29 April 2018

টিফিনটাইম

স্কুলে টিফিন টাইমটা নানাভাবে কেটে যেত। গোল্লাচোর বা হাত টেনিস খেলে।টেনিস ব্যাট কোথা থেকে আসবে? হাতটাই ছিল ব্যাট।বল আসতো ব্যাগে করে। তবে গোল্লাচোরের মত সবাইকে নিয়ে খেলা আর ছিল না ।ফুটবলটা হতো গেমস পিরিয়ডেই, তাতে অবশ্য অনেকেই সেরকম পেরে উঠত না ।
মনে পড়ে স্কুলে,ক্লাসঘরে বসে বাইরে দেখা যেত সারি সারি নারকেল গাছ। হাওয়ায় তাদের দুলুনি দেখতে দেখতে পড়ানো কতবার ভুলে গেছি ,ওই দিকেই মন চলে গেছে ।পড়া ধরেছেন স্যার, বুঝতে পেরেছেন আমার অন্যমনস্কতার কথা । কিংবা মনে পড়ে পিরিয়ড শেষ হবার পর সেই সহজ চপলতা। বেঞ্চি ডিঙিয়ে দৌড়োদৌড়ি বা গল্পগুজব বা নানা রকম খেলা।টিফিন টাইমটাই ছিল সবচেয়ে অপেক্ষার বিষয়। পিরিয়ড গুলো পার হতেই ছুট লাগাতাম স্কুলের মাঠে বা প্রাইমারি সেকশন এর নিরিবিলিতে। সেখানে একদিন এরকমও হয়েছে তিন বন্ধু মিলে ঘুরতে ঘুরতে,মেন বিল্ডিংয়ের টিফিন শেষের ঘন্টা শুনতে পাইনি। ফিরতে ফিরতে পিরিয়ড শুরু, তারপর যথারীতি মার খাওয়া। তখনকার দিনে আজকের মত, ছাত্ররা মার খেলে বাবা-মা স্কুলে আন্দোলন করতে যেত না বা মিডিয়ার খবর হয়ে যেত না ।প্রায় প্রতিদিনই নানা কারণে নানারকম মার খাওয়াটা ছিল স্কুলের একটা খুব স্বাভাবিক ঘটনা ।মার খেতে খেতেই আমাদের গোটা  ব্যাচটা মানুষ হয়েছে ,কোনো অসুবিধা হয়নি। অবশ্য কিছু মার খুব একটা নিরামিষ ছিলনা,যেমন ডাষ্টার ছুঁড়ে  মার বা আঙুলের ফাঁকে পেন্সিল ঢুকিয়ে মার।
টিফিন টাইমটা ছিল নানা রকম টিফিন ভাগ করে খাবার সময়। দুষ্টুমি, দাপাদাপি, মারপিটও হতো মাঝেমাঝে। যে যার মত সময়টা কাটাতাম। কেউ আবার বাড়ির টিফিন ফেলে দিয়ে, বন্ধুদের মুখরোচক টিফিনেই মহানন্দে ভাগ বসাত। আর ছিল স্কুলের গেটের বাইরে হাত বার করে পঁচিশ পয়সায় বাপীদার মিল্ক আইসক্রিম ,মনাদার কমলা রঙের আলুরদম বা ছুটকি ঝালমুড়িওলার কারেন্ট আচার ।
ছোটবেলায় টনসিলে ভুগতাম বলে আমার আইসক্রিম খাওয়া বারন ছিল।তাই স্কুলের টিফিনটাইমে তার শোধ তুলতাম।বাদামভাজা বা ঝালমুড়ি খাবার জন্য যে পঁচিশ পয়সা দেওয়া হত,তা দিয়ে মনের আশ মিটিয়ে আইসক্রিম খেতাম।অবশ্য বাপীদা আসেনি বলে বা মিল্ক আইসক্রিম শেষ হয়ে গেছে বলে অনেকদিন নিরাশ হয়েও ফিরতে হয়েছে।রঙীন আইসক্রিম বা কমলা রঙের লোভনীয় আলুরদম খেতে গিয়ে ,সাদা জামায় দাগ লাগিয়ে বাড়ি ফিরলে, পিটুনি খেতে হত ।তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও সেসব খাবার ত্যাগ করতে হয়েছিল।
আজ শুনতে অদ্ভুত লাগে পঁচিশ পয়সারও কত দাম ছিল তখন। বারো পয়সার বুড়ির মাথার পাকা চুল খাবার জন্য কত বায়না করতাম মার কাছে ,স্কুল থেকে ফেরত আসার সময়। আর ছিল গোলাপ রেউরি।এরোপ্লেন, প্রজাপতি এরকম কত রকম আকারে আর রঙে বানিয়ে কাঠিতে গুঁজে দিত। স্কুলের বাইরে এইসব ফেরিওয়ালারা টিফিন বা ছুটির সময়ে ঠিক চলে আসত।
 স্কুল লাইফটা খুব তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে গেছে, আর আসবেও না জানি ।শুধু স্মৃতিগুলো ফিরে এলে মনটা ভালো হয়ে যায় ।এইটুকুই যা।

25 April 2018

প্রজাপতিরা হারিয়ে যায়


         বাসের জানলা দিয়ে হু হু করে হাওয়া ঢুকে আসছে। মাথার চুলগুলো আমার এলোমেলো হয়ে পড়ছে বারবার। আর জানলা দিয়ে দ্রুত, খুব দ্রুত পিছিয়ে যাচ্ছে কলেজ স্ট্রিট। এ সেই কলেজস্ট্রিট, যেখানে আমার জীবনের অনেক দুরন্ত বিকেল কেটেছে ,অনেক না বলা কথা পথ খুঁজে নিয়েছে, আবার অনেক চোখের জল চিরকালের জন্য থেমে থেকেছে এখানে ।আর আজ এখানেই আমি চিরকালের মত ফেলে রেখে এলাম আমার বর্ষ প্রেমিকাকে। ডানার সঙ্গে আমার সম্পর্কটা ছিল প্রেমেরই। কিন্তু আমরা একে বলতাম বন্ধুত্ব, কখনো বলতাম মনের সম্পর্ক। কোনো স্থায়ী নাম ছিল না এই সম্পর্কের ।আমরা নিজেরাই জানতাম না যে ঠিক কি করছি, আর সে তাগিদও ছিল না, কারণ আমাদের সম্পর্কের চুক্তি ছিল মাত্র এক বছরের । অবাক হয়ে ভাবছিলাম , এই একটা বছর  কিভাবে কাটিয়ে দিলাম। এই এক বছরে আমরা কি করিনি! কফি শপ বা পার্কে গিয়ে অদ্ভুতভাবে বিকেলগুলো কাটিয়েছি, রাস্তার মধ্যে মেতে উঠেছি দুষ্টুমি, খুনসুটিতে,দুজনে হারিয়ে গেছি দুজনের মধ্যে ।আমাদের মধ্যে সীমারেখার বাঁধন বা  ছিল না কোন, শুধু খুশিতে, চাঞ্চল্যে কেটে গেছে দিনগুলো। কিন্তু আমি আর ডানা দুজনেই জানতাম,মেনেও নিয়েছিলাম বর্ষশেষের আসন্ন বিচ্ছেদ। সম্পর্কের গভীরতা তৈরি হতে দিতে চাইনি, কিন্তু না চাইলেও হয়ে গেছে। আমাদের মিলন যে হবেনা কোনদিন, এ কথা প্রথম থেকেই ঠিক ছিল।এ যেন ছিল একটা খেলা। অন্ধকারে রেললাইন ধরে মৃত্যুর দিকে পিছন করে এবং প্রতিবার বেঁচে ফিরে আসার মত।এই উদ্দাম হেঁটে চলার কোন মানে ছিল না,কোন গন্তব্য ছিল না। একে অপরকে আমরা শুধু কবিতাই দিয়েছি, উত্তর প্রত্যুত্তরে আমাদের কবিতার ডায়েরি আর ছড়ানো ছেটানো কাগজগুলো ভরে উঠেছিল ।জীবনের নানা উপলব্ধি পথ খুঁজে পেত সেখানে ,আমরা জীবনকে খুঁজে পেয়েছিলাম ।
        এক বছর আগে ডানার সঙ্গে আমার পরিচয় ,আর দেখতে দেখতে কেটে গেছে গোটা বছরটা, ঘটনাবহুল। দুঃখ, রাগ, অভিমান ,আবেগ আর আনন্দে।
        হঠাৎই আমার পুনেতে চাকরি হয়ে গেল। সেখানেই থাকতে হল । শুধু মাঝে মাঝে বাড়ি ফিরতে পারতাম,তাও ঘন ঘন নয়।বাদ সাধল দূরত্ব আর খরচ ।তাই চেনা শহর ,চেনা প্রেমিকার সঙ্গে যোগাযোগটা গেল কমে। সম্পর্কটা হালকা হয়ে এলো,দেখা-সাক্ষাৎ গেল কমে। দেখতে দেখতে এপ্রিল মাস এসে গেল এবং যা কথা ছিল সেই মত আমাদের বিদায় নেবার পালা ।আমি বুঝতে পারলাম যে এই একটা বছর যে উচ্ছ্বাস আর আনন্দে কাটিয়েছি, তার তুলনা হয় না ।আবেগময় কিছু মুহূর্তের চপল খুনসুটিতে মেতে ওঠা সময়গুলো ,আমার সারা জীবন স্মৃতি হয়ে থাকবে। এটাই হয়ত আমার চিরকালের সোনালী পাওয়া। এই নামহীন সম্পর্ক এই জীবনের এক মূল্যবান রত্ন ,এক সেরা অনুভব ।তাকে ভুলতে পারব না আমি, কোনদিনও। ডানাকে অনেক শুভেচ্ছা জানিয়ে, তাকে বিদায় জানাতে সত্যিই আমার কষ্ট হয়েছিল। আগের দিন সারারাত বিছানায় ছটফট করেছিলাম।কিন্তু ডানা?ওর কথা তো জানা হল না?ও কেমন থাকবে? বিদায় কালে আমার একটাই সান্তনা থাকবে, যদি ডানা আমাকে ভুলে না যায়।কিন্তু তা কি হবে? তারও সেই স্মৃতি কি ভরা থাকবে? আমি আর ভাবতে পারছি না। অনেকগুলো উপহারের শেষে, সেই সুন্দর দিনগুলোর সুখস্মৃতিই  এখন আমাদের একে অপরকে দেওয়া  শ্রেষ্ঠ উপহার।
        বাসটা শ্যাম বাজারের মোড়ে এসে পৌঁছলো।কত স্মৃতি এই জায়গাটার সঙ্গে জড়িয়ে ,কত আবেগ-বিহ্বল সময় কেটেছে প্রতীক্ষায়, কত উদ্দাম পথচলা ।আমার চোখ জলে ভরে এল ।কিন্তু কথা তো রাখতেই হবে, সর্বনাশা পরিণতিহীন সম্পর্কের ইতি টানতেই হবে। নামহীন সম্পর্ক যে সম্পর্কের নাম। তাই বিদায় নিতেই হল ।
        আমার শূন্য দৃষ্টির মাঝেই  কন্ডাক্টরের ঘন্টি পড়ল, বাস ছাড়বে।

22 April 2018

একটা পাগল মন

চারদিকে গুমোট গরম,বিরক্তিকর।সেই একইভাবে এই নতুন শহরে দিনগুলোও কেটে যাচ্ছে ।নানা রকম ভাবে কেটে যাচ্ছে।কিন্তু ভীষণই মনে হচ্ছে, যে সেরকম কিছুই ঘটছে না,বিশেষ কিছুই করা হচ্ছে না ,বড় কোনো প্রাপ্তি ঘটছে না, হুট করে এসে পড়ছে না কোনো বন্ধু  বা আত্মীয়, অবাক করা আনন্দজনক কোন খবরও থাকছে না ,এমনকি রাস্তায় হুট্ করে দেখাও হয়ে যাচ্ছে না পুরোনো প্রেমিকার সঙ্গে।দিনগুলো কেটে যাচ্ছে একেবারে কিচ্ছু না ঘটিয়ে। যদিও চারপাশে দুর্বোধ্য অনেক কিছুই ঘটছে, তবুও আমার কেন জানি মনে হচ্ছে, করা হচ্ছে না  বা বলা হচ্ছে না গুরুত্বপূর্ণ কোনকিছুই। অন্ততঃ মিটিয়ে ফেলা যাচ্ছে না একটাও পুরোনো ফয়সালা। নতুন দেশের নানা রকম নতুন লোকের সঙ্গে অবশ্য পরিচয় হচ্ছে, প্রত্যেককেই ভাল লাগছে আর মনের মধ্যে প্রত্যেকের অস্তিত্বই স্পষ্ট হয়ে বসে যাচ্ছে। কাউকেই ভোলা যাচ্ছে না, এমনকি যে লোকটা খুব একটা ভালো নয় বলে অন্যরা বলেছিল, তাকেও ভালো লাগছে, মনে থাকছে, শুধু এই জন্যই যে এও একটা ধরন। তাছাড়া কোনো মানুষই পুরো ভালো বা পুরো খারাপ হয় না, খারাপ লোকের মধ্যেও খুঁজলে কিন্তু কিছু কিছু ভাল গুণ দেখতে পাওয়া যাবে । আমার বাড়িতে একটা সুন্দর পোস্টার আছে,এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে গেল ।সেটার মোদ্দা কথাটা এইরকম যে,জীবনের যাত্রাপথে গন্তব্যে পৌছোনটাই বড় নয়,যাত্রাপথটাকে উপভোগ করা আর তার ছোট ছোট অসংখ্য জিনিসকে মনের খোরাক করে নেওয়াটাই বড়।কারণ গন্তব্যের শেষটা নয়,পথ চলার মধ্যবর্তী আনন্দ আর অভিজ্ঞতাটাই আসল।
  শুধু এই জন্যই মাঝে মাঝে ভীষণ ভালো লাগে নিজেকে, ভালো লাগে পৃথিবীকে, ভালো লাগে প্রকৃতিকে। ভালোবেসে ফেলি সবাইকে ,চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে "আমি ভালবাসি"। কতদিন বাঁচব আমি জানিনা, কিন্তু যতদিন বাঁচব জীবনকে জানা-বোঝার সুযোগ থেকে যেন বঞ্চিত না হই। নানাভাবে বাঁচতে ইচ্ছে করে, নানা অনুভূতি, অভিজ্ঞতা নিজের করে নিতে ইচ্ছে করে ।কিন্তু এই একটা জীবনে কত কিছু করা সম্ভব? এই যেমন চলে যেতে ইচ্ছে করে সারা পৃথিবীর দুর্গমতম প্রান্ত গুলোতে, সুন্দরতম জায়গা গুলোতে, মিশে যেতে ইচ্ছে করে মানুষের মধ্যে,সেনাবাহিনীর হয়ে মরণপণ যুদ্ধে লড়ে যেতে ইচ্ছে করে, সমাজের অন্যায় গুলোর বিরুদ্ধে ঘা দিতে,রুখে দাঁড়াতে ইচ্ছে করে,লিখে ফেলতে ইচ্ছে করে দারুন সব কবিতা, এঁকে ফেলতে ইচ্ছে করে নতুন ধরনের ছবি ,প্রচুর বই পড়তে ইচ্ছে করে, অনেক কিছু শিখতে ইচ্ছে করে,নতুন কিছু আবিষ্কার করে ফেলতে অথবা মাস্তানের উপর মাস্তানি  করতে, দাগী অপরাধীদের ভীষণ শাস্তি দিতে, সারাদেশের মানুষের কাছে ভীষণ আদর্শ হতেও ইচ্ছে করে। কিন্তু এত কিছু এই একটা জীবনে করা সম্ভব নয়, এতভাবে বাঁচার পক্ষে জীবনটা বড়ই ছোট। তখনই মনটা খারাপ হয়ে যায়। জীবনটা শেষ হয়ে এলো, অথচ কত কিছু করার বাকি থেকে গেল ।কত পথে হেঁটে যাওয়া হলো না, কত মুখ চেনা হল না, কত কি দেখা হল না,কত ভুল শুধরোনো হলো না, আর হবেও না হয়তো। এই হল জীবনের ব্যর্থতা।
এইমাত্র কড়কড় করে মেঘ ডাকল, বৃষ্টি এখনই শুরু হবে। কিন্তু এই দূষিত পরিবেশে, ধোঁয়া আর ধুলোর মধ্যে বৃষ্টি দেখতে ভালো লাগে না।মনে হয় ,এখন যদি থাকতাম হিমালয়ের কোলে কোন ফুলের বাগানের মধ্যে ,একটা কাঁচের বাড়িতে বা পাহাড়ের ঢালে বয়ে চলা কোন ঝর্ণার পাথরের খাঁজে ,অথবা দিগন্তব্যাপী সবুজ ধান ক্ষেতের মধ্যে একটা খড়ের গাদায় হেলান দিয়ে শুয়ে, তবে বৃষ্টি দেখতে বেশ লাগতো। সেই সঙ্গে অনেক মন কেমন এসে জমা হত, অনেক কথাও। কিন্তু এই পাথুরে পরিবেশ, এই শব্দ, ধোঁয়া-ধুলো ,এর মধ্যে বৃষ্টি এসে সেই মনের আরাম দেয় না।তাই কথারাও আসে না।তাই এখানে আমি একা, ভীষন একা ,একেবারে একা। নিজে নিজেই রান্না করি, নিজে নিজেই খাই ।কখনো রান্না করি না, খাইও না। ঘরের সব কাজ নিজেই করি ,কেউ কিছু বলার নেই। হরেক রকম বই পড়া, খবরের কাগজ পড়া, গান শোনা, টিভি দেখা, সব একা একা। একাই গল্প পড়ি ,হাসি, কাঁদি, কিছুতেই সময় কাটে না। মাঝে মাঝে একাকিত্বের জন্য চোখ ফেটে কান্না আসে, নিজেই দেখি নিজের কান্না ,নিজেই মুছে ফেলি ।বাড়ির কথা মনে পড়ে। তক্ষুনি চলে যেতে ইচ্ছে করে ,সবার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করে।বাড়ির, পাড়ার খবর জানতে ইচ্ছে করে। আমার ভীষণ প্রিয় কলকাতা শহরটায় ছুটে যেতে চায় মন। কিন্তু আমাকে একা বাড়িতে বিষন্ন ফেলে রেখে প্রতি সন্ধ্যাতেই ছটা পনেরোর লাস্ট ট্রেন ব্ল্যাক ডায়মন্ড এক্সপ্রেস শব্দ করে ছুটে চলে যায় কলকাতার দিকে।চোখে জল এসে যায় অভিমানে। এই ভাবেই প্রতি সন্ধ্যাতেই ট্রেন মিস করে চলেছি ।প্রতিবারই সেই একই আফশোষ। কে আমাকে ট্রেন ধরিয়ে দেবে? অনেকদিন কবিতা লিখি না, এই পরিবেশে কবিতা হয়না। কবিতা সৃষ্টির মত, মনে কোন আনন্দ হয়নি ,বড়ই নীরস জীবনটা।এখন কবিতা শুধু পড়তে চেষ্টা করি, তাও বেশিক্ষণ ভালো লাগেনা ।কত ভালোলাগা কবিতা এইটুকু মনের পরিসরে জায়গা দিতে পারি না ।খুব খারাপ লাগে, কিন্তু জানি ,জীবন এরকমই। কতটুকু জায়গা হয়, কতটাই বা হাত গলে পড়ে যায়।
বৃষ্টি শুরু হল। সেই শব্দ শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল, ভালোবাসার যদি কোন রূপ থাকতো ,তাহলে তা যেন এই কালবৈশাখী ঝড়ের রুপই হয়। বিকেলে খোলা মাঠে একা আমাকে এসে যে জানিয়ে দিয়ে যাবে ,সে আছে এবং থাকবে। চুপিচুপি কোন মনের কথা, প্রাণের রেশ সেই ঝড়ের মুখ থেকেই ঝরে পড়বে হৃদয়ের সবচেয়ে দামি সম্পদের মতো ,অথচ যা বিলিয়ে দিতে একটুও দ্বিধা নেই ,লজ্জা নেই, শঙ্কা বা অহংকার নেই ।ভালোবাসার যদি কোন রং থাকত ,তবে তা হতো সূর্যাস্তের গেরুয়া রং। দিনের শেষে জানিয়ে দেবার জন্য যে সবচেয়ে দামী সেই রঙ কোন বিভেদ মানে না, আকাশের প্রতিটি কোণে তার প্রকাশ জানিয়ে দিয়ে তবে সে বিদায় নেয়। আমাদেরও শুধু সেই রংয়েই হারিয়ে যেতে হবে একদিন ,'হলুদ বসন্ত' পাখির সবচেয়ে নীল পালকটির মত।ভালোবাসার যেমনই প্রকাশ হোক না কেন, তা আমার হাতের তালুর মতই  চেনা ,আমার সহজ জীবনবোধ ,সাবলীল আবেগের সঙ্গে কোথাও তার বিরোধ নেই ।সে যে আমিই। তাই ভালোবাসা আমার কাছে জীবনের সবচেয়ে দামী অংশ, সবচেয়ে সত্য,সর্বদা অটুট এবং খুবই স্বাভাবিক ।তা নিয়ে আমার কোন মাথা ব্যাথা নেই। ভালোবাসার যদি কোন রূপ থাকত ,তা সেই অল্প চেনা পাড়াতুতো  প্রেমিকাতেই প্রকাশিত  হত,আর তো কেউ কখনো নেই আমার।ভালোবাসা যদি ভুল হয় তো সেই , ভালোবাসা যদি জীবনের পরম প্রাপ্তি হয় ,তা হলেও সেই। সে একই সঙ্গে ভালোবাসার শুরু এবং শেষ, মায়া এবং বাস্তব ,প্রকাশ এবং প্রলয়। সেই আমার উন্মাদনা ও আবেগ, আমার পিটুইটারির খেলা ।তার জন্যই আমার দেহ মনের সমস্ত স্পর্শ সংরক্ষিত ,কেবল সেই তা অনুভব করতে পারবে একদিন।।তার- আমার হয়ত কোনদিনই সবুজ হওয়া হয়ে উঠবে না, তবু বলছি, দূর থেকেই বলছি ,কবিতার অনুরণন যে আমাকে পাগল করে তোলে, তা হয়তো বা সেই  একদিন প্রকৃত বুঝতে পারবে ,যেদিন হয়তো আমিই থাকব না। তখন কোন দুপুরবেলা হঠাৎ নীল আকাশে হারিয়ে যাওয়া ছোট্ট চিলটার দিকে তাকিয়ে, তার আমার কথা মনে পড়ে যাবে, আর তখনই ঠিক, তাকে কাঁদিয়ে যাবে আমার না লেখা কবিতা ।যদিও কবি পরিচয়ে আমি বিন্দুমাত্র গর্বিত বোধ করি না,কারণ আমি আদৌ কোনদিনও কবি হতে চাই না।বরং এও জানি,আমার না লেখা কবিতা সেই লিখবে-একদিন।
আমার একান্ত আপনার জনের বিষয়ে আমার আদৌ কোনো ভরসা নেই। আমি জানি সেই একজনকে আমি কোনদিনও পাবনা ।যে একদিন আমার হবে ,সে হয়ত কোনদিনই আমার কবিতা বুঝবে না ,দিন আনি- দিন খাই ভালোবাসার রাতে লাল নাইটল্যাম্পের তলায় শুয়ে নীরবে কেঁদে যাবে আমার কবিতা ।সেই একজন হতে পারত শুধু সেই  বর্ষপ্রেমিকা,অথচ নামহীন সম্পর্কের নদীতে ,পাতার নৌকা হয়েই সে হয়ত চিরকাল ভেসে যাবে ।তার কাছে থাকতে পারছি না,ইচ্ছে না হলেও বাধ্য হয়েছি তাকে কলকাতার পথচলতি ফুটপাতের কাছে ছেড়ে আসতে।সেখানে আমার কোনো জোর নেই, ভিড়ে হারিয়ে যাবার পর কত সহজেই, তার প্রতি আমার সব দাবী হারিয়ে যায় ।কিন্তু,সে কাছে থাকুক বা দূরে ,তার সংজ্ঞা ,তার স্মৃতি, আমার মনের সবচেয়ে দামি ঘরে তালাবন্ধ হয়ে আছে ,আর সেই ঘরের ভেতরে প্রবেশাধিকার শুধুমাত্র আমার।
 বৃষ্টি শেষ হল। আকাশ নীল, সজীব হয়ে উঠেছে ।আমি তবুও খুঁজে চলেছি নিজেকে নতুন করে পাবার জন্য, যেমন সবুজ ধান ক্ষেতের পাশ দিয়ে দৌড়ে যাবার সময় কোন কিশোর নিজেকে খুঁজে পায়। তবু কেন আমি ধান ক্ষেতের মধ্যে বোকার মত দাঁড়িয়ে থাকা সেই কাকতাড়ুয়া হয়েই জীবনটা কাটিয়ে দিচ্ছি ,কে জানে? আমি ভগবান মানি না ,তবে যে পদ্ধতিতে মানুষের সৃষ্টি ,সেই বিজ্ঞানের সূত্র ধরেই বলছি, বিজ্ঞান আমাদের যে দৃষ্টি দিয়েছে, যে মন দিয়েছে, তা সবার চেয়ে দামী ,যে আবেগ দিয়েছে , সৃষ্টিশীলতা দিয়েছে, লেখার হাত দিয়েছে,তা তো শুধু সেই আপনার জনকে  সারা জীবন ধরে বুঝবো বলেই।একথাই আমাকে আজ শান্তিতে রেখেছে, জীবনের সমস্ত ওঠা-পড়া,দুঃখ ,অভিমান একাকিত্বে পাশে থেকেছে, উৎসাহ দিয়েছে ,বলেছে আমার নাম আর আমার সমস্ত আবেগ, চেতনা আর বোধের মূল্য আছে ,প্রাণ আছে- আছে ভালবাসার টান- তার কাছে, যা কখনই শেষ হয়ে যেতে পারে না । এইসবই জীবনের অপরূপ প্রকাশ, হৃদয়ের উৎস এবং মোহনা, মানুষের পরিপূর্ণতা কেবল এই মনই আনতে পারে।
 অল্প জানা প্রেমিকাকে কোনদিনও ভুলব না ,ভুলতে চাইও না। তারই সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে আমার জুতোর সুকতলা তিনবার বদলাতে হয়েছে,অফিসে ম্যানেজারের চোখরাঙানি সইতে হয়েছে, মাত্র সাতটা ছুটি বাকি থাকতেও দুটো ছুটি নিয়ে ফেলেছি সম্পূর্ণ বিনা কারণে ,এমনকি সাইকেলের রিম বেঁকিয়ে ফেলে কড়কড়ে  ছাব্বিশ টাকা পর্যন্ত গুনতে হয়েছে মুরারী মিস্ত্রির কাছে। অপ্রস্তুতে পড়তে হয়েছে বন্ধুদের মাঝে, ধরা পড়তে হয়েছে এমনকি বাবা-মার কাছেও। তবু তাকে ছাড়িনি। বেদম মার খেয়েও তারই সঙ্গে থেকে গিয়েছি, থেকে যাবো, তাকে রেখে দেবো আমার মনে ।কিছুতেই যেতে পারবে না সে, এই বন্দীদশা চিরকালের ।এখানেই আমাদের সবুজ হওয়া। আমিও জানি, প্রকৃত প্রেমকে ঘরের বিছানা পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া যায় না।তাই  দূরে চলে যাবার মধ্যে যে ভীষণ আবেগ লুকিয়ে আছে, যে পাগল করা ভালবাসার মন কেমন করা আছে, তাতেই ভালোবাসার গুরুত্ব শতগুণ বেড়ে যায়। আরো ভালবেসে ফেলি সেই অবিনশ্বরীকে। তবু শেষমেষ তাকে বিদায় দিতেই হয়। সন্ধ্যে নামার আগে, সূর্যের শেষ আলোর গেরুয়া স্নিগ্ধতার রং সাদা চোখে মুখে মেখে নিয়ে, তাকে হারাতে হয়।এ তো জীবনযুদ্ধে হার নয়,এ শুধু তার মনের কোণে নতুন করে জায়গা পাব বলেই ,আর হঠাৎ এক বর্ষার দিনে আকুল কান্নায় তাকে আবারও মনে পড়বে বলে।সেইখান থেকেই আমার আবার নতুন পথচলা শুরু হয়। পেছনে পড়ে থাকে সমস্ত স্বার্থান্বেষীদের কাতরোক্তি, লোভী আর হিংসুটেদের বড় লোলুপ চোখ, হিংসার রক্তাক্ত ছুরি।সমস্ত বিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে ,মলিকুলার ফিউশন আর ফিশনকে মাড়িয়ে চলি আমি, সমস্ত পাহাড়ের মধ্য দিয়ে আমি খুঁড়ে ফেলি সুড়ঙ্গ, এমনকি সমুদ্রের তলা থেকে কুড়িয়ে আনি মুক্তোঝিনুক, শুধু একজনকেই দেব বলে। এইভাবেই চলতে থাকে আমার জীবনযাপন ।সবাইকে পেরিয়ে নিমেষে চলে যাই অজানা লক্ষ্যে  আলোর পথ ধরে, অমোঘ চোখের ডাকে।আমার চলা একদিন শেষ হবে, যেদিন জীবনের লক্ষ্যে আমার জন্য অপেক্ষা করে থাকবে শুধু আমারই একটুকরো সবুজ দিন। সেই সবুজ বৃষ্টিতে আমি বুক পেতে দেব।আমার চোখ, মুখ, গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে,আমার সারা শরীর ভিজিয়ে ,সেদিন আমার সবুজ হবার পালা ।
এই সমাপ্তি তো একান্ত আমার নিজের, কিন্তু সেই নদীকে তো বাঁচতে হবে,তাকে তো আমায় হারাতেই হবে। সেদিন সে শেষবারের মতো আমাকে হারাবে, এমনকি আমিও হারাবো তাকে । আমি আমার হৃদয়ের নিঃশেষিত আবেগ আর অস্তিত্ত্ব,তার হাতে দিয়ে যেতে পারিনি ,শুধু তারই হতে পারিনি, তাকে কাছে টেনে নিতে পারিনি ।এই পথে চলতে চলতে, আমি আমার সীমিত হাতের তালুতে তাকে ধরে রাখতে পারিনি, আমার ছোট্ট ঘরের কোণে দুধেল বিছানায় তাকে নিয়ে যেতে পারিনি।এ আমার ব্যার্থতা নয়, এ হলো এই পথের ইতিহাস।তাই সে চলে গেছে তার নিজের ছন্দে, সুরে, জীবনবোধে ।সে যেন নদী হয়ে বয়ে চলে গেছে আমার তৃষিত বালুচর সবুজে ভরিয়ে দিয়ে।সে স্থান-কাল-পাত্র, জীবন-মরণ, পার্থিব-অপার্থিবের হাতের পুতুল নয়,সে চিরন্তনী বহমান,সে আবেগ সঞ্চারী চেতনার নদী, সে বর্ষা। আমার কাছে জীবনের বেশ কিছু অনুভূতির দাম এত বেশি যে তারা আমাকে আবেগ-বিহ্বল করে তোলে মাঝে মাঝে। সবখানেই একটা সুতোর টান থেকে যায়। যতই দূরে থাকি না কেন, ভীষণ চেনা হয়ে চিরকালের জন্য গেঁথে থাকে সেই অনুভূতিগুলো ,সেই স্মৃতিগুলো ।সেই ভালোবাসার টান আমাকে শান্তিতে থাকতে দেয় না। পাগল করে দেয়, তাড়িয়ে বেড়ায়,আর আমার জৈবিক দিন গুজরানের ফাঁকে ফাঁকে ভালবাসার দাম দিতে গিয়ে নিজেকেই পাছে হারিয়ে ফেলি, এই ভয়ে আমি নিজেই মাঝে মাঝে কেটে দিই সেই আবেগ নির্ভর স্মৃতির সুতোগুলো। মুক্তি পেয়ে আমি একটু হাঁফ ছেড়ে বাঁচি ।একটু অন্যরকম আমি হয়ে আমি আসলে বাঁচিয়ে রাখি আমাকেই। প্রতিবার তাই নিজেকে আবার নতুন করে খুঁজে পাই ,নতুন করে নিজেকে ভালোবাসতে পারি, নতুন করে লিখতে পারি কবিতা ।বর্ষার জলের মত জীবনে আসুক প্রেম, বদ্ধ জলাশয়ের মত নয় ।জীবনে ভালবাসার গুরুত্ব প্রচন্ড বেশি উপলব্ধি করি বলেই বোধহয় আমি এই কথা বলতে পারি,এমনকি এই রুক্ষ পাথুরে জীবনে অভ্যস্ত হয়ে গেলেও।
খুব ছোটবেলার কথা মনে পড়ে ।মায়ের সঙ্গে স্কুল থেকে ফেরার কথা ,সেই সরকারপাড়ার ঢালু রাস্তা, সেইসব পুকুর ,পুকুরে বাবার সঙ্গে সাঁতার শেখাও মনে পড়ে। ছোটবেলার কথা মনে পড়লেই মনটা খুব চঞ্চল হয়ে ওঠে। অনেক কিছু ফেলে আসার দুঃখ এসে বড়ই আঘাত করে। বারবার মনে হয়, সেসব কেন আর কখনো ফিরে পাবোনা ?কেন তারা হারিয়ে যাবে চিরকালের মতো? শুধু স্মৃতির পাতায় তারা মাঝেমধ্যে চকচক করে ওঠে , মনে পড়ে ,আর তখনই মনটা খারাপ হয়ে যায়। হারিয়ে আমি আজও ফেলছি অনেক কিছুই ,সেই দামাল প্রেমকে হারিয়ে ফেলছি ধীরে ধীরে কিন্তু দ্রুতগতিতে। কলকাতা থেকে দূরে থাকতে থাকতে প্রতিদিনের চেনা শহরটার সঙ্গেই আর তাল রাখতে পারছি না ,ক্রমশই দূরে সরে যাচ্ছি আমার প্রিয় শহর, প্রিয় বন্ধুরা আর প্রিয়তমার থেকে। সরে যেতেই হবে ,দূরে থাকতে থাকতে  পারিপার্শ্বিকের স্মৃতিতে এভাবেই ক্রমশ ফিকে হয়ে যাব আমি, আমার স্মৃতিতে প্রিয় সবকিছু ।শুধু কোন এক বর্ষার দিন রাস্তার দিকে তাকিয়ে ,বৃষ্টিতে কাক ভেজা কোন একটা লোককে চলে যেতে দেখে, হয়তো ভীষণ কান্না পাবে ,এই কলকাতা থেকে এত দূরে থাকলেও। এ কথা ভাবলেই বড় দুঃখ হয়, হারিয়ে ফেলার ভয় হয়, এবং হারিয়ে আমি সত্যিই ফেলছি। প্রেম, ভালোবাসা, এইসব স্মৃতি,সব স্থির ধ্রুবতারার মতো, সেইটাকে যত্ন করে ধরে রাখতে চাই ।তাই আমার ভালোবাসা ঠিক এখানেই শেষ হয়ে গেছে ,সারা জীবনের মতো স্থির হয়ে আছে সেই অনুভব ।
আমি যে কে এই পৃথিবীর, তা সময়ের চিঠিতে লেখা থেকে যাবে,এইটুকুই স্বস্তি।আমার তাই কোন দুঃখ নেই,কারণ পাওয়া এবং হারানো এ দুই'ই আমার কাছে ভালবাসার রূপ। ভালবাসা হল মোমবাতির আলোয় দেখা চেনা মুখ , ভালোবাসা হল বুক দিয়ে ধরে নেওয়া বৃষ্টির ফোঁটা, ভালোবাসা হল ইউক্যালিপটাস গাছ, ভালোবাসা হলো আঠাশে এপ্রিল ,বিদায় দেবার চোখের জল আর হেরে বাড়ি ফিরে শাওয়ারের জলে স্নানের সময় মিশে যাওয়া সারা জীবনের কান্না।ভালবাসা কখনো কফি হাউজের কোণের টেবিল,বাটার সামনে প্রতীক্ষা, এমনকি ভালোবাসা আমার কাছে স্বপ্নে দেখা মানবীর সঙ্গে দেখা না হওয়া পুরো সতেরোটা বছর। তবু আজও যখন মনে পড়ে তার কথা, তখন মন কেমন করে ,মন ছুটে চলে যায় ,কিন্তু কখনই বাস্তবিক শারীরিকভাবে  তার কাছে যাওয়া যায়না, সে থেকে যায় চিরকালের জন্য অধরা।আমিও অবশ্য হতে পারিনি  তার মনের কল্পিত প্রেমিক পুরুষ। আমি জানি আমার মধ্যে এমন কিছু নেই, যা তার চিরনতুন মনের অসম্ভব আবেগ আর জটিল ভালোবাসার বিমূর্ত্ত প্রতীক হতে পারে।
আমি বড় বেশী আবেগপ্রবন, কিন্তু আমি আবেগে ভেসে যেতে দিইনা নিজেকে,সংযত করে রাখি ।প্রয়োজনে কঠোর হই। নিজের আবেগ আর হৃদয়ের উন্মাদনা গুলোকে মেরে ফেলে মাঝে মাঝে আমি নিজেকেই বাঁচিয়ে দিই, নইলে আমি শান্তি পেতাম না ।আমি জানি এবং দেখেছি দূরত্ব বাড়ে এবং ঠিক তাই ।হারিয়ে ফেলা সত্যিই ভীষণ দুঃখের, ভীষন কষ্টের ।কিন্তু এই কষ্ট পেতে চাই না বলেও তা পেতেই হয়, পেতে হয়েছে এবং হবেও। যেমন এখন পেতে হল এই দূরদেশে বসে ।এইসব ফ্যাকাশে দুরছাই দিনগুলোই দেখে যেতে হবে বাকি জীবনটা। কিন্তু তা সত্বেও আমি তো ঠিক বেঁচে আছি ।কবিতা লেখা হয়তো বন্ধ হয়েছে ,কিন্তু জীবন এগিয়ে চলেছে।শুধু একটা অভিমান,এতদিন পরেও সেই ছদ্মবেশিনী একইরকম অচেনা,অজানা।এ শুধু চলে যাবার সময় আমার দুঃখময় উপলব্ধি নয়,এ আমার হৃদয়ের গভীর থেকে বেরিয়ে আসা দীর্ঘশ্বাস।অনেক কিছু জানা হলনা,আর হয়ত কোনদিনও হবেনা।একদিন আসবে,যখন আর কোনদিনও দেখা হবে না,কালের গহ্বরে হারিয়ে অনেক দূর চলে যাব আমরা, সেইসঙ্গে এইসব প্রশ্নও মিলিয়ে যাবে চিরকালের মত।যা করতে পারলাম না,যা বলতে পারলাম না,যে চিঠি কোনদিনও তার হাতে পৌঁছল না,তা শেষপর্যন্ত হয়ত ভালোর জন্যই হয়েছে।আমার দুঃখ এই দূরত্বের জন্য,এই জীবনযাপন,এই   সমাজব্যবস্থার জন্য,যা বদলাবার আগেই সম্পর্কগুলো হারিয়ে ফেলব আমি,জীবনটা এতই ছোট আর দ্রুত। এই চলে যাবার যদি ক্ষমা থাকে কোন,মনে মনে  ক্ষমাপ্রার্থী আমি।আমি জানি,আমি নই, আমি হতে পারিনি ,সেই আদর্শ প্রেমিক পুরুষ হতে। থাকি না আমি সেই অন্যরকম অসম্পূর্ণ পুরুষ হয়ে ,শুধু আমার কবিতার পরিচয়ের মধ্য দিয়ে ?এই সামান্য অথচ সারাজীবনের মনের কথাটা সবচেয়ে আগে একমাত্র সেই স্বপনচারিণীই বুঝতে পারবে, যখন আমি থাকবো না তার চোখের মাঝে। সেদিন সেই প্রেমকাহিনী হবে তো লেখা?
সব কথা বলা শেষ হল।বৃষ্টিশেষের ঠান্ডা হাওয়ায় বারান্দায় দাঁড়িয়ে মনটা বোধহয় শান্তি পেল একটু।তারই মধ্যে দেখতে পেলাম ইউক্যালিপটাসের পাতাগুলো সবুজ থেকে আরো সবুজ হয়েছে।চারিদিকে সতেজ যৌবনের প্রথম পরশ,আর তারই মধ্যে বেঁচে আছে একটা পাগলমন।

14 April 2018

বডি

বাজে পুড়ে যাওয়া শিবমন্দিরটার পাশে গজিয়ে ওঠা জঙ্গলটা থেকে দুটো রক্তমাখা পা বেরিয়ে ছিল। দেখতে দেখতে ভিড় জমে গেল। ছেলে-ছোকরাদের মাতব্বর নিতাই এগিয়ে গেল বডিটা বের করতে ।নেতার গাড়ি এসে থামল একটু দূরে। জটলা সরিয়ে নিতাই এগিয়ে এসে বেজার মুখ করে বলল, "স্যার, মালটাকে চিনতে পারছিনা, মাথাটাই নেই।"

বেপরোয়া মাঝরাত

সময় জ্ঞান নেই ,পাত্র-পাত্রী বিচার নেই, নিজের সম্পর্কেও বড় বেশি বেপরোয়া; এমন কেউ চিঠি লিখে , মনের সব জীবনমরণ কথা বলে যাবে ভাবলে, তার পক্ষে রাত দুটোই ঠিক সময় ।আবেগ নেই, ভালোবাসা নেই, সৃজনশীলতা নেই, আর নেই একটা পাগল মন, এমন কেউ লিখলে,সে লেখা কবিতাই হতো না কখনো,সে ছবিতে রঙই থাকত না কোন,আর ফ্যাকাশে একঘেয়ে বর্ষার বিরক্তিতে ধুয়ে ধুয়ে, ক্ষয়ে ক্ষয়ে, শেষ হয়ে যেত সে লেখা। এ কাজ আমার দ্বারা হবে না ।এই গভীর রাতে উল্টো ফুটের বাড়ির ছাদের ঘরে আলো জ্বলছে কিনা,সে বাড়ির বর্ষা অনেক ভাবনার গোপনে ডুব সাঁতার দিচ্ছে ,নাকি বিছানায় হেলান দিয়ে 'কোয়েলের কাছে' ,আর সত্যি সত্যিই সেখানে পৌঁছে গেল কিনা, অনেক চেষ্টা করেও সেকথা জানার উপায় নেই ।বারান্দা থেকে দেখা যায় না তোরসার ঘর। ছাদে উঠে হয়তো এক চিলতে দেখা যাবে, কিন্তু তার জন্য মশারি থেকে বেরোতে হবে ,সাবধানে চটি পায়ে গলাতে হবে ,খুব আস্তে আস্তে খুলে ফেলতে হবে প্রথমে খিল, তারপর ছিটকিনি, তারপর গদরেজ লক্ ।এতসব করলে দরজাটা ঠিক বিরক্তি প্রকাশ করবে ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ করে। তাই সে ব্যাটাকে ঠেকনা দিয়ে রাখতে হবে ,যাতে পাশের ঘরে শব্দ না যায় ।কিন্তু শব্দ যাবেই, আমি জানি। বাবার ঘুম খুব পাতলা ,মা ও জেগে যেতেই পারে। এরপরে আরও আছে। মই বেয়ে উঠতে হবে উপরে। মইটা একদিক ঢক্ ঢক্ করে, শব্দ না করে সেও ছাড়বেনা ।রাতের এই অ্যাডভেঞ্চারে  এরা কোন না কোন অবদান রাখতে বদ্ধপরিকর হবেই। আর শব্দ যা হবে, ভয় হয় তা সব বাধা পেরিয়ে ,ঠিক সময় সোজা বাবার  কানে পৌঁছে যাবে। তারপরেও আধভাঙা দরজাটা খুলে, শেষে ছাদে উঠতে হবে আর ছাদে পা রাখা মাত্রই একটা দমকা হাওয়ায় দরজাটা আছড়ে বন্ধ হবে ,যেটা রাত দুটোয় যে কারোও ঘুম ভাঙানোর পক্ষে যথেষ্ট।এরা কেউই কোনকালে আমার বাধ্য ছিল না,হবেও না,বৃথা শাপশাপান্ত। এমতাবস্থায় ছাদে ত্রিশঙ্কু হব আমি, আমাকে নীচ থেকে বাবার অসংখ্য বকুনি শুনতে হবে, আর কিছুতেই বুঝিয়ে উঠতে পারব না ,আমি ঠিক কি কারনে এই মধ্যরাতে ছাদে উঠেছিলুম। তাই সেই দুর্গম ঘরের আলো জ্বলছে কিনা ,আর  সেই ঘরে সে বেচারা আমার জন্য রাত জেগে বসে আছে কিনা আর একটিমাত্র ঝোড়ো উড়ো চিঠি বুকে করে সতেরোতম বার গোগ্রাসে পড়ে ফেলছে কিনা, তার আভাস পাওয়া ,এখন আর তাই কিছুতেই সম্ভব নয়।কেন যে প্রিয় মানুষগুলোর কাছে পৌছনোই সবসময় এত কঠিন,কে জানে? সুতরাং মশারির বাইরে বেরই হবনা ঠিক করলুম।বসে বসে ফালতু সব কথা ভাবতে লাগলুম আর এইসব বিশেষ কথা যারা ভাবতে পারেনা, তাদের জন্য দীর্ঘশ্বাস ফেললুম।দেখলুম, এই অসীম  ক্ষমতা কেবল ভূভারতে আমারই আছে ,নইলে এই রাত দুটোর সময় কেনই বা আমার ঘুম ভেঙে এইসব অসাধারন জরুরী কথা মনে পড়ে গেল?  আর কেনই বা জানলা দিয়ে মৃদু হাওয়া ঢুকে আমার চুল এলোমেলো করে দিল?সে কি বর্ষা নয়? নাকি সে ঘুমিয়েই পড়েছে তার উষ্ণ ছাদের ঘরে আমার নাম লেখা বালিশে শুয়ে? আর এই যে স্পষ্ট দেখছি চাঁদের আলো আর স্ট্রীটলাইট দুই'ই জানলার এক কোনা দিয়ে ঢুকে, তার মুখের ওপর পড়তে  চেয়েও পড়তে পারছে না,তার কি হবে? কানের কাছে সিলিং ফ্যানের একঘেয়ে শোঁ-শোঁ শব্দ আর আর বুকের ভেতর একফোঁটা দুঃখই হয়ত অগত্যা জেগে আছে। চিন্তা করার বা অবাক হবার কিছু নেই, এই রাতের অন্ধকারকে হারিয়ে আর তার ঘরের জানালার গরাদ পেরিয়ে এই ভাবনাটা, জানি ঠিক ঢুকে পড়বে হুড়মুড় করে সেই ঘরে,সেই ঠোঁটে, কোনো বাধা-নিষেধ না শুনে, সময় জ্ঞান ভুলে; আমারই মত বেপরোয়া ।

12 April 2018

অনিকেত বিজয়

ছেলেটার নাম ছিল বিজয়। বিজয়া দশমীর দিন জন্মেছিল বলেই ওর এই নাম। জন্ম দিয়েই ওর মা অন্ধকারে ঢলে পড়েছিলেন, তারপর বিজয়কে হাতড়ে হাতড়ে, খুঁজতে খুঁজতে গভীরতর অন্ধকারে কোথায় যে হারিয়ে গেলেন!
ছোটবেলা থেকেই বিজয় মামারবাড়িতে মানুষ।ওর বাবা স্কুলমাষ্টারি থেকে ফেরিওয়ালা, জুতোর ব্যবসা থেকে উকিলের মুহুরিগিরি সবই করেছেন, কিন্তু কোনটাই টেঁকেনি বেশিদিন ।বয়সের ভারে শেষে বেশী খাটতে পারতেন না। রোজ রাতে ঘুম চোখে, বাবা অনেক গল্প শোনাতেন ।বাবা ঘুমিয়ে পড়লে অন্ধকারেই বিজয় যেন স্পষ্ট দেখতে পেত ,হাল্কা কাচের পদ্মফুলের মত আলোর শেডের বিচ্ছুরিত মৃদু নীল ছায়ালোক থেকে মা এসে দাঁড়িয়েছেন তার সামনে। তারপর জেগে ঘুমিয়ে কত কথা হতো দুজনের।
 অবশেষে একদিন মামার বাড়ি থেকে বাবার হাত ধরে বেরিয়ে পড়তে হলো দুজনকে।বাবা বলেছিলেন আর জীবনে ওখানে যাবেন না ।একটা ঘর ভাড়া করে অনেক কষ্টে ওরা থাকত।ওদের ঘরে কোন মায়াবী নাইটল্যাম্প নেই,শুধু রাস্তার আলোই এসে পড়ে ,সেই আলো আঁধারের মধ্যে অনেকক্ষণ চোখ সওয়ালে বাবার ঘুমন্ত মুখটাই দেখা যায় শুধু।
 বিজয়কে ছোটবেলায় একটা স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিলেন বাবা, কিন্তু পরে মাইনে দিতে না পারায় আর সে স্কুলে পড়তে পারেনি। কিন্তু সেদিন বাবাই ওর হাত ধরে নিয়ে গিয়ে, ওকে একটা ফ্রি নাইট স্কুলে ভর্তি করে দিলেন।
এদিকে বাবা রাতের খাওয়া বন্ধ করলেন,খেলেই বমি হয়ে যেত। বাবা ই এতো দিন বিজয়কে স্নেহের বাঁধনে আগলে রেখেছিলেন।সেই বাবাও একদিন হুট করে মার কাছে চলে গেলেন। বিজয়ের বয়স তখন মাত্র দশ। মামার বাড়িতেই আবার থাকতে শুরু করলো ও। কিন্তু একদম ভালো লাগতো না ।মামার বাড়ির যে ঘরটায় শুয়ে শুয়ে বাবার কাছে গল্প শুনত বিজয়,সেই ঘরটায় এখন ছোটমামার সংসার ।ঐ ঘরে ওকে ঢুকতেই দেয় না। ঘরটা অনেক বদলে গেছে, কিন্তু মাথার ওপর পদ্মকাটা হালকা নীলচে আলোর শেডটা সেই একই রকম আছ। ঐ ঘরে শুয়ে শুয়ে ছোট মামা এখন হয়তো ওর ছেলেকে গল্প শোনায়। কখনো মামার বাড়ির তিনতলার জানালা দিয়ে রাস্তার দিকে চেয়ে থাকে বিজয়। বাড়ির সামনে দিয়ে পূব থেকে পশ্চিমে ট্রামলাইন চলে গেছে। ওই রাস্তার ডানদিকের ফুটপাথ দিয়েই বাবা হেঁটে আসতেন, কোন কোন দিন তিনতলার ঝুলবারান্দায় দাঁড়িয়ে বাবার জন্য অপেক্ষা করত ও। বিকেলবেলা বাবাকে আসতে দেখলেই, ছুটে চলে যেত নীচে। তারপর দুজনে ওপরে আসত।
বড়মামা বিজয়কে খুব ভালবাসেন ।তার জন্যই সে এ বাড়িতে থাকতে পেরেছে।বড়মামা বিজয়কে  স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছেন। সে মন দিয়ে পড়াশোনা করে আর ভাবে, বাবার খুব ইচ্ছে ছিল তার লেখাপড়া  হোক।সে পড়বেই।ছোটবেলা থেকে না খেয়ে না পড়ে, নানা অপমান আর দুঃখ-কষ্টের মধ্যে মানুষ হলেও, বিজয়কে কেউ কখনো কাঁদতে দেখেনি ।বাবার মৃত্যুতেও সে কাঁদেনি।
 স্কুল ফাইনালে দারোন ভাল রেজাল্ট করে বিজয় এখন কলেজে পড়ে। মামার বাড়ির কেউ ওকে দেখতে পারে না। বড়মামার ভালোবাসা পায় বলে ,ও যেন সকলের চোখের কাঁটা হয়ে উঠেছিল ।বড়মামার ভালো রোজগার, তার মুখের উপর কেউ কোন কথা বলতে পারতো না ।বাবা মারা যাওয়ার পর, বাবার অভাব বুঝতে না দেবার জন্য ,বড় মামা অনেক চেষ্টা করেছেন।বিজয়ও  তাকে ভক্তি করত ভগবানের মতো। ওকে পড়াশুনা করতেই হবে ।বাবার শেষ ইচ্ছে, বড়মামার এত চেষ্টা ,এতো ভালোবাসার দাম ওকে দিতেই হবে। নিজের পায়ে একদিন দাঁড়িয়ে তারপরেই ওর ঘরে বাবার যে ছবিটা আছে, সেটার সামনে দাঁড়িয়ে বাবাকে প্রনাম করে বলবে, "দেখো, এই সেই আমি।" ভাবতে ভাবতে বিজয় তন্ময় হয়ে যায়। ছোটবেলা থেকে আঘাত পেয়ে পেয়ে ওর চোখে আর জল আসে না, বুকে তাই ওর আঠেরো বছরের কান্না জমানো।
 বড়মামার শরীরটা কিছুদিন ধরেই খারাপ যাচ্ছিল। সেদিন সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে, মাথা ঘুরে পড়ে গেলেন। হার্ট অ্যাটাক। ডাক্তার আসার আগেই ,সব শেষ ।বিজয়ের সামনে থেকে পৃথিবীর সমস্ত আলো যেন এক নিমেষে হারিয়ে গেল।
নিজের জীবনের যে ছবিতে বিজয় শুধু  অবাক হয়েছিল,মামাতো ভাইয়ের সেই ছবি দেখে, বিজয়ের নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হতে লাগল।একটু আগেই সে দেখে এসেছে ছোটমামা পুরোনো ল্যাম্পশেডটা খুলে ফেলেছেন। অন্ধকার রাতে ,দেওয়ালের যে লাইটশেডে এক স্বপ্নের ঘোর এসে ঘিরে ধরত,আর না দেখা মা'র একটা অস্তিত্ব এসে ভালবাসার পরশ দিয়ে যেত, সেই লাইটশেডটা আর নেই।একটা কঠিন পাথরের মত কি,গলা দিয়ে যেন উঠে আসতে লাগল ।পড়াশোনা আর বোধহয় হল না।কে পড়াবে? এখন কি তবে চাকরির চেষ্টা করতে হবে ?সেটাই বা কে বলে দেবে?বিজয়ের প্রথমবার মনে হল এই পৃথিবীতে সে সম্পূর্ণ একা।মনে হল,"বাবা ,মামা ,তোমাদের শেষ ইচ্ছে আমি বোধহয় রাখতে পারলাম না ।"
দুপুরের কাঠফাটা রোদে আবারও বড়রাস্তায় চোখ চলে যায় ,ছাতা মাথায় একটা লোককে অনেক চেনা ভঙ্গিতে হেঁটে আসতে দেখে, ওর চোখ মুখ গলা বুক বেয়ে ঝর্ণার মত কান্না উথলে উঠল ।বালিশে মুখ গুঁজে হুহু করে কেঁদে উঠল সে। সারা জীবনের সব আবেগ, সব জমে থাকা কান্না, যেন সেদিন বেরিয়ে এল ওর হৃদয় থেকে ।"মাগো তোমায় আমি কোথায় পাব, মা ?আর বাবা ও তো নেই ।মামা ও যে চলে গেল ।"
বিজয়কে সেই প্রথমবার কেউ হয়তো কাঁদতে দেখলো।কিন্তু তারপর সে যখন ধীরে ধীরে, দুহাতে সে কান্না দৃঢ়ভাবে মুছে ফেলল,সে দৃশ্য কিন্তু নিশ্চিতভাবেই কেউ দেখল না।এসব জিনিস কেউ কোনদিনও দেখে না।(সারাংশ)

11 April 2018

মরসুমি পাতাঝরা

শীতকাল কাউকে কোথাও পৌঁছে দেয় না ।এই যে শীতের শুরুতে আমার তার সঙ্গে আলাপ ,মধ্যভাগে প্রেম আর শেষ শীতে এই যে আমি একা একা দেবদাসের মতো বসে মাথা চুলকোচ্ছি, এর থেকে আজ এইটাই মনে হয়।
প্রথম শীতের স্বভাবের মধ্যে একদিন তাকে ট্রামের ফার্স্ট ক্লাসে প্রথম দেখি। সে নেমে গেল বিদ্যাসাগর কলেজে, আমার যাবার কথা ছিল কলেজস্ট্রিট- বই কিনতে। মন্ত্রমুগ্ধের মতো আমিও তার পেছনে নেমে গেলাম। প্রথম দিন তার সঙ্গে কিভাবে কথা বলব তা বুঝতে পারিনি।
সেদিন আলাপ করা আর আমাদের মরসুমি প্রেমের ইতি, মাঝে তিনটে মাস। একদিন ,শীতের আর্তিতে কাঁপতে কাঁপতে আমি দেখলাম, আমি আবার একা হয়ে গেছি,সে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে।আমার চেয়েও আকর্ষণীয় কাউকে কি সে পেয়ে গেছে? তাহলে সেদিন কার সাথে হাঁটছিল হেদুয়ার পাশ দিয়ে? কাকে ফোন করত সে, প্রায়ই আমাকে বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়াতে বলে, আড়ালে? আমি কি তার দরোয়ান হয়ে গেলাম? কিন্তু আমি যে তার সাথী হতে চেয়েছিলাম।
 শীতকাল চলে যেতে বসেছে, ফুল ঝরে গেছে ডালিয়া, চন্দ্রমল্লিকা, অ্যাসটারের। বর্ষপ্রেমিকা চলে গেছে দুরে,হয়ে গেছে অধরা,ঠিক প্রথম দিনের মতই। এই মাঝরাতে তাই ভীষণ জলতেষ্টা, ভীষণ জড়িয়ে ধরা শেষ রাতের কম্বলের উত্তাপকে। ভীষণ মনে পড়ছে সেই পথ চলা ,টুকরো টুকরো কথা, অমলিন হাসি।নাঃ, আর হলো না এ জীবনে। নইলে কেন বারবার হেরে যাই আমি?
এরপরে বোঝাবার মত রাত্রি নেই ,এরপরে দুঃখ বোঝাবার কিছু নেই ,নেই একাকীত্ব বোঝাবার। এর চেয়ে বড় বিষ কিছু হয়না, এর থেকে বড় আঘাত আর হয়না ।এই মনকেমনের জবাব এলো না এবং সেই দিন হলো ,সেই রাত হল, সেই পথ চলতে ফিরে দেখতে হল চেনা ভঙ্গিমা।
এর চেয়ে ভাল ছিল দিন আনি দিন খাই, এর চেয়ে ভাল ছিল প্রথম দিন রাত্তিরে ধেবড়ে যাওয়া কাজল মুছে আবার নতুন করে কাজল পরা, এর চেয়ে ভালো ছিল কোমর জড়িয়ে উদ্দাম নাচা অচেনা কারো সঙ্গে আর পরেরদিন অন্ধকার ঘরে খুনসুটি করা অন্য কারো সঙ্গে। এর চেয়ে অনেক ভালো ছিল কোনদিন কবিতাই না লেখা, কোনদিন স্বপ্নই না দেখা।সাবানের ফেনার রামধনুতে আর স্বপ্ন দেখব না।
এতে লোকে হয়তো আমাকে ঘেন্না করবে। লোকে আমার গায়ে থুতু দিক, তবু জীবন নিয়ে নতুন করে জুয়া আমি খেলব না ।আমি জুয়া খেলবো শুধু খেলার মেজাজে ।সেখানে আবেগ থাকবেনা, চুম্বন থাকবে না, হাতের মধ্যে আঙুল নিয়ে খেলা থাকবে না। আমায় ঘেন্না করো সবাই, কারণ আমি নিজেই নিজেকে ঘেন্না করি। কারণ আমি লোক ঠকাই, কারণ আমি বাস্তববাদী, কারণ আমি আবেগের মূল্য ভুলে গেছি, কারণ আমি পথ চলতে ইচ্ছাকৃতভাবে হড়কে যেতে চাইনা, মনের মধ্যে আগুন চেপে রেখে সঙ্গিনীর সঙ্গে ন্যাকামিতে ভরা গল্প চালাতে চাইনা।
কথাটা ঠিকই, শীতকাল কাউকে কোথাও পৌঁছে দেয় না। শুধু পাতাঝরা বিকেলে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পথ হারিয়ে দেয় ,প্রতিবারই।

10 April 2018

বিপরীত বর্ণমালা


ফুটপাতের ধারে রকে পা ঝুলিয়ে বসে বুধো বিড়ি টানছিল। এখন দুপুর বেলা, তায় গ্রীষ্মকাল। রাস্তায় লোকজন কম। হঠাৎ উল্টোদিকের ফুটপাতে হলুদ শাড়ি পরা কে যেন যাচ্ছে, অহনা না? চমকে ওঠে বুধো। বিড়িটা ছুঁড়ে ফেলে ,ভালো করে ঠাহর করে। কিন্তু না, অহনা তো এত লম্বা ছিল না। অহনা বলে যাকে মনে হয়েছিল সে একটা ট্যাক্সি ধরে চলে যায় ।হুশশ্।অমনি বুধোর ভাবনার ঘোড়াও দৌড়াতে শুরু করে দিল। এককালে সে হুটহাট প্রেমে পড়ত, অনেক প্রেমিকাও ছিল। অ্যালফাবেটের এক একটা লেটার দিয়ে ওদের নাম শুরু। কখনো এক লেটার দিয়ে শুরু এমন নামের দু'জনের সঙ্গে প্রেম করতো না বুধো। তখন তার সময় ছিল, চেহারার জৌলুস তো ছিলই, অর্থের বড়াইও ছিল। বাবা ডাকসাইটে ডাক্তার, লেকটাউনে তিনতলা বাড়ী, দুটো বিশাল গাড়ি ,গেটে দারোয়ান ।জিন্সের উপর  ছোট টি-শার্টে বাইসেপ বার করে ,একলাখি বাইক নিয়ে , চোখে রে ব্যান লাগিয়ে ও বের হত ,ব্যাকব্রাশ চুলে জেল চকচক্ করছে আর পকেটে ভর্তি কড়কড়ে টাকা। বন্ধু বান্ধবী মহলেও ওই ছিল মধ্যমণি।
কিন্তু হঠাৎ করে কি যে হয়ে গেল ।বুধোর বাবা একদিন হুট করে চোখ বুজলেন ,হার্ট অ্যাটাক ।দাদার সঙ্গে সম্পত্তি নিয়ে ঝামেলা শুরু হল, একদিন দাদা-বৌদিই ওকে ফাঁসিয়ে দিল ,ওর নামে ওয়ারেন্ট বেরোল বেআইনি অস্ত্র রাখার দায়ে।পুলিশ সার্চের সময় বুধোর ঘরে,ওর নিজের আলমারির মাথায় পাওয়া গেল দু'দুখানা বিদেশী আগ্নেয়াস্ত্র। মাত্র পাঁচ বছর জেল হয়েছিল। কেউ কোন খবর আর রাখেনি,যা হয় আরকি।তারপর থেকে বুধো এই ফুটপাতেরই বাসিন্দা । বাড়িতে ঢুকতে দেওয়া হয় না ওকে,শুনেছে মারও নাকি স্থান হয়েছে কোন বৃদ্ধাশ্রমে,সম্পত্তিলোভী দাদা-বৌদি আটঘাট বেঁধেই কাজ করেছে,মার ঠিকানা পর্যন্ত জানতে দেওয়া হয়নি ওকে।আর একটা বিড়ি ধরাল বুধো,ও এখন ফুটপাতেই নবুদার ভাতের হোটেলে ফাইফরমাস খাটে, মাসে বারোশো টাকা পায় আর দুবেলার খাবার ।তাতে বিরক্তি নেই বুধোর ।ও জানে পাশা একদিন উল্টোবেই। ও অপেক্ষা করে থাকে ।
ধুলো উড়িয়ে একটা বাস চলে গেল।বিড়িটা কখন নিভে গেছে,তেঁতো লাগল বুধোর, থুতু ফেলল,তারপর আধখাওয়া বিড়িটা আছাড় মেরে ফেলে খিস্তি করে উঠল।
ইদানিং রাতেও বেরোতে হচ্ছে বুধোকে,ঐ রোজগারে আর চলছে না। গতকাল অবশ্য সারা রাত একটাও হাত মারতে পারা যায়নি,আসলে লাইনে নতুন তো। সিমেন্টের রকে বসে বসেই সারা রাতজাগা ক্লান্তি ওকে ঘিরে ধরে,ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসে বুধোর।ওখানেই শুতে যাবে,হঠাৎ ঠিক তখনই কোথা থেকে একটা বুড়ি এসে জড়োসড়ো হয়ে বসে রকের কোনটায়,সাদা কাপড়ে মুখটা ঢাকা,হাতে একটা ছোট পুঁটলি।কিছু  বলতে   গিয়েও কি একটা মনে করে বুধো চুপচাপ নিজের জায়গাতেই বাবু হয়ে বসে রইল।চোখ গিয়ে পড়ল সেই পুঁটলিটায়। "কোথায় যাবে গো ঠাকমা?কি নিয়ে চললে পুঁটলি করে?"ও বলেই ফেলে।বুড়ি ওর লোভী দৃষ্টি বুঝতে পারে বোধহয়, পুঁটলিটাকে আরও জড়িয়ে ধরে ।বুধো  চোখ নামিয়ে নেয়,তারপর মাথাটা নিচু করে কি যেন একটা সুর ভাঁজে। একগাদা মাছি ভন্ ভন্ করছে চারিদিকে,ও পরোয়া করে না।সুরটা ওকে প্রতিদিনই তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়।কোনোদিন রাতে ভাল দাঁও মারতে পারলে আপন মনেই গলা দিয়ে বেরিয়ে আসে গানটা। আবার আজ যে একেবারেই মালকড়ি হয়নি - তাতেও নাছোড়বান্দা। এটা ভেবেই শব্দ করে হেসে ওঠে বুধো। পাশে চায়ের স্টল থেকে সাধনদা বলে "কি রে বুধো, একা একা হাসছিস যে বড়? কিছু হলো টোল?"বুধো কিছু বলে না,নিষ্ফল রাগে এক লাথি মারে মাটিতে শুয়ে থাকা কুকুরটার গায়ে। “কেঁউ” করে ককিয়ে উঠে, কুকুরটা চলে যায়।ওদিকে বুড়িটাও উঠে পড়ে,গুটিগুটি রওনা দেয় অজানা কোন দিকে ।
  বুধো রকের ওপরেই শুয়ে পড়ে,ওর আর কোন গন্তব্য নেই।সুরটা আবারও ভেসে আসছে। অনেক শান্তিতে চোখটা জড়িয়ে আসছে। সুরটা ঘিরে ধরছে ,বুধোও পালাতে চাইছে না। শেষে সুরটা ঘুমের জমাট কুয়াশার মত বুধোকে গ্রাস করে। কাজ না থাকলে ঘুম আসতে ওর এক মিনিটও লাগেনা। শুধুমাত্র সেই কারণেই বুধো ঘুমিয়ে পড়ে।
ঘুমের মধ্যেই শোনে, কে যেন ওকে ডাকছে ‘অসিত ও অসিত’। কে আবার ওর ভালোনাম ধরে ডাকছে, নামটাতো ভুলতেই বসেছিল ও। গলাটা কিন্তু খুব চেনা, ঘুমের মধ্যেই বুধো চিনতে পারে। ‘মা’ বলে ডেকে ওঠে। কিন্তু কোথায় মা, এ তো সেই বুড়িটা। একটু আগেই যে বসেছিল রকের কোনটাতে। ঘুমচোখে ভাল করে মুখটা তখন দেখেইনি বুধো।শেষে চিনতে পেরে ‘মা,তুমি এসেছ?’ বলে কেঁদে ওঠে বুধো।
 ঘুমটা ভেঙে যায়, স্বপ্ন নয় সত্যি। বুধো দেখে, ওর মাথায় গায়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে ওরই মা।‘এতদিন কোথায় ছিলে মা?কি করে খবর পেলে?’বুধোর মনটা প্রশ্নে জর্জরিত। কতদিন পরে অবশেষে মা ছেলের দেখা হল। দুজনেই কাঁদতে লাগল একে অপরকে জড়িয়ে।
বুধো থেকে অসিত হয়ে শেষে গন্তব্য স্থির হল। দুজনে হাত ধরাধরি করে  হেঁটে যেতে থাকল পুলিশফাঁড়ির দিকে।

7 April 2018

বর্ষাকে শেষ চিঠি


আজ এই শেষ চিঠি লিখতে গিয়ে মনে হয়, তুমি যদি সারাজীবন ধরে আমার পাশে থাকতে, আর আমাকে প্রতিদিনই নতুন করে আবিষ্কার করতে, তবে বড় ভালো হত। কিন্তু ভেবে দেখ,এই আমাকে বাদ দিয়ে এই কথাগুলো , হয়ত এক টুকরো কাগজে লেখা ফালতু কথা হয়েই উড়ে হারিয়ে যেত। তাই অহেতুক আমার অত দাম দিওনা।
একমাত্র তোমাকে না পাবার  দুঃখ-অভিমানেই ,না বলা কথাগুলোকে বাঁধন ছিঁড়ে মুক্ত করে দিয়েছি আমার মন থেকে তোমার মনে ।কারণ তুমি সকলের থেকে আলাদা। তোমাকে আমি যেটুকু বুঝেছি, তাতে দেখেছি তুমি অনেকটা আমারই মতো ।তোমার- আমার হয়তো কোনদিনই সবুজ হওয়া হয়ে উঠবে না, তবু বলছি, দূর থেকেই বলছি ,তোমার অনুরণন যে আমাকে পাগল করে তোলে, তা হয়তো বা তুমিই প্রকৃত বুঝতে পারবে একদিন ,যেদিন আমিই হয়তো থাকব না। তখন কোন শীতের দুপুরবেলা হঠাৎ নীল আকাশে হারিয়ে যাওয়া ছোট্ট চিলটার দিকে তাকিয়ে, আমার কথা তোমার মনে পড়বে, আর তখনই দেখো ঠিক, তোমাকে কাঁদিয়ে যাবে আমার সেই ‘আমি’ ।
আমার একান্ত আপনার জনের বিষয়ে আমার আদৌ কোনো বিশ্বাস নেই। আমি জানি সেই একজনকে আমি কোনদিনও পাবনা ।যে একদিন আমার হবে ,সে হয়ত কোনদিনই আমার কবিতা বুঝবে না ,দিন আনি দিন খাই ভালোবাসার রাতে লাল নাইটল্যাম্পের তলায় শুয়ে নীরবে কেঁদে যাবে আমার কবিতা ।সেই একজন হতে পারতে তুমি ,বর্ষপ্রেমিকা,অথচ নামহীন সম্পর্কের নদীতে ,পাতার নৌকা হয়েই সে হয়ত চিরকাল ভেসে যাবে ।তোমার কাছে থাকতে পারছি না,ইচ্ছে না হলেও বাধ্য হয়েছি তোমাকে কলকাতার পথচলতি ফুটপাতে ছেড়ে আসতে।সেখানে আমার কোনো জোর নেই, ভিড়ে হারিয়ে যাবার পর কত সহজেই, তোমার প্রতি আমার সব দাবী হারিয়ে যায় ।কিন্তু,তুমি কাছে থাকো বা দূরে ,তোমার সংজ্ঞা ,তোমার স্মৃতি, আমার মনের সবচেয়ে দামি ঘরে তালাবন্ধ হয়ে আছে ,আর সেই ঘরের ভেতরে প্রবেশাধিকার শুধুমাত্র আমার। একথাই আমাকে আজ শান্তিতে রেখেছে, জীবনের সমস্ত ওঠা-পড়া,দুঃখ ,অভিমান একাকিত্বে পাশে থেকেছে, উৎসাহ দিয়েছে ,বলেছে আমার নাম আর আমার সমস্ত আবেগ, চেতনা আর বোধের মূল্য আছে ,প্রাণ আছে- আছে ভালবাসার টান- তোমাতে, যা কখনই শেষ হয়ে যেতে পারে না ।
সেইখান থেকেই আমার আবার নতুন পথচলা শুরু হয়। পেছনে পড়ে থাকে সমস্ত স্বার্থান্বেষীদের কাতরোক্তি, লোভী আর হিংসুটেদের বড় লোলুপ চোখ, হিংসার রক্তাক্ত ছুরি।সমস্ত বিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে মলিকুলার ফিউশন আর ফিশনকে মাড়িয়ে চলি আমি, সমস্ত পাহাড়ের মধ্য দিয়ে আমি খুঁড়ে ফেলি সুড়ঙ্গ, এমনকি সমুদ্রের তলা থেকে কুড়িয়ে আনি মুক্তোঝিনুক, শুধু তোমাকেই দেব বলে। এইভাবেই চলতে থাকে আমার জীবনযাপন ।সবাইকে, এমনকি তোমাকেও পেরিয়ে চলে যাই অজানা লক্ষ্যে  আলোয় পথ ধরে, অভূতপূর্ব চোখের ডাকে।আমার চলা একদিন শেষ হবে, যেদিন জীবনের লক্ষ্যে আমার জন্য অপেক্ষা করে থাকবে শুধু আমারই একটুকরো সবুজ দিন। সেই সবুজ বৃষ্টিতে আমি বুক পেতে দেব।আমার চোখ, মুখ, গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে,আমার সারা শরীর ভিজিয়ে ,আমার সবুজ হবার পালা ।জানি সেদিন তোমার অভিমান হবে, রাগ হবে ,দুঃখ হবে। কিন্তু সে সমাপ্তি তো একান্ত আমার নিজের, তার ভাগ পাবে না তুমি, কারন তোমাকে তো বাঁচতে হবে,তোমাকে তো আমায় হারাতেই হবে। সেদিন তুমি শেষবারের মতো আমাকে হারাবে, এমনকি আমিও হারাবো তোমাকে ,শুধু এই জন্যই যে আমি আমার হৃদয়ের সমস্ত আবেগ ,তোমার কাছে পৌঁছে দিতে পারিনি ,তোমার জন্য শুধু তোমারই হতে পারিনি, তোমাকে কাছে টেনে নিতে পারিনি ।এ আমার ব্যার্থতা নয়, এ হলো এই পথের ইতিহাস,এ পথের ভবিতব্য ।এই পথে চলতে চলতে, আমি আমার সীমিত হাতের তালুতে তোমাকে ধরে রাখতে পারিনি ,আমার ছোট্ট ঘরের কোণে দুধেল বিছানায় তোমাকে নিয়ে যেতে পারিনি।আমি মন দিয়েছিও মাত্র একটুকরো ,আর তার বদলে তোমার মনেরও ঠিক একটুকরোর বেশি নিজের করে নিতে পারিনি। তুমি চলে গেছ তোমার নিজের ছন্দে, সুরে, জীবনবোধে ।তুমি যেন নদী হয়ে,আমার তৃষিত বালুচর সবুজে ভরিয়ে দিয়ে, বয়ে চলে গেছ। তুমি স্থান-কাল-পাত্র, জীবন-মরণ, পার্থিব-অপার্থিবের হাতের পুতুল নও,তুমি চিরন্তনী বহমান,তুমি আবেগ সঞ্চারী চেতনার নদী, তুমি বর্ষা। আমি যে কে তোমার, তা চিঠি লিখে সময়ের কাছে দিয়ে দিও ,তাহলে আমিও স্বস্তি পাব।
 পাওয়া এবং হারানো এ দুই'ই আমার কাছে ভালবাসার রূপ। ভালবাসা হল মোমবাতির আলোয় দেখা তোমার মুখ , ভালোবাসা হল বুক দিয়ে ধরে নেওয়া বৃষ্টির ফোঁটা, ভালোবাসা হল ইউক্যালিপটাস গাছ, ভালোবাসা হলো আঠাশে এপ্রিল ,আর্চিস গ্যালারি,বিদায় দেবার চোখের জল আর বাড়ি ফিরে শাওয়ারের জলে স্নানের সময় মিশে যাওয়া সারা জীবনের কান্না।ভালবাসা কখনো কফি হাউজের কোণের টেবিল,বাগবাজার বাটার সামনে প্রতীক্ষা, এমনকি ভালোবাসা আমার কাছে তোমার সঙ্গে দেখা না হওয়া পুরো আঠেরোটা বছর। তবু ভালোবাসা মানে নর-নারীর প্রেম শুধু নয়।জীবনের এক একটা মূল্যবান ঘটনা ,যে সময়গুলো আমি মনে রেখেছি,ভালোবেসে ফেলেছি, অসংখ্য স্মৃতি, অসংখ্য মানুষ আর তাদের সকলের সঙ্গে আমার উপস্থিতি যখন এক হয়ে যায়, যখন মনে পড়ে সে কথা, তখন মন কেমন করে ,মন ছুটে চলে যায় ,কিন্তু শারীরিকভাবে বাস্তবিক তার সঙ্গে যাওয়া যায়না, সে থেকে যায় চিরকালের জন্য অধরা।বিশ্বজনের জন্য এই আবেগ বিহ্বলতাও জীবনের ভালবাসারই অঙ্গ। তুমি যে দেখেছ ,আমি তোমার মনের কল্পিত প্রেমিক পুরুষ, এ ঠিক নয়। আমি জানি আমার মধ্যে এমন কিছু নেই, যা তোমার চিরনতুন মনের অসম্ভব আবেগ আর জটিল ভালোবাসার বিমূর্ত্ত প্রতীক হতে পারে।
শুধু একটা অভিমান,এতদিন পরেও তুমি আজও অনেক অচেনা,অজানা।এ শুধু চলে যাবার সময় আমার দুঃখময় উপলব্ধি নয়,এ আমার হৃদয়ের গভীর থেকে বেরিয়ে আসা দীর্ঘশ্বাস।অনেক কিছু জানা হলনা,আর হয়ত কোনদিনও হবেনা।একদিন আসবে,যখন তোমার আমার আর কোনদিনও দেখা হবে না-কালের গহ্বরে এই সম্পর্ক হারিয়ে যাবে,অনেক দূর চলে যাব আমরা, সেইসঙ্গে এইসব প্রশ্নও মিলিয়ে যাবে চিরকালের মত।
তোমারও কিন্তু পুরো আমাকে জানা হয়নি,যা করতে পারলাম না,যা বলতে পারলাম না,যে চিঠি কোনদিনও তোমার হাতে পৌঁছল না,তা শেষপর্যন্ত হয়ত ভালোর জন্যই হয়েছে।আমার দুঃখ এই দূরত্বের জন্য,এই জীবনযাপন,এই সমাজব্যবস্থার জন্য,যা বদলাবার আগেই তোমাকে হারিয়ে ফেলব আমি,জীবনটা এতই ছোট আর দ্রুত। এই চলে যাবার যদি ক্ষমা থাকে কোন,মনে মনে অন্ততঃ ক্ষমা করে দিও।আমি জানি,আমি নই, আমি পারিনি ,সেই আদর্শ প্রেমিক পুরুষ হতে। যদিও একদিন আমিই,হয়ত পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ প্রেমিক হতে পারব আর সবচেয়ে আগে একমাত্র তুমিই তা বুঝতে পারবে, কিন্তু তখন তো আমি থাকবো না তোমার চোখের মাঝে ! সেদিন আমায় মনে পড়বে  তো বর্ষা?

2 April 2018

গেরুয়া রোদ্দুর

হঠাৎই ঘটলো ব্যাপারটা-মানে এই টাকা পেয়ে যাওয়াটা আরকি। বিশ্বনাথবাবু এতটা আশাই করতে পারেননি। জীবনে লটারির টিকিট কেটেছেন বহুবার ,কিন্তু একলাখ দুলাখ তো দূরের কথা, পাঁচটা টাকা পর্যন্ত কখনো পাননি ।তাই একেবারে পঞ্চাশ লাখ টাকা পেয়ে গিয়ে বিশ্বনাথবাবুর তো হার্টফেল করার অবস্থা। কিন্তু টাকাটা নিজের নয়, একথা তিনি ভাবতেই পারছেন না,মেনে নেওয়া তো দূরের কথা।
ব্যাপারটা খুলেই বলি ।আসলে দিন পনেরো আগে পাড়ার পঞ্চার কাছ থেকে তার বাল্যবন্ধু শ্যামল একটা টিকিট কেটেছিলেন।শ্যামলের কোনদিনই ওইসব লটারি ফটারির ব্যাপারে কোন আস্থা ছিল না, খেটেখাওয়া মানুষ। কিন্তু পঞ্চাও তো তারই সামনে বড় হয়েছে।মা বাপ মরা ছেলেটা খেতে না পেয়ে, অভাবের তাড়নায় লটারির দোকানটা খুলেছে। সেই এসে তাকে গছিয়ে গেছে,আর তিনিও যথারীতি ভুলে যেতেন টিকিটের কথা।  ভুলো মনের জন্যই টিকিটটা তাই বিশ্বনাথবাবুকে দিয়ে দিয়েছিলেন।দেবার সময় হেসে বাল্যবন্ধুকে বলেছিলেন " টাকাটা উঠলে তুই'ই নিয়ে নিস"। তার পরেই শ্যামলবাবু চলে গেছেন বড় মেয়ের বাড়ি কদিন ঘুরে আসতে।এদিকে আবার পঞ্চাও তার দোকানে এলাহি ব্যাপার স্যাপার করে বসেছে-ওর দোকান থেকে নাকি সেকেন্ড প্রাইজ উঠেছে-পঞ্চাশ লাখ টাকার।
গতকালই বিশ্বনাথবাবু টিকিটটা মিলিয়েছিলেন পঞ্চার দোকান থেকেই ।ঘোড়েল পঞ্চাটা আবার জিজ্ঞেস করছিল টাকা ফাকা উঠেছে কিনা ।সেকেন্ড প্রাইজটা যে তারই ভাগ্যে উঠেছে, মানে শ্যামলবাবুর আরকি, সে কথাটা বেমালুম চেপে গিয়েছিলেন।
টাকা উঠেছে দেখেই বিশ্বনাথ বাবু মনে মনে ঠিক করলেন ওই টাকাটা আর শ্যামলবাবুকে দেবেন না। শ্যামল নিজেইতো বলেছিল। ভাবলেন শ্যামলের টাকার অভাব কি? আর তাছাড়া এতদিন পর ফিরে এসে ওর আর অত মনেও থাকবে না। আর থাকলেও নিদেনপক্ষে ঐ নম্বরটা ?সে মনে রাখা দুঃসাধ্য ।অতএব "ওঠেনি" বলে চালিয়ে দিলেই হয়।আর তিনি নিজে যে মাঝেমাঝেই লটারির টিকিট কাটেন,একথা সবাই জানে।সুতরাং দুয়ে দুয়ে চার মিলে যেতে আর অসুবিধা কোথায়?
(তারপর বিশ্বনাথবাবু কি করলেন?কি হল শেষ পর্যন্ত?পুরো গল্পটা পড়তে হবে)