9 June 2018

ঠিকানা নেই


বেলুনে নিজের নাম ঠিকানা লিখে উড়িয়ে দিল দেবাঙ্গন। এটা ওর একটা অদ্ভুত নেশা। বেলুন ওড়ানোর ব্যাপারটা ওর কাছে এখন জলভাত। নীল আকাশে উড়তে উড়তে গ্যাসবেলুনের দূরে ভেসে যাওয়া দেখতে  দারুন লাগে ওর।মনে হয় ওও যদি এরকম উড়তে পারত!
মা অবশ্য মাঝেমাঝেই বকাঝকা করে, ‘এ তোর কি রকম নেশা দেব? বেলুন ওড়ানো?’ ‘কেন মা,আকাশে রঙীন বেলুনের ভেসে যাওয়া দেখতে কি দারুন লাগে না?’ ‘সে সব তো ঠিক আছে,কিন্তু পড়াশোনার দিকে এবার একটু নজর দে । রেজাল্ট না শেষে খারাপ হয়, তোর এই অদ্ভুত শখের পেছনে।‘মা একটু চিন্তিত হয়। ‘তুমি কিচ্ছু ভেবো না মা, রেজাল্ট আমার ভালই হবে।জানো,কত হট এয়ার বেলুন ওড়ানোর ক্লাব আছে? একসঙ্গে বেলুন ওড়ানোর কম্পিটিশনও হয়।আমাকে কেন যেতে দাও না মা!‘ ‘অত জানিনা বাপু।ওসব খুব ভয়ের জিনিস। এ যে কি বাজে নেশা হল তোর!’, বলে মা চলে যায়।
বাবা কিন্তু মাঝেমাঝেই বেলুন রাইডের ওপর নানা বই, তাছাড়া নিউমার্কেট থেকে এরোস্ট্যাট,বেলুনিং এসব নানা দামী দামী বিদেশী ম্যাগাজিন এনে দেয় ওকে। নেটে সার্চ করেও অনেক কিছু জানতে পারে দেবাঙ্গণ, ইউটিউব ভিডিও তো আছেই। টাইগার বেলুনে চড়ে ও নিজেও একদিন ভেসে পড়বে আকাশে,দিনরাত এই স্বপ্নই দেখে দেবাঙ্গন ।দিল্লি মুম্বাইতে তো কত বেলুন সাফারি আছে, বাবাকে কতবার বলেছে নিয়ে যাবার জন্য। কিন্তু মা এত ভয় পায়! একবার শুধু রাজস্থানে বেড়াতে গিয়ে পুষ্করে ,বেলুন ওড়া দেখেছিল। আকাশ ছেয়ে গেছিল নানা রঙের হট এয়ার বেলুনে, শুধু মার জন্য চাপা হল না ।কিন্তু সেই থেকে বেলুন ওড়ানোটাই ওর ধ্যান-জ্ঞান হয়ে গেল । এখানে অত বড় হট এয়ার বেলুন কোথায় পাবে? এডভার্টাইজিং বেলুনগুলোরও অনেক দাম। তাই ছোট হিলিয়াম বেলুনই সই। গ্যাস ভরার কিটও কিনে নিয়েছে দেবাঙ্গণ । বাবার আস্কারা আর দেবাঙ্গনের নিজের পকেটমানি থেকে,বাপ-বেটা দু’য়ে মিলে, বেশ কসরত করে পুরো জিনিসটা শিখে ফেলেছে। এখন অবশ্য ও নিজে নিজেই সব করতে পারে। আজ যে বেলুনটা ছেড়েছিল সেটা একটু বড়। ভেতরে হিলিয়াম গ্যাসও ভরেছে তাই বেশি,তবে হিসেব করে। উপরে উঠে বাইরের হাওয়ার চাপ কমে গেলে ,ভেতরের গ্যাসের চাপে বেলুনটা এমনিতেই বড় আর গোল হয়ে যাবে। বেলুনের গায়ে ছোট্ট চিঠি আর নিজের নাম ঠিকানা লিখে, আকাশে ছেড়ে দিতে অদ্ভুত একটা রোমাঞ্চ আর ভাললাগা গ্রাস করে ওকে,যেন ওই ভেসে যাচ্ছে।কেউ যদি কোনদিন পায় ওই বেলুনটা ,তার বাড়ির ছাদে।কি দারুন হবে! কতদূর দেশে যেতে পারে বেলুনটা ...??? কল্পনার রাজ্যে পাড়ি দিত  দেবাঙ্গন ।কিন্তু গত ক’বছরে অন্তত গোটাপঞ্চাশ ছোট-বড় বেলুন ছাড়লেও, কোনটারই কোন উত্তর আসেনি। হয়তো বেশি দূরে যেতে পারেনি ,বা কারও হাতে পড়ার আগেই নষ্ট হয়ে গেছে বেলুনগুলো। তাই এবারে পিভিসির বড় বেলুন, দামও পড়েছে ভালই। এটাও অনলাইনে কিনতে হয়েছে।সাধারণ যে বেলুনগুলো বিক্রি হয়, তা এতই পাতলা যে বাতাসের চাপ আর ভেতরের গ্যাসের ধাক্কা বেশিক্ষণ সইতে পারে না। দেখা যাক এই দামী বেলুনটা কতদূর যেতে পারে। আরো ক’টা ছাড়তে হবে এই রকমই ,ঠিক করে নিল দেবাঙ্গন।
কিন্তু দিন যায়,মাস যায়, কোন উত্তর আসে না কেন? বেলুনগুলো ভেসে ভেসে যায় কোথায়, ভোজবাজির মত উবে যায় নাকি? দূরে,অনেক দূরে পাড়ি জমাতে পারে না একটাও!দেবাঙ্গনের মনটা আকুল হয়।
‘তোর বেলুন নিশ্চয়ই কেউ পাবে,একদিন না একদিন।হাল ছাড়িস না,দেব।‘ বাবা ওকে উৎসাহ দেয়।‘কিন্তু বাবা,বেলুনের লেখাগুলো মুছে যায় না তো রোদ-বৃষ্টিতে?’ ‘সেজন্যই তো তোকে পাইলট ব্ল্যাকটা এনে দিলাম। ওর লেখা নষ্ট হবে না সহজে।‘ ‘ওটা দিয়েই তো আজকাল লিখি,বাবা।‘ ‘তাহলে অপেক্ষা কর,উত্তর আসবেই ’,বাবা বলে। ‘আসলে বেশিরভাগ সময় হাওয়ার গতি-প্রকৃতি দক্ষিণের দিকে থাকে।তুই তো জানিস,আকাশের স্ট্রাটোস্ফিয়ার লেভেলে উঠে বেলুনের ওপর বায়ুচাপ একটু কমলে ও পাড়ি দিতে থাকে।আমার মনে হচ্ছে সব বঙ্গোপসাগরের দিকে চলে যাচ্ছে।স্থলভাগে না পড়লে কে তোর চিঠির উত্তর দেবে?’ দেবাঙ্গন,বাবার কথা মতো পড়াশোনা করে জানতে পারে, একমাত্র বর্ষাকালে  বাতাস একটু ভেতরের দিকে বয়।স্যাটেলাইট ইমেজ দেখে, বাতাসের গতিপ্রকৃতি ও এখন পড়তে শিখে গেছে।সেইসব মাথায় রেখেই আজকাল বেলুনগুলো ছাড়ে ও।বাবাই উৎসাহ দেয় পুরো ব্যাপারটায়,বুঝিয়েও দেয়। বাবা বলে, ‘দেব, যখন যেটা করবি, প্রাণ দিয়ে করবি, ভালোবেসে করবি। দেখবি, তাহলেই ফল পাবি।‘ দেব বলে, ‘আমি বড় হয়ে জিওফিজিসিস্ট হব বাবা।‘ বাবা খুশি হয়ে বলে, ‘যা খুশি হ না,কে বারণ করেছে।শুধু অ্যাভারেজ স্টুডেন্ট হোস না।তোকে সব বিষয়ে মহাপন্ডিত হতে হবে না।শুধু যে বিষয়টা তোর ভাল লাগে,সেটার সব খুঁটিনাটি জানতে থাক,কোর্সে না থাকলেও ডিটেলসে জান।ঐ বিষয়টায় তোর চেয়ে বেশি কেউ যেন না জানে।পৃথিবীতে এখন স্পেশালিস্টদেরই কদর রে।‘ দেব বলে,’বাবা তুমি কখনও বেলুন উড়িয়েছ?’ ‘আমাদের ছোটবেলায় আমরাও অনেক ফানুস ওড়ানো দেখেছি, সেও তো হট এয়ার বেলুনই।‘ বাবা বলে। ‘তুমি নিজে ওড়াতে না কেন বাবা?’, দেবাঙ্গণ জিজ্ঞেস করেছিল। ‘আমারও খুব ইচ্ছে হতো, জানিস। কিন্তু কি করব বল, ছোটবেলাতেই বাবা মরে গেল। তোর মতো এতো আরামে আমার ছোটবেলাটা কাটেনি রে। না খেয়ে, না দেয়ে অনেক কষ্টে কেটেছে। আর ফানুস তো ওড়াত বড়লোকরা ।আমি শুধু আড়াল থেকে দেখতাম। বিশ্বকর্মা পুজোর দিন, কালীপুজোর দিন, অস্ট্রেলিয়ান রঙিন কাগজে তৈরী, কি সুন্দর সুন্দর নকশা করা,সব বড় বড় ফানুস ওড়ানো হতো।আকাশে উঠে গিয়ে ,ছোট হতে হতে, দূরে কোথায় হারিয়ে যেত। দেখতে আমারও ভাল লাগত, জানিস। কিন্তু নিজে কেনার সাধ্য ছিল না।‘ বাবা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
মাস ছয়েক পরের কথা। দেবাঙ্গনের রেজাল্ট বেরিয়েছে।রেজাল্ট তো ওর বরাবরই ভাল হয়।তার মধ্যে ভূগোলে এবারেও ও টপার,ওর প্রিয় সাবজেক্ট। হঠাৎই একদিন বিকেলে স্কুল থেকে ফিরে, লেটারবক্সে ও দেখে ওরই নামে একটা চিঠি এসেছে। চিঠিটা পেয়েই, দেবাঙ্গনের বুকটা আনন্দে ভরে উঠল।অবশেষে,ওর বেলুন চিঠির উত্তর এল তাহলে,তাও আবার সুদূর ভুবনেশ্বর থেকে। রোজই ফাঁকা ডাকবাক্সে হাত ঢুকিয়ে কত নিরাশ হতে হয়েছে। কত রাতে ঘুমের মধ্যেও ‘বেলুন আসছে, বেলুন আসছে’, বলে চেঁচিয়ে উঠেছে। আজ চিঠিটা পেয়ে এবং অচেনা নামের প্রেরক দেখে ও খুশিতে পাগল হয়ে উঠেছিল ।চিঠিটা খুলে দেখে ঠিক তাই ,ভুবনেশ্বর থেকে বিষ্ণু ওকে চিঠি লিখেছে,ওরই বয়সী। বেলুনটা কলকাতা থেকে ভুবনেশ্বর উড়ে চলে গিয়েছিল! ভাবতে পারেনা দেবাঙ্গন ।মনটা খুশিতে পাগল হয়ে উঠেছিল, আনন্দে চোখে জলও এসে গেল।ছুটতে ছুটতে মাকে গিয়ে প্রথম খবরটা দিল ও।‘মা চিঠি এসেছে।বেলুনটা একজন পেয়েছে।‘ মা খুশি হয়ে বলল, ‘তাই নাকি? কি লিখেছে রে?’ দেবাঙ্গণ বলল ‘বলছি, পুরোটা পড়িনি।আগে বাবাকে খবরটা দিয়ে দিই? ফোন করব মা?’ মা বলল, ‘বাবা তো এখন অফিসে, আসলে বলিস এখন।‘ কিন্তু আর তোর সয়না দেবাঙ্গনের। মোবাইলে ফোন করে বাবাকে। বাবাও শুনে মহা খুশি ,‘ভুবনেশ্বর? তোকে বলেছিলাম না,বর্ষার শুরুতে দক্ষিণ পশ্চিম মৌসুমী হাওয়া কেরলে ঢুকলেই, বেলুন দেশের ভিতরের দিকে উড়ে যাবে।দেখলি তো’,বাবাও উত্তেজিত হয়ে বলে। 
ঘরে এসে চিঠিটা ভাল করে পড়তে শুরু করল দেবাঙ্গণ । প্রতিটা লাইন যেন গিলে খেতে চাইছিল ও। বিষ্ণু নাকি খুব আনন্দ পেয়েছে  এই বেলুনটা পেয়ে ,আর ও দেবাঙ্গনের বন্ধু হতে চায়,ওকে আসতে লিখেছে।কিন্তু এ কি লিখেছে বিষ্ণু চিঠির শেষটাতে ?লিখেছে ওর নাকি ব্রেন ক্যান্সার হয়েছে,হসপিটালে শুয়ে আছে। সিস্টারই দিয়েছে ওকে বেলুনটা। 
বিষ্ণুর জন্য মনটা খারাপ হয়ে গেল দেবাঙ্গনের,এত উচ্ছ্বাস,এত আনন্দ নিমেষে উধাও।ও  বুঝতে পারেনা কি করে বিষ্ণুর সঙ্গে যোগাযোগ করবে। বেলুন পৌঁছবে হয়তো অন্য কোন ঠিকানায়, চিঠি পৌঁছতে যদি দেরি হয়ে যায়!

No comments:

Post a Comment