমাকে দিল, তার এক দাদুর ছোট্ট একটা ডায়েরি, যাতে প্রতি পাতায় মুক্তোর মত অক্ষরে উনি লিখে গেছেন এক একটা কোটেশন। পাতায় পাতায় শুধু রবীন্দ্রনাথের গান বা কবিতার থেকে নেওয়া কয়েকটি করে লাইন। সে যেন আমার কাছে এক মহা মূল্যবান রত্ন হয়ে দাঁড়াল, তাকে নিয়েই কাটত দিনগুলো। নিজেও এক ডায়েরিতে লিখতে শুরু করলাম বিভিন্ন গান বা কবিতার ভালোলাগা সব লাইন । এভাবেই মরমে মরমে গেঁথে যেতে লাগলেন রবীন্দ্রনাথ।           তারপর বড় হয়েছি , কেরিয়ারের লড়াই চলছে,গান শোনাও গেছে কমে। রাস্তাঘাটে রবীন্দ্র সঙ্গীত কানে এসে পড়লে শুধু থমকে দাঁড়ায় পা। কই, হিন্দি গান শুনে কখনো তো এমন হত না? বুঝলাম, বাবা কেন মার মার করতেন চটুল গান শুনতে দেখলেই। সেদিন থেকেই আবার নতুন করে রবীন্দ্রনাথ পড়তে, রবীন্দ্রনাথকে জানা শুরু হল। আমি ঘুরে এলাম জোড়াসাঁকো আর শান্তিনিকিতন থেকে। মনে আছে, সেবার শান্তিনিকেতনের একটা গাছের নীচে, ভাঙা ইঁটের পাঁজায়, নিঝুম দুপুরে বসে থাকতে থাকতে আমি যেন এক অদ্ভুত ঘোরের জগতে চলে গেলাম। মনে হল, আমি যেখানে বসে আছি, কতদিন আগে রবীন্দ্রনাথ নিজেও বোধ করি এখানেই বসে থাকতেন, ক্লাস নিতেন, কবিতা লিখতেন। আমার জন্য কি কবির ঐটুকু ছোঁয়া এখনও বেঁচে আছে? কেউ যা জানে না, পায় না, কবির সঙ্গে সেই যোগাযোগটুকু এখানেই করে ফেলতে পারলাম? উনি কি জানলেন, আমি এসেছিলাম, কবির কথা ভেবেছিলাম, নিবিড়ভাবে তাঁর লেখা ভালবেসেছিলাম। এমনও কি হতে পারে না? তিনি তো আছেন।            রবীন্দ্র মিউজিয়ামে ঢুকে রবিঠাকুরের জীবন নিয়ে, কর্ম নিয়ে, পৃথিবীব্যাপী তার প্রভাব দেখে, আমার চোখ খুলে গেল। ওনার আঁকা ছবি, চিঠিপত্র এসব দেখে  মন ভরে গেল। একটা মানুষ, একটাই জীবনে এত কিছু করেছেন! কি দানবিক! বাবা সারাজীবনে যা পারেননি, আমি তা করে ফেললাম। সব জমানো টাকাগুলো দিয়ে কিনে ফেললাম সমগ্র রবীন্দ্র রচনাবলী। আর সেই সময়েই হঠাৎ অনেক দূরে চলে গেল, বিশ্বজিৎ। এই অল্প বয়সেই আমাকে একা ফেলে রেখে, সে চলে গেল না ফেরার দেশে। মেনে নিতে পারিনি ঘটনাটা, শুধু রয়ে গেল ওর চিঠিগুলো আর একসঙ্গে বড় হয়ে ওঠার অসংখ্য সব স্মৃতি, অসংখ্য ভাগ করে নেওয়া অনুভূতিগুলো। আর অবশ্যই রবীন্দ্রনাথ, যে রবীন্দ্রনাথকে সে আমায় চিনিয়েছিল। "তুমি রবে নীরবে, হৃদয়ে মম" গাইতে গেলে তাই আজও চোখে জল আসে।       রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে আমার ব্যক্তিগত অনুভূতির কোন শেষ নেই। আজও মনে পড়ে, সেদিন বিকেল, আমার প্রেম ভেঙে গেছে । শেষমেশ দেখা করে সব চিঠিচাপাঠি ফিরিয়ে দেবার দিন। দেখতে পেলাম হলদে শাড়ি পড়ে সে আসছে, চোখ মুখ অন্যরকম। অনেক কেঁদেছিল নাকি? সে এগিয়ে আসছে, বুকের কাছে ধরা আমারই উপহার দেওয়া 'শেষের কবিতা' বইটা। সে বলল, "মানুষটাই যখন চলে গেছে, তখন আর উপহারগুলো রেখে কি লাভ ?এই নাও, সব ফিরিয়ে দিলাম।" শেষের কবিতা বইয়ের প্রথম পাতায় আমারই লেখা কবিতার ধৃষ্টতা, ভেতরে অসংখ্য হাত চিঠি। সব কি ফিরিয়ে দেওয়া যায়? শেষ প্রেমিকা বাস ধরে চলে গেল। আমার হাতে থেকে গেল "শেষের কবিতা"। সেদিন সেই মুহূর্তে আমার গলায় নয়, মনে ভেসে আসছিল একটাই গান, “তবু মনে রেখো, যদি দূরে যাই চলে“। তারপর থেকে আজ অবধি যখনই গানটা গুনগুন করে গাই, আমার চোখে ভেসে ওঠে এক ধূসর বিকেলবেলা। জীবনের সবচেয়ে দামী সঞ্চয় অক্লেশে ফিরিয়ে দিয়ে, নিঃস্ব হয়ে বাসে চেপে চলে যাচ্ছে একটি মেয়ে, যে আর কখনও ফিরে আসতে পারবে না সেই ছেলেটার কাছে, যার চেয়ে বেশী ভাল কেউ কখনও বাসেনি তাকে।

No comments:

Post a Comment