3 March 2020

দিবানাপন

বিতানের টিনএজ হার্টথ্রব শ্রাবণী, ওর জন্য বিতান একেবারে দিবানা । কিন্তু মুখ ফুটে বলার সাহস নেই। শুধু ওকে ফলো করে, ওর চালচলন লক্ষ্য করে। কিন্তু আজ ও এল না কেন? এমনটা তো ও কখনো করে না! বিতান অবাক হল। নিয়মিত মামার কাছে শ্রাবণীকে পড়তে আসতেই হয়, আর তার ফাঁকেই প্রেম। ওর কথাবার্তা, চালচলন সব বিতানের এত ভাল লাগে, যে একেবারে ফিদা হয়ে যায়। ওর মনে হয় ইস্, শ্রাবণী যদি সত্যি সত্যি ওর প্রেমিকা হত! কিন্তু তা যে হবার নয়। হঠাৎ মামা এসে পড়ায় ওর টনক নড়ল। একথা সেকথার পর শ্রাবণীর প্রসঙ্গ উঠল। ওর খোঁজ নিয়ে আসতে মামাই বিতানকে বলল, ‘সামনে ওর পরীক্ষা,পড়তে আসল না, ফোনও ধরছে না কেন?’ ও মামাকে চুপ করিয়ে দিল। সব কাজ সেরে, সন্ধেবেলায় শ্রাবণীর বাড়ি গেল বিতান। ওর বাবা ডাক্তারের কাছে, আর মা দোকানে গেছে। এরকম অযাচিত সুযোগ কি ছাড়া যায়! কিন্তু ওর বাড়ির কাছে এসে দেখে বাড়ীটা একেবারে অন্ধকার, একটা মাত্র ঘরে একটা টিমটিমে ল্যাম্প জ্বলছে। কেউ নেই নাকি! দ্বিতীয়বার কলিংবেল বাজানোর পর, দরজা খুলে শ্রাবনীই বেরিয়ে এল, চোখমুখ ফোলা, অন্যরকম।যথাসম্ভব নিজেকে স্বাভাবিক রেখে, অবাক হয়ে ও ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, ’কি ব্যাপার বিতান, তুই?’, 'মামা পাঠিয়েছে, তুই পড়তে যাচ্ছিস না!’ ,বলতে শ্রাবণী চুপ করে রইল, কিছু বলতে গিয়েও যেন বলতে পারল না। শ্রাবণীকে শুকনো লাগছিল, কোন কারণে ও যেন বিধ্বস্ত। এই অন্ধকারে পরিবেশটা কেমন অস্বস্তিকর লাগছিল বলে, বিতান আর বেশি কথা না বাড়িয়ে মামার দেওয়া ক্যাডবেরিটা ওকে গিফ্ট করে চলে এল। ও অবশ্য খেতে চাইছিল না। পরদিন বিতানের ঘুম ভাঙল মার ডাকে। কাঁচা ঘুম ভেঙে যাওয়ায় খাপ্পা হয়ে, একচোট হাঁকডাক করতে যাবে, তখনই উত্তেজিতভাবে মা বলল, ‘ওরে ওঠ রে, সর্বনাশ হয়েছে। এইমাত্র খবর পেলুম, শ্রাবণীর কি একটা হয়েছে। বোধহয় মেয়েটা আর নেই রে।‘ ব্যাপারটা বুঝতে চোখ কচলে, কটা হাই তুলতে হল বিতানকে, তারপর জামাটা গলিয়েই ছুটল। ওদিকে মামা ঘুমোচ্ছে। নানা ভাবনা চিন্তা এসে ওর মাথায় দানা বাঁধতে লাগল, মা আজ মশলা বাটবে কিসে? সেফটিক ট্যাঙ্ক সাফ করাই বা কবে হবে? যাহোক, ঘটনাস্থলে এসে দেখে, সারা পাড়ার লোক ঝেঁটিয়ে জড়ো হয়েছে। ঢুকতে গিয়েই পুলিশের ব্যারিকেডে আটকা পড়তে হল। এর ওর মুখে শোনা গেল, শ্রাবণী নাকি বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেছে। ওর বাবা মা রাতে ফিরে এসে, দরজা খুলে দেখে এই কান্ড। কাল সন্ধেয় ওর সঙ্গে শেষ কথাবার্তা আর আজ এই মৃত্যু আর আনুসঙ্গিক ছোটখাটো নানা ঘটনা ঘোরালো রূপে বিতানের মনে হানা দিতে লাগল, বারান্দায় ক্যাডবেরির প্যাকেট পড়ে কেন?দরজা বাইরে থেকে কে বন্ধ করল? অবশ্য তার সঙ্গে আর একটা বিষয়ও খুব চিন্তায় ফেলল, মামাও কাল থেকে গায়েব, গেল কোথায়? এই ঘটনার সঙ্গে কি তবে মামারও কোন যোগসূত্র রয়েছে? তখনই সব মনে পড়ে গেল বিতানের, সেদিন মামার ঘরে ও হঠাৎ ঢুকে পড়েছিল। আসলে নানা ছুতোয় শ্রাবণীর সঙ্গে মিশতে চাইত তো, তাই শ্রাবণী পড়তে এলে বিতানের আর পড়ায় মন বসত না, খালি ওর পেছনেই ছুঁকছুঁক করত। সেদিনও ওরকম খবরের কাগজ খুঁজতে মামার ঘরে ঢুকে ওর ইচ্ছে ছিল, ওর নতুন মোবাইলে লুকিয়ে শ্রাবণীর একটা ছবি তুলবে। কিন্তু ‘আজকের কাগজটা তোমার কাছে আছে?’, বলতে বলতে পরদা সরিয়ে ঘরে ঢুকতেই দেখে মামা আর শ্রাবণী একে অপরকে জড়িয়ে ধরে আছে আর চুমু খাচ্ছে। দৃশ্যটা দেখেই ওর পা থেকে মাথা অবধি রাগে ঘৃণায় জ্বলে যাচ্ছিল। বিতানকে দেখেই ওরা ছিটকে দুজনে দু’দিকে সরে গেল আর আবার হোমটাস্কের আলোচনা শুরু করে দিল। আর বিতানও যেন কিছু দেখেনি এমন ভাব করে, অন্য দিকে ঘুরে বইয়ের তাকটা ঘেঁটে ফিরে গেছল। কিন্তু সেই ঘটনাটা ও কোনদিন ভুলতে পারেনি, ওর বুকটা যন্ত্রনায় দুমড়ে মুচড়ে গেছল। মামাও আর সে নিয়ে ওকে কখনও কিছু বলেনি, হয়ত ভেবেছে ও কিছু দেখেনি।কিন্তু সেই থেকে বিতান দুজনকেই ঘৃণা করতে শুরু করে দিয়েছিল।শ্রাবনীকে যে ও প্রাণ দিয়ে ভালবাসত, মনে মনে এত চাইত, তা ওরা কেউই জানত না। কিন্তু বিতান ওদের দুর্বলতার কথা জেনে গেল সেদিন, আর সেই সঙ্গে এটাও, যে শ্রাবনী অন্য কারও। সেই দিন থেকে ওর একমাত্র ধ্যানজ্ঞান হয়ে গেল, দু’জনের ওপর কি করে প্রতিশোধ নেওয়া যায়। শ্রাবনীকে পোস্টমর্টেম করলে জানা যাবে, টিকটিকির বিষে মৃত্যু। মাছের পেটে মরা টিকটিকি ভরে মাটিতে পুঁতে, তারপর নানা কায়দায় তৈরী করা বিষ। আর মামা তো উঠোনের পাশের সেফটি ট্যাঙ্কের ভেতরই ঘুমোচ্ছে, আর কোনদিন উঠবে না। আর বিতান?ও এখন পাশের পাঁচতলা ফ্ল্যাটবাড়িটার ছাতের কার্নিস ধরে হাঁটছে। মোবাইলটা বেকার, ঝুপ করে হাত থেকে ফেলে দিল ও।নীচে পড়ে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল ওটা। ওর নিজের পা স্লিপ করলে এবার কি হবে?

2 comments:

  1. অসাধারন হয়েছে লেখাটা! ভীষন ট্রাজিক শেষটা।কীন্তু গল্পটা খুব ছোট হয়ে গেছে। আরো একটু বাড়ানোর দরকার ছিল!

    ReplyDelete