25 June 2019

পলাশ আর পাখি

           খড়্গপুরের কাছেই নারায়ণগড় থানার যমুনা গ্রাম। তারই পোস্ট অফিসে বদলি হলুম পোস্টমাস্টার হিসেবে। তখন আমার ঝাড়া হাত-পা, বিয়ে থা হয়নি। প্রত্যন্ত, অখ‍্যাত, অজানা সব গ্রামে পোস্টিং নিতে তাই বেশ ভালই লাগত। জায়গাটাও চেনা হত। শহুরে ছেলের গ্রামের প্রতি টান তো থাকবেই, চাকরিটা যেন সেই ভালোবাসাকেই ঝালিয়ে নেবার একটা সুযোগ এনে দিল।
           এপ্রিলের মাঝামাঝি তল্পিতল্পা গুটিয়ে রওনা দিলুম। ট্রেন থেকে নেমে ,ভ্যান রিক্সা করে ঘন্টাখানেকের রাস্তা।পোস্ট অফিস বলতে একটা টিনের চালার ঘর, তারই পাশে তেমনই অবস্থা পোস্টমাস্টারের কোয়ার্টার। ভ্যান থেকে নেমে চোখ জুড়িয়ে গেল , চারিদিকে সবুজে সবুজ ।ঠিক যেমনটি চেয়েছিলুম।
 যাইহোক ,দায়িত্ব বুঝে নিয়ে, নিজের কোয়ার্টারখানা তাড়াতাড়ি গুছিয়ে ফেললুম, জিনিস তো মাত্র কটা বই আর বিছানাপত্র। নিঝুম পাড়াগাঁ, লোকজন কমই আসে পোস্ট অফিসে। স্টাফ বলতে বয়স্ক পিয়ন বামাপদবাবু। বেশ রসিক মানুষ ,নানা গল্পে দুজনের সময় কেটে যায়। বিকেলে নারায়ণগড় থেকে ডাকের গাড়ি এলে সব চিঠিপত্র বুঝিয়ে, পোস্ট অফিস বন্ধ করে, তবে বাড়ি আসি।বামাপদবাবুও  সাইকেল নিয়ে ফিরে যান বারো মাইল দূরে নিজের বাড়িতে।
          এই ভাবেই চলছিল বেশ। আস্তে আস্তে বুঝতে পারলুম, গ্রামটার বেশিরভাগ লোকই গরিব আর জাতপাত রয়েছে ভীষন ।ব্রাহ্মণরা তথাকথিত নিচু জাতের লোধা- শবর -হরিজনদের  ছোঁয় না, থাকেও সব আলাদা আলাদা পাড়ায় ,অদৃশ্য একটা লাইন টানা রয়েছে সবখানে।  গ্রামে কারো বিয়েতে সব জাতের লোককে নেমন্তন্ন করা হলেও, ব্রাহ্মণ কায়স্থদের জন্য আলাদা বসার জায়গা নির্দিষ্ট করা থাকে। সেখানে নিচু জাতের বসার অধিকার নেই।এমনকি পুজোতে পর্যন্ত এই নিচু জাতের লোকগুলোর কোন স্থান নেই ,ছোঁয়া দিলেই সব ফেলা যাবে ,এমনই ভয়ঙ্কর ঘৃণার  পরিমন্ডল। লোধা-হরিজনদের বাচ্চারা খেলতে পারে না উঁচু জাতের বাচ্চাদের সাথেও, তারা থাকে একধারে ।সে ঘরের বউদের পুজোয় ফল কাটতেও দেওয়া হয় না, বলা হয় তাতে নাকি দেবী 'কুপিত' হবেন, সব অপবিত্র হয়ে যাবে। জাতের নামে একতরফা ঘৃণা, পাল্টা ঘৃণা ।
 এছাড়া, মোটের ওপর গ্রামটা খুবই সুন্দর। ফাঁক পেলেই বেরিয়ে পড়ি এদিক-ওদিক। সবাই খুব খাতির করে, পোস্টমাস্টার বলে কথা ।জানিনা কোথায় থাকে ওদের জাতপাতের বিরোধ, নিজে মানিনাও কিছু ।তাই নিশ্চিন্তে মিশে যাই সবার সঙ্গে ।তবে, বুঝতে পারি কিছু সতর্ক চোখ সব দিকে নজর রাখছে ।গরিব নিচু জাতের মানুষগুলো মুখ বুজে সহ্য করে অন্যায় শ্রেণীবৈষম্য। আমি সব জেনে বুঝেও কিছু বলতে পারতুম না । মাসে একবার ছুটির দিনে, সঙ্গে আরও একটা কি দুটো ছুটি জুড়ে বাড়ি থেকে ঘুরে আসতুম। বেশ কেটে যাচ্ছিল দিনগুলো।
             একদিন পোস্ট অফিসে বসে মন দিয়ে কটা মানিঅর্ডার সই করে স্ট্যাম্প মারছি, বিকেলের ডাকে যাবে, হঠাৎ দেখি একটা রোগা বউ এক কোণে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে । 'কি চাই?' বলতে কোন উত্তর দিল না ।বামাপদবাবু নিজের সিট ছেড়ে গিয়ে, বউটাকে কি সব বুঝিয়ে দিতে সে মাথা নেড়ে ধীরে ধীরে চলে গেল। মনে হল ,যাবার সময় আঁচলের খুঁটে  চোখ দুটো একবার যেন মুছে নিল। বামাপদবাবু ফিরে আসতে জিজ্ঞেস করলুম ,'কে উনি?আপনার কেউ হন?' উনি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন' নাঃ ,ও তো বুদি পাতর। পাখির মা।' আমি অবাক হয়ে বললুম 'পাখি? কোন পাখি ?' উনি একটা কষ্টের হাসি হেসে বললেন ,'পাখি ওর মেয়ের নাম। মারা গেছে কয়েক মাস হল।' 'কিভাবে ?'আমার কৌতুহল দেখে শেষে উনি সেই করুন কাহিনী বলতে থাকেন। বাইরে কড়া রোদ, লোকজনও বিশেষ নেই। পাখির গল্প শুনতে থাকি আমি ।
            'পাখি ছিল হরিজন। থাকত ওর পিসির বাড়ি। যুবতী মেয়ে, পড়াশোনাও করেছিল। গ্রামের অলিখিত নিষ্ঠুর জাতপাতের বেড়া মানতে পারেনি সে।ভালোবেসে ফেলেছিল ব্রাহ্মণ যুবক পলাশকে ।পলাশও ভালবাসত পাখিকে ।ওদের প্রেম ছিল বেশ কয়েক বছরের ।একদিন দুজনের বাড়ি থেকেই জেনে গেল ওদের প্রনয়ের কথা। ব্যাস, আর যায় কোথায় ?উঁচু জাতের মানুষগুলো যাদের ঘৃনার চোখে দেখে, তার সঙ্গে প্রেম! ওদের এই সম্পর্ক কিছুতেই মেনে নিল না গ্রামের উঁচু সম্প্রদায়ের ক্ষমতাশালী মানুষগুলো ।ব্যাপক অশান্তি শুরু হয়ে গেল পলাশের বাড়িতে। হাড়ির মেয়ের সঙ্গে প্রেম! বউ করে আনলে দেবত্ব সম্পত্তি অপবিত্র হয়ে যাবে না? তাছাড়া ঘরে মা কালী রয়েছেন, অজাতের মেয়ের ছোঁয়ায়, ঠাকুরই তো চলে যাবেন। ওদের ওপর চলল নানা রকম অত্যাচার ,নির্যাতন। পাখির পরিবারকে একঘরে করে দেওয়া হল ।পলাশ ছোটবেলা থেকেই বাউন্ডুলে প্রকৃতির ,খড়গপুরে একটা হোটেলে চাকরি করে,ওর কোন কথাই কেউ শুনল না,জুটল অবর্ণণীয় অপমান।ঘটনার আগের দিন দুজনে মিলে গিয়েছিল একটা ভিডিও হলে সিনেমা দেখতে ,তারপর আর ওদের কেউ দেখেনি ।' বামাপদবাবু বোতল থেকে একটু জল খেয়ে, মুখটা মুছে, একটু থামলেন। আমার কৌতূহল তখন তুঙ্গে, 'তারপর?' আমি না বলে থাকতে পারি না। ‘ তারপর আর কি? সিনেমা দেখে, দুজনে গ্রাম থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার হেঁটে চলে যায় বাখরাবাদের দিকে। রেল লাইনের ধারে সেখানে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে ট্রেনের জন্য। পরদিন ভোরে ভুবনেশ্বরগামী প্যাসেঞ্জার ট্রেনের সামনে দুজনেই ঝাঁপিয়ে পড়ে। দুজনেই শেষ এক সঙ্গে। কিছুক্ষণ পরে যখন ওদের দেহ পাওয়া যায়, পাখির কপালে কেউ কেউ নাকি সিঁদুরের ফোঁটা দেখেছিল।'
            মনটা ভারী হয়ে গেল ওদের পরিণতি শুনে। মুখটা নামিয়ে নিলুম কি এক লজ্জায়। দুপুরের খাবার সময় হয়ে গেছে, কিন্তু একটুও খেতে যেতে ইচ্ছে করছে না ।গলাটা কি রকম যেন টক টক হয়ে গেছে। জাতপাতের নিদারুণ পরিণামের কথা ভেবে বুকে একটা ভীষন কষ্ট উঠে আসছিল।
          বামাপদবাবু বলে চলেন, 'এখানেই শেষ নয় বুঝলেন? লাশ কাটা ঘরে পাশাপাশি শুয়ে ছিল পলাশ আর পাখি। ওদের বাবা-মা-পরিবারের কাছেও ওরা হয়ে গিয়েছিল 'বেওয়ারিশ' প্রেমিক যুগল। জাত ধর্ম ভুলে ভালবাসার অপরাধে, সাত দিনেও কেউ নিতে আসেনি নিথর দেহ দুটো।কিরকম বাবা-মা দেখুনতো! নিজেদের সন্তানের দেহ নিতে এল না ,এত রাগ !' বামাপদবাবু ঘটনার কথা বলতে বলতে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন।
 'এত নিষ্ঠুর হতে পারে মানুষ!' আমি না বলে পারি না । 'বুঝলেন, গোটা গ্রামে কোন হেলদোল ছিল না ।উঁচু জাতের ছেলে নিচু জাতের মেয়ে কে ছুঁয়েছে ,মরেছে, বেশ হয়েছে। তখনও নাক শিঁটকোচ্ছে মানুষ। দুজনের শোকাতুরা মায়েরা যদি দেহ দেখে আরো শোকে বিহ্বল হয়ে পড়েন, তাই বডি, গ্রামে ঢুকতে দেওয়া হল না। বেঁচে থাকতে শাস্তি তো দিতে পারেনি , তাই মরার পর 'বেওয়ারিশ' করে সেই রাগ পুষিয়ে নেওয়া।পলাশের দাদা পিনাকী খালি রেললাইনে গিয়ে একবার দেহ সনাক্ত করেই চলে এসেছিল। ময়নাতদন্ত হল, তারপর রেল পুলিশের হেফাজত থেকে দেহ নিতে আর কেউ গেল না। টাকার অভাবে পাখির মৃতদেহও গ্রামে আনা যাবে না, বলে দিল ওর আত্মীয়রাও। দেড় হাজার টাকা ওদের কাছে অনেক টাকা ,গরিব পরিবার তো।' 'দেহ সৎকারও করল না?' আমার অবাক প্রশ্ন। 'না 'ক্ষীণ স্বরে বলেন বামাপদ বাবু। 'পুলিশের অনুরোধেও মৃতদেহ নেয়নি কেউ। সরকারি নিয়মে, বেওয়ারিশ লাশ দুটো, সাত দিন পরে অন্য সব ওইরকম লাশের সঙ্গে পুড়িয়ে দেওয়া হয়।' অসহায় কন্ঠে বলেন বামাপদবাবু 'এখনও আমরা কত পিছিয়ে আছি, না? ভালোবাসার কি নিদারুন শাস্তি, বলুন?' আমি স্তব্ধ হয়ে রইলুম।
            পোস্ট অফিস বন্ধের সময় হয়ে এসেছে, বাইরে রোদ পড়ে এসেছে। জানালার বাইরে দিয়ে চেয়ে থাকতে থাকতে মনে হল, দূরে কোন এক ফুলে ফুলে ভরা লাল পলাশ গাছে, কোন এক চঞ্চল পাখি হয়ত  ঠিক এখনই বসে , আমার দিকেই যেন তাকিয়ে আছে ।আমি  দেখতে পাচ্ছি না কেন?

5 comments:

  1. দারুন হয়েছে! যথেষ্ট Maturity আছে লেখাটার মধ্যে। এরকম লেখা আরো চাই!

    ReplyDelete
  2. ভালো হয়েছে। তবে গতানুগতিক।
    আরেকটু পিছনের প্লটের বাস্তব দৃশ্য ও ডায়ালেক্ট হাজির করা গেলে আরও রসালো উপাদান জুটতো, পাঠকের আকাঙ্ক্ষা মিটতো।
    গল্পের নাম ও প্রচ্ছদ সামনযস্যপূর্ণ। চলুক।

    ReplyDelete
    Replies
    1. ধন্যবাদ।খেয়াল রাখবো।

      Delete