মানিকতলার মদেরগলি বস্তি অঞ্চল। পাশেই একটা বন্ধ রঙ কারখানার পাঁচিল, রাত নামলেই সেখানে মদ-জুয়াসহ নানা অসামাজিক কাজকর্ম শুরু হয়ে যায়। সেখানেই ঘুপচি অন্ধকারে, নর্দমার অস্বাস্থ্যকর দুর্গন্ধে, বাস করে কয়েকটা গরিব পরিবার।
শ্যামল দাস ভ্যান চালায়। ওখানেই একটা দরমার ছোট্ট ঘরে একমাত্র ছেলে অরুনকে নিয়ে ও থাকে। শ্যামলের বউ মারা গেছে বেশ ক'মাস হল। কি রোগে মরেছে, তা অবশ্য কেউ জানে না। খুব জ্বর হত, কাশি হত, সঙ্গে রক্তও উঠত। চিকিৎসার জন্য শ্যামল বৌটাকে নিয়েও গিয়েছিল হাসপাতালে। কিন্তু বেড নেই বলে, ওরা বাইরেই ফেলে রেখে দিয়েছিল বেশ ক'দিন। সেভাবে কোন চিকিৎসাই হয়নি। তারপর যা হয়, আর কি। একদিন রাতে শেষে শ্বাসকষ্ট শুরু হতে, অবশেষে ভেতরে ওয়ার্ডে বৌটার ঠাঁই হয়েছিল। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরী হয়ে গেছে, আর বাঁচানো যায়নি।
ছেলেটার তখন মাত্র তিন কি চার বছর বয়স। সেই থেকেই বড় কষ্টে মানুষ। শখ-আহ্লাদ তো দূরের কথা, ছেলেটাকে কোনদিন ভাল করে খেতে, পরতে পর্যন্ত দিতে পারেনি শ্যামল। অথচ ওর সরল নির্ভীক চোখে তখন অনেক প্রশ্ন, অনেক স্বপ্ন।
‘বাবা, বাবা ,ওই পাঁচিলটার ওপারে কি আছে?’
‘পাঁচিলের ওপারে? ওখানে সব বড়লোকদের বাড়ি আছে। বড় বড় গাড়ি আছে ,অ—-নে---ক টাকা আছে।‘
‘আমি যাব ওখানে ।‘
‘না বাবা, ওখানে আমাদের যাওয়া মানা।‘
‘কেন বাবা, আমরা কি করেছি?’
‘আমরা যে গরিব লোক। আমরা খেতে পাই না, ময়লা ছেঁড়া জামা কাপড় পরি,ঝুপড়ি ঘরে থাকি।‘
‘সেই জন্য?’
‘হ্যাঁ, বাবা। তাই সরকার পাঁচিল তুলে দিয়েছে। বড়লোক আর গরিব লোকদের আলাদা করে দিয়েছে।‘
‘আমরা কোনদিন বড়লোক হতে পারব না?’
‘কি জানি? আমি তো পারলাম না। তুই কি পারবি ?’
‘হ্যাঁ বাবা, আমি বড় হয়ে অনেক বড়লোক হব, ঠিক তোমার মত।‘
‘দুর বোকা, সে বড়লোক নয় রে। আমি বলছি অনেক টাকা থাকলে যে বড়লোক হওয়া যায়, তার কথা।‘
‘অ---নে---ক টাকা?’
‘হ্যাঁ, অনেক।‘
‘আমারও অনেক টাকা থাকবে। আমিও বড়লোক হব।‘
‘পারবি? ঠিক পারবি?’
‘হ্যাঁ। আমি না পাঁচিলটা টপকে ওপারে যাব। ওপারে কি আছে আমি দেখব।‘
‘না রে অরুণ, ওপারে যেতে দেবে না আমাদের। ওপারে আকাশ ছোঁয়া বাড়ি, পাখির মত হাওয়া গাড়ি, সুন্দর সুন্দর জামা কাপড় পরা লোকজন,ফুলের বাগান ,কত দোকানপাট,মনোহারি সব ব্যাপার। আমাদের ঢুকতেই দেবে না।‘
‘কিন্তু আমি ঠিক যাব বাবা, তুমি দেখো। একদিন রাতে আমি পাঁচিলটা টপকাবই, কেউ দেখতে পাবে না।‘
‘তুই অত উঁচু পাঁচিল টপকাতে পারবি? ওরা যদি দেখে ফেলে? গুলি চালায়? যদি তোকে ধ’রে খুব মারে? যাস না অরুন।’
‘আমার গায়ে গুলি লাগবেই না। এক লাফ দিয়ে নেমেই ছুট লাগাব। ওরা ধরতেই পারবে না।‘
‘মনে হচ্ছে, তুই পারবি রে। একটু বড় হলে তবে চেষ্টা করিস।‘
বাবা-ছেলে উদাস ভাবে পাঁচিলের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে একসঙ্গে কত কি আকাশ পাতাল ভাবে, কত স্বপ্ন দেখে।
এইভাবেই দিনগুলো চলছিল। একদিন পাশের রামকৃষ্ণ মিশনের সন্ন্যাসীরা, বস্তিতে কিছু নরনারায়ন সেবার কাজে এসেছিলেন। হঠাৎ অরুনের দিকে ওদের চোখ পড়ে গেল। অরুন তখন একটা পুরোনো কাগজের ঠোঙা খুলে মন দিয়ে পড়ার চেষ্টা করছে। দেখেই এক মহারাজ ওকে কোলে তুলে নিয়েছিলেন। শ্যামলের অবস্থা জেনে, ওরা অরুনের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন। ঐ মহারাজই ছিলেন পাশের রামকৃষ্ণ মিশন স্কুলের হেডস্যার। তিনি জেদ করে অরুণকে স্কুলে ভর্তি করে নিলেন, বিনা পয়সায়। শ্যামলের বুক থেকে যেন একটা বড় দুশ্চিন্তার বোঝা নেমে গেল। অনেক কষ্টে জমানো টাকাগুলো দিয়ে ও পরের দিনই, অরুণকে স্কুলের জামা-প্যান্ট-ব্যাগ-বই-খাতা সব কিনে দিল। অরুন স্কুলে যেতে শুরু করল। শ্যামল দু'চোখ ভরে দেখত, ওর কোন বাজে নেশা নেই, ছেলেটাই ওর সব।
বেশ কয়েক বছর পরের কথা। মহারাজের আশাকে সত্যি প্রমাণ করে, অরুণ মাধ্যমিকে নবম হল। ভ্যানওয়ালার ছেলের এই সাফল্যে , একটা বস্তিঘরের ছেলের না হারিয়ে গিয়ে জীবনে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার বীরত্বে অভিভূত হয়ে সমস্ত সবাই ওকে আনন্দে জড়িয়ে ধরলেন। খুশি হয়ে, মহারাজই ওকে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ভর্তি করে দিলেন।
শ্যামল আবেগে বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। ওদের বস্তিতে আগে কখনো এমন হয়নি। ভ্যান চালিয়ে আর ক'টাকা হয়! ধারফের করে, নানা জায়গা থেকে সাহায্য চেয়ে ও ছেলের উচ্চশিক্ষার জন্য টাকা জোগাড় করতে লাগল। তবে শরীরেও আর সেই আগের মত জোর নেই। সারাক্ষণ ঝিমুনি লাগে। মহারাজ জানতে পেরে শ্যামলকে আস্বস্ত করলেন, অরুণের সমস্ত খরচ ওরা বহন করবেন। শ্যামলের ধড়ে প্রাণ এল।
'অরুন দাস কে?'
'আমি ফাদার।'
'তুমি মাধ্যমিকে নবম হয়েছ? কনগ্রাচুলেশন্স।'
'থ্যাঙ্ক ইউ স্যার।'
'তোমার নম্বরই কলেজের নতুন স্টুডন্টদের মধ্যে সেরা। এই কলেজেও রেকর্ড হায়েস্ট!'
'ও, তাই বুঝি?'
'হ্যাঁ। কে পড়ান তোমায়?'
'কেউ না স্যার। নিজেই পড়ি।'
'বাহ্। তা তোমার বাবা কি করেন?'
'বাবা তো ভ্যান চালান।'
'অ্যাঁ! ভ্যান চালান!'
'হ্যাঁ স্যার।'
'আর মা?'
'মা তো অনেক ছোটবেলাতেই মারা গেছেন।'
'ও আচ্ছা, বোসো। আমি তোমার স্কলারশিপের ব্যবস্থা করব। তুমি আরো পড়বে তো?'
'হ্যাঁ স্যার, নিশ্চয়ই পড়ব। আমার বাবাও তো তাই চান।'
'কি চান?'
'এই যে আমি অনেক বড় হই, সফল হই।'
'বাহ, খুব ভাল। আমরাও সবাই তাই চাই।'
'থ্যাঙ্ক ইউ স্যার। আমিও আপ্রাণ চেষ্টা করব।'
অরুন চিরকালই ভাল রেজাল্ট করে আসছিল, এবারেও তার কোন ব্যতিক্রম হল না। ওর পড়াশোনার আগ্রহ আর উন্নতি দেখে, ফাদার আর কয়েকজন স্যার মিলে ওকে স্পেশাল কোচিংয়ে ভর্তি করে দিলেন। ও ও ভীষণ পরিশ্রম করতে লাগল। মেধা আর অধ্যাবসায়ের জোরে, সকলের সব প্রত্যাশা পূর্ণ করে, ও ইঞ্জিনিয়ারিংয়েও চান্স পেল। ফাদার ওকে শিবপুর বিই কলেজে ভর্তি করে দিলেন। অরুণের বাড়িতে ওর বাবার সঙ্গে দেখা করতে এসে, ফাদারের তো চক্ষু স্থির। এরকম চরম দরিদ্র, নোংরা, ঘিঞ্জি বস্তির ঘরে এরকম প্রতিভাবান একটা ছেলে থাকতে পারে! উনি অবাক হলেন অরুণের জীবন সংগ্রামের কথা জেনে। তবে মহারাজ এ খবরটা জেনে যেতে পারেননি, তিনি মাত্র ক'মাস আগেই দেহত্যাগ করেছিলেন।
'অরুন, তুমি এত তাড়াতাড়ি প্রোগ্রামিংগুলো এত নির্ভুল কর কি করে বল তো!'
'স্যার করে করে হয়ে গেছে। মাথার ভেতর ওগুলো যেন ভেসে আসে।'
'হুঁ, তা তুমি কটা ল্যাংগুয়েজ জান?'
'দশটা স্যার।'
'অ্যাঁ? কি কি শুনি?'
'সি, সি প্লাস, জাভা, জাভিস্ক্রিপ্ট, পিএইচপি,রুবি,অবজেক্টিভ সি,পাইথন,এসকিউএল আর নোড জেএস স্যার'
'বাপরে। এর সব তো এখনো পড়ানোই হয়নি। তুমি শিখলে কি করে?'
'লাইব্রেরী থেকে বই নিয়ে পড়ে স্যার।'
'তুমি তো এই সেমিস্টারেও টপার হবে দেখছি। তা কোথায় থাক?'
'মানিকতলায় স্যার।'
'আরে মানিকতলায় তো আমিও থাকি। তোমার বাড়ি কোন পাড়ায়?'
'বাড়ি বা পাড়া কোনটাই নয় স্যার। আমি মদেরগলি বস্তিতে থাকি।'
'অ্যা!'
আরো দু'বছর পরের কথা।অনেক লড়াইয়ের শেষে, অরুণ আজ কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেছে। কলেজের কনভোকেশন থেকে ও সেদিন অনেকগুলো প্রাইজ নিয়ে ঘরে ফিরেছে। আজ ও নিজেকে প্রমাণ করতে পেরেছে। বাঙ্গালোরে বিশাল মাইনের একটা চাকরিও পেয়েছে, ক্যাম্পাস ইন্টারভিউ থেকে। ওরা বিদেশে পাঠিয়ে দেবে ক’মাসের মধ্যেই। আরো বিভিন্ন কোম্পানি থেকে বিভিন্ন লোভনীয় অফার আসছে, কিন্তু অরুণ সব অফার ফিরিয়ে দিয়েছে।
‘কেমন রেজাল্ট হল বাবা? পাস করেছিস?’
‘হ্যাঁ বাবা, কলেজে আমি টপার।‘
‘বা বা বা, এইতো চাই। আহা, আজ যদি তোর মা বেঁচে থাকত! তা কোন চাকরি টাকরি পেলি নাকি রে?’
‘পেয়েছি তো অনেক। কিন্তু করবো না।‘
‘করবি না! তাহলে কি করবি?’
‘দেখি, আমি অন্য কিছু করব ভাবছি ।‘
‘দ্যাখ, চাকরি পেলে সংসারটা ভাল ভাবে চলত। এত পড়াশোনা করলি। কত কষ্টে ধার দেনা করে তোকে পড়ালাম। এবার অন্তত—’
‘তুমি চুপ করো তো বাবা। জানো না, তোমার বেশি কথা বলা বারণ?‘
‘ছাড় তো বারণ। কোন ডাক্তার আমাকে আর ভাল করতে পারবে না।‘
‘কেন এরকম বলছ, বাবা। তোমাকে আমি ভাল করে তুলবোই।‘
‘না রে, কেউ পারবি না। তোর মার অসুখ আমারও হয়েছে, আমি জানি।‘
‘না, তুমি কিচ্ছু জানো না। তুমি ছাড়া আমার আর কে আছে, বাবা?‘
‘অরুন, একটা কথা বলবি?’
‘বলো।‘
‘তুই চাকরি করবি না কেন রে?’
‘চাকরি করে কি হবে? সেই তো একই কাজের গন্ডিতে আটকে থাকা আর খালি ক’টা টাকা রোজকার করা। কিন্তু আমার স্বপ্ন? সেটার কি হবে ?’
‘তাহলে কি করবি রে? বলনা। আমার তো আর বেশিদিন নেই, মরার আগে জেনে যাই।‘
‘আমি একটা স্কুল খুলব, ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে। বস্তির ছেলেমেয়েদের ফ্রিতে পড়াবো। কাউকে চায়ের দোকানে বা ইটভাঁটায় খাটতে দেব না, বরং স্কলারশিপ দেব। তারা সবাই পড়তে আসবে আমার স্কুলে। অনেক অনেক বড় হবে।‘
‘তাই? তাহলে তো দারুন ব্যাপার হবে রে। কিন্তু সে তো অনেক টাকার ব্যাপার। তুই পারবি তো? অত টাকাই বা পাবি কোথায় ?’
‘সে ঠিক জোগাড় হয়ে যাবে। তুমি ভেবোনা ।‘
‘তারপর কি করবি?’
‘তারপর? তারপর আমরা সবাই মিলে পাঁচিলটা ভেঙে ফেলব। এটাই আমাদের প্রথম কাজ হবে, আমার অনেক দিনের স্বপ্ন ।‘
‘পারবি ভাঙতে? পারবি?’
‘পারতেই হবে বাবা। নাহলে ওপারে যাব কি করে?‘
‘সবাইকে নিয়ে ওপারে যাবি অরুণ, এই বস্তির সবাইকে নিয়ে।‘
‘হ্যাঁ, বাবা। সবাইকে নিয়ে যাব। তোমাকেও।‘
‘আমাকেও? কিন্তু আমি কি অত দিন---’
‘আমাদের কলেজের বেশ কিছু প্রফেসর আর এক্স স্টুডেন্টরা রাজি হয়েছে। তারা আমার সঙ্গে থাকবে। কিছু এনজিও স্পন্সর করতেও চাইছে। আমার অনেক বন্ধুও সাহায্য করবে বলেছে। আমি স্কুলটা করবোই বাবা। আর মার নামে একটা ফাউন্ডেশনও করব। ফ্রিতে মেডিকেল ইনসিওরেন্স করে দেব বস্তির সবার জন্য। বিনা চিকিৎসায় কেউ আর মরবে না। পরে একটা মাইক্রোফিন্যান্স স্কিম আনারও প্ল্যান আছে। টাকা পয়সার অভাবে যাতে কারো স্বপ্ন ধ্বংস না হতে সারে।'
‘অরুণ, মনে হয় এবারে আমি শান্তিতে চোখ বুঁজতে পারব। আর আমার কিচ্ছু চাওয়ার নেই।‘
বাবা-ছেলে দুজনের চোখই খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। পাঁচিলটা ভাঙতে শুরু করেছে, একদিন ওটা থাকবেই না। ওরা এক সঙ্গে স্বপ্ন দেখতে থাকে।
আমি আবেগ ও অনুভূতিপ্রবণ,ভাবুক আর সৃষ্টিশীল।জীবনের চলা,ওঠাপড়া আর অভিজ্ঞতা নিংড়োনো এই সব লেখা ।এ আমার পাগল মনের নিঃশেষিত প্রকাশ।
8 March 2020
3 March 2020
দিবানাপন
বিতানের টিনএজ হার্টথ্রব শ্রাবণী, ওর জন্য বিতান একেবারে দিবানা । কিন্তু মুখ ফুটে বলার সাহস নেই। শুধু ওকে ফলো করে, ওর চালচলন লক্ষ্য করে। কিন্তু আজ ও এল না কেন? এমনটা তো ও কখনো করে না! বিতান অবাক হল। নিয়মিত মামার কাছে শ্রাবণীকে পড়তে আসতেই হয়, আর তার ফাঁকেই প্রেম। ওর কথাবার্তা, চালচলন সব বিতানের এত ভাল লাগে, যে একেবারে ফিদা হয়ে যায়। ওর মনে হয় ইস্, শ্রাবণী যদি সত্যি সত্যি ওর প্রেমিকা হত! কিন্তু তা যে হবার নয়।
হঠাৎ মামা এসে পড়ায় ওর টনক নড়ল। একথা সেকথার পর শ্রাবণীর প্রসঙ্গ উঠল। ওর খোঁজ নিয়ে আসতে মামাই বিতানকে বলল, ‘সামনে ওর পরীক্ষা,পড়তে আসল না, ফোনও ধরছে না কেন?’ ও মামাকে চুপ করিয়ে দিল।
সব কাজ সেরে, সন্ধেবেলায় শ্রাবণীর বাড়ি গেল বিতান। ওর বাবা ডাক্তারের কাছে, আর মা দোকানে গেছে। এরকম অযাচিত সুযোগ কি ছাড়া যায়! কিন্তু ওর বাড়ির কাছে এসে দেখে বাড়ীটা একেবারে অন্ধকার, একটা মাত্র ঘরে একটা টিমটিমে ল্যাম্প জ্বলছে। কেউ নেই নাকি! দ্বিতীয়বার কলিংবেল বাজানোর পর, দরজা খুলে শ্রাবনীই বেরিয়ে এল, চোখমুখ ফোলা, অন্যরকম।যথাসম্ভব নিজেকে স্বাভাবিক রেখে, অবাক হয়ে ও ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল, ’কি ব্যাপার বিতান, তুই?’, 'মামা পাঠিয়েছে, তুই পড়তে যাচ্ছিস না!’ ,বলতে শ্রাবণী চুপ করে রইল, কিছু বলতে গিয়েও যেন বলতে পারল না। শ্রাবণীকে শুকনো লাগছিল, কোন কারণে ও যেন বিধ্বস্ত। এই অন্ধকারে পরিবেশটা কেমন অস্বস্তিকর লাগছিল বলে, বিতান আর বেশি কথা না বাড়িয়ে মামার দেওয়া ক্যাডবেরিটা ওকে গিফ্ট করে চলে এল। ও অবশ্য খেতে চাইছিল না।
পরদিন বিতানের ঘুম ভাঙল মার ডাকে। কাঁচা ঘুম ভেঙে যাওয়ায় খাপ্পা হয়ে, একচোট হাঁকডাক করতে যাবে, তখনই উত্তেজিতভাবে মা বলল, ‘ওরে ওঠ রে, সর্বনাশ হয়েছে। এইমাত্র খবর পেলুম, শ্রাবণীর কি একটা হয়েছে। বোধহয় মেয়েটা আর নেই রে।‘ ব্যাপারটা বুঝতে চোখ কচলে, কটা হাই তুলতে হল বিতানকে, তারপর জামাটা গলিয়েই ছুটল। ওদিকে মামা ঘুমোচ্ছে। নানা ভাবনা চিন্তা এসে ওর মাথায় দানা বাঁধতে লাগল, মা আজ মশলা বাটবে কিসে? সেফটিক ট্যাঙ্ক সাফ করাই বা কবে হবে?
যাহোক, ঘটনাস্থলে এসে দেখে, সারা পাড়ার লোক ঝেঁটিয়ে জড়ো হয়েছে। ঢুকতে গিয়েই পুলিশের ব্যারিকেডে আটকা পড়তে হল। এর ওর মুখে শোনা গেল, শ্রাবণী নাকি বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেছে। ওর বাবা মা রাতে ফিরে এসে, দরজা খুলে দেখে এই কান্ড। কাল সন্ধেয় ওর সঙ্গে শেষ কথাবার্তা আর আজ এই মৃত্যু আর আনুসঙ্গিক ছোটখাটো নানা ঘটনা ঘোরালো রূপে বিতানের মনে হানা দিতে লাগল, বারান্দায় ক্যাডবেরির প্যাকেট পড়ে কেন?দরজা বাইরে থেকে কে বন্ধ করল? অবশ্য তার সঙ্গে আর একটা বিষয়ও খুব চিন্তায় ফেলল, মামাও কাল থেকে গায়েব, গেল কোথায়? এই ঘটনার সঙ্গে কি তবে মামারও কোন যোগসূত্র রয়েছে?
তখনই সব মনে পড়ে গেল বিতানের, সেদিন মামার ঘরে ও হঠাৎ ঢুকে পড়েছিল। আসলে নানা ছুতোয় শ্রাবণীর সঙ্গে মিশতে চাইত তো, তাই শ্রাবণী পড়তে এলে বিতানের আর পড়ায় মন বসত না, খালি ওর পেছনেই ছুঁকছুঁক করত। সেদিনও ওরকম খবরের কাগজ খুঁজতে মামার ঘরে ঢুকে ওর ইচ্ছে ছিল, ওর নতুন মোবাইলে লুকিয়ে শ্রাবণীর একটা ছবি তুলবে। কিন্তু ‘আজকের কাগজটা তোমার কাছে আছে?’, বলতে বলতে পরদা সরিয়ে ঘরে ঢুকতেই দেখে মামা আর শ্রাবণী একে অপরকে জড়িয়ে ধরে আছে আর চুমু খাচ্ছে। দৃশ্যটা দেখেই ওর পা থেকে মাথা অবধি রাগে ঘৃণায় জ্বলে যাচ্ছিল। বিতানকে দেখেই ওরা ছিটকে দুজনে দু’দিকে সরে গেল আর আবার হোমটাস্কের আলোচনা শুরু করে দিল। আর বিতানও যেন কিছু দেখেনি এমন ভাব করে, অন্য দিকে ঘুরে বইয়ের তাকটা ঘেঁটে ফিরে গেছল। কিন্তু সেই ঘটনাটা ও কোনদিন ভুলতে পারেনি, ওর বুকটা যন্ত্রনায় দুমড়ে মুচড়ে গেছল। মামাও আর সে নিয়ে ওকে কখনও কিছু বলেনি, হয়ত ভেবেছে ও কিছু দেখেনি।কিন্তু সেই থেকে বিতান দুজনকেই ঘৃণা করতে শুরু করে দিয়েছিল।শ্রাবনীকে যে ও প্রাণ দিয়ে ভালবাসত, মনে মনে এত চাইত, তা ওরা কেউই জানত না। কিন্তু বিতান ওদের দুর্বলতার কথা জেনে গেল সেদিন, আর সেই সঙ্গে এটাও, যে শ্রাবনী অন্য কারও। সেই দিন থেকে ওর একমাত্র ধ্যানজ্ঞান হয়ে গেল, দু’জনের ওপর কি করে প্রতিশোধ নেওয়া যায়।
শ্রাবনীকে পোস্টমর্টেম করলে জানা যাবে, টিকটিকির বিষে মৃত্যু। মাছের পেটে মরা টিকটিকি ভরে মাটিতে পুঁতে, তারপর নানা কায়দায় তৈরী করা বিষ। আর মামা তো উঠোনের পাশের সেফটি ট্যাঙ্কের ভেতরই ঘুমোচ্ছে, আর কোনদিন উঠবে না। আর বিতান?ও এখন পাশের পাঁচতলা ফ্ল্যাটবাড়িটার ছাতের কার্নিস ধরে হাঁটছে। মোবাইলটা বেকার, ঝুপ করে হাত থেকে ফেলে দিল ও।নীচে পড়ে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল ওটা। ওর নিজের পা স্লিপ করলে এবার কি হবে?
2 March 2020
ক্ষতিপূরণ
(১)
‘কি গো মহিনদা, কোথায় চললে এই ভরদুপুরে?’
‘এই একটু বেরোলাম আরকি।‘ হেসে বিগলিত হয়ে উত্তর দেয় মহীন্দ্র। নাইট ডিউটি করে ফিরে যার এখন ঘুমোনোর কথা।
‘তা বেরোও, তবে ওই শ্যামলবাবুর কাছে হত্যে দিয়ে তোমার লাভ হবে না কিছু।‘ রামচাঁদ ব্যঙ্গ করে।
‘কি করে জানলি কিছু হবে না? উনি আমায় কথা দিয়েছেন।‘
‘দুর। ছাড় ওনার কথা। সকাল-বিকেল পঞ্চাশজন লোককে উনি ওরকম কথা দেন।চাকরি হয় কারো?’
‘হবে না কেন? আমার ছেলেটা কি ফেলনা নাকি?’
‘না গো মহিনদা। ফেলনা হতে যাবে কেন? তবে বলছিলাম কি, তোমার ছেলের মত মেট্রিক পাশ তো কত ছেলে ঘুরে বেড়াচ্ছে ।দেখে যাও, কারো চাকরি করে দিতে পারেনি তোমাদের ওই ইউনিয়নের নেতা,খালি মুখে বুকনি ।‘
‘তুই থামবি? আমাকে যেতে দে।‘
‘যাও যাও, টাকাগুলো জলে যাবে, এই সাবধান করে দিলাম কিন্তু। আমাদের কথা তো শুনবে না, মরুক গে যাক।‘
মহীন্দ্র আর কথা না বাড়িয়ে সাইকেলে উঠে প্যাডেল করতে শুরু করে।নাইট ডিউটির ক্লান্তি ওকে জড়িয়ে ধরে। কিন্তু উপায় নেই, আর কদিন পরেই রিটায়ারমেন্ট। ছেলেটার পিছনে লাখ লাখ টাকা খরচ হয়ে গেছে, তবু না হয়েছে পড়াশোনা, না চাকরি।প্রচুর খরচা হলেও, মেয়েদুটোর অবশ্যি বিয়ে দিয়ে দিয়েছে ভালোই। বড় জামাইয়ের ডাম্পার চলে দু’দুখানা ,আর ছোটজন স্কুল মাস্টার। কিন্তু একমাত্র ছেলেটারই কিছু হল না ,ব্যবসাটাও তো ঝুলে গেল। ওদিকে অনেক টাকা পিএফ লোন বকেয়া রয়েছে,বাজারেও ধার। রিটায়ারমেন্টের পরে লাখতিরিশের বেশি কেটেকুটে পাবে না। ওই টাকায় কি করে তিনজনের পেট চলবে, কে জানে ? তারপর কোয়ার্টারও ছেড়ে দিতে হবে, বাড়ি ভাড়া কম করে চারহাজার টাকা মাসে। দুশ্চিন্তায় ঘুম হয়না মহীন্দ্রের। ছেলেটা বদসঙ্গে পড়ে গেল, মদ- জুয়া-আড্ডা-মারামারি কিছুই বাকি নেই,এইসবই করে বেড়ায় সারাদিন। বাড়িতে থাকেই বা কতক্ষণ।
হাতে-পায়ে ধরেছিল শ্যামলবাবুর। ইউনিয়নে ওনার কথাই শেষ কথা, কেউ ঘাঁটায় না ওনাকে। খতরনাক লোক, এক কথাতেই ছেলেটার চাকরি হয়ে যেতে পারে কন্ট্রাকটারের আন্ডারে। শুধু যে টাকাটা চেয়েছেন,সেটা দেবে কি করে মহীন্দ্র?ব্যাঙ্কে যা পড়ে আছে, সব দিয়েও যদি হয়।আজ সে কথাই বলতে যাচ্ছে ভরদুপুরে নেতার কাছে। এই সময় উনি খেতে আসেন বাড়িতে, যদি দশ মিনিট সময় দেন।
‘কিরে মহিন,এনেছিস নাকি?’
‘না শ্যামলদা,মানে ---’
‘আনিসনি তো আবার এসেছিস কেন?তোকে তো সেদিনই বলে দিলাম।‘
‘সে তো বলেছেন,কিন্তু আমি বলছিলাম---’
‘আর কিছু বলতে হবে না রে, এখন যা ।আমার চান খাবার সময় হল।‘
‘শ্যামলদা ,একটা কথা শুনুন। আমি টাকা দিয়ে দেব। এই মাসেই তো রিটায়ার করব,তখনই নয় বাকি --’হাত জোড় করে বলে মহীন্দ্র।
‘থাম, থাম। গোটা রাজ্যের লোক এডভান্স দিয়ে সিট বুক করছে, আর উনি বলছেন পরে দেবেন। যা তো, অনেক ক্যান্ডিডেট আছে ।আগে টাকা তারপর কাজ।‘
‘শ্যামলদা, অতগুলো টাকা জোগাড় করতে পারিনি ।যদি অর্ধেক দিলে----’ অনুনয় করে মহীন্দ্র।
‘তুই যাবি? বলেছিনা, পুরো টাকা চাই। কোন ছাড়াছাড়ি নেই। চাকরি যেন হাতের মোয়া !ফোট এখন।‘
নেতা উঠে পড়েন। দরজার আড়ালে তার নাদুস নুদুস শরীরটা হারিয়ে যেতে দেখে মহীন্দ্র। দরজা বন্ধ হয়ে যায় ওর মুখের উপর। বিরস বদনে ফিরতে হয় মহীন্দ্রকে। ছেলেটার চাকরিটা না হলেই নয় ।রিটায়ার করে গেলে আর কেউ পুছবে না, যা করার এই ক’দিনেই করতে হবে।
(২)
‘কিরে বিক্রম, আজ বাড়ি চললি যে এত আগেই! মুড নেই নাকি?’
‘না দোস্ত ,আসলে একটা কাজ আছে।‘
‘আরে ছোড় তোর কাজ। আর দু’দান খেলে যা না। এবার সিওর জিতবি।‘
‘না রে দিলদার ,বাপটা শালা এ মাসের শেষেই রিটায়ার করে যাবে ।তারপর সেই টাকায় বড় গেম খেলব।যত ধারবাকি আছে সব তখন শোধ করে দেব। বাকি টাকা দিয়ে একটা দোকান দেব ভাবছি। সেই ব্যাপারেই যেতে হবে রে ।‘
‘আরে বাঃ। কিসের দোকান দিবি গুরু। চুল্লুর?’
‘চুপ কর তো।এখন ফালতু ইয়ার্কি ভাল লাগে না।‘
‘আরে না না গুরু।চটছিস কেন?বলছিলাম কি নিজের প্ল্যান্টে একটা হিল্লে করে দিতে পারল না তোর বাপ? এতদিন চাকরি করল আর এটুকু পারল না?’
‘ধুর ,আমার বাপের অত দম থাকলে তো হয়েই যেত।‘
‘তাই তো দেখছি। আবার দেখ কত লোকের চাকরি হয়েও যাচ্ছে।‘
‘কার আবার চাকরি হল রে?’
‘এই তো নকুলদার। দু’মাস হল, বাপমরা কেসে জয়েন করেছে প্ল্যান্টে।‘
‘তাই নাকি? জানি না তো!কিন্তু ওর বাপটা তো কার অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছিল ।‘
‘তুই কিস্যু জানিস না। অ্যাক্সিডেন্টটা হয়েছিল জিটি রোডে, কিন্তু ডেডবডি পাওয়া গেল প্ল্যান্টের ভেতর।‘
‘মানে? সেটা কি করে সম্ভব?’
‘সব সম্ভব গুরু।রাতের বেলায় কত বডি কোথায় কোথায় পাচার হয়ে যাচ্ছে ,আর এ তো লোকাল কেস। পয়সা দিলে কি না হয়! বাপের ডেডবডি রাতারাতি প্ল্যান্টের ভেতর রাস্তার ধারে ফেলে রেখে গেল।‘
‘তারপর? ডিউটির মধ্যে অ্যাক্সিডেন্ট বলে দেখিয়ে দিল?’
‘আর নয় তো কি? তারপর ইউনিয়নের ঝামেলা, গোটা মিলে প্রোডাকশন বন্ধ।এমডি ছুটে এল। রাতারাতি নকুলদার চাকরি হয়ে গেল, বড় ছেলে বলে কথা।‘
‘হুঁ,বুঝলাম। যাই রে ।‘
‘যাচ্ছিস?যা।মন খারাপ করিস না।‘
বিক্রম বাড়ির পথে হাঁটা দিল,বড় অন্যমনস্ক আজ।মাথাটা আগুন হয়ে আছে । এমনও হয়? ও তো এসব জানতই না, কখনো ভাবেওনি। ডেডবডি নিয়ে চাকরি পাবার ষড়যন্ত্র! আর ভাবতে পারেনা বিক্রম।
(৩)
‘কি মহিনদা ,আজও রাতপালি?’
‘হ্যাঁ রে চেঞ্জ করলাম। কাজ ছিল।‘
‘আর তো কালকের দিনটা। তারপরেই তো তোমার ছুটি। রিটায়ারমেন্টের পর বহুৎ ফুর্তি করবে না গো?’
‘ফুর্তি কি বলছিস রে অমিত! ক’টাকাই বা পাব? সব তো দেনা শুধতেই চলে যাবে।‘
‘সে কি গো! সবাইতো গাড়ি-বাড়ি হাঁকাচ্ছে রিটায়ার করে, কত দেশ ঘুরে বেড়াচ্ছে ।আর তোমার এই দশা কেন?’
‘আর বলিস না রে। মেয়ে দুটোর ভাল ঘরে বিয়ে দিতেই সব জমানো টাকা চলে গেল।তার ওপরেও কত ধার হয়ে গেল।ওদিকে ছেলেটা আবার ব্যবসা করবে বলে কত টাকা উড়িয়ে দিল। কি করব বল।‘
‘তোমার ছেলেটা কি করে বলতো মহিনদা ?’
‘কিচ্ছু করে না রে ,শুধু নেশা আর বদসঙ্গে টাকাগুলো উড়িয়ে দিল।‘
‘চাকরি বা ব্যবসা কিছু করে দিতে পারলে না?’
‘চেষ্টা তো অনেক করেছিলাম রে। ব্যবসার জন্য দু’দুবার টাকা দিলাম পিএফ থেকে তুলে। হতভাগা সব টাকাগুলো জলে দিল ।এখন আবার ওষুধের দোকান করবে বলে দু’লাখ টাকা চাইছে। ওই সব টাকাগুলো শেষ করবে রে অমিত।‘
‘নাঃ, তোমার কপালটা সত্যিই খারাপ দেখছি।দিনকাল কিন্তু ভাল নয়,নিজের বাকি জীবনটার জন্য কিছু টাকা হাতে রেখো,সব এভাবে শূন্য করে দিও না।‘
‘সবই তো বুঝি রে,কিন্তু বাপ তো।ছেলেটার কিছু ব্যাবস্থা তো করতে হবে।’
‘দেখ না,বড় সাহেবকে বলে ছেলেটার জন্য চাকরি বাকরি কিছু জোটাতে পার কিনা।‘
‘বলেছিলাম তো কতবার। ওর স্বভাব চরিত্র জেনে গেছে এখন সবাই ।আর কেউ নিতে চায় না।তাছাড়া পড়ালেখাও তো বেশিদূর করল না। কন্ট্রাক্টরের আন্ডারেও এখন তো কত গ্রাজুয়েট ছেলে লেবার খাটছে, আর ও তো শুধু মেট্রিক পাশ ।‘
‘ তা যা বলেছ।‘
মহীন্দ্র গার্ড দিতে চলে যায় গুদাম ঘরের দিকে। সারারাত জাগতে হবে। এত কষ্ট করেও ওর মনে কোন শান্তি নেই। কাল চাকরির শেষ দিন, তারপরেই শেষ চেক পেয়ে যাবে। কিন্তু কি করে চলবে বাকি জীবনটা? ওই ক’টা টাকা তো ছেলেটাই লুটে নেবে, তারপর তাড়িয়ে না দেয় বুড়োবুড়িকে। দুশ্চিন্তায় আজকাল সব সময় অন্যমনস্ক থাকে মহীন্দ্র ।ছেলেটা আজকাল কেমন যেন রেগেমেগে তাকায় ওর দিকে, যেন গিলে খেয়ে ফেলবে ।রিটায়ারমেন্টের শেষ টাকাগুলোর জন্য ওর খুব লোভ, বোঝে মহীন্দ্র।কিন্তু কিই বা করবে,ছেলেকে যে বড্ড ভালবাসে ও। ওর অন্ধস্নেহেই যে ছেলেটা গোল্লায় গেছে, আজকাল বুঝতে পারে মহীন্দ্র,কিন্তু এখন বড় দেরী হয়ে গেছে। টাকাগুলো ফিক্সড করে দিলে বা এলআইসির পেনশন স্কিমে দিয়ে দিলে ,এমআইএস পেত ।ক’দিন খেয়ে পরে বাঁচত। কিন্তু তা কি হতে দেবে রাক্ষসটা? শাসিয়ে রেখেছে ,ওষুধের দোকানের জন্য দু’লাখ টাকা ওর চাই’ই। কিন্তু মহীন্দ্র জানে ,ওষুধের দোকান না ছাই। সব সাট্টা-জুয়ার পেছনে উড়িয়ে দেবে বজ্জাতটা। ওরও মার্কেটে অনেক দেনা হয়েছে,পাওনাদারেরা প্রায়ই আসে বাড়িতে,হুমকি দিয়ে যায়। তাই বাপের টাকার দিকে ওর এত লোভ।তবু যদি এই টাকাটায় ছেলেটার কিছু ভাল হয়,একটু শুধরোয়,এই আশায় আশায় মরে মহীন্দ্র।
(৪)
‘এ কোথায় নিয়ে এলি রে লাল্টু, ভয় করছে।‘
‘ভয় করলে হবে, দোস্ত? কাম সারতে হবে না।‘
‘শেষে ফেঁসে যাব না তো! লোক জানাজানি হয়ে গেলে?’
‘ তার কোন চান্স নেই ,দোস্ত । হারুদার কাজ একদম পরিষ্কার। নো রিস্ক ।‘
‘থানা পুলিশ হলে শেষে ---’
‘এবার কিন্তু বড্ড ফালতু বকছিস। তাহলে এলি কেন আমার টাইম বরবাদ করে ?এত কষ্টে হারুদার ডেরায় আসার গ্রিন সিগনাল পেলাম, আর লাস্ট মোমেন্টে ঝোলাচ্ছিস?’
‘আরে রাগ করছিস কেন লাল্টু? একটু ভয় করছে আসলে। ফার্স্ট টাইম তো ।‘
‘ সুপারি দিতে এসেছিস, অত ভয় পেলে চলবে? কাজ হাসিল হয়ে গেলে তিরিশ হাজার টাকার চাকরিটা তোর বাঁধা ,সেটা দেখ।‘
‘সেইজন্যই তো এলাম।এখানে দিতে হবে বলে বাবার অ্যাকাউন্টের এটিএম কার্ড থেকে পিন জেনে বেশ কিছু টাকা তুলে নিয়েছি, আজ সকালেই।‘
‘কি করেছিস রে। শালা বাবার টাকাতেই বাবার সুপারি। তোর এলেম আছে বলতে হবে ।‘
বলতে বলতেই, ঝুপড়ি ঘরের দরজায় হাজির হয় দুজনে। ‘হারুদা হারুদা’ বলে চাপা গলায় দু’বার ডাকল লাল্টু। কিছুক্ষণ পরে দরজাটা আস্তে আস্তে খুলে গেল, বিস্রস্ত কাপড়চোপড় সামলে একটা কমবয়সী মেয়ে উঁকি দিল ।‘কাকে চাই?’ ‘আমি লাল্টু। হারুদা আসতে বলেছিল।‘ ঘরের ভেতর থেকে কে যেন কিছু বলে উঠল, মেয়েটা দরজা খুলে দিল। দুজনে ঘরে ঢুকে দেখে মদের আসর বসেছিল।কিন্তু ডিল করার সময় হারুন মদ খায় না। গেলাসের বাকি মদটুকু এক ঢোঁকে গলায় ঢেলে দিয়ে হারুন ইশারা করল মেয়েটাকে ।মেয়েটা সব সরিয়ে নিয়ে গিয়ে বিছানাতেই দুজনের বসার জায়গা করে দিল। ‘বল এবার কার সুপারি?’ লাল চোখে হারুন জানতে চায়। ‘ওর বাবার ।নাম মহীন্দ্র দাস।‘ লাল্টু আমতা আমতা করে বলে। ‘বাবার!’ হারুন অবাক হয় ।ওর মত ভাড়াটে খুনিও এ কথায় একটু চমকে উঠল। লাল্টু পুরো প্ল্যানটা হারুদাকে বোঝাযতে শুরু করে ।বিক্রম মাথা নীচু করে বসে থাকে,গলা শুকিয়ে এসেছে ওর, কাজটা ঠিক করছে তো ? বাবাকে মারবে চাকরির শেষ দিনে ,নিজের চাকরি পাকা করতে? ‘নাঃ, এছাড়া আর কোন উপায় নেই। আজই রাতে লাস্ট চান্স। মাস গেলে কড়কড়ে তিরিশ হাজার টাকা মাইনে। ছাড়া যায়?’,বিক্রম ভাবে। হারুন চোখটা ছোট করে ,ভুরু কুঁচকে তাকায় বিক্রমের দিকে ।ওর খুনি মনও কেমন যেন অবিশ্বাসের চোখে মেপে দেখতে চায় আপাত ভদ্র ছেলেটার মন। ‘কি দিনকাল পড়ল রে বাবা। ছেলে বাবাকে, বউ বরকে,প্রেমিক-প্রেমিকাকে সুপারি দিয়ে খুন করাচ্ছে। সবাই শালা সাধুপুরুষ ।শুধু যত পাপী এই আমার মত সুপারিকিলাররা?’বলে হো হো করে হেসে ওঠে হারুন। যাইহোক টাকা পেলেই হল, কে কাকে মারছে তাতে ওর কি? তবে কাজটা একটু কঠিন। লোকটাকে মারতে হবে প্ল্যান্টের ভিতর। বাকি অঙ্কটা পরিষ্কার হয়ে যায় হারুনের কাছে। ভালো দাঁও মারতে হবে। ‘না না ,বিশ হাজারে হবে না।প্ল্যান্টে ঢুকে মারতে অনেক হ্যাপা, সিকিউরিটি আছে গেটে।পঞ্চাশ হাজার লাগবে।‘ তিনজনে দরাদরি, অনুনয়-বিনয় চলতে থাকে।
ওদিকে তখন মহীন্দ্র বাড়িতে বসে রিটায়ারমেন্টের ফাইল গোছাতে ব্যস্ত। ভাবতে থাকে আজ নাইট ডিউটিটাই শেষ চাকরি। কাল সকাল দশটায় ঠিক কত টাকার চেক পাবে হিসেব করতে থাকে। ছেলেটাকে দু’লাখ দিলে আর কত পড়ে থাকবে? তাতে তিনজনের পেট চলবে তো ?মাসে খরচ কিছু কমাতে হবে, একটা ছোটখাটো লোকাল কমিটির নাইট গার্ডের চাকরি ধরবে নাকি? দু’পয়সা তো আসবে তাতে।
(৫)
পরদিন ভোরবেলা রামচাঁদ ছুটতে ছুটতে আসে মহীন্দ্রর বাড়ি,এ কি কথা শুনছে! বাড়ি তখন ভিড়ে উপছে পড়ছে, সবাই জানতে চাইছে কি হয়েছিল মহীন্দ্রর। কেউ বলতে পারছে না, বাড়িতে তখন কেউই প্রায় নেই।জটলার মধ্যে নানা লোক নানা কথা বলতে থাকে।কোনটা সত্যি,কোনটা মিথ্যে কে জানে?ওদিকে বেলার দিকে, লোকাল নিউজ চ্যানেলে ব্রেকিং নিউজ দেখাতে থাকে।
“ কর্মজীবনের শেষ দিনে খুন হলেন মহীন্দ্র দাস নামে প্ল্যান্টের এক রক্ষী। এদিন তিনি নাইট ডিউটি করছিলেন অফিস ও গোডাউনে। হঠাৎ অন্য সহকর্মীরা গুলির শব্দ পান, দেখা যায় গেটের কাছে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছেন মহীন্দ্রবাবু। এরিয়া সূত্রে জানা গেছে এদিনই অবসর নেওয়ার কথা ছিল মহীন্দ্রবাবুর। সকাল ছ’টায় পুলিশ দেহ উদ্ধার করতে এলে সহকর্মী ও পরিবারের সদস্যরা বাধা দেন।দেহ আটকে রেখে ছেলের চাকরি ও ক্ষতিপূরণের দাবিতে তারা বিক্ষোভ দেখাতে থাকেন। মিলে উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়।শেষে সকাল দশটায় সব দাবী মেনে নেওয়া হলে, তবে বিক্ষোভ থামে। এই ঘটনায় সেন্টার কর্মী আবাসনে শোকের ছায়া নেমে এসেছে ।সেখানে গিয়ে দেখা যায় পড়শীরা ভিড় করে এসেছেন মহীন্দ্র বাবুর বাড়ি । এক পড়শী ও সহকর্মী অমিত চ্যাটার্জী বলেন, মহীনবাবু খুব সাদাসিধা মানুষ ছিলেন,পাড়াতে বা কারখানাতে ওর কোন শত্রু ছিল না।তাকে কেন খুন করা হল, কেউ বলতে পারেননি। কারখানার তরফে থানায় পুরো বিষয়টি তদন্ত করে উপযুক্ত পদক্ষেপ নেবার জন্য আর্জি জানানো হয়েছে। পুলিশ কমিশনার বলেন, একটি অস্বাভাবিক মৃত্যুর মামলা দায়ের করা হয়েছে। মাথার ডান দিকে গুলি বিঁধেছিল। ঘটনাস্থল থেকে একটি পিস্তল উদ্ধার করা হয়েছে। দেহটি ময়নাতদন্তের জন্য পাঠানো হয়েছে। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট পেলে মৃত্যুর কারণ বোঝা যাবে, তদন্ত চলছে ।কারখানার এমডি সুনীল তিওয়ারি জানিয়েছেন মৃত কর্মচারীর ছেলেকে চাকরি ও ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে।“
Subscribe to:
Posts (Atom)