14 October 2019

অন্য প্রেম

ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করতে না করতেই, ক্যাম্পাস ইন্টারভিউতে কুনাল চাকরি পেয়ে গেল জামশেদপুরে একটা বড় কোম্পানিতে। কলকাতার দামাল ছেলেটা, চোখের জল ফেলতে ফেলতে বিদায় দিল পুরনো শহর, পুরনো বন্ধু-বান্ধব- আত্মীয়স্বজন ,এমনকি পুরনো প্রেমিকাকে পর্যন্ত। চার ঘণ্টা জার্নি করে রোজ রোজ তো আর বাড়ি ফেরা যায় না, মাসে দু’মাসে ছুটিতে, এক আধবার বাড়ি আসতে পারে বটে ,কিন্তু সবার সঙ্গে আগের সেই যোগাযোগটা কমে গেল। প্রতিবার ছুটির শেষে ওকে যখন আবার জামশেদপুরে ফিরে যেতে হত, বুকটা যেন ফেটে যেত। চোখে জল এসে যেত কুনালের। কিন্তু সময় থেমে থাকে না। মানুষকেও সব পরিস্থিতিতে মানিয়ে চলতে হয়। জামশেদপুরে আস্তে আস্তে মন বসতে শুরু করল কুনালের, কিছু নতুন বন্ধুও হল, তবে সবই কলিগ স্থানীয়। বেশকিছু বাঙালির বাস এখানে, তাছাড়া স্থানীয় মানুষজনও খারাপ নয়। তাদেরকেই আত্মীয় করে নেওয়া ছাড়া আর উপায়ই বা কি? মাঝেমধ্যে এক এক দিন বিকেলে, তাদের সঙ্গে জুবিলি পার্ক বা দলমা পার্কে ঘুরে আসাটাই ছিল একমাত্র মনকে তাজা করার উপায়। ততদিনে শম্পার সঙ্গে সম্পর্কটাও কিছুটা হালকা হয়ে এসেছে, চোখের বাইরে মানে সত্যিই মনেরও বাইরে। দিনগুলো কাটছিল বড় একঘেয়ে। হঠাৎই একদিন বিকেলে, কুণালের মোবাইলে একটা ফোন এল, অচেনা নম্বর থেকে। একটা মেয়ের গলা, মেয়েটা কাকে যেন খুঁজছে। ফোনটা কাটতে গিয়েও, কুণালের মনে হল, আরে মেয়েটার গলাটা তো বেশ মিষ্টি , কেমন যেন মাদকতাময়। -হ্যালো কনিকা? -কে বলছেন? -আপনি কে বলছেন? -আমি কুনাল। - কুনাল! ও সরি। এটা কোথায়? - জামশেদপুর। -ও, আমি ভাবলাম বোধহয় কণিকার নাম্বার। -না না, রং নাম্বার। -ও, ভুল হয়ে গেছে। আচ্ছা, রাখছি। -না না, ঠিক আছে। আপনার নামটা জানতে পারি? -ঝিমলি। ফোনটা ছেড়ে দেয় কুনাল। কিন্তু ঝিমলিকে ভুলতে পারে না। বেশ সুন্দর গলাটা ওর, ভালো কথাও বলতে পারে । কেমন দেখতে কে জানে? শেষকালে রং নাম্বারের সূত্রেই রাইট পার্টনার পেয়ে গেল দুজনে। মাঝেমধ্যেই কথাবার্তা হতে লাগল ওদের মধ্যে। সম্পর্কটা ধীরে ধীরে জমে উঠতে শুরু করল। ঘন্টার পর ঘন্টা ফোন, কখনো বা মেসেজের পর মেসেজ। ফেসবুক , হোয়াটসঅ্যাপ কোনটাই অবশ্য ঝিমলির নেই, ও থাকে মুর্শিদাবাদের এক অখ্যাত গ্রাম ভৈরবটোলায়। কিন্তু কিভাবে যেন, দুজনে দুজনের দুর্নিবার আকর্ষনে বাঁধা পড়ে গেল। ক্রমশঃ কুনাল আর ঝিমলি একে অপরের মনের মানুষ হয়ে উঠল, মেড ফর ইচ আদার যাকে বলে আর কি। প্রতিদিন বেশ ক'বার ফোনে কথা না বললেই নয়, প্রাণটা যেন আকুলিবিকুলি করে। কুনাল একদিন ঝিমলিকে বলল,'শুধুই কি আমরা ফোনফ্রেন্ড? আমি তোমাকে দেখতে চাই, মিট করতে চাই, সামনাসামনি । 'কেন? এই তো বেশ চলছে। এখন আমার দেখা করার প্রবলেম আছে।', ঝিমলি ওকে দমিয়ে দেয়। 'কিসের প্রবলেম?’ ,কুনাল অধীর হয়ে বলে। -তুমি বুঝবে না, আমার বাড়িতে খুব কড়াকড়ি । তুমি দেখা করতে এসেছ জানলে, সর্বনাশ হবে। আমাকে আর তোমাকে ফোন করতেও দেবে না। -ঠিক আছে, সামনে দেখতে না পাই, একটা ছবি অন্ততঃ পাঠাও, প্লিজ।তোমাকে যে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে। -হুঁ, কিন্তু কিভাবে পাঠাব? -কেন? ফেসবুক বা হোয়াটসঅ্যাপে! ইউজ করতে শুরু কর এবার, কতবার তো বললাম। -ধুর, আমার ফোনে ওসব হবেই না। আমারটা যে স্মার্টফোন নয়। -তো একটা স্মার্টফোন কিনে নাও না! -না গো, অত সোজা নয় ।বাবা আমাকে কিনেই দেবেনা । বাবার সামান্য রোজকার, মিলে চাকরি করে। এই ফোনটা কিনে দিয়েছে এই ঢের। -আরে বাবাকে বলেই দেখ না,নইলে টিউশনির পয়সা জমিয়ে জমিয়ে কেন। -দেখি, অত সহজ নয়, সময় লাগবে। আমার জমানো টাকাতেই তো প্রতি মাসে রিচার্জ করি, ওটাও বাবা দেয় না। আমার কাছে স্মার্টফোন স্বপ্নই! -ঠিক আছে, ঠিক আছে ,কিন্তু আমাকে তোমার একটা ছবি পাঠাতেই হবে, আমার চাইই। প্লিজ, না বোলো না। তোমার কোন বন্ধুর মোবাইল থেকে অন্তত পাঠাও। -আচ্ছা দেখছি, দাঁড়াও, পরে বলছি। এইভাবেই চলতে থাকে, ছবি আর পাঠানো হয় না। কুনাল ততদিনে ঝিমলির প্রেমে পাগল, ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে দুজনে কত প্রাণের-মনের কথা হয়।কুনাল বুঝতে পারে ,ঝিমলি ঠিক ওর মনের মত, যেমনটি ও চায়।এক দুর্নিবার আকর্ষণে, ঝিমলির পিছনে দেহমন ঢেলে দেয় কুনাল। ওর জীবন এখন ঝিমলিকে ঘিরেই, বাড়ি ফেরার তাগিদও এখন আর ততোটা অনুভব করে না ও। কুনাল একদিন ভাবল, মুর্শিদাবাদে চলে যাবে। ঝিমলিকে নিজের মাইনের টাকা থেকে একটা স্মার্টফোন কিনে দেবে। কিন্তু ঝিমলি বারণ করে, পরে আসতে বলে। বাড়িতে নাকি সমস্যা হবে। কুনাল তখন ঝিমলির প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে, ঝিমলিও। কুনাল বুঝতে পারে না, এত যদি ভালবাসা, ঝিমলির দেখা করতে বা ফটো পাঠাতে তাহলে এত আপত্তি কিসের! একদিন হঠাৎ একটা ঘটনা ঘটে। কুনাল সেদিন ওর মোবাইল নাম্বারটা রিচার্জ করতে ভুলে গেছে, ব্যালেন্স নেই, আউটগোইংও বন্ধ। ওখানে ও একটা লোকাল নাম্বার নিয়েছিল, সেটা থেকেই তখন ও ঝিমলিকে ফোন করে। ওদিকে একজন ফোন তোলে ,কিন্তু ঝিমলির গলা নয়, এ গলা পুরুষালী।কুনাল কথা বলতে, মুহুর্তেই সেই গলা আবার ঝিমলিতে পরিণত হয় ।কথাবার্তা সেদিন আর সেরকম জমেনা। কুনাল একটু সন্দেহগ্রস্ত হয়। ওর কয়েকজন বন্ধুর ,কয়েকটা অদ্ভুত অভিজ্ঞতার কথা ওর মনে পড়ে যায়। ওরা হিজড়ের প্রেমে পড়েছিল। মেয়ের গলা নকল করে ওরা ছেলেদের ফাঁসাত। আর ওর বন্ধুরাও, কতবার মেয়ে ভেবে আসলে সেই হিজড়েদের মোবাইল রিচার্জ করে দিয়েছে বা অনলাইনে কোন গিফট কিনে পাঠিয়েছে। এইভাবে প্রেমের ফাঁদে পড়ে , অনেক টাকা ক্ষুইয়ে ওরা শেষমেষ বোকা বনে গেছল। দেখা করতে যাবার জন্য জোর করতেই, সব সম্পর্ক ঐসব হিজড়েরা কেটে দিয়েছে। এসব মনে পড়ায়, কুনাল ঝিমলির ব্যাপারটা নিয়েও একটু দ্বিধাগ্রস্ত হয়। এরকম কোন ফাঁদে ও নিজেও পা দিয়ে ফেলল না তো! ঝিমলির গলাটা কেমন যেন ছেলেদের মতো লাগল, হিজড়ে নয়তো! অন্য নম্বর থেকে ফোন আসাতে কি ওর আসল সহজাত গলাটা বেরিয়ে এসেছিল? ছবিই বা পাঠায় না কেন, দেখাই বা করেনা কেন! পরের দিনই , সন্দেহগ্রস্ত হয়ে, কুনাল এইসব প্রশ্নে প্রশ্নে জেরবার করে দেয় ঝিমলিকে। -তোমার গলাটা কাল ওরকম লাগছিল কেন? -কেন? কি রকম? -কিরকম আবার? তোমার গলা তো মেয়েদের মতো নয়! -মানে? কি বলছ ! -ঠিকই বলছি। আমি স্পষ্ট শুনলাম ছেলেদের গলা। -ও ওটা? আসলে আমার না কাল শরীরটা খুব খারাপ ছিল। গলাটাও বসে গেছিল ঠান্ডা লেগে। -থাক, মিথ্যে কথা কেন বলছ? -আমি মিথ্যে কথা বলি! তুমি একথা বলতে পারলে! -হ্যাঁ, পারলাম। তুমি আমার সঙ্গে ভালবাসার খেলা খেলছ, আমাকে ঠকাচ্ছ। -কি যা তা বলছ তুমি? কি খেলা খেলেছি তোমার সঙ্গে? - তুমি জান না? তুমি মেয়ে নয়, হিজড়ে। আমি যা বোঝার সব বুঝে গেছি। -কি বুঝেছ? তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? -মোটেই না। তুমি কেন আমার সঙ্গে এরকম অভিনয় করছ? আমাকে ফাঁসাচ্ছ? -অভিনয়! কি করেছি তোমার সাথে? কোনদিন কিছু সুবিধা নিয়েছি কি? তাহলে কেন এসব কথা বলছ! -না, মানে.. -আমি তোমাকে ভালোবাসি কুনাল। -ভালোবাসা! থাক, আমার বোঝা হয়ে গেছে। - কি বুঝেছ, শুনি? ঝিমলি কেঁদে ওঠে। কুনাল রেগে ফোনটা কেটে দেয়। কিন্তু তারপরেই ও একটু দোনামোনায় পড়ে যায়। ঠিকই তো, বন্ধুদের শোনা গল্পের মতো ঝিমলি তো কোনদিন কুনালকে মোবাইল রিচার্জ করতে বা কোন গিফট পাঠাতে বলেনি। তাহলে? কিন্তু সন্দেহটা ওর মনে গেঁথে যায়। আরো ভালভাবে পরীক্ষা করার জন্য কুনাল এবার ওর বন্ধু অনুপের সাহায্য চায়। অনুপ মুর্শিদাবাদের জিয়াগঞ্জে থাকে, ঝিমলিদের গ্রামটাও চেনে। দুদিনেই খবর পেয়ে যায় কুনাল, যা সন্দেহ করেছিল, ঠিক তাই।ওর করা ফোনও, কোন ছেলেই তুলেছে। তাছাড়া অনুপ বলে, ‘ওই এলাকায় প্রচুর হিজড়ে থাকে, ওরা তো এসবই করে, তুই জানতিস না? তুইও শেষে ওদের পাল্লায় পড়লি?’, অনুপ ব্যঙ্গ করে। কুনাল ভেঙে পড়ে। ছি,ছি, কি না কি ভেবে এসেছে এতদিনের ফোনফ্রেন্ডকে। কত মনের কথা বলেছে, হৃদয় দিয়ে ফেলেছে শুধু ওই সুন্দর গলার মোহে। এত যাকে ভালবেসে ফেলেছে, সে হিজড়ে! ঝিমলিকে নিয়ে এত স্বপ্ন দেখেছিল, সব ভেঙে চুরমার হয়ে গেল! ঝিমলি মেয়ে নয়! রাগে, অপমানে নিজের চূড়ান্ত হয়রানিতে বোকা বনে গিয়ে, দিকবিদিক জ্ঞানশুন্য হয়ে আবারও আর একটা অন্য নাম্বার থেকে ঝিমলিকে ফোন করে কুনাল। দেখে, যা ভেবেছিল ঠিক তাই, পুরুষকন্ঠ। বেশ দু’চার কথার পরে, নিজের পরিচয় দিয়ে, নিজের আসল গলা চেনায় কুনাল।রেগে চিৎকার করে ওঠে। -ছিঃ, ঝিমলি। তুমি এরকম? -কেন গো কি হয়েছে? -কি হয়েছে জান না! তুমি মেয়ে সেজে আমাকে দিনের পর দিন বোকা বানিয়ে চলেছ? -আমি তোমাকে বোকা বানাচ্ছি! কোনদিনও নয় কুনাল। -থামো। তুমি এতদিন ধরে আমাকে নিয়ে খেলা করলে! আমার ভালবাসা নিয়ে মজা করলে !ছি ছি! -কি বলছ তুমি! আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। প্লিজ রাগ কোরো না। আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচব না কুনাল। -চুপ করো। আজ থেকে আমি আর তোমার সঙ্গে কোন সম্পর্ক রাখতে চাই না, সব সম্পর্ক শেষ। - প্লিজ সোনা, আমাকে ভুল বুঝোনা প্লিজ। আমাকে ছেড়ে যেও না, আমি মরে যাব। -দূর হয়ে যাও আমার জীবন থেকে, মিথ্যেবাদী! ইনিয়ে বিনিয়ে কাঁদতে থাকে ঝিমলি, আবার মেয়েলি গলায়। ওর কি দুটো সত্ত্বা আছে নাকি? নাকি পুরোটাই অভিনয়? ট্রান্সজেন্ডার সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানেনা কুনাল। শুধু ওদের ঘৃণা করতে হয়, সেইটুকু জানে। ও মেয়ে নয়, তাই কুনালের আকর্ষণের আর একটুও অবশিষ্ট থাকে না। শরীর যেখানে নেই, সেখানে মন আসে কি করে? কুনাল ফোনটা কেটে দেওয়ার পর, ঝিমলি পাগলের মত বিছানায় ঝাঁপিয়ে পড়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে।মেয়েলি কান্না,ওর শাড়ি অবিন্যস্ত হয়ে যায়। শাড়ির ভেতর ওর শরীর, সেটা পুরো মেয়েলি নয়। কিন্তু মন? সেটাতো মেয়েরই ছিল। আর সেই ভালবাসাতেও কোনো ফাঁকি ছিল না। মনের তো আর ট্রান্সজেন্ডার হয়না!

কুসুম ফোটেনি

-নহরপুলের কাছে কি হয়েছে শুনেছিস?
-না তো! কি হয়েছে?
-রেপ হয়েছে রেপ,যা দেখে আয়।কত ফটো তুলবি,তুলে আয়।
-সে কি রে? তুই কি করে জানলি?
-আরে, মেয়েটাকে জঞ্জালের মধ্যে পড়ে থাকতে, আমিই তো প্রথম  দেখেছি,সেই সকালে।
-পুলিশে জানাস নি?
-ধুর!আমার কি! মরুক গে।
                   সত্যিই তাই। কারও কিছু না। বিক্রম শহরের কাছে, সেদিন ভোরে যখন ময়লা, ছেঁড়া জামাকাপড় পরা,বছর বারো তেরোর মেয়েটাকে জঞ্জালের গাদার মধ্যে দেখা গিয়েছিল, ভিড় জমে গিয়েছিল। কোথা থেকে এল মেয়েটা ,কিই বা হয়েছিল ওর? সবাই তো প্রথমে ভেবেছিল মেয়েটা বোধহয় মরেই গেছে। পরে দেখা যায় বেঁচে আছে, অল্প নড়ছে চড়ছে। সারা শরীরে অত্যাচারের ছাপ স্পষ্ট। কিন্তু হেলদোল হয়নি এলাকার বাসিন্দাদের। কোথাকার মেয়ে,কে তুলে নিয়ে গিয়ে রেপ করে ফেলে গেছে,কে জানে? পাশেই জিটি রোড, সারারাত ট্রাক যাবার কমতি নেই।চারিদিকে তো এরকম কত ঘটনার কথা শোনা যায়, কে কার খবর রাখে !রোগা-পাতলা অপুষ্ট শরীরের মেয়েটা কাতরাচ্ছে।আসলে মেয়ে তো,খেতে না পাক, ভগবানের দেওয়া শরীর আছে না! নিজে খাবার হতে বাধা কোথায়? চারপাশে এত লোলুপ দৃষ্টি। হায়রে, অভাগা দেশ। নিজের ঘরে বসে এই কথাগুলোই ভাবছিলেন চন্দ্রভূষণ, এলাকায় শিক্ষক হিসেবে তার খুব সুনাম আছে। চন্দ্রমাস্টার আর ভাবলেন না ,এভাবে চুপচাপ বসে সব দেখা যায়না। নিজের বন্ধু ও প্রতিবেশী সুদীপকে নিয়ে চলে গেলেন ভ্যাটের কাছে।
‘কি হল বল তো, কি করতে চাইছিস তুই ?’ সুদীপের গলায় বিস্ময় ।
-কি করব বুঝতে পারছিনা। কিন্তু এ তো চোখে দেখা যায় না। মেয়েটা মনে হচ্ছে বেঁচে আছে।
-সে তো দেখেছি। কিন্তু থানা-পুলিশের ঝামেলায় জড়াস না রে চন্দ্র। ফেঁসে যাব। রেপ কেস।
-তা বললে হয়! মেয়েটাকে এভাবে পড়ে পড়ে মরে যেতে দেব ?
-কি করবি তবে?
-চল, বলছি।
                  দুজনে গিয়ে হাজির হলেন জঞ্জালের স্তুপে। তখনও দর্শকসংখ্যা নেহাত কম নয়। মুখরোচক আলোচনা চলছে, ঘৃণায় তাদের দিকে একটা জ্বলন্ত দৃষ্টি ছুড়ে দিয়ে, পাশের চায়ের দোকান থেকে বোতলে করে একটু জল নিয়ে এলেন চন্দ্র। তারপর মেয়েটার পাশে বসে একটু একটু করে মুখে চোখে জলের ঝাপটা দিতে লাগলেন। ওর নিজের মেয়েও তো প্রায় এই বয়সীই, এমনি যদি ওর নিজের মেয়েটার হত? মেয়েটার কপালে হাত রাখলেন চন্দ্র, জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে, সারা শরীরে যন্ত্রণার ছাপ। জল দিতেই একটু যেন নড়ে চড়ে উঠল মেয়েটা। চন্দ্র বললেন,‘এই মেয়ে, তোর নাম কি? তোর কি হয়েছে?উঠে বসতে পারবি?’
                মেয়েটা গোঙানির মত একটু শব্দ করল। তারপর অস্ফুটে বলে উঠলো ‘পানি, পানি’। চন্দ্রমাস্টার মেয়েটার মাথাটা পরম মমতায় নিজের কোলে তুলে নিলেন ।ততক্ষণে আর একটা জলের বোতল নিয়ে এসেছে সুদীপ। সেই বোতল থেকে একটু একটু করে জল ঢেলে দিতে লাগলেন মেয়েটার ঠোঁটের ফাঁকে, তখনও সেখানে রক্ত শুকিয়ে রয়েছে। মেয়েটা অতিকষ্টে একটু ঠোঁট ফাঁক করে অল্প জল খেল, তারপর আবার যন্ত্রনায় কঁকিয়ে কেঁদে উঠল,  চোখের কোন দিয়ে দু’ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল,রক্ত-ধুলো-ময়লার মধ্যেই।
                ‘কোথায় যন্ত্রণা রে তোর মেয়ে?’, বলতেমেয়েটা নিজের নিম্নাঙ্গের দিকে একটা হাত অল্প তুলে দেখাল। লজ্জায় মাথা নিচু হয়ে গেল চন্দ্র-সুদীপের, সব বুঝতে পারলেন।হঠাৎ মেয়েটা কেঁদে উঠল ‘আম্মা, আম্মা’ করে, তারপর আবার বেহুঁশ হয়ে গেল।আস্তে আস্তে ওরা মেয়েটাকে আবার ওখানেই শুইয়ে দিলেন, চারপাশে ভ্যাটের দুর্গন্ধ।কিন্তু কি করা যাবে? চারপাশের মানুষগুলো তখন একটু তফাতে। ওদেরও কি লোলুপ দৃষ্টি,যেন চোখ দিয়ে খাচ্ছে সব।পারলে ওরাও ছিঁড়েখুঁড়ে খেত মেয়েটাকে। পারেনি, সুযোগ পায়নি বলে। মেয়েটার যে এই দশা করেছে,সেই নরপিশাচটার থেকে,আলাদা কিছু নয়। ঘৃণাভ’রে ওদের দেখে,চন্দ্রমাস্টার উঠে পড়লেন। ‘চল রে সুদীপ, থানায় যেতে হবে। একটা এফআইআর করা দরকার।‘
                (বাকিটা জানতে গল্পটা পুরো পড়তে হবে)

7 October 2019

তেরো তারিখ শুক্রবার

সৌরদীপের অফিস একটা প্রাচীন বিশাল সরকারি বাড়িতে।সবাই বলে ‘লালবাড়ি’। বাড়িটার  এখন সম্পূর্ণ রিনোভেশন চলছে। সবকিছু কালের যাত্রায় আজ জীর্ণ,ভঙ্গুর। তাই ভেঙেচুরে সারানোর সঙ্গে সঙ্গে, পুরনো ঐতিহ্যবাহী বাড়িটাকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচানোরও একটা চেষ্টা চলছে।এ এক বিশাল কর্মযজ্ঞ। বেশিরভাগ অফিসই অন্য বাড়িতে সরানো হয়ে গেছে, মাত্র কয়েকটা অফিস এখনো কোনরকমে টিমটিম করে চলছে। তার মধ্যে সৌরদীপদের এডুকেশন ডিপার্টমেন্টও আছে। চারিদিকে ঠকঠকাঠক ভয়ানক শব্দের মধ্যেই, কাজ করে চলেছে গুটিকয়েক মানুষ । অবশ্য সকলেই নতুন ঝাঁ চকচকে অফিসে শিফ্ট হবার দিন গুনছে। ক্যান্টিন,টি -স্টল  সবই প্রায় বন্ধ। বিশাল বাড়িটাকে এখন আর চেনাই দায় ,চারদিকে ভাঙা রাবিশ, কড়ি-বরগা-দরজা-জানলা, লোহার গ্রিল, পুরোনো ফার্নিচার ,নানা রকম জিনিসপত্র, হাবিজাবি সব ভর্তি।
 সেদিন একটু তাড়াতাড়িই বাড়ীর পথে পা বাড়িয়েছিল সৌরদীপ।কাল শনিবার ,পরশু রবি, পরপর দুদিন ছুটি। ভেবেছিল সুচেতাকে নিয়ে ঘুরে আসবে বর্ধমানে নিজেদের দেশের বাড়ি থেকে, দুদিনের জন্য। সবে বাড়ি ফিরে জুতোটা খুলে, ঘরে ঢুকেছে, অমনি ফোন। ওরই কলিগ তনু। ‘কিরে, কি হলো আবার?’, সৌরদীপের মনে শঙ্কা। আগে বেরিয়ে পড়েছে বলে বস আবার গাল পাড়ছে না তো! তনুর গলায় তখন উৎকণ্ঠা। ‘শোন, একটা ব্যাপার হয়ে গেছে ।সকাল থেকে সরখেলবাবুকে দেখেছিলি তুই?’ ‘না, মানে একবার মনে হচ্ছে দেখেছিলাম।কেন কি হয়েছে?’ ‘আরে সেটাই তো, আমিও তো দেখেছি সকালে, টয়লেটে যাবার  সময়।‘ ‘হ্যাঁ,তো কি হয়েছেটা কি,বলবি তো?’ সৌরদীপের গলায় উদ্বেগ। ‘আর বলিস না।সরখেলবাবুকে পাওয়া যাচ্ছে না।‘ ‘পাওয়া যাচ্ছে না! মানে?’ ‘মানে বলছি। তুই একবার এখনই অফিসে ফিরে আয়।‘ ‘কি?আবার এক ঘন্টা বাস জার্নি করে অফিস যাব! ইয়ার্কি পেয়েছিস?’ ‘ না রে,  কেসটা সিরিয়াস ।সবাই খুঁজছে, চলে আয় তাড়াতাড়ি’, বলে ফোনটা কেটে দেয় তনু।
সৌরদীপের মেজাজটা খিঁচড়ে যায়। কাল সকালে বর্ধমান যাবার বাস ধরার আছে। গোছাগুছি সব বাকি। এর মধ্যে আবার কি এক উটকো ঝামেলা হল! কিন্তু তনুর গলায় কিছু একটা ছিল, একটা অশুভ ইঙ্গিত ।মনটা কুডাক দিল সৌরদীপেরও। কি হল অফিসে,অদ্ভুত কান্ড! সরখেলবাবুকে  পাওয়া যাচ্ছে না কেন?কোথায় গেলেন অফিস থেকে! এই তো সামনের মাসেই ওনার রিটায়ারমেন্ট। নিপাট, অমায়িক ভদ্রলোক, সাতে-পাঁচে থাকেন না, পার্টি -পলিটিক্সের ধার ধারেন না, চাঁদাতে না বলেন না, চায়ের পয়সা বাকি রাখেন না, অযথা অফিস কামাই করেন না এমনকি চেয়ারে বসে ঢোলেনও না।শুধু একটাই সখ ভদ্রলোকের- খুব গ্যাজেট ভালোবাসেন।প্রায়ই নতুন কিছু না কিছু জিনিস এনে সবাইকে দেখান।তা সে স্মার্ট ওয়াচই হোক , নতুন ক্রেডিটকার্ড সাইজ মোবাইল  বা ম্যাগনেটিক পাজল্।সেই সরখেলবাবু বেপাত্তা!
 আধঘন্টাতেই উল্টোদিকের বাসে চেপে, অফিসে পৌঁছে যায় সৌরদীপ। গিয়ে দেখে এলাহি কান্ড। অফিসে ভেঙে পড়েছে সমস্ত ডিপার্টমেন্টের লোকজন।বস উৎকন্ঠিত হয়ে এদিক ওদিকে ছুটে বেড়াচ্ছেন আর ফোন করছেন। সেকশনাল হেড তো থানায় ফোন করেছেন ,সবাইকে বলছেন ’একটু খুঁজে দেখুন না, ভদ্রলোক কোথায় গেলেন!’ খোঁজা তো যথেষ্ট হয়েছে গত এক-দেড় ঘন্টায়। সৌরদীপ চলে গেল ওনার চেয়ারের কাছে। চেয়ার থেকে ঝুলছে ওনার ব্যাগ, যেমন রোজ ঝোলে । টেবিলের ওপর ওনার চেনা টিফিন ক্যারিয়ারটাও  দিব্যি সাজানো  রয়েছে। তার পাশে খোলা রয়েছে ওনার ফাইলপত্র , এমনকি ফাইলের উপর ওনার পেনটাও খোলা অবস্থায় পড়ে রয়েছে।বোঝাই যাচ্ছে ,হঠাৎ কোন কারণে উঠে গিয়েছিলেন। সব যেমনকার তেমন আছে,শুধু মানুষটাই নেই।অবাক কান্ড।
সবাই বলাবলি করছিল, সকালে যেমন আসেন তেমনটিই এসেছিলেন, ঠিক দশটায়, ইন সাইনও করেছেন। গেটে দুজন দারোয়ান সবসময় থাকে।তারাও ওনাকে নেমে যেতে দেখেনি। ওরা তো প্রত্যেককে চেনে, নাম জানে ।এখন লোকজন কমে যাওয়ায়, ওদের পক্ষে হিসেব রাখা আরো সহজ হয়েছে।তাহলে সরখেলবাবু গেলেনটা কোথায়? অফিসের প্রতিটা ঘর খোঁজা হয়েছে, প্রতিটা বাথরুমও , এমনকি স্টোররুম ,রেকর্ডরুম পর্যন্ত বাদ যায় নি। কোথাও নেই সরখেলবাবু। সবাই সবদিক খুঁজেছে,ওনার মোবাইলে ফোন করলে খালি বেজে যাচ্ছে ,সবার মনে উৎকণ্ঠা। এদিকে পুলিশ এসে গেছে, জয়েন্ট সেক্রেটারিও হাজির,  মিসিং ডায়েরিও করা হয়েছে।
 হঠাৎ ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে ছুটে আসে পিওন তপা।চিৎকার করে বলে ‘পাওয়া গেছে। সবাই এদিকে এসো।‘ ওর দেখানো আঙুলের দিকে লক্ষ্য করে, সবাই হুড়মুড় করে ছুটে চলে। সিঁড়ি দিয়ে নামার বদলে উপরে উঠতে থাকে তপা।আরে! উপরে কেন!ওখানে তো কাজ চলছে রিনোভেশনের। লাল রিবন দিয়ে ঘেরা,ডেন্জার ট্যাগও লাগানো রয়েছে। ওখানে কি করতে গেছলেন উনি! সিঁড়িটা ঘোরার মুখেই পাওয়া যায় সরখেলবাবুকে। মাটিতে বসে আছেন ,কিছু পুরোনো ফার্নিচার,হাবিজাবির মধ্যে, বিস্ফোরিত চোখ। বোঝাই যাচ্ছে দেহে প্রাণ নেই।উল্টো দিকের দেওয়ালে টাঙানো একটা বহু পুরোনো ,বন্ধ গ্র্যান্ড ফাদার  ক্লকের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন তিনি। যেন খুব ভয় পেয়েছেন, বা শক পেয়েছেন কিছু দেখে।ডাক্তার এসে দেখে গেল ,বললো হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যু। সৌরদীপ অবাক হয় ,সব ঠিক যেন স্বাভাবিক নয়,ও কিছু একটা  রহস্যের আঁচ পায়।এদিকে সবার মধ্যে ফিসফাস চলতে থাকে, এত জায়গা থাকতে, নিজের চেয়ার ছেড়ে, এখানে কি করছিলেন সরখেলবাবু, কারও কাছেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হয় না।
(রহস্যের জাল বিস্তার জানতে পুরো গল্পটা পড়তে হবে)