পঞ্চাশোর্ধ পাঁচ বন্ধু। ওরা ছোটবেলায় একই স্কুলে পড়েছিল, বরানগর রামকৃষ্ণ মিশন। বারো বছর একসঙ্গে কাটানোর ফলে, ওদের বন্ধুত্ব ছিল ভীষণ গভীর। কিন্তু স্কুল থেকে বেরিয়ে যাবার পর, বাধ্য হয়েই যে যার নিজের নিজের কেরিয়ার আর প্রফেশন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। এখনকার মতো তো আর সে সময় মোবাইল বা ইন্টারনেট ছিল না। তাই ওদের যোগাযোগটাও ধীরে ধীরে হালকা হয়ে এসেছিল। প্রথম প্রথম কিছুদিন চিঠি-চাপাঠি চলেছিল ঠিকই, তারপর ধীরে ধীরে সে সবও বন্ধ হয়ে গেল। জীবনসংগ্রামে আর কেউ কারো সেভাবে খবর রাখতে পারেনি।
পাঁচজনের স্বভাব চরিত্র কিন্তু ভীষণ আলাদা রকমের। কেউ বা পড়াশোনায় খুব ভাল ছিল, কেউ ভাল ছবি আঁকত, কেউ ছিল দুরন্ত বাউন্ডুলে প্রকৃতির আবার কেউ বা পড়ার ফাঁকে ফাঁকে লুকিয়ে কবিতা লিখত। প্রত্যেকেরই এক একটা নিজস্ব সত্বা, নিজস্ব আলাদা জগৎ ছিল। কিন্তু তাতে তাদের বন্ধুত্বে কোন ছেদ পড়েনি। এমনকি বহুদিন দেখাসাক্ষাৎ, যোগাযোগ না থাকলেও। কিন্তু বয়সের ভারে ক্লান্ত হয়ে পড়ার মুখে, হঠাৎ একদিন আবার এই পাঁচ বন্ধুর দেখা হয়ে গেল।
অনেকদিন পরে পুজোতে, ললিত জার্মানি থেকে দেশে ফিরেছে। ওদিকে ললিতের সঙ্গে বিভাসের একটা যোগাযোগ আগে থেকেই ছিল। ললিতের ভাইপো বিভাসের কাছেই পড়ে, বিভাস সিটি কলেজের বাংলার অধ্যাপক। ললিতের দেশে ফেরার খবরটা বিভাসই ফোনে জানিয়েছিল আরেক বন্ধু বসন্তকে। শুনেই বসন্ত এক পায়ে খাড়া, দেখা হবে সপ্তমীর দিন।
সেদিন বসন্ত ওদের আরেক বন্ধু শঙ্করকেও তাই সঙ্গে করে যেন খোঁজ নেওয়ার ঠেলাগাড়ি কে ঘিরে ওরা নিয়ে এসেছে, দুজনে একই পাড়ায় থাকে। এসে দেখে, আগে থেকেই সেখানে দীপক এসে হাজির। দারুন ব্যাপার, অনেক দিন পরে সকলে একসঙ্গে হওয়া গেল। দীপক এখন বাঙ্গালোরে থাকে, তবে প্রতিবছরই পুজোয় কলকাতায় আসে। ললিতের সঙ্গে নাকি কালই ওর হঠাৎ নিউমার্কেটে দেখা হয়ে গিয়েছিল। এই গেট-টুগেদারের কথা শুনতে পেয়েই ও ছুটে এসেছে, কাল নাকি আনন্দে সারারাত ঘুমোতেই পারেনি। একটু পরে বিভাসও এসে জুটল।
বহুদিন ছাড়াছাড়ি, সকলেই অনেকটা বদলে গেছে। অন্তত সকলেই সকলকে এ কথাটা বারবার বলেছে, কিন্তু কেউ সেটা স্বীকার করেনি। কেউই নিজের নিজের অতীতটা ভুলে যায়নি। সেই সোনালী দিনগুলো আজও ওদের মনের চোখে জ্বলজ্বল করছে। যেন হজমিওলার ঠেলাগাড়ির চারপাশে ওরা পাঁচ বন্ধু দাঁড়িয়ে আছে।
হাজার কাজের মধ্যে কবিতা লিখত যে দীপক, সে এখন আর অবসরই পায়না। পড়াশোনায় খুবই ভাল ছিল, অথচ ও এখন একটা ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানির সেলসম্যান হিসেবে চাকরি করে, চাকরি বাঁচাতে এত ছুটতে আর ঘুরতে হয়, যে কবি মনটাই বোধহয় মরে গেছে। দুষ্টু, দুরন্ত যে ছেলেটা সবাইকে ছোটবেলায় মাতিয়ে রাখত, যার ভয়ে সবাই সবসময় তটস্থ হয়ে থাকত, সেই শঙ্করের মাথায় এখন চকচকে টাক। বয়সের ছাপ ওর মধ্যেই যেন সবচেয়ে বেশি পড়েছে। ললিত কোনদিনই পড়াশোনায় ভাল ছিল না, ছোটবেলাতেই বাবা-মাকে হারায়। দয়া করে সামান্য একটা জামা-কাপড়ের ব্যাবসায় ঢুকিয়ে দিয়েছিল জ্যাঠা। আজ সেই ব্যাবসাই ফুলেফেঁপে তিন তিনটে দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। আজ ও কোটিপতি।
তবু, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থান যার যাই হোক না কেন, কেউ কাউকে ভোলেনি। স্কুলফ্রেন্ড বলে কথা, বন্ধুত্বের ভালবাসার টানটা রয়ে গেছে সেই একই রকম। সপ্তমীর দিন বিকেলে ললিতের বাড়িতে ওদের জমাটি আড্ডা চলছে। ছোটবেলার টুকরো-টাকরা নানা ঘটনার স্মৃতিচারণ চলছে, পুরনো দিনের গল্প একবার শুরু হলে কি আর শেষ হতে চায়? চল্লিশ বছর আগেকার কথা, তবু হেডস্যার মহারাজের ঘরে ঢিল মারার গল্পটা সকলেই অল্পবিস্তর মনে করতে পারল। কাজটা ডানপিটে শঙ্করেরই, কিন্তু মার খেয়েছিল ক্লাসশুদ্ধু ছেলে। সকলেই জানত, তবু কেউ ভয়ে শঙ্করের নাম বলতে চায়নি। কারণ তারপর শঙ্করের হাতে রামঠ্যাঙানি খেতে হবে, এ কথা জানাই ছিল। হেডস্যার রেগে বললেন, "কে এ কাজ করেছে তার নাম না বললে, প্রত্যেককে বেত মারব"। শেষ পর্যন্ত পিঠে বেতই পড়েছিল সবার। অনেকদিন পরে সকলেই প্রাণ খুলে হাসাহাসি, ইয়ার্কি-ফাজলামি করছিল। সকলেই বেশ খোশমেজাজে। কিন্তু শঙ্কর নিজে বেশ গম্ভীর। "কি হল রে? বুড়োবয়সে পুরোনো দুষ্টুমির কথা শুনতে লজ্জা করছে নাকি?", বিভাস ফুট কাটল। সকলেই হো হো করে হেসে উঠল।
দীপক ছিল একটু অন্যরকম। পড়াশোনায় খুব ভাল, কিন্তু একটু চুপচাপ, আত্মভোলা টাইপের। কারো সঙ্গে সেভাবে মিশত না। খুব কাছের বন্ধুরাই একমাত্র জানত, যে ও কবিতাও লেখে। বসন্ত বলল, "কি রে দীপক, এখনো কবিতা-টবিতা লিখিস নাকি?" "আরে না না।", দীপক লজ্জা পেল। কবি পরিচয়ে ওর কোনদিনই অবশ্য খুব গৌরব ছিলনা।
চলতে লাগল যে যার বাড়ির গল্প, ছেলে-মেয়ের গল্প, ছোট থেকে বড় আর বড় থেকে বুড়ো হবার সালতামামি। স্কুলের বন্ধু, ছোটবেলার স্মৃতি, এসব চিরকাল আঁকড়ে থাকে মনকে। কিন্তু আরো কিছু ছিল ওদের আড্ডায়, পুরোনো আফসোস, পুরোনো রেষারেষি, এমনকি পুরোনো অভিমান-যন্ত্রণাও। যার মধ্যে দিয়ে অচেনা মানুষ চেনা, আবার চেনা মানুষও কখনো কখনো অচেনা হয়ে উঠছিল।
প্লেটে করে চা, বিস্কুট আর চানাচুর এসে যেতে ওদের স্মৃতিচারণে একটু বিঘ্ন ঘটল। চিনি ছাড়া চা, দুধ ছাড়া চা, কম চিনির চা, চা ছাড়া চা যে যার হাতে তুলে নিল। ললিত কোনদিন চা খায় না, চা ছাড়া চা অর্থাৎ দুটো ক্রিমক্র্যাকার বিস্কুট তারই জন্যে। কিন্তু অতীতে ডুব দেবার প্রবণতা ওদের বয়সে বড্ড বেশি, সেই অভ্যাস আজও পিছু ছাড়ছিল না। ললিত বলল, "কি রে বিভাস, তুই তো একেবারে মিষ্টির পোকা ছিলিস, আর এখন দুধ চিনি ছাড়া শুধু লিকার চা খাচ্ছিস!" "কি করব বল, চারশো সুগার। ডাক্তার বলেছে, আর একদানাও চিনি নয়।", বিভাস বিরস বদনে বলল।
একমাত্র বসন্তের চেহারাটাই এখনো ঠিকঠাক আছে, চুল-টুল বিশেষ ওঠেনি, পাকও ধরেনি। "কি রে, তোর গ্ল্যামার যে দিন দিন বাড়ছে! কি ব্যাপার বলতো?", ললিত পাকড়াও করল। কড়মড় করে চানাচুর খেতে খেতে বসন্ত বলল, "আরে শরীরটাকে রাখতে হলে নিয়মিত সাধনা করতে হয়, বুঝলি? এই দেখ না, এই বয়সেও আমি নিয়মিত ব্যায়াম-জগিং করি।" দীপক বসন্তের হাতটা টিপে দেখে বলল, "তা বটে"। শঙ্করের হালচাল দেখে কিন্তু সবাই অবাক। ছেলেটা ছোটবেলায় কি ছিল, আর এখন এই বয়সেই কেমন যেন বুড়িয়ে গেছে, ফুরিয়ে গেছে, কেমন যেন মনমরা হয়ে গেছে। ওকে অনেক কষ্টেও সক্রিয় করে তোলা যাচ্ছিল না। বসন্ত অবশ্য এর কারণটা জানে। শঙ্করের এক ছেলে কিছুদিন আগেই রাজনৈতিক কারণে খুন হয়ে গেছে। সেই থেকে প্রাণচঞ্চল শঙ্কর একেবারে পাল্টে গেছে। যদিও এই ব্যাপারটা বসন্ত আর সকলকে জানানোর প্রয়োজন মনে করেনি। বরং শঙ্করের মনটা যদি একটু ভাল হয়, সেই জন্যই ওকে জোর করে এই পুরোনো বন্ধুদের গেট টুগেদারে নিয়ে এসেছিল।
চিরকালই স্কুলফ্রেন্ডদের বন্ধুত্ব হয়ে এসেছে রাজনীতি-দল-মত নিরপেক্ষ ভাবে। আজকের আলোচনাও সংসার, বেড়ানো, পুজো, ওষুধপত্র এসব নিয়েই চলছিল। কিন্তু শঙ্কর যখন দেওয়ালে ঝোলানো বেহালাটার দিকে এগিয়ে গিয়ে ধীরে ধীরে সেটা হাতে তুলে নিল, ওদের খোশগল্প একটু যেন থমকে গেল। কেউ কেউ আবার ব্যাপারটা খেয়ালও করেনি।
শঙ্কর বেহালার ছড়ে টান দিল। এক একটা করে সুরের সৃষ্টি হচ্ছে, আর ঘরের কোনে কোনে তা ছড়িয়ে যাচ্ছে। সকলে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনছে। বিভাস খবরের কাগজে মুখ গুঁজে চা খাচ্ছিল। সুরের মূর্চ্ছনায় কাগজটা কখন যেন ওর হাত থেকে খসে পড়ে গেছে, কাপের চা-ও ঠাণ্ডা। ললিত যে বালিশে হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়ে ছিল, এখন সেটাই কোলে নিয়ে, ভীষণ অবাক হয়ে সোজা হয়ে বসেছে। শুধু সুর নয়, যেন একের পর এক কথা ভেসে আসে। শঙ্কর এত সুন্দর বেহালা বাজাতে জানে! কই, ওরা তো কখনো জানত না! ওদিকে জানলার ধারের ছোট টুলটায় বসে, শঙ্কর তখন কি এক মহাসাধনায় ডুবে গেছে।
বেহালার মৃদুরাগ আশাবরীতে হারিয়ে যাচ্ছিল ললিতের মন। এই ঘর, এই দেওয়াল আর এইসব বন্ধুরা, সকলকে ভুলে যাচ্ছিল ও। শুধু বেহালার তার চারখানা আর ছড়িটা। সুরেরও যে একটা নিজস্ব ভাষা আছে, তা ও আগে জানত না! আর এ সুর তো সকলের থেকে আলাদা, যেন এক কান্নার বর্ণমালা। ও ভুলে গেল একাদশীর দিন কোলোন পৌঁছেই, অ্যাকুইজিশন আর মার্জার প্ল্যানিং নিয়ে একগাদা মিটিং করতে হবে। বরং ওর চোখে ভেসে উঠছিল একটা দৃশ্য, খুব ছোটবেলার দৃশ্য। বাবার হাত ধরে ও চলেছে জাহাজ দেখতে, আউট্রাম ঘাটে। জীবনে সেই প্রথম জাহাজ দেখার দৃশ্য, ও আজও ভোলেনি। মনে পড়তে লাগল বাবার সঙ্গে রোজ সকালে স্কুলে যাবার কথা। রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে বাবা কত গল্প বলতেন। স্কুলে যাবার অতটা পথ কখন যেন শেষ হয়ে যেত। সেই বাবা একদিন অফিস থেকে বিধ্বস্ত হয়ে বাড়ি ফিরলেন। বাবা নাকি কোন এক টাকা চুরির কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়েছেন। বাবা কখনো এ কাজ করতে পারেন, ভাবতেই পারত না ললিত। যে বাবা পকেটে পাঁচটা টাকা থাকলেও, ভিখিরিকে দু'টাকা দিয়ে সাহায্য করতে দ্বিধা করতেন না, বাড়ি ফিরে চুপচাপ মায়ের বকুনি সহ্য করতেন, যে মাসের বাকি দিন কটা কিভাবে চলবে, সেই বাবা করবেন চুরি? ও বিশ্বাস করেনি, দিনের পর দিন দেখেছে লুকিয়ে লুকিয়ে বাবার কান্না। শেষে বাবার চাকরিটা চলেই গেল। তারপর থেকে বাবা আর বাড়ি থেকেও বিশেষ বের হতেন না। শেষকালে এই করেই, ঘটনাটার তিন মাসের মধ্যে বাবা হার্ট অ্যাটাকে মারা যান। "বাবা, তুমি কেমন দেখতে ছিলে? বড় দেখতে ইচ্ছে করে তোমায়। আগের মতো আবারও তোমার হাতটা ধরতে ইচ্ছে করে। এত ঝাপসা কেন তোমার মুখটা?" ললিতের চোখ ভিজে এল, গলা বুক দিয়ে কান্না হয়ে যেন নেমে আসতে চাইছিল মোহময় বিষন্ন সুরটা। ললিত যে বেহালা বাজাতে জানে না।
বেহালার সুরটার মধ্যে কি একটা গভীর গোপন অনুভূতি ছিল! প্রতিবাদী কন্ঠ বসন্ত ফিরে গেল ওর রক্তঝরা অতীতে। সেদিন ওর বাড়ি ফেরার তাড়া ছিল, কিন্তু পারল না। শঙ্করের পারিবারিক আঘাতের কথা ও জানে, কিন্তু এই শঙ্কর যেন অনেক দূরের অন্য এক শঙ্কর। ওর হাতের বেহালায় এরকম অপরিসীম মায়া আর আবেগ আছে, আগে জানত না বসন্ত। শঙ্করের বড় ছেলে বিয়ে করে আলাদা হয়ে গেছে, ছোট ছেলের পরিণতির কথা ভাবলে আজও বুকটা কেঁপে ওঠে। বাড়িতে ঢুকে রুলিং পার্টির কিছু আশ্রিত গুন্ডা ছেলেটাকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যায়। শঙ্কর বাধা দিতে গিয়েছিল, কিন্তু ওর মাথায় আঘাত করে অজ্ঞান করে দেওয়া হয়েছিল। গুরুতর আহত হয়েছিল শঙ্করের স্ত্রীও। এক সপ্তাহ পরে খালধার থেকে ছেলেটার লাশ পাওয়া গিয়েছিল। বসন্ত নিজেও একসময় সক্রিয়ভাবে রাজনীতি করেছে বটে, কিন্তু এরকম পরিণতির কথা কোনদিনও ভাবেনি। আপনিই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল ওর বুক থেকে। ভেতরে ভেতরে ও এই ভেবেও লজ্জা পাচ্ছিল, যে এখনো অল্পস্বল্প রাজনীতি ও করে। মিটিং, মিছিল, সমাবেশে মাঝেমধ্যেই যায়, বক্তৃতাও দেয়। মোটা টাকা চাঁদা তো আছেই। অথচ রাজনীতির বলি ও নিজেও। যখন সক্রিয়ভাবে পার্টি করত, রেষারেষি চলত পাড়ার এক গণ্যমান্যর সঙ্গে, যে নিজে ছিল আদ্যোপান্ত অসৎ। আবার তার পোষা গুন্ডার সংখ্যাও কম ছিল না। স্বার্থ আর নীতির সংঘাতে, ওদের দল দু'ভাগ হয়ে গিয়েছিল। বসন্তের দলের ছেলেরা নিরাপদ ছিল না,তবু ওরা আলাদা একটা দল গড়ল। ভোটের সময় এক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে ওদের ক'জনকে প্ল্যান করে খুন করা হয়েছিল, যার মধ্যে বসন্তের হবু জামাইও ছিল। দলটা ভেঙে গেল। তবে বসন্ত হার মানল না। ও ছিল আদর্শবান, কোনদিন কারো দোষ দেখলে ছেড়ে কথা বলেনি। জীবনে বহু লড়াই করে আজ আবার ও একটা সম্মানীয় জায়গায় এসে পৌঁছেছে। বিশেষ বড় কোন অনুষ্ঠানে যাবার জন্য, জেনারেল সেক্রেটারি নিজে এসে ওকে নেমন্তন্ন করে যান। রাজনীতি ওর রক্তে, যুবক বয়সের সেই আকর্ষণটা তাই এখনো যায়নি। যদিও ও আজ ভীষণরকম বীতশ্রদ্ধ।
দীপক চিরকাল এমন আমুদে লোক ছিল না, বরং উল্টোটাই। ও একটু চাপা স্বভাবেরই ছিল। লেখালেখিতে বন্ধুরা উৎসাহ দিত, তাই লুকিয়ে চুরিয়ে ও লিখেও ফেলত খাতার পেছনে, গড়ে উঠত ওর ব্যক্তিগত অনুভূতির জগত। পূর্ণিমা রাত, হাওয়ার কানাকানি আর মৃদু স্পর্শের রোমাঞ্চ নিয়েই ভরে ছিল যৌবনটা। সেই উত্তেজনা কেটে গেলে ও দেখল, যেখানে ছিল সেখানেই পড়ে আছে। দেখল, বাস্তব জীবনটা ভীষণ কঠোর। সহজভাবে কোন কিছুই বয়ে চলেনা, থাকে নাটকীয়তা। কিন্তু নাটকের এক একটা চরিত্রের মতো, বাস্তবের নিজেকে দেখে ফেলার মধ্যে কোন আনন্দ ছিল না। দীপকের জীবনটা হয়ে গেল কঠিন, নীরস, বিমর্ষ। তবু ও বলত, ও হল জীবনের কবি, মৃত্যুর নয়।আনন্দ আর ভালবাসার কবি, বিরহের নয়। বেহালার সুরে ওর সঙ্গীতপ্রিয় মনটা নেচে উঠছিল। ভালবাসার অনুভূতির কথাগুলো একে একে মনে পড়ে যেতে লাগল। সেই সব আনন্দ, যার কোন কারণ নেই, নাম নেই। ও ভেসে চলছিল এক চনমনে সুরের মূর্চ্ছনায়। ভারি ভাল লাগছিল আজকের বিকেলটাকে। দীপক ভাবল, বাড়ি ফিরেই আবার কবিতা লেখা শুরু করবে, সেই ক্ষমতা এখনও ওর আছে। জীবনের সুখ দুঃখের সরু মধ্যরেখাটার গুরুত্ব ও ভালভাবেই জানে। কি আর হবে সেসব ভেবে? বরং নতুন করে শুরু তো করাই যায়। মনে হল ছোট ছেলেটাকে ক্রিকেট কোচিংয়ে ভর্তি করে দিতে হবে। গিন্নিকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে এ সপ্তাহেই। আচ্ছা কোলেস্টরেল ফ্রি মাখনটা খেয়ে দেখলে কেমন হয়?
সন্ধ্যা হল, যেন অনন্তকালের বেহালা বেজে চলেছে। সমস্ত ডাইমেনশন নিরপেক্ষ হয়ে বেজে চলেছে। সুরটা যেন দেওয়ালের ওপার থেকে ভেসে আসছে, কি এক আশ্রয়হীনতার অভিমান নিয়ে। অথচ স্বার্থপর পৃথিবী ফিরে চেয়েও দেখল না, এই দোতলার ঘরে কি আলোড়ন ঘটে গেল। কেউ ভাবল না এই পাঁচ বন্ধু মিলে কি জাদুতে, কি আবহে, এক আবেগময় অস্তিত্বের জগতে চলে যেতে পেরেছিল। কিভাবে সময় পেরিয়ে, নিজেদের স্বরূপ নতুনভাবে আবিষ্কার করতে পেরেছিল। শুধু বিভাস হয়ত কোন অজ্ঞাত কারণে নিজের অতীত জীবনের কথা মনে করার বিলাসিতায় গা ভাসাতে চাইছিল না। কোনদিনই ওর কোনকিছু বলার নেই, কেউ ওর কথাও শোনে না। ও বড়ই নিরীহ, ছাপোষা। বেহালার সুর শুনতে শুনতে চোখ বুঁজে ও এক অন্য রাজ্যে চলে গেছিল। কোন ভাবনা নেই, আবেগ নেই, আশা নেই, আশাভঙ্গ নেই, কৈশোরের চপলতা নেই, যৌবনের মত্ততা নেই, প্রৌঢ়ত্বের নিরাসক্ততাও নেই। জীবনের গড়ে তোলা বা ভেঙে যাওয়ার সহজ সরল গল্পও নেই। ওর জীবন হয়তো বাধ্য হয়েই হয়ে গেছে চারপাশের প্রভাবমুক্ত, যাবতীয় ঘটনা আর ঘাত-প্রতিঘাত নিরপেক্ষ। বিভাস আবেগপ্রবণ নয়।
শুধু শঙ্করের পিতৃহৃদয় কি এক ব্যথায় যেন দুমড়ে মুচড়ে উঠছিল। ও কোন ছন্দই হারায়নি, কোন কিছুই ওকে আর অভিমানী করে তোলে না। এক অশেষ উন্মুক্ততা ওর চারপাশের পৃথিবীতে। সেই আনন্দেই হয়তো ওর চোখ ফেটে এক ফোঁটা জল বেরিয়ে এল। কেউ দেখতে পেল না।
আমি আবেগ ও অনুভূতিপ্রবণ,ভাবুক আর সৃষ্টিশীল।জীবনের চলা,ওঠাপড়া আর অভিজ্ঞতা নিংড়োনো এই সব লেখা ।এ আমার পাগল মনের নিঃশেষিত প্রকাশ।
30 May 2018
29 May 2018
অবাধ্য
অনিলবাবুর বয়স হলো প্রায় ষাট বাষট্টি। একেবারে থুথ্থুড়ে বুড়ো হয়ে না পড়লেও, বয়সের ভারে তিনি অনেক নুয়ে পড়েছেন ।শরীর আর মনের নিস্পৃহতা ক্রমেই বাড়ছে। অনিলবাবুর আপন বলতে এখন আর কেউ নেই,বিশাল বাড়িটায় শুধু তিনি আর বাবার আমলের পুরোনো চাকর 'গৌর'। তার স্ত্রী গত হয়েছেন বছরখানেক হল। বড় ছেলে ইউকেতে চাকরি করে ,ফোনটোন করে নামকে ওয়াস্তে। আর মাসে মাসে হাজার দশেক টাকা পাঠায়।খরচ তেমন নেই ,চলে যায় একরকম।ভাড়াটেরা টাকা দিলে অবশ্য এই দানটুকুরও দরকার হত না। ছোট ছেলেটা বেকার হয়ে বসে আছে বছর তিনেক। রাতে আড্ডা মারা আর দিনরাত টো-টো করে ঘুরে বেড়ানো ছাড়া ওর কোন কাজ নেই,ওকে বাড়িতে পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। বাবার কোন কথা মোটেই শোনে না , ছেলেটা বখে গেল বোধহয়। অনেক চেষ্টা করেছিলেন , কিন্তু এই প্রজন্মটাই অন্যরকম ।কি যে সব হচ্ছে। ওকে বোঝে শুধু বড় মেয়ে, এখন সেই ওর মা, সেই মেয়ে।শাশুড়ির মন ভিজিয়ে মাঝে মাঝে যখন আসে, তখন বাড়িটাতে যেন আলোর রোশনাই সেজে ওঠে। ওই অনিলবাবুর আশাভরসা। অনেক দেখেই বিয়েটা দিয়েছিলেন ,তবুও মানুষ বোঝে কার সাধ্য? স্বামীর বদলির চাকরি ,শ্বাশুড়ি খুব কর্তৃত্ব ফলাচ্ছে। কি আর করবে! কথায় কথায় স্ত্রীর কথা মনে পড়ে যায় ,তারপর ছোট মেয়ের কথা। তার জীবনের সবচেয়ে দুঃখজনক অধ্যায় হল এই দুজনের মৃত্যু ।আদর করে ছোট মেয়ের নাম রেখেছিলেন 'রাণী'। পাকা পাকা কথার ফুলঝুরিতে ও সবাইকে ব্যতিব্যস্ত করে মারত।সবাই খুব ভালোবাসত, কিন্তু ছোটবেলাতেই সুখের সংসার ছেড়ে ওকে চলে যেতে হয়েছিল ,কেড়ে নিয়েছিল সমাজের অঙ্গার সেই শ্রেণীটা। আগে সেদিনটার কথা মনে পড়লে শুধু রাগে-দুঃখে তিনি কাঁপতেন, এখন শুধু চোখ ফেটে জল বের হয়ে আসে ।
(গল্পটা পুরো পড়লে ভাল লাগবে)
(গল্পটা পুরো পড়লে ভাল লাগবে)
28 May 2018
উত্তর
অমিত আর অদিতির প্রেমটা ছিল দামাল হাওয়ার মত, সবকিছু উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া। ওরা ছিল যাকে বলে 'মেড ফর ইচ আদার'। কলকাতার রাস্তায় ওদের প্রেম উড়ে বেড়াত কোন বাঁধন ছাড়াই।
কিন্তু হঠাৎই তাল কাটল, আস্তে আস্তে দুরে সরে যেতে লাগল অদিতি ,আর অমিতের সঙ্গে দেখা করে না বা চিঠির উত্তর দেয় না। অনেক চেষ্টা করেছিল অমিত ওকে ফিরিয়ে আনার, কিন্তু একেবারে ঘরকুনো হয়ে গেল অদিতি। এমনকি বিচ্ছেদের কারণটাও কেউ জানতে পারেনি কোনোদিন ,অমিতও না।
অমিত পাগলের মত চেষ্টা করেছিল অদিতির সঙ্গে একবার দেখা করার। সব কাজ ছেড়ে পড়ে থাকত ,ওর বাড়ির আশেপাশে ঘুরে বেড়াত, কলেজে গিয়ে দেখা করার চেষ্টা করত। কিন্তু হলো না। বন্ধু-বান্ধবীদের মাধ্যমেও যোগাযোগ করার বা চিঠিও দিয়েছে অমিত। অদিতি হেসে সে চিঠি রেখে দিয়েছে ,কোনো উত্তর দেয় নি।
অমিত হাজার চেষ্টাতেও জানতে পারল না ,কেন চলে গেল অদিতি। কি ভুল ছিল অমিতের।
জীবনতো কখনোই একভাবে থেমে থাকেনা। কয়েক মাসের মধ্যেই শোনা গেল অদিতির বিয়ে ।কোন এক এনঅরআইকে বিয়ে করে স্টেটসে সেটেলড্ হল অদিতি। খবরটা শুনে রাগে-দুঃখে হতবাক হয়ে গেল অমিত ।সে বুঝলো অদিতি তাকে ঠকিয়েছে। তার ভালোবাসার মূল্য সে দেয়নি, পায়ে দলে দিয়েছে তার আবেগ, নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছে তার হৃদয়ের সবচেয়ে দামি উপহারটাকে -অমিতের প্রেম ।অমিতের সেই শুরু অদিতিকে ঘৃণা করার।
জীবন যুদ্ধ চলতেই থাকল। অমিত তার নিজের জীবনের দিকে এবার ফিরে তাকাল। দেখল সে অনেকটাই পিছিয়ে পড়েছে ।কেরিয়ারের লড়াই লড়তে হবে তাকেও। দাঁতে দাঁত চেপে ,চোখের জল মুছে, সেই লড়াইটাতেই এবার নামল সে।
কুড়ি বছর পরের কথা ।অমিত আজ বড় সহকারী পদে কর্মরত। তার সুখের সংসার, স্ত্রী-পুত্রকে নিয়ে সেও আজ প্রকৃত অর্থেই সফল ভাবে প্রতিষ্ঠিত। থাকে জামশেদপুরে। কলকাতায় আসে মাঝে মাঝে। জীবন যে যার মত এগিয়ে চলেছে। হঠাৎ একদিন অমিতকে কলকাতা আসতে হয়েছিল কলেজের রিইউনিয়নে। একটা বড় শপিংমলের টপ ফ্লোরে অনুষ্ঠান ।লিফটে করে উঠছিল অমিত ।আর সেই লিফটেই দেখা হয়ে গেল অদিতির সঙ্গে, দীর্ঘ কুড়ি বছর পর। অদিতির সঙ্গে ওর বাচ্চা ছেলেও ছিল। অদিতি যেন আরো সুন্দরী হয়েছে, আরও জেল্লা। অমিতেরও একটু ভারী হয়েছে চেহারাটা, মাথায় হালকা টাক। কিন্তু আভিজাত্যের ছাপ স্পষ্ট। অবাক বিস্ময়ে অদিতি দেখছিল অমিতকে। ঘোরলাগা চোখ অমিতেরও, কিন্তু মুখে কথা সরছিল না। অদিতি জিজ্ঞেস করেছিল "কেমন আছো? চিনতে পারছো আমাকে?" অমিত উত্তর দেয়নি। নিজের ফ্লোরে নেমে যেতে যেতেও ,অদিতি উত্তরের জন্য পিছন ফিরে তাকিয়েছিল ।অমিত চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে ছিল, মুখে কোন উত্তর নেই। লিফটের দরজা বন্ধ হয়ে গেল দুজনের দৃষ্টির মাঝখানে।
অমিত মনে মনে বলল, বিদায় অদিতি, একদিন কতশত প্রশ্ন ছিল, একদিন কত চিঠি দিয়েছিলাম ।তোমার উত্তর পাইনি ।হাজার প্রশ্ন, হাজার দুঃখ ,হাজার অভিমানের কোন জবাব সেদিন দাওনি। আমার জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছিলে ।আজ তোমার একটা প্রশ্নের উত্তর না হয় নাই পেলে।
কিছু কিছু প্রশ্নের উত্তর পেতে কি সারা জীবন লেগে যায়? অমিত জানতে পারল না, অদিতির এক্বেবারে নিজস্ব আলমারিতে, বিয়ের বেনারসি গুলোর ভাঁজেভাঁজে অদিতি আজও, গভীর গোপন কোন অনুভূতিতে, রেখে দিয়েছে অমিতের সব চিঠিগুলো ।উত্তর দেবে বলে। একদিন।
কিন্তু হঠাৎই তাল কাটল, আস্তে আস্তে দুরে সরে যেতে লাগল অদিতি ,আর অমিতের সঙ্গে দেখা করে না বা চিঠির উত্তর দেয় না। অনেক চেষ্টা করেছিল অমিত ওকে ফিরিয়ে আনার, কিন্তু একেবারে ঘরকুনো হয়ে গেল অদিতি। এমনকি বিচ্ছেদের কারণটাও কেউ জানতে পারেনি কোনোদিন ,অমিতও না।
অমিত পাগলের মত চেষ্টা করেছিল অদিতির সঙ্গে একবার দেখা করার। সব কাজ ছেড়ে পড়ে থাকত ,ওর বাড়ির আশেপাশে ঘুরে বেড়াত, কলেজে গিয়ে দেখা করার চেষ্টা করত। কিন্তু হলো না। বন্ধু-বান্ধবীদের মাধ্যমেও যোগাযোগ করার বা চিঠিও দিয়েছে অমিত। অদিতি হেসে সে চিঠি রেখে দিয়েছে ,কোনো উত্তর দেয় নি।
অমিত হাজার চেষ্টাতেও জানতে পারল না ,কেন চলে গেল অদিতি। কি ভুল ছিল অমিতের।
জীবনতো কখনোই একভাবে থেমে থাকেনা। কয়েক মাসের মধ্যেই শোনা গেল অদিতির বিয়ে ।কোন এক এনঅরআইকে বিয়ে করে স্টেটসে সেটেলড্ হল অদিতি। খবরটা শুনে রাগে-দুঃখে হতবাক হয়ে গেল অমিত ।সে বুঝলো অদিতি তাকে ঠকিয়েছে। তার ভালোবাসার মূল্য সে দেয়নি, পায়ে দলে দিয়েছে তার আবেগ, নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছে তার হৃদয়ের সবচেয়ে দামি উপহারটাকে -অমিতের প্রেম ।অমিতের সেই শুরু অদিতিকে ঘৃণা করার।
জীবন যুদ্ধ চলতেই থাকল। অমিত তার নিজের জীবনের দিকে এবার ফিরে তাকাল। দেখল সে অনেকটাই পিছিয়ে পড়েছে ।কেরিয়ারের লড়াই লড়তে হবে তাকেও। দাঁতে দাঁত চেপে ,চোখের জল মুছে, সেই লড়াইটাতেই এবার নামল সে।
কুড়ি বছর পরের কথা ।অমিত আজ বড় সহকারী পদে কর্মরত। তার সুখের সংসার, স্ত্রী-পুত্রকে নিয়ে সেও আজ প্রকৃত অর্থেই সফল ভাবে প্রতিষ্ঠিত। থাকে জামশেদপুরে। কলকাতায় আসে মাঝে মাঝে। জীবন যে যার মত এগিয়ে চলেছে। হঠাৎ একদিন অমিতকে কলকাতা আসতে হয়েছিল কলেজের রিইউনিয়নে। একটা বড় শপিংমলের টপ ফ্লোরে অনুষ্ঠান ।লিফটে করে উঠছিল অমিত ।আর সেই লিফটেই দেখা হয়ে গেল অদিতির সঙ্গে, দীর্ঘ কুড়ি বছর পর। অদিতির সঙ্গে ওর বাচ্চা ছেলেও ছিল। অদিতি যেন আরো সুন্দরী হয়েছে, আরও জেল্লা। অমিতেরও একটু ভারী হয়েছে চেহারাটা, মাথায় হালকা টাক। কিন্তু আভিজাত্যের ছাপ স্পষ্ট। অবাক বিস্ময়ে অদিতি দেখছিল অমিতকে। ঘোরলাগা চোখ অমিতেরও, কিন্তু মুখে কথা সরছিল না। অদিতি জিজ্ঞেস করেছিল "কেমন আছো? চিনতে পারছো আমাকে?" অমিত উত্তর দেয়নি। নিজের ফ্লোরে নেমে যেতে যেতেও ,অদিতি উত্তরের জন্য পিছন ফিরে তাকিয়েছিল ।অমিত চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে ছিল, মুখে কোন উত্তর নেই। লিফটের দরজা বন্ধ হয়ে গেল দুজনের দৃষ্টির মাঝখানে।
অমিত মনে মনে বলল, বিদায় অদিতি, একদিন কতশত প্রশ্ন ছিল, একদিন কত চিঠি দিয়েছিলাম ।তোমার উত্তর পাইনি ।হাজার প্রশ্ন, হাজার দুঃখ ,হাজার অভিমানের কোন জবাব সেদিন দাওনি। আমার জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছিলে ।আজ তোমার একটা প্রশ্নের উত্তর না হয় নাই পেলে।
কিছু কিছু প্রশ্নের উত্তর পেতে কি সারা জীবন লেগে যায়? অমিত জানতে পারল না, অদিতির এক্বেবারে নিজস্ব আলমারিতে, বিয়ের বেনারসি গুলোর ভাঁজেভাঁজে অদিতি আজও, গভীর গোপন কোন অনুভূতিতে, রেখে দিয়েছে অমিতের সব চিঠিগুলো ।উত্তর দেবে বলে। একদিন।
11 May 2018
আনকোরা
সেদিন অক্সফোর্ড বুক স্টোরে এক কান্ড।
এমনিতে আমার খুব একটা যাওয়া হয় না বটে, তবে কলকাতা এলে আমার পুরনো কলেজপাড়া পার্ক স্ট্রিটে একবার চরতে বেড়ানো চাই'ই, আর পার্কস্ট্রীট গেলে অক্সফোর্ড বুক স্টোরে যাব না! বই কিনি, না কিনি, একবার ঢুঁ না মেরে পারিনা।
তো সেদিনও যথারীতি ঢুকে পড়েছি, ঢোলা পাঞ্জাবি আর জিন্স পরে, আর নেড়েচেড়ে দেখছি বাংলা বইয়ের তাকগুলোয়। তখনই তার আবির্ভাব। বয়স কুড়ি বাইশের এক সুন্দরী ,সপ্রতিভ তরুণী ।পরনে জিন্স আর টপ, সাজ-পোশাকে আধুনিকা হলেও উগ্র নয় ।যাহোক সে দিকে খেয়াল ছিলো না খুব একটা, বই দেখতেই ছিলাম ব্যস্ত, যেরকমটা সচরাচর হয় আরকি।
কিন্তু সেলসম্যানের সঙ্গে তার কথোপকথনে আমার টনক নড়লো। সব কথা কান পেতে শুনতে লাগলুম উৎসুক হয়ে।
"এসব লেখা নয় ,আপনি অন্য কিছু দেখান না", বাংলা পরিষ্কার উচ্চারণ ।বুঝলাম নির্ভেজাল বাঙালি, ইংরেজী বা হিংরেজী মিশ্রিত বাংলা ব্যবহার করেনা, নব্য বংগালীদের মত, এই মেয়েটি। একটু সম্ভ্রম তাই আমারও চোখে, চোখাচোখি হল।
"না ম্যাডাম ,এই যা দেখছেন ,এই আছে আমাদের ।" "আরে ,নতুন লেখকদের লেখা নেই ?সব তো সুনীল আর শীর্ষেন্দু দেখাচ্ছেন।"
বুকটা ধড়াস করে উঠল, বলে কি মেয়েটা ? সুনীল শীর্ষেন্দু জয় সঞ্জীব বুদ্ধদেব ছেড়ে নতুন লেখক? এ কোন দেশি পাঠিকা! "না ম্যাডাম, এর চেয়ে নতুন লেখক আর নেই। নতুন স্টক এই টেবিলে দেখুন।" মেয়েটি তাতে বশ হয় না। "না ,না, এরা নয়, এদের সব লেখা পড়া। আমার নতুন লেখকদের বই চাই ,একদম আনকোরা।"
গলা শুকিয়ে আসে। লজ্জাবনত হয়ে, মনে মনে বলি, "হে আধুনিকা, তোমার সামনেই, এইতো দাড়িয়ে আছি, এক হতভাগ্য আনকোরা লেখক ।লেখা তো অনেকই লিখেছি ,বুকে ধরে লালনও করেছি, জীবন দিয়ে ,অনুভূতি দিয়ে, প্রাণ দিয়ে। কিন্তু হে অনুপমা, তোমার জন্য নেইতো আমার একটাও বই। কোন পাবলিশারই ছাপাতে রাজি হয়নি যে সেইসব ছাইপাঁশ। কি করি বলোতো, হে নব প্রজন্মের পাঠিকা, সুযোগটা হারালাম। তোমার জন্য নেই আমার মতো আনকোরা হাজার হাজার কবি-লেখকের বুকের গভীর কথায় সাজানো পরম অভীপ্সিত সেই বইখানি ,সেসব কথা বুকেই মরে যায় আজও ।ভাবালু বেদনাহত চোখে, মুগ্ধতায় তার চোখের দিকে তাকাই।সে আমাকে চিনতে পারে না।
সেলসম্যানের পরাজয়ে, সে এবার নিজেই ফোন লাগায় ,"হ্যাঁ দাদু ,কি বই নেব বলতো? সব তো তোমার পড়া। না ,নতুন লেখকদের কোন বই নেই এখানে। ও ,আচ্ছা ,দেখছি......."
তার বই খোঁজার শেষটুকু আর থাকতে পারি না, শেষ পর্যন্ত সে কি বই কিনে ,পরম আনন্দে বাড়ি ফিরবে, তা জানতেও ইচ্ছা করে না। দাদু-নাতনি মিলে কোন অনামী লেখকের সৌভাগ্যের কারণ হবে তা না জানাই থাক ।কিছু কিছু জিনিসের শেষ দেখতে নেই ,এই অনুসন্ধান যেন নিঃশেষ না হয়ে, চলতেই থাকে ।লেখকেরাও আশায় আশায় বেঁচে থাকে, এইসব পাঠক-পাঠিকাদের জন্যই ।এই যেমন আমি।
এমনিতে আমার খুব একটা যাওয়া হয় না বটে, তবে কলকাতা এলে আমার পুরনো কলেজপাড়া পার্ক স্ট্রিটে একবার চরতে বেড়ানো চাই'ই, আর পার্কস্ট্রীট গেলে অক্সফোর্ড বুক স্টোরে যাব না! বই কিনি, না কিনি, একবার ঢুঁ না মেরে পারিনা।
তো সেদিনও যথারীতি ঢুকে পড়েছি, ঢোলা পাঞ্জাবি আর জিন্স পরে, আর নেড়েচেড়ে দেখছি বাংলা বইয়ের তাকগুলোয়। তখনই তার আবির্ভাব। বয়স কুড়ি বাইশের এক সুন্দরী ,সপ্রতিভ তরুণী ।পরনে জিন্স আর টপ, সাজ-পোশাকে আধুনিকা হলেও উগ্র নয় ।যাহোক সে দিকে খেয়াল ছিলো না খুব একটা, বই দেখতেই ছিলাম ব্যস্ত, যেরকমটা সচরাচর হয় আরকি।
কিন্তু সেলসম্যানের সঙ্গে তার কথোপকথনে আমার টনক নড়লো। সব কথা কান পেতে শুনতে লাগলুম উৎসুক হয়ে।
"এসব লেখা নয় ,আপনি অন্য কিছু দেখান না", বাংলা পরিষ্কার উচ্চারণ ।বুঝলাম নির্ভেজাল বাঙালি, ইংরেজী বা হিংরেজী মিশ্রিত বাংলা ব্যবহার করেনা, নব্য বংগালীদের মত, এই মেয়েটি। একটু সম্ভ্রম তাই আমারও চোখে, চোখাচোখি হল।
"না ম্যাডাম ,এই যা দেখছেন ,এই আছে আমাদের ।" "আরে ,নতুন লেখকদের লেখা নেই ?সব তো সুনীল আর শীর্ষেন্দু দেখাচ্ছেন।"
বুকটা ধড়াস করে উঠল, বলে কি মেয়েটা ? সুনীল শীর্ষেন্দু জয় সঞ্জীব বুদ্ধদেব ছেড়ে নতুন লেখক? এ কোন দেশি পাঠিকা! "না ম্যাডাম, এর চেয়ে নতুন লেখক আর নেই। নতুন স্টক এই টেবিলে দেখুন।" মেয়েটি তাতে বশ হয় না। "না ,না, এরা নয়, এদের সব লেখা পড়া। আমার নতুন লেখকদের বই চাই ,একদম আনকোরা।"
গলা শুকিয়ে আসে। লজ্জাবনত হয়ে, মনে মনে বলি, "হে আধুনিকা, তোমার সামনেই, এইতো দাড়িয়ে আছি, এক হতভাগ্য আনকোরা লেখক ।লেখা তো অনেকই লিখেছি ,বুকে ধরে লালনও করেছি, জীবন দিয়ে ,অনুভূতি দিয়ে, প্রাণ দিয়ে। কিন্তু হে অনুপমা, তোমার জন্য নেইতো আমার একটাও বই। কোন পাবলিশারই ছাপাতে রাজি হয়নি যে সেইসব ছাইপাঁশ। কি করি বলোতো, হে নব প্রজন্মের পাঠিকা, সুযোগটা হারালাম। তোমার জন্য নেই আমার মতো আনকোরা হাজার হাজার কবি-লেখকের বুকের গভীর কথায় সাজানো পরম অভীপ্সিত সেই বইখানি ,সেসব কথা বুকেই মরে যায় আজও ।ভাবালু বেদনাহত চোখে, মুগ্ধতায় তার চোখের দিকে তাকাই।সে আমাকে চিনতে পারে না।
সেলসম্যানের পরাজয়ে, সে এবার নিজেই ফোন লাগায় ,"হ্যাঁ দাদু ,কি বই নেব বলতো? সব তো তোমার পড়া। না ,নতুন লেখকদের কোন বই নেই এখানে। ও ,আচ্ছা ,দেখছি......."
তার বই খোঁজার শেষটুকু আর থাকতে পারি না, শেষ পর্যন্ত সে কি বই কিনে ,পরম আনন্দে বাড়ি ফিরবে, তা জানতেও ইচ্ছা করে না। দাদু-নাতনি মিলে কোন অনামী লেখকের সৌভাগ্যের কারণ হবে তা না জানাই থাক ।কিছু কিছু জিনিসের শেষ দেখতে নেই ,এই অনুসন্ধান যেন নিঃশেষ না হয়ে, চলতেই থাকে ।লেখকেরাও আশায় আশায় বেঁচে থাকে, এইসব পাঠক-পাঠিকাদের জন্যই ।এই যেমন আমি।
10 May 2018
ভালবাসার মানুষ
টিভিতে আজ মন বসলো না অপরাজিতার। এত দেরী করেনাতো অভী সচরাচর। কিছু বলেও যায়নি সকালে। ফোনটাও কখন থেকে সুইচড্ অফ। একটু চিন্তা হচ্ছে, রাস্তাঘাটের ব্যাপার। সব সময় খারাপ চিন্তাটাই আগে মাথায় আসে ।মেয়েটা যখন বারবার ঘ্যানঘ্যান করে বাবার কথা জিজ্ঞেস করতে লাগল, শেষে মিথ্যে করেই বলে দিল অপা "বাবার অফিসের কাজ ছিল বোধহয়, ফিরতে তাই দেরি হচ্ছে। তুমি হোমওয়ার্ক করে ফেলো।"
বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো অপা। মেয়েটাও সঙ্গ ছাড়ছে না ।মেয়েটা বড্ড বাবার ন্যাওটা ,যত রাতেই বাবা ফিরুক না কেন, একছুটে বাবার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়বে। আর অভীরও কোন ক্লান্তি নেই ,ব্যাগ-জুতো-মোজা কোথায় কোথায় ছুঁড়ে ফেলে, মেয়েকে নিয়ে খাটে গড়াগড়ি, আদর।
"তুমি এখানে কি করছ মিতুন? যাও ঘরে। হোম টাস্ক গুলো হলো না এখনও ?বাবা এখনই আসবে, যাও বলছি।" মৃদু শাসনের সুর অপরাজিতার গলায়।ওর দুশ্চিন্তামগ্ন অন্যমনস্কতা ছ'বছরের মেয়েরও নজর এড়ায়না বোধহয়। তাই মেয়ে কাছ ছাড়ে না মায়ের। দুজনে তাকিয়ে থাকে তৃতীয় ব্যক্তিটির ঘরে ফেরার অপেক্ষায় ।মায়ার বাঁধন একেই বলে।
টিভিতে কোন প্রোগ্রামই তেমন ভাল লাগছে না আজ। আরও একবার চেষ্টা করেছে অভীর মোবাইলে। এখনো সুইচড্ অফ।এবার একটু দুশ্চিন্তা হতে শুরু করলো অপার। আর কাকে ফোন করবে, কোথা থেকে খবর পাবে?অভীর কোন বন্ধুকে ফোন করবে কি ?কিন্তু এই ডিপার্টমেন্টে তো ওর সবেমাত্র বদলি হয়েছে, সে রকম কোনো কলিগের নাম্বারও নেওয়া হয়ে ওঠেনি ।কি করবে ও?
আটটা বাজল, মেয়েটা ঘুমিয়ে পড়েছে না খেয়েই। মোবাইলে একটা ফোন এলো, বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠলো। ও,বাবার ফোন ।অভী ফেরেনি শুনে বলল, "দ্যাখ ,আজও তো অবরোধ হয়েছে কলেজ স্ট্রিটে। কলকাতার রাস্তাঘাট যা ,কারো বাড়ি ফেরার টাইমের ঠিক নেই ।চিন্তা করিস না ,ঠিক ফিরে আসবে।"বাবারা এরকমই হয়,কত সহজে অস্থির মনে শান্তির আশ্বাসবাণীটুকু ভরে দিতে পারে।মনে একটু বল পায় অপা।কিন্তু রাস্তার জ্যাম, মিটিং ,মিছিল ,অবরোধ তো আগেও হয়েছে ।অভীও জানিয়ে দিয়েছে যে বাড়ি ফিরতে দেরী হবে ।কিন্তু আজকে একটাও ফোন করলো না কেন ?মোবাইলটাই বা সুইচড্ অফ কেন? দুশ্চিন্তাটা আবারও ঘিরে ধরেছিল অপাকে ।কিছু ভাল লাগছিল না ,অসহায় লাগছিল।
ঘড়ির কাঁটা কথা শুনছে না, ন'টা ছুঁইছুঁই ।বাবাকে আবারও ফোন করতে হল অভীর অফিসে একবার ফোন করে খোঁজ নেবার জন্য। পুরনো ডিপার্টমেন্টের তন্ময়দা, সৌভিকদা সবাইকে ফোন করা হয়ে গেছে, কেউ কিছু বলতে পারেনি। বুকের মধ্যে উৎকণ্ঠাটা এখন অনেক বেড়ে গেছে বুঝতে পারে অপা। একবার গেট অব্দি হেঁটে গিয়ে ঘুরে এসেছে। দারোয়ান শিবপ্রসাদ বলেছে "বাড়ি যান ম্যাডাম, বাবু ঠিক ফিরে আসবে। আজকে রাস্তায় বহুৎ জ্যাম আছে।" কিন্তু কোথাও কোনো খবর পাওয়া গেলনা। দুশ্চিন্তাটা গ্রাস করে ফেলল অপাকে। অথচ মেয়েটা কি নিষ্পাপ মুখে শান্তির গভীর নিদ্রায় মগ্ন ।কি নিশ্চন্তে মিথ্যে আশ্বাসটুকুকে নির্দ্বিধায় বিশ্বাস করে।হায়রে কেউ যদি এমন আশ্বাস দিতে পারত অপাকে,কেউ যদি দিত একটু মনের শান্তি।কি হলো অভির?
অপা আর ভাবতে পারেনা। অনেক পুরনো কথা মনে আসতে লাগলো, অনেক অযথা ঝগড়া, অনেক অভিমান ।"আজ আসুক অভী, আর ঝগড়া করব না কখনো", মনে মনে বলে অপা।চোখে একরাশ জল কোথা থেকে জমা হয়েছে, মনে ঝড় ।"কোথায় গেলে অভী? কি করব আমি একা?", বিপন্ন,বিপর্যস্ত অপা।বড্ড অসহায়।
দরজা খোলাই ছিল,হঠাৎ মনে হয় কে যেন এসে দাঁড়িয়েছে পেছনে ।চমকে ওঠে অপা। " একি, সব অন্ধকার কেন? কি করছো তোমরা ?"চেনা স্বরে সম্বিত ফেরে অপরাজিতার। বুঝতে পারে মানুষটা ফিরেছে। নিমেষে সব উৎকণ্ঠার অবসান ,হঠাৎ এত আবেগ উঠে আসে ওর গলা দিয়ে !জীবন-মরণ যাই বল, সব তো এই টুকুই ।এই অভী আর মিতুন ।নিজেকে আর ধরে রাখতে পারেনা অপা। একটা আশ্রয় চাই। ঝাঁপিয়ে পড়ে অভির বুকে। চেনা ঘামের গন্ধে মুখটা গুঁজে দিয়ে ডুকরে ওঠে ,"কি করছিলে এত রাত পর্যন্ত ,কেন এত দেরী করলে, কেন একবারও জানাওনি ........"
সব ভালবাসার মানুষই জানে এই সময় কিছু বলতে নেই। শুধু পাল্টা অনুভূতির উত্তাপে মুড়ে ফেলতে হয়, জড়িয়ে নিতে হয় আশ্লেষে।
6 May 2018
ফেলে আসা
ফেলে দিলাম সেই পুরনো কবিতাটা ।পুরনো অক্ষরগুলো নিয়ে সেটা এখনই বিদেয় হলো ।আজ আবার নতুন করে লিখতে বসলুম ।নতুন নতুন শব্দ, একঘেয়ে অক্ষরগুলো নতুন বৃষ্টির জলে ধুয়ে মুছে চকচকে। আজ তারাই ভরে দিল এই পৃষ্ঠা নতুন কথা বলবে বলে ।পুরনো কবিতার কথাগুলো কোথায় হারিয়ে যাবে কে জানে ?
কেউ নয় আমিই জানি ,ওরা কোথাও হারাবেনা ,থেকে যাবে আমার মনে ।যেমন করে থেকে গেছে ছোটবেলায় সেই শীতের রোদে পা ডুবিয়ে বসে থাকার সময়টা। তারপর সেই ছুটতে থাকা আর পিছনে ফেলে আসা এক একটা বছর শুধু নয়, এক একটা চিত্র ।সেই স্কুলের জীবন,সেই পুরোনো পাড়া, সেই বন্ধুবান্ধব,আত্মীয়স্বজন। হঠাৎ তার মধ্যে থেকে বেরিয়ে এসে একা হয়ে গেলাম আমি, একসময় ।অথচ,কিছুই হারিয়ে যায়নি, কিছুই হারায় না ,সেই পুরনো কবিতাটাও নয় ।
কিন্তু সত্যিই আমি পিছনে ফেলে এসেছি অনেক কিছু। কিছু স্মৃতি ,কিছু মানুষ সেই পুরনো পাতায় জ্বলজ্বল করে।পুরনো সব চিত্র ভেসে ওঠে মাঝে মাঝে। ভেসে ওঠে আমার মামা বাড়ির পুরনো বাড়িটার ছবিগুলো যার কিছুই এখন আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। ভেসে ওঠে পুরনো মানুষগুলোর পুরনো অভিব্যক্তি, কথা বলা ,পুরনো আফশোষ, পুরনো দুঃখ, পুরনো আনন্দ ।আর আমি অবাক হয়ে দেখছি কি অবলীলাক্রমে আমি ফেলে রেখে এলাম সেই সব স্মৃতি। কিন্তু শুধু স্মৃতি নয় ,কতগুলো মানুষকেও ফেলে রেখে এসেছি আমি অতীতে ,তাদের মধ্যে অনেকেরই আজ অতীতের গন্ডী পেরিয়ে বাস্তবে আসার ক্ষমতা বা অধিকার বা দুই'ই নেই। তারা মিলিয়ে গেছে বৃষ্টির জলে, ধুয়ে মুছে ঝাপসা হয়ে গিয়েছে। আর বাকিদের সঙ্গে দেখা হয় না অনেকদিন। স্কুলজীবনের, কলেজ জীবনের কত বন্ধু, এমন কি আমার প্রিয় বন্ধুর সঙ্গেও দেখা হয়নি কত দিন হলো। মানুষকে তো সবকিছুই ফেলে রেখে, এই জগত ছেড়ে চলে যেতে হয় ।কিছুই নাকি সঙ্গে যায় না। একমাত্র কৃতকর্মই তাড়া করে বেড়ায় তাকে। সবকিছুকেই ফেলে রেখে যেতে হবে। কত মায়া, কত স্বপ্ন, নিমেষে ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে, এমনকি শরীরটাও নাকি সঙ্গে যাবে না। এতকিছু ফেলে রেখে এগিয়ে যেতে যেতে কোনোদিন সবচেয়ে প্রিয়জনদেরও ফেলে আসতে হচ্ছে। ফেলে রেখে যেতে হবে,এমনকি প্রিয়তমাকেও।কারো ছাড় নেই। মানুষ তাই আঁকড়ে ধরে প্রিয় সব জিনিস গুলো। বেদম মার দিলেও ব্যাটারা হাতছাড়া করতে চায়না স্মৃতির সবুজ ডালটাকে ।আসলে আবেগ আর ভালবাসাটাকে কোনো দিনও ফেলে রেখে আসা যায় না কোথাও। চিরকাল তা বাঁচিয়ে রাখে বেঁচে থাকার ইচ্ছেটাকেই ,আর চারপাশ বদলে গেলেও সঙ্গে চলতে থাকে।এটাই তো পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সম্পদ ।আমার মনে হয় এতদিনেও আমার সেই পুরোনো কবিতাগুলোর মৃত্যু হয়নি,যেগুলো কোনদিন লেখাই হয়নি ।
এক্ষুনি খেয়াল হলো আমি ফেলে রেখে এসেছি সেই সময়টা ,যখন বৃষ্টির মধ্যে হঠাৎ প্রিয় মানুষটার কথা মনে পড়েছিল।
কেউ নয় আমিই জানি ,ওরা কোথাও হারাবেনা ,থেকে যাবে আমার মনে ।যেমন করে থেকে গেছে ছোটবেলায় সেই শীতের রোদে পা ডুবিয়ে বসে থাকার সময়টা। তারপর সেই ছুটতে থাকা আর পিছনে ফেলে আসা এক একটা বছর শুধু নয়, এক একটা চিত্র ।সেই স্কুলের জীবন,সেই পুরোনো পাড়া, সেই বন্ধুবান্ধব,আত্মীয়স্বজন। হঠাৎ তার মধ্যে থেকে বেরিয়ে এসে একা হয়ে গেলাম আমি, একসময় ।অথচ,কিছুই হারিয়ে যায়নি, কিছুই হারায় না ,সেই পুরনো কবিতাটাও নয় ।
কিন্তু সত্যিই আমি পিছনে ফেলে এসেছি অনেক কিছু। কিছু স্মৃতি ,কিছু মানুষ সেই পুরনো পাতায় জ্বলজ্বল করে।পুরনো সব চিত্র ভেসে ওঠে মাঝে মাঝে। ভেসে ওঠে আমার মামা বাড়ির পুরনো বাড়িটার ছবিগুলো যার কিছুই এখন আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। ভেসে ওঠে পুরনো মানুষগুলোর পুরনো অভিব্যক্তি, কথা বলা ,পুরনো আফশোষ, পুরনো দুঃখ, পুরনো আনন্দ ।আর আমি অবাক হয়ে দেখছি কি অবলীলাক্রমে আমি ফেলে রেখে এলাম সেই সব স্মৃতি। কিন্তু শুধু স্মৃতি নয় ,কতগুলো মানুষকেও ফেলে রেখে এসেছি আমি অতীতে ,তাদের মধ্যে অনেকেরই আজ অতীতের গন্ডী পেরিয়ে বাস্তবে আসার ক্ষমতা বা অধিকার বা দুই'ই নেই। তারা মিলিয়ে গেছে বৃষ্টির জলে, ধুয়ে মুছে ঝাপসা হয়ে গিয়েছে। আর বাকিদের সঙ্গে দেখা হয় না অনেকদিন। স্কুলজীবনের, কলেজ জীবনের কত বন্ধু, এমন কি আমার প্রিয় বন্ধুর সঙ্গেও দেখা হয়নি কত দিন হলো। মানুষকে তো সবকিছুই ফেলে রেখে, এই জগত ছেড়ে চলে যেতে হয় ।কিছুই নাকি সঙ্গে যায় না। একমাত্র কৃতকর্মই তাড়া করে বেড়ায় তাকে। সবকিছুকেই ফেলে রেখে যেতে হবে। কত মায়া, কত স্বপ্ন, নিমেষে ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে, এমনকি শরীরটাও নাকি সঙ্গে যাবে না। এতকিছু ফেলে রেখে এগিয়ে যেতে যেতে কোনোদিন সবচেয়ে প্রিয়জনদেরও ফেলে আসতে হচ্ছে। ফেলে রেখে যেতে হবে,এমনকি প্রিয়তমাকেও।কারো ছাড় নেই। মানুষ তাই আঁকড়ে ধরে প্রিয় সব জিনিস গুলো। বেদম মার দিলেও ব্যাটারা হাতছাড়া করতে চায়না স্মৃতির সবুজ ডালটাকে ।আসলে আবেগ আর ভালবাসাটাকে কোনো দিনও ফেলে রেখে আসা যায় না কোথাও। চিরকাল তা বাঁচিয়ে রাখে বেঁচে থাকার ইচ্ছেটাকেই ,আর চারপাশ বদলে গেলেও সঙ্গে চলতে থাকে।এটাই তো পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সম্পদ ।আমার মনে হয় এতদিনেও আমার সেই পুরোনো কবিতাগুলোর মৃত্যু হয়নি,যেগুলো কোনদিন লেখাই হয়নি ।
এক্ষুনি খেয়াল হলো আমি ফেলে রেখে এসেছি সেই সময়টা ,যখন বৃষ্টির মধ্যে হঠাৎ প্রিয় মানুষটার কথা মনে পড়েছিল।
1 May 2018
ঘুষ
জীবনে ঘুষ খায়নি কখনো এমন সরকারি কর্মচারী খুঁজে পাওয়া দুষ্কর ।ব্যতিক্রম ছিলেন আমার বাবা। রাইটার্সের বড়বাবু এবং শেষে গেজেটেড অফিসার আমার বাবা সৎভাবেই কর্মজীবনটা পার করেছেন ।নুন আনতে পান্তা ফুরিয়েছে, কিন্তু কিভাবে ঘুষ প্রত্যাখ্যান করেছেন তার নানা কাহিনী শুনেছি ছোটবেলায় ।সেই সঙ্গে অধস্তনদের ঘুষ নিয়ে খেয়োখেয়ি আর হ্যাংলামির করুন বৃত্তান্ত ।আমার বাবার সেই সৎ ভাবমূর্তিটা আমার অভাবী ছোটবেলার একটা বল ছিল ,ভালোবাসা ছিল উৎসাহ ছিল। পকেটে স্ট্যাম্পপ্যাড নিয়ে নিজেই ছুটে বেড়াতেন লোকের ঘরে ঘরে আ্যটেস্টেড করার দাবিতে ।আমি তখন একটু বড়, বলতাম" তুমি কেন যাবে ওদের বাড়ি ,এরকম আবার হয় নাকি ?ওদেরই তো তোমার বাড়ি এসে করিয়ে নিয়ে যাবার কথা। দরকারটা তো ওদেরই।" বাবা হেসে বলতেন "না ,বেচারা যদি বাড়ি চিনতে না পারে" বা "ও পড়াশোনায় ব্যস্ত" ইত্যাদি দরদী অজুহাত।
যাই হোক শৈশব থেকেই জেনে ,না জেনে সততার একটা প্রথম পাঠ হয়ে গিয়েছিল ।কেউ বলে দেয়নি সৎ থাকতে হবে, শুধু একটা জেদ তৈরী হয়ে গিয়েছিল ।তাই আমার কর্ম জীবনে কনট্রাক্টরদের কত রকম প্রলোভন বা অলিখিত নিয়মে পা বাড়াইনি কখনো। পেছনে তাড়া করেছে তারা, এমনকি পাঁচ টাকার নোট নিয়েও, আর আমি মাথা উঁচু করে, গলা ছেড়ে নিজেকে, নিজের ঐতিহ্যকে প্রমাণ করে ছেড়েছি। সে এক অন্যরকম ভাল লাগা ছিল ,সে এক অন্যরকম অস্তিত্ব প্রমাণ করা ছিল ।
মনে আছে একদিন খাবার টেবিলে নিছকই মজা করে , মা যখন বলেছিল "বুবাই আজকাল তোর হাতে অনেক পয়সা টয়সা আসছে দেখছি, যা খুশি যেভাবে খুশি খরচা করছিস !কিভাবে আসছে রে এত পয়সা ?অফিসে ঘুষটুষ নিচ্ছিস না তো?" মুহূর্তে খাওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল আমার। খাবার টেবিলে প্রতিবাদের সঙ্গে হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলেছিলাম সারা জীবনের কান্না। সে কান্না ছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করার কঠিন সময়গুলোয় জেতার অভিমান, হৃদয়ের এক্কেবারে ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা চরিত্রের প্রতিবাদ ।এতটাই পবিত্র ছিল সেই অস্তিত্বের প্রকাশ ।
সেদিন সবচেয়ে খুশি হয়েছিলেন আমার বাবা।
যাই হোক শৈশব থেকেই জেনে ,না জেনে সততার একটা প্রথম পাঠ হয়ে গিয়েছিল ।কেউ বলে দেয়নি সৎ থাকতে হবে, শুধু একটা জেদ তৈরী হয়ে গিয়েছিল ।তাই আমার কর্ম জীবনে কনট্রাক্টরদের কত রকম প্রলোভন বা অলিখিত নিয়মে পা বাড়াইনি কখনো। পেছনে তাড়া করেছে তারা, এমনকি পাঁচ টাকার নোট নিয়েও, আর আমি মাথা উঁচু করে, গলা ছেড়ে নিজেকে, নিজের ঐতিহ্যকে প্রমাণ করে ছেড়েছি। সে এক অন্যরকম ভাল লাগা ছিল ,সে এক অন্যরকম অস্তিত্ব প্রমাণ করা ছিল ।
মনে আছে একদিন খাবার টেবিলে নিছকই মজা করে , মা যখন বলেছিল "বুবাই আজকাল তোর হাতে অনেক পয়সা টয়সা আসছে দেখছি, যা খুশি যেভাবে খুশি খরচা করছিস !কিভাবে আসছে রে এত পয়সা ?অফিসে ঘুষটুষ নিচ্ছিস না তো?" মুহূর্তে খাওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল আমার। খাবার টেবিলে প্রতিবাদের সঙ্গে হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলেছিলাম সারা জীবনের কান্না। সে কান্না ছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করার কঠিন সময়গুলোয় জেতার অভিমান, হৃদয়ের এক্কেবারে ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা চরিত্রের প্রতিবাদ ।এতটাই পবিত্র ছিল সেই অস্তিত্বের প্রকাশ ।
সেদিন সবচেয়ে খুশি হয়েছিলেন আমার বাবা।
Subscribe to:
Posts (Atom)