(১)
-কি রে কোকো মন খারাপ করে বসে আছিস কেন?
'আরে বড় মামা তুমি? কখন এলে?', তড়াক করে লাফিয়ে ওঠে কোকো।
-কালই ফিরলাম চীন থেকে। কিন্তু তুই তো বললি না।মন খারাপ কেন রে?
- আর বোলো না, বাবা-মা খুব এক চোট বকল সকালবেলায়। অথচ আমার দোষই নয়।
- কেন রে কি করেছিলি?
- আরে বাবা দাড়ি কামানোর আয়নাটা, বাথরুমে এমন ভাবে ঝুলিয়ে রেখে চলে গেছে, কি বলব। আমি ঘুম চোখে দাঁত মাজতে যেতে, কিভাবে যেন হাত লেগে পড়ে ভেঙে গেল।
- ও এই ব্যাপার! সক্কাল সক্কাল আয়না ভেঙেছিস! এঃ হে , বাজে ব্যাপার করে ফেলেছিস।
- বাজে ব্যাপার কেন বলছ বড়মামা? মাত্র শ’খানেক টাকা তো দাম!
- আরে সেজন্য নয় রে। জানিস না, রোমে একটা পুরোনো কুসংস্কার আছে। আয়না ভাঙলে নাকি তার সাত বছরের জন্য ব্যাডলাক আসবে আর তা থেকে মুক্তি পেতে গেলে, সবকটা ভাঙা টুকরো কুড়িয়ে জড়ো করে, চাঁদের আলোয় উঁচু কোন গাছের নীচে পুঁতে দিতে হবে।
- তাই নাকি? কিন্তু মা যে সব টুকরোগুলো ঝাঁট দিয়ে ডাস্টবিনে ফেলে দিল, কি হবে এখন?
- আরে ধুর, তুইও না।
হা হা করে হেসে ফেলেন দীপাঞ্জনবাবু । ইতিহাসের প্রফেসর হিসেবে প্রেসিডেন্সি থেকে ভলান্টারি রিটায়ার ক'রে, যিনি এখন দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়ান নানা রিসার্চ ওয়ার্কে। আর্কিওলজি ওর নেশা। বিয়ে থা করেননি ,ঝাড়া হাত পা মানুষ। পঁচ্চান্ন বছরের এক তরতাজা যুবক যেন।
-সেরকম ভয় পেলে তো বাড়ি থেকে আয়নার পাটই চুকিয়ে দিতে হয় রে। সেকালে রোমান বড়লোকরা যেমন করত । বাড়িতে পুল বানিয়ে তার স্বচ্ছ জলে মুখ দেখত, বাড়িতে ভয়ে আয়নাই রাখত না । ওদের বিশ্বাস ছিল আয়নায় যে মুখ দেখা যায়, সেটা আসলে নিজের আত্মারই অংশ। তাই আয়না ভাঙলে আত্মারও ক্ষতি হয়। এমনকি কোন আয়না যদি আপনি আপনি পড়ে ভেঙে যায়, তাহলে সে বাড়িতে কারো মৃত্যু অবধারিত।
-ওরে বাবা, এত জানতাম না তো!
- আরে এসব তো কুসংস্কার।ছাড়। যা বুলিকে গিয়ে বলে আয় তো চা দিতে। সকালে প্লেনের চা টা ঠিক জুত হয়নি।
কোকো ক্লাস ইলেভেনে পড়ে , সাইন্স। স্কুলে বরাবরই ওর ভাল রেজাল্ট ছিল, এখন কলেজেও তার কোন ছেদ পড়েনি। পড়াশোনার চাপ ভীষণ, কলেজ থেকে ফিরে আবার টিউশন। শুধু সন্ধ্যেবেলায় ঘণ্টাখানেকের ছাড়, নিজের মোবাইলে ঐ সময় গেম খেলাটা ওর একটা নেশা। তবে বাবা-মা বলে দিয়েছেন ঘণ্টাখানেকের বেশি যেন ও গেম না খেলে, কিন্তু শুনলে তো!
- বড়মামা, তার মানে আয়না ভাঙলে রোমানরা ভাবত, আত্মারও আঘাত লাগে। কিন্তু আত্মা জুড়ত কি করে?
-ভাল বলেছিস। 'আত্মা জোড়া'। সেজন্যই তো প্রাচীন ভারতবর্ষের আয়নায় এসবের বালাই ছিল না রে।
- কিরকম?
-সিন্ধু সভ্যতায়, মহেঞ্জোদড়ো আর হরপ্পাতে আজ থেকে সাড়ে চার হাজার বছর আগে, ব্রোঞ্জ বা তামার তৈরী ছোট ছোট আয়না ব্যবহার হত, বুঝলি? হাত থেকে পড়ে ভাঙ্গার কোন ভয় নেই, কি বলিস?
- তাই নাকি, মেটালের আয়না?
-হ্যাঁ, তখন তো আর এদেশে কাঁচ আবিষ্কার হয়নি। কাঁচ তো আবিষ্কার হল তারও এক হাজার বছর পরে,মিশরে।
-হ্যা,সেটা আমিও পড়েছি।আর কাঁচের আয়না কবে আবিষ্কার হল গো বড়মামা?
-সে তো অনেক পরে, আঠেরোশো পঁয়ত্রিশ সালে। তার আগে বল, অঙ্ক করতে করতে, পাবজি গেমটা খোলা ছিল কেন রে তোর মোবাইলে? ভাবছিস কিছু বুঝতে পারব না, বড়মামার চোখকে ফাঁকি দিতে পারবি ভেবেছিস?
মিটমিটিয়ে হাসতে লাগলেন বড় মামা। মুচকি হেসে কোকো বলল, ' ঠিক ধরে ফেললে! তুমি কি, গোয়েন্দা নাকি গো ? পাঁপড় ভাজা খাবে তো, মাকে বলে এসেছি।'
বছরে মাত্র দু'বার কয়েক দিনের জন্য পাওয়া যায় বড়মামাকে, বাকি সময়টা দেশ-বিদেশ ঘুরতেই চলে যায়। বড়মামা এলে এ বাড়িতে সবচেয়ে খুশি হয় কোকো।আর মা তো 'দীপু' বলতে অজ্ঞান । কোকো যে পড়াশোনায় বরাবর এত ভাল, সেটা বড়মামাও জানেন। তাই ওকে এত ভালোবাসেন আর নতুন নতুন রিসার্চ ওয়ার্কের কথাও হোয়াটসঅ্যাপে প্রায়ই পাঠান। কোকো অধীর আগ্রহে, সারা বছর ধরে অপেক্ষা করে থাকে, বড়মামা কবে আসবেন। বড়মামা এলে দিনগুলো যেন দ্রুত শেষ হয়ে যায়, তাই কোকো ওনাকে কাছ ছাড়া করতেই চায় না।
একটু বাদেই মা চা নিয়ে এল, সঙ্গে পাঁপড়ভাজা আর কুচো নিমকি।
- হ্যাঁ রে দীপু, এবার ক'দিন থাকবি ইন্ডিয়াতে? একবারও ফোন করলি না তো আসার আগে!
-আরে, জানিয়ে আসলে কি এভাবে সারপ্রাইজ দেওয়া যেত? কোকো কেমন চমকে উঠল আমায় দেখে, সেটাই তো মজা।
- নে , এবার মামা ভাগ্নে হৈচৈ করে বেড়া। এবারে মাসখানেক থেকে যা না রে দীপু। ছেলেটা তো তোকে বেশি পায় না, আমাদেরও কত ভাল লাগে তুই এলে, জানিস তো। এবারে আর আগের বারের মত হুট করে পালাবি না কিন্তু।
- না রে পালাতে তো হবেই। এবার যাব ন্যাজকা লাইন নিয়ে রিসার্চ করতে।
-সেটা আবার কি রে?
'আমি জানি, পেরুর মরুভূমিতে বিশাল বিশাল সব জ্যামিতিক নকশা আর জীবজন্তুর ছবি আঁকা, যা শুধু আকাশ থেকেই বোঝা যায়।' কোকো চেঁচিয়ে বলে। মা চোখ গোল গোল করে তাকিয়ে বলে, 'নাও এবার তোমার তো হয়ে গেল, বড় মামা এসে গেছে। পড়াশোনার বারোটা বাজল বলে। পরে একবার আমার ঘরে আসিস রে দীপু, কথা আছে।', বলে মা চলে গেল।
(২)
বড় মামার সঙ্গে কোকোর মনের এত মিল, যে দুজনে প্রায় বন্ধুই হয়ে গেছে। তাছাড়া রহস্য ও গোয়েন্দা গল্পের প্রতি কোকোর দুর্নিবার আকর্ষণও এর একটা কারণ। বড়মামার কাছ থেকে পাওয়া যায় সত্যিকারের রহস্যের সন্ধান। ইতিহাস,বিজ্ঞান আরো নানা বিষয়ে এত জ্ঞান, আর এত সহজে সব গল্পের মাধ্যমে বুঝিয়ে দেন ।আর সেই সব গল্প শেষ হবার নয় ।
এই তো গতবার পুজোর সময়ে, বড়মামার সঙ্গে বাগবাজার সার্বজনীনের দুর্গাপুজো দেখতে গিয়ে বড়মামা বলল, 'বলতো, এই জায়গাটার নাম বাগবাজার কেন?'
-কেন আবার বাঘটাঘ বেরোত নিশ্চয়ই আগে।
-ধুর বোকা, এই যে এইখানে, যেখানে পুজোটা হচ্ছে, সেখানে আগে কি ছিল জানিস ? ক্যাপ্টেন চার্লস পেরিন সাহেবের বাগান। তিনি ছিলেন জাহাজ বিষয়ে পণ্ডিত। ওনার নিজেরও অবশ্য একটা জাহাজ ছিল, সেপটর বলে। সেই জাহাজে ক'রে পেরিন সাহেব নানা দেশে বাণিজ্য করে বেড়াতেন। তো পেরিন সাহেবের এই বাগান ছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর সাহেবদের শখের সান্ধ্য বেড়াবার জায়গা।
-তারপর? বাঘ কোথা থেকে এল?
-আবার বাঘ ? মারব এক গাঁট্টা । তো আর্থিক দুরবস্থার জন্য সতেরোশো বাহান্ন সালে সাহেবের বাগান নিলামে ওঠে , কলকাতার ম্যাজিস্ট্রেট হলওয়েল মাত্র আড়াই হাজার টাকায় কিনে নিলেন বাগানটা। কিন্তু তিনিও রাখতে পারলেন না বেশিদিন। সতেরোশো পঞ্চান্ন সালে ফোর্ট উইলিয়ামের সেনাধ্যক্ষ ফ্রেডরিক স্কট পঁচিশ হাজার টাকায় কিনে নিলেন বাগানটা। তারপর সেখানে একটা গান পাউডারের কারখানা চালু করলেন। এই যে বাগবাজার স্ট্রীট দিয়ে এলি, এর নাম তখন কি ছিল জানিস? 'গান পাউডার ফ্যাক্টরি রোড'। সিরাজের কলকাতা আক্রমণের সময় এই বাগানে বসানো হয়েছিল কামান, নবাবের আক্রমণ প্রতিহত করতে বেশকিছু সৈন্যও ঘাঁটি গেড়েছিল এখানে । তাদের জন্যই এখানে বসল বাজার ।আর বাগান বা বাগ থেকে এই বাজারটার নাম হয়েছিল বাগবাজার। বুঝলি ব্যাটা?
' এইবারে বুঝলাম', দেঁতো হাসি হেসে বলল কোকো।
-এবার বাগবাজারের আসলি জায়গায় যাব। রসগোল্লার স্রষ্টা নবীন ময়রার বাড়িও এখানে ছিল, সেটা জানতিস ?
-না তো! নবীন চন্দ্র দাসের রসগোল্লা ?
-তা নয় তো আর কি? চল চল, খিদে পেয়েছে।
এই হল বড় মামা। ঘুরতে ফিরতে কত কি গল্পচ্ছলে বলে চলেন,নতুন নতুন কত কি জানা হয়ে যায় । দোষের মধ্যে, বড় মামা মাঝে মধ্যে বিড়ি খান ।বলেন, 'বিড়ির ওপর কিছু নেই, বুঝলি? সারা পৃথিবী ঘুরলাম, কত সিগারেট- চুরুট-পাইপ- হুঁকো টানলাম, কিন্তু বিড়ি ইজ দ্যা বেস্ট।যা তো একটা দেশলাই নিয়ে আয় দেখি।' কোকো ছুটে রান্নাঘর থেকে দেশলাই এনে দিল। বড়মামা বললেন, 'এই যে দেশলাই, এর আবিষ্কারক কে জানিস?' কোকো যথারীতি চুপ।
-জন ওয়াকার। ভদ্রলোক সেই যুগে কত বড় মনের মানুষ ছিলেন, ভাব। জনসাধারণের খুব কাজে লাগবে, সেই বিশ্বাসে উনি দেশলাইয়ের কোন পেটেন্ট পর্যন্ত নেননি। অবশ্য নিলেও ভুবনমোহন নিয়োগীর কিছু যায় আসত না।
-ভুবনমোহন নিয়োগী আবার কে গো? জন ওয়াকারের রাইভাল?
-না রে! সে ছিল কলকাতার এক বনেদি বাবু। দশ টাকার নোট জ্বালিয়ে সিগারেট ধরাত। এক ধুতি দু'দিন পড়ত না । তাও আবার পাড় ছিঁড়ে পড়ত, যাতে কোমরে না লাগে। রোজ সারা বাড়ি, আদ্যোপান্ত গোলাপ জল দিয়ে ধোয়াতো।
কোকো হাঁ করে চেয়ে থাকে।
(৩)
বড় মামা মৌজ করে পাঁপড়ভাজা আর কুচো নিমকি চিবোচ্ছিলেন। মা ডাক দিয়ে গেছেন পার্সোনাল টকের জন্য। কোকো ঠিক করল বড়মামা নীচে যাবার আগেই, জিনিসটা ক্লিয়ার করে নিতে হবে। বড়মামার পাশে বসে ও বলল, 'তুমি যে গতবার চিলি না কোথায়, কিসব এক্সক্যাভেশনের কাজে যাবে বলেছিলে, সেটার কি হল, বললে না তো?'
-চিলি নয় তো! তার থেকে একটু দূরে, ইস্টার আইল্যান্ডে। মোয়াইগুলো তো ওখানেই খুঁড়ে বের করা হচ্ছিল।
-মোয়াই? সেটা আবার কি?
-দাঁড়া দাঁড়া, একদিনেই সব শুনতে চাইছিস?
বলতেই হঠাৎ লোডশেডিং হয়ে গেল।কোকো বলে উঠল, 'যাঃ,গেল।ব্যাস, নাও এবার।পাক্কা দু'ঘন্টা।আজকাল একটা ফেজ খুব যাচ্ছে,সকালের দিকে।'
-কি আর করবি,বল। টেসলার বাক্সগুলো পাওয়া গেলে অবশ্য এরকম আর কারেন্ট যেত না রে।
গল্পের গন্ধে কোকো চেপে ধরল, 'কেন গো, টেসলার সঙ্গে লোডশেডিং-এর কি সম্পর্ক? বল না।'
-জানিস না? ওয়্যারলেস বিদ্যুৎ আবিষ্কার করেছিল যে। কিন্তু ফান্ডের অভাবে কমপ্লিট করতে পারল না। তার ওপর,উনি মারা যাবার পরে ওর রিসার্চ ওয়ার্কের কুড়িটা বাক্সও কে ঝেড়ে দেয় । সেখানেই সম্ভবত ছিল তার ছাড়া বিদ্যুৎ পাঠানোর উপায়। আর যদি সেটা সম্ভব হত, সারা পৃথিবীর যেকোন জায়গা থেকে যেকোনো জায়গায় আজ বিদ্যুৎ পাঠাতে কোন অসুবিধেই হত না ।
'আর লোডশেডিংও হত না।', কোকো চেঁচিয়ে বলে ওঠে।বড় মামা হেসে বললেন, 'ছাড় ওসব। এবারে দিলখুশার চিকেন কবিরাজিটা কিন্তু খেতেই হবে, আজ বিকেলেই যাব। আর একটা গোপন ব্যাপার আছে, ওখানেই সব বলব। তার আগে বুলি কি বলছে শুনে আসি।'
বড়মামা উঠে পড়লেন। অগত্যা আবার পড়ার বই নিয়ে বসে পড়ল কোকো। বিকেলের অ্যাডভেঞ্চারে যেতে বাবা-মার পারমিশন পেতে গেলে, টাস্কগুলো সব শেষ করে রাখা দরকার। তছাড়া কলেজ যাবারও সময় হয়ে এল।
(৪)
দিলখুশার চিকেন কবিরাজিটা কাঁটা চামচ দিয়ে, পাক্কা সাহেবি কায়দায় কেটে, এক টুকরো মুখে পুরেই, বড় মামা 'হু হু' করে উঠলেন।
- কি হল গো, খুব গরম নাকি?
-আরে না না, গরম হবে কেন? এতদিন চীনেদের শুধু চাউমিন আর আধকাঁচা মাংস খেয়ে খেয়ে ,পেটে একেবারে চড়া পড়ে গেছিল রে। কতদিন যে এরকম খাইনি। আহা, কি টেস্ট ! অবশ্য দুপুরে তোর মার হাতের , মাছের মাথা দিয়ে পুঁইশাক, আলু-পোস্ত আর কচি পাঁঠার ঝোলটা ভালই খেলাম, বেড়ে বানিয়েছিল। তবে দিলখুশার চিকেন কবিরাজির জন্য চীন থেকে চলে এসে ঠিকই করেছি,কি বল। মনটা একেবারে হু হু করছিল।
-কি যে বল চীনের কাজ শেষ হয়েছে তো? তোমার কি যেন প্রোজেক্ট ছিল ওখানে? আলোর প্রতিবিম্ব নিয়ে, লিখেছিলে না?
- হ্যাঁ রে বাবা। তার আগে দিলখুশার এই বিখ্যাত আয়নাটা ভাল করে দেখ, দেওয়াল জোড়া। খাঁটি বেলজিয়াম গ্লাস, দুশো বছরের পুরোনো। এখন তো বিকেল সাড়ে চারটে বাজে।দেখ, আয়নার ওপর সূর্যের আলোটা প'ড়ে, রিফ্লেক্ট করে ওদিকের দেওয়ালে কিভাবে পড়েছে। দেখতে পাচ্ছিস?
- হ্যাঁ, পড়ন্ত রোদ আয়নায় ছিটকে দেওয়ালে চৌকো চৌকো শেপ তৈরি করেছে। এতে অদ্ভুতের কি আছে?
- আছে রে আছে।চীনের 'টু কুয়ান চিং' আয়না না দেখলে,তুই সেটা বুঝতে পারবি না।
- কিরকম?
- শোন তাহলে, তুই যে আজ সকালে আয়নাটা ভাঙবি, সেটা আমি আগেই জানতাম।
- মানে?
- মানে আমি যে মুহূর্তে ইন্ডিয়ায় পা রাখলাম, সেই সময় থেকেই টু কুয়ান চিং- এর অভিশাপ আমাকে ফলো করে তোদের বাড়ি অব্দি চলে এসেছে ।
-কি বলছ, কিছুই বুঝতে পারছি না। টু কুয়ান চিং-ই বা কি ?
-আরে ওই জন্যই তো চীনে যাওয়া। প্রাচীন জাদু আয়নার খবরটা গতবছরেই পেয়েছিলাম আমেরিকান অ্যান্টিকুইটির জার্নালে। আয়নাটায় নাকি একটা অদ্ভুত রহস্যময় ঘটনা ঘটে, ঠিক বিকেল চারটের সময় ।আয়নায় সূর্যের আলো প'ড়ে রিফ্লেক্ট করে উল্টোদিকের একটা দেওয়ালে পড়ে, আর সেখানে রহস্যময় কি সব লেখা ফুটে ওঠে। যেটা আজ অব্দি কেউ প'ড়ে উঠতে পারেনি। ওরা ভেবেছিল আয়নার ভেতরের কোন নকশা ফুটে উঠছে, কিন্তু সেটা নয়। ওটা যে শুদ্ধ দেবনাগরী লিপি, সেটা আমি না গেলে ওরা জানতেই পারত না।
- তুমি বের করলে? বলো না কি লেখা ছিল ওখানে?
- বলছি বলছি, আরেকটা কাটলেট খাবি নাকি?
-না না ,আর পারব না, পেট আইঢাই করছে।
- এই হল তোদের নিয়ে মুশকিল। আমার তো বাবা তোর মত অত পুঁচকে পেট নয়। তিন মাস ঠিকমত খেতে পারিনি রে। দিল্লি এয়ারপোর্টে নেমে ভাবলাম, বেরিয়ে গিয়ে, সি আর পার্কের বিরিয়ানীটা খেয়ে আসি। কিন্তু সে আর হল না, আর তাছাড়া অত সকালে বিরিয়ানীই বা কে বানাবে! কপালটাই খারাপ। কলকাতার কানেক্টিং ফ্লাইট ধরার লাইনে গিয়ে দাঁড়াতে হল, মাত্র আধঘন্টা হাতে ছিল যে।
-এঃ হে, চীনে তোমার খুব খাওয়া দাওয়ার অসুবিধে হয়েছে তাহলে বল।
- সে আর বলতে।আচ্ছা চল, বরং ফেরার সময় একবার মিত্রকাফেতে ঢুঁ মেরে আসব, ফাউল কাটলেটটা এখনো আগের মতই বানায়। দেরি করলে কিন্তু শেষ হয়ে যাবে। নাকি গোলবাড়ির কষা মাংস খাবি? সে অবশ্য এখনো দেরি আছে। চাচার হোটেলটা অবশ্য খোলা, মাটন কাবাবটা চেখে দেখব নাকি?
-ওফ্ । তোমার খালি খাই খাই। এবার খাওয়ার কথাটা বন্ধ করে, চীনের আয়নার কথাটা বলবে?
- ও, আচ্ছা, আচ্ছা।যা হোক, ওরা তো কেউ পড়তে পারল না লেখাটা, তখন আমাকে ডাকল। আসলে আয়নাটার কাঁচের পিছনে, দেবনাগরীতে গোলাকারে লেখাটা লিখেছিল। মন্ডুকা উপনিষদের মন্ত্র।অথচ বৌদ্ধদেরও মূলমন্ত্র। আমি গিয়েই পড়ে দিলাম।
- কি করে?
- কি করে আবার? আয়নায় রিফ্লেক্ট হয়ে লেখাটা উল্টো হয়ে পড়ছিল ।আমি তার উপর আরেকটা আয়না ধরে প্রতিবিম্বটাকে আবার সোজা করে ফেললাম ,আর তখন সেটা বেশ পড়া গেল।
-কি লেখা ছিল শুনি?
-ওঁ মণিপদ্মে হূঁ ।
- তার মানে?
- মানে হল, জ্ঞান একত্রিত করার অভ্যাসে অপবিত্র শরীর ও মনকে বিশুদ্ধ আলোকোজ্জ্বল রূপে পরিবর্তিত করা যায়।
- কিন্তু টু কুয়াং চিং-এর অভিশাপটা কি বললে না তো?
বড়মামা ঠোঁটে আঙুল চেপে বলল, 'চুপ,এখানে নয়।'
কলেজস্ট্রীট থেকে বাড়ি ফিরে, বড়মামা নিজের ঘরে গিয়ে, ব্যাগ খুলে একটা জার্নাল বার করে দিল কোকোকে। 'রেখে দে, পরে পড়িস। মোয়াই কি জানতে পারবি। তবে আগে, নিজের কলেজের পড়াশোনাগুলো ঠিকঠাক করবি, নইলে আর 'ওঁ মণিপদ্মে হূঁ' হতে হচ্ছে না।
(৫)
রাতে ডিনারের টেবিলে কোকো দেখে, বাবা মা আর বড়মামার মধ্যে দারুন আড্ডা জমেছে । ইস্ , আফসোস করে কোকো। থাকা হল না, কত কিছু শোনা হল না । কোকো যেতেই বাবা হেসে বললেন, 'এইতো কোকো এসে গেছে । বোস বোস,দীপুদা কি বলছে, শোন।'
'কাল তোর কলেজ আছে নাকি রে?', বড়মামা জিজ্ঞেস করলেন।
- কাল? কাল তো বিশ্বকর্মা পুজো।
- আর কোচিং?
- সে তো সন্ধ্যেবেলা। কেন বল তো?
-কাল তোতে আমাতে একবার মিউজিয়াম থেকে ঘুরে আসব ভাবছি। অরিজিৎ অনেকদিন ধরে বলছে।
- অরিজিৎ কে?
- আরে আমারই স্টুডেন্ট ছিল, অরিজিৎ বসু। মিউজিয়ামের ডাইরেক্টর।
-ওরেব্বাস্ ,দারুন হবে। কাল মিউজিয়ামে যাব আমি তোমার সঙ্গে।
'দাঁড়া, এত লাফাস না। চারটের মধ্যে ফিরতে হবে কিন্তু। পাঁচটায় তোর পড়া না?', বাবা বললেন। 'হ্যাঁ হ্যাঁ, ঠিক আছে।', কোকো ঘাড় নেড়ে বলে।
বাবা-মা মৃদু হাসেন। প্রশ্রয় ওদেরও আছে। আসলে ছেলেটা কলেজ-বাড়ি-কোচিং আর মোবাইলে আটকা পড়ে থাকুক,সেটা ওরাও চান না।বড়মামা এলেই ওর এই যে নানা বিষয়ে ইন্টারেস্ট জেগে ওঠে, দুজনে নানা বিষয়ে আলোচনা ক'রে অনেক কিছু নতুন শিখতে পারে, এটা তো ওরাও চান। জীবনে এসবেরও দরকার আছে, শুধু কারিকুলামের পড়ার বাইরেও জানা দরকার। দুনিয়াতে কত কিছু ঘটে যাচ্ছে, সেসবের পাঠ কোকো যে বড়মামার থেকেই পায়, সেটা ওরা জানেন।
- কাল আমরা কি দেখতে যাব মিউজিয়ামে?
-মহেঞ্জোদড়োর আয়না।
-ঐ তখন যেটা বলছিলে? মেটালের, পড়ে ভাঙবে না?
হা হা করে ঘরশুদ্ধু সবাই হেসে ওঠে।
(৬)
- ডিমের অমলেট করে দাওনা মা।
- না আজ ডিম খাবি না। আজ শুধু রুটি তরকারি।
- কেন? একটা ডিম খেলে কি হবে?
- না বলেছি না। রোজ এত ডিম খাওয়া ভাল নয়।
মাঝেমধ্যেই খাওয়া-দাওয়া নিয়ে কোকোর সঙ্গে মার এরকম তর্কাতর্কি লাগে। কোকোর বায়না আর মার বকুনি। 'কিরে, কি নিয়ে ঝামেলা হচ্ছে, শুনি?', বড়মামা চা খেতে খেতে এসে ঢুকলেন।
- দেখোনা, ব্রেকফাস্টে মা কিছুতেই ডিম দিতে চাইছে না।
- সে কি রে? ডিম খেতে দিচ্ছিস না? নরওয়ের রাজা জানলে, যে তোর ফাঁসি হয়ে যেত রে বুলি।
'কেন গো বড়মামা? কি হয়েছিল নরওয়েতে?', গল্পের গন্ধে উৎসাহ ঝরে পড়ে কোকোর গলায়।
- শোন তবে। একবার বহু বছর আগে, ওই বংশের কোন এক রাজার শরীর ভাল ছিল না, খাওয়ায় রুচি নেই। হেড শেফকে বললেন, 'একটা সিদ্ধ ডিম দাও।' কিন্তু কপাল খারাপ, সারা রাজবাড়ি তন্ন তন্ন ক'রে খুঁজেও, কোথাও ডিম পাওয়া গেল না। বাজারে চাকর-বাকরদের পাঠানো হল। তখন সব দোকান টোকানও বন্ধ হয়ে গিয়েছে। রাজার আর ডিমসিদ্ধ খাওয়া হল না।
-রাজা ভীষণ রেগে গেল নিশ্চয়ই।
-শোন না, সেইদিন থেকে হুকুম হল, প্রত্যেকদিন একটা করে সিদ্ধ ডিম যেন রাজার খাবার সময় হাজির থাকে। সেই নিয়ম আজও চলছে ।এখনকার রাজা হয়ত ডিমসেদ্ধ তেমন ভালবাসেন না, হয়ত রোজ খানও না, তবু তার খাবার তালিকায় ডিমসিদ্ধ থাকবেই।
'ও বাবা, ডিম নিয়ে এত!', হেসে বলে কোকো। মাও হেসে ফেলে বলেন,'নাও,খাও এবার ওমলেট। দাঁড়া, দু'জনকেই একটা করে ভেজে দিচ্ছি। দীপুর আশকারাতে ছেলেটা একেবারে মাথায় উঠল।' মা চলে গেলে, বড়মামা কোকোর কাছে এসে কানে কানে বললেন, 'এই আশকারা শব্দটা কোথা থেকে এসেছে জানিস?'
-না তো।
-এটা ফরাসি শব্দ। এর মানে মোটেও 'প্রশ্রয় দেওয়া' নয় ।
- তাহলে ? কি মানে?
- 'গুপ্ত বিষয়ের প্রকাশ'। সেটাই করব আজ।
(৭)
বড়মামা বিড়ি ধরাতে বারান্দায় চলে গেলেন। কোকো ভাবতে বসল, টু কুয়াং চিং আর মহেঞ্জোদড়োর আয়নার মধ্যে কি যোগসুত্র। বড় মামা কিছুতেই খুলে বলছেন না, কাল বারকয়েক জিজ্ঞেস করতেও এড়িয়ে গেছেন। আজ আবার মিউজিয়ামে যাওয়া হবে । আয়নাগুলোর মধ্যে কি এমন আছে? কি গুপ্ত জিনিসের প্রকাশ করবেন বলে গেলেন? নাঃ, কিচ্ছু বুঝতে পারছে না কোকো। এবার মাথাটাই বোধহয় খারাপ হয়ে যাবে। এমনিতে ওর বুদ্ধিতে ও নানা বিষয়ের গভীরে গিয়ে, শিখতে আর জানতে ভীষণ আগ্রহী। কাল রাতে ও প'ড়েও ফেলেছে বড় মামার লাস্ট রিসার্চ পেপারটা। ইস্টার আইল্যান্ডে বেশ কিছু বিশাল পাথরের মূর্তি রয়েছে । অদ্ভুত লম্বা টাইপের মুখ,আকাশের দিকে ওরা তাকিয়ে রয়েছে। সমুদ্রের ধারে সাজানো আছে সেগুলো।এগুলোকেই বলে মোয়াই। রাপা নুই বলে এক জনগোষ্ঠীর তৈরি, আজ থেকে হাজার বছরের পুরোনো। সবাই জানত এগুলো পাথরের মূর্তির মুখ, কিন্তু কেন যে এগুলো ওরা বানিয়েছিল, সেটা রহস্যই ছিল। বড়মামার টিম এক্সক্যাভেশন করে মূর্তির তলা খুঁড়ে দেখেছে, প্রত্যেকটা মূর্তির বাকি শরীরটা আছে মাটির নীচে, আর তারও তলায় এক বা একাধিক মানুষের মৃতদেহ রয়েছে। এখন মনে করা হচ্ছে মিশরের পিরামিডের মত, এই পাথরের মূর্তিগুলোও মৃত মানুষের কবরের উপর কোন বিশেষ বিশ্বাসে, সৌধ হিসেবে বানানো হত। গোগ্রাসে ও লেখাটা পড়েছিল কাল রাত জেগে,পড়ার বইয়ের মধ্যে লুকিয়ে। মোবাইলে গেম খেলা কাল থেকে মাথায় উঠেছে।
হঠাৎ বড় মামা বারান্দা থেকে এসে জিজ্ঞেস করলেন, 'হ্যাঁ রে কোকো, তুই বড় হয়ে কি হতে চাস?' 'আমি?', একটু ভেবে কোকো বলে, 'অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার।'
-তা ভাল। শোন, যেটা করবি সেটাই মন দিয়ে, অধ্যাবসায় নিয়ে করবি। কোন কাজই দুনিয়ায় ছোট নয়। 'নিয়ারা' কাদের বলে জানিস?
-কাদের? জানিনা তো!
-বউবাজার অঞ্চলে সোনা-রুপোর গয়না তৈরি হয়,জানিস তো। সেখানে রাস্তায় ধুলো, নোংরা,নর্দমার পাঁক, সবের মধ্যেই সোনার ছোট ছোট কণা পাওয়া যায়। সেজন্য সে সবই বিক্রি হয়, নানা রেটে। কিছু লোক সেসব কিনে নিয়ে, দিন রাত ওগুলো ঘেঁটে , বহু খেটে, সোনার কণা খুঁজে বের করে। ওদেরই বলে নিয়ারা। রোজকার মন্দ হয়না রে, কপাল ভাল থাকলে মাঝে মাঝে বড় মাপের কণাও জুটে যায়, আর তাহলে তো এক রাতেই একজন বড়লোক।
(৮)
মিউজিয়ামে গিয়ে তো কোকোর চক্ষু চড়কগাছ । বড়মামার সুযোগ্য ছাত্র অরিজিৎবাবু, নিজের ঘরে ওদের দারুন খাতির ক'রে বসালেন। বড়মামাকে যে উনি কি অসম্ভব শ্রদ্ধা করেন, তা সেদিনই বোঝা গেল। 'কি খাবেন বলুন স্যার, কফি বলি?' বড়মামা বললেন, 'নাঃ,কিচ্ছু খাব না। তোমার সিন্ধু সভ্যতার ক্যাটালগটা দেখাও তো একটু, তারপর মহেঞ্জোদড়োর আয়নাটাও একবার দেখব।' অরিজিৎবাবু কাকে যেন স্টোর রুমে পাঠালেন। বড় মামা বলে চললেন 'জানিস কোকো,সবাই ভাবত, চীনের মতো সিন্ধু সভ্যতার লিপিও বোধহয় লোগোগ্রাফিক। মানে, এক একটা শব্দ, এক একটা ছবি দিয়ে বোঝানো। কিন্ত এই সেদিন সুজান রাডেলিয়া রিসার্চ করে জানাল, যে আসলে এটা একটা অ্যালফাবেটিক লিপিই, হায়ারোগ্লিফিকের মত।' বলতে বলতেই এসে গেল ক্যাটালগগুলো। ওরা বসে বসে, ক্যাটালগের পাতাগুলো উল্টেপাল্টে দেখতে লাগল । অনেকগুলো সিলমোহরের ছবিও দেখল, যেখানে বেশ কিছু লিপি ক্ষোদাই করা আছে। কিছুক্ষণ বাদে বাক্সে করে আয়নাটাও এসে গেল।অরিজিৎবাবু বললেন, 'স্যার,এটাই মহেঞ্জোদড়োর আয়না।আপনি কি এ নিয়ে এখন কোন রিসার্চ ওয়ার্ক করছেন নাকি?' আয়নাটা খানিক্ষণ উল্টেপাল্টে দেখে, তারপর কোকোকেও সেটা দেখতে দিলেন ,বড়মামা। অরিজিৎবাবুর কথার উত্তর না দিয়ে বললেন,'এই ধরনের আয়না এখনও এ দেশে তৈরি হয়, জান কি? মাত্র কয়েকটা পরিবার হাতে ক'রে তৈরী করে।' 'আরানমুলা কানাড়ির কথা বলছেন কি স্যার?' অরিজিৎবাবু বলেন।'ঠিক বলেছ',খুশি হয়ে হাসেন বড়মামা।কোকো অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,'সেটা আবার কোথায় গো?' বড়মামা বললেন, 'কেরালায়। হাই টিন ব্রোঞ্জের পাতলা ছোট পাত ঢালাই ক'রে, পালিশ করে , পেতলের ফ্রেমে আটকে আয়না বানায় ওরা।' 'ওরাও কি সিন্ধু সভ্যতার লোকেদের থেকেই আয়না বানাতে শিখেছিল?',কোকো না বলে পারে না। 'খুব ভাল প্রশ্ন করেছিস, তোর হবে। আমারও এই প্রশ্নটা মাথায় এসেছিল। যেটুকু জেনেছি,তাতে মনে হয় ওরা সিন্ধু সভ্যতার মানুষদেরই পরের প্রজন্ম । দু'হাজার বছর আগে, সিন্ধু সভ্যতা ধ্বংসের পরপরই, মানুষ সিন্ধু নদীর এলাকা থেকে চলে এসে, দক্ষিণ ভারতের কেরালায় বসবাস করতে শুরু করেছিল।' 'কেরালার এই আয়নাগুলো এখনো পাওয়া যায়?', কোকো উৎসাহে বলে। 'পাওয়া যাবে না কেন? কিনতেও পারিস আমাজনে, তবে প্রায় হাজার পাঁচেক টাকা দাম।'
'এবার আসল জিনিস দেখাব। অরিজিৎ, তোমার ঘরের, ওই কোনটায় বেশ সূর্যের আলো এসে পড়ছে, ওখানে সবাই চল।', বড়মামা বললেন। সবাই গুটিগুটি ওদিকে গেল। বড়মামা ব্যাগ থেকে দু'তিন রকম শিশি, কাঁচ, কাপড়, ব্রাশ এসব বার করে টেবিলটার উপর রাখলেন। 'এবার দেখ, এই মহেঞ্জোদড়োর আয়নাটার উপরের দিকটা আর একেবারেই মসৃণ নেই, সূর্যের আলো পড়ে দেখ, ওই দিকের দেওয়ালে অদ্ভুত সব দাগ তৈরি হয়েছে। কি হয়েছে তো?' 'হ্যাঁ', ওরা বলে।
সেটা হল, এই আয়নার ওপরে তৈরি বিভিন্ন দাগের রিফ্লেকশন। এত বছর ধরে আয়নাটার প্রচুর করোশন হয়েছে। যদি কিছু লেখা খোদাই করা থাকত, তাহলে সেটারও রিফ্লেকশন দেওয়ালে পড়ত,অবশ্য উল্টো হয়ে।
'আর একটা আয়না ধরলেই, লেখাটা সোজা হয়ে যেত। তাই না?' কোকো মাঝে বলে ওঠে। -ঠিক। এবার দেখ, আমি কি করি। এই আয়নাটার ওপর এই বিশেষ ধরনের আঠাটা ঢেলে দিলাম। ভয় নেই অরিজিৎ, আয়নাটার কোন ক্ষতি হবে না। পরে পরিস্কার কাপড় দিয়ে মুছে নিলেই হবে। এইবার এই দেখ, এই আঠা দিয়ে আমি এর ওপর এই কাঁচটা বসিয়ে দিলাম। এবার কি দেখছিস বলত?
-এ কি ! এ তো পুরো মুখ দেখা যাচ্ছে!
-হুঁ, এই হল টু কুয়াং চিং-এর আয়না। এজন্যই ওতে মুখ দেখাও যেত, আবার বিশেষ কোণে আলো পড়লে, পিছনের নকশা বা লেখাও দেওয়ালে প্রতিবিম্ব তৈরি করত। এটাই ঐ আয়নার রহস্য। মেটালের আয়নার উপর কাঁচ বসিয়ে আসলে ওগুলো বানানো হত। সিন্ধু সভ্যতার সময় এবং তারও আগে-পরে মেসোপটেমিয়া, চীন, রোম অনেক জায়গাতেই এরকম মেটালের পালিশ করা আয়না ব্যবহার হত। এক দেশ থেকে অন্য দেশে সেগুলো ব্যবসার মাধ্যমে ছড়িয়েও পড়ত। এবার দেখ, এই কোণে আমি সূর্যের আলোর ওপর আবার আয়নাটাকে ধরছি,দেখ তো সেই দাগগুলো আবার দেওয়ালে ফুটে উঠল কিনা।
কিন্তু সকলে অবাক হয়ে দেখল,আর তো সেই অদ্ভুত দাগগুলো দেওয়ালে ফুটছে না। তার বদলে, এবারে ফুটে উঠছে কিছু অদ্ভুত মানুষ, ত্রিভুজ, গাছের ডাল, মাছ এরকম সব চিহ্ন। 'সিন্ধু লিপি', চেঁচিয়ে উঠলেন অরিজিৎবাবু। বড়মামা মুচকি হেসে বললেন, 'ঠিক এটাই সন্দেহ করে চীন থেকে তড়িঘড়ি চলে এসেছিলাম। ছবি তোল, কোকো,ছবি তোল। অরিজিৎ তুমিও ছবি তুলে নাও। সুজানের রিসার্চ পেপারটা কালই ওই জন্য নেট থেকে ডাউনলোড করে নিয়েছিলাম। নাও, এবার লেখাটার মানেটা পড়ে ফেল তো অরিজিৎ।' বলে বড় মামা একটা প্রিন্টেড ডকুমেন্ট বের করে টেবিলে রাখেন। অরিজিতবাবু তাড়াতাড়ি আয়নায় রিফ্লেক্ট হওয়া লিপিটা, সুজানের সিন্ধু বর্ণমালার পাঠোদ্ধারের সঙ্গে মেলাতে থাকেন।
বড়মামা এবার কোকোর কাছে এসে ফিসফিস করে বললেন, 'চীনেম্যান দেখলেই বলবি কিন্তু, ডেঞ্জারাস। আমার পিছু ধাওয়া করতে পারে।' কোকোর মনে এদিকে তখন অনেক প্রশ্ন ভীড় করে এসেছে। ফিসফিস করে বলল, 'বড়মামা,চীনারা এখনো তোমাকে ফলো করবে কেন? ওখানে কি কিছু ঝামেলা হয়েছিল?' বাড়ি গিয়ে সব বলব, বলে বড়মামা আবার থামিয়ে দেন ওকে।
একটু পরেই অরিজিৎবাবুর মুখে হাসি ফুটে উঠল। এ তো লেখা আছে দেখছি, 'অন্তর অনন্য', পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। তার মানে অন্য আয়নাগুলোতেও এরকম কিছু লেখা আছে নাকি স্যার?' 'মনে হয় না,একমাত্র মহেঞ্জোদড়ো থেকে পাওয়া আয়নাগুলোতেই এরকম লিপি পাবে বলে আমার মনে হয়। তবু একবার দেখো অন্য আয়নাগুলোও। ন্যাশনাল মিউজিয়ামে কিছু আছে, সুব্রতকে জানিয়ে, আয়নাগুলোকে একবার এইভাবে দেখার চেষ্টা কোরো। তবে এই স্পেশাল সলিউশনগুলো আমি ছাড়া কেউ বানাতে পারবে না।', আয়না থেকে যত্নে সলিউশনগুলো সাদা কাপড়ে মুছে নিতে নিতে বললেন বড়মামা। 'তবে তোমরা কেউই একটা জিনিস লক্ষ্য করোনি,বোধহয়। কি রে কোকো,এই শেখালাম এতদিন ধরে ?' কোকো একটু ভেবে বলল, 'আয়নার প্রতিফলনে লেখাটা সোজা পড়া গেল, আর একটা আয়না দিয়ে ডবল রিফ্লেক্ট করার দরকার হল না। তার মানে লেখাগুলো আগে থাকতেই উল্টে লেখা ছিল।' 'ব্রাভো, এই না হলে আমার ভাগ্নে! আর সেই সঙ্গে ভাব, আমাদের দেশের সিন্ধু সভ্যতা, চীনের থেকে কতটা এগিয়ে ছিল সেসময়। ওরা বুদ্ধি করে, লেখাটা প্রথমেই রিফ্লেকশন করে লিখেছিল, যাতে একবারেই সহজে পড়া যায়। 'অন্তর অনন্য' না হলে কি আর এরকম হয় রে?', বড় মামা আর অরিজিৎবাবু দুজনেই হেসে ওঠেন।ফেরার সময় অরিজিৎবাবু ঢিপ করে বড়মামাকে একবার প্রণাম সেরে নেন।বলেন,'আপনি একজন জিনিয়াস স্যার।আমি আপনার নখের যুগ্যিও হতে পারলাম না।' বড়মামা হেসে অরিজিৎবাবুকে জড়িয়ে ধরে বলেন, 'সলিউশনগুলো রেখে গেলাম,জানিও কি লেখা পড়ে উদ্ধার করলে।'
(৯)
রাতে খাওয়া-দাওয়ার শেষে, কোকো ঘরে শুয়ে শুয়ে মোবাইলে ইউটিউব খুলে আরানমুলা কানাড়ি আয়না তৈরীর ভিডিও দেখছিল।সত্যিই কি চকচকে, পালিশ করা মেটাল, ব্রোঞ্জ বলে মনেই হয় না। ঠিক যেন কাঁচেরই মত পালিশ,অথচ স্বচ্ছ নয়।এই প্রতিবিম্বই হল সঠিক ছবি। কাঁচের আয়নায় নীচের তল থেকে প্রতিবিম্ব প্রতিফলিত হয়ে তৈরি হয়।মেটালের আয়নাতেই একমাত্র, ওপরের তল থেকে প্রতিবিম্ব তৈরী হয়। তাই কোন বিচ্যুতি বা বিকৃতি থাকে না। ওদিকে বড় মামা মিউজিয়াম থেকে ফিরে আসার পর থেকেই বেশ চুপচাপ। হাসিখুশি, হৈ হৈ করার ভাবটা কোথায় যেন উধাও। কোচিং থেকে ফিরে এসে থেকেই কোকো দেখছে। অথচ কারণটা কি পরিস্কার হচ্ছে না। তখনই ওর ঘরের দরজায় ঠকঠক করে শব্দ হল।কোকো সোজা হয়ে বসতেই দেখে বড়মামা। খুশি হয়ে ও বলল, 'বোসো বোসো।' 'বসতে পারব না রে', ফিসফিস করে বলল বড়মামা। গলির মুখে সন্ধ্যেয় বিড়ি কিনতে গেছি,দেখি একটা চীনে লোক রিস্কা করে এদিকেই আসছে। সঙ্গে সঙ্গে ভাগ্যিস আড়ালে লুকিয়ে পড়লাম। টু কুয়াং চিং-এর অভিশাপ ফিরে এসেছে, বুঝলি! এবার পালাতে হবে।' 'এরই মধ্যে চলে যাবে?' মন খারাপ হয়ে যায় কোকোর। 'কিন্তু ওরা জানল কি করে,তুমি এখানে আছ?',কোকো অবাক হয়ে জানতে চাইল।' মনে হচ্ছে তোর চীনা মোবাইলের পাবজি গেমের মধ্যে দিয়েই। নিশ্চয়ই ফিসিং অ্যাপ লুকোনো আছে, ডার্ক ওয়েবে সব তথ্য দিয়ে দিচ্ছে। শোন, তোকে একটা মেল পাঠালাম,বাবার ল্যাপটপে খুলে পড়বি।টু কুয়াং চিং এর জাদু আয়না সম্পর্কে সব জানতে পারবি।' 'না তুমি এত তাড়াতাড়ি যেতে পারবে না, আর ক'টা দিন থেকে যাও না! বাড়ির ভেতরেই থাক,তাহলে তো আর কেউ জানতে পারবে না।আর মোবাইলটা অফ করে আমি আলমারিতে তুলে রাখছি।', ছলছলে চোখে বলল কোকো। 'ওঃ, তোকে নিয়ে আর পারা গেল না ।', বাধ্য হয়ে চেয়ার টেনে বসে পড়লেন বড়মামা। 'আগের বারেও তোকে বলে যাওয়া উচিত ছিল,আসলে সেবারেও একটু তাড়াহুড়ো করে চলে যেতে হয়েছিল। তাই এবারে আর ভুল করলাম না। শোন, মন খারাপ করিস না।ক'দিনের জন্য যেতেই হবে মাল্টায়,পেরু যাওয়া এখন পোস্টপন্ড।' 'কিন্তু চীনে কি এমন হয়েছিল,যে ওরা এখান অব্দি ধাওয়া করে এল? কতবার জিজ্ঞেস করছি,বলছ না কেন?', কোকো অভিমান করে বলে। 'ওফ্ , বলছি রে বলছি। টু কুয়াং চিং-এর সেই আয়নাটায় আসলে দিনের বিভিন্ন সময়ে, সূর্যরশ্মির পড়ার কোনের ওপর নির্ভর করে, বিভিন্ন লেখা ফুটে উঠত। কিন্তু যে মিউজিয়ামে ওটা রাখা ছিল, সেই ঘরে শুধু চারটের সময়ই পড়ন্ত রোদ এসে পড়ত আয়নাটার ওপর একটা বিশেষ কোণে, তাই একটাই লেখা রোজ ফুটে উঠত। বাকি লেখাগুলো কিভাবে পড়তে হবে, সেটা শুধু আমিই জানি। ওরা কিছু একটা সন্দেহ নিশ্চয়ই করেছিল, তাই চীনা গুপ্ত সংগঠনগুলো আমার পেছনে এইভাবে লেগে পড়েছে। ওদের ধারণা, আয়নাটায় অমরত্ব বা টাইম ট্রাভেলের কোন মন্ত্র লেখা আছে। মেলটা পড়লেই সব জানতে পারবি। গুড নাইট। পরেরবার তোকে ম্যাঘট্যাব সম্পর্কে বলব।' বড়মামা চলে যায়। কোকো বসে বসে ভাবতে থাকে কথাগুলোর মানে। কিন্তু তার থেকেও বেশি একটা মন খারাপ উঠে আসছিল ওর বুক থেকে। হঠাৎ মোবাইলে একটা মেসেজ ঢুকতে, তাড়াতাড়ি সেটা খুলে দেখে আননোন নাম্বার দেখাচ্ছে।আর মেসেজটা হল,'ম্যাঘট্যাব ইজ প্রোহিবিটেড,ডোন্ট পোক ইওর নোজ,দীপাঞ্জন।' দেখেই ওর মনে পড়ে গেল,বড়মামা সেদিনই বলেছিলেন,মাল্টার ম্যাঘটাব হল একটা শব্দ প্রতিফলন আয়না।কোকো ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে দেখে,যাঃ,বড়মামা আগেই চলে গেছেন।চোখ ফেটে কোকোর তখন কান্না উঠে আসছিল।
