30 March 2018

চাহিদা

     পুজোর আর সপ্তা তিনেক বাকি।আজই বোনাসের টাকা পেয়েছি । টাকা তো নয়,যেন ভিক্ষা।  এবারে আর আট পার্সেন্ট দিতে পারবে না বলে জানিয়ে দিল কোম্পানি,কোথায় জানি কি সব লস হয়ে গেছে। মাত্র পাঁচ হাজার টাকা ঠেকাল,একেবারেই সব আশায় জল ঢেলে দিয়ে ।এই ক’টা টাকায় বউ ,ছেলে আর মেয়ের চাহিদা মিটবে না। কয়েকজন নিকটাত্মীয়কে দেওয়া-থোওয়ারও ব্যাপার আছে। কি যে হবে? মনটা অস্বস্তিতে ভরে গেল।দু’দিন আগেই বউ-মেয়ের সঙ্গে বসে হাজার বারোর মত একখানা তালিকা তৈরি হয়েছিল ।এর চেয়ে কমে আর কিছুতেই করা যায়নি ।এখন সবার জন্য  কি কিনব,কি বাদ দেব,কি'করেই বা খরচে কুলোব, ভাবতে বসলুম।
    এক ভয়াবহ সমস্যা মানুষের এই চাহিদা ,এই জন্যই পৃথিবীতে এত অরাজকতা, এত দুরবস্থা ।চাহিদার তুলনায় রোজগার কম।ইকনমিক্সে যাকে বলে ইনইকুয়ালিটি। দেশের দশ শতাংশ মানুষের কাছেই নব্বই শতাংশ সম্পদ।ছিঃ।
     নিজের জন্য অনেক কিছু কমাতে হবে ।গতবারে নিজের একটা জামা-প্যান্ট আর বউয়ের একটা কম দামী শাড়ি হয়েছিল ।এছাড়াও বাচ্চাদের আব্দার আবারও না মেনে কমেসমে কিসব হয়েছিল। এবার সবার আব্দার মেনে, আরো বেশি টাকার প্রয়োজন হবে বলে ভেবেছিলুম, সব আশা ভেস্তে গেল। এদিকে সবাই তো কত আশায় বুক বেঁধে, আমার দিকেই চেয়ে বসে আছে। তাছাড়া জামাকাপড়ের যা দাম। একই জিনিস ভোল পাল্টে দ্বিগুণ দামে আসছে।
     ভয়ে ভয়ে,দুগ্গা দুগ্গা ব’লে,দোকানে গেলুম সকলকে নিয়ে ।মেয়ে খুব বুদ্ধিমতী, কিন্তু ছোট ছেলেটা কি এসব বুঝবে? ছেলে-মেয়ের অপছন্দ করা পোশাক কিনতেই প্রায় সব টাকা চলে গেল ।শেষে গেঞ্জি জুতো চটি এসব কিনতে গিয়ে মাইনের টাকাতেও হাত পড়ে গেল। যা হয় হোক, দরাদরী করে বউয়ের একটা শাড়ি মোটা টাকায় রফা হল । নিজের জন্য একটা প্যান্ট পিসও কেনা হল ।মেয়ে পড়তে যায়, ভাল ছাতা নেই,একটা কিনতেই হল ।নিজের জন্যও একটা কিনলুম ।বউয়ের অনিচ্ছাসত্ত্বেও একরকম জোর করেই ইমিটেশন চুড়ি,হার,দূল কিনেছি। বউয়ের পরার গয়না নেই। যেগুলো আছে তাদেরও খোঁজ পাওয়া যাবে বন্ধকীর দোকানে। জোরাজুরি করে এক জোড়া রূপোর  দূলও কেনা হল ,ছেলের আবদারে ভিডিও গেম।মাইনের টাকাও প্রায় শেষ হয়ে এল ।এবার মেয়ের অনেকদিনের বায়না চুড়িদার ।দাম পড়ল আশাতীত, দোকানীর সঙ্গে ঝগড়া লাগে লাগে।টাকা পয়সা শেষ করে সর্বস্বান্ত হয়ে বাড়ি ফিরলুম। তবুও আজ আমার বড় সুখ। মনের মত করে খরচ করা গেছে। অনেকদিন পরে মিটেছে সকলের চাহিদা, তা সে যেমনই হোক। কিন্তু বাকি মাসটা কিভাবে চলবে? নতুন জামা প্যান্ট জুতোর বাক্সের গন্ধ শুঁকে? ইকোনমিক্সে একেই বোধহয় বলে বাজেট ডেফিশিয়েন্সি।
     রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেল ফেরিওয়ালা "বাআআআসোওওওন"।শাড়ির বদলে বাসন বিক্রি। শুনেছি ,এসব হাতফেরত জামাকাপড়ের আলাদা মার্কেট আছে। গরীব মানুষরাই নিশ্চয়ই এর ক্রেতা। পাশের গলি থেকে একটা ক্ষীণ কন্ঠ ভেসে আসল ।কেউ যেন ভিক্ষা চাইছে। কান পেতে কথাগুলো শুনলুম। চোখটা গ্লিসারিনে ভিজে গেছে মনে হল। বিরক্তিতে চোখ দুটো মুছে ফেললুম।
     মনে মনে ঠিক করলুম, মা আসুক। ষষ্ঠীর দিন ভোরেই আদ্দিকালের পাঞ্জাবিটা পরেই মার সামনে গিয়ে করজোড়ে অভিযোগ জানাব। ‘মা সবার সব চাহিদা মিটিয়ে দাও মা।‘

29 March 2018

দুগ্গাপুজো

ছোটবেলার কথা মনে পড়ে।পুজো এলেই তখন
বুকের মধ্যে কেমন ধুকপুকানি বেড়ে যেত। পুজোটা কিভাবে কাটাবো, কি কি আনন্দ করবো ,কোন মজা বাদ যাতে না পড়ে। পুজোর চার দিন বেশ তাড়াতাড়ি কেটে যেত। ঘণ্টায় ঘণ্টায় ,বেলায় বেলায়, শেষে এক একটা দিন চলে যেত ।সপ্তমীর দিন মনে হতো এইতো পুজো শুরু ,এখনও অষ্টমী আছে ,নবমী আছে। দু--দি--ন ।অষ্টমীও কেটে যেত ,তবু মনে হতো নবমী তো আছে , আরও একটা দিন, আরও অনেক কিছু ঘটবে, আরও আনন্দ। আশ্চর্যজনকভাবে নবমী ও কেটে যেত ।পরম বিস্ময়ে দেখতুম আর পুজোকে ঠেকিয়ে রাখতে পারছি না, হাতের মুঠো আলগা হয়ে যাচ্ছে, পুজো শেষ হয়ে যাচ্ছে, শেষ হয়ে এল বলে ,শেষই হয়ে যাবে। চোখ ফেটে জল এসে যেত। তবু মনখারাপটাকে প্রশ্রয় দিতুম না। শেষবেলার ভাসান,শেষ পুজোটুকু, তারপরেও ঠাকুর  কোন কোন প্যান্ডেলে থাকত ঠিকই, কিন্তু আমাদের ন্যাড়া প্যান্ডেল, খালি বেদী,প্যান্ডেল থেকে ডেকোরেটরের লোকরা কাপড় খুলতে শুরু করেছে, ইলেকট্রিসিয়ানরা লাইট খুলে নিচ্ছে ;এসব দেখে সহ্য করতে পারতুম না। কষ্টর সেই বোধহয় প্রথম অনুভূতি--- পুজো শেষ।
কিন্তু শৈশবের সেই যে ষষ্ঠীর ভোরে হঠাৎ ঢাকের বাজনায় ঘুম ভেঙে যাওয়া আর মামাবাড়ির তক্তাপোষে শুয়ে প্রচন্ডতম বাস্তবকে মনে পড়া- আজ থেকে পুজো, সেই আনন্দটুকু আজ এই বয়সেও সেই একইরকম আছে। আমার এবং আমার মেয়েরও। ঢাকের শব্দে আমার ছোট্ট মেয়েটাও একই ভাবে পুলকিত হয়- দুগ্গাপুজো। সেও বুঝে গেছে, সেও তৈরি তার ছোট্ট শরীর মন দিয়ে সেই অজানা আনন্দ কে সারাজীবনের মতো আপন করে নিতে-এই তার শুরু ।আমার আর সেই পুজো নেই, অফিসে ছুটি নেই, বন্ধুদের সঙ্গে তেমন যোগাযোগ নেই ,গোলাপি চুড়িদারের সেই মাতন নেই, সেই দিন চলে গেছে। নিজের ইচ্ছে অনিচ্ছের ওপরে, পরিবার-বাবা-মা-মেয়ের জন্য এখন এই নবআনন্দের পুজো। সবাইকে আনন্দে রাখার একটা দায়িত্ব।কিন্তু আমার মেয়ের চোখে সেই ঠাকুর, সেই প্যান্ডেল আর সেই ঢাকের বাজনার আবেগ, আনন্দ আর আকর্ষণ দেখে পুরনো স্মৃতি কিছু কিছু বুঝে পাই ,ফিরে আসে যেন আমারই শৈশব। আমাদের সকলের দুগ্গাপুজো- এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্ম- সেই কালের যাত্রা।

25 March 2018

এক অন্ধকার ও আমি

ভোট করতে গিয়েছিলুম উড়িষ্যার বনাই এর এক প্রত্যন্ত গ্রামে,সেখানে বিদ্যুৎ পৌঁছয়নি ।সন্ধ্যার অন্ধকারে যখন লঝঝড়ে ট্রাকটা আমাদের কোমর ব্যথা সমেত উগরে দিয়ে চলে গেল, মনটা আমার একেবারে হু হু করে উঠল ।এ কোথায় এলাম ?চতুর্দিকে ঘিরে ধরেছে ঘুটঘুটে অন্ধকার ।কোথাও কোথাও চিলতে লণ্ঠনের আলো বেরিয়ে এসেছে ।তার মধ্যে আবছা  স্কুলবাড়িটার অস্তিত্ত্ব। দূরে, আরো দূরে কোথাও কোথাও হালকা আলোর ইশারা বুঝে নিতে হয়। বাকি সবই মিশমিশে কালো অন্ধকার। গাঢ় অন্ধকারে কে যেন চলে গেল মানুষের অবয়ব। এখানেই এই অসহ্য অন্ধকারে থাকতে হবে এই কোলকাতার শহুরে ছেলেকে?যে আলো ছাড়া থাকেনি কখনো, এমনকি শহরের লোডশেডিংয়েও যার রয়েছে এমারজেন্সি, ইনভার্টার,ব্যাটারি?
বাক্স-পেঁটরা নামাতে হয় ওই লণ্ঠনের আলোতেই। কোনক্রমে ভাঙা অযত্নের চৌকিতে বসি। স্কুলের দারোয়ান চুলা জ্বালাতে ব্যস্ত। পাশে ব্রাম্ভণী নদীর থেকে বয়ে আসছে শিরশিরে হাওয়া।আমার সহকর্মীরা হয়ত এই অন্ধকারে অত অনভ্যস্ত নয় ,তারা খোশগল্পে মত্ত। আর আমি চারপাশে ঘিরে ধরা কালোর ভয়ে সিঁটিয়ে যেতে চলেছি।মেনে নিতে পারছিনা এই সম্পূর্ণ একক অন্ধকারকে। এই পরিবেশকে সঙ্গী করে কি করে কাটাবো এতটা সময় ?একটু আলো চাই।মন চলে যাচ্ছে বাড়ির আলোকিত ঘরটায়,যেখানে হয়ত এখন টিভি দেখছে গিন্নি,বই পড়ছে বাবা আর কম্পিউটারে গেম খেলছে ছেলে ,যাবতীয় আনন্দ উপকরণ মজুত। মোবাইলের স্ক্রিনে সভ্যতার ছোঁয়া, কিন্তু ব্যাটারি ফুরোলেই? কান্না পেতে লাগল ।
হঠাৎই উপরে মাথা তুলে চমকে উঠলাম। নিকষ কালো অন্ধকার আকাশে সমগ্র নক্ষত্রমন্ডল ফুটে উঠেছে। এত স্পষ্ট ,এত সুন্দর এই অন্ধকার আকাশে তারাদের আলো, আগে দেখিনি কখনো। কলকাতার কংক্রিটের জঙ্গলে আকাশ দেখার ফাঁক নেই ।একসঙ্গে এতটা আকাশ আর আমি- মাঝে কেউ নেই ।একটা অদ্ভুত অনুভূতি হল। পৃথিবী আর সমগ্র সৌরজগতই আমাকে দেখছে যেন ।এ যেন নিজেকে এই বিশাল জগতের মাঝে নতুন করে আবিষ্কার করা। কি নিদারুন তুচ্ছ আমি। বিশাল অন্ধকার আকাশে তারাদের ঝিকিমিকি দেখতে দেখতে মনে হল আমি কি, কেন, কোথায় ?ডুবে যেতে থাকলাম সেই অদ্ভুত মহানুভবে।শহরের সব ইনভার্টার , সব ব্যাটারি যেদিন শেষ হয়ে যাবে, আমাদের ফিরতেই হবে এই আদিম অন্ধকার আকাশের নীচে ।এ এক নির্মম বাস্তব।
সেই প্রথমবার সেই প্রত্যন্ত গ্রাম্য সন্ধ্যাকে, একসঙ্গে অনেকটা ভাল লেগে গেল।

23 March 2018

ইচ্ছেডানা

আমি যদি চাকরি না করতুম, আর বাঁধাধরা কোন কাজের গণ্ডির মধ্যে বাঁধা না থাকতুম, তাহলে আমি হয়তো অন্য অনেক কিছু করতে পারতুম। তাতে অবশ্য খাবার জুটতো কিনা নিশ্চিত করে বলতে পারি না ;তবে মনের আর প্রাণের ইচ্ছের বিকাশের একটা রাস্তা খুঁজে পেতুম নিশ্চিত। সারাদিন ইচ্ছেকে ভাসিয়ে দিতুম ডানায়, কখনো সে কবিতা লিখত, কখনো বা ছবি আঁকতো। দেয়ালে আজগুবি নকশা করতো বা হারমোনিয়ামে গলা সাধতো। এর পরেও অবশ্য অনেক সময় থেকে যেত নিজের শখ, পরিবারের শখ মেটানোর জন্য ।মেয়েকে ,ছেলেকে সময় দিতে পারতুম, খেলতুম  নতুন নতুন খেলা ,মনের মত করে তাদের গড়তে পারতুম।বৌকেও সময় দিতুম অনেক, অনেক গল্প মজা করে, সংসার আনন্দে ভরে যেত। নিজের ভুলগুলো শুধরে নিতেও পারতুম। ভুলতো কতই করি ,আসলে সময় চাই, সময়। নিজেকে বদলে ফেলার জন্য। মোড়ক বদল আরকি ।চাকরি না করলে বা অবসরে জীবন কাটালে অন্যান্য কিছু অসুবিধাও হতো ঠিকই, তবে প্রাণশক্তিটা বাড়তো, আকাশ -বাতাস- পৃথিবী -প্রকৃতির সুখটুকু উপভোগ করে নিতে পারতুম। কেন জানিনা সেটা হবার নয়।কে  যে এই নিয়মখানা করেছে, তাকে বড় দুষতে ইচ্ছে হয় ।সময়টাই আসলে আলাদা।কোথাও মানুষ উদয়াস্ত পরিশ্রম করে সেইদিনের খাবারটা জোগাবে বলে ;আবার কোথাও আরও বড় সাম্রাজ্য, আরও বড় প্রাসাদের মালিক হবে বলে। কিন্তু মানুষ বড় বেশি সময়ের দাস। সময়কে বাগে রাখতে পারিনা আমরা -সেই অক্ষমতার কোন ক্ষমা নেই। সে বড় অসহায়তা -একমাত্র মৃত্যুতেই বোধ হয় তার শেষ।কিন্তু পৃথিবী একদিন ছিল না,একদিন থাকবেও না।কোথায় রইবে কোটি কোটি জীবনের এই সব ইতিহাস,ভাসমান দ্রুতপ্রসারিত মহাবিশ্বে?

19 March 2018

পথ চলা

কালে কালে বয়েস কম হল না।কেরীয়ারের লড়াই লড়তে লড়তে চোখে চালসে পড়ল।প্রেসারের ওষুধ ধরতে হল।চুল তো পাতলা কবেই হয়েছিল,এবার অল্প অল্প পাকও ধরল।গোঁফদাড়িও তথৈবচ।তবে বয়েস হলেও শখ যায়নি।চুরি করে মেয়ের চকোলেট আজও খাই।সুন্দরী মহিলা দেখলে চোরাচাউনিতে আজও চাই।তবে কিছু ব্যাথা আজও রয়ে গেছে।কিছু ভুল করে ফেলেছি,কিছু অভিমান।কিছু সময় চলে গেছে।কিছু মানুষ চলে গেছে।শেষ প্রেমিকা আমাকে ফেলে বাস থেকে নেমে গেছে,গলি ঘুঁজি খুজেও আর পাইনি। শেষ পরীক্ষায় পাশ করতে পারিনি,শেষ দেখা দেখতে পাইনি কাউকে কাউকে।কিছু আফশোষ রয়ে গেছে,কিছু দীর্ঘশ্বাস।আর অনেক না পাবার মধ্যে কিছু পাওয়াও রয়ে গেছে।স্ত্রীর আলতো হাতের যত্ন,মায়ের হাতের আমঝোল বা বাবার ধমক "ঝড় উঠেছে বুবাই,কোথাও বেরোবি না।” আর রয়ে গেছে ঘুমন্ত ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে নিজেকে খোঁজার চেষ্টা।যেমন পার্ক স্ট্রীটের ফুটপাথে হাঁটতে গিয়ে এখনও খুঁজি টাটকা এসির গন্ধ,যেমন মামাবাড়ির কড়ী বরগা খড়খড়ী আর পঙ্খের কাজে খুঁজি ছোটবেলার স্মৃতি।তাই মনে হয় প্রত্যেকটা মানুষই আসলে ভেতরে ভেতরে ভীষন একা।সন্ধ্যা নামলে পূর্ণীমা চাঁদের দিকে তাকালেই মনে হয় কোথায় যেন জেগে উঠছে আমার একাকীত্ব,আমার মনকেমন।কোথায় কি যেন ছিল,পাওয়া হয়নি।কোথায় কে যেন ছিল,দেখা হয়নি।শহুরে আলোর রোশনাই যেন জোর করে একাকীত্ব অস্বীকার করাতে চায়।তবু সিগারেটের ধোঁয়ার মত নিংড়ে বের হয়ে আসে কান্না।দেখা যায়না,বোঝা যায়না।এত বড় সংসারে কেউ কাঁধে হাত রেখে বা চোখে চোখ রেখে বুঝতে আসেনা কারও মনকেমন।হঠাৎ আকাশ কালো করে বর্ষা আসে,গাছের ডাল নুইয়ে পড়ে মাটি ছুঁতে চায়।দলা পাকিয়ে ওঠে দীর্ঘশ্বাস,চোখে জল এসে যায়।মনে হয় কেউ় কি বুঝলো আমাকে ঠিকঠাক,এ জগতে কেউ কি অনুভব করল আমার এই ছোট্ট আবেগ,ছোট্ট উপস্থিতি?গভীরে কোথাও রক্তাক্ত হই,অভিমান জেগে ওঠে,মনে হয় আমি কি কেউ নই?কিচ্ছু নই?কেন আমি এত একা শুধু আমার পাগল মনটাকে নিয়ে?কেন আমি এত ক্ষুদ্র,অসহায়?হঠাৎই রবিঠাকুরের গানের দুটো লাইন চোখের   জলে ভিজিয়ে দেয়,বলে কি করলে জীবনে?“প্রহর হল শেষ”।

18 March 2018

কবির বিড়ম্বনা

একটা কবিতা লিখেছিলুম। অনেক ভরসা করে  মনোমতো সব ভালো ভালো  কথা দিয়ে  সাজিয়ে কবিতাটাকে দাঁড় করানো গেছিলো।অনেকবার পড়ে মনে  হলো, স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ এর চেয়ে ভালো লিখতে পারতেন না।গর্বে বুকের  পাটা দু ইঞ্চি বেড়ে গেল।অনেক আশা নিয়ে বাবাকে পড়ে শোনাতে গেলুম,বাবা পাত্তাই দিলেন না।বললেন ‘পড়াশোনার পালা চুকিয়ে ফেললে তাহলে!অবশ্য করেও লাভ হতো না কিছুই।তা এবার  কবিতা ফবিতা না লিখে একটা চাকরির চেষ্টা  করো।কবি হবে কবি।ফুঃ’। মনটা খারাপ হয়ে গেল।কবিতা লেখা পৃথিবীতে যেন ঘোর অন্যায়, কাজ ফাজ না থাকলেই বোধ হয় শুধু লোকে কবিতা লেখে।মনের দুঃখে খাতাটা বগলে চলে গেলুম হেবোর বাড়ি।হেবো দিনরাত হিন্দি গান শোনে,হিন্দি ফিল্মের ডায়ালগ ঝাড়ে। কবিতা টবিতা কি ব্যাটা বুঝবে?তবু একবার চেষ্টা করেই দেখা যাক।পড়ে শোনালাম পুরোটা।হেবো গম্ভীর ভাবে শুনলো সবটা।তারপর মুচকি হেসে বললো ‘সবই তো বুঝলাম গুরু, কিন্তু মেয়েটা কে?’ ‘তার মানে? এর মধ্যে মেয়ে এল কোত্থেকে?’আমি তো অবাক।‘ছুপানেকি কোশিস মত্ করো গুরু।লুকিয়ে লুকিয়ে প্রেম করছ, কবিতাও লিখছ আজকাল’।মানেখানা এমন, কবিতা লিখলেই বোধহয়  প্রেম করতে  হয়,  নাকি  প্রেম করলেই কবিতা লিখতে হয়।মাথা গরম হয়ে গেল।ওর কোন কথায় কান না দিয়ে,হাজারটা আরও ঠাট্টা হজম করে সোজা রাস্তায় বেরিয়ে পড়লাম।এসে দেখি বুধু নাপিত একা একা বসে আছে,কোনো খদ্দের নেই।এই মওকা।তাড়াতাড়ি ওর খাটো টুলে বসতেই ও সাবান গুলতে শুরু করে দিল।ওকে থামিয়ে বললাম ‘দাঁড়া,দাড়ি পরে কাটবি.আগে এটা শোন দেখি কেমন হয়েছে’?বলেই কবিতা পড়তে শুরু করে দিলাম কোনো প্রতিবাদ এর সুযোগ না দিয়ে।বুধু যদি এক মুহূর্ত ধৈর্য ধরে শুনে থাকে।একবার ঘাড় চুলকোচ্ছে,একবার ক্ষুর শানাচ্ছে তো একবার রাস্তার ওপারে কি হচ্ছে মাথা উঁচিয়ে দেখছে।বিরক্ত হয়ে একবার ধমক দিলাম অ্যায়সা।বাকিটা অবশ্য ঠিকঠাক শুনলো।শুনে বলল’ভালই হয়েছে,তবে শেষের দিকটা ঠিক যেন ইজি হয়নি।এবার তবে কামাই দাড়িটা’।যেন দাড়ি কামানোর জন্যই বসে ছিল এতক্ষন।শখের দাড়িটা বিসর্জন দিয়ে ,এক্সট্রা দুটাকা কবিতা শোনার ফি দিয়ে মুক্তি পাই অবশেষে।এবং বুধুও আমাকে সবিস্তারে বুঝিয়ে দেয় কবিতা সাইজ করা, চুল দাড়ি সাইজ করার মতোই সহজ এবং বেশ কিছু সাজেশনও সে  অক্লেশে বিলিয়ে দেয়।গা জ্বলে গেল শুনে,গালটাও জ্বলছিল।নেহাত হাতে ক্ষুর ছিল ব্যাটার ,নইলে---।কবিতার খাতাটার ওপরই রাগ হয়।তাল পাকিয়ে, কুচিয়ে তারপর রাগে লাথি মেরে উড়িয়ে দিই সেটাকে।তাতেও বিপদ।পাড়ার বিনোদবাবু জ্ঞান দিতে এলেন।‘এঃ,এভাবে পাড়াটাকে নোংরা করবেন না।এপাড়া তো আমার আপনার সক্কলের।এপাড়াতে যেমন.......’।বিনোদবাবুর উপদেশ শোনার সময় নেই।বাড়ি যাই।আর কোনদিন সাবানের ফেনার রামধনুতে স্বপ্ন দেখব না।

17 March 2018

শুধু তুমি

তোমার জন্য আমি সব করতে পারি. বোমাবাজি  কিংবা পকেটমারি. তুমি আমার  কন্ডাকটরীর পয়সায় সাত টাকা থেকে এক লাফে দশ টাকা হয়ে যাওয়া এগরোল  সাটালেও তাই আমি উদাস না হয়ে তারিয়ে তারিয়ে তোমার ঠোঁটে লেগে থাকা লাল সসের  চেটে নেওয়া দেখতে থাকি. গভীর রাতে শুধু মাঝে মাঝে ভীষণ সুরসুর করে হিসি পায়, মনে হয় কন্ডাকটরীর ব্যাগটা খুচরো পয়সার ওজনে এত ভারী হয়ে গ্যাছে যে আর বইতে পারছিনা. ওটাকে ছুড়ে ফেলি, কিন্তু ওর স্ট্রাপ আমার কাঁধ বেয়ে গলায় উঠে আসে, আর হিসহিস করে জড়িয়ে ধরে আমার গলা. দমবন্ধ হয়ে আমার ঘুম ভেঙে যায়. এক গ্লাস জল খেয়ে আমার টালির চালের দিকে তাকিয়ে থাকতে আবার তখন তোমার কথাই মনে পড়ে যায়. কারণ তুমিই আমার বেঁচে থাকার একমাত্র সুখ. ভাবি তোমার সঙ্গে হেঁটে চলে যাব কোদাইকানাল, বা প্যারাসুটে করে ঝাঁপিয়ে পড়ব তোমাকে জড়িয়ে এরোপ্লেন  থেকে. অনেক রাস্তা পেরিয়ে অনেক মৃত্যু ডিঙ্গীয়ে  তোমার জন্যে আমি মায়াচন্দন আনতে পারি. তোমাকে নিয়ে আমি উদ্দাম উল্লাস বা অবুঝ প্রেম সবটাই করতে পারি কয়েক মিলিসেকেণ্ডে. তোমার কাছে শুধু আমার একটাই চাহিদা. অনেক লড়ে  অনেক হেরে, কিছু জিতে অনেক বেচে, আমার চারপাশের নেশাখোর, খিস্তিবাজ  অন্ধকার ঠেলে তোমার কাছে শেষমেষ এসে পৌঁছলে, আমার পায়জামার দড়িটা  খুঁজে দেবে তো?
দিনরাত শুধু তোমার কথাই ভাবি।তোমাকেই চাই। একঘেয়ে জীবন থেকে মুক্তি, উচ্ছল আকর্ষণীয় কথা, হালকা গরম নিশ্বাস, কপালে জমা ঘাম, শরীরজুড়ে সুড়সুড়ি । তুমি কি যৌবনের তাড়না ,যৌনতার নেশা? বদলে গেছি আমি। বদলে গিয়েছে সৌন্দর্যের মানে। কোনটা শেষকথা জীবনে? মনের চাহিদা, আবেগ, কবিতা এসব কোথায় গেল? বাস্তব কি এত নিষ্ঠুর? আমার দাম শুধু শরীরে, যৌবনে ?তারপর কি হবে ?কি নিয়ে বাঁচবো আমি?একটা স্থায়ী পরিচয় কি আমার পাওয়া যাবে না? মানুষ? তাই বা বলি কী করে?আমার নিজস্ব বলে কোন সত্ত্বা নেই, কোন মত নেই , বিচার নেই, বুদ্ধি নেই। আমি চলেছি তালেগোলে ,ভুলে ভালে। এই ক্ষয়িষ্ণু সমাজে আমার কোন ভূমি নেই ,ভূমিকা নেই ।আমার শুধু একটা নাম আছে। ওটা বদলাবে না ।কিন্তু ওটার কোন মূল্য নেই ।ঘাড়ে চেপে থাকবে ফাঁকা শুকনো একটা জন্জাল-মৃত্যু পর্যন্ত ।যে নামের ঠিক মানেই আমি জানি না ।ঐ নামের আমি যোগ্য কিনা তাও জানিনা। ঐ নামটা আমি খাব , না মাথায় দেব ,নাকি ছুঁড়ে ফেলে দেব, তাও জানিনা।ফেলে দেবই বা কোথায় তাও জানিনা।

শুধু বসন্তকাল এলেই আমার বুকটা ধড়পড় করে।মন আনচান শুরু হয়।আসলে আমি সহজেই প্রেমে পড়ে যাই ।এক ঝলক কোন সালোয়ার-কামিজ পরা মেয়ে আমাকে দেখলেই, বুক কেমন করে। মনে হয় ও বোধহয় আমাকে কিছু বলতে চায় ।কোন মেয়ের হঠাৎ মুখোমুখি হয়ে যাওয়া, বাসে পাশের সিটে কোন অচেনা মেয়ে বা পুকুরে চান করতে করতে সরকার বাবুর বাড়ির ছাদে একটা ছায়া- সবাই মনে হয় আমাকে কিছু বলতে চায় ।আমার মনটা খুব নরম আর প্রেমিক প্রকৃতির। আমি কবিতাও লিখি। সব ফালতু কবিতা ,সব নিজের জন্য ,নিজের করে সব মেয়েকে পাবার জন্য বানিয়ে বানিয়ে লেখা। লিখে ফেলে শান্তি, কিছু তো বলা হলো ।বাস্তবে বলতে গেলে তো জিভ শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাবে। কোন মেয়েকে জীবনে প্রেমপত্র দিতে পারব বলে তো মনে হয় না,ফোনে কথা বললেও কথা গুছিয়ে উঠতে পারিনা। শুধু হৃদয়ে ভীষণ অবুঝ প্রেম জেগে ওঠে, হজম হয়না, জেলুসিল আর কত খাব?প্রেমের চোটে ঘুম হয় না ,খিদে কমে যাচ্ছে। আর কতকাল খুঁজবো তোমায়? আসলে নীল রঙটাই যত নষ্টের গোড়া। আজকাল আর নীল রঙয়ের জামাটা পরিনা। আমাদের পাড়ার হারামি মনোজ ডাক্তারের গাড়িটাও নীল রঙয়ের।তুমি তো আমাকে কাঁদিয়ে চলে গেলে- তবু তোমার নীল ওড়নাটা চোখে ভাসে। নীল চোখের সুন্দরী ঐশ্বর্য রাই আমার দিকে কক্ষনো তাকায় না ,কক্ষনো না।তাই নীল রঙটা ভাল না। নীল বলে একটা ছেলে -ভীষণ বোকা,ভীষণ ক্যাবলা।সবাই ওকে ঠকায়। ধুর ছাই।

11 March 2018

ভয়ংকর রাগারাগি

সারাটা জীবন খালি রাগ, অভিমান ,দুঃখ আর হতাশা নিয়েই পেরিয়ে এলুম। কিছুই পেলুম না অবশ্য তাতে। ওই লোকটা আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছে, ওই সবজিওলাটা ঠকিয়েছে, ঐ বন্ধুটা টাকা ধার নিয়েও ফেরত দিচ্ছে না--এতগুলো লোক একসঙ্গে খারাপ হয়ে গেল ।মনে মনে প্রতিশোধ পরায়ণও হলুম ।শালাকে দেখে নেব ,হাতে পাই একবার।যেখানে দুর্বল পেলুম সেখানে আস্ফালন ,প্রতিপক্ষ সবল হলে আড়ালে শাপান্ত ,বাপান্ত ।এই করেই কাটিয়ে এলুম চল্লিশটা বসন্ত।কত মানুষ এই ক’বছরে বর্জন করলুম তুচ্ছাতিতুচ্ছ কারণে ,ভাবলে আজ  আফশোষ হয় ।দুঃখ আর হতাশার কারণ গুলো অবশ্য আলাদা ,তাতে আমার মত নগন্য লোকের ট্যাঁ ফুঁ করবার জো নেই ।এই যেমন মাইনে বাড়ছে না , তেলের দাম কমছে না, স্ট্রীট লাইট জ্বলছে না।এই সমস্ত আরকি ।এর কোন চটজলদি সমাধান নেই, ঝগড়া করে দু'কথা শুনিয়ে মনের শান্তি নেই ।তাই রাগটা মনে মনে জমে জমে বারুদের স্তুপের মত হয়ে ওঠে।এর চেয়ে যদি এরকম হত, কাজের লোক দুদিন  টানা আসছেনা, তৃতীয় দিনেই তক্কে তক্কে থেকে দু'কথা শুনিয়ে দেওয়া বা মাছওলা পচা মাছ গছিয়েছে বলে রোজ ওর দোকানের সামনে দিয়ে যাবার সময় মনে মনে গালমন্দ করে পার পেয়ে যাওয়া। বন্ধু বই ফেরত দেয়নি বলে তার নামে আর পাঁচজনের কাছে আশ মিটিয়ে নিন্দে করে নেওয়া। ঝাল ঝাড়তে পারার মত আরাম আর কোথায় আছে?এইসব রাগ ,দুঃখ যখন যথোচিত বিহিত না পেয়ে বুকের ভেতরেই ফুটতে শুরু করে ,খেতে থাকে হাড়  মজ্জা, পাত্তা পাচ্ছি না কোথাও, ঠিক তখনই ভালো মানুষ বুড়ো কাগজওলার পাল্লায় গলদ ধরে ফেলে সেই জমানো বারুদের স্তুপে আগুন ধরে যায়।তারপর  সে কি বীরনৃত্য ,সেকি গরিবের গলায় চেপে তান্ডবকান্ড। এইটুকুই জীবনযুদ্ধে জয়লাভ, এইটুকুই মধ্যবিত্তের মারিতং জগৎ। বাকি সবই পরাজয়, বাকি সবই অপমান ,লজ্জা আর হার মেনে নিয়ে মুখ লুকিয়ে ফেলা ।হায়রে, কেউ হারে কেউ জেতে ।পাশা উল্টে যায়।

8 March 2018

আঁচল


আজও ছেলেটার  জ্বরটা কমল না।দু’দিন ধরে অনিল কোবরেজের ওষুধ দেওয়া হচ্ছে ।সারারাত জলপটি, ওষুধ-পথ্য ।ভোরের দিকে চোখটা লেগে গিয়েছিল মল্লিকার। তাতেই ঘোরের মধ্যে হাজির সুতনু । -তুমি কোথায় আছ সুতনু ?আমি যে তোমাকে অনেক দিন ধরে খুঁজছি। -আমাকে খুঁজছ?এখনও? আমি তো সব ছেড়ে চলে গেছি। - কি বলছ সুতনু ? তুমি আমার সঙ্গে শুধু ভালবাসার খেলা খেলেছিলে,না? -জানি না।তুমি বৃথা সময় নষ্ট করছ,আমাকে আর খুঁজে পাবেনা মল্লিকা। -সময় নষ্ট? একরত্তি ছেলেটার কথা একবারও ভাবলে না? ওর জন্য অন্তত একবারটি ফিরে এসো, তোমার পায়ে পড়ি। সুতনু কি যেন বলতে চাইছিল মল্লিকাকে। শেষে কিছু না বলেই প্রতিবারের মতো এবারও ঝাপসা হয়ে হারিয়ে গেল।  চোখটা জলে ভরে আসছিল মল্লিকার। স্বপ্ন দেখার কান্না ? হবেও বা। সুতনু চলে গেছে আজ এক বছর এক মাস হলো ।কোলের ছেলেটাকে নিয়ে মল্লিকা আজও সেইরকমই অসহায়। আদিত্য মানে সূর্য ও জানে। নামটা সুতনুরই দেওয়া । দাদাবাবুদের বাড়ির ছেলেটার নাম আদিত, খুব শান্ত ।কতই বা বয়স ,ছয় সাত হবে। স্কুলে নিয়ে যাওয়া ,নিয়ে আসার দায়িত্ব মল্লিকার। বৌদির নাকি কি সব অপারেশন হয়েছে, শুয়েই থাকে সারা দিন। আরো কিছু জটিল অপারেশন হবে, দাদাবাবুদের বাড়ির কথাবার্তায় বুঝতে পারে ও।বৌদির অবস্থা ভালো নয় ,কে জানে বাঁচবে কিনা । একদিন দাদাবাবু এসে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল মল্লিকাকে, বৌদির ঘরে। ‘একবার এস মল্লিকা, বৌদি তোমার সঙ্গে একটু কথা বলতে চায়’, দাদাবাবু বলেছিল। ধীরে ধীরে পর্দা সরিয়ে ঘরটায় ঢুকেছিল মল্লিকা ।সারা ঘরে ওষুধের গন্ধ, চব্বিশ ঘন্টার নার্স । তারই মধ্যে বিছানা থেকে একটা শীর্ণ হাত বাড়িয়ে দিয়ে, মল্লিকার হাতটা ধরেছিল বৌদি, ‘তুমিই মল্লিকা?’ কি মিষ্টি গলা, কি সুন্দর দেখতে বৌদিকে। মনটা খারাপ হয়ে যাচ্ছিল, বৌদিকে বাঁচিয়ে দিও ঠাকুর,মনে মনে বলেছিল মল্লিকা। ঘাড় নেড়ে ‘হ্যাঁ’ বলেছিল। ‘আদিতকে একটু দেখো, আমি তো কিছুই করতে পারি না ।তুমিই ওর সব। ছেলেটাকে সাবধানে রেখো, খুব দুষ্টু ।‘বৌদি অনেক কষ্টে কথাগুলো বলেছিল। কোথা থেকে একরাশ কান্না উঠে আসছিল মল্লিকার, কোনরকমে নিজেকে সামলে নিয়ে বলেছিল, ‘তুমি একদম চিন্তা কোরো না বৌদি, আমি আছি তো।‘ বৌদি সেই কথায় কেন যেন, ভীষণ আস্বস্ত হয়েছিল ।আসলে মায়েরা মায়েদের মন বোঝে। বিছানায় শুয়ে শুয়ে একটু হেসে বলেছিল, ‘তুমি খুব ভাল, আমি জানি।‘ মল্লিকার চোখে জল এসে গেল, বলল, ‘তুমি তাড়াতাড়ি সেরে ওঠো বৌদি, দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে।‘ বৌদি বিছানায় এলিয়ে প’ড়ে, ক্লান্ত স্বরে বলেছিল, ‘কিচ্ছু ঠিক হবে না, কিচ্ছু না।‘ নার্সের ইশারায় মল্লিকা বেরিয়ে এসেছিল ঘর থেকে। আঁচলে চোখ দুটো তাড়াতাড়ি মুছে ফেলেছিল। সে কান্না কেউ দেখতে পায়নি ।দাদাবাবু মল্লিকাকে এসে বলেছিল, ‘তোমার হাতে ছেলেটাকে দিয়ে আমাদের কত শান্তি,তুমি জানো না। তুমি কিন্তু কামাই করবে না একদম, বুঝেছ?’ মল্লিকা ঘাড় নেড়েছিল। ছেলেটাকে স্কুলে নিয়ে যেতে আসতে, হাতটা তাই শক্ত করে ধরে রাখে মল্লিকা। নিজের ছেলেটাও আর কদিন পরেই স্কুলে যাবে- নিশ্চয়ই যাবে ।ও একটু একটু করে পয়সা জমাবে ।স্কুলে যাবার মেলা খরচ ।বই-খাতা ,জামা-প্যান্ট,ব্যাগ, টিফিন বক্স, ওয়াটার বটল্। বাবুদের ছেলেটার সেইসব গোছাতে গিয়ে ওর চোখ যেন দেখতে পায় আদিত নয়, আদিত্য নামটাকে। নামেও কি অদ্ভুত মিল ছেলেদুটোর ।মায়াটা যেন একটু বেশিই পড়ে গিয়েছে ।পরম মমতায় মল্লিকা সব গুছিয়ে দেয়, একটুও ভুল হয় না। তারপর জামা-প্যান্ট পরিয়ে যখন আদিত একেবারে রেডি, চোখ সরাতে পারে না মল্লিকা। আদিত্যও ঠিক এরকমই একদিন স্কুলে যাবে। ‘আজ স্কুলে যাব না মাসি, প্লিজ’, আদিত বায়না করত। ‘কেন যাবেনা সোনা? কি হয়েছে?’ ‘আমি মার কাছে থাকব, মার কাছে আমায় যেতেই দেয় না‘, আদিত কাঁদোকাঁদো। ‘যাবে তো মার কাছে। মা একটু সুস্থ হলেই যাবে।‘মল্লিকা বোঝাতে চেষ্টা করে। ‘মা কবে সেরে উঠবে মাসি?’ মল্লিকার কাছে এর কোন জবাব ছিল না। সে ডাক্তার নয়, কিন্তু ডাক্তারও কি বলতে পারতো ?তবে মল্লিকা মার অভাব পূরণ করার সাধ্যমত চেষ্টা করত। আদিতের হাত ধরে বলত, ‘চল, চল স্কুলে যেতে হবে। স্কুল থেকে ফিরে এসে মার কাছে নিয়ে যাব।‘ আদিত্য খুশি হয়ে বলত, ‘স্কুল থেকে এসে? মার ঘরে কিন্তু আমি আজকে সারাদিন থাকব। ঠিক আছে?’ ‘হ্যাঁ, ঠিক আছে’ মল্লিকা স্তোকবাক্য দেয়। আর মার কাছেই শোব কিন্তু রাতে, মা আমাকে ঘুম পাড়াবে, দিদা নয়‘, আদিত আবদার করে। ‘ঠিক আছে, ঠিক আছে’, এবারেও মিথ্যে বলে মল্লিকা। আহা রে ,ওর হাতে যদি সত্যি এর কোন উপায় থাকত! জ্বরটা যায়নি ছেলেটার। আজ মনটা দুশ্চিন্তায় বেজে উঠছে বারবার। তবু কামাই করা যাবেনা বাবুদের বাড়ি। গুরুদায়িত্বে একদিনও ফাঁকি দেবার জো নেই।আর মাত্র এক ঘণ্টা ।আদিতকে বাড়ি পৌঁছে, জামা-কাপড় ছাড়িয়ে, টিফিন খেতে দিয়েই, এক ছুট দেবে মল্লিকা ।আজই হরেণ ডাক্তারকে দেখাবে ছেলেকে । আঁচলে বাঁধা আছে জমানো কয়েকটা টাকা ।যেভাবে হোক ছেলেটাকে সুস্থ করে তুলতেই হবে। অনেক স্বপ্ন ওর আদিত্যকে নিয়ে ।ও’ও স্কুলে যাবে ,বড় হবে ,বড় হয়ে মল্লিকার মুখে একটু হাসি ফোটাবে। অনেক লড়াই । এই অবেলায় কেন চলে গেলে সুতনু ?লড়াইটা নয় দুজনে একসঙ্গে লড়ত।আদিত্যকে বড় করে তোলার দায়িত্ব কেন নিলেনা সুতনু? কেন পালিয়ে গেলে ? ছিঃ।চোখে জল আসতে দেয় না মল্লিকা।স্কুল থেকে ফেরার সময়, দাদাবাবুদের গাড়িতে আদিতকে ওঠাতে গিয়ে ,হাত চেপে ধরে ভাল করে। কিন্তু আজ আদিত বড় বায়না করছে ।গাড়িতে কিছুতেই উঠবে না। ‘আমি ওই আইসক্রিমটা খাব মাসি।‘ ‘কোন আইসক্রিম ?’ ‘ওই যে’, বলে পাশের আইসক্রিম পার্লারের শোকেসের দিকে আঙ্গুল দিয়ে দেখায় আদিত। অনেক দামি আইসক্রিম, মল্লিকা কি করবে বুঝে উঠতে পারে না। এমন তো কখনো করে না ছেলেটা, বরাবরই শান্ত। তবে আজকাল একটু জেদি হয়ে উঠেছে। আসলে মাকে বেশি কাছে পায় না তো ছেলেটা, মার ভালবাসা, মার সান্নিধ্য না পেলে শিশুদের কত কষ্ট, জানে মল্লিকা।ভালোবাসা দিয়ে মন ভোলাতে চায় ,কিন্তু পেরে ওঠে না আদিতের জেদের কাছে। ‘আমি আইসক্রিম খাবই, এনে দাও না মাসি।‘ ‘পরে একদিন খেও ,আজ দেরি হয়ে যাচ্ছে যে’, মল্লিকা সামলাতে চেষ্টা করে। ‘কিচ্ছু দেরি হচ্ছে না ,আমি গাড়িতে যেতে যেতে খাব। তুমি কিনে দাও না মাসি’, মল্লিকা কি করে সামলাবে ছোট্ট ছেলেটাকে, কিভাবে বোঝাবে, নিজেই বুঝে উঠতে পারে না ।আবার শাসন করতেও মন চায় না। এই ক’দিনে নিজের ছেলের থেকে আদিতের কোন তফাৎ করে উঠতে পারেনি মল্লিকা ।না শুধু নামের মিলে নয়, ওর আদিত্যের স্বপ্ন আর আদিতের বাস্তব প্রতি মুহূর্তে মিলেমিশে এক হয়ে যায় বলে। আদিত ওর ভবিষ্যতের আদিত্য । ড্রাইভার সাহেব হাত উল্টে মুখটা ব্যাজার করে বুঝিয়ে দিল এসব আবদারে ওর সায় নেই। কিন্তু ছেলেটা নাছোড়বান্দা ,আইসক্রিমটা কিনে দিতেই হবে। হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে চলে মল্লিকা মাসিকে, সেও জানে মাসি তার বড় বিশ্বাসের ,বড় আপনার। শিশুরাও স্পর্শ চেনে। ‘চলো না মাসি, চলো না ।ওই আইসক্রিমটা আমার চাই।‘ ‘আমার কাছে তো টাকা নেই সোনা,বাড়ি চল।পরে বাবা কিনে দেবেন।‘ ‘না,আমার এখনই চাই।তোমার কাছে টাকা আছে,আমি জানি।দাও না মাসি কিনে।‘ মল্লিকা চমকে ওঠে,আঁচলের খুঁটে যে কটা টাকা আছে তা তো ছেলেটাকে ডাক্তার দেখানোর জন্য।সেই টাকা কটা...।কাঁপা কাঁপা গলায় শুধু বলে ওঠে, ‘ঠিক আছে সোনা, আগে আমার হাতটা ভাল করে ধরো, দুষ্টুমি কোরোনা।‘ ‘কিনে দেবে তো?’, আদিত মাসির হাতটা শক্ত করে ধ’রে, বলে। ‘ হ্যাঁ সোনা’, মল্লিকার মনটা হু হু করে ওঠে। ছেলেটা তো মাকে সেভাবে পায়না ,আজ মাসি ওর কাছে মার মত। প্রথমবার ভালোবেসে মাসির কাছে কিছু আবদার করছে, আর মল্লিকা তা দেবে না,এ হয় নাকি? লাফাতে লাফাতে, আদিত মাসির হাত ধরে আইসক্রিম পার্লারে ঢুকে পড়ে। আঁচলের বাঁধাটা খুলে মল্লিকা জমানো খুচরো মোচড়ানো টাকাগুলো গুনে গুনে ,সোজা করে, পরম মমতায় সাজায়। তারপর ও সেই টাকাগুলো যখন একটা দামী আইসক্রিমের জন্য তুলে দিচ্ছিল আইসক্রিম পার্লারের সুসজ্জিত সেলসম্যানের হাতে ,ওর কিন্তু একটুও কষ্ট হচ্ছিল না,আফসোস হচ্ছিল না ।ছেলেকে ডাক্তার দেখানোর জমানো টাকাটা আইসক্রিম এর পেছনে বাজে খরচ হয়ে গেল ,একবারও মনে হচ্ছিল না ।খালি প্রাণভরে দেখছিল আদিত্য থুড়ি আদিতের পরম তৃপ্তিতে আইসক্রিম খাওয়া।আসলে মল্লিকা যে মা।

5 March 2018

শেষ সম্বল

পোড়ো স্কুলবাড়ির গা দিয়ে যে রাস্তাটা নতুন কলেজ বাড়ির দিকে চলে গেছে, সেখানে সন্ধ্যার পর কেউ পারতপক্ষে পা রাখে না। কেমন একটা গা ছমছমে ব্যাপার। দিনের বেলা গেলে দেখা যায়, স্কুলবাড়িটা ভেঙেচুরে একদিকে ধ্বসে গেছে, পাঁচিল বলেও কিছু আর অবশিষ্ট নেই। বড় বড় গাছের শেকড় আর ডালপালা আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রয়েছে বাড়িটাকে। রাস্তাটাও নির্জন, দু'পাশে রাজ্যের আগাছা। বড় বড় গাছপালা দিয়ে ঘেরা বলে জায়গাটা একটু ঠান্ডা, শিরশিরে। তার সঙ্গে অজানা একটা ভয়ের অনুভূতি। একা বেশীক্ষণ থাকা যায় না এদিকটায়। সেদিন দুপুরে, ওপাশের লাহাবাড়ির সবচেয়ে ডানপিটে দুই ছেলে বুবু আর তুতু এই পোড়োবাড়িতেই ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছিল। ওদের কোন ভয়ডর নেই, দুরন্ত দুপুরে খালি অ্যাডভেঞ্চারের নেশা। বাড়িতে মা ঘুমোলেই, কোন ফাঁকে ওরা দু'জনে পালিয়ে চলে আসে এখানে। স্কুলবাড়ির কোনে কোনে দামাল পায়ে ছুটে বেড়াতে লাগল ওরা। হঠাৎ ভাঙা ঘরগুলো পেরিয়ে, খোলা উঠোনটায় পড়তেই দুজনে চমকে উঠল। বুবু বলল ‘দেখ তুতু, কুয়োধারে কার যেন কাপড় শুকোতে দেওয়া আছে না?’ তুতু বলল, ‘চল তো গিয়ে দেখি। এখানে তো কখনও কেউ আসে না।' কাছে যেতেই একটা লাঠির একটু অংশ দেখা যেতে লাগল।বুবু তুতু খুব সাবধানে পা টিপে টিপে, একটু ঘুরে কুয়োতলার দিকে এগিয়ে যেতেই ওদে বুকদুটো হঠাৎ ধক্ করে উঠল।কার যেন পা দেখা যাচ্ছে কুয়োর আড়ালে। কোন সাড়াশব্দ নেই। 'এটা কে-কে শুয়ে আছে রে, তুতু?', ভয়ে বলে উঠল বুবু। 'আমি জানি না, চল পালাই', বলেই দৌড় দিল তুতু। পিছনে বুবুও। দৌড় দৌড়। পোড়ো বাড়িটার গেটের ভাঙ্গা থামদুটো পেরিয়ে, ডানদিকে বেশ কিছুটা প্রাণপনে ছোটার পরে শিমুলতলায় হারুর সাইকেল সারাইয়ের দোকান। বুকটা তখনও ওদের হাপরের মত উঠছিল নামছিল। বিকেলে সবেমাত্র হারু খুলেছে দোকানটা, খদ্দের আসাও শুরু হয়েছে। হারু ওদের মুখে সব শুনে, চোখ কপালে তুলে বলল, ‘করেছ কি তোমরা? ওই ভূতের বাড়িতে ঢুকেছ এই অবেলায়! সর্বনাশ! বাড়ি যাও এখুনি, নাহলে কিন্তু সব বলে দেব রমেনদাকে। ‘রমেনদা' তুতুর বাবা, বুবুর জ্যাঠা। দুজনেই যমের মত ভয় করে এই রাশভারী ভদ্রলোকটিকে। বেগতিক দেখে, দুজনেই গুটিগুটি রওনা দেয় বাড়ির দিকে। হারুর কোন ভয়ডর নেই, পেটানো চেহারা। সবাই বলে, ওর মত বেপরোয়া সাহসী অথচ পরোপকারী ছেলে আর দুটি হয় না। পড়াশোনাও ঠিকঠাকই করত। কিন্তু বাবা হুট করে মরে যেতে, সেসব ছেড়ে দিয়ে বাধ্য হয়েই এখন ওকে পেটের দায়ে দোকানটা চালাতে হয়। হঠাৎ একটা ব্যাপারে হারুর কেমন যেন খটকা লাগল। কে যেন শুয়ে আছে পোড়ো বাড়িটায়, বলছিল না ছেলেদুটো! ফালতু কল্পনা নয়তো? দোকানের ব্যস্ততার মধ্যেও কথাগুলো কিন্তু ও ভুলে উড়িয়ে দিতে পারল না। অ্যাডভেঞ্চারের নেশা ওরও কম নেই। ব্যাপারটা কি একটু খতিয়ে দেখা দরকার। কেউ ঘাঁটি গাড়েনি তো ওখানে চুপিসাড়ে? বা কোনও অঘটন! একটা পাংচার আর দুটো চাকা হাওয়া দেওয়া সারা হলে, ফুটবল পাম্প দিতে কলোনির ছেলেগুলো এল। রাস্তার ওপাশে পুকুরধারে বিশাল খেলার মাঠ। হারুও সময় পেলেই ওদের সঙ্গে একটু আধটু ফুটবল খেলে। হারু ঠিক করল এদের দলেই ব্যাপারটা বলে দেখা যাক। 'শোন, পুরোনো স্কুল বাড়িটাতে কে যেন লুকিয়ে আছে শুনলাম, যাবি না কি দেখতে?', হারু ওদের বলল। হারু ওদের মধ্যে খুব পপুলার, সবাই হারুদা বলতে অজ্ঞান। বয়সে বড় বলে, ওরা খুব মানেও ওকে। সেই হারুদা যখন বলছে, নিশ্চয়ই কিছু একটা ব্যাপার আছে। সুতরাং, যা শোনা তাই কাজ। দু'একজন যদিও বা একটু গাঁইগুঁই করছিল, 'কি হবে বাবা ওখানে গিয়ে, ভূতের বাড়ি' বা 'না বাবা, ওখানে সাপখোপের আড্ডা, এখন যাব না', এসব বলে, কিন্তু সমর,পলাশ,কাত্তিক সব মাথাগুলো এক পায়ে খাড়া। সুতরাং ভিতুদের প্রতিরোধ ধোপে টিঁকল না। প্রবল অত্যুৎসাহী ছেলেদের দল হৈ হৈ করে এগিয়ে চলল পোড়োবাড়িটার দিকে। সামনে অসীম সাহসী হারু, পিছনে দল বেঁধে চলল ছেলে ছোকরার দল। যদিও বোঝাই যাচ্ছে তারা একটু ভয় পেয়েছে, বিশেষত নির্জন নিস্তব্ধ স্কুল বাড়িটাতে ঢোকার পর হঠাৎ যখন একটা অজানা পাখি টিঁ টিঁ করে ডেকে উঠল কোথা থেকে। বুকটা একটু ছমছম করছে হারুরও। হারুর এই সাইকেল সারাইয়ের দোকানটা অনেক পুরোনো, বাবার আমলের। কিন্তু সব কাজকর্ম সামলাতেই রোজ সন্ধ্যে হয়ে যায়। তাই আগে কখনও ও এমন অ্যাডভেঞ্চারের নেশায় ঢোকেনি এই পোড়োবাড়িটাতে। আর ঢুকেই বা কি করবে? আগাছার জঙ্গলে প্রায় সবটাই ঢাকা পড়ে গেছে যে। তবো ওর মনে হচ্ছিল, কাজটা কি ঠিক হচ্ছে? বাবার মুখে শুনেছে, এককালে বেশ নামকরা স্কুল ছিল এটা। ও কিন্তু ছোটবেলা থেকেই এরকম ভগ্ন দশাতেই দেখেছে স্কুল বাড়িটাকে। কেউ কেউ বলে, অনেকদিন আগে নাকি এটা আসলে সাহেবদের বাগানবাড়ি ছিল। তখন নাকি বিশাল রমরমা ছিল এখানে। দলে দলে সাহেব মেম জুড়িগাড়ি চেপে, মাঝে মাঝেই আসত ফুর্তি করতে। সে সব পাট চুকে যাবার পর, বিধান রায়ের আমলে এখানেই চালু হয়েছিল সরকারি স্কুলটা, 'বল্লভপুর প্রাইমারি স্কুল'। তারপরে চলেছিলও সেটা অনেকদিন। কিন্তু ঐ যা হয়। সাহেবী আমলের বাড়ি, রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে আগে থাকতেই ধুঁকছিল। তারপর একদিন ঝড়বৃষ্টিতে হুড়মুড় করে ধসে গেল একটা দিক। তারপর থেকে শুধু বাড়িটাতে বট-অশ্বত্থের শেকড় আর ডালপালাই গজিয়েছে, স্কুলবাড়ি হয়ে গেছে পোড়োবাড়ি। তবু আজও খেয়াল করলে খিলানের আদল, কড়ি বরগা, দেওয়ালের নকশা করা থাম আর ছাদের কিছু ভগ্নপ্রায় পঙ্খের কাজ চোখে পড়ে। যা হোক, উঠোনটা সাবধানে পেরিয়ে, আগাছা সরিয়ে, কুয়োর দিকে গামছা শুকোতে দেওয়া আছে দেখে, সেদিকেই হেঁটে চলছিল সবাই। একটু এগোতেই দেখা গেল, একটু জায়গা পরিস্কার মত করা হয়েছে আর সেখানে সত্যিই তো, একটা লাল কাপড়ের পুঁটলি আর লাঠি পড়ে রয়েছে। আরও একটু এগোতেই সবাই থমকে দাঁড়াল। দেখা গেল, ময়লা শতচ্ছিন্ন কাপড় পরে একটা বুড়ি শুয়ে আছে আকাশের দিকে তাকিয়ে, চেহারাটা শুকিয়ে কাঠ, পাকা চুলগুলো অবিন্যস্ত। চোখের দৃষ্টিটা স্থির, বড় ভয়ঙ্কর। দাঁতগুলো বিশ্রীভাবে বেরিয়ে আছে, তাকালেই বুকটা হিম হয়ে যায়। এবারে দল বড় হওয়ায় কেউ আর পালাল না ঠিক, তবে সকলেরই মুখ ভয়ে শুকিয়ে গেছে, চাপা স্বরে নানা প্রশ্ন, ফিসফাস চলতে লাগল। কে এই বুড়িটা? মরলই বা কি করে? পোড়ো বাড়ি বলে তো ঢুকতেই সবাই ভয় পায়, তবুও এল কি করে বুড়িটা! কেনই বা এল! কিই বা আছে পুঁটলিতে? খবরটা চাউর হতে সময় লাগল না। তার পরেই থানা,পুলিশ,লোকজন,ভীড়ভাট্টা। সন্ধ্যে হবার আগেই পুলিশ উঠিয়ে নিয়ে গেল বডি। সঙ্গে লাঠি,গামছা,পুঁটলি। বুড়িটা নাকি মরেছে বেশ ক'দিন আগে। এমনই চামড়াসর্বস্ব হাড় জিরজিরে শরীর, যে মরে তেমন গন্ধটুকুও বেরোয়নি। আহারে, কতদিন বুঝি খেতে পায়নি বেচারা। কিন্তু বুড়িটা কে? কোনদিন তো আগে কেউ দেখেনি এ তল্লাটে! দোকানটা আর খুলল না হারু। তারও মনটা কেমন যেন ছমছম করছে। সন্ধ্যে হয়ে এল, আলো পড়ে এসেছে বেশ। বাড়ি ফিরে মাকে বলতে হবে ঘটনাটা। নিজের সাইকেলটার হ্যান্ডেলে হাত রাখতেই হারুর শিরদাঁড়া দিয়ে নেমে গেল একটা ঠান্ডা স্রোত। সাইকেলের কেরিয়ারে একটা লাল পুঁটলি বাঁধা, ঠিক ওই রকমই।

4 March 2018

একটি সামান্য দিন গুজরান

বন্ধু কাকে বলে?এই যে আমার হাতের মোয়া উঠতি মেয়েটাকে বিকেলবেলা আইসক্রিম খাইয়ে নিতাই হাতড়ে নিয়ে চলে গেল, এটা কি বন্ধুর কাজ?অনেক কষ্টে রংকলের ফর্সা মেয়েটাকে পটাতে পেয়েছিলাম।শালা নিতাই চুল ঘুরিয়ে, ড্রেস মেরে, আমার হাতে হ্যারিকেন করে দিল। ওকে আমি দেখে নেব। কিন্তু ওর সঙ্গে কি আমি পারব? বাবার চলতি মুদীখানার জোরে ব্যাটার পয়সা আকাশে উড়ছে।আমি তো ওর মত আজ আইসক্রিম,কাল আলুকাবলি,পরশু টিপের পাতা কিনে খরচা করতে পারব না!আমার বাপটা তো জন্মভিখিরি।শিবুদার দোকানে পার্টটাইম কাজ করে আমার যা জোটে ,সে তো বিড়ি ফুঁকেই উড়ে যায়।নাঃ,এবার একটা কাজের চেষ্টা করতে হবে।আগে কাজ, তার পরে মেয়ে।পয়সা ছাড়া শালা এ জীবনে কিস্যুর দাম নেই।
মাগীটা ঐ হাড়গিলে নিতাইকেই বিয়ে করুক।রোজ বাইকে চাপতে পারবে। দামী সেন্ট মেখে, চকচকে শাড়ি আর বগলকাটা ব্লাউজ পরে ঘুরে বেড়াবে। ওদের ভাল হোক। আমার জন্য কাউকে দুঃখ করতে হবে না। কোন শালা চলে গেলেও আমি ভেঙে পড়ব না। পাড়ায় নতুন নতুন মেয়ে দেখব, দোতলার বাথরুম থেকে রেশমিদের বাথরুম দেখব।পার্টি অফিসে দেবাদার পায়ের কাছে বসে থাকব।আমার দিন কেটে যাবে,ওদেরও কেটে যাবে। কিন্তু ভাবি, কি আশ্চর্য, দিনগুলো সত্যিই কি ভাবে কেটে যায়।