14 October 2019

অন্য প্রেম

ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করতে না করতেই, ক্যাম্পাস ইন্টারভিউতে কুনাল চাকরি পেয়ে গেল জামশেদপুরে একটা বড় কোম্পানিতে। কলকাতার দামাল ছেলেটা, চোখের জল ফেলতে ফেলতে বিদায় দিল পুরনো শহর, পুরনো বন্ধু-বান্ধব- আত্মীয়স্বজন ,এমনকি পুরনো প্রেমিকাকে পর্যন্ত। চার ঘণ্টা জার্নি করে রোজ রোজ তো আর বাড়ি ফেরা যায় না, মাসে দু’মাসে ছুটিতে, এক আধবার বাড়ি আসতে পারে বটে ,কিন্তু সবার সঙ্গে আগের সেই যোগাযোগটা কমে গেল। প্রতিবার ছুটির শেষে ওকে যখন আবার জামশেদপুরে ফিরে যেতে হত, বুকটা যেন ফেটে যেত। চোখে জল এসে যেত কুনালের। কিন্তু সময় থেমে থাকে না। মানুষকেও সব পরিস্থিতিতে মানিয়ে চলতে হয়। জামশেদপুরে আস্তে আস্তে মন বসতে শুরু করল কুনালের, কিছু নতুন বন্ধুও হল, তবে সবই কলিগ স্থানীয়। বেশকিছু বাঙালির বাস এখানে, তাছাড়া স্থানীয় মানুষজনও খারাপ নয়। তাদেরকেই আত্মীয় করে নেওয়া ছাড়া আর উপায়ই বা কি? মাঝেমধ্যে এক এক দিন বিকেলে, তাদের সঙ্গে জুবিলি পার্ক বা দলমা পার্কে ঘুরে আসাটাই ছিল একমাত্র মনকে তাজা করার উপায়। ততদিনে শম্পার সঙ্গে সম্পর্কটাও কিছুটা হালকা হয়ে এসেছে, চোখের বাইরে মানে সত্যিই মনেরও বাইরে। দিনগুলো কাটছিল বড় একঘেয়ে। হঠাৎই একদিন বিকেলে, কুণালের মোবাইলে একটা ফোন এল, অচেনা নম্বর থেকে। একটা মেয়ের গলা, মেয়েটা কাকে যেন খুঁজছে। ফোনটা কাটতে গিয়েও, কুণালের মনে হল, আরে মেয়েটার গলাটা তো বেশ মিষ্টি , কেমন যেন মাদকতাময়। -হ্যালো কনিকা? -কে বলছেন? -আপনি কে বলছেন? -আমি কুনাল। - কুনাল! ও সরি। এটা কোথায়? - জামশেদপুর। -ও, আমি ভাবলাম বোধহয় কণিকার নাম্বার। -না না, রং নাম্বার। -ও, ভুল হয়ে গেছে। আচ্ছা, রাখছি। -না না, ঠিক আছে। আপনার নামটা জানতে পারি? -ঝিমলি। ফোনটা ছেড়ে দেয় কুনাল। কিন্তু ঝিমলিকে ভুলতে পারে না। বেশ সুন্দর গলাটা ওর, ভালো কথাও বলতে পারে । কেমন দেখতে কে জানে? শেষকালে রং নাম্বারের সূত্রেই রাইট পার্টনার পেয়ে গেল দুজনে। মাঝেমধ্যেই কথাবার্তা হতে লাগল ওদের মধ্যে। সম্পর্কটা ধীরে ধীরে জমে উঠতে শুরু করল। ঘন্টার পর ঘন্টা ফোন, কখনো বা মেসেজের পর মেসেজ। ফেসবুক , হোয়াটসঅ্যাপ কোনটাই অবশ্য ঝিমলির নেই, ও থাকে মুর্শিদাবাদের এক অখ্যাত গ্রাম ভৈরবটোলায়। কিন্তু কিভাবে যেন, দুজনে দুজনের দুর্নিবার আকর্ষনে বাঁধা পড়ে গেল। ক্রমশঃ কুনাল আর ঝিমলি একে অপরের মনের মানুষ হয়ে উঠল, মেড ফর ইচ আদার যাকে বলে আর কি। প্রতিদিন বেশ ক'বার ফোনে কথা না বললেই নয়, প্রাণটা যেন আকুলিবিকুলি করে। কুনাল একদিন ঝিমলিকে বলল,'শুধুই কি আমরা ফোনফ্রেন্ড? আমি তোমাকে দেখতে চাই, মিট করতে চাই, সামনাসামনি । 'কেন? এই তো বেশ চলছে। এখন আমার দেখা করার প্রবলেম আছে।', ঝিমলি ওকে দমিয়ে দেয়। 'কিসের প্রবলেম?’ ,কুনাল অধীর হয়ে বলে। -তুমি বুঝবে না, আমার বাড়িতে খুব কড়াকড়ি । তুমি দেখা করতে এসেছ জানলে, সর্বনাশ হবে। আমাকে আর তোমাকে ফোন করতেও দেবে না। -ঠিক আছে, সামনে দেখতে না পাই, একটা ছবি অন্ততঃ পাঠাও, প্লিজ।তোমাকে যে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। -হুঁ, কিন্তু কিভাবে পাঠাব? -কেন? ফেসবুক বা হোয়াটসঅ্যাপে! ইউজ করতে শুরু কর এবার, কতবার তো বললাম। -ধুর, আমার ফোনে ওসব হবেই না। আমারটা যে স্মার্টফোন নয়। -তো একটা স্মার্টফোন কিনে নাও না! -না গো, অত সোজা নয় ।বাবা আমাকে কিনেই দেবেনা । বাবার সামান্য রোজকার, মিলে চাকরি করে। এই ফোনটা কিনে দিয়েছে এই ঢের। -আরে বাবাকে বলেই দেখ না,নইলে টিউশনির পয়সা জমিয়ে জমিয়ে কেন। -দেখি, অত সহজ নয়, সময় লাগবে। আমার জমানো টাকাতেই তো প্রতি মাসে রিচার্জ করি, ওটাও বাবা দেয় না। আমার কাছে স্মার্টফোন স্বপ্নই! -ঠিক আছে, ঠিক আছে ,কিন্তু আমাকে তোমার একটা ছবি পাঠাতেই হবে, আমার চাইই। প্লিজ, না বোলো না। তোমার কোন বন্ধুর মোবাইল থেকে অন্তত পাঠাও। -আচ্ছা দেখছি, দাঁড়াও, পরে বলছি। এইভাবেই চলতে থাকে, ছবি আর পাঠানো হয় না। কুনাল ততদিনে ঝিমলির প্রেমে পাগল, ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে দুজনে কত প্রাণের-মনের কথা হয়।কুনাল বুঝতে পারে ,ঝিমলি ঠিক ওর মনের মত, যেমনটি ও চায়।এক দুর্নিবার আকর্ষণে, ঝিমলির পিছনে দেহমন ঢেলে দেয় কুনাল। ওর জীবন এখন ঝিমলিকে ঘিরেই, বাড়ি ফেরার তাগিদও এখন আর ততোটা অনুভব করে না ও। কুনাল একদিন ভাবল, মুর্শিদাবাদে চলে যাবে। ঝিমলিকে নিজের মাইনের টাকা থেকে একটা স্মার্টফোন কিনে দেবে। কিন্তু ঝিমলি বারণ করে, পরে আসতে বলে। বাড়িতে নাকি সমস্যা হবে। কুনাল তখন ঝিমলির প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে, ঝিমলিও। কুনাল বুঝতে পারে না, এত যদি ভালবাসা, ঝিমলির দেখা করতে বা ফটো পাঠাতে তাহলে এত আপত্তি কিসের! একদিন হঠাৎ একটা ঘটনা ঘটে। কুনাল সেদিন ওর মোবাইল নাম্বারটা রিচার্জ করতে ভুলে গেছে, ব্যালেন্স নেই, আউটগোইংও বন্ধ। ওখানে ও একটা লোকাল নাম্বার নিয়েছিল, সেটা থেকেই তখন ও ঝিমলিকে ফোন করে। ওদিকে একজন ফোন তোলে ,কিন্তু ঝিমলির গলা নয়, এ গলা পুরুষালী।কুনাল কথা বলতে, মুহুর্তেই সেই গলা আবার ঝিমলিতে পরিণত হয় ।কথাবার্তা সেদিন আর সেরকম জমেনা। কুনাল একটু সন্দেহগ্রস্ত হয়। ওর কয়েকজন বন্ধুর ,কয়েকটা অদ্ভুত অভিজ্ঞতার কথা ওর মনে পড়ে যায়। ওরা হিজড়ের প্রেমে পড়েছিল। মেয়ের গলা নকল করে ওরা ছেলেদের ফাঁসাত। আর ওর বন্ধুরাও, কতবার মেয়ে ভেবে আসলে সেই হিজড়েদের মোবাইল রিচার্জ করে দিয়েছে বা অনলাইনে কোন গিফট কিনে পাঠিয়েছে। এইভাবে প্রেমের ফাঁদে পড়ে , অনেক টাকা ক্ষুইয়ে ওরা শেষমেষ বোকা বনে গেছল। দেখা করতে যাবার জন্য জোর করতেই, সব সম্পর্ক ঐসব হিজড়েরা কেটে দিয়েছে। এসব মনে পড়ায়, কুনাল ঝিমলির ব্যাপারটা নিয়েও একটু দ্বিধাগ্রস্ত হয়। এরকম কোন ফাঁদে ও নিজেও পা দিয়ে ফেলল না তো! ঝিমলির গলাটা কেমন যেন ছেলেদের মতো লাগল, হিজড়ে নয়তো! অন্য নম্বর থেকে ফোন আসাতে কি ওর আসল সহজাত গলাটা বেরিয়ে এসেছিল? ছবিই বা পাঠায় না কেন, দেখাই বা করেনা কেন! পরের দিনই , সন্দেহগ্রস্ত হয়ে, কুনাল এইসব প্রশ্নে প্রশ্নে জেরবার করে দেয় ঝিমলিকে। -তোমার গলাটা কাল ওরকম লাগছিল কেন? -কেন? কি রকম? -কিরকম আবার? তোমার গলা তো মেয়েদের মতো নয়! -মানে? কি বলছ ! -ঠিকই বলছি। আমি স্পষ্ট শুনলাম ছেলেদের গলা। -ও ওটা? আসলে আমার না কাল শরীরটা খুব খারাপ ছিল। গলাটাও বসে গেছিল ঠান্ডা লেগে। -থাক, মিথ্যে কথা কেন বলছ? -আমি মিথ্যে কথা বলি! তুমি একথা বলতে পারলে! -হ্যাঁ, পারলাম। তুমি আমার সঙ্গে ভালবাসার খেলা খেলছ, আমাকে ঠকাচ্ছ। -কি যা তা বলছ তুমি? কি খেলা খেলেছি তোমার সঙ্গে? - তুমি জান না? তুমি মেয়ে নয়, হিজড়ে। আমি যা বোঝার সব বুঝে গেছি। -কি বুঝেছ? তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? -মোটেই না। তুমি কেন আমার সঙ্গে এরকম অভিনয় করছ? আমাকে ফাঁসাচ্ছ? -অভিনয়! কি করেছি তোমার সাথে? কোনদিন কিছু সুবিধা নিয়েছি কি? তাহলে কেন এসব কথা বলছ! -না, মানে.. -আমি তোমাকে ভালোবাসি কুনাল। -ভালোবাসা! থাক, আমার বোঝা হয়ে গেছে। - কি বুঝেছ, শুনি? ঝিমলি কেঁদে ওঠে। কুনাল রেগে ফোনটা কেটে দেয়। কিন্তু তারপরেই ও একটু দোনামোনায় পড়ে যায়। ঠিকই তো, বন্ধুদের শোনা গল্পের মতো ঝিমলি তো কোনদিন কুনালকে মোবাইল রিচার্জ করতে বা কোন গিফট পাঠাতে বলেনি। তাহলে? কিন্তু সন্দেহটা ওর মনে গেঁথে যায়। আরো ভালভাবে পরীক্ষা করার জন্য কুনাল এবার ওর বন্ধু অনুপের সাহায্য চায়। অনুপ মুর্শিদাবাদের জিয়াগঞ্জে থাকে, ঝিমলিদের গ্রামটাও চেনে। দুদিনেই খবর পেয়ে যায় কুনাল, যা সন্দেহ করেছিল, ঠিক তাই।ওর করা ফোনও, কোন ছেলেই তুলেছে। তাছাড়া অনুপ বলে, ‘ওই এলাকায় প্রচুর হিজড়ে থাকে, ওরা তো এসবই করে, তুই জানতিস না? তুইও শেষে ওদের পাল্লায় পড়লি?’, অনুপ ব্যঙ্গ করে। কুনাল ভেঙে পড়ে। ছি,ছি, কি না কি ভেবে এসেছে এতদিনের ফোনফ্রেন্ডকে। কত মনের কথা বলেছে, হৃদয় দিয়ে ফেলেছে শুধু ওই সুন্দর গলার মোহে। এত যাকে ভালবেসে ফেলেছে, সে হিজড়ে! ঝিমলিকে নিয়ে এত স্বপ্ন দেখেছিল, সব ভেঙে চুরমার হয়ে গেল! ঝিমলি মেয়ে নয়! রাগে, অপমানে নিজের চূড়ান্ত হয়রানিতে বোকা বনে গিয়ে, দিকবিদিক জ্ঞানশুন্য হয়ে আবারও আর একটা অন্য নাম্বার থেকে ঝিমলিকে ফোন করে কুনাল। দেখে, যা ভেবেছিল ঠিক তাই, পুরুষকন্ঠ। বেশ দু’চার কথার পরে, নিজের পরিচয় দিয়ে, নিজের আসল গলা চেনায় কুনাল।রেগে চিৎকার করে ওঠে। -ছিঃ, ঝিমলি। তুমি এরকম? -কেন গো কি হয়েছে? -কি হয়েছে জান না! তুমি মেয়ে সেজে আমাকে দিনের পর দিন বোকা বানিয়ে চলেছ? -আমি তোমাকে বোকা বানাচ্ছি! কোনদিনও নয় কুনাল। -থামো। তুমি এতদিন ধরে আমাকে নিয়ে খেলা করলে! আমার ভালবাসা নিয়ে মজা করলে !ছি ছি! -কি বলছ তুমি! আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। প্লিজ রাগ কোরো না। আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচব না কুনাল। -চুপ করো। আজ থেকে আমি আর তোমার সঙ্গে কোন সম্পর্ক রাখতে চাই না, সব সম্পর্ক শেষ। - প্লিজ সোনা, আমাকে ভুল বুঝোনা প্লিজ। আমাকে ছেড়ে যেও না, আমি মরে যাব। -দূর হয়ে যাও আমার জীবন থেকে, মিথ্যেবাদী! ইনিয়ে বিনিয়ে কাঁদতে থাকে ঝিমলি, আবার মেয়েলি গলায়। ওর কি দুটো সত্ত্বা আছে নাকি? নাকি পুরোটাই অভিনয়? ট্রান্সজেন্ডার সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানেনা কুনাল। শুধু ওদের ঘৃণা করতে হয়, সেইটুকু জানে। ও মেয়ে নয়, তাই কুনালের আকর্ষণের আর একটুও অবশিষ্ট থাকে না। শরীর যেখানে নেই, সেখানে মন আসে কি করে? কুনাল ফোনটা কেটে দেওয়ার পর, ঝিমলি পাগলের মত বিছানায় ঝাঁপিয়ে পড়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে।মেয়েলি কান্না,ওর শাড়ি অবিন্যস্ত হয়ে যায়। শাড়ির ভেতর ওর শরীর, সেটা পুরো মেয়েলি নয়। কিন্তু মন? সেটাতো মেয়েরই ছিল। আর সেই ভালবাসাতেও কোনো ফাঁকি ছিল না। মনের তো আর ট্রান্সজেন্ডার হয়না!

No comments:

Post a Comment