27 April 2020

একটু মনকেমন

মাঝে মাঝে হঠাৎ হঠাৎ মন কেমন করে,অকারণেই করে। আসলে পাগল মন তো, চোখে তাই জল জমে। কার কথা ভেবে,কে জানে? যাদের হারিয়েছি, যাদের অনেক খুঁজেও আর পাইনি, হয়ত তাদের কথা ভেবেই। কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় একা ঘুরে বেড়াই,তাকে খুঁজে পাই না। আকাশে মেঘ করে ,একটানা বৃষ্টি শুরু হয়, জল জমে রাস্তায়। রাস্তায় একা আমি, লোকজন কম। পাশাপাশি,ঘেঁষাঘেঁষি সব বাড়ি, বড় আদরের মনে হয় সব,বড় চেনা যেন। কেউ কি মুখ বাড়াবে কোন বাড়ির জানলা খুলে? কেউ কি আসবে উল্টো দিক থেকে হেঁটে? এত ভিড়ে কোথায় খুঁজব তোমায়? তুমি তো জান না, এতদূর আমি চলে এসেছি, শুধু তোমায় খুঁজতে। তুমি কিছু জানলেও না। আমি চলে যাচ্ছি, আর হয়ত আসব না কোনদিন এখানে। এই মনকেমনও মরে যাবে একদিন ।তবুও কিছু  কি থেকে যাবে?
           মানুষ আর প্রকৃতি ,এই  দুইকে চেনার, জানার শেষ নেই, এই নিয়েই তো পথ চলা। পুরনো দিনের স্মৃতি নিয়ে আজকের  আবেগ সেজে ওঠে। কখনও, মনে হঠাৎ খুব ভালো লাগা এসে জড়ো হয়। ঠোঁটের কোণে একটু হাসি । ভোরবেলা  আকাশ আলোয় আলোয় ধুয়ে যায়, নানা  রঙে সেজে ওঠে ।  পাখিরা ডেকে ওঠে। আমার তো মনে হয় পৃথিবীর এত কালিমা সত্বেও আজও ভোর হয়, শুধু পাখিদের মুখ চেয়ে। আর কেউ কিছু নয়, সব নিমিত্ত মাত্র। আসা যাওয়ার এই ছোট্ট জীবনে, এই মনকেমন টুকুই শুধু নিজের, সেই নিয়েই বেঁচে থাকা।
             যারা চলে গেছে, তারা আর আসবে না ।তবু সেই স্মৃতিই তাড়া করে বেড়ায়, আজও। ছাদে উঠে খোলা হাওয়ায় দাঁড়াই।চারিদিকে অনেক দূর অবধি দেখা যায়। কোন দিকে তোমার বাড়ি? কোন দিকে তার বাড়ি? তার? তার? খুঁজে পাওয়া যাবে না জানি। শুধু খোঁজা, সেটার কোন শেষ নেই। সেইসঙ্গে একটু ভালোবাসা। ভালোবাসার তো  আর  কোন শেষ নেই, একজনকে দিয়ে দিলে তা ফুরিয়েও যায় না ।এর সমুদ্রে প্রতিমুহূর্তে ঢেউ ওঠে, পাড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে, ভাসিয়ে নিয়ে যায় । সেইসব নিয়েই রয়েছি আর কটা দিন,এর থেকে মুক্তি নেই। এরা আমাকে ঘিরে রয়েছে, জড়িয়ে রয়েছে, পৃথিবীতে বেঁচে থাকার একটা মানে খুঁজে দিয়েছে।এতেই আমি খুশি।

26 April 2020

নো ম্যানস ল্যান্ড

    আমার ছোটবেলার অনেকটা সময়ই কাটত মামাবাড়ি শোভাবাজার রাজবাড়িতে ।গ্রে স্ট্রীটের ধারে রাজা কালীকৃষ্ণ স্ট্রিট ,সেখানেই ছিল পেল্লায় মেজরাজার বাড়ি। বিশাল দোতলা বাড়ি ,কত শরিক, বড় উঠোন, নাচঘর, পড়বার ঘর,  বিশাল ছাদ,বড় বড় অয়েল পেন্টিং,ঝাড়লন্ঠন,দামি দামি আসবাবপত্র ,আরও কত কি।বনেদি আদব-কায়দা,দারুন খাওয়া দাওয়া,আর হৈ হৈ-এর মধ্যেই আনন্দে কেটে যেত দিনগুলো।তবে সবচেয়ে আনন্দের ছিল, রহস্যময় সেই বাড়িটার কোণে কোণে আমার একলা দুপুরে ঘুরে বেড়ানো।আমার ছোটবেলার স্বপ্নময়,মায়াময় দিনগুলোর কত যে স্মৃতি এখানে রয়ে গিয়েছে, তার শেষ নেই। কৈশোরের কত কল্পনা আর ভাবনার রসদ ছিল এই বাড়ি। শুধু তো একটা বাড়ি নয়,এ ছিল আমার গোটা ছোটবেলাটাই।
    আজ সে বাড়ি আর নেই।কালের নিয়মে যা হয় আর কি।ভগ্নপ্রায় বাড়িটা শরিকি বিবাদে,শেষে প্রোমোটারের লোলুপ হাতে গিয়ে পড়ল।তাই সে বাড়ি আজ ঝাঁ চকচকে চারতলা ফ্ল্যাটবাড়ি।ভেঙে ধূলিসাৎ হয়ে গেছে আমার ছোটবেলার স্মৃতিবিজড়িত বাড়িখানি ,সেইসঙ্গে সেই সব রহস্যময়,রোমাঞ্চকর দিনগুলোও।
    মামাবাড়ির অনেক  রহস্যের মধ্যে, একটা বড় রহস্য ছিল, সে বাড়ির লাগোয়া একটা সরু গলি।এতটাই সরু, যে একজনের বেশি দু’জন পাশাপাশি হাঁটা যায় না।মামাবাড়ির পাশেই যে দোতলা বাড়িটা নতুন উঠল, তাকে আমরা বলতুম ‘হলুদবাড়ী’, তার রঙের জন্য। তো সেই বাড়ি আর আমার মামাবাড়ির মাঝখানেই ছিল সেই সরু গলিটা। সেই ছিল আমাদের ছোটবেলার ‘নো ম্যানস ল্যান্ড’।
    হলুদ বাড়িটা ওঠার আগে ওখানে একটা পোড়ো বাড়ি ছিল।আমি জানতাম সেটা ছিল ভুতের বাড়ি। সেই বাড়িতে  থাকত এক ভয়ঙ্কর তান্ত্রিক, কি সব সাধনার জন্য, সে নাকি সাতটা মড়ার খুলি পুঁতে, বেদীতে বাঁধিয়ে রেখে দিয়েছিল। আমরা ছোটরা মাঝে মাঝেই সেসব দেখতে চাইতুম বলে,ওই গলিপথে যাবার একমাত্র রাস্তা, যেটা ছোটমামাদের রান্নাঘরের পিছন দিকে ছিল,সেটা দাদুরা কষে বন্ধ করে দিলেন।দরজাটাও আলমারি-টালমারি কিছু দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছিল।
    তবু আমার উৎসাহের অন্ত ছিল না।বাইরের কলঘরের জানালাটা বন্ধই থাকত, কিন্তু বিশাল জানলাটার ফাঁকফোকর দিয়ে ওই গলিটা দেখা যেত।পরে যখন দোতলা বাড়িটা হল,তান্ত্রিকও পাশে কোথায় যেন পাট চুকিয়ে চলে গেল।তবুও,ওই বাড়ির লোকজনই কালেভদ্রে গলিটা ব্যবহার করত।আমার দাদুরা তাতে কোনদিন কোন অধিকার ফলায়নি,সে মাথাব্যথাও ছিল না।
    শুধু কলঘরের জানলার ফাঁক দিয়ে দেখা যেত সেই নো ম্যানস ল্যান্ড, আমার ওয়ান্ডারল্যান্ড, সেই রহস্যময় গলি। শুনেছিলুম, গলিপথে বেরিয়ে আর একটা দরজা খুলে সরাসরি গ্রে স্ট্রীটে পড়া যেত ।যাহোক তান্ত্রিক , ভুত, মড়ার খুলি আর নিষিদ্ধ গলি-এসব  আমার কিশোর মনে নানা উন্মাদনার  সৃষ্টি করেছিল, উৎসাহের কোন অন্ত ছিল না।সে বয়সে কল্পনা আর বাস্তব কখনো কখনো মিলেমিশে একটা অদ্ভুত গল্পের জগৎ তৈরি করত।আমার ছোটবেলার একটা বড় অংশই ছিল ,এসব নিজস্ব কল্পনা আর ভাবনার স্রোতে ভেসে যাওয়া ।
    একদিন কি কারণে যেন কলঘরের বড় জানলাটা খোলা হয়েছিল। আমি দেখে নিয়েছিলুম, যে ওই জানলা খুলে একজন অনায়াসেই বেরিয়ে পড়তে পারে গলিটাতে।ব্যাস আর যায় কোথায়! একদিন নির্জন দুপুরে সেই সুযোগটাই কাজে লাগালুম।মা ঘুমোচ্ছে দেখে, বাথরুমে যাবার নাম করে, নীচের কলঘরে ঢুকে হাঁসকল দিলুম।তারপর অনেক কষ্টে, কায়দা  ক’রে জানলাটা খুলে ফেললুম।ব্যাস, আমার সামনে সেই রহস্যময় নো ম্যানস ল্যান্ড উন্মুক্ত হয়ে গেল।টুক করে লাফিয়ে নেমে পড়লুম। নীচে চারিদিকে ডাঁই করে রাখা জন্জাল, গোটা  গলিটাই বেশ নোংরা,এখানে ওখানে আগাছা জন্মেছে, নুড়ি-পাথর পড়ে আছে।খিড়কি পথ বলে খুব একটা ব্যবহারই হয় না, পরিষ্কারও কেউ করে না। খেলার সময়, আমাদের ছাদ থেকে ক্যাম্বিস বল অবশ্য কয়েকবার পড়ে গিয়েছিল এই গলিটাতে,তবে আর ফিরে পাওয়ার কোন প্রশ্নই ছিল না। আজ এতদিন পরে সে কি আর খুঁজে পাওয়া যাবে? তবু ভাবলুম একটু খুঁজেই দেখি না।আর সেইসঙ্গে গলিটাও ঘুরে দেখা হয়ে যাবে, যদি রহস্যময় কিছু পাওয়া যায়। হঠাৎ দেখি একতলার একটা জানলা দিয়ে একটা দাড়িওলা বুড়ো জুলজুল করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।বুড়োটাকে দেখেই ভয়ে আমি পালিয়ে যেতে  গেলুম। একে তো দুপুরে অ্যাডভেঞ্চারের নেশায় এক নিষিদ্ধ রাজ্যে ঢুকে পড়েছি, মনটা ভয়ে দুরদুর করছে, ওদিকে আবার ওরকম একটা বেঢপ বুড়ো আমাকে চুপচাপ দেখে যাচ্ছে,অথচ কিছুই বলছে না,কে রে বাবা। কিন্তু পরক্ষণেই ভাবলুম,ধুর, পাগল-টাগল হবে হয়তো। সাহসটা একটু বেড়ে গেল।
    পালিয়ে না এসে আবার ঘুরেফিরে জায়গাটা ভাল করে দেখতে লাগলুম।অবশ্য খুঁজেপেতেও সেই সাতটা নরকরোটির চিহ্নও দেখতে পেলুম না ।তখনই দেখলুম এক কোণে কয়েকটা সিমেন্টের স্ল্যাবের আড়ালে একটা সুন্দর কাঠের বাক্স পড়ে আছে, তার মুখ আঁটা। যাহোক বল টল যখন খুঁজে পাওয়া গেলই না, ভাবলুম বাক্সটা একবার খোলার চেষ্টা করি, যদি কোন গুপ্তধন পাওয়া যায়।এই নোংরার মধ্যে বাক্সটা এলই বা কোথা থেকে? আসলে গোয়েন্দা আর অ্যাডভেঞ্চার গল্পের বইয়ের পোকা ছিলুম, রাতদিন সেসবই মাথায় ঘুরঘুর করত।বাক্সটাতে হাত দিতেই,বুড়োটা আমার দিকে কটমট করে তাকাতে লাগল, আর মুখটা লম্বাটে করে,দুলিয়ে দুলিয়ে অদ্ভুত একটা আওয়াজ করতে লাগল। এবার সত্যিই ভয় করতে লাগল।বুড়োটারই হবে হয়তো বাক্সটা, তাই ওরকম করছে। যাহোক, পরের বাড়িতে ঢুকে, পরের জিনিসে হাত দেওয়াটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে ভেবে ফিরে আসার সিদাধান্ত নিলুম।তাছাড়া বেশি সময়ও ছিল না হাতে।শিগগির না ফিরতে পারলে কপালে বেদম মার জোটার কথা। ওদিকে কলঘরের দরজা ধাক্কানোরও আওয়াজ পেলুম,মনে হয়। তড়িঘড়ি ফিরে এলুম।
   লাফ মেরে জানলাটায় চেপে, আবার বাথরুমে ঢুকতে যাব, তখনই পেছন থেকে কে যেন বলে উঠল ‘যাঃ,চলে গেল। ওঃ হো, চলে গেল‘, আরো  কি সব। সেই পাগলটাই  বোধহয় ।তখন আর সেসব দেখার বা শোনার মতো সময় নেই, জানলাটা আগের মতো বন্ধ করতে না করতেই, বাইরে থেকে মার হাঁক শুনতে পেলুম, ‘সেই কখন বাথরুমে যাব বলে বেরিয়েছে,পাত্তাই নেই! কোথায় তুই?’ ‘বেরোচ্ছি’, বলে জানলাটা ঠেসে ঠিকঠাক বন্ধ করে, ভালো মানুষের মতো বেরিয়ে এলুম। মা হিড়হিড় করে টানতে টানতে নিয়ে চলল, সঙ্গে অজস্র বকুনি। দুপুরে আমার দুষ্টুমির চোখে ঘুম হচ্ছে না, বাবা এলে আজ বলতে হবে, চারিদিকে ছেলেধরা ঘুরে বেড়াচ্ছে, ইত্যাদি ইত্যাদি ।
    যেতে যেতে তখনও ভাবছিলুম, ধুর বাক্সটার ভিতর কি ছিল দেখাই হল না।ইসস্, সত্যিই যদি গুপ্তধন থাকতো!

22 April 2020

জন্মদিন

আজ সৈকতের জন্মদিন। তবে আজকাল আর এসবের খেয়াল রাখে না ও। জীবনটা তছনছ হয়ে গেছে। বাবা-মা দুজনেই মারা গেলেন, পিঠোপিঠি এক বছরের মধ্যেই। আর তার ক'দিন পরেই শ্রাবন্তীর সঙ্গে মিউচুয়াল সেপারেশনটাও হয়ে গেল। তাও এক বছর হতে চলল। তবে রুপা আসে মাঝে মাঝে, স্কুলের ছুটিতে। গোটা দিনটা ওর সঙ্গে কাটিয়ে, বিকেলেই ফিরে যায়। শ্রাবন্তীই ওকে পৌছে দিয়ে চলে যায়, কিন্তু নিজে ঢোকেনা এ বাড়িতে, নিয়ে যাবার সময়ও। দীর্ঘদিন বাক্যালাপ নেই দুজনের । আজ যে ওর জন্মদিন, সেটা অবশ্য ভোরবেলাতেই মনে পড়ে গেল সৈকতের। না, কেউই আজ এখনও বার্থডে উইশ করেনি। আর করবেই বা কে? এক রুপা ছাড়া। আসলে আজকাল বহু শপিং সাইটই জন্মদিনের মেসেজ পাঠায় সকাল-সকাল।ওর ব্যাঙ্ক, এমনকি ওর কোম্পানি পর্যন্ত। তারপর ফেসবুক খুললে তো বড় বড় করে জন্মদিনের শুভেচ্ছা। সুতরাং ভুলে থাকা আর হল না সৈকতের। যা হোক জন্মদিন বলে কথা। কত যেন হল বয়সটা ? হিসেব করতেই সৈকতের ঠোঁটে একটা দুঃখ মেশানো হাসি ফুটে উঠল। এই একবছরে শরীরের বয়স যত না বেড়েছে, মনের বয়স বেড়েছে তার বহুগুণ। একা থাকার যন্ত্রণা নিয়ে এই একটা বছর কেটে গেছে বড় অনাড়ম্বরে, আরো কত বছর যে এইভাবে কাটাতে হবে! সৈকত ভাবল, প্রথমেই মা বাবার ছবিতে গিয়ে একটা প্রণাম সেরে আসবে। যতদিন ওঁরা জীবিত ছিলেন, এটাই তো করত দিনের শুরুতে। ছোটবেলায় এই দিনটায় মা সক্কাল বেলায় ঘুম থেকে উঠিয়ে দিয়েই জন্মদিনের কথা মনে করিয়ে দিত। তারপর জড়িয়ে ধরে দু'গালে দুটো চুমু খেত, বাবাও। মা বলত,' যাও মুখ হাত ধুয়ে আগে বাবা মাকে প্রণাম করে নেবে।' সৈকতের মনটা খুশিতে নেচে উঠত, আজ স্পেশাল দিন। মা সেদিন দারুন দারুন সব রান্না করত। বাবা সকালেই এলাহি বাজার করে নিয়ে আসত। তারপর মা বানাত লুচি-আলুর দম আর বিকেলে কেক। বাবা এইদিনটা অফিস ছুটি নিত। দুপুরে নানা রকমের রান্না করে, দশটা বাটি সাজিয়ে, বড় কাঁসার পদ্মকাটা থালায় ভাত দিত মা। থালার ঠিক মাঝখানে বাটি উপুড় করে গোল শেপের ভাত। সবকটা পদ একটু করে টেস্ট করতেই হত সৈকতকে। মা বলত, 'কত কষ্ট করে সারাদিন ধরে রান্না করলুম, অন্তত একটু মুখে দিয়ে দেখ বাবা।' খেয়ে দেয়ে বাবা-মার সঙ্গে বেরোনো। হয় ছোটদের সিনেমা, নয়তো পার্কে ঘুরতে যাওয়া। এই সময়টাই ছিল ওর সবচেয়ে আনন্দের। ফেরার সময় নিউমার্কেটের বড় খেলনার দোকানে ওকে নিয়ে ঢুকত বাবা। ওর পছন্দের একটা দারুন খেলনা, তা সে যত দামীই হোক না কেন, কিনে দিত বাবা। বড় হয়ে যাবার পর আর কিছু থাক না থাক, সকালবেলা বাবা-মার চুমু আর প্রণামটা কিন্তু ছিলই। বিয়ের পরে, পুরনো ট্র্যাডিশন বজায় রেখেছিল শ্রাবন্তীও, কোন কিছুতেই ছেদ পড়েনি, রুপা হবার পরেও নয়। সবাই মিলে কত কিইনা হত সারা দিনটাতে। হইচই ,আনন্দ, উপহার, দারুন দারুন খাবার, বিকেলে ঘুরতে বেরোনো, বড় রেস্তোরাঁয় ডিনার সারা ,একেবারে জমজমাট প্রোগ্রাম। শ্রাবন্তী সারপ্রাইজ গিফট দিত একটা। আশ্চর্য ব্যাপার, সৈকত যেটা ক’দিন ধরেই কিনব কিনব ভাবছিল, কিন্তু কোন না কোন কারণে কেনা হচ্ছিল না, সেটাই শ্রাবন্তী কিনে এনে হাজির করত। একটা সাধারণ স্কুলে পড়িয়ে, জমানো সব ক’টা টাকাই হয়ত সেদিন শেষ করে ফেলত ও। বাবা-মার ততদিনে বয়স হয়েছে, ওঁনারা আর কোথাও বেরোতে চাইতেন না। তবু সকালে উঠে ওঁনাদের প্রণাম করা দিয়েই দিনটা শুরু হত। শ্রাবন্তীর আবদারে ওই দিনটা ছুটি নিতেই হত সৈকতকে। কিন্তু আজ? আজ আর কেউ নেই, কোথাও নেই। আজ একা একা জন্মদিনটা হয়ে গেছে বড়ই জৌলুসহীন, বিরক্তিকর। আজও তাই অফিস ,আজও ক্যান্টিনের ঘ্যাঁট আর মাছের ঝোল । আউটিং,শপিং, গিফট তো কবেই বন্ধ হয়ে গেছে। সময় থাকতে যদি সংসারের ভাঙ্গনটা রোখা যেত! মেনে নিত না হয় আরো কিছু, পাল্টে নিত না হয় নিজেকেও। ভুল কি আর শুধরোনো যায় না? কিন্তু রূপা? ওকে কেন ছিনিয়ে নিল শ্রাবন্তী? রুপা তো সৈকতের চোখের মণি ছিল, কি দোষ ছিল মেয়েটার? ফ্রেশ হয়ে একটা মোটামুটি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন পাঞ্জাবী পায়জামা পড়ে নিল সৈকত। আগে তো পাটভাঙ্গা নতুন পাঞ্জাবী পায়জামাই পড়ত এই দিনটায়। আগে থেকেই তা কিনে রাখা থাকত। ঠিক খেয়াল থাকত মার, পরে শ্রাবন্তীরও। আজ সেসব আর কোথায়? মা-বাবার ছবিতে ফুল দিয়ে প্রণামটা সেরে, আবার পাঞ্জাবী পায়জামা খুলে ফেলে, অফিসের জামাকাপড় পড়তে হবে। অফিস যাবার সময়ও হয়ে যাবে ততক্ষনে। ছুটি নিয়ে আর কি হবে? আজ আর পাঁচটা দিনের মতোই একটা সাধারন দিন। কাজের মেয়েটা জলখাবার বানিয়ে দেয় এসময়। রান্নাঘরে তারই ঠুংঠাং শব্দ। প্রতিবারই নতুন এক একটা ভাবনা এসে ভিড় করে মা-বাবার ছবিটার সামনে এসে দাঁড়ালে। এবারও সেই একই। মা যেন কি একট বলতে চাইছে, বাবা যেন মৃদু হেসে আশীর্বাদ করছে। 'কি বলছ মা?’, কান পেতে শুনতে চাইল সৈকত । প্রণাম করে মাথাটা তুলে অনেক কষ্টে অনুভব করার চেষ্টা করল, গালদুটো কি একটু ভিজে লাগছে? বুড়ো বাবা-মা যেমন শেষদিকে ভিজিয়ে দিত জন্মদিনের সকালে হাম খেয়ে? নাঃ, কিন্তু তার বদলে স্পষ্ট শুনল, মা যেন বলছেন ‘বাবা, এই নে, পায়েসটুকু খেয়ে নে। আজ যে তোর জন্মদিন।‘ চোখটা ভিজে গেল সৈকতের। মা? পায়েস ?কোথা থেকে আসবে? সব শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু অদ্ভুতভাবে সৈকতের নাকে তখনই ভেসে আসতে লাগল পায়েসের সুগন্ধ। কোথা থেকে আসছে ?কি ব্যাপার? পিছন ঘুরতেই চমক। একহাতে পায়েসের বাটি আর অন্য হাতে প্রসাদী ফুল-মিষ্টি প্লেটে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রূপা। স্নান করে, শাড়ি পড়েছে বলে কত বড় দেখাচ্ছে। ‘একি তুই? কখন এলি?’ সৈকত অবাক। ‘এগুলো কি?’ রুপা খিলখিল করে হেসে বলল, ‘হ্যাপি বার্থডে বাবা। এই নাও, তোমার জন্য মা পাঠিয়ে দিয়েছে।‘ মা ? আরো একরাশ বিস্ময়। শ্রাবন্তী এখনো মনে রেখেছে? রূপার হাত ধরে আবার মা-বাবার ছবিটার কাছে গেল সৈকত। মার মুখে তখন যেন এক চিলতে হাসি লেগে রয়েছে, বাবারও চোখ থেকে যেন একরাশ খুশি ঝরে পড়ছে। পাশে তাকাতে, সেই একই হাসিটা সৈকত দেখতে পেল রুপার মুখেও। মেয়ের গালে হাম খেয়ে ভিজিয়ে দিতে দিতে, সৈকতের মনে হচ্ছিল পৃথিবীতে বাবা-মা, ছেলে-মেয়ে এগুলো কোন আলাদা আলাদা সম্পর্ক নয়, সময়ভেদে মিলেমিশে সব এক হয়ে যায়।

17 April 2020

কালো পেন

কালিপদবাবু ছাপোষা মানুষ, একটা ছোটখাটো প্রাইভেট কোম্পানিতে কেরানীর চাকরী করেন। বিয়ে-থা করেননি,একা মানুষ।থাকেন বাগবাজারের পৈর্তৃক বাড়িটাতে, আর থাকে এক ঘর ভাড়াটে। শরিকি বিবাদে দীর্ঘদিন বাড়িটাতে কোন রক্ষণাবেক্ষণ হয়নি, শুধু একটা দিক কোনমতে এখনো টিঁকে আছে। ওনার শখের মধ্যে শুধু পুরোনো গ্রামাফোন রেকর্ড সংগ্রহ করা। খুঁজে-পেতে নানা পুরোনো রেকর্ড কিনে আনেন ওয়েলিংটন,সদর স্ট্রীট বা ফ্রি স্কুল স্ট্রীট থেকে। আজকাল বাইরে বেরোনো মানা বলে, সারাদিনই বাবার আমলের পুরোনো রেকর্ড-প্লেয়ারটায় সেসবই চালান। ভীমসেন যোশী,পাহাড়ী সান্যাল, গীতা দত্ত,পিট সিগার বা পালুসকরের গান তাকে নিয়ে যায় কোন না পাওয়া স্বর্গরাজ্যে। আজ মাসের প্রথম দিন। মাইনে পেয়েই কালিপদবাবু ঠিক করলেন লেনিন সরণিতে একবার ঢুঁ মারবেন জামালউদ্দিনের দোকানে। যদি কিছু মণিমুক্তো পাওয়া যায় কম দামে। দু’ তিন হাজার টাকা খরচা করে দুর্লভ অ্যান্টিক রেকর্ড কেনার সামর্থ্য তার নেই। তবু চোখের দেখা । গিয়ে দেখেন জামালের দোকান সেদিন বন্ধ। ওরও বাপ ঠাকুরদার ব্যবসা, আজকাল সব পেনড্রাইভ, মোবাইল আর ইউটিউবের যুগ,তার ওপর লকডাউন। বিক্রিবাটা প্রায় নেই বললেই চলে।তবুও কি যে মায়া-ভালোবাসা জড়িয়ে আছে পুরনো দিনের স্মৃতি ঘিরে, ওই জানে, আর জানেন কালিপদবাবু । যা হোক চলেই যাচ্ছিলেন, হঠাৎ একটা ফ্যান্সি আইটেমের দোকানে চোখ পড়ল রাস্তায়। কত সুন্দর সুন্দর ঘড়ি,শোপিস, সিগারেট কেস, টর্চ, লাইটার, নানা রকম বিদেশি জিনিস থরেথরে সাজানো দেখে, বেশ লোভ লেগে গেল কালিপদবাবুর। একটা পেনের দিকে তার নজর পড়ল, হাতে নিয়ে বেশ পছন্দ হল। চকচকে কালো মেটালিক ফিনিশ, সঙ্গে গোল্ডেন টিপ আর হ্যান্ডেল। কিন্তু যেখানে চোখ আটকে গেল সেটা আর কিছুই নয়, কালোর ওপরে গোল্ডেন কালারে খোদাই করা ইংরেজিতে ‘কালি’ নামটা, তার নামের সঙ্গে তো বেশ মিলে যাচ্ছে। হতে পারে কোম্পানির নাম। দোকানীকে জিজ্ঞেস করতে বলল জাপানি পেন, দেড়শো টাকা দাম। কিন্তু ঐ চকচকে কালো রঙের পেন আর ঐ স্বর্নাক্ষরে লেখা ‘কালি’র মোহে ততক্ষনে পড়ে গেছেন কালিপদবাবু। দরদাম আর বেশি না ক’রে, পেনটি পকেটস্থ করলেন। মনটা তার বেশ প্রফুল্ল হয়ে গেল, এতদিনে মনের মত একটা পেন পেলেন। এমন একটা মহার্ঘ জিনিস যে হঠাৎ ক’রে এইভাবে হস্তগত হয়ে যাবে, তা তিনি ভাবতেও পারেননি।ঠিক করলেন, এবার থেকে এই পেনটাই সবসময় ব্যবহার করবেন, অফিসের কাজে হোক বা বাড়িতে শখের কবিতা লেখাতেই হোক । পাড়ায় ঢুকতেই হঠাৎ দেখা হয়ে গেল পুরোনো বন্ধু অনুপের সঙ্গে। ‘কি রে কালি, কোথায় গেছলি ?’ নিজেই এগিয়ে এসে কথা বলল অনুপ। একবার শ’পাঁচেক টাকা ধার নিয়ে আর এ তল্লাট মাড়ায়নি অনুপ, কথাবার্তাও হয়নি দীর্ঘদিন। পথে-ঘাটে দু’একবার দেখা হলেও এড়িয়ে চলত। সেই অনুপই আজ নিজে এসে পকেট থেকে পাঁচশো টাকা ফেরত দিয়ে দেঁতো হেসে বলল ‘কিছু মনে করিস না রে ভাই, সেই কবে থেকে তোকে টাকাটা দেব দেব করেও দেওয়া হয়নি। একটি মাস্ক -স্যানিটাইজারের স্টল দিয়েছি, ভালই চলছে।' ‘ তাই নাকি? ভালই করেছিস, তা আসিস একদিন বাড়িতে, যা দিনকাল পড়েছে আজ আছি, কাল নেই।‘ বলে এগোলেন কালিপদবাবু। বাড়িতে ঢুকতে গিয়েই চমক, একটা বড়সড় খাম এসে পড়ে আছে। খুলে দেখেন, সেই কবে একটা কবিতা পাঠিয়েছিলেন নামী পত্রিকায়, এতদিন কোন খবরই ছিল না। ভেবেছিলেন হয়তো মনোনীত হয়নি। হঠাৎ সেই পত্রিকাই আজ এতদিন পরে ছেপেছে কবিতাটা।আজকাল ই পত্রিকার যুগেও, এই পত্রিকাটি এই আবহেও ছাপা পত্রিকা বের করছে কষ্ট করে। পত্রিকার সঙ্গে একটা হাজার টাকার চেকও পাঠিয়ে দিয়েছে। পরপর এতগুলো প্রাপ্তিযোগে কালিপদবাবু একেবারে দিশাহারা হয়ে গেলেন, হাওয়ায় যেন তিনি ভাসছিলেন । বিকেলে ইজিচেয়ারে বসে, একটা কবিতা লিখে ফেলবেন ঠিক করলেন। মনটা আজ বেশ উড়ু উড়ু। কথারা ঝাঁক বেঁধে আসছে। তার ওপর নতুন পেন। পেনটা বের করেই খেয়াল হল, আচ্ছা পেনটা বেশ পয়া তো! সবে ভাবটা এসেছে, দু-এক লাইন লিখেছেন, তখনই সবিতা আসে চা নিয়ে, সঙ্গে আজ পিঁয়াজি-মুড়ি। ওপাশে ভাড়া থাকে ওরা। সবিতার মা’ই মাঝেমধ্যে বিকেলে চা-টা পাঠিয়ে দেয়। তবে আজকাল এ বাড়ি ও বাড়ি মানুষ জনের যাওয়া আসা প্রায় বন্ধই হয়ে গেছে। ‘কিরে আজকে দারুন ব্যাপার যে, দে দে। হঠাৎ পেঁয়াজি ভাজলো তোর মা!’ বলেই ফেলেন তিনি। ‘না গো জেঠু, এতদিন আটকে থাকার পর আজ বাবা ফিরেছে না দিল্লি থেকে স্পেশাল ট্রেনে, তাই বাড়ির সবাই খুব খুশি। তোমার ছ’মাসের বাকি বাড়িভাড়াও পাঠিয়ে দিয়েছে মা। এই নাও।‘ বলে একটা খাম বাড়িয়ে দেয় সবিতা। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছেন না বাক্যহারা কালিপদবাবু। কি সব হচ্ছে আজকে! এত সব ভাল ভাল ব্যাপার একদিনেই ঘটছে কি করে? তিনি স্বপ্ন দেখছেন না তো? চিমটি কাটতে গিয়ে বিস্তর লাগল, বুঝলেন সব সত্যি। সবিতা চলে যেতে তিনি সকাল থেকে হয়ে যাওয়া ঘটনাগুলো ভাবতে লাগলেন। সবই তার পাওনা ছিল, কিন্তু আটকে ছিল। একদিনে সব একসঙ্গে হওয়াটা কি স্রেফ কাকতালীয়? ভাগ্যের চাকা হঠাৎ এইভাবে ঘুরে গেল? এই করোনা বাজারে? কালিপদবাবু আদর করে পেনটায় হাত বোলাতে লাগলেন, সঙ্গে পিঁয়াজিতে কামড়। হঠাৎ দরজায় কে যেন কড়া নাড়ল। ‘কে?’ বলে গেঞ্জিটা পড়ে দরজাটা খুলতে গেলেন। ওদিক থেকে কে যেন বলে উঠল ‘আমি, মামা’। দরজা খুলে দেখেন বড়দির ছেলে সুবিমল। ওদের সঙ্গেই তো শরিকি মামলাটা চলছে। বাড়িটা এতদিন এভাবে পড়ে আছে, না বিক্রি হচ্ছে না সারানো যাচ্ছে। সেই সুবিমল এইসময়! ‘কিরে, কি ব্যাপার?হঠাৎ?’ ‘না গো মামা। এই এলাম আর কি। অনেকদিন আসা হয়না তো। তা বাড়িটার কি দশা হয়েছে গো?’ মাস্কটা ভাল করে নাকের ওপর টেনে নিয়ে সুবিমল বলে। ‘হবে না? কি করব বল। কোর্ট-কাছারি, মামলাতেই তো সব আটকে আছে, জানিস তো।‘ ‘সেই জন্যই তো এলাম মামা। আমরা মামলা তুলে নিয়েছি। এই নাও কোর্টের কাগজ। বাড়ি এখন থেকে তোমার, তুমি যা করবে।‘ সুবিমল এক নিঃশ্বাসে বলে কথাগুলো । ‘সেকিরে? হঠাৎ কি মনে করে! আয় আয় ঘরে এসে বোস।‘ মামার গলায় উৎফুল্লতা। ‘না গো মামা, ভেতরে আর ঢুকবো না, বাইরে থেকে আসছি। জানো, আমার চাকরিটা না চলে গেছে, কাকাও মারা গেল, কি যে হবে! তার মধ্যে আর এইসব মামলা-মোকদ্দমা ভাল লাগছে না। মা যতদিন বেঁচে ছিল, মাও তো চায়নি।‘ সুবিমল সব কাগজপত্র দিয়ে চলে গেল। এও হয় ! এ যে মেঘ না চাইতেই জল। বাড়ির মামলা তাহলে মিটলো। এবারে বাড়িটাকে মনের মত করে সারানো যাবে। তিনিই এখন মালিক, বিক্রিও করে দিতে পারেন, করলে অবশ্য বড়দিকেও ভাগ দেবেন, ওদের খুব খারাপ অবস্থা। অনেকদিন ধরে তেওয়ারি বলে একটা প্রোমোটার ছুঁকছুঁক করছে। তিনি ভাল করেই জানেন এ বাড়ি বিক্রি করলে কোটি খানেকের বেশি টাকা পাওয়া যাবে। খুশিমনে কালিপদবাবু আবার ইজি চেয়ারটায় এসে বসেন। সামনে সাদা পাতাটা খোলা আর তার ওপর পেনটা রাখা। আর কবিতা লেখা হল না। আলগোছে পেনটাকে হাতে তুলে নেন তিনি, অদ্ভুত তো পেনটা! এটার মধ্যে কি জাদু আছে? কেনার পর থেকেই তো একের পর এক সুখবর! পেনটাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে থাকেন কালিপদবাবু । পরদিন সকালে কাজের মেয়ে কলি বারবার দরজা ধাক্কা দিয়েও কোন সাড়া পেল না। একা থাকে মানুষটা, কি হল! লোকজন ডেকে আনল সে, দরজা ভেঙ্গে ভেতরে ঢুকতেই খাটে শোয়া অবস্থায় কালিপদবাবুকে পাওয়া গেল। শরীরটা প্রানহীন, ঠান্ডা, অথচ মুখে কি সুন্দর একটা হাসির রেখা লেগে আছে। কেউ তো ভয়ে ঘরে ঢুকবে না, কি না কি রোগ হয়েছে। তবে ডাক্তার এসে দেখে বলল, ঘুমের মধ্যেই হার্টঅ্যাটাক। মৃত্যুকে যেন তিনি আলিঙ্গন করে নিয়েছেন খুশিমনে, হাসতে হাসতেই। ডান হাতে তখনও মুঠো করে কি একটা ধরা , কলি দেখে একটা কালো পেন। ইভিনিং স্কুলে পড়ে কলি,পেন সেও ভালবাসে। কৌতুহলবশতঃ চুপিচুপি পেনটা নিজের হাতে নিয়ে দেখে ওরই নাম লেখা আছে পেনটাতে ‘কলি’।অদ্ভুত তো! লোভ সামলাতে পারে না কলি। এ মাসের মাইনেটা গেল, কলি পেনটা ব্লাউজে গুঁজে বিলাপ করে কেঁদে ওঠে। ওদিকে ঘরে তখনও লং প্লেইং রেকর্ডটা কিসের যেন দুঃখে বিদীর্ণ হয়ে কেটে গিয়ে, বেজে চলেছে নজরুলের গাওয়া গানখানি ‘ঘুমিয়ে গেছে শ্রান্ত হয়ে আমার গানের বুলবুলি’।

9 April 2020

কবি না হলেও

রাস্তার বাঁকের মুখের বাড়িটার নাম ‘ওঁ শান্তি’, গৃহকর্তা হলেন সুখেন রায়। ভালমানুষ চেহারার মানুষটি সবসময় পিসিমার ভয়েই অস্থির হয়ে থাকেন আর রোজই কিছু না কিছু গুলিয়ে ফেলেন। এহেন সুখেন রায় একদিন একটা কবিতা লিখে ফেললেন।কিন্তু দুঃখের বিষয়, পিসিমা ঠিক জানতে পেরে গেলেন। ‘হ্যাঁরে সাখু, কি লিখছিলি রে সকাল থেকে?’বুকটা ধক করে উঠল সুখেনের। ‘ও কিছু না পিসিমা।‘ ‘কিছু না কি রে ?স্পষ্ট দেখলাম, লিখছিলি।দেখা বলছি।‘পিসিমার রক্তচক্ষু উপেক্ষা করার সাহস নেই। লেখাটা একটু পালিশ করবেন ভেবেছিলেন,তা আর হল না।ব্যাজার মুখে নিজের লেখা প্রথম কবিতাটা দেখাতেই হল। একটা নির্মল আনন্দ আর উত্তেজনায় ফুলে উঠেছিল বুকটা, সেসব এখন চুপসানোর যোগাড়। অপরাধীর মত মুখ করে পিসিমার হাতে খাতাটা তুলে দিলেন।পিসিমা ধমকে উঠলেন,’আমার চশমা নেই, পড়ে শোনা।‘ অগত্যা তাই শোনালেন। শুনতে শুনতে পিসিমার চোখমুখের রাগী রাগী ভাবটা দ্রুত পাল্টে একটা খুশি খুশি ভাব জেগে উঠল।সুখেন অবশ্য সেসব দেখতে পেলেন না।পড়া শেষ করে পিসিমার দিকে ভয়ে ভয়ে তাকাতেই,পিসিমার আবার সেই রাগীভাব ফুটে উঠল,কিন্তু আগের মত নয়।বললেন ‘সংসারের কাজকর্ম সব চুকিয়ে ফেললি তাহলে!অবশ্য করছিলিও যে কত !তা কবিতা ফবিতা না লিখে এবার একটু বাজারে বেরিয়ে পড় দিকি।’। মনটা খারাপ হয়ে গেল সুখেনের।কবিতা লেখা পৃথিবীতে যেন ঘোর অন্যায়, কাজ ফাজ না থাকলেই বোধ হয় শুধু লোকে কবিতা লেখে।আর রোজ রোজ অত বাজার করারই বা কি আছে?বাড়িতে তো মোটে জনাপাঁচেক প্রাণী।তার মধ্যে বাবা তো সারাদিন বই মুখে করে বসে আছে।সংসারের খবর রাখেনই না।যা মুখের সামনে ধরা হয় বিনা বাক্যব্যায়ে খেয়ে নেন। গিন্নি সারাদিন গানের ক্লাস নিয়েই ব্যাস্ত।তিনি তো নাওয়া খাওয়ার সময়ই পান না।আর একমাত্র ছেলে সাবু স্কুল থেকে ফিরেই কার্টুন চ্যানেল চালিয়ে বসে যায়।ওসব দেখতে দেখতেই খায়।কি খাচ্ছে সেদিকে হুঁশ থাকে না।পিসিমা নিজে তো নিরামিষ এক তরকারি ভাত আজ কত বছর ধরে খেয়ে আসছেন।তাহলে এত বাজার ,এত রান্না কিসের জন্য?ফালতু কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা খরচা।কিন্তু সেসব বোঝাবেন কাকে?পিসিমার এইরকম দোর্দন্ড প্রতাপ,বাড়ির লোকজনের এরকম উপেক্ষা,জীবনটাই নিমপাতা হয়ে গেল। সুখেনের ছেলে সাহেবের ওপর কিন্তু এত বাধানিষেধ,বকাঝকা,শাসণ কোনটাই নেই,তার সাতখুন মাফ।পিসিমা তাকে মাথায় তুলেছেন। এখন সুখেন কিছু বললেও সাবু মোটেই গ্রাহ্যি করে না,উল্টে ভয় দেখায় ‘ঠাকুমাকে বলে দেব কিন্তু।‘সুখেন চুপসে যান।ওদিকে গিন্নিও আজকাল পিসিমার ভয় দেখান।সেদিন সুখেন বলতে গেছিলেন ,’সারাদিন গানের ক্লাস না করে ছেলেটার দিকে একটু নজর দাও না।‘গিন্নি বললেন,’কেন,পিসিমা আছে তো।‘সুখেন আরও দু’এক কথা শোনাতে গিয়েছিলেন।গিন্নি তার আগেই বকে দিলেন,’সেদিন লুকিয়ে ছাদে সিগারেট খেয়েছিলে,সব জানি।পিসিমাকে বলে দেব নাকি?’ এরপর আর কথা চলে না।মানে মানে পালিয়ে এসেছিলেন। কেউ তাকে আর মানুষ বলেই মনে করে না।তার ওপর আবার পিসিমার ‘সাবু’ আর ‘সাখু’ ডাকদুটো কাছাকাছি হওয়ায় তিনি সবসময় বুঝে উঠতে পারেন না,প্রায়ই গুলিয়ে ফেলেন।ছেলেকে যা বলা হয়েছে,তা নিজে করতে গিয়ে বোকা বনে গিয়ে হাসির খোরাক হন।আবার তাকে যা বলা হয়েছে, তা ছেলের জন্য ভেবে বসে থেকে,ভয়ানক ঝাড় খান।কপালটাই খারাপ ,সব পুরো ঘেঁটে গেছে। শুধু একটু কবিতা লিখবেন ভেবেছিলেন,তাও কেউ হতে দিল না। মনের দুঃখে ডাস্টবিনে খাতাটার গতি করতে যাবেন,হঠাৎ পেছন থেকে কার ডাক,’বাবা সুখেন’। এই নামে এরকম ডাক !এ তো মা ডাকত।বিশ বছর আগে, শেষবার। ‘মা’ বলে ভুল করে ডেকে, পেছন ফেরেন সুখেন।দেখেন পিসিমা।‘খাতাটা ছিঁড়ে ফেলিস না সুখেন ।বড় ভাল লিখেছিস রে।তুই কবিতা লিখবি,যত খুশি লিখবি।কেউ তোকে বারন করবে না বাবা।‘এ কি!এ পিসিমা যে অন্য পিসিমা।সুখেন কি করবেন গুলিয়ে ফেলে, শেষে পিসিমাকে ঢিপ করে একটা প্রণাম করে ফেলেন। পিসিমাও আদরের সাখুকে বুকে জড়িয়ে ধরেন,দুজনের চোখেই তখন জল।

মণিরহস্য

রোডস ডিপার্টমেন্টের ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে সৌরনীলের পোস্টিং তখন রেশিখোলায়। জঙ্গলের ভিতরে নদীর ধারে সরকারি বিশাল বাংলো। এক সন্ধ্যেবেলা বারান্দায় বসে বসে ও সেদিন চা খাচ্ছে, সঙ্গে পবনের বানানো চিকেন পকোড়া। পাশেই জঙ্গল, কানে আসছে নদীর জলের কুলুকুলু আওয়াজ । হঠাৎ একটা বিজাতীয় মৃদু একটানা ঘড়ঘড় শব্দ ওর কানে আসতে লাগল। বাধ্য হয়েই ইজিচেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ল ও। পবনকে জিজ্ঞেস করতে বলল, ‘আর বলবেন নাইকো বাবু, নদীর ধারে মিল বসিছে।‘ -এই জঙ্গলে মিল বসেছে! আর জায়গা পেল না? তা কিসের মিল রে, জানিস না কি? -সে জানিনাকো বাবু, উদিকে যাওয়া মানা আছে। যা শুনলাম তাই কইছি। এই অন্ধকারে নদীর ধারে যাওয়া সম্ভব নয়। জায়গাটাও নিরাপদ নয়। সাপখোপ ছাড়াও হিংস্র জন্তু জানোয়ারের আনাগোনা আছে। কিন্তু এই পান্ডববর্জিত জায়গায়, এরকম নিবিড় জঙ্গলের মধ্যে, কিসের মিল বসতে পারে আর রাতের অন্ধকারে তা চালিয়ে কারই বা কি লাভ, সেটা সৌরনীলের মাথায় ঢুকল না।বরং ওর একটু খটকা লাগল। যাই হোক, পরের দিন সকালে, চা-টা খেয়ে ও যথারীতি হাঁটতে বেরোল। ঢালু পায়ে চলা পথটা সোজা নদীর দিকে চলে গেছে।বেশ কিছুটা হেঁটে গিয়ে দেখল, খানিকটা জায়গা পরিষ্কার করে দুটো তাঁবু পাতা হয়েছে, তার পাশে সার সার কটা সোলার প্যানেল, আর তারও পাশে চেয়ার পেতে বসে আছে দুজন ষন্ডামার্কা লোক। সাথে একটা গ্রে-হাউন্ড কুকুর। ওকে দেখেই কুকুরটা ঘেউঘেউ করে তেড়ে এল। অবশ্য লোকদুটো তাড়াতাড়ি কুকুরটাকে ধরে থামাল। তারপর সৌরনীলের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। ও ততক্ষনে দেখে নিয়েছে অপ্রশস্ত নদীর বুকে এপার থেকে ওপার একটা পাটাতনের ব্রিজ পাতা রয়েছে। তার মধ্যে অনেকগুলো বালতিওয়ালা চাকা ঘোরানোর ব্যবস্থা। এখন অবশ্য সেটা বন্ধ। সৌরনীল নিজের আসল পরিচয়টা চেপে গিয়ে, হেসে বলল, ‘মানে আমি পাশেই থাকি আর কি, আপনারা কোথা থেকে এসেছেন, জানতে পারি কি?’ ফর্সা ষন্ডা লোকটা বলল, ‘আমরা মাইনিং ডিপার্টমেন্টের লোক। এখানে গভমেন্ট প্রজেক্ট হচ্ছে।‘ হেসে, কিছু না বোঝার ভান করে, ওদের আর না ঘাঁটিয়ে, ও ওখান থেকে চলে এল। চারপাশটা একটু লক্ষ্য করে মনে হল, যে বেশ বড়সড় কোন কর্মকান্ড চলছে। আরো দুটো লোক তাঁবুর ভেতর থেকে মুখ বাড়িয়ে ওকে দেখছে বলেও মনে হল। মোটের ওপর ও বুঝতে পারা গেল, এখানে কিছু একটা গোলমেলে ব্যাপার চলছে, কিন্তু সেটা যে কি তা স্পষ্ট হল না। বাড়ি না ফিরে, ও সোজা চলে গেল ওর পরিচিত, স্কুলের হেডমাস্টার ব্রজেনবাবুর বাড়ি। ব্যাপারটা খুলে বলতেই উনি বললেন, ‘তাই নাকি? নদীর মধ্যে মেশিন লাগিয়ে গভমেন্ট প্রজেক্ট! বাপের জন্মেও শুনিনি মশাই।‘ পরপর ক’দিন সন্ধে থেকে গভীর রাত অব্দি, এরকম একটানা মেশিনের শব্দ চলল। হাল্কা, কিন্তু একটু কান খাড়া করলেই বেশ শোনা যায়। ডিস্ট্রিক্ট কালেক্টরেট অফিসে সৌরনীলের এক বন্ধু শুভঙ্কর কাজ করে। ব্যাপারটা খুলে বলতে, ও বলল, ’তুই আবার এসব ঝুটঝামেলার মধ্যে ঢুকছিস কেন? বরং লোকাল থানার ওসিকে ব্যাপারটা একবার জানিয়ে রাখ।‘ পরের রবিবার সকালে ওর নদীর দিকটা আর একবার সরেজমিনে দেখতে ইচ্ছে হল। ব্রজেনবাবুও সঙ্গে ছিলেন। দু’জনে নদীর দিকে বেশ কিছুটা এগিয়ে গিয়ে, একটা বড় পাথরের আড়াল থেকে সব দেখতে লাগল। দেখল একটা সাইকেল ভ্যান নদীর পাশে মাটিতে দাঁড় করানো আছে, আর তাতে কয়েকটা কাঠের পেটি ভর্তি নানা রকম নুড়িপাথর তোলা হয়েছে। এরকম সব নুড়িপাথর তো কতই এই অঞ্চলের নদীতে থাকে,ওরা রাস্তা তৈরী করতেও প্রচুর ব্যবহার করে। এদের বাক্সভর্তি করে নিয়ে যাবারই বা কি আছে! ব্রজেনবাবু বললেন ‘পাহাড় থেকে নদীতে নানারকম দামী পাথর নেমে আসে জানি। সেগুলো নানা খনিজ সম্পদে ভরা, কিছু কিছু বেশ দামীও। এগুলো সেরকমই কিছু নয় তো?’ কাছাকাছি কেউ নেই। একটু দূরে ভ্যানওয়ালা আর কালকের সেই ফর্সা লোকটা নদীর ধারে গিয়ে কি সব আলোচনা করছে। এই সুযোগ, পাথরের আড়াল থেকে বেরিয়ে সৌরনীল বাইরে গিয়ে দেখে, হাতবিশেক দূরেই এক জায়গায় ঐরকমই বেশকিছু সাদা নুড়িপাথর ডাঁই করে রাখা রয়েছে, পরে বাক্সভর্তি করা হবে বলে।ও চুপিচুপি একছুটে ওখানে গিয়ে, একমুঠো পাথর কুড়িয়ে নিয়েই, হাঁফাতে হাঁফাতে আবার পাথরের আড়ালে ফিরে এল। যাক, কেউ দেখতে পায় নি। বিকেলে সৌরনীল পাথরক’টা নিয়ে ওর বন্ধু কুণালের বাড়ি গেল। কুনাল মেটালার্জিস্ট, স্টিল প্ল্যান্টে চাকরি করে। ও পাথরটা নেড়েচেড়ে দেখে, তারপর কি একটা যন্ত্র দিয়ে একটা কোনা ভেঙে, একটা প্লাস্টিকে ভরে ফেলল। বলল, ‘মাইক্রোস্ট্রাকচার অ্যানালিসিস করতে হবে, তবে মনে হচ্ছে এটা সাধারণ গ্র্যাভেলই, খুব দামি কিছু নয়। তোকে আমি কাল জানিয়ে দেব।‘ সৌরনীলের মনটা একটু দমে গেল। তবে কি ফালতু সন্দেহ করেছিল! নুড়িপাথর মাত্র। তাহলে পবন যে বলছিল, গ্রামের লোকদের নাকি গুন্ডাদুটো ভয় দেখিয়ে রেখেছে। নদী থেকে সাধারণ নুড়ি পাথর তোলার জন্য, এত গোপনে মেসিন বসিয়ে, কেউ এত খরচা করে নাকি? ওর সন্দেহটা মোটেই গেল না, মনে হল নিশ্চয়ই এর পিছনে অন্য কোন রহস্য আছে। পরের দিন সকাল সকাল নদীর দিকে আর একবার যাবার ইচ্ছেয়,সৌরনীল ব্রজেনবাবুকে আবার ডাকতে গেল। কিন্তু সেদিন উনি আর যেতে চাইলেন না, স্কুলে বেরিয়ে গেলেন। গতকাল সন্ধ্যায় দুটো অচেনা লোক এসে নাকি ওনাকে ভয় দেখিয়ে গেছে। ‘কাজটা ভাল হচ্ছে না মাস্টারমশাই’, বলেই বাইক চালিয়ে চলে গেছে। ব্রজেনবাবু বললেন, ’কি দরকার ভাই ওদের ঘাঁটিয়ে, ঝামেলা বাড়িয়ে? তার চেয়ে পুলিশই যা করার করুক না।‘ কিন্তু সৌরনীল জানে পুলিশ প্রমাণ ছাড়া কিচ্ছু করবে না, বাধ্য হয়ে ও একাই আবার হাজির হল, বড় পাথরটার আড়াল থেকে ব্যাপারটা ভাল করে দেখবে বলে। দেখে ভ্যানওয়ালাটা ভ্যান নিয়ে তখনই রওনা দিল। নদী থেকে শুঁড়িপথ ধরে বড়রাস্তায় আসতে আসতে, ও অন্য পথ ধরে আগেই সেখানে চলে এল। ওকে ফলো করতে হবে, কোথায় যায়। চায়ের দোকানের মাধববাবুর সাইকেলটা পাশেই দাঁড় করানো থাকে। ওটা চাইতেই পেয়ে গেল। মাধববাবু একটু অবাক হয়ে বললেন, ’হঠাৎ? সাইকেল নিয়ে? কি ব্যাপার?’ সৌরনীল বলল, 'এই একটা আর্জেন্ট ওষুধ কিনতে হবে মনে পড়ে গেল।এখনই আসছি।' সাইকেলটায় চেপে বসে, একটু দূরত্ব রেখে ও ভ্যানটাকে ফলো করতে লাগল। কিছুদূর গিয়ে হঠাৎ অযাচিত ভাবেই একটা সুযোগ এসে গেল। ভ্যানওয়ালাটা ভ্যানটাকে একটা গাছের নীচে দাঁড় করিয়ে, প্রাতঃকৃত্য সারতে জঙ্গলে ঢুকল। সৌরনীলও তাড়াতাড়ি সাইকেলটাকে একটু পেছনে গাছের আড়ালে লুকিয়ে, ঝটিতি এগিয়ে গেল। উপরের প্লাস্টিকটা টেনে সরিয়ে, একটা পেটির পাথরগুলো হাঁটকাতে লাগল। বেশ কিছু পাথর সরানো হয়ে গেছে, তখনও কিছু পায়নি, শুধুই নুড়িপাথর। ও বেশ একটু দোনামনায় পড়ে গেল। হঠাৎই পেটির তলা থেকে কি যেন একটা সূর্যের আলো পড়ে, চকচক করে উঠল। তাড়াতাড়ি আরো কিছু পাথর সরাতেই ও দেখল, ঠিক যা ভেবেছে তাই। লাল নীল সবুজ সব দামী দামী পাথর তলায় লুকোনো রয়েছে। ওর কাছে পুরো ব্যাপারটা পরিস্কার হয়ে গেল। তাড়াতাড়ি আবার আগের মত করতে না করতেই, জঙ্গলের ভেতর থেকে শিস দিতে দিতে ভ্যানওয়ালার ফিরে আসার শব্দ পাওয়া গেল। আর সাইকেল অব্দি যাবার সময় নেই। সৌরনীল প্লাস্টিকটা টেনে দিয়ে, রাস্তার ধারে একটা মাটির ঢিপির আড়ালে তাড়াতাড়ি লুকিয়ে পড়ল। ভাগ্যিস ভ্যানওলা কিছু সন্দেহ করল না, সোজা রওনা দিল। ফিরে এসেই, শুভঙ্করকে ফোন করে সব জানাতেই ও বলল, ‘করেছিস কি? তোকে বারণ করলাম না? নিজের বিপদ এইভাবে কেউ বাড়ায়? দাঁড়া, আমি দেখছি।‘ আধঘন্টা পরেই সৌরনীলের মোবাইলে একটা ফোন এল। ডিস্ট্রিক্ট ফরেস্ট অফিসার সৌম্যবাবু নিজে ফোন করেছেন। ওকে অবশ্য উনি কাজের সুবাদে আগেই চিনতেন। সব খুঁটিনাটি সৌরনীলের থেকে জেনে নিয়ে উনি বললেন, ’সে কি! এ তো মনে হচ্ছে ইল্লিগাল মাইনিং এর কেস। দেখতে হচ্ছে ব্যাপারটা। আসলে এই নদীখাতে উপরের পাহাড়ি এলাকার কোন না কোন খনি থেকে হীরে, চুনী, পান্না, নীলা, গোমেদ, স্ফটিক এসব নানা দামি পাথর বয়ে আসে। অনেকে কুড়িয়েও পেয়েছে। তবে এভাবে নদীতে সেপারেটর মেশিন বসিয়ে, চেলে পাথর লুঠ আগে কখনও হয়নি। এ তো মারাত্মক ব্যাপার দেখছি!’ সৌরনীল বলতে গেল, ‘স্যার, তাহলে ওদেরকে ধরবেন না কি?’ উনি একটু রেগে বললেন, ‘যা করেছেন, করেছেন। আপনার পুলিশকে না জানিয়ে, এইভাবে এত রিস্ক নেওয়া উচিত হয়নি। জানেন ওরা কত ফেরোসাস?’ ও ঘাবড়ে গিয়ে বলল, ‘তাহলে কি হবে?’ সৌম্যবাবু বললেন, ‘ভয় পাবেন না, তবে আজকে আর আপনি বাড়ি থেকে কোথাও বেরোবেন না, আর কাউকে কিছু বলবেনও না। আমি যা করার করছি।‘ তাই সই, বেকার একটা ছুটি গেল। সারাদিন সৌরনীলের একটু টেনশনে কাটল, ফোনে ফোনেই অনেক অফিশিয়াল কাজ সারতে হল। বিকেলে কুনাল এসে হাজির, প্রায়ই ওদের দাবা খেলা আর সেইসঙ্গে জমিয়ে আড্ডা হয়। ‘কি রে, আজ অফিসে যাস নি?’, ও জিজ্ঞেস করল। ও বেশি কিছু না বলে বলল, ‘পাথরটা অ্যানালিসিস করলি?’ ও বলল, ’হ্যাঁ, তা করেছি। তোরটা তো স্যান্ডস্টোন। তবে কোয়ার্টজাইট, ফেলস্পার, লাইমস্টোন আর ডলোমাইটও থাকে নদীখাতে। আমাদের স্টিলপ্ল্যান্টে প্রচুর লাগে, রাস্তা তৈরীতেও তো লাগে, তুই তো জানিস। নদীর ধারে ওরকম পাথর হাজার হাজার পড়ে আছে। তা তুই কি করবি?’ সৌরনীল তখন বাধ্য হয়েই কুনালকে পুরো ব্যাপারটা খুলে বলল। কুনাল সব শুনে বলল, ‘শোন, এখন মনে পড়ল। তোর বাংলোয় আসতে গিয়ে তখন দেখলাম, একটা অচেনা লম্বামত লোক গেটের কাছে ঘুরঘুর করছে। তোর চেনা?’ শুনে তো সৌরনীলের বেশ ভয় ভয় করতে লাগল, কেউ কি এবার ওর ওপরও হামলা করতে পারে? ওরা কি সব জেনে গেছে? ভাবল একবার শুভঙ্করকে জানানো যাক ব্যাপারটা। কিন্তু তার আগেই, আবার সৌম্যবাবুর ফোন এল। ‘কি ব্যাপার, বন্ধুর সঙ্গে খুব দাবা খেলা চলছে বুঝি? তা, ওনাকেও সব বললেন না কি?’ সৌরনীল তো অবাক, ‘না না, মানে স্যার, আপনি কি করে জানলেন?’ উনি হেসে বললেন, ‘ওনাকে ওসব বলে ঠিক করেন নি। যা হোক বলে দিন, উনি যেন আবার কাউকে বলে না বেড়ান। আপনাকে বারণ করে দিলাম না সকালবেলা?’ সৌরনীল একটু লজ্জিত হয়ে পড়ল। উনি ফোনটা ছেড়ে দিলেন। তবে ওর স্থির বিশ্বাস হল, কুনাল যাকে দেখেছে, সে নিশ্চয়ই পুলিশেরই লোক, সাদা পোষাকে ছিল। সেদিন দাবা খেলা আর তেমন জমল না। পরের দিন ভোরেই রেড হল এলাকাটায়। পবন সকালে এসেই খবর দিল, ‘পুলিশে পুলিশে ছায়ে গেছে গো।‘ সৌরনীল অবশ্য একটু পরে অফিশিয়াল খবরটা পেল, লোকাল থানার ওসির থেকে। লোকগুলোর সঙ্গে বন্দুক থাকলেও, বিশাল পুলিশ বাহিনী ওদের কব্জা করে ফেলেছিল। পেটিগুলো সার্চ করে পাওয়া গেল, উপরে কমদামি নুড়িপাথর রেখে, তলায় দামী দামী মণিমানিক পাচার করা হচ্ছিল। স্থানীয় কিছু এজেন্টও নাকি ওদের সাহায্য করছিল। বাক্সগুলো বিভিন্ন লাক্সারি হোটেলে পাঠানো হত। তারপর জেমস্টোন ডিলারদের মাধ্যমে দেশে বিদেশে পাচার হয়ে যেত। লোকগুলোর থেকে পাওয়া গেল প্রায় পঞ্চাশ কেজি এরকম নানা মূল্যবান পাথর, যার বাজারদর কয়েক কোটি টাকা। ডিস্ট্রিক্ট ফরেস্ট অফিসার, এসডিও, পুলিশ কমিশনার সবাই থানায় ডেকে, সৌরনীলকে বাহবা দিয়ে গেলেন। কিসব পুরস্কার দেওয়া হবে বলেও জানালেন। সৌম্যবাবু হ্যান্ডশেক করার সময় হেসে বললেন, ‘একদিন যাব আপনার বাংলোয়, দাবা খেলতে। কি, অসুবিধে নেই তো?’ সৌরনীল হেসে ওনাকে নিমন্ত্রণ জানিয়ে রাখল। ওর মনটা প্রশান্তিতে ভরে গেল। শুধু একটা ভয়ানক সংগঠিত অপরাধ ধরা পড়ে সমূলে বিনষ্ট হল বলে নয়, প্রকৃতিকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করা গেল বলেও। এবার থেকে শুধুই প্রকৃতির আদি অকৃত্রিম রূপকে যে আবার নিবিড় ভাবে পাবে, এটাই তো আসল পুরস্কার।

6 April 2020

ছোটিয়া

হঠাৎ দিল্লিতে ট্রান্সফার হয়ে গেল অনীকের।ওর সফটওয়্যার কোম্পানি মাত্র তিন দিনের নোটিশ দিল, চলে যেতে হবে সল্টলেক সেক্টর ফাইভ থেকে নয়ডায়। কলকাতার ছেলে অনীক, বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে রোজ সন্ধ্যেয় একটু আড্ডা না মারলে ভাত হজম হয় না । সেখানে হুট করে একেবারে দিল্লি! একটু মুশড়ে পড়ল ও। কিন্তু চাকরি বড় বালাই, যেতে তো হবেই। বাড়িতে সবারই মন খারাপ। হয়তো মাসে একবার লং উইকেন্ডে বাড়ি আসতে পারবে, অবশ্য তারও ঠিক নেই, যাওয়া-আসার খরচে পোষাবে কি? দিল্লি পৌঁছে নয়ডায়, অফিসের কাছেই একটা গেস্ট হাউসে থাকার ব্যবস্থা করে দিল কোম্পানি। জয়েন করে কাজকর্ম বুঝে নেবার পরে,বস সৌভিকদা বলল, ‘অনীক, আজ তুই জলদি বাড়ি চলে যা ।কোম্পানির গেস্টহাউসে তো তোকে বেশিদিন রাখবে না! অফিসের কাছাকাছি দেখে একটা ঘরভাড়া খুঁজে নে এই ক’দিনে।‘ সৌভিকদাও বাঙালী, তবে অনেকদিন দিল্লিতে আছে ।মোটামুটি সব চেনে। ওই বলে দিল অনীককে, কোন এলাকায় বাড়ি ভাড়া কেমন ,কি সুবিধা-অসুবিধা, কত ভাড়া, খাবার ব্যবস্থা কি রকম ইত্যাদি। একজন দালালের নাম্বারও দিয়ে দিল, কৌশল বলে, দিল্লির লোকাল ছেলে।অনীক ফোন করতেই বলল ,’হাঁ, দাদা,বহোত বড়িয়া ঘর কিরায়েমে মিল জায়গা।হাম দিখা দেঙ্গে। সাথমে খানা ভি মিলেগা।‘ একদিন সকালে, দুজনে বাড়ি দেখতে বের হল। সবই এক কামরার ফ্ল্যাট টাইপের ।এখানে বাড়িভাড়ার প্রচণ্ড চাহিদা বলে, সব বাড়িওলাই এরকম খুপরী টাইপের ঘর আর অ্যাটাচ বাথরুম-কিচেন বানিয়ে বাড়িগুলোকে মডিফাই করে রাখে। বাড়ির বিভিন্ন তলায় এরকম অসংখ্য খুপরিতে অসংখ্য ভাড়াটে চাপাচাপি গাদাগাদি করে থাকে ,কারও একটু হাত পা ছড়ানোর উপায় নেই। দশ ফুট বাই দশ ফুট ঘর,তাতেই খাওয়া-শোওয়া-বসা সবকিছু ।এক চিলতে একটা বাথরুম আর হয়তো বা ততোধিক ছোট একটা কিচেন। পছন্দ হয় না অনীকের। নিজেদের কলকাতার বড় দোতলা বাড়িটায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অভ্যাস। এরকম ঘুপচি অন্ধকার ঘরে ও থাকবে কি করে? কয়েকটা এরকম দেখার পর, রেগেমেগে অনীক বলল ‘আমি এরকম ছোট ঘর চাইনা ।আরো একটু বড় খোলামেলা ঘর নেই?’ কৌশল হেসে বলল,’কোই বাত নেহি দাদা, চলিয়ে মেরা সাথ। কিরায়া লেকিন জাদা পড়েগা’। ‘নো প্রবলেম’ অনীক বলে দেয়।এবার বড় রাস্তা থেকে একটু ভেতরে একটা গলির মধ্যে, একটা আড়াইতলা বাড়িতে নিয়ে এল কৌশল ।বাড়িওলা একতলায় থাকে, দোতলায় ছয় সাতটা ভাড়াটে থাকে। কিন্তু আড়াইতলাটা পুরো ফাঁকা। ঘরটাও বড়, তার সঙ্গে ছাদে যাবারও রাস্তা আছে। পাশেই একটা ভদ্রস্থ বাথরুম। কিচেন নেই ,তবে ছাদে হাবিজাবি ভর্তি একটা পরিত্যক্ত ঘর ও চাইলে ব্যবহার করতে পারে। ভাড়া বিশহাজার।‘বি-শ-হা-জা-র!‘ অনীক অবাক হয়। কিন্তু কিছু করার নেই ,দশহাজারী ঘরগুলো ওর একটাও পছন্দ হয়নি ।এটা তার চেয়ে বেশ ভাল, যদিও একটু গরম হবে, কিন্তু বেশ খোলামেলা ।উপরি পাওনা, গোটা ছাদটাও ব্যবহার করা যাবে ।ছাদে দাঁড়ালেই এক ঝলক ঠাণ্ডা হাওয়ায় উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। শেষমেষ এটাই পছন্দ করে ফেলল অনীক ।অনেক দরদাম করেও আঠেরোর নীচে কিছুতেই নামানো গেল না ।এইচআরএ যা পাবে তাতে পোষাবে না, না পোষাক ।ওর বেশ পছন্দ হয়েছে ঘরটা। তারপর পুরো ফার্নিশড। ফার্নিচার, খাট-বিছানা, বড় আলমারি, ওয়াশিং মেশিন,ফ্রিজ, টিভি পর্যন্ত,সবই আছে । বাড়িওলা ইউপিরই মানুষ,নাম রাজকুমার সিং। সব ফাইনাল হয়ে গেল। কাগজপত্র, অ্যাডভান্স ,সেলামি,কৌশলের কমিশন সব মিটিয়ে অফিস চলে গেল অনীক। সর্বক্ষণের ফাইফরমাস খাটার লোক মনুয়ার সঙ্গেও কথা হয়ে গেল। ভীষণ চটপটে ছেলেটা,বলে দিল দুপুরের মধ্যেই সব ঘরদোর সাফসুতরো করে রেখে দেবে। সকালে আর রাতে খাবারও পেয়ে যাবে ঠিক সময়ে ।অনীক তো মহা খুশি,অফিস যেতে সৌভিকদাও সব শুনে বলল ‘ভাল জায়গা ,কিন্তু খাবারের ব্যাপারটা ঠিক মতো বুঝিয়ে বলে দিবি। নইলে যা তেল মশলা দেবে, তোর মুখে রুচবে না।‘ যাহোক নতুন অফিসের পরিবেশ, নতুন কলিগ, কাজের দায়িত্ব সবকিছুর সঙ্গে মানিয়ে নিতে শুরু করল অনীক। বাড়ি ফিরতে ফিরতে সেই আটটা। তারপর চান-টান ক’রে টিভি চালিয়ে ব'সে, বাড়িতে আর বন্ধুদের সঙ্গে ফোনে একটু কথা বলত অনীক। লাঞ্চ তো অফিসেই করে,তারপর সারাদিন চা-কফি খেয়ে খেয়ে পেটের বারোটা বেজে গেছে।তাছাড়া অফিসে সাতটা বাজলেই ব্রেড পকোড়া বা সামোসা টিফিন বাঁধা।তাই এ সময়টা ও কিছু খেতনা। বিছানায় হেলান দিয়ে বসে টিভি দেখত। ঠিক সাড়ে ন’টায় ডিনার পৌঁছে দিত মনুয়া। দুটো মোটা রুটি, তড়কা আর রায়তা। খেয়েদেয়ে খবরের কাগজটা নিয়ে একটু নাড়াচাড়া করতে করতেই চোখে ঘুম চলে আসত, তারপর গভীর ঘুম। সেই সকাল আটটায় ঘুম ভাঙত। টয়লেট ক’রে, দাঁত মাজা হতেই ব্রেকফাস্ট এসে যেত।আলুপরোটা,দই,আচার আর চা। খেয়েদেয়ে চান করে জামাকাপড় পড়তে না পড়তেই, বাইরে অফিসের গাড়ির হর্ন।ব্যাস,তড়িঘড়ি ছুট। এ বাড়িতে আরো কিছু অফিসযাত্রী থাকে, তাদের আলাদা গাড়ি,সময়ও আলাদা। আলাপও হয়ে গেছে ক’জনের সঙ্গে যাতায়াতের পথে ।বাঙালি কেউই নেই , সব পাঞ্জাবি আর সাউথ ইন্ডিয়ান। যা হোক, মোটের ওপর খারাপ লাগছিল না অনীকের। আস্তে আস্তে নতুন শহর,চাকরি,একা থাকা, এসবের সঙ্গে মানিয়েও নিচ্ছিল। সমস্যাটা শুরু হল সপ্তাহখানেক পর থেকে ।সেদিন অফিস থেকে আগে ফিরে আসায় বেশ খিদে পেয়ে গেছিল অনীকের। ফ্রিজটা খুলে দেখে ভেতরে মাত্র একটা কেক পড়ে আছে, বাধ্য হয়ে সেটাই গলাধঃকরণ করল। অথচ ওর পরিস্কার মনে আছে কেক ছাড়াও একটা স্যান্ডউইচ আরেকটা কোকের ক্যান ক’দিন আগেই ও কিনে রেখে দিয়েছিল । অদ্ভুত ব্যাপার, এত ভুল তো হবে না। ও তো ফ্রিজ থেকে এর আগে কখনও কিছু বের করে খায়নি। তাহলে কেউ কি চুরি করে খেল? ইঁদুর-বিড়াল তো আর ফ্রিজ খুলে খেয়ে যাবে না, তাহলে? মনুয়া তো খাবার দিয়েই চলে যায়, আর তো কেউ আসেনি কখনো। ওর একটু খটকা লাগে। পরেরদিন বাথরুমে ঢুকে অনীক দেখে সাবান-শ্যাম্পু সব যেন বেশ কিছুটা করে কম লাগছে। এইতো কদিন আগেই কেনা ,এরই মধ্যে এতটা কমল কি করে!তারপর মাপা জল,চান ক’রে সেসব কে শেষ করে দেওয়াতে,ওর সেদিন আর চানই করা হল না। আরেকদিন ওর মনে হল ঘরের জিনিসপত্র, বিছানা বালিশ কেমন যেন এদিক ওদিক করা হয়েছে ।এভাবে তো ও রাখেনি। তবে কি ও না থাকলে কেউ ঘরে ঢুকে ওর ঘর-বাথরুম ব্যবহার করে? যাহোক মনের ভুল ভেবে, ক’দিন নিজেকে বোঝাল অনীক। তার পরেও একদিন বাড়ি ফিরে দেখে ফ্রিজের খাবার আর চানের জল দুটোই শেষ,এবার খাপ্পা হয়ে গেল অনীক। বাড়িওলা রাজকুমার সিংকে ডেকে জিজ্ঞেস করতে সে বলল “নেহি নেহি দাদা, কোই আপকা রুমমে ঘুসতা নেহি। অর ফির চাবি তো আপকেই পাসমে রহতা হে।‘ কাজের লোক মনুয়া সকালে আসতে, ওকেও জিজ্ঞেস করল অনীক। মনুয়াও স্পষ্ট জানাল যে, অনীক বাড়ি না থাকলে , কেউ এদিকে আসেই না, ঢোকা তো দূরস্থান ।তবে কেউ হয়তো ছাদে গেলেও যেতে পারে, কিন্তু অনীকের ঘরে তো তালা দেওয়া থাকে ,ঢুকবে কি করে?আর কেনই বা ঢুকবে?তাছাড়া এ পাড়াতে চোরের উপদ্রব নেই বললেই চলে। তাহলে? অনীক প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে পায়না। একদিন ব্যাপারটা ভাল করে বোঝার জন্য, ইচ্ছে করে ও একটা চিকেন প্যাটিস আর একটা চকলেট পেস্ট্রি কিনে ফ্রিজে রেখে দিল। পরের দিন দেখে, ঠিক যা ভেবেছে তাই।পেস্ট্রিটা গায়েব। তারও পরের দিন দেখে প্যাটিসটাও নেই। আর একদিন ইচ্ছে করে, দুপুরে একবার বাড়ি ফিরেও পরখ করে নিয়েছে,না ঘর বন্ধ,ভেতরেও কেউ ঢুকে নেই।তাহলে? ঘরে চোর ঢুকে খাবার খেয়ে যাচ্ছে ,বাথরুমে ঢুকে সাবান-শ্যাম্পু মেখে চানও করে যাচ্ছে।অথচ ধরা যাচ্ছে না।ঢুকছেই বা কি ক’রে?এরপর ওর ওপর হামলা করলে বা চুরি-ডাকাতির মতলব করলে? ও তো একাই থাকে ,তাহলে ওর সেফটি কোথায়? অফিসে গিয়েই বস সৌভিকদাকে ব্যাপারটা জানাল সেদিন। সৌভিকদা বলল ‘তুই শিওর, তোর ঘরে কেউ ঢোকে? দরজা-জানলা ঠিকঠাক বন্ধ করে বেরোস তো?’ ‘হ্যাঁ গো, হান্ড্রেড পার্সেন্ট।‘ অনীক বলে। ‘আমি ভাল করে চেক করে দেখে, তবেই তোমাকে বলছি।‘ ‘তাহলে তো চিন্তার ব্যাপার রে। তবে, তুই ভয় পাস না,বুঝলি। আমি তোকে একটা বুদ্ধি দিচ্ছি। আমার কাছে একটা সিসিটিভি ক্যামেরা পড়ে আছে, অনেকদিন ইউজ হয় না। তোকে আমি কালই ওটা এনে দেব। তুই ঘরে লাগিয়ে রাখবি তো। সারাদিন কি কি হচ্ছে, সব জানতে পেরে যাবি।’সৌভিকদা বলে। খুব ভাল প্ল্যান। পরের দিনই অনীক ক্যামেরাটা এনে উঁচু একটা তাকের ওপর ফিট করে ফেলে। পরদিন অফিস বেরোবার সময়, সেটা অন ক’রে, দরজা বন্ধ করে বেরিয়ে পড়ে। সেদিন একটু তাড়াতাড়িই ঘরে ফেরে অনীক ।ঘরে ঢুকে দেখে, ঠিক তাই। বালিশ বিছানা যেভাবে রেখে গেছিল, সব একটু সরানো, নাটঘাট করা।পরিষ্কার কেউ তার খাটে শুয়েছে ।ফ্রিজেও খাবার যথারীতি কম।তাড়াতাড়ি তাকের ওপরের সিসিটিভিটা অফ ক’রে মেমোরি কার্ডটা বের ক’রে, ল্যাপটপে ঢোকায় ও। ভিডিওটা চালু হয়। সাদাকালো ভিডিও, কম আলোয় উঠেছে বলে একটু গ্রেনও এসেছে। কিন্তু সব বোঝা যাচ্ছে। একটু ফরওয়ার্ড করার পরেই হঠাৎ গায়ে কাঁটা দেয় অনীকের ।এ কি দেখছি ও। দেখে বড় আলমারিটা, যেটা সচরাচর ও ব্যবহারই করেনা, সেটার পাল্লাদুটো ফাঁক হয়ে গেল, ভেতর থেকে হামাগুড়ি দিয়ে একটা রোগাপাতলা মেয়ে বেরিয়ে আসল। এই মেয়েটা কোথা থেকে আলমারির ভেতর এল ! তারপর কখনো খাটে বসল, শুয়ে পড়ল, কখনো বা আয়নায় চুল আঁচড়াচ্ছে, একবার বাথরুমে ঢুকল, তারপর ফ্রিজ খুলে জল খেল, খাবার খেল, আবার খাটে কিছুক্ষণ শুয়ে রইল। তারপর বিকেল বিকেল আবার আলমারির ভেতর ঢুকে গেল। ও আসার কিছুক্ষণ আগেই।শেষদিকে অবশ্য মেমারি ফুল দেখাচ্ছিল। তবু যতটুকু দেখেছে,তাতেই ভয়ে গলাটা শুকিয়ে গেল অনীকের। মেয়েটা কে ?এত দুঃসাহস!ওর ঘরে ওর সঙ্গেই বাস করে , আর ও জানতেও পারেনি! দুরু দুরু বুকে উঠে দাঁড়াল অনীক।আজ একটা হেস্তনেস্ত করেই ছাড়বে। হাতে নিল একটা পর্দার রড, যদি আত্মরক্ষায় কাজে লাগে।একা একা ভয়ও করছে। কোনরকমে মনে সাহস সঞ্চয় ক’রে, পা টিপে টিপে বন্ধ আলমারিটার কাছে গেল ও, তারপর এক টানে পাল্লা দুটো হাট করে খুলে দিল। লাঠিটা বাগিয়ে ধরল। কিন্তু এ কি? ভেতরে তো কেউ নেই। ফাঁকা আলমারি। ভেতরে অবশ্য একজন থাকার মত যথেষ্ট জায়গা আছে, হাওয়া-বাতাসও ঢুকবে ।কিন্তু সেই মেয়েটা কোথায় গেল? এইমাত্র যে সিসিটিভি ফুটেজে দেখল ঢুকতে! ভোজবাজির মত উবে গেল নাকি? টেনশনে ঘামতে শুরু করল অনীক। তবে কি অন্য কিছু? প্রেতাত্মা, অশরীরী ? গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল।আর ভাবতে পারেনা অনীক ।এতদিন একাই শুয়েছে ঘরটাতে, কিছু জানত না বলে। কিন্তু আজ এই ভিডিও ক্লিপ দেখার পর ,এই ভূতের ভয় নিয়ে আর ও কিছুতেই শুতে পারবে না এই ঘরে। দরজাটা খুলে তাড়াতাড়ি চিৎকার করে ডাকে মনুয়াকে।মনুয়া ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে আসে, ‘কেয়া হুয়া দাদা, ইতনা চিল্লা কিউ রাহে হো?' অনীক আর মেয়েটার কথা খুলে বলতে পারে না মনুয়াকে ।কি জানি, কি মনে করবে। ব্যাচেলার ছেলে, একা থাকে ।ঘরের মধ্যে একটা মেয়ে ঢুকে পড়েছে জানলে, কেলোর কীর্তি হবে, লজ্জার একশেষ। শুধু বলে,কেউ ওরে ঘরে ঢুকেছে। শুনে, দুজনে মিলে তোলপাড় করে খোঁজে গোটা ঘরটা ।খাটের তলা, ওয়াশিং মেশিনের ভেতর পর্যন্ত। কেউ নেই কোথাও। তাহলে? রাতটা আর ঘরে থাকতে পারে না অনীক। কয়েকটা জরুরী জিনিস নিয়ে সোজা নেমে আসে দোতলায়। সোফাটার উপরই সেদিন শুয়ে পড়ল ও, ডিনার করতেও আর রুচি হল না। পরের দিন ঘুম একটু দেরিতেই ভাঙল অনীকের। আসলে রাতে নানা দুশ্চিন্তা, বদস্বপ্ন আর ভুতের ভয়ে-অস্বস্তিতে ঘুমোতে পারেনি ঠিকমতো। ভোরের দিকে একটু ঘুম এসে গেছিল, সকালে তাই উঠতে পারেনি। আজ আর অফিস যাওয়ার টাইম নেই, ইচ্ছেও হল না ।গাটাও ম্যাজম্যাজ করছে ,মনে নানা দুশ্চিন্তা। বাড়িটা ছেড়ে দিতে হবে, এইসব উটকো ঝামেলা নিয়ে কে বাস করবে? বাড়িওলা রাজকুমারজি এসে জানতে চাইল কাল কি হয়েছিল?কে ঢুকেছিল ঘরে? অনীক বেশি কিছু বলতে পারে না, প্রমাণ ছাড়া কি বলবে?তাছাড়া ভিডিও ফুটেজের মেয়েটার কথাটা বলতেও সংকোচ হয়। ওদিকে ঘরটা ছেড়ে দিলে এরকম বড়সড় ঘরই বা পাবে কোথায়?অতগুলো টাকাও জলে যাবে। কি যে করবে ?ভাবতে ভাবতে শেষে সৌভিকদাকেই ফোন করে অনীক। আজ না যেতে পারার কারণটা বলে আর বলে কালকের সমস্ত ঘটনা। শৌভিকদাও একটু চিন্তিত হয়, বলে চিন্তা করিস না, পুলিশকে জানাতে হবে। সিসিটিভি ফুটেজটা আমাকে হোয়াটসঅ্যাপে পাঠা তো।একা আর ঘরে যাবার সাহস নেই, কিন্তু বাথরুম তো যেতেই হবে ।বাধ্য হয়ে মনুয়াকে সঙ্গে নিয়ে, তবে ঘরে যায় অনীক। কাজকর্ম সেরে আবার দোতলায় ফিরে এসে, ভিডিওটা খুঁটিয়ে দেখে ও। পরিস্কার একটা দুবলা পাতলা মেয়ে, বছর কুড়ি-পঁচিশ বয়স। সৌভিকদাকে পাঠিয়ে দেয় ভিডিওটা। একটু পরেই সৌভিকদা ফোন করে।‘ঘরটা তুই ছেড়েই দে রে,অনীক।‘ ‘সেই তো ভাবছি। দেখলে ভিডিওটা?’ ‘হ্যাঁ দেখলাম। পরে বলছি তোকে। তুই বাড়িটা আজই ছেড়ে দে। আমাদের অফিসেরই তমাল যে বাড়িটায় থাকে, ওখানেই একটা ঘর খালি হয়েছে শুনলাম। তুই ওখানেই শিফ্ট করে নে।‘ ‘কিন্তু সৌভিকদা, মেয়েটা কে দেখতে হবে না? পুলিশে---‘ ‘ছাড় তোর পুলিশ ।এটা অন্য ব্যাপার। তোকে যা বলছি তাই কর।‘ সৌভিকদার গলায় কিছু একটা ছিল। অনীক ফেলতে পারেনা। লোকাল গার্জেন তো ওই, ওর কথা মতই সমস্ত কিছু করে অনীক।কিন্তু সৌভিকদা কি এমন দেখল? মনুয়াকে জলখাবার আনতে বলে ভিডিওটা আরেকবার চালায় অনীক। কিন্তু এবার যা দেখল, তাতে ওর ভয়ে অজ্ঞান হবার জোগাড় ।ভিডিও রেকর্ডিংটায় মেয়েটা এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাচ্ছে যেন অস্বাভাবিক বেশি স্পিডে। ঘরে কখনও বিছানা থেকে নেমে বাথরুমে,কখনও বা ফ্রিজ খুলে খাবার খেয়ে, জল খেয়ে, ফ্রিজ বন্ধ করে আবার খাটে ফেরত আসা, সব কিছু অস্বাভাবিক দ্রুততার সঙ্গে ঘটছে। অথচ ক্যামেরার স্পিড তো ঠিকই আছে ,টাইমও দেখাচ্ছে পাশে। তবে কি ও যা ভয় করেছিল তাই? অশরীরী আত্মার ব্যাপার? তাই যদি হয়, সিসিটিভি রেকর্ডিংই বা হল কি করে ?ভুতের কি ছবি ওঠে ?দেখতে দেখতে আরেকটা জায়গায় থমকে গেল অনীক।ওই জায়গাটা রিওয়াইন্ড করে বারবার দেখতে লাগল ও, যেখানে ফ্রিজ খোলার দৃশ্য ,সেখানে দেখা যাচ্ছে ফ্রিজ খুলতে, ফ্রিজের ভেতরের আলো আর তাকগুলো পর্যন্ত মেয়েটার শরীরের মধ্যে দিয়ে দেখা যাচ্ছে। মেয়েটা যেন ছায়া, মানব শরীর নয় ।মাথাটা ঘুরতে লাগল অনীকের, শিরদাঁড়া দিয়ে নেমে গেল একটা ঠান্ডা স্রোত ।ঠিক, সৌভিকদা এটাই দেখেছে ,এ সত্যিই ভুতুড়ে কারবার।আজই বাড়ি ছাড়তে হবে। যা দেখল এখানে তো আর থাকা যাবে না,টাকা লস হয় হোক। গায়ে কাঁটা দিল অনীকের,এ কার সঙ্গে ও থেকেছে এতগুলো দিন! কিন্তু একটা খটকা ওর গেল না। ভুতে কি ফ্রিজ খুলে প্যাটিস-পেস্ট্রি-স্যান্ডউইচ এসব খায়?অদ্ভুত তো! হঠাৎ সিঁড়ির ওপর থেকে হইচই শুনে চমক ভাঙল।বাড়িওলা রাজকুমার আর মনুয়া উপরে গেছিল সবকিছু খতিয়ে দেখতে, ওরাই চেঁচাতে চেঁচাতে নামছে। সঙ্গে ঘাড় ধরে নিয়ে আসছে একটা মেয়েকে। না, ভুত তো নয়,একটি জলজ্যান্ত মেয়েই বটে। মেয়েটা তারস্বরে কাঁদছে। কিন্তু ওরা টেনেহিঁচড়ে মারতে মারতে নামাচ্ছে মেয়েটাকে । অনীকের তো চক্ষুস্থির।আরে, এই তো সেই মেয়েটা,সেই রোগা-পাতলা চেহারা । একেই তো দেখেছে ভিডিওতে। কিন্তু এতক্ষণ কোথায় ছিল ও? ঘরে তো ছিল না। উত্তরটা মনুয়াই দিল ‘দাদা, ছত পর থি এ লেড়কি। ছত কি রসুইঘর তো আপ কভি ভি উপয়োগ নেহি কি।ইসলিয়ে আপকো পাতা নেহি চলা।ইয়ে লেড়কি ওহি পে ছুপকে রহি রইথি।অর আপকা কামরেমে ক্যায়সে ঘুসতি থি,ওভি পাতা চলা। আপহিকা টয়লেট কা খিড়কিসে, যো আপ কভি ঠিকসে বন্ধ নেহি করতে থে। এহি হে চোর দাদা,অব ইসে পুলিশমে দেনা পড়েগা।‘ মেয়েটা ততক্ষনে কেঁদেকেটে অনীকের পায়ে এসে পড়েছে। অনীক অবাক হয়ে দেখে মেয়েটাকে।সারা শরীরে অভাবের ছাপ,জটপড়া চুল, ময়লা রোগা চেহারা, ততোধিক ময়লা একটা জামা পড়ে আছে। হাড় ক’খানা দেখা যায়। আহারে, গরিব মেয়েটা খেতে,থাকতে পেত না। তাই এভাবে লুকিয়ে আসত ওর ঘরে ।ওর সামান্য ক’টা ফেলে যাওয়া খাবার খেয়ে, কাটাল কি করে এতগুলো দিন? মায়া পড়ে যায় অনীকের। ‘ভাইয়া, ভাইয়া ,ছোড় দিজিয়ে,মাফ কর দিজিয়ে’ বলে দেহাতি ভাষায় ইনিয়েবিনিয়ে কাঁদতে থাকে আর পায়ে পড়তে থাকে মেয়েটা।মনুয়া ওকে টেনে নিয়ে যেতে চায়, রাজকুমার সিং তো পুলিশে ফোন করতে যাচ্ছিল। অনীক ওদের দুজনকে থামায়।‘ছেড়ে দিন রাজকুমারজি।গরীব মেয়ে ,খেতে পায় না, পুলিশকে ডাকবেন না। কিছু তো চুরি ও করেনি,শুধু পেটের জ্বালায় ক’টা খাবারই তো খেয়েছে।‘ বাড়িতে এভাবে লুকিয়ে থেকে একটা মেয়ে এইসব কীর্তি করেছে, এটা রাজকুমার সিংয়ের ঠিক পছন্দ হচ্ছিল না। কিন্তু মেয়ে বলে কথা। সকলেই একটু থমকে যায়। অন্য ক’জন ভাড়াটেও এসে হাজির হয়। সবাই তো অবাক ঘটনার কথা শুনে। অনেকে আবার তির্যকভাবে অনীকের দিকেই তাকায়। অনীকও একটু অস্বস্তিতে পড়ে। কুড়ি-বাইশ বছরের একটা মেয়ে তারই ঘরে এতদিন আসা-যাওয়া করেছে, বাস করেছে তারই সাথে, খুবই লজ্জাজনক ব্যাপার। কে কি না শেষে ভাবে। ব্যাপারটা এখানেই ইতি হয়ে যাওয়া ভাল। ও মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করে ‘এই মেয়ে ,তোর নাম কি?’ ‘ছোটিয়া’ মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতে বলে। ‘বাড়ি কোথায়?এখানে কেন এসেছিলি?’ এসব জেরার উত্তরে, দেহাতি ভাষায় কাঁদতে কাঁদতে মেয়েটা যা বলে, তার সারমর্ম হল, রাস্তার ওপাশের বস্তিতে থাকত ওরা। বাবা দিনমজুর, মা নেই । ক’দিন আগে বাবা আর একটা মহিলাকে ঘরে এনে তুলেছে, আর দু’জনে মিলে মেরে, ওকে ঘর থেকে বের করে দিয়েছে ।ঘুরতে ঘুরতে ও পাশের বাড়িটাতে ঢুকে পড়েছিল। বাড়িতে তখন রিপেয়ারের কাজ চলছিল। ও আশ্রয়ের খোঁজ করছে দেখে দুজন মিস্ত্রি খারাপ উদ্দেশ্যে ওকে টানাটানি করেছিল।তখন ও ভয়ে, ছুটে ছাদে উঠে যায়, তারপর প্রাণ আর মর্যাদা বাঁচাতে পাঁচিল টপকে লাফ মেরে পড়েছিল লাগোয়া এই বাড়িটার ছাদে। সেই থেকে ছাদের ঘরেই লুকিয়ে থাকত, আর অনীক অফিস চলে গেলে বাথরুমের পিছনের দরজাটা, পাশের জানলা দিয়ে হাত গলিয়ে খুলে, ঢুকে পড়ত, তারপর সেখান থেকে অনীকের ঘরে ঢুকত । খিদে,তেষ্টার জ্বালায়, সারাদিন ওখানেই চান-খাওয়া করে আবার বিকেলে লুকিয়ে ছাদের ঘরে চলে যেত। কোনদিন অনীক হুট করে আগে এসে পড়লে, বাধ্য হয়ে ও লুকিয়ে পড়ত বড় আলমারিটার মধ্যে। সব শুনে অনীকের মনটা একটু হাল্কা হল। যাক বাবা, ভুত বা চোরের ব্যাপার নয়, এটুকু শান্তি। সবাই মিলে মেয়েটাকে ধরে নিয়ে গেল নিচে আর ওর থেকে কথা আদায় করে নিল ,আর কখনো এবাড়িতে যেন ও না ঢোকে। মেয়েটা ময়লা জামাটা দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে চলে গেল, একবার শুধু সিঁড়ির বাঁকে পিছনে ঘুরে,অনীকের দিকে তাকিয়ে বলল ‘থ্যাংক ইউ ভাইয়া।‘ বলেই চোখের আড়ালে চলে গেল।অনীক ভাবছিল কিসের জন্য ধন্যবাদ? ওর সঙ্গে ঘর শেয়ার করা, খাবার শেয়ার করা, বাথরুম শেয়ার করার জন্য ?না কি, পুলিশে না ধরিয়ে দেবার জন্য? মেয়েটা কোথায় যাবে, কি করবে,বাড়িতে ঢুকতে পারবে কিনা,এসব ভেবে মনটা একটু খারাপই হয়ে গেল অনীকের।একটু মায়াও পড়ে গেছে,’ভাইয়া’ বলে ডেকেছে যে । বাড়িটা তাহলে আর ছাড়তে হচ্ছে না। বরং যেন এক আপনজনের সংস্পর্শেই এই ঘরটার সমস্ত কোনাগুলো ভরে রয়েছে। সেই অনুভূতি জড়িয়ে থাকতে অনীকের আর কোনো অসুবিধা নেই । একটা মনোরম স্মৃতি থাকুক না ঘরটায়। ‘ছোটিয়া’ মৃদু হেসে ,মনে মনে বিড়বিড় করে উঠল অনীক।

3 April 2020

পাজি ট্যাক্সিওয়ালা

ধর্মতলা যাব বলে ট্যাক্সিতে চেপেছিলুম সিঁথির মোড় থেকে। কি কুক্ষণেই না সেদিন, সেই ট্যাক্সিওয়ালাটা আমার ডাকে সাড়া দিয়েছিল, কে জানে ! ট্যাক্সিতে ওঠার পরেই শুরু হল সেই অবাঙালী ট্যাক্সিওয়ালার উৎপাত। প্রথমেই আমাকে দু’তিনটে ওষুধের স্ট্রিপ ধরিয়ে দিয়ে বলল, ‘দেখুন তো, এগুলো কিসের ওষুধ ? ব্যথা কমবে?’ আমি দেখেটেখে কিছুই বুঝতে পারলুম না ।বললুম ‘কোথায় ব্যথা?’ সে বলল ‘এই ,মুখে হাতে পায়ে ।খুব লেগেছে দু’একদিন আগে।‘ আমি বললুম ‘কি করে লাগল?পড়ে  গেছলেন বুঝি?’সে নির্বিকার ভাবে বলল ‘না না, হেভি মারপিট হয়েছিল একজনের সঙ্গে ।‘ শুনে দমে গেলুম,বাপরে কি ডানপিটে ছেলে। না ঘাবড়ে  বললুম ‘ওষুধগুলো কে দিয়েছে?’ সে বলল ‘একটা ওষুধের দোকানে।ঠিকই দিয়েছে,না?’ আমি আর বেশি কথা বাড়াতে চাইছিলুম না। বললুম ‘হ্যাঁ,ঠিকই দিয়েছে নিশ্চয়ই।আমার ঠিক জানা নেই।‘ একটু পরে বুঝেছিলুম, মারপিট করাটা ঐ ট্যাক্সিওয়ালাটার একটা সহজাত প্রবৃত্তি ছিল। যাইহোক ওষুধগুলো ফেরত দিয়ে, আর বেশি সহমর্মীতা না দেখিয়ে, নিজের কাজে মন দিলুম। সেও স্ট্রিপ থেকে একটা ওষুধ ছিঁড়ে মুখে দিয়ে,জলের বোতল থেকে জল খেতে লাগল ট্যাক্সি চালাতে চালাতেই,  বেশ কায়দা টায়দা করে।নিজেই বিড়বিড় করে বলতে লাগল ‘ধুর শালা,এর চেয়ে দু ‘বোতল দারু খেয়ে নিলেই,ব্যাথা ট্যাথা সব পালাত।‘ আমি তার কথায় বিশেষ কান দিলুম না,বেশ টেনশন হচ্ছিল,কার পাল্লায় পড়লুম রে বাবা।ট্যাক্সিটা স্বাভাবিকের থেকে বেশ জোরেই চলছিল।আমি একটু ভয়ও পাচ্ছিলুম,সত্যি সত্যি ব্যাটা দারু খেয়েই ট্যাক্সি চালাচ্ছে না তো! বোতল থেকে কি খেল,কে জানে? যা হোক, টালা ব্রিজের ওপর জ্যামে দাঁড়াতে, পাশের আর এক দেশোয়ালী ট্যাক্সিওয়ালা তাকে সাবধান করে বলল ‘কি ভাই, এত জোরে, তাড়াহুড়ো করে চালাচ্ছ কেন?’ কথাটা সে ঠিকই বলেছিল । কিন্তু আমার ট্যাক্সিওয়ালা সেসব বুঝলে তো! সে উল্টে তাকেই ধমক দিয়ে বলল ‘নিজের চরকায় তেল দাও গে, আমি ঠিকই চালাচ্ছি।‘ এরপর আসল খেলা শুরু হল। সেন্ট্রাল এভিনিউতে উঠে আমার ট্যাক্সিটা আর একটা প্রাইভেট গাড়িকে ওভারটেক করতে গিয়ে তার সঙ্গে একটু ঘষা লাগিয়ে ফেলল। আর পালাবে কোথায়, ওই গাড়িটাও একে তাড়া করে আসতে লাগল,সঙ্গে অশ্রাব্য গালিগালাজ।ভয়ের চোটে এও ঊর্ধ্বশ্বাসে পালাতে শুরু করল, হলিউড সিনেমার কার চেসিং কোথায় লাগে।আমি ওদিকে ইষ্টনাম জপ করছি। কিন্তু এটা কলকাতা শহর, পালাবে কোথায়! একটু পরেই একটা ক্রসিংয়ে দাঁড়াতেই হল। ব্যাস, আর যায় কোথায়।ওই প্রাইভেট গাড়িতে যারা ছিল, তারাও বেশ হাট্টা কাট্টা টাইপের ,ছোড়নেবালা নয়,এরই মত অবাঙালী।দু’জন সঙ্গে সঙ্গে সেই গাড়িটা থেকে নেমে ছুটে এসে,ট্যাক্সির দরজা খুলে একে বের করার জন্য টানাহেঁচড়া শুরু করল।বলছিল ‘কি করেছিস,দেখবি চল।কত ক্ষতি হয়ে গেল।‘ সঙ্গে উভয়ের গালিগালাজ,কেউ কাউকে ছেড়ে দেবার পাত্র নয়। শেষে দরজা খুলে টেনে হিঁচড়ে ট্যাক্সিওয়ালাকে নামাতে যেতেই,এও পায়ের কাছে আগে থাকতে  লুকোনো একটা  রেঞ্চ বের করে, ওদের সঙ্গে লড়তে লাগল।আমি নীরব দর্শক। কিন্তু ওরা দু’জন, আর এ একা ,পারবে কেন? ওরা টানতে টানতে একে রাস্তার ডিভাইডারের কাছে নিয়ে গিয়ে পেটাতে শুরু করল। সে এক ভয়ঙ্কর দৃশ্য, আমার ট্যাক্সিওয়ালা গাড়ি ছেড়ে রাস্তায় পড়ে মার খাচ্ছে আর আমি ট্যাক্সির পিছনে কিংকর্তব্যবিমূঢ় বসে আছি। রাস্তায় জ্যাম, সব গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়েছে।দেখতে দেখতে লোক জড়ো হতে শুরু করেছে। শুনতে পেলুম কে যেন ‘পুলিশ পুলিশ’ বলে ডাকছে। জানিনা পুলিশ এসে সেই ঝামেলা মিটমাট হবে কিনা ,কিম্বা হলেও কখন হবে।সেসব জানবার আমার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে ছিল না।আমি শুধু এই ঝামেলা থেকে যেভাবে হোক পরিত্রাণ পেতে চাইছিলুম। এই অবস্থায় বোকার মত ট্যাক্সিতে বসে থাকার কোন মানে হয় না। একে তো এই ট্যাক্সিতে ধর্মতলা পৌছোনোর বারোটা বাজল, এই ঝামেলা সহজে মেটার নয়। ওদিকে ধর্মতলা থেকে দুর্গাপুরের বাস ধরার দেরী হয়ে যাচ্ছে। সত্তর টাকা মতো ভাড়া উঠেছিল। সে যাকগে,ঠিক করলুম কেটে পড়ি।যদিও ভাড়ার টাকাটা মেরে দেবার মোটেও ইচ্ছে ছিল না,কিন্তু আর কিছু করারও ছিল না,বিশেষত যাকে ভাড়া দেবার কথা, সে তখন রাস্তায় চিৎপাত হয়ে শুয়ে মার খেতে ব্যাস্ত। অযথা ঝামেলায় কে ফাঁসতে চায়? দেখলুম, এই সুযোগ, সোজা রাস্তার দিকের দরজাটা খুলে ,হাতের ব্যাগটা নিয়ে নেমে পড়লুম।ধাঁ করে দু’তিনটে গাড়ির ফাঁক দিয়ে গলে বেরিয়ে, সোজা ফুটপাতে উঠে ভিড়ে মিশে গেলুম। হাঁটতে-হাঁটতে পেছন ফিরে বারবার দেখছিলুম, ঝামেলাটা কতদূর গড়াচ্ছে বা আদৌ  থামার দিকে যাচ্ছে কিনা। ততক্ষণে রাস্তায় ভিড় জমে গেছে,কিছু বোঝা গেল না। অন্য একটা  যা হোক বাস ধরে তড়িঘড়ি এলাকা ছাড়লুম। সেই ট্যাক্সিওয়ালাটার কি  হল আর জানা হলনা ।মনে মনে বললুম,বেশ হয়েছে,যেমন কর্ম তেমনি ফল।মার খাওয়া ছাড়াও ওর সত্তর টাকা লোকসানটাকে ধরেই বললুম।