12 April 2018

অনিকেত বিজয়

ছেলেটার নাম ছিল বিজয়। বিজয়া দশমীর দিন জন্মেছিল বলেই ওর এই নাম। জন্ম দিয়েই ওর মা অন্ধকারে ঢলে পড়েছিলেন, তারপর বিজয়কে হাতড়ে হাতড়ে, খুঁজতে খুঁজতে গভীরতর অন্ধকারে কোথায় যে হারিয়ে গেলেন!
ছোটবেলা থেকেই বিজয় মামারবাড়িতে মানুষ।ওর বাবা স্কুলমাষ্টারি থেকে ফেরিওয়ালা, জুতোর ব্যবসা থেকে উকিলের মুহুরিগিরি সবই করেছেন, কিন্তু কোনটাই টেঁকেনি বেশিদিন ।বয়সের ভারে শেষে বেশী খাটতে পারতেন না। রোজ রাতে ঘুম চোখে, বাবা অনেক গল্প শোনাতেন ।বাবা ঘুমিয়ে পড়লে অন্ধকারেই বিজয় যেন স্পষ্ট দেখতে পেত ,হাল্কা কাচের পদ্মফুলের মত আলোর শেডের বিচ্ছুরিত মৃদু নীল ছায়ালোক থেকে মা এসে দাঁড়িয়েছেন তার সামনে। তারপর জেগে ঘুমিয়ে কত কথা হতো দুজনের।
 অবশেষে একদিন মামার বাড়ি থেকে বাবার হাত ধরে বেরিয়ে পড়তে হলো দুজনকে।বাবা বলেছিলেন আর জীবনে ওখানে যাবেন না ।একটা ঘর ভাড়া করে অনেক কষ্টে ওরা থাকত।ওদের ঘরে কোন মায়াবী নাইটল্যাম্প নেই,শুধু রাস্তার আলোই এসে পড়ে ,সেই আলো আঁধারের মধ্যে অনেকক্ষণ চোখ সওয়ালে বাবার ঘুমন্ত মুখটাই দেখা যায় শুধু।
 বিজয়কে ছোটবেলায় একটা স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিলেন বাবা, কিন্তু পরে মাইনে দিতে না পারায় আর সে স্কুলে পড়তে পারেনি। কিন্তু সেদিন বাবাই ওর হাত ধরে নিয়ে গিয়ে, ওকে একটা ফ্রি নাইট স্কুলে ভর্তি করে দিলেন।
এদিকে বাবা রাতের খাওয়া বন্ধ করলেন,খেলেই বমি হয়ে যেত। বাবা ই এতো দিন বিজয়কে স্নেহের বাঁধনে আগলে রেখেছিলেন।সেই বাবাও একদিন হুট করে মার কাছে চলে গেলেন। বিজয়ের বয়স তখন মাত্র দশ। মামার বাড়িতেই আবার থাকতে শুরু করলো ও। কিন্তু একদম ভালো লাগতো না ।মামার বাড়ির যে ঘরটায় শুয়ে শুয়ে বাবার কাছে গল্প শুনত বিজয়,সেই ঘরটায় এখন ছোটমামার সংসার ।ঐ ঘরে ওকে ঢুকতেই দেয় না। ঘরটা অনেক বদলে গেছে, কিন্তু মাথার ওপর পদ্মকাটা হালকা নীলচে আলোর শেডটা সেই একই রকম আছ। ঐ ঘরে শুয়ে শুয়ে ছোট মামা এখন হয়তো ওর ছেলেকে গল্প শোনায়। কখনো মামার বাড়ির তিনতলার জানালা দিয়ে রাস্তার দিকে চেয়ে থাকে বিজয়। বাড়ির সামনে দিয়ে পূব থেকে পশ্চিমে ট্রামলাইন চলে গেছে। ওই রাস্তার ডানদিকের ফুটপাথ দিয়েই বাবা হেঁটে আসতেন, কোন কোন দিন তিনতলার ঝুলবারান্দায় দাঁড়িয়ে বাবার জন্য অপেক্ষা করত ও। বিকেলবেলা বাবাকে আসতে দেখলেই, ছুটে চলে যেত নীচে। তারপর দুজনে ওপরে আসত।
বড়মামা বিজয়কে খুব ভালবাসেন ।তার জন্যই সে এ বাড়িতে থাকতে পেরেছে।বড়মামা বিজয়কে  স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছেন। সে মন দিয়ে পড়াশোনা করে আর ভাবে, বাবার খুব ইচ্ছে ছিল তার লেখাপড়া  হোক।সে পড়বেই।ছোটবেলা থেকে না খেয়ে না পড়ে, নানা অপমান আর দুঃখ-কষ্টের মধ্যে মানুষ হলেও, বিজয়কে কেউ কখনো কাঁদতে দেখেনি ।বাবার মৃত্যুতেও সে কাঁদেনি।
 স্কুল ফাইনালে দারোন ভাল রেজাল্ট করে বিজয় এখন কলেজে পড়ে। মামার বাড়ির কেউ ওকে দেখতে পারে না। বড়মামার ভালোবাসা পায় বলে ,ও যেন সকলের চোখের কাঁটা হয়ে উঠেছিল ।বড়মামার ভালো রোজগার, তার মুখের উপর কেউ কোন কথা বলতে পারতো না ।বাবা মারা যাওয়ার পর, বাবার অভাব বুঝতে না দেবার জন্য ,বড় মামা অনেক চেষ্টা করেছেন।বিজয়ও  তাকে ভক্তি করত ভগবানের মতো। ওকে পড়াশুনা করতেই হবে ।বাবার শেষ ইচ্ছে, বড়মামার এত চেষ্টা ,এতো ভালোবাসার দাম ওকে দিতেই হবে। নিজের পায়ে একদিন দাঁড়িয়ে তারপরেই ওর ঘরে বাবার যে ছবিটা আছে, সেটার সামনে দাঁড়িয়ে বাবাকে প্রনাম করে বলবে, "দেখো, এই সেই আমি।" ভাবতে ভাবতে বিজয় তন্ময় হয়ে যায়। ছোটবেলা থেকে আঘাত পেয়ে পেয়ে ওর চোখে আর জল আসে না, বুকে তাই ওর আঠেরো বছরের কান্না জমানো।
 বড়মামার শরীরটা কিছুদিন ধরেই খারাপ যাচ্ছিল। সেদিন সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে, মাথা ঘুরে পড়ে গেলেন। হার্ট অ্যাটাক। ডাক্তার আসার আগেই ,সব শেষ ।বিজয়ের সামনে থেকে পৃথিবীর সমস্ত আলো যেন এক নিমেষে হারিয়ে গেল।
নিজের জীবনের যে ছবিতে বিজয় শুধু  অবাক হয়েছিল,মামাতো ভাইয়ের সেই ছবি দেখে, বিজয়ের নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হতে লাগল।একটু আগেই সে দেখে এসেছে ছোটমামা পুরোনো ল্যাম্পশেডটা খুলে ফেলেছেন। অন্ধকার রাতে ,দেওয়ালের যে লাইটশেডে এক স্বপ্নের ঘোর এসে ঘিরে ধরত,আর না দেখা মা'র একটা অস্তিত্ব এসে ভালবাসার পরশ দিয়ে যেত, সেই লাইটশেডটা আর নেই।একটা কঠিন পাথরের মত কি,গলা দিয়ে যেন উঠে আসতে লাগল ।পড়াশোনা আর বোধহয় হল না।কে পড়াবে? এখন কি তবে চাকরির চেষ্টা করতে হবে ?সেটাই বা কে বলে দেবে?বিজয়ের প্রথমবার মনে হল এই পৃথিবীতে সে সম্পূর্ণ একা।মনে হল,"বাবা ,মামা ,তোমাদের শেষ ইচ্ছে আমি বোধহয় রাখতে পারলাম না ।"
দুপুরের কাঠফাটা রোদে আবারও বড়রাস্তায় চোখ চলে যায় ,ছাতা মাথায় একটা লোককে অনেক চেনা ভঙ্গিতে হেঁটে আসতে দেখে, ওর চোখ মুখ গলা বুক বেয়ে ঝর্ণার মত কান্না উথলে উঠল ।বালিশে মুখ গুঁজে হুহু করে কেঁদে উঠল সে। সারা জীবনের সব আবেগ, সব জমে থাকা কান্না, যেন সেদিন বেরিয়ে এল ওর হৃদয় থেকে ।"মাগো তোমায় আমি কোথায় পাব, মা ?আর বাবা ও তো নেই ।মামা ও যে চলে গেল ।"
বিজয়কে সেই প্রথমবার কেউ হয়তো কাঁদতে দেখলো।কিন্তু তারপর সে যখন ধীরে ধীরে, দুহাতে সে কান্না দৃঢ়ভাবে মুছে ফেলল,সে দৃশ্য কিন্তু নিশ্চিতভাবেই কেউ দেখল না।এসব জিনিস কেউ কোনদিনও দেখে না।(সারাংশ)

No comments:

Post a Comment