7 October 2019

তেরো তারিখ শুক্রবার

সৌরদীপের অফিস একটা প্রাচীন বিশাল সরকারি বাড়িতে।সবাই বলে ‘লালবাড়ি’। বাড়িটার  এখন সম্পূর্ণ রিনোভেশন চলছে। সবকিছু কালের যাত্রায় আজ জীর্ণ,ভঙ্গুর। তাই ভেঙেচুরে সারানোর সঙ্গে সঙ্গে, পুরনো ঐতিহ্যবাহী বাড়িটাকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচানোরও একটা চেষ্টা চলছে।এ এক বিশাল কর্মযজ্ঞ। বেশিরভাগ অফিসই অন্য বাড়িতে সরানো হয়ে গেছে, মাত্র কয়েকটা অফিস এখনো কোনরকমে টিমটিম করে চলছে। তার মধ্যে সৌরদীপদের এডুকেশন ডিপার্টমেন্টও আছে। চারিদিকে ঠকঠকাঠক ভয়ানক শব্দের মধ্যেই, কাজ করে চলেছে গুটিকয়েক মানুষ । অবশ্য সকলেই নতুন ঝাঁ চকচকে অফিসে শিফ্ট হবার দিন গুনছে। ক্যান্টিন,টি -স্টল  সবই প্রায় বন্ধ। বিশাল বাড়িটাকে এখন আর চেনাই দায় ,চারদিকে ভাঙা রাবিশ, কড়ি-বরগা-দরজা-জানলা, লোহার গ্রিল, পুরোনো ফার্নিচার ,নানা রকম জিনিসপত্র, হাবিজাবি সব ভর্তি।
 সেদিন একটু তাড়াতাড়িই বাড়ীর পথে পা বাড়িয়েছিল সৌরদীপ।কাল শনিবার ,পরশু রবি, পরপর দুদিন ছুটি। ভেবেছিল সুচেতাকে নিয়ে ঘুরে আসবে বর্ধমানে নিজেদের দেশের বাড়ি থেকে, দুদিনের জন্য। সবে বাড়ি ফিরে জুতোটা খুলে, ঘরে ঢুকেছে, অমনি ফোন। ওরই কলিগ তনু। ‘কিরে, কি হলো আবার?’, সৌরদীপের মনে শঙ্কা। আগে বেরিয়ে পড়েছে বলে বস আবার গাল পাড়ছে না তো! তনুর গলায় তখন উৎকণ্ঠা। ‘শোন, একটা ব্যাপার হয়ে গেছে ।সকাল থেকে সরখেলবাবুকে দেখেছিলি তুই?’ ‘না, মানে একবার মনে হচ্ছে দেখেছিলাম।কেন কি হয়েছে?’ ‘আরে সেটাই তো, আমিও তো দেখেছি সকালে, টয়লেটে যাবার  সময়।‘ ‘হ্যাঁ,তো কি হয়েছেটা কি,বলবি তো?’ সৌরদীপের গলায় উদ্বেগ। ‘আর বলিস না।সরখেলবাবুকে পাওয়া যাচ্ছে না।‘ ‘পাওয়া যাচ্ছে না! মানে?’ ‘মানে বলছি। তুই একবার এখনই অফিসে ফিরে আয়।‘ ‘কি?আবার এক ঘন্টা বাস জার্নি করে অফিস যাব! ইয়ার্কি পেয়েছিস?’ ‘ না রে,  কেসটা সিরিয়াস ।সবাই খুঁজছে, চলে আয় তাড়াতাড়ি’, বলে ফোনটা কেটে দেয় তনু।
সৌরদীপের মেজাজটা খিঁচড়ে যায়। কাল সকালে বর্ধমান যাবার বাস ধরার আছে। গোছাগুছি সব বাকি। এর মধ্যে আবার কি এক উটকো ঝামেলা হল! কিন্তু তনুর গলায় কিছু একটা ছিল, একটা অশুভ ইঙ্গিত ।মনটা কুডাক দিল সৌরদীপেরও। কি হল অফিসে,অদ্ভুত কান্ড! সরখেলবাবুকে  পাওয়া যাচ্ছে না কেন?কোথায় গেলেন অফিস থেকে! এই তো সামনের মাসেই ওনার রিটায়ারমেন্ট। নিপাট, অমায়িক ভদ্রলোক, সাতে-পাঁচে থাকেন না, পার্টি -পলিটিক্সের ধার ধারেন না, চাঁদাতে না বলেন না, চায়ের পয়সা বাকি রাখেন না, অযথা অফিস কামাই করেন না এমনকি চেয়ারে বসে ঢোলেনও না।শুধু একটাই সখ ভদ্রলোকের- খুব গ্যাজেট ভালোবাসেন।প্রায়ই নতুন কিছু না কিছু জিনিস এনে সবাইকে দেখান।তা সে স্মার্ট ওয়াচই হোক , নতুন ক্রেডিটকার্ড সাইজ মোবাইল  বা ম্যাগনেটিক পাজল্।সেই সরখেলবাবু বেপাত্তা!
 আধঘন্টাতেই উল্টোদিকের বাসে চেপে, অফিসে পৌঁছে যায় সৌরদীপ। গিয়ে দেখে এলাহি কান্ড। অফিসে ভেঙে পড়েছে সমস্ত ডিপার্টমেন্টের লোকজন।বস উৎকন্ঠিত হয়ে এদিক ওদিকে ছুটে বেড়াচ্ছেন আর ফোন করছেন। সেকশনাল হেড তো থানায় ফোন করেছেন ,সবাইকে বলছেন ’একটু খুঁজে দেখুন না, ভদ্রলোক কোথায় গেলেন!’ খোঁজা তো যথেষ্ট হয়েছে গত এক-দেড় ঘন্টায়। সৌরদীপ চলে গেল ওনার চেয়ারের কাছে। চেয়ার থেকে ঝুলছে ওনার ব্যাগ, যেমন রোজ ঝোলে । টেবিলের ওপর ওনার চেনা টিফিন ক্যারিয়ারটাও  দিব্যি সাজানো  রয়েছে। তার পাশে খোলা রয়েছে ওনার ফাইলপত্র , এমনকি ফাইলের উপর ওনার পেনটাও খোলা অবস্থায় পড়ে রয়েছে।বোঝাই যাচ্ছে ,হঠাৎ কোন কারণে উঠে গিয়েছিলেন। সব যেমনকার তেমন আছে,শুধু মানুষটাই নেই।অবাক কান্ড।
সবাই বলাবলি করছিল, সকালে যেমন আসেন তেমনটিই এসেছিলেন, ঠিক দশটায়, ইন সাইনও করেছেন। গেটে দুজন দারোয়ান সবসময় থাকে।তারাও ওনাকে নেমে যেতে দেখেনি। ওরা তো প্রত্যেককে চেনে, নাম জানে ।এখন লোকজন কমে যাওয়ায়, ওদের পক্ষে হিসেব রাখা আরো সহজ হয়েছে।তাহলে সরখেলবাবু গেলেনটা কোথায়? অফিসের প্রতিটা ঘর খোঁজা হয়েছে, প্রতিটা বাথরুমও , এমনকি স্টোররুম ,রেকর্ডরুম পর্যন্ত বাদ যায় নি। কোথাও নেই সরখেলবাবু। সবাই সবদিক খুঁজেছে,ওনার মোবাইলে ফোন করলে খালি বেজে যাচ্ছে ,সবার মনে উৎকণ্ঠা। এদিকে পুলিশ এসে গেছে, জয়েন্ট সেক্রেটারিও হাজির,  মিসিং ডায়েরিও করা হয়েছে।
 হঠাৎ ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে ছুটে আসে পিওন তপা।চিৎকার করে বলে ‘পাওয়া গেছে। সবাই এদিকে এসো।‘ ওর দেখানো আঙুলের দিকে লক্ষ্য করে, সবাই হুড়মুড় করে ছুটে চলে। সিঁড়ি দিয়ে নামার বদলে উপরে উঠতে থাকে তপা।আরে! উপরে কেন!ওখানে তো কাজ চলছে রিনোভেশনের। লাল রিবন দিয়ে ঘেরা,ডেন্জার ট্যাগও লাগানো রয়েছে। ওখানে কি করতে গেছলেন উনি! সিঁড়িটা ঘোরার মুখেই পাওয়া যায় সরখেলবাবুকে। মাটিতে বসে আছেন ,কিছু পুরোনো ফার্নিচার,হাবিজাবির মধ্যে, বিস্ফোরিত চোখ। বোঝাই যাচ্ছে দেহে প্রাণ নেই।উল্টো দিকের দেওয়ালে টাঙানো একটা বহু পুরোনো ,বন্ধ গ্র্যান্ড ফাদার  ক্লকের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন তিনি। যেন খুব ভয় পেয়েছেন, বা শক পেয়েছেন কিছু দেখে।ডাক্তার এসে দেখে গেল ,বললো হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যু। সৌরদীপ অবাক হয় ,সব ঠিক যেন স্বাভাবিক নয়,ও কিছু একটা  রহস্যের আঁচ পায়।এদিকে সবার মধ্যে ফিসফাস চলতে থাকে, এত জায়গা থাকতে, নিজের চেয়ার ছেড়ে, এখানে কি করছিলেন সরখেলবাবু, কারও কাছেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হয় না।
(রহস্যের জাল বিস্তার জানতে পুরো গল্পটা পড়তে হবে)

No comments:

Post a Comment