আমি আবেগ ও অনুভূতিপ্রবণ,ভাবুক আর সৃষ্টিশীল।জীবনের চলা,ওঠাপড়া আর অভিজ্ঞতা নিংড়োনো এই সব লেখা ।এ আমার পাগল মনের নিঃশেষিত প্রকাশ।
27 October 2020
অপারেশন আপসাইলন
2021 সালের পনেরোই মার্চ। নরওয়ের অসলো বিমানবন্দরের এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলারদের একেবারে হিমসিম অবস্থা। একের পর এক নামছে নানা দেশ থেকে আসা ফ্লাইটগুলো। বাছা বাছা সমস্ত পৃথিবী বিখ্যাত মানুষজনদের ডেকে আনা হয়েছে সেখানে।এসকর্ট করে তাদের নিয়ে গিয়ে, দ্রুত ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে আলাদা আলাদা চারটে ঘরে। বিমানবন্দরের লাউঞ্জের বিলাসবহুল সেই সব ঘর থেকে কাউকে বের হতে দেওয়া হবে না আগামী পনেরো দিন। মহামারি ভাইরাসের চারটে মাত্র ভ্যাকসিন এখনও পর্যন্ত তিনটি ট্রায়ালেই উত্তীর্ণ হতে পেরেছে। এবার তাদের সর্বশেষ পরীক্ষা হবে। সর্বসম্মতিক্রমে পৃথিবীব্যাপী চূড়ান্ত ট্রায়ালটিই হবে এই পনেরো দিন ধরে। এর ঠিক পরেই ঘোষণা করা হবে সফলতম ভ্যাকসিনটির নাম এবং এমনকি বাণিজ্যিকভাবে তা বিক্রিও শুরু হয়ে যাবে পৃথিবীময়। তাই সারা পৃথিবীর নজর এখন অসলোর দিকে।
চারটে আলাদা ঘরে, আলাদা ধরণের মানুষদের রাখা হবে, প্রতি ঘরে দশ জন করে। আলাদা ঘর ,আলাদা ভ্যাকসিন।নির্দিষ্ট ভ্যাকসিনের ডোজ দিয়ে, নির্দিষ্ট ঘরে তাদের ঢুকিয়ে দেওয়া হবে। ঘরে রয়েছে লুকোনো ক্যামেরা এবং মাইক্রোফোন। প্রতি মুহূর্তে নজর রাখা হবে তাদের শারীরিক অবস্থা, তাদের কথাবার্তা, চালচলন সবকিছুর উপর। আলাদা একটা কন্ট্রোল রুমও লুকোনো রয়েছে ওই লাউঞ্জের ভেতরেই, যেখানে অপারেটররা সর্বক্ষণ তাদের ভিডিও এবং অডিও রেকর্ডিং করে চলবে।
সমস্ত কুশীলবদের আসার সঙ্গে সঙ্গেই ভ্যাকসিনেশন পর্ব সারা হয়ে গেল। চারটি ঘরের কোন ঘরে কারা থাকবেন, তা আগে থেকেই ঠিক করা ছিল। প্রথম ঘরে থাকবেন পৃথিবী বিখ্যাত সব বিজ্ঞানীরা, নানা দেশের, নানা বয়সের। দ্বিতীয় ঘরটাতে থাকবেন দুনিয়ার প্রথম শ্রেণীর সমস্ত পর্নস্টারেরা। তৃতীয় ঘরটাতে থাকবেন পৃথিবী বিখ্যাত সমস্ত কবিরা। আর চতুর্থ ঘরটাতে সেরকম নামকরা কেউ থাকবেন না, শুধু বেশ কিছু পাঁড় মাতালদের এনে ঢুকিয়ে দেওয়া হবে। সেই সব মাতাল আর নেশাড়ুদেরও অবশ্য ধরে আনা হয়েছে পৃথিবী বিখ্যাত সব শুঁড়িখানার লিস্ট ধরে ধরে। সবার জন্যই থাকছে এলাহি খাওয়া-দাওয়া আর সমস্ত আধুনিক সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা। শুধু শর্ত একটাই, ঘর ছেড়ে বেরোনো যাবেনা এই ক'দিন। ঐ ঘরের মধ্যেই থাকা-খাওয়া-ঘুম। আর দুটো ব্যাপার, তাদের যে গোপনে ছবি তোলা হচ্ছে আর কথা রেকর্ড করা হচ্ছে সেটা তারা জানবে না আর এক ঘরের লোক অন্য ঘরের লোকের সঙ্গে যোগাযোগও করতে পারবে না, এমনভাবে নেটওয়ার্ক ব্লকিং করা আছে।
অপারেশন আপসাইলন শুরু হয়ে গেল।
(বাকিটা জানতে পুরো গল্পটা পড়তে হবে)
পরিত্যক্ত গাড়ির রহস্য
'হ্যালো.. মিস্টার সৌরনীল বসু বলছেন?'
'হ্যাঁ, বলছি বলুন।'
'ওসি রাঘব সোম একটু কথা বলবেন, ধরুন। স্যার এই নিন।'
লাইনটা ট্রানস্ফার করতেই ওপাশে চেনা গলা।
'কে সৌরনীল? আমি রাঘবদা বলছি।'
'আরে, রাঘবদা বলুন। এত সকাল সকাল কি মনে করে?'
'একবার এয়ারপোর্ট থানায় এখনই আসতে পারবে? আর্জেন্ট।'
'আরে নিশ্চয়ই পারব। কিন্তু কেসটা কি?'
'একটা গাড়ি। মালিক বেপাত্তা। এসো, তারপর সব বলছি।'
ফোনটা কেটে যায়। সৌরনীলের রেডি হতে ঠিক পাঁচ মিনিট লাগে। চা-জলখাবারের পাটটা এখন তোলা থাক, পরে দেখা যাবে। রাঘবদার আর্জেন্ট ফোন মানে নিশ্চয়ই জটিল রহস্য, পুলিশ কুলকিনারা পাচ্ছে না। বেশকিছু এরকম কেসের সুরাহা করে সৌরনীল এখন পার্টটাইম গোয়েন্দা। পুলিশের কোন না কোন বড়কর্তার ফোন আসে, নানা কেসের ব্যাপারে হেল্প করার অনুরোধ নিয়ে।
সৌরনীল বেরিয়ে পড়ে, এখন দারুণ দারুণ সব এসি ইলেকট্রিক বাস হয়েছে। ভাড়াটা একটু বেশি হলেও আরামে যাওয়া যায়। সেরকমই একটা বাস পেয়ে গেল সৌরনীল। দমদম এয়ারপোর্টের দু'নম্বর গেটের সামনেই থানা। কাছেই পার্কিং লট আর একটু দূরেই এয়ারপোর্টের মূল দরজা। থানায় রাঘববাবু ওর জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। 'চলো,পার্কিং লটে চল,দেখাই তোমায়।' বলে রাঘববাবু উঠে পড়লেন। হেঁটেই ওরা চলে এল পার্কিং লটে। রাঘববাবু নো এন্ট্রি টেপে ঘেরা ছাই রঙের একটা গাড়ির কাছে নিয়ে এলেন সৌরনীলকে। আরো কয়েকজন পুলিশ অফিসার রয়েছেন।
'দেখো, এই গাড়িটা।'
'ওরে বাবা, এ তো হেব্বি ঘ্যামা গাড়ি দেখছি, বিএমডব্লু।'
'হ্যাঁ, গত দু'সপ্তাহ ধরে এখানেই পড়ে আছে গাড়িটা। কে যে ফেলে গেছে বোঝা যাচ্ছেনা।'
'দু'সপ্তাহ! এতদিনে আপনাদের টনক নড়ল?'
'আর বোলো না। ঢাকা থাকায়, প্রথমে কেউ খেয়াল করেনি। অনেকসময়ই কোন ইন্টারন্যাশনাল ফ্লাইটের পাইলটের গাড়ি এখানে থাকে। সে হয়তো লম্বা সফরে রয়েছে বা কোথাও আটকা পড়ে গেছে। এখানকার স্টাফেরা সেরকমই কিছু ভেবেছিল।'
'তারপর?'
'প্রথম সন্দেহটা হল কাল। বিকেলে হঠাৎ কালবৈশাখী ঝড়ে গাড়ির ঢাকাটা উড়ে গিয়ে নম্বরটা বেরিয়ে পড়ল বলে।'
'ও, সেই জন্য? 'R-E-V-E-N-G-E' লেখা এরকম নাম্বার প্লেট আবার হয় নাকি?'
'সেটাই তো রহস্য। এরকম নম্বর প্লেট দেখেই সবার সন্দেহ হয়। তখনই খেয়াল হয়, যে দু'সপ্তাহ ধরে গাড়িটা পড়ে আছে, কেউ নিতে আসেনি। ব্যাস, থানায় খবর যায়।'
'তো কোন খোঁজ পেলেন নাকি?'
'কি খোঁজ পাব বলো। এরকম নাম্বার প্লেট আদৌ হয় নাকি? তারপর কে কার ওপর রিভেঞ্জ নিচ্ছে, সেটাই তো মাথায় ঢুকছেনা। পিলে চমকে গেছে সবার। এই নামে তো কোন গাড়ি রেজিস্ট্রেশন হতেই পারে না। তাই তুমি নিজেই একটু দেখো।'
'বুঝলাম। কিন্তু একটা জিনিস খেয়াল করেছেন? গাড়িটার একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল এবং সেটা কোন সাধারণ অ্যাক্সিডেন্ট নয়।'
(এরপর রহস্যের ঘনঘটা জানতে গেলে পুরো গল্পটা পড়তে হবে)
ক্যানভাস
বর্ধমান শহরের কাঞ্চননগর গ্রাম। সেখানে রয়েছে দেবী দূর্গার এক বহু পুরোনো মন্দির, যা খুবই জাগ্রত বলে শোনা যায়। প্রতি বছর দূর্গাপুজোর সময় সেখানে আঠেরো দিন ধরে বিশাল ধুমধাম করে পুজো হয়। অনেক দূর দূরান্ত থেকে মানুষজন দেখতে আসে। শোনা যায় বর্ধমানরাজ চিত্রসেন নাকি মায়ের স্বপ্নাদেশ পেয়ে এই মন্দির সতেরোশো পঞ্চাশ সালে তৈরি করেছিলেন। এত প্রাচীন এই মন্দিরের অবস্থা এখন জরাজীর্ণ হলেও, ইদানিং কিছুটা যত্নের ছাপ পড়েছে। মন্দিরের ভেতরে রয়েছে দেবী দূর্গার অষ্টধাতুর মূর্তি। সারা বছর স্থানীয় পুরোহিত স্বপন ভট্টাচার্য্যই এই মন্দিরের দেখাশোনা, পুজোআচ্চা করেন।
দূর্গাপুজো এগিয়ে আসছে। গ্রামের পুজো কমিটির মিটিং ডাকা হল। কর্তাব্যক্তিরা সবাই হাজির, ঠাকুরমশাইকেও ডাকা হয়েছে। শ্যামল সামন্ত গ্রামের সবচেয়ে গণ্যমান্য লোক। যেমন তার আর্থিক প্রতিপত্তি, তেমনি লোকবল। প্রচুর জমিজমা ছাড়াও ট্রাক্টার, ডাম্পার পর্যন্ত রয়েছে, মাসে হেসেখেলে লাখখানেক টাকা রোজগার। মন্দিরের সামনের যে চাতালটায় বসে মিটিং হচ্ছে, সেটাও তিনিই বানিয়ে দিয়েছেন। মন্দিরের বাইরেটা ঘিরে গ্রিলের দরজা পর্যন্ত তারই পয়সায় করা। পুজো নিয়ে এখনও শেষ কথা তারই।
শ্যামলবাবু বললেন, 'এবার পুজোয় ভাবছি আঠেরো দিনই ভোগ রান্না হবে, গোটা গ্রামের লোক এসে প্রসাদ খেয়ে যাবে। কারো বাড়িতে আর রান্নাবান্না করার দরকার নেই। কি বলেন পঞ্চাননবাবু ?'
পঞ্চাননবাবু গ্রামের সবচেয়ে বয়োঃজ্যেষ্ঠ, খুবই সম্মানীয় মানুষ, স্কুলশিক্ষক ছিলেন। তিনি বললেন, 'সে তো ভালই। তবে অনেক খরচের ব্যাপার যে।গোটা গাঁয়ের লোকের প্রসাদের ব্যবস্থা করা কি চাট্টিখানি কথা? অত রান্নাই বা কে করবে?'
'ও আপনাকে কোন চিন্তা করতে হবে না। ঠাকুরমশাইকেই দায়িত্ব দিয়ে দিচ্ছি। ঠাকুরানি আছেন। ওনার সঙ্গে বাড়ির মেয়ে বউরাও হাত লাগাবে। ও সব ঠিক হয়ে যাবে। কি ঠাকুরমশাই?' শ্যামলবাবু ভটচাজবাবুর দিকে তাকান।
ভটচাযবাবু বললেন, 'হ্যাঁ, সে ঠিক আছে। কিন্তু যদি অনুমতি দেন, একটা কথা বলব?'
'বলে ফেলুন', শ্যামলবাবু বললেন।
'মানে, বলছিলাম কি, এতদিন ধরে তো পুজো। এতরকম জোগাড়-যন্তর। সব একা একা আর পেরে উঠি না, বয়স হচ্ছে তো। যদি আমার ছেলেটাকেও আমার সঙ্গে রাখি, তাহলে বড় ভাল হয়। ও তো বড় হয়েছে, আমাকে বেশ সাহায্য করতে পারবে।'
'ও,এই ব্যাপার! এ তো ভাল কথা। তা আপনার ছেলের নামটা কি যেন?'
'অভিষেক'
'বাঃ বাঃ। খুব ভাল। তাহলে তাই হবে। তাছাড়া রান্না আর অন্যান্য যোগাড় যন্ত্রের জন্য ক্লাবের ছেলেরা তো আছেই। কি বলেন?'
সবাই একপায়ে রাজি। শেষে সব ঠিকঠাক হয়ে গেল, পুজোর খরচের সিংহভাগই দেবেন শ্যামলবাবু। গণ্যমান্য বাকিরা মিলে বাকিটুকু। গাঁয়ের লোকের থেকে চাঁদাপত্র কোনদিনও নেওয়া হয়না এই পুজোয়।
বাড়ি গিয়ে ভটচাজবাবু খুশি হয়ে গিন্নিকে ডেকে বললেন, 'শুনছ,এবার বড় করে পুজো হচ্ছে গো! আঠেরো দিনই ভোগ রান্না হবে। গ্রামসুদ্ধ সবাই খাবে। আর আমাদের তিনজনকেই অনেক দায়িত্ব দিয়েছে গো।'
'তাই নাকি? এ তো ভালো কথা। তো আমাদের কি কি দায়িত্ব দিয়েছে শুনি?'
'পুরো রান্নার দায়িত্ব তোমার, বুঝলে?'
'হ্যাঁ! আমার! আমি একা এত পারব কি করে?'
'আরে চিন্তা করছ কেন? সব হয়ে যাবে তাছাড়া তো গাঁয়ের মেয়ে বউরাও তোমাকে সাহায্য করবে।'
' দেখি, যা কোমরে বেদনা! তা আর কি বলেছে শুনি?'
' অভিও এবার থেকে আমার সঙ্গে মায়ের পুজোর দায়িত্বে থাকবে। ওদের বলে ক'য়ে ঢুকিয়ে নিয়েছি। আর চিন্তা নেই ছেলেটার, কি বল?'
'তাই নাকি? তা বেশ করেছ।'
ভটচাজবাবু হেসে কিছু একটা বলতে যাবেন, তখনই অভিষেক ঘরের ভেতর থেকে পায়ে পায়ে বেরিয়ে আসে। পাশের গ্রামের স্কুলে ও ক্লাস নাইনে পড়ে। পড়াশোনাতে বরাবরই ভাল। কিন্তু বাপের মত পুজোআচ্চার ব্যাপারে ওর কোনদিনই মন নেই। এদিকে বাবা চান পুরুতগিরিটা ভাল করে ছেলে শিখে নিক, তাতে অন্তত রোজগারের একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে। কিন্তু অভিষেকের এসবে কোনো উৎসাহই নেই। ও খুব সুন্দর ছবি আঁকে,নিজেই শিখেছে। ও বড় হয়ে আর্টিস্ট হতে চায়, অনেক বড় আর্টিস্ট। যদিও ভীষণ লাজুক আর ঘরকুনো বলে, গাঁয়ের কেউই ওর এই বিশেষ গুণটা সম্পর্কে তেমন কিছু জানেই না।
অভিষেক বলল, 'কেন বাবা? আমাকে এসবের মধ্যে কেন ঢোকাচ্ছ? পুজোর পরেই তো আমার ফাইনাল পরীক্ষা, জান না?'
'তুই থাম দিকি। এত কষ্টে একটা মওকা বুঝে, তোর একটা হিল্লে করে দিলাম, আবার বড় বড় কথা বলছিস?', রেগে বলেন ভটচাজবাবু।
অভিষেক বলে, 'সারাদিন মন্দিরে থেকে, ওইসব আমি করতে পারব না। আমি পুজোআচ্ছা পারিনা।'
'পারিস না! ওগো, এ কি বলছে দেখ গো বামুনের ছেলে হয়ে! ছি, ছি, এ কথা বলতে পারলি? মার মন্দিরে পুজোর দায়িত্ব পেলি, কোথায় বর্তে যাবি, তা না।' স্তম্ভিত ভটচাজবাবু।
'আমার ওসব ভাল লাগে না বাবা।', অভিষেক আপ্রাণ বোঝাতে চেষ্টা করে।
'ভাল লাগে না! তো কি ভাল লাগে শুনি? ছবি আঁকতে, না? শুধু ছবি এঁকে তোর পেট চলবে নাকি?' চিৎকার করে ওঠেন ভটচাজবাবু।
বাবা-মার বকুনি খেয়ে, মন খারাপ করে, শেষে চুপচাপ নিজের ঘরে ঢুকে যায় অভিষেক। এই ঘরটাই ওর কাছে মন্দির। চারিদিকে ছড়ানো রং-তুলি, ইজেল, ড্রইংয়ের খাতা আর দেওয়াল ভর্তি ওর আঁকা অসাধারণ সব পেন্টিং। পড়াশোনার বাইরে এটাই ওর নেশা, প্রাণমন তাতেই ঢেলে দেয় ও। মনের আনন্দ বা দুঃখ সবেতেই ছবি আঁকাটাই ওর একমাত্র মুক্তির পথ। ওর আঁকার হাত দেখে, স্কুলের হেডস্যার শ্যামাপদবাবু ওকে কলকাতায় একটা বড় প্রতিযোগিতায় ছবি এঁকে পাঠাবার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। অর্গানাইজাররা ওই প্রতিযোগিতার প্রথম তিনজনকে বিশেষ এক্সিবিশনের সুযোগ করে দেবে আর কলকাতার আর্ট কলেজে আঁকা শেখারও ব্যবস্থা করে দেবে। সেই স্বপ্নেই এখন মশগুল অভিষেক। বড় ক্যানভাসটা কলকাতা থেকে হেডস্যারই আনিয়ে দিয়েছেন। খুব যত্নে সেটা তুলে রেখেছে অভিষেক, এবারে ওটাতেই ও আঁকা শুরু করবে। স্যার বলেছেন, 'আঁকার সময় শুধু চোখ আর হাত দিয়ে নয়, হৃদয় দিয়ে আঁকবি রে অভি, তাহলেই সে সৃষ্টি সার্থক হবে।'
ওদিকে পুজোর প্রস্তুতি প্রায় সারা। চারিদিকে সাজো সাজো রব। ছোট একটা প্যান্ডেল বাঁধা হয়েছে, খাবার জায়গায় আলাদা প্যান্ডেল, আর এক কোণে ভোগ রান্নার ব্যবস্থা। বাজার দোকানও গ্রামের ছেলেরা মিলে প্রায় করে ফেলেছে, মহানন্দ চারিদিকে। পঞ্চাননবাবু ঘুরে ফিরে সব তদারকি করছেন, কোথাও যেন কোন ফাঁকি না থেকে যায়। গ্রামের ছেলেবুড়ো কচিকাঁচারা সব এদিক-ওদিক উঁকিঝুঁকি মেরে দেখে যাচ্ছে, সবারই উৎসাহ আগ্রহের শেষ নেই। পঞ্চাননবাবু ছেলেছোকরাদের মাঝেমধ্যেই ধমকাচ্ছেন, 'কিরে বিশে, এখনো প্রদীপ, ধামা কিছুই এল না?', 'এই শ্যামা, জলের জগগুলো সব এভাবে রেখেছিস কেন?', এইসব চলছে। ঠাকুরমশাই ভটচাজবাবু ধুপ-ধুনো আর যজ্ঞের কাঠের হিসেব মিলিয়ে নিতে নিতে, হেসে বললেন, 'বুঝলে পঞ্চাদা, এবার দেখবে কেমন আড়ম্বরে পুজোটা করি। ছেলেটাও থাকবে সঙ্গে, অনেক সুবিধে হবে।' পঞ্চাননবাবু বলেন, 'হ্যাঁ তা তো করবেই। এত বড় করে পুজো হচ্ছে, কত লোক দেখতে আসবে কত দূর দূর থেকে। শুনলাম টিভি থেকেও নাকি ছবি তুলতে আসছে।'
সেদিন পঞ্চমী, রাত পোহালেই ষষ্ঠী। হঠাৎই ভোরবেলা কোথা থেকে হৈ হৈ, চিৎকার-চেঁচামেচি ভেসে এল। দাবানলের মত দুঃসংবাদটা ছড়িয়ে পড়ল চারিদিকে। মন্দিরের বাইরের লোহার গ্রিলের দরজা কাটা, মন্দিরের জানলা ভাঙ্গা। তড়িঘড়ি ঠাকুরমশাইকে খবর দেয়া হল। উনি মূল দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে দেখলেন, যা ভয় করা হয়েছিল ঠিক তাই। অষ্টধাতুর দূর্গামূর্তি আর লক্ষীমূর্তি দুটোই গায়েব।
সবার মাথায় বজ্রাঘাত হল। পুজোর আগের দিন বিগ্রহ চুরি গেল। হায় হায় করে উঠল সবাই। সব আনন্দ-উৎসব তো তাহলে বন্ধ! কি হবে এখন? সারা বছরের সব অপেক্ষা শেষে এক মুহূর্তে এইভাবে ধূলিসাৎ হয়ে গেল! শোকের ছায়া নেমে এল সারা গ্রামে, ঘরে ঘরে অরন্ধন। থানায় খবর দেওয়া হল, পুলিশ কুকুর এল। কিন্তু চারদিকে খোঁজাখুঁজি করেও কোন সূত্র পেল না কেউ। ভটচাজবাবু তো একেবারে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলেন। সবার মনে একটাই প্রশ্ন, পুলিশ যা করার করছে, কিন্তু পুজোর কি হবে? বিগ্রহ ছাড়া তো আর পুজো হয়না। কেউ তো আর কখনও ভাবতে পারেনি, যে এভাবে বিগ্রহ চুরি হয়ে যেতে পারে! এত প্রাচীন অষ্টধাতুর জাগ্রত দূর্গামূর্তি শেষে চোরাবাজারে বিক্রি হয়ে যাবে? আসলে প্রতি সন্ধেয় আরতির পর, মন্দিরে তালাচাবি দিয়ে ভটচাযবাবু বাড়ি চলে যান। তাছাড়া কোন নাইট গার্ডের ব্যবস্থা নেই, জায়গাটাও নির্জন। তাই দুষ্কৃতীদের কাজটা সহজ হয়েছে। সব শুনে মন্দিরে চলে এসেছে অভিষেকও, ওরও মনটা খারাপ। পুরুতগিরি ওর পছন্দ না হলেও, বাবার সঙ্গে প্রায়ই মন্দির আসে। পুজো, আরতি, হোম এসব দেখে। টুকটাক সাহায্যও করে পুজোর কাজে, সবাই যেমন করে। আসলে জন্ম থেকে এই মন্দির আর দেবী দূর্গার মূর্তি ওদের হৃদয়ে স্থান পেয়েছে, ওর ঘরেও টাঙানো আছে দূর্গামূর্তির একটা ছবি। সেই দূর্গাপুজো হবে না! তাও পুজোর ঠিক আগের দিন! ব্যাপারটা মেনে নিতে পারছিল না কেউই। সকলে ভিড় করে মন্দির চত্বরে দাঁড়িয়ে রয়েছে, গ্রামের মেয়ে-বৌরা কান্নাকাটি করছে, শিশু থেকে বুড়ো সবার চোখে জল।
অভিষেক বাবাকে জিজ্ঞেস করল, 'বাবা, পুজো কি তাহলে আর হবে না?'
ভটচাজ বাবু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,'নাঃ, আর তো কোন উপায় দেখছি না। সব শেষ হয়ে গেল রে অভি।', বলে চশমাটা খুলে রুমাল দিয়ে চোখ মুছতে লাগলেন। কথাগুলো সহ্য করতে পারল না অভিষেক, এক ছুটে বাড়ি গিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা দিয়ে দিল।
সারাদিন আলাপ-আলোচনাতেই কেটে গেল, কোন সুরাহা বেরোল না। পুলিশ বলছে, তদন্ত চলছে। কয়েকজন অত্যুৎসাহী থানায় গিয়েছিল জানতে, থানা থেকে ভাগিয়ে দিল সবাইকে। মন্দিরের চাতালে জড়ো হওয়া কর্তা-ব্যক্তিরা নীচু গলায় নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছিলেন। পঞ্চাননবাবু বললেন, 'আমি তো ভাবতেও পারছিনা, আমাদের গ্রামের মন্দিরে এভাবে চুরি হতে পারে! কে করতে পারে চুরিটা বলুন তো?' সকলে চুপ। শ্যামলবাবু বললেন, 'যা হবার সে তো হয়েছে, এবার পুজোর কি হবে সেটা বলুন দিকি।' পোস্টমাস্টার সুবিমলবাবু খুব পন্ডিত মানুষ, সারাদিন মোটা মোটা বই পড়েন। তিনি বললেন, 'পুলিশ তো কিছু করতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না। অন্তত রাতারাতি মূর্তি উদ্ধার করার কোন আশা দেখছি না।' শ্যামলবাবু ব্যাজার মুখে বললেন, 'তাহলে আর কি হবে বলুন। পুজোর মুখে এরকম ঘটনা, আমার তো কিছু মাথায় আসছেনা।' বয়স্ক কয়েকজন বললেন, 'এ বড় অশুভ ঘটনা। দূর্গামূর্তি এত জাগ্রত ছিল এই গ্রামে, এখন কোন অঘটন না ঘটে।' শেষে সকলে চিন্তিত মুখে, ভয়ে ভয়ে বাড়ি চলে গেল। সবার মনে উদ্বেগ, বুকে ঝড়।
পরের দিন ষষ্ঠী, সকালে আবার পুলিশের এনকোয়ারি। ভটচাজবাবুকে আবার তালা চাবি খুলে দিতে বললেন ওসি। তালা খুলে ভেতরে ঢুকতে, মূল দরজার সামনে এসে সবাই বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল। মন্দিরের দরজার গায়ে, হেলান দিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখা রয়েছে বিরাট ক্যানভাসে আঁকা অবিকল দূর্গামূর্তিটার একটা ছবি। কোন পার্থক্যই করা যাচ্ছে না আসলটার সঙ্গে। সবাই তো অবাক, কে আঁকল এত সুন্দর ছবি! আর এখানে রেখে গেলই বা কখন! ছবিটা মন্দিরের ভেতরে নিয়ে যাওয়া হল। কোথায় রাখবেন ঠিক করতে না পেরে, ভটচাজবাবু ছবিটাকে শূন্য বেদীটার উপরেই রেখে দিলেন। লোকজন ততক্ষণে খবর পেয়ে, ভেঙে পড়েছে মন্দিরে। আসল মূর্তি যতদিন না পাওয়া যাচ্ছে, তার অবিকল প্রতিমূর্তিকেই পুজো করা হোক, সকলের এটাই দাবি, অন্যরাও তাতে মত দেন। দুঃখের মধ্যেও আনন্দের হিড়িক পড়ে যায় গ্রামে, মুখে মুখে রটে যায় 'পুজো হবে'। দ্বিগুন উৎসাহে ঝাঁপিয়ে পড়ে ছেলে-বুড়ো সবাই।
শ্যামলবাবু হেসে বললেন, 'ওফ্ , অবশেষে একটা ব্যবস্থা হল। মূর্তির বেদীটা খালি দেখতে, বড্ড কষ্ট হচ্ছিল।' সুবিমলবাবুও সায় দিয়ে বললেন, "হ্যাঁ, যা বলেছেন। শেষ পর্যন্ত যে পুজো হবে, এই ঢের। কি যে মনটা খারাপ হয়েছিল কাল থেকে, কি বলব।' শ্যামলবাবু বললেন, 'সে আর বলতে? কাল মশাই, সারারাত ঘুমই এল না ঠিকমত। কি যে কষ্ট, বলে বোঝাতে পারব না।' পঞ্চাননবাবু বললেন, 'শুধু আপনার নয় শ্যামলবাবু, গোটা গাঁয়ে কারো বাড়িতে কাল হাঁড়ি চড়েনি। ছেলে-বুড়ো কারো চোখের জল বাঁধ মানে নি।''ঠিক বলেছ', সুবিমলবাবু বলে ওঠেন, 'তা স্বপন, পুজোতে কোন সমস্যা নেই তো ?' ভটচাযবাবু বলেন, 'এই ছবিতেই পুজো হবে, কোন দোষ নেই। যতদিন না আসল মূর্তি উদ্ধার হচ্ছে।' পঞ্চাননবাবু বললেন, 'কিন্তু এত সুন্দর এই ছবিটা আঁকলই বা কে? আর এখানে রেখে গেলই বা কখন, সেটাই তো বুঝতে পারছিনা।'
ভটচাজবাবু কোন উত্তর দিলেন না। সব লোকজনের ভীড়ের মধ্যে খুঁজতে খুঁজতে, এক কোণে পাড়ার ছেলেছোকরাদের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা অভিষেকের দিকে নজর পড়ে গেল। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকাতেই, অভিষেক ফিক করে হেসেই মুখটা লুকিয়ে নিল। সেই হাসি তখন ফুটে উঠল ভটচাজবাবুর মুখে, চোখে জল। ঢাক বেজে উঠল মন্দিরের চাতাল থেকে।
স্যুইট নং ১১
একটা গাড়ি পড়েে আছে এয়ারপোর্টের পার্কিং লটে।নেমপ্লেটে লেখা REVENGE.জানা গেল গাড়িটা ফিল্মস্টার অনিরুদ্ধ চৌধুরীর।কিন্তু উনি কোথায়, কেউ বলতে পারল না।গাড়িটার কি অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল?সৌরনীল নিজে নিশ্চিত
কি যে হল ফিল্মস্টার ভদ্রলোকের?
সৌরনীল বলল, 'গাড়িটা অ্যাক্সিডেন্টের পর কে এত দূরে চালিয়ে নিয়ে এল, এটাই আমার অদ্ভুত লাগছে।'
'কেন? নিশ্চয়ই ওনার বা ড্রাইভারের কারো তেমন চোট লাগেনি, তাই চালিয়ে নিয়ে চলে এসেছেন।'
'সে তো হতেই পারে, কিন্তু এয়ারব্যাগগুলো তো চুপসোনো অবস্থায় এখনো লেগে আছে। এত তাড়া, যে পাল্টে নেওয়ারও সময় হল না!'
'তাইতো! ঠিক বলেছ। এটা তো আমি খেয়াল করিনি।'
'কিন্তু সবার আগে জানা দরকার, অ্যাক্সিডেন্টটা কোথায় হয়েছিল।' সৌরনীল হেসে বলল।
হঠাৎ হন্তদন্ত হয়ে বেশ উদ্ভ্রান্ত অবস্থায় হাজির হল অনিরুদ্ধ চ্যাটার্জীর ড্রাইভার তিনকড়ি পাত্র। ওকে জেরা করতে শুরু করলেন রাঘববাবু।
'অনিরুদ্ধবাবু কোথায়?'
'আজ্ঞে, উনি তো শুটিং করছেন।'
'কোথায়? ফোনে তো পাওয়া যাচ্ছে না!'
'দার্জিলিঙে।'
'লাস্ট কবে ওনার সঙ্গে তোমার দেখা হয়েছে?'
'আজ্ঞে দিন পনেরো আগে,দার্জিলিঙেই।'
'তারপর? তুমিই তো ওনার গাড়ি চালাতে। ওকে রেখে দিয়েই চলে এলে?'
'সাহেব যে আমাকে ট্রেনে চলে যেতে বললেন।' ঢোঁক গিলে বলল তিনকড়ি।
'তা গাড়িটা কই?'
'সাহেবের কাছে।'
'তাই নাকি? তা কবে ফিরলে তুমি?'
'গত মাসের সাতাশ আঠাশ তারিখ হবে।'
' তারপর আর ওনার কোন খবর পেয়েছ? বা ফোনে কথা হয়েছে?'
'না স্যার।'
'তাহলে তুমি কি করে জানলে যে উনি ওখানে শুটিং করছেন?' কড়া ভাবে বলেন রাঘববাবু।
'আমি না স্যার। মেমসাহেবই তো বললেন, উনি শুটিংয়ের কাজে ব্যস্ত আছেন। তাই..'
'আর তুমি? তুমি কিছু জানতে না?' ড্রাইভারকে ধমকান রাঘববাবু।
'আমি তো রোজই হাজিরাতে আসি হুজুর। সাহেব নেই বলে কিছুক্ষণ বসে থাকি। তারপর মেমসাহেব বলেন চলে যেতে, তাই বাড়ি চলে যাই।'
'আর সাহেবের গাড়ি যে এয়ারপোর্টের পার্কিং লটে পড়ে আছে সেটা জানতে না?'
'সে কি? গাড়ি নিয়ে সাহেব কলকাতা চলে এসেছেন? আমি জানতাম না তো। মেমসাহেবও তো বলেননি।'
'ন্যাকামি হচ্ছে? ঠিক করে বল, তোমার সাহেব এখন কোথায়?'
'জানি না স্যার। বিশ্বাস করুন।'
'দার্জিলিঙে আর কে কে ছিল তোমাদের সঙ্গে?'
'আর কেউ না স্যার।'
'সাহেবের গাড়ির অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল, সেটা জান?'
'কই জানি না তো?' হাঁকপাঁক করে উঠল তিনকড়ি।
'গাড়ি এখানে আর তোমার সাহেব দার্জিলিঙে শুটিং করছেন! যতসব গাঁজাখুরি বলতে এসেছ?', ধমকে উঠলেন রাঘববাবু।
'বিশ্বাস করুন স্যার।আমি কিচ্ছু জানি না, সত্যি বলছি।'
'আচ্ছা তোমার সাহেবের সঙ্গে মেমসাহেবের ফোনে কথাবার্তা হয়?'
'জানি না স্যার। তবে মেমসাহেব বললেন, সাহেব দার্জিলিংয়েই রয়েছেন। আমিও সেটাই বিশ্বাস করলাম।'
'ও তাই বুঝি? তা মেমসাহেবকেই বা ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না কেন? উনি কোথায় আছেন?'
'আজ্ঞে বাড়িতেই আছেন। লেক গার্ডেন্সে।'
আবার মিসেস চ্যাটার্জিকে ফোন লাগানো হল, কিন্তু এবারেও সুইচড অফ। 'নাঃ, বেরোতেই হবে দেখছি', বলে রাঘববাবু তিনকড়িকে গাড়িতে উঠতে বললেন। সৌরনীলকেও সঙ্গে যেতে অনুরোধ করলেন, ফেরার পথে ওর বাড়িতে নামিয়ে দেবেন। দুজন পুলিশ কনস্টেবলকেও তিনকড়ির ওপর নজর রাখার জন্য নিয়ে নেওয়া হয়। যেতে যেতেই রাঘববাবু ফোন করলেন দার্জিলিং থানার ওসি তাপস অধিকারীকে। উনি কনফার্ম করলেন যে ওখানে কোন শুটিং হচ্ছে না, আর ফিল্মস্টার অনিরুদ্ধ চ্যাটার্জীও ওখানে নেই। কলকাতা ফিরে গেছেন বেশ কিছুদিন আগে। রাঘববাবুর কপালে ভাঁজটা গভীর হল। পাশে বসা সৌরনীলকেও কথাটা ফিসফিস করে বললেন। সৌরনীলও বেশ অবাক হল। অনিরুদ্ধ চ্যাটার্জী যদি গাড়ি নিয়ে কলকাতা ফিরলেনই, তাহলে নিজের বাড়ি গেলেন না কেন? তিনকড়িকেই বা আগেভাগে ট্রেনে করে ফেরত পাঠিয়ে দিলেন কেন! আর তারপর গাড়িটা এয়ারপোর্টের পার্কিং লটে রেখে, নিজে বেপাত্তাই বা হয়ে গেলেন কেন? ওনার কোন বিপদ আপদ হয়নি তো? অ্যাক্সিডেন্টের ধাক্কা তো সামলে নিয়েছিলেন বলেই মনে হচ্ছে। কোন চোট লাগার চিহ্ন পর্যন্ত নেই গাড়ির ভেতরে, এয়ারব্যাগও খুলেছিল ঠিকঠাক। তারপর এতটা চালিয়ে নিয়ে চলেও এলেন। তবু ঘটনাগুলোর কোন থই পাওয়া যাচ্ছে না।
আর একটা বিষয় ভাববার। মিসেস চ্যাটার্জীই বা এতদিন ধরে কেন মিথ্যে বলেছিলেন, যে উনি দার্জিলিঙে শুটিং করছেন? কেনই বা উনি গোপন রাখছিলেন অনিরুদ্ধবাবুর রহস্যজনক অন্তর্ধান? ব্যাপারটা বেশ গোলমেলে।
লেক গার্ডেন্সের অভিজাত ফ্ল্যাট বাড়িটায় পৌঁছে, সৌরনীল আর রাঘববাবু তড়িঘড়ি উঠে গেলেন সাততলায়। দরজা নক করতে কাজের একটা মেয়ে দরজা খুলল। পাশে আরও একটা কাজের মেয়ে দাঁড়িয়ে। পুলিশ দেখেই ওরা ভয়ে দরজা ছেড়ে দিল। 'মিসেস চ্যাটার্জী কোথায়?', রাঘববাবু বলতে মেয়েটা একটু ঘাবড়ে গিয়ে বলল, 'মেমসাহেব ঘুমোচ্ছেন, ওনার শরীর খারাপ।'
'কি হয়েছে?'
'জানি না।'
'ডাক্তার দেখিয়েছিলে?'
'হ্যাঁ', বলে ডেস্কের উপর থেকে একটা প্রেসক্রিপশন নিয়ে ওনার হাতে দেয়। রাঘববাবু দেখলেন, সাইকোলজিস্ট ডঃ অসীম রায়ের প্রেসক্রিপশন, কলকাতার নামজাদা ডাক্তার। দেখা গেল, কিছু ঘুমের ওষুধ লিখে গেছেন। আরও অন্য কিছু নার্ভের ওষুধ।
'ম্যাডাম দিনে কতক্ষণ ঘুমোন?'
'এই চোদ্দো পনেরো ঘন্টা মত।'
'এখন কখন শুয়েছেন?'
'এই তো জলখাবার খেয়ে, ওষুধ খেয়ে শুলেন। এক ঘন্টাও হয়নি।'
'ও ঠিক আছে ,পরে ওনাকে ইন্টারোগেট করব। তোরা দুজন এখানে বোস।',বলে সোফাটা দেখিয়ে দেন।
ওদিকে সৌরনীল ততক্ষণে সব ঘুরেফিরে দেখে নিচ্ছে। বিশাল সাজানো ফ্ল্যাট, সবদিকে বৈভবের ছাপ সুস্পষ্ট। দুজন কাজের লোকই সব সামলায় বোঝা গেল।
রাঘববাবু জিজ্ঞাসা করলেন, 'তোদের সাহেব কোথায় জানিস কিছু?'
দুজন কাজের লোক একে অপরের দিকে মুখ চাওয়াচাওয়ি করে বলল, 'না স্যার, আমরা কিছুই জানিনা। মেমসাহেব বললেন সাহেব দার্জিলিংয়ে শুটিং করছেন।'
'সাহেব ফোন করতেন?'
'জানিনা, মেম সাহেব জানেন।'
'দার্জিলিং কবে গেছিলেন সাহেব?'
'গত মাসে।'
'আর কে গেছিলেন সঙ্গে?'
'আর কেউ না, সাহেব একাই নিজের গাড়িতে গেছিলেন।'
'ড্রাইভার কে ছিল, তিনকড়ি?'
'হ্যাঁ', দুজনে মাথা নেড়ে কাঠের পুতুলের মত বলে যাচ্ছিল। বোঝাই যাচ্ছে, শেখানো বুলি আওড়াচ্ছে।
'সাহেব কবে ফিরলেন কলকাতা?', ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করলেন রাঘববাবু।
'আজ্ঞে সাহেব তো এখনো ফেরেননি।'
'তাই নাকি? চল, তোদের থানায় নিয়ে যাচ্ছি।'
মেয়ে দুটো কেঁদেকেটে বলল, 'এর বেশি কিছু জানি না স্যার। আমাদের ছেড়ে দিন।'
'তোদের ব্যবস্থা পরে করছি।', বলে রাঘববাবু বেরিয়ে এলেন ঘর থেকে। সৌরনীল বলল,'চলুন রাঘবদা, ঘরগুলো আরো একটু ভাল করে দেখি।' সৌরনীল ঘুরেফিরে সব দেখতে লাগল। পুরনো কাগজ, ম্যাগাজিন রাখার তাকগুলো ঘেঁটে কি সব দেখল। জুতোর তাক দেখল, ফ্রিজ খুলে দেখল, বইপত্র, নোটপ্যাড, ওষুধের স্ট্রিপ এমনকি অনিরুদ্ধবাবুর আলমারি পর্যন্ত ঘেঁটে দেখল। তারপর চলে গেল ম্যাডামের বেডরুমে। পর্দা সরিয়ে বাইরে থেকে দেখল, ম্যাডাম খাটের এককোনে চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছেন। ঘর অন্ধকার, ফুলস্পিডে এসি চলছে। সৌরনীল মেয়েদুটোকে বলল ঘরের আলো জ্বেলে, এসি নিভিয়ে দিতে আর দরজা জানালা সব খুলে দিতে। ঘরটা একটু আলোকিত হয়ে স্বাভাবিক হলে, সৌরনীল ওদের ম্যাডামকে ডাকতে বলল। অনেক কষ্টে ম্যাডামকে ডেকে তোলা গেল। অত্যন্ত সুন্দরী মহিলা, কিন্তু চোখের তলায় চিন্তায় কালি পড়েছে। ঘুম চোখে উঠে উনি মেয়েদুটোকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করতে লাগলেন। তারপর পুলিশ দেখে একটু থমকে গিয়ে জড়োসড়ো হয়ে বসে রইলেন। 'নমস্কার মিসেস চ্যাটার্জী, আমরা এয়ারপোর্ট থানা থেকে আসছি, মিস্টার অনিরুদ্ধ চ্যাটার্জীর নিখোঁজ হবার তদন্ত করতে। একটু ঘরে ঢুকতে পারি?', সৌরনীল বলল। মিসেস চ্যাটার্জীর মুখের পেশিগুলো একটু যেন কেঁপে উঠল, একটু ধাতস্থ হয়ে বসে উনি বললেন, 'অনিরুদ্ধ নিখোঁজ কে বলেছে আপনাদের?' 'তাহলে উনি কোথায়? আপনি বলুন।', সৌরনীল বলল। 'উনি তো শুটিংয়ের কাজে দার্জিলিংয়ে আছেন', আবার সেই ভাঙা রেকর্ড বাজালেন ম্যাডাম।
'আর কত মিথ্যে বলবেন? আমরা খবর নিয়ে জেনেছি, উনি দার্জিলিং ছেড়ে গত মাসেই কলকাতা চলে এসেছেন। আপনি জানেন না?'
ভদ্রমহিলা একটু যেন চমকে উঠলেন। বললেন, 'না তো! আমাকে যে ফোনে বলল, ও দার্জিলিংয়েই আছে।'
'কবে কথা হয়েছিল আপনার সঙ্গে?'
'রোজই তো হয়। গতকালও হয়েছিল।'
'কই, দেখি আপনার ফোনটা।'
ম্যাডাম বালিশের পাশে থেকে বাধ্য হয়ে মোবাইলটা বের করে অন করে, লক খুলে, ওদের হাতে দিলেন।
'এ কি? এ তো দেখছি গত মাসের কুড়ি তারিখের পর থেকে কোন কল রেকর্ডসই নেই। কেন জানতে পারি?'
'আমি জানি না। আমার কিছু মনে থাকে না।', ম্যাডাম দিশাহারা হয়ে হিস্টিরিয়া গ্রস্থের মতো আচরণ করতে থাকলেন।
'তাহলে বললেন যে, উনি গতকালই ফোন করেছেন?', সৌরনীল ছাড়বার পাত্র নয়।
'আমি কিছু জানিনা, আমার শরীর খারাপ। আমাকে ছেড়ে দিন।', ভদ্রমহিলা পাগলের মত করতে লাগলেন। সৌরনীল এসব অভিনয় অনেক দেখেছে।বলল, 'আপনি ডাক্তার দেখিয়েছেন?'
'হ্যাঁ, ওনার ওষুধ খেয়েই তো ঘুমাচ্ছিলাম।'
'মিস্টার চ্যাটার্জী দার্জিলিং থেকে কবে কলকাতা ফিরলেন?'
'আমি জানি না।', এবার রেগে উঠে বললেন মহিলা। সৌরনীল বুঝল এ বড় কঠিন ঠাঁই। সঙ্গে মহিলা পুলিশও নেই, জোর করার উপায় নেই। কোনো প্রমাণও নেই ওনার বিরুদ্ধে, খালি একটা সন্দেহ। তার ওপর এরকম সাইকোলজিক্যাল পেশেন্ট। যখন-তখন পাগল সাজবে। বড় সেয়ানা মহিলা। এখন আর কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করে কোন লাভ হবেনা। তবু বলল, 'মিঃ চ্যাটার্জীর আর কোন নাম্বার আছে?'
'না'
'ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ করতেন?'
'ফেসবুক প্রোফাইল আছে একটা', গম্ভীরভাবে বললেন ভদ্রমহিলা।
'উনি যে এখন কলকাতায়, তা জানেন?'
'না তো। ওর গাড়ি কোথায়, ও কোথায়, আমি কিচ্ছু জানি না। বললাম তো, আমার কিছুই মনে থাকেনা। ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমাই। আমাকে ছেড়ে দিন প্লিজ।', শেষ কথাগুলো এত মিষ্টি করে বললেন ভদ্রমহিলা, যে সৌরনীল আর কোন কিছুই বলতে পারল না। কিন্তু নিজের থেকে উনি গাড়ির কথা তুললেন কেন! সন্দেহটা নিয়েই বাধ্য হয়ে, ওরা উঠে ঘরের বাইরে বেরিয়ে এল। সৌরনীল রাঘববাবুকে বাইরে এসে চুপিচুপি বলল, 'রাঘবদা, আপনি এদিকটা দেখুন। আমি কালই একবার দার্জিলিং রওনা হয়ে যাই। আমার মনে হচ্ছে রহস্যের সূত্র ওখানেই রয়েছে। ওখানকার লোকাল থানায় একটু বলে দেবেন। অ্যাক্সিডেন্টের স্পটটাও দেখতে হবে। তাছাড়া উনি কোথায় কোথায় গেছিলেন, কি করেছিলেন, সাতাশে মার্চ তিনকড়িকে ট্রেনে চাপিয়ে দিয়ে তারপর কি করলেন, সব আমাকে পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসন্ধান করতে হবে। না হলে অনিরুদ্ধ চ্যাটার্জীর অন্তর্ধান রহস্যের কিনারা কিছুতেই করা যাবে না। কেসটার আগাপাশতলা কিচ্ছু বোঝা যাচ্ছে না।'
'ঠিক বলেছ সৌরনীল, বিদঘুটে কেস। তাহলে তাই কর, আমি ওখানকার ওসি তাপসদাকে সব বলে দিচ্ছি, কোন অসুবিধা হবে না। তুমি কালই চলে যাও।'
'কিন্তু এখানকার ব্যাপারটা? আমার মনে হচ্ছে ড্রাইভার তিনকড়ি আর কাজের মেয়েদুটো কেউ সত্যি কথা বলছে না। ওদের থানায় ডেকে আরো ইন্টারোগেট করতে থাকুন, নজর রাখুন। পালাতে যেন না পারে।'
'সে নয় হল। কিন্তু তুমি কি করে বুঝলে যে ওরা মিথ্যে বলছে?'
'পুরনো কাগজ রাখার তাকটা ভাল করে দেখে বুঝলাম, মার্চের কুড়ি থেকে সাতাশ কেউ এ বাড়িতে কাগজগুলো খুলেও দেখেনি। অনিরুদ্ধ চ্যাটার্জী না হয় ছিলেন না, কিন্তু মিসেস চ্যাটার্জী সে সময় কি করছিলেন, যে কাগজ পড়ারও সময় পাননি? অথচ তার পরের কাগজ গুলো সব পড়া বোঝা যাচ্ছে। আমার মনে হয় উনিও একই সঙ্গে দার্জিলিং গেছিলেন।আজ আমাদের দেখে ভালই অ্যাক্টিং করলেন।'
'তাহলে মিসেস চ্যাটার্জীকে আরেকবার বাজিয়ে দেখলেই হয়।'
'এখন না। এখন ওনাকে বিরক্ত করার দরকার নেই, তবে নজরে রাখুন। আর ওর মোবাইলের কল রেকর্ডস আর টাওয়ার লোকেশনগুলো আমাকে দেবেন।', বলে সৌরনীল বেরিয়ে লিফটের দিকে এগিয়ে গেল।
(এরপর রহস্যের ঘনঘটা জানতে পুরো গল্পটা পড়তে হবে)
Subscribe to:
Posts (Atom)