31 August 2019

বাপ্পা আর ভোরবেলার কাক

সেদিন কাকভোরেই ছাদে উঠেছিল বাপ্পা। ক'দিন ধরে এত গরম পড়েছে, যে ভোর হতে না হতেই ঘুম ভেঙে যাচ্ছে। তারপর আর শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করে না। এখন স্কুলে গরমের ছুটি, তাই সকালটা একটু ধীরেসুস্থে কাটাতে পারে বাপ্পা। নইলে এখন তো বাড়িতে হুড়োহুড়ি পড়ে যাবার সময়। দাঁত মেজে, চোঁ চোঁ করে হরলিক্স খেয়ে, জামা-প্যান্ট- জুতো-মোজা ঝটপট পরে নিয়ে, ব্যাগ-জলের বোতল-টিফিন নিয়ে ছুটেমুটে স্কুলের বাস ধরতে ছুটতে হয়। আর তার সঙ্গে রয়েছে মার সমানে তাড়া লাগানো। সেসব থেকে এখন ক'দিন মুক্তি, হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে বাপ্পা। কিন্তু অভ্যাস যাবে কোথায়? সেই সাতসকালেই উঠে পড়ছে ঘুম থেকে। কিন্তু এ সময় বাড়ির বাকি সকলের ঘুম ভাঙানো বা বিরক্ত করা মানা, বেদম বকুনি জুটবে। তাই ব্রাশে টুথপেস্ট লাগিয়ে, বাপ্পা সোজা ছাদে উঠে যায়। এটাই বাড়ির মধ্যে ওর সবচেয়ে পছন্দের জায়গা, ঠান্ডা হাওয়ায় শরীরটা জুড়িয়ে যায় এসময়। সেদিন সকালে ছাদে উঠে দেখে তুলকালাম কান্ড। দুটো কাকের বাচ্চা ছাদের পাঁচিলে বসে খুব মারামারি লাগিয়েছে। তারস্বরে 'কা' 'কা' করে ডেকে, ডানা ঝাপটিয়ে, পা দিয়ে লাথালাথি করে সে কি হুটোপুটি। দরজার চৌকাঠে বসে তাই দেখে বাপ্পা। কিছুক্ষণ পরে মারপিটটা অবশেষে থামে ,আর সবটুকু পেস্ট গিলে ,সাদা ব্রাশ নিয়ে নীচে নেমে আসে বাপ্পা ।সত্যি, কাকগুলো যা ঝগড়ুটে, বলার নয়। কেন যে ওদের এত মারপিট লাগে কে জানে? তবে কাকেদের নিয়ে চিন্তা করার আর অবকাশ পাওয়া যায় না, বাবা মুড়ি-বিস্কুট খেয়ে পড়তে বসার হুকুম করেন। কিন্তু পড়তে বসেও ওর মন ছুটে যায় এদিক-ওদিক। কোথায় পিঁপড়েরা লাইন দিয়ে চলেছে, টিকটিকিটা ঘুলঘুলি থেকে মুখ বাড়াচ্ছে, জানলার বাইরে আমগাছটার পাতাগুলো দুলছে, দূরে নীল আকাশে সাদা মেঘ ভেসে চলেছে-এখনই যেন ভারতবর্ষের ম্যাপ হয়ে যাবে, এসবই দেখে। ওদিকে শুনতে পায় পাশের বাড়ির মৌদি হারমোনিয়াম নিয়ে গলা সাধছে, সাধনকাকু অ্যা অ্যা করে জিভ ছুলছে, গলিতে পাঁউরুটিওলা হেঁকে যাচ্ছে, নীচে রাস্তার কলে বালতি পাতার শব্দও পাওয়া যায়। হঠাৎ কোত্থেকে একটা বাচ্চা কাক উড়ে এসে জানলার পাশটাতে বসল। সেই কাকটা নাকি! সেই যে ছাদে যেটা খুব ঝগড়া করছিল! অবশ্য সব কাকই দেখতে একইরকম লাগে, শুধু দাঁড়কাকগুলোকে একটু আলাদা করে চেনা যায়। অবশ্য দাঁড়কাক আর আসে কই এ তল্লাটে! চারদিকে শুধু এই পাজি আর চোর কাকগুলোর দৌরাত্ম্য। হঠাৎ কাকটা একবার 'কঃ' করে অদ্ভুত স্বরে ডাকল। কি বলতে চাইছে ও? কাকটা বসে বসে, একবার বুকে মাথা গুঁজছিল আর একবার বাপ্পার দিকে তাকাচ্ছিল। যেন বলছিল, "সরি ভাই, সকালে রাগের মাথায় একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলেছি, ক্ষমা করে দাও এবারের মত।" কিন্তু তখনই বাপ্পার ভাবনার সুতো ছিঁড়ে গেল। "কি পড়ছ বাপ্পা, শব্দ পাচ্ছি না কেন?" বলে বাবার হাঁক শুনেই ও প্রকৃতিবিজ্ঞান চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে পড়তে শুরু করে দিল। কয়েকদিন পরের কথা, বাপ্পার সেদিন মনটা খুবই খারাপ। একে তো দুদিন পর পর বৃষ্টি হয়ে, আকাশ এখনও গোমড়া মুখ করে আছে, তার ওপর জমা জলে লাফালাফি করে পা ভেজানোর জন্য মার একচোট বকুনিও শুনতে হয়েছে। ওদিকে আবার ছাদে জল সোক করে, ঘরে জল পড়া নিয়ে মা আর বাবার মধ্যে একপ্রস্থ ঝগড়াও শুরু হয়ে গেছে। বাবা-মার ঝগড়া হলে বাপ্পার খুবই মন খারাপ লাগে। কে ঠিক আর কে ভুল ও ঠিক করতে পারে না,মনে হয় দুজনেই ভুল। তখন ওর নিজেকে খুব একা মনে হয়। মনে হয়, বাবা-মা এরকম তুচ্ছ কারণে এত ঝগড়া করে কেন? তার চেয়ে চুপচাপ সব শুনে গিয়ে বিজ্ঞের মত ঘাড় নাড়তে পারে না? ক্লাসে ও যেমন করে। তাহলেই তো মিটে যায়! তবে মন খারাপটা বেশিক্ষণ থাকে না ,পাড়ার বন্ধুরা সব হৈ হৈ করে খেলতে আসে। তাদের সঙ্গে একতলায় ক্যারাম ,টেবিল টেনিস খেলা নিয়ে মেতে যায় ও। হঠাৎ বাবার ডাক আসে, এক্ষুনি বাজারে যেতে হবে কিসব কিনতে আর ছাদ সারানোর মিস্ত্রিরও খোঁজ করতে হবে। কি আর করা! অনিচ্ছা সত্বেও বন্ধুদের বিদায় দিয়ে বাবার সঙ্গে রাস্তায় বেরোতেই হল। হাঁটতে হাঁটতে কিছুদূর যাবার পর বাজারের ঠিক মুখেই, হঠাৎ একটা ভিখিরি হাত পাততে, বাবা ভিক্ষে না দিয়েই চলে গেল। বাবার সঙ্গে রাস্তায় বেরোনোটা নতুন নয়, আর বাবারও ভিখিরিদের পয়সা না দেওয়াটাই স্বভাব। কিন্তু এই ভিখিরিটা যেন একটু অন্যরকম, একটা ওরই বয়সী ছেলে, খালি পায়ে, খালি গায়ে সাদা কাপড়ের থান পরে, ভিক্ষে চাইছিল। বলছিল ওর বাবা নাকি মারা গেছে, কিছু সাহায্য করতে। বাবা তো সেসব পাত্তাই দিল না, ছেলেটার পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেল, তারপর বাপ্পাকে বলতে লাগল, "এসব ফলস্ , জানিস তো। ওর বাবা মারা গেছে না ছাই, পয়সা পাওয়ার জন্য এসব ওদের নিত্যনতুন কায়দা, একদম বিশ্বাস করবি না ।" কিন্তু বাপ্পার কেমন যেন লাগল , ও জানে ভারতবর্ষে গরিবের সংখ্যা কত বেশি, কি তাদের কষ্ট। তাদের সবাই কি এমন অভিনয় করে? বাপ্পার বারবার মনে হচ্ছিল, আহা রে, এই ছেলেটা সত্যিই খুব গরিব ছিল আর সত্যিই ওর বাবা মারা গেছে। ওর টাকার নিশ্চয়ই খুব দরকার, সবার ওকে সাহায্য করা উচিত ছিল। কিন্তু এখন কি হবে, সবাই যদি ওকে এরকম ভুয়োভিখিরি ভাবে আর ভিক্ষে না দেয়! ও কি তাহলে একটাও টাকা পাবেনা! বাবার ওপরও বাপ্পার খুব রাগ হয়। মনে পড়ে, বাবা ভিখিরিদের সম্পর্কে বলেছিল, "এত লাখ লাখ ভিখিরি রোজ রোজ ভিক্ষে চাইলে কি আর দেওয়া যায় রে! তাই, ভিখিরি দেখলেই মাথায় হাতটা ঠেকিয়ে, নমস্কার করে চলে যাই। মানে হল, মাফ কর বাবা, আমি দিতে পারব না। অথচ দিচ্ছি না বলে তুমি কিছু মনেও করতে পারবে না। ওই যে কপালে হাতটা ঠেকালুম, ওটাই রীতি।" বাপ্পাকে অবশ্য কখনো এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হয়নি। ওর থেকে সাধারণত কেউ ভিক্ষে চায় না। শুধু একবার দল বেঁধে সব বন্ধুরা স্কুল থেকে ফেরার সময়, রাস্তার মধ্যে একটা বুড়ো ভিখিরি ভিক্ষে চেয়েছিল। বাপ্পার কেমন একটা লজ্জা করেছিল, ওর কাছে একটাও টাকা না থাকায়। যা সামান্য টাকা থাকে, সেদিনই সব খরচা করে ফেলেছে টিফিনে আইসক্রিম খেতে গিয়ে। তাছাড়া রোজ মা'ই তো ওকে নিতে আসে স্কুল থেকে, শুধু সেদিন তাড়াতাড়ি ছুটি হয়েছিল বলেই, বন্ধুরা মিলে একসঙ্গে বেরিয়ে পড়েছিল। ওর বেস্টফ্রেন্ড সাত্যকি ভিখিরিটাকে বলেছিল, " আমাদের কাছে টাকা নেই।" কিন্তু অজয় যখন পকেট থেকে পাঁচ টাকার একটা কয়েন বের করে বুড়ো ভিখিরিটার কাঁসিতে রেখে দিয়েছিল, ভিখিরিটা মাথায় হাত তুলে আশীর্বাদ করে বলেছিল, "রাজা হও বাবা,রাজা হও।" অজয়কে সেদিন এত ভাল লেগেছিল বাপ্পার, খানিকটা যেন শ্রদ্ধাও এসে গিয়েছিল। ঈষৎ ঝুঁকে পড়ে, একটা অ্যালুমিনিয়ামের বাটিতে কিছু চাল আর কটা কয়েন নিয়ে, বুড়োটার হেঁটে যাবার দৃশ্যটা আজও মনে পড়ে বাপ্পার। কিন্তু আজ? আজ এ কি হল! বারবারই ওর মনে হচ্ছিল সবাই ভুল করছে, সবাই ভুল বুঝছে ,বাবাও ভুল করল । বাবা ভাল করে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে দেখলই না, ওর সব কথাও শুনল না, তাহলেই বুঝতে পারত, ছেলেটার সত্যি কথাই বলছে। স্কুলের সামনের বুড়ো ভিখারিটা তো তবু কিছু পেয়েছিল, কিন্তু ছেলেটার হাতে তো কোন কাঁসি দেখেনি ,ও তো তবে কিছুই ভিক্ষে পায়নি! এসব ভাবতে ভাবতে বাবার সঙ্গে বাপ্পা একসময় বাড়ি এসে গেল । পরদিন ভোরবেলা, ঘুম ভেঙে গেল একদল কাকের চিৎকারে। তড়িঘড়ি করে ঘুম চোখেই ছাদে উঠে গেল বাপ্পা। দেখল ডিস এন্টেনা আর কেবলের তারে পা আটকে, একটা কাক খুব ছটফট করছে, কিছুতেই ছাড়াতে পারছে না। আর একদল কাক, তার জন্য খুব ব্যস্ত হয়ে 'কা' 'কা' করে ডাকছে আর ওড়াউড়ি করছে , কখনো মাথার ওপর উড়ছে, কখনো এন্টেনায় বসছে, আবার কখনো এধারে ওধারে উড়ে যাচ্ছে, এইসব চলছে। বাপ্পা আসতে ওকে দেখে কাকগুলোর চেঁচামেচি আরও যেন বেড়ে গেল, যেন বাপ্পাকে ওরা বলছে "একটু হেল্প কর, ভাই।" কিন্তু এখন সদর দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে, তড়িৎ কাকুদের বাড়ি যাওয়া যাবে না, বকুনি খেতে হবে। তারপর আবার মনে হচ্ছে, তড়িৎ কাকুরা বোধহয় আজ বাড়িতেই নেই। সুতরাং নিরুপায় হয়ে বাপ্পা ওদের কান্ড কারখানাই দেখতে লাগল। দেখে সঙ্গীকে বাঁচানোর জন্য কাকগুলোর কি ভীষণ উৎসাহ-উদ্দীপনা। তারের ওপর বসা দু'চারটে কাকের এলোমেলো ওড়াউড়ি আর পা আটকে যাওয়া কাকটার আপ্রাণ চেষ্টায়, ভীষণ ভাবে দুলতে লাগল তারগুলো। আর তাতেই একসময় কিভাবে যেন কাকটার পা-ও মুক্ত হয়ে গেল ঐ তারের ফাঁস থেকে। কাকটা মুক্তি পেয়ে ,খানিকটা উড়ে অন্য একটা বাড়ির পাঁচিলের ওপর বসে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। ধীরে ধীরে চেঁচামেচি,ওড়াউড়ি সব খানিকটা শান্ত হয়ে গেল। ওদিকে আরেক বিপদ, মা খুব রেগে গিয়ে নীচ থেকে চেঁচাচ্ছে। ভোরবেলা উঠেই দাঁত না মেজে, ছাদে উঠে গেছে বাপ্পা, আর এতক্ষণ সময় ফালতু নষ্ট করেছে বলে। মার গলাটা শুনতে ভাল লাগছে না, সিঁড়ি দিয়ে চটপট নেমে আসল ও। সেদিন টুথ ব্রাশে পেস্ট লাগাতে লাগাতে বাপ্পা ভাবছিল, আচ্ছা একটা কাক বিপদে পড়ায় বাকি সব কাক ছুটে সাহায্য করতে আসতে পারে, কিন্তু মানুষ বিপদে পড়লে লোকে একটা টাকা দিয়েও সাহায্য করতে চায় না কেন? দাঁত মাজতে গিয়ে বাপ্পার পেস্টটাকে কেমন যেন তেঁতো মনে হল। বাপ্পা তখনই ঠিক করল, ওর জমানো সব টাকাগুলো নিয়ে কাল আর একবার বাবার সঙ্গে বাজারে গিয়ে খুঁজে দেখবে, গরিব ছেলেটাকে পাওয়া যায় কিনা। ওর মন বলছিল, নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে।

No comments:

Post a Comment