কিন্তু হঠাৎ করে কি যে হয়ে গেল ।বুধোর বাবা একদিন হুট করে চোখ বুজলেন ,হার্ট অ্যাটাক ।দাদার সঙ্গে সম্পত্তি নিয়ে ঝামেলা শুরু হল, একদিন দাদা-বৌদিই ওকে ফাঁসিয়ে দিল ,ওর নামে ওয়ারেন্ট বেরোল বেআইনি অস্ত্র রাখার দায়ে।পুলিশ সার্চের সময় বুধোর ঘরে,ওর নিজের আলমারির মাথায় পাওয়া গেল দু'দুখানা বিদেশী আগ্নেয়াস্ত্র। মাত্র পাঁচ বছর জেল হয়েছিল। কেউ কোন খবর আর রাখেনি,যা হয় আরকি।তারপর থেকে বুধো এই ফুটপাতেরই বাসিন্দা । বাড়িতে ঢুকতে দেওয়া হয় না ওকে,শুনেছে মারও নাকি স্থান হয়েছে কোন বৃদ্ধাশ্রমে,সম্পত্তিলোভী দাদা-বৌদি আটঘাট বেঁধেই কাজ করেছে,মার ঠিকানা পর্যন্ত জানতে দেওয়া হয়নি ওকে।আর একটা বিড়ি ধরাল বুধো,ও এখন ফুটপাতেই নবুদার ভাতের হোটেলে ফাইফরমাস খাটে, মাসে বারোশো টাকা পায় আর দুবেলার খাবার ।তাতে বিরক্তি নেই বুধোর ।ও জানে পাশা একদিন উল্টোবেই। ও অপেক্ষা করে থাকে ।
ধুলো উড়িয়ে একটা বাস চলে গেল।বিড়িটা কখন নিভে গেছে,তেঁতো লাগল বুধোর, থুতু ফেলল,তারপর আধখাওয়া বিড়িটা আছাড় মেরে ফেলে খিস্তি করে উঠল।
ইদানিং রাতেও বেরোতে হচ্ছে বুধোকে,ঐ রোজগারে আর চলছে না। গতকাল অবশ্য সারা রাত একটাও হাত মারতে পারা যায়নি,আসলে লাইনে নতুন তো। সিমেন্টের রকে বসে বসেই সারা রাতজাগা ক্লান্তি ওকে ঘিরে ধরে,ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসে বুধোর।ওখানেই শুতে যাবে,হঠাৎ ঠিক তখনই কোথা থেকে একটা বুড়ি এসে জড়োসড়ো হয়ে বসে রকের কোনটায়,সাদা কাপড়ে মুখটা ঢাকা,হাতে একটা ছোট পুঁটলি।কিছু বলতে গিয়েও কি একটা মনে করে বুধো চুপচাপ নিজের জায়গাতেই বাবু হয়ে বসে রইল।চোখ গিয়ে পড়ল সেই পুঁটলিটায়। "কোথায় যাবে গো ঠাকমা?কি নিয়ে চললে পুঁটলি করে?"ও বলেই ফেলে।বুড়ি ওর লোভী দৃষ্টি বুঝতে পারে বোধহয়, পুঁটলিটাকে আরও জড়িয়ে ধরে ।বুধো চোখ নামিয়ে নেয়,তারপর মাথাটা নিচু করে কি যেন একটা সুর ভাঁজে। একগাদা মাছি ভন্ ভন্ করছে চারিদিকে,ও পরোয়া করে না।সুরটা ওকে প্রতিদিনই তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়।কোনোদিন রাতে ভাল দাঁও মারতে পারলে আপন মনেই গলা দিয়ে বেরিয়ে আসে গানটা। আবার আজ যে একেবারেই মালকড়ি হয়নি - তাতেও নাছোড়বান্দা। এটা ভেবেই শব্দ করে হেসে ওঠে বুধো। পাশে চায়ের স্টল থেকে সাধনদা বলে "কি রে বুধো, একা একা হাসছিস যে বড়? কিছু হলো টোল?"বুধো কিছু বলে না,নিষ্ফল রাগে এক লাথি মারে মাটিতে শুয়ে থাকা কুকুরটার গায়ে। “কেঁউ” করে ককিয়ে উঠে, কুকুরটা চলে যায়।ওদিকে বুড়িটাও উঠে পড়ে,গুটিগুটি রওনা দেয় অজানা কোন দিকে ।
বুধো রকের ওপরেই শুয়ে পড়ে,ওর আর কোন গন্তব্য নেই।সুরটা আবারও ভেসে আসছে। অনেক শান্তিতে চোখটা জড়িয়ে আসছে। সুরটা ঘিরে ধরছে ,বুধোও পালাতে চাইছে না। শেষে সুরটা ঘুমের জমাট কুয়াশার মত বুধোকে গ্রাস করে। কাজ না থাকলে ঘুম আসতে ওর এক মিনিটও লাগেনা। শুধুমাত্র সেই কারণেই বুধো ঘুমিয়ে পড়ে।
ঘুমের মধ্যেই শোনে, কে যেন ওকে ডাকছে ‘অসিত ও অসিত’। কে আবার ওর ভালোনাম ধরে ডাকছে, নামটাতো ভুলতেই বসেছিল ও। গলাটা কিন্তু খুব চেনা, ঘুমের মধ্যেই বুধো চিনতে পারে। ‘মা’ বলে ডেকে ওঠে। কিন্তু কোথায় মা, এ তো সেই বুড়িটা। একটু আগেই যে বসেছিল রকের কোনটাতে। ঘুমচোখে ভাল করে মুখটা তখন দেখেইনি বুধো।শেষে চিনতে পেরে ‘মা,তুমি এসেছ?’ বলে কেঁদে ওঠে বুধো।
ঘুমটা ভেঙে যায়, স্বপ্ন নয় সত্যি। বুধো দেখে, ওর মাথায় গায়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে ওরই মা।‘এতদিন কোথায় ছিলে মা?কি করে খবর পেলে?’বুধোর মনটা প্রশ্নে জর্জরিত। কতদিন পরে অবশেষে মা ছেলের দেখা হল। দুজনেই কাঁদতে লাগল একে অপরকে জড়িয়ে।
বুধো থেকে অসিত হয়ে শেষে গন্তব্য স্থির হল। দুজনে হাত ধরাধরি করে হেঁটে যেতে থাকল পুলিশফাঁড়ির দিকে।
No comments:
Post a Comment