পঞ্চাশোর্ধ পাঁচ বন্ধু। ওরা ছোটবেলায় একই স্কুলে পড়েছিল, বরানগর রামকৃষ্ণ মিশন। বারো বছর একসঙ্গে কাটানোর ফলে, ওদের বন্ধুত্ব ছিল ভীষণ গভীর। কিন্তু স্কুল থেকে বেরিয়ে যাবার পর, বাধ্য হয়েই যে যার নিজের নিজের কেরিয়ার আর প্রফেশন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। এখনকার মতো তো আর সে সময় মোবাইল বা ইন্টারনেট ছিল না। তাই ওদের যোগাযোগটাও ধীরে ধীরে হালকা হয়ে এসেছিল। প্রথম প্রথম কিছুদিন চিঠি-চাপাঠি চলেছিল ঠিকই, তারপর ধীরে ধীরে সে সবও বন্ধ হয়ে গেল। জীবনসংগ্রামে আর কেউ কারো সেভাবে খবর রাখতে পারেনি।
পাঁচজনের স্বভাব চরিত্র কিন্তু ভীষণ আলাদা রকমের। কেউ বা পড়াশোনায় খুব ভাল ছিল, কেউ ভাল ছবি আঁকত, কেউ ছিল দুরন্ত বাউন্ডুলে প্রকৃতির আবার কেউ বা পড়ার ফাঁকে ফাঁকে লুকিয়ে কবিতা লিখত। প্রত্যেকেরই এক একটা নিজস্ব সত্বা, নিজস্ব আলাদা জগৎ ছিল। কিন্তু তাতে তাদের বন্ধুত্বে কোন ছেদ পড়েনি। এমনকি বহুদিন দেখাসাক্ষাৎ, যোগাযোগ না থাকলেও। কিন্তু বয়সের ভারে ক্লান্ত হয়ে পড়ার মুখে, হঠাৎ একদিন আবার এই পাঁচ বন্ধুর দেখা হয়ে গেল।
অনেকদিন পরে পুজোতে, ললিত জার্মানি থেকে দেশে ফিরেছে। ওদিকে ললিতের সঙ্গে বিভাসের একটা যোগাযোগ আগে থেকেই ছিল। ললিতের ভাইপো বিভাসের কাছেই পড়ে, বিভাস সিটি কলেজের বাংলার অধ্যাপক। ললিতের দেশে ফেরার খবরটা বিভাসই ফোনে জানিয়েছিল আরেক বন্ধু বসন্তকে। শুনেই বসন্ত এক পায়ে খাড়া, দেখা হবে সপ্তমীর দিন।
সেদিন বসন্ত ওদের আরেক বন্ধু শঙ্করকেও তাই সঙ্গে করে যেন খোঁজ নেওয়ার ঠেলাগাড়ি কে ঘিরে ওরা নিয়ে এসেছে, দুজনে একই পাড়ায় থাকে। এসে দেখে, আগে থেকেই সেখানে দীপক এসে হাজির। দারুন ব্যাপার, অনেক দিন পরে সকলে একসঙ্গে হওয়া গেল। দীপক এখন বাঙ্গালোরে থাকে, তবে প্রতিবছরই পুজোয় কলকাতায় আসে। ললিতের সঙ্গে নাকি কালই ওর হঠাৎ নিউমার্কেটে দেখা হয়ে গিয়েছিল। এই গেট-টুগেদারের কথা শুনতে পেয়েই ও ছুটে এসেছে, কাল নাকি আনন্দে সারারাত ঘুমোতেই পারেনি। একটু পরে বিভাসও এসে জুটল।
বহুদিন ছাড়াছাড়ি, সকলেই অনেকটা বদলে গেছে। অন্তত সকলেই সকলকে এ কথাটা বারবার বলেছে, কিন্তু কেউ সেটা স্বীকার করেনি। কেউই নিজের নিজের অতীতটা ভুলে যায়নি। সেই সোনালী দিনগুলো আজও ওদের মনের চোখে জ্বলজ্বল করছে। যেন হজমিওলার ঠেলাগাড়ির চারপাশে ওরা পাঁচ বন্ধু দাঁড়িয়ে আছে।
হাজার কাজের মধ্যে কবিতা লিখত যে দীপক, সে এখন আর অবসরই পায়না। পড়াশোনায় খুবই ভাল ছিল, অথচ ও এখন একটা ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানির সেলসম্যান হিসেবে চাকরি করে, চাকরি বাঁচাতে এত ছুটতে আর ঘুরতে হয়, যে কবি মনটাই বোধহয় মরে গেছে। দুষ্টু, দুরন্ত যে ছেলেটা সবাইকে ছোটবেলায় মাতিয়ে রাখত, যার ভয়ে সবাই সবসময় তটস্থ হয়ে থাকত, সেই শঙ্করের মাথায় এখন চকচকে টাক। বয়সের ছাপ ওর মধ্যেই যেন সবচেয়ে বেশি পড়েছে। ললিত কোনদিনই পড়াশোনায় ভাল ছিল না, ছোটবেলাতেই বাবা-মাকে হারায়। দয়া করে সামান্য একটা জামা-কাপড়ের ব্যাবসায় ঢুকিয়ে দিয়েছিল জ্যাঠা। আজ সেই ব্যাবসাই ফুলেফেঁপে তিন তিনটে দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। আজ ও কোটিপতি।
তবু, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থান যার যাই হোক না কেন, কেউ কাউকে ভোলেনি। স্কুলফ্রেন্ড বলে কথা, বন্ধুত্বের ভালবাসার টানটা রয়ে গেছে সেই একই রকম। সপ্তমীর দিন বিকেলে ললিতের বাড়িতে ওদের জমাটি আড্ডা চলছে। ছোটবেলার টুকরো-টাকরা নানা ঘটনার স্মৃতিচারণ চলছে, পুরনো দিনের গল্প একবার শুরু হলে কি আর শেষ হতে চায়? চল্লিশ বছর আগেকার কথা, তবু হেডস্যার মহারাজের ঘরে ঢিল মারার গল্পটা সকলেই অল্পবিস্তর মনে করতে পারল। কাজটা ডানপিটে শঙ্করেরই, কিন্তু মার খেয়েছিল ক্লাসশুদ্ধু ছেলে। সকলেই জানত, তবু কেউ ভয়ে শঙ্করের নাম বলতে চায়নি। কারণ তারপর শঙ্করের হাতে রামঠ্যাঙানি খেতে হবে, এ কথা জানাই ছিল। হেডস্যার রেগে বললেন, "কে এ কাজ করেছে তার নাম না বললে, প্রত্যেককে বেত মারব"। শেষ পর্যন্ত পিঠে বেতই পড়েছিল সবার। অনেকদিন পরে সকলেই প্রাণ খুলে হাসাহাসি, ইয়ার্কি-ফাজলামি করছিল। সকলেই বেশ খোশমেজাজে। কিন্তু শঙ্কর নিজে বেশ গম্ভীর। "কি হল রে? বুড়োবয়সে পুরোনো দুষ্টুমির কথা শুনতে লজ্জা করছে নাকি?", বিভাস ফুট কাটল। সকলেই হো হো করে হেসে উঠল।
দীপক ছিল একটু অন্যরকম। পড়াশোনায় খুব ভাল, কিন্তু একটু চুপচাপ, আত্মভোলা টাইপের। কারো সঙ্গে সেভাবে মিশত না। খুব কাছের বন্ধুরাই একমাত্র জানত, যে ও কবিতাও লেখে। বসন্ত বলল, "কি রে দীপক, এখনো কবিতা-টবিতা লিখিস নাকি?" "আরে না না।", দীপক লজ্জা পেল। কবি পরিচয়ে ওর কোনদিনই অবশ্য খুব গৌরব ছিলনা।
চলতে লাগল যে যার বাড়ির গল্প, ছেলে-মেয়ের গল্প, ছোট থেকে বড় আর বড় থেকে বুড়ো হবার সালতামামি। স্কুলের বন্ধু, ছোটবেলার স্মৃতি, এসব চিরকাল আঁকড়ে থাকে মনকে। কিন্তু আরো কিছু ছিল ওদের আড্ডায়, পুরোনো আফসোস, পুরোনো রেষারেষি, এমনকি পুরোনো অভিমান-যন্ত্রণাও। যার মধ্যে দিয়ে অচেনা মানুষ চেনা, আবার চেনা মানুষও কখনো কখনো অচেনা হয়ে উঠছিল।
প্লেটে করে চা, বিস্কুট আর চানাচুর এসে যেতে ওদের স্মৃতিচারণে একটু বিঘ্ন ঘটল। চিনি ছাড়া চা, দুধ ছাড়া চা, কম চিনির চা, চা ছাড়া চা যে যার হাতে তুলে নিল। ললিত কোনদিন চা খায় না, চা ছাড়া চা অর্থাৎ দুটো ক্রিমক্র্যাকার বিস্কুট তারই জন্যে। কিন্তু অতীতে ডুব দেবার প্রবণতা ওদের বয়সে বড্ড বেশি, সেই অভ্যাস আজও পিছু ছাড়ছিল না। ললিত বলল, "কি রে বিভাস, তুই তো একেবারে মিষ্টির পোকা ছিলিস, আর এখন দুধ চিনি ছাড়া শুধু লিকার চা খাচ্ছিস!" "কি করব বল, চারশো সুগার। ডাক্তার বলেছে, আর একদানাও চিনি নয়।", বিভাস বিরস বদনে বলল।
একমাত্র বসন্তের চেহারাটাই এখনো ঠিকঠাক আছে, চুল-টুল বিশেষ ওঠেনি, পাকও ধরেনি। "কি রে, তোর গ্ল্যামার যে দিন দিন বাড়ছে! কি ব্যাপার বলতো?", ললিত পাকড়াও করল। কড়মড় করে চানাচুর খেতে খেতে বসন্ত বলল, "আরে শরীরটাকে রাখতে হলে নিয়মিত সাধনা করতে হয়, বুঝলি? এই দেখ না, এই বয়সেও আমি নিয়মিত ব্যায়াম-জগিং করি।" দীপক বসন্তের হাতটা টিপে দেখে বলল, "তা বটে"। শঙ্করের হালচাল দেখে কিন্তু সবাই অবাক। ছেলেটা ছোটবেলায় কি ছিল, আর এখন এই বয়সেই কেমন যেন বুড়িয়ে গেছে, ফুরিয়ে গেছে, কেমন যেন মনমরা হয়ে গেছে। ওকে অনেক কষ্টেও সক্রিয় করে তোলা যাচ্ছিল না। বসন্ত অবশ্য এর কারণটা জানে। শঙ্করের এক ছেলে কিছুদিন আগেই রাজনৈতিক কারণে খুন হয়ে গেছে। সেই থেকে প্রাণচঞ্চল শঙ্কর একেবারে পাল্টে গেছে। যদিও এই ব্যাপারটা বসন্ত আর সকলকে জানানোর প্রয়োজন মনে করেনি। বরং শঙ্করের মনটা যদি একটু ভাল হয়, সেই জন্যই ওকে জোর করে এই পুরোনো বন্ধুদের গেট টুগেদারে নিয়ে এসেছিল।
চিরকালই স্কুলফ্রেন্ডদের বন্ধুত্ব হয়ে এসেছে রাজনীতি-দল-মত নিরপেক্ষ ভাবে। আজকের আলোচনাও সংসার, বেড়ানো, পুজো, ওষুধপত্র এসব নিয়েই চলছিল। কিন্তু শঙ্কর যখন দেওয়ালে ঝোলানো বেহালাটার দিকে এগিয়ে গিয়ে ধীরে ধীরে সেটা হাতে তুলে নিল, ওদের খোশগল্প একটু যেন থমকে গেল। কেউ কেউ আবার ব্যাপারটা খেয়ালও করেনি।
শঙ্কর বেহালার ছড়ে টান দিল। এক একটা করে সুরের সৃষ্টি হচ্ছে, আর ঘরের কোনে কোনে তা ছড়িয়ে যাচ্ছে। সকলে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনছে। বিভাস খবরের কাগজে মুখ গুঁজে চা খাচ্ছিল। সুরের মূর্চ্ছনায় কাগজটা কখন যেন ওর হাত থেকে খসে পড়ে গেছে, কাপের চা-ও ঠাণ্ডা। ললিত যে বালিশে হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়ে ছিল, এখন সেটাই কোলে নিয়ে, ভীষণ অবাক হয়ে সোজা হয়ে বসেছে। শুধু সুর নয়, যেন একের পর এক কথা ভেসে আসে। শঙ্কর এত সুন্দর বেহালা বাজাতে জানে! কই, ওরা তো কখনো জানত না! ওদিকে জানলার ধারের ছোট টুলটায় বসে, শঙ্কর তখন কি এক মহাসাধনায় ডুবে গেছে।
বেহালার মৃদুরাগ আশাবরীতে হারিয়ে যাচ্ছিল ললিতের মন। এই ঘর, এই দেওয়াল আর এইসব বন্ধুরা, সকলকে ভুলে যাচ্ছিল ও। শুধু বেহালার তার চারখানা আর ছড়িটা। সুরেরও যে একটা নিজস্ব ভাষা আছে, তা ও আগে জানত না! আর এ সুর তো সকলের থেকে আলাদা, যেন এক কান্নার বর্ণমালা। ও ভুলে গেল একাদশীর দিন কোলোন পৌঁছেই, অ্যাকুইজিশন আর মার্জার প্ল্যানিং নিয়ে একগাদা মিটিং করতে হবে। বরং ওর চোখে ভেসে উঠছিল একটা দৃশ্য, খুব ছোটবেলার দৃশ্য। বাবার হাত ধরে ও চলেছে জাহাজ দেখতে, আউট্রাম ঘাটে। জীবনে সেই প্রথম জাহাজ দেখার দৃশ্য, ও আজও ভোলেনি। মনে পড়তে লাগল বাবার সঙ্গে রোজ সকালে স্কুলে যাবার কথা। রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে বাবা কত গল্প বলতেন। স্কুলে যাবার অতটা পথ কখন যেন শেষ হয়ে যেত। সেই বাবা একদিন অফিস থেকে বিধ্বস্ত হয়ে বাড়ি ফিরলেন। বাবা নাকি কোন এক টাকা চুরির কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়েছেন। বাবা কখনো এ কাজ করতে পারেন, ভাবতেই পারত না ললিত। যে বাবা পকেটে পাঁচটা টাকা থাকলেও, ভিখিরিকে দু'টাকা দিয়ে সাহায্য করতে দ্বিধা করতেন না, বাড়ি ফিরে চুপচাপ মায়ের বকুনি সহ্য করতেন, যে মাসের বাকি দিন কটা কিভাবে চলবে, সেই বাবা করবেন চুরি? ও বিশ্বাস করেনি, দিনের পর দিন দেখেছে লুকিয়ে লুকিয়ে বাবার কান্না। শেষে বাবার চাকরিটা চলেই গেল। তারপর থেকে বাবা আর বাড়ি থেকেও বিশেষ বের হতেন না। শেষকালে এই করেই, ঘটনাটার তিন মাসের মধ্যে বাবা হার্ট অ্যাটাকে মারা যান। "বাবা, তুমি কেমন দেখতে ছিলে? বড় দেখতে ইচ্ছে করে তোমায়। আগের মতো আবারও তোমার হাতটা ধরতে ইচ্ছে করে। এত ঝাপসা কেন তোমার মুখটা?" ললিতের চোখ ভিজে এল, গলা বুক দিয়ে কান্না হয়ে যেন নেমে আসতে চাইছিল মোহময় বিষন্ন সুরটা। ললিত যে বেহালা বাজাতে জানে না।
বেহালার সুরটার মধ্যে কি একটা গভীর গোপন অনুভূতি ছিল! প্রতিবাদী কন্ঠ বসন্ত ফিরে গেল ওর রক্তঝরা অতীতে। সেদিন ওর বাড়ি ফেরার তাড়া ছিল, কিন্তু পারল না। শঙ্করের পারিবারিক আঘাতের কথা ও জানে, কিন্তু এই শঙ্কর যেন অনেক দূরের অন্য এক শঙ্কর। ওর হাতের বেহালায় এরকম অপরিসীম মায়া আর আবেগ আছে, আগে জানত না বসন্ত। শঙ্করের বড় ছেলে বিয়ে করে আলাদা হয়ে গেছে, ছোট ছেলের পরিণতির কথা ভাবলে আজও বুকটা কেঁপে ওঠে। বাড়িতে ঢুকে রুলিং পার্টির কিছু আশ্রিত গুন্ডা ছেলেটাকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যায়। শঙ্কর বাধা দিতে গিয়েছিল, কিন্তু ওর মাথায় আঘাত করে অজ্ঞান করে দেওয়া হয়েছিল। গুরুতর আহত হয়েছিল শঙ্করের স্ত্রীও। এক সপ্তাহ পরে খালধার থেকে ছেলেটার লাশ পাওয়া গিয়েছিল। বসন্ত নিজেও একসময় সক্রিয়ভাবে রাজনীতি করেছে বটে, কিন্তু এরকম পরিণতির কথা কোনদিনও ভাবেনি। আপনিই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল ওর বুক থেকে। ভেতরে ভেতরে ও এই ভেবেও লজ্জা পাচ্ছিল, যে এখনো অল্পস্বল্প রাজনীতি ও করে। মিটিং, মিছিল, সমাবেশে মাঝেমধ্যেই যায়, বক্তৃতাও দেয়। মোটা টাকা চাঁদা তো আছেই। অথচ রাজনীতির বলি ও নিজেও। যখন সক্রিয়ভাবে পার্টি করত, রেষারেষি চলত পাড়ার এক গণ্যমান্যর সঙ্গে, যে নিজে ছিল আদ্যোপান্ত অসৎ। আবার তার পোষা গুন্ডার সংখ্যাও কম ছিল না। স্বার্থ আর নীতির সংঘাতে, ওদের দল দু'ভাগ হয়ে গিয়েছিল। বসন্তের দলের ছেলেরা নিরাপদ ছিল না,তবু ওরা আলাদা একটা দল গড়ল। ভোটের সময় এক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে ওদের ক'জনকে প্ল্যান করে খুন করা হয়েছিল, যার মধ্যে বসন্তের হবু জামাইও ছিল। দলটা ভেঙে গেল। তবে বসন্ত হার মানল না। ও ছিল আদর্শবান, কোনদিন কারো দোষ দেখলে ছেড়ে কথা বলেনি। জীবনে বহু লড়াই করে আজ আবার ও একটা সম্মানীয় জায়গায় এসে পৌঁছেছে। বিশেষ বড় কোন অনুষ্ঠানে যাবার জন্য, জেনারেল সেক্রেটারি নিজে এসে ওকে নেমন্তন্ন করে যান। রাজনীতি ওর রক্তে, যুবক বয়সের সেই আকর্ষণটা তাই এখনো যায়নি। যদিও ও আজ ভীষণরকম বীতশ্রদ্ধ।
দীপক চিরকাল এমন আমুদে লোক ছিল না, বরং উল্টোটাই। ও একটু চাপা স্বভাবেরই ছিল। লেখালেখিতে বন্ধুরা উৎসাহ দিত, তাই লুকিয়ে চুরিয়ে ও লিখেও ফেলত খাতার পেছনে, গড়ে উঠত ওর ব্যক্তিগত অনুভূতির জগত। পূর্ণিমা রাত, হাওয়ার কানাকানি আর মৃদু স্পর্শের রোমাঞ্চ নিয়েই ভরে ছিল যৌবনটা। সেই উত্তেজনা কেটে গেলে ও দেখল, যেখানে ছিল সেখানেই পড়ে আছে। দেখল, বাস্তব জীবনটা ভীষণ কঠোর। সহজভাবে কোন কিছুই বয়ে চলেনা, থাকে নাটকীয়তা। কিন্তু নাটকের এক একটা চরিত্রের মতো, বাস্তবের নিজেকে দেখে ফেলার মধ্যে কোন আনন্দ ছিল না। দীপকের জীবনটা হয়ে গেল কঠিন, নীরস, বিমর্ষ। তবু ও বলত, ও হল জীবনের কবি, মৃত্যুর নয়।আনন্দ আর ভালবাসার কবি, বিরহের নয়। বেহালার সুরে ওর সঙ্গীতপ্রিয় মনটা নেচে উঠছিল। ভালবাসার অনুভূতির কথাগুলো একে একে মনে পড়ে যেতে লাগল। সেই সব আনন্দ, যার কোন কারণ নেই, নাম নেই। ও ভেসে চলছিল এক চনমনে সুরের মূর্চ্ছনায়। ভারি ভাল লাগছিল আজকের বিকেলটাকে। দীপক ভাবল, বাড়ি ফিরেই আবার কবিতা লেখা শুরু করবে, সেই ক্ষমতা এখনও ওর আছে। জীবনের সুখ দুঃখের সরু মধ্যরেখাটার গুরুত্ব ও ভালভাবেই জানে। কি আর হবে সেসব ভেবে? বরং নতুন করে শুরু তো করাই যায়। মনে হল ছোট ছেলেটাকে ক্রিকেট কোচিংয়ে ভর্তি করে দিতে হবে। গিন্নিকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে এ সপ্তাহেই। আচ্ছা কোলেস্টরেল ফ্রি মাখনটা খেয়ে দেখলে কেমন হয়?
সন্ধ্যা হল, যেন অনন্তকালের বেহালা বেজে চলেছে। সমস্ত ডাইমেনশন নিরপেক্ষ হয়ে বেজে চলেছে। সুরটা যেন দেওয়ালের ওপার থেকে ভেসে আসছে, কি এক আশ্রয়হীনতার অভিমান নিয়ে। অথচ স্বার্থপর পৃথিবী ফিরে চেয়েও দেখল না, এই দোতলার ঘরে কি আলোড়ন ঘটে গেল। কেউ ভাবল না এই পাঁচ বন্ধু মিলে কি জাদুতে, কি আবহে, এক আবেগময় অস্তিত্বের জগতে চলে যেতে পেরেছিল। কিভাবে সময় পেরিয়ে, নিজেদের স্বরূপ নতুনভাবে আবিষ্কার করতে পেরেছিল। শুধু বিভাস হয়ত কোন অজ্ঞাত কারণে নিজের অতীত জীবনের কথা মনে করার বিলাসিতায় গা ভাসাতে চাইছিল না। কোনদিনই ওর কোনকিছু বলার নেই, কেউ ওর কথাও শোনে না। ও বড়ই নিরীহ, ছাপোষা। বেহালার সুর শুনতে শুনতে চোখ বুঁজে ও এক অন্য রাজ্যে চলে গেছিল। কোন ভাবনা নেই, আবেগ নেই, আশা নেই, আশাভঙ্গ নেই, কৈশোরের চপলতা নেই, যৌবনের মত্ততা নেই, প্রৌঢ়ত্বের নিরাসক্ততাও নেই। জীবনের গড়ে তোলা বা ভেঙে যাওয়ার সহজ সরল গল্পও নেই। ওর জীবন হয়তো বাধ্য হয়েই হয়ে গেছে চারপাশের প্রভাবমুক্ত, যাবতীয় ঘটনা আর ঘাত-প্রতিঘাত নিরপেক্ষ। বিভাস আবেগপ্রবণ নয়।
শুধু শঙ্করের পিতৃহৃদয় কি এক ব্যথায় যেন দুমড়ে মুচড়ে উঠছিল। ও কোন ছন্দই হারায়নি, কোন কিছুই ওকে আর অভিমানী করে তোলে না। এক অশেষ উন্মুক্ততা ওর চারপাশের পৃথিবীতে। সেই আনন্দেই হয়তো ওর চোখ ফেটে এক ফোঁটা জল বেরিয়ে এল। কেউ দেখতে পেল না।
No comments:
Post a Comment