28 January 2019

একটি চোরের কাহিনী

 
    সকাল থেকে হুলুস্থুলু।চোর ধরা পড়েছে ভটচাজবাবুর বাড়িতে। কুয়োতলায় ঘাপটি মেরে লুকিয়ে ছিল । দুই দারোয়ান তো একেবারে হামলে পড়েছে। সঙ্গে চাকর, মালি, ড্রাইভার।সবাই মিলে ঘিরে ধরে যা তা কান্ড !চোর বেচারা পালাবার পথ পায়নি। তারপরেই শুরু হয়েছে হাটুরে মার ,এখনো চলছে। ল্যাম্পপোস্টে বাঁধা হয়েছে হাড়জিরজিরে ভিখিরিপানা মানুষটাকে, খালি হাত জোড় করে বলছে, সে নাকি চুরি করেনি। কিন্তু কার কি?
    ভটচাজবাবুর বিশাল ব্যবসা,প্রচুর টাকা।নিন্দুকেরা বলে তার নাকি সবই ব্ল্যাকমানি। তিনি দু'তিনজন ইনকাম ট্যাক্স লইয়ার আর চাটার্ড একাউন্টেন্ট পুষেছেন মোটা টাকা দিয়ে। তারাই ট্যাক্স ফাঁকি আর ব্যালেন্সশীটের ফিকিরগুলো দেখে। চোরটা ধরা পড়ে মার খাওয়ার সময়, রাগের বশে অবশ্য বেজায় গাল পাড়ছিল। ভটচাজবাবুর দিকে ঘৃণাভরে তাকিয়ে, জ্বলন্ত চাওনি ছুঁড়ে দিয়ে বলেছিল ,"তুই ধরবি চোর! শালা চোরাই সোনার দোকানে এত রমরমা না ? তাই মুখে বড় বড় কথা!নিজের যত বেআইনি কারবার আর আমাকে বলিস চোর ?" ভটচাজবাবু দ্রুত গেটের ভেতরে ঢুকে গটগট করে ভেতরে চলে গেলেন ,গেট বন্ধ হয়ে গেল।
      চোরটাকে এসে মেরে গেল বাজার করতে, অফিস করতে আসা কত মানুষজন।এদিকে চোরটাও সমানে প্রতিবাদ জানাচ্ছে। ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট হরেন সান্যালকে কথা শুনতে হল চোরটার কাছে। "কত টাকার কারেন্ট জালি  করে চুরি করেছিস রে, তোর বেআইনি তিনঘরার কারখানায়? মজুরদের তো ন্যায্য টাকা কিছুই দিস না, বারোঘন্টা অমানুষিক খাটাস।  তুই আবার এসেছিস আমাকে মারতে?"হরেন বাবু পালিয়ে বাঁচেন, ভিড়ে গা ঢাকা দেন ।পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন সুদখোর মানিক দাস ।তাক করে দু চারটে মোক্ষম মার তিনিও মেরেছিলেন ।চোরটা কঁকিয়ে উঠে বলে "চোরকে মারতে এসেছে, শালা সুদখোর! হাজার টাকার এক বছরের সুদও হাজার টাকা? শালা।" আবার দু'চারটে মার পড়ে, তবে এবার জোরটা একটু যেন কম। চোরটা মানিককে ছেড়ে, রেগে গিয়ে পাশে দাঁড়ানো ফিটফাট রবীন পাকড়াশির চোখে চোখ রেখে বলে "জাল ওষুধের কারবারটা কেমন চলছে রে রবীন?আর জাল বেবিফুডটাও চালিয়ে যাচ্ছিস ভালোই, নারে ?"রবীন আর মানিকবাবু একটু সরে গেলেন আড়ালে।
      এসি গাড়িটা ঘ্যাঁচ করে পাশে এসে থামল। কাঁচ নামিয়ে মুখ বার করলেন পাড়ার সম্মানীয় নেতা অতুল লাহিড়ী ।দেখলেন চোর পেটানো চলছে। "ও, ভালো করেছিস। মার শালাকে। কেলিয়ে বিন্দাবন দেখিয়ে দে।"চোরটা মুখ তুলে দেখে ।চেঁচিয়ে বলে "এই তো এসে গেছ বাবা দাপুটে নেতা।শালা, ভালোমানুষী দেখাচ্ছ? কটা বেনামে ফ্ল্যাট কিনে রেখেছ, কটা জমি দখল করেছ, কোথায় কোথায় তোলাবাজির টাকা লাগিয়েছ জানি না ভাবছ?" অতুলবাবুর গাড়ির কাঁচটা একটু উঠে যায় ,মুখটা বার করে হাজিমস্তানকে বলেন "এই, এটা কে রে? বিরোধী দলের মনে হচ্ছে। শালা মাওবাদী নয়তো?" চোরটার গলা এবার সপ্তমে "এই শালা হাজি,বল দেখি ,অনি-বুড়ো আর স্বপ্নার লাশগুলো কি করেছিলি? স্বপ্নার সঙ্গে কি করেছিলি বলে দেব নাকি? নিমেষে হাজিমস্তান  আর তার পূজনীয় নেতার গাড়ি হাওয়া হয়ে যায়।
         চোরটা মার খেয়ে আস্তে আস্তে নেতিয়ে পড়ছে।তাই দেখে লোকজনের জমায়েতের মধ্যে গুঞ্জন ওঠে। চোরটা কে, কোথা থেকে এল ? এত গোপন খবর ফাঁস হয়ে যাচ্ছে।চোরটা কি ঠিক কথা বলছে? সবার সব অপকর্ম ও জানলোই বা কি করে? কেউ কেউ বলে উঠলো ঠিকই তো বলেছে। কে যেন বলে উঠল , ও পাড়ার সুনীলবাবুরও তো ভুয়ো কোম্পানি আর কটা এনজিও খুলে সরকারি টাকা মেরে দিয়েছে। কে বলে ওঠে ওপাশের গলিতে একটা বেআইনি বাড়ি উঠছে ।কার যেন মার্সিডিজ গাড়ি আছে ড্রাগের ব্যবসার টাকায়,কার জাল নোটের কারবার,কোন বালি মাফিয়া ডাম্পারপিছু পুলিশ আর পার্টিকে কত যেন মাসোহারা দেয়,কোন নামকরা ডাক্তারের নার্সিংহোমে কিডনিপাচার আর কন্যাভ্রুণ হত্যার মত ঘৃণ্য কাজ হয়। বেআইনি কাজকর্মের  গল্প-আলোচনাই চললো মুখে মুখে।
      গনধোলাইয়ের আসরের ভিড়টা পাতলা হতে শুরু করে , চোরটার দিকে আর কারো কোন নজর নেই। এদিকে চোরটার ততক্ষণে হয়ে এসেছে। রক্ত ঝরছে সারা শরীর থেকে। চোখ থেকে অবিরাম জল গড়িয়ে পড়ছে, মুখ থেকে রক্ত লালা সিকনি সব মিশে  ছেঁড়া গেঞ্জি ভিজে গেছে ।অর্ধনগ্ন মানুষটার আর জ্ঞান নেই, মুখে আর কথাও নেই কোন। আর হয়তো কোন কথা ও কোনদিনই বলবে না, আর বললেই বা শুনছে কি কেউ ? নাকি শুনছে?????

26 January 2019

চেনা

যদিও রাতবিরেতে কুকুরগুলো চিৎকার ক'রে জ্বালাচ্ছে দু'দিন ধরেই, ঘুমের দফারফা, তবুও আজ উঠে পড়েছিলুম সকাল সকালই। তারপর চশমাটি নিঃশব্দে চোখে নিয়ে  বাসি মুখেই মোবাইলে খুটখুটও করছিলুম যথারীতি। হঠাৎই গিন্নির তাগাদা দিয়ে দিনটা শুরু হয়ে গেল, একেবারে রসকষহীন ভাবেই দুম করে শুরু হয়ে গেল। কিন্তু এই সাধারন দিনটা যে একটা অসাধারণ দিন হিসেবে দেখা দেবে তা কে জানত? আজ অফিস ছুটি, কিন্তু ল্যাদ খাবার উপায় নেই। গিন্নির হুকুমে বাজারে বেরোতেই হল, আর সে ঝক্কিও সেরে ফেলেছিলুম এক্কেবারে সেন্ট পার্সেন্ট নম্বর নিয়ে। চুনোমাছ কিনিনি, মাছের পিস ছোট করে কাটাইনি, গিন্নির পছন্দের ঢেঁড়স আমার অপছন্দ হলেও, অবশ্যই কিনেছি এবং আমার প্রিয় বরবটি মাত্র আড়াইশো গ্রামের বেশি কিনিনি (বেশি বেশি  বরবটি কিনি বলে আমার কিঞ্চিত বদনাম আছে)। দুধের প্যাকেট নিতে যথারীতি ভুলতে ভুলতেও ভুলিনি এবং ছেঁড়াফাটা নোট বা একগাদা খুচরো পয়সারও আমদানি করিনি। ফুলকপিটা পেয়েছিলুম জলের দরে আর বেগুনগুলোর চেহারাও ছিল একেবারে ঘি চকচকে।যাকগে থাক সেসব, দুর্দশার কাহিনী বলতে এসেছি, বাজারের কিস্যা নয়।    তো সেসব সেরে বাড়ি ফিরতেই, আবার নির্মম অর্ডার হল। ছেলের আজ পরীক্ষা, ফেরার সময় পুলকার আসবে না, তাই স্কুল থেকে নিয়ে আসতে হবে। মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল, একটু আড্ডা মারতে বেরুবো মনে করেছিলুম, সে গুড়ে বালি। যাই হোক, যথারীতি বিস্বাদ, একঘেয়ে জলযোগ (যা নিয়ে কোন অভাব অভিযোগ জানানো মানা, আর করলেও তা ভস্মে ঘি ঢালার সামিল)গলধঃকরণ করে, অগত্যা  বেরিয়ে পড়তেই হল পুরোনো সেকেন্ডহ্যান্ড গাড়িটা নিয়ে। জানলার কাঁচ নামানো, মৃদুমন্দ হাওয়াও আসছিল। স্টিরিওতে গান চালাতে গিয়ে দেখলুম স্পিকারটা কেটে গেছে, সেই শুরু । ঘ্যাংকোর ঘ্যাংকোর শব্দে কান ঝালাপালা হবার জোগাড়। তাড়াতাড়ি সেটা বন্ধ করে নিজেই বেসুরো গুনগুন করতে শুরু করেছিলুম মহানন্দে। যদিও তখনো জানিনা কি দিনটাই না অপেক্ষা করে আছে আমার জন্য, যদি জানতুম! কিছুদূর যাবার পরেই গাড়িটা একদিকে টানতে শুরু করল, যেন চলতেই চায়না। ছেলের স্কুল তখন অল্পই দূরে, প্রায় দেখা যায়। গাড়িটা রাস্তায় সাইড করে, নেমে দেখি, সব্বোনাশ! সামনের চাকা বসে গেছে। নির্ঘাত পাংচার। এই অবস্থায় আর চালালে সমূহ ক্ষতির সম্ভাবনা, টিউব বদলানোর মতো পয়সা নেই। এখনো মাসের চার পাঁচ দিন পড়ে আছে, কোনোক্রমে চালিয়ে নিতে হবে কোল্ড ড্রিঙ্কসের প্যাক থেকে আপ্রাণ শেষ ফোঁটাটুকু শুষে নেবার মত। এখন চাকাটাকে কোনক্রমে খুলে স্টেপনিটা লাগিয়ে নিতে পারলেই কেল্লাফতে। বাকি পরে দেখা যাবে। এই মনে করে ডিকি থেকে জ্যাকটা বের করলুম। জ্যাকটার অবস্থা সঙ্গীন, সর্বাঙ্গে মরচে ধরা। ক্যাচোরকোঁচোর শব্দ ক’রে সেটা ভীষণ আপত্তি জানাতে লাগল। কতদিন ব্যবহার হয়নি, কে জানে? আমার আশঙ্কাকে নির্ভুল প্রমাণ করে সে সত্যিই দেহ রাখল। বেঁকে তুবড়ে তার দেহ পড়ে রইল, পাশে কিংকর্তব্যবিমূঢ় আমি। রাস্তার ওপাশে গাড়ি দাঁড় করিয়ে একটা পুলকারের ড্রাইভার বোধহয় ফোনে কারও সঙ্গে কথা বলছিল। আমার দুরবস্থা দেখে, এবার সেই কমবয়সী ছেলেটা গাড়ি থেকে নেমে এসে বলল, 'কি দাদা ,পাংচার?' বললুম, 'হ্যাঁ ভাই, জ্যাকটাও গেছে।' বলতে পারলুম না, শুধু টায়ার নয়, প্রেস্টিজটাও  পাংচার। হাতে কালি মেখে, ভ্যাবলা-ক্যাবলার মত মাঝরাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি, ঠিক যেন একটা জোকার। তখনই গিন্নির ফোন এল। ছেলের স্কুল ছুটি হয়ে গেছে, ঠিকঠাক পৌঁছেছি কিনা। গিন্নি এরকম রাস্তায় ঘাটে হামেশাই ফোন করে, আমার সময়জ্ঞান সম্পর্কে তার দারুন ভরসা। বলতে গেলুম 'গাড়ি খারাপ হয়েছে ', কিন্তু তার আগেই পিঁ পিঁ করে মোবাইলটা সুইচড অফ হয়ে গেল। যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই সন্ধ্যা হয়। এবার মোবাইলটাও বিট্রে করল। আরো একটা ধাক্কা খেলুম। ক'দিন ধরেই চার্জারটা লুজ কানেকশন হচ্ছিল, সারারাত চার্জই হয়নি মনে হচ্ছে। চার্জার আর মোবাইলের বাপান্ত করতে লাগলুম। এদিকে ছেলের স্কুল ছুটি হয়ে গেছে, আর আমি রাস্তায় ত্রিশঙ্কু হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। মুখ কাঁচুমাচু করে ছেলেটাকে বললুম, 'ভাই, কি হবে এখন?' আমার বিপন্ন, বিপর্যস্ত দশা দেখে তার দয়া হল। সে আশ্বাস দিয়ে বলল, 'দাঁড়ান, দেখছি'। বলে, তার গাড়ির ডিকি থেকে একটা নতুন জ্যাক নামিয়ে নিয়ে এল। 'সরুন, আমি করে দিচ্ছি', বলে নিপুন হাতে, চটপট চাকাটা খুলে ফেলল। বুঝতেই পারলুম সে ড্রাইভার কাম মেকানিক। বিপদের মধ্যে যেন একটু আশার আলো দেখতে পেলুম। পাংচার চাকাটা পাশে রেখে সে বলল, 'কই, আপনার স্টেপনি দিন এবার, লাগাতে হবে।‘ মহানন্দে ডিকি থেকে স্টেপনি বার করে দিলুম। সে তো স্টেপনি মাটিতে নামিয়েই আর্তনাদ করে উঠল। 'এ কি করেছেন? স্টেপনিতে তো হাওয়াই নেই!' তার আর্তনাদের সঙ্গে সঙ্গে আমার বুকটাও যেন হায় হায় করে উঠল। এবারে স্টেপনিও গেল, কি হবে? একে একে সবাই সুযোগ বুঝে আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করতে লাগল। বৃথা শাপ-শাপান্ত, গালমন্দ। আমি যেন নির্বাক একটা কাঠপুতুল, মুখটা হাঁ করে দাঁড়িয়ে রইলুম। এরপর কি করতে হবে, আমার জানা নেই। ছেলেটা অবশ্য মোটেই ঘাবড়াল না, আমাকে দাবড়ালও না, এই বিপদে আমাকে ছেড়েও গেল না। শুধু বলল, 'স্টেপনিতে হাওয়া ভরে রাখেন না?' আমার মনে পড়ল, গাড়িতে যখনই হাওয়া ভরি, খুবই  আলিস্যি করে ড্রাইভার সিট থেকে নেমে, ডিকিটা আর খুলি না। চারটে চাকায় হাওয়া ভরা হয়ে গেলেই, তাচ্ছিল্যভরে একটা দশ টাকার নোট গরিব ছেলেটার ময়লা হাতে আলগোছে দিয়েই, নিজেকে দুনিয়ায় রাজা প্রতিপন্ন করে চলে যাই, প্রতিবারই। স্টেপনির কথা আর মনেই থাকে না। সেই তাচ্ছিল্যের আজ সে বদলা নিল, একেবারে মোক্ষম সময়ে। ঘাম মুছে বোকার মত জানতে চাইলুম, 'তাহলে কি হবে ?' এবারও সে আমার রক্ষাকর্তা হয়ে হাজির হল, আমার মত অপোগন্ডকে সে এবারেও ক্ষমা করে দিল, আর আমি সেই একমাত্র আশাভরসা, সেই শেষ অবলম্বনকে প্রাণপনে জড়িয়ে ধরলুম। সে আমাকে ফেরাল না। 'দাঁড়ান, দিন আমাকে চাকাটা। আমি গাড়িতে করে সামনের মোড় থেকে সারিয়ে নিয়ে আসছি। আপনি যাবেন আমার সাথে?' আমি দেখলুম আমার হয়ে ছেলেটা যখন এতই করছে, এত সময় নষ্ট করছে, তার মানে ওর বোধহয় কোন কাজই নেই। স্বার্থপরের মত তাই বললুম, 'ভাই, তুমিই করিয়ে আনোনা একটু, আমি টাকা দিয়ে দিচ্ছি।' যেন টাকা দিলেই দুনিয়ার সমস্ত বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়া যায়, যেকোনো পরিস্থিতিতে টাকাই যেন শেষ কথা। আমার সেই ঔদ্ধত্য, সে তার সরল মনে বুঝতে পারল না। হাত পেতে বলল, 'দিন টাকা'। আমি স্যাট্ করে পেছনের পকেটে থেকে মানিব্যাগটা বের করে টাকা দিতে গিয়ে, প্রথম বার থাপ্পড়টা খেলুম। মানিব্যাগে মাত্র দশটা খুচরো টাকা আর কটা কয়েন পড়ে আছে, সব টাকা বাজারে শেষ। সাবেক মধ্যবিত্ত আমি, বাজারে মানিব্যাগ খালি হয়, এ আর নতুন কি? পুঁজিও এমন নেই যে, সেই মানিব্যাগ পরমুহূর্তেই নতুন টাকায় ভরে দেব, তার ওপর মাসের শেষ। বুরবক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলুম। এবার মনে হল, আমি বোধহয় ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলব। এত অপমানিত আর অপ্রস্তুত আমি জীবনে কখনো হইনি। সব বেইমান, লজ্জায় মাথা কাটা যেতে লাগল। এবারেও পরিত্রাতা হয়ে ছেলেটা বলল, 'ও টাকা নেই, ঠিক আছে। আমি আমার নামে লিখিয়ে করে আনছি । আপনি নাম বলে, কাল দিয়ে দেবেন দোকানে। ঠিক আছে?' আমি বাধ্য ছেলের মত ঘাড় নাড়লুম। সে চাকা নিয়ে সাঁ করে বেরিয়ে গেল। পরক্ষনেই মনে হল, নামটাই তো জানা হয়নি ছেলেটার, ঠিক আছে ফিরুক, তখন জেনে নেব। আবার কিঞ্চিৎ সন্দেহও হল, চাকাটা নিয়ে হাপিস হয়ে যাবে না তো? আজকাল তো কত কিছুই হচ্ছে! চারিদিকে এটিএম ফ্রড আর লোকঠকানো ব্যবসা। কাকে বিশ্বাস করব? আসলে মানুষ চিনি না আমিও, এই ছেচল্লিশ বছর বয়সেও। কে সৎ আর কে অসৎ কে জানে? মানুষকে বিশ্বাস করতে ভয় হয়। পরক্ষনেই চোখ পড়ে গেল ছেলেটার জ্যাকটার ওপর, আমার গাড়িতেই লাগানো আছে, নতুন। একটা পাংচার হওয়া শতচ্ছিন্ন চাকার থেকে কম দাম হবে না নিশ্চয়ই। আরো একটা যেন থাপ্পড় এসে পড়ল গালে। মানুষকে অবিশ্বাস করার শাস্তি। মানুষের মানবিক মুখটাকে না চিনে, ভেকধারী অমানুষকে আপন করে নেবার প্রায়শ্চিত্ত কবে যে করব, কে জানে? খেয়াল হল, ছেলের অনেকক্ষণ ছুটি হয়ে গেছে। এটুকু রাস্তা হেঁটে গিয়ে বরং নিয়ে আসি স্কুল থেকে। অগত্যা পদব্রজন, ঘামতে ঘামতেই। ছেলেকে অনেক জবাবদিহি করে, অবশেষে ফিরতে শুরু করলুম। মনে মনে ভাবলুম, এর চেয়ে শতগুণ বেশি জবাবদিহি এখনও অপেক্ষা করে আছে বাড়িতে। নিজের অপদার্থতার এবারে সবকিছু খুল্লামখুল্লা হল বলে। মনটা ভারাক্রান্ত হ্য়ে গেল, সমস্ত বেগড়বাঁই এই একই দিনে হতে হল? কি কুক্ষনেই না আজকের ছুটিটা আরাম আয়েশ করে কাটিয়ে দেব ভেবেছিলুম! সে কি আর হবার জো আছে? কোন অপয়ার যে আজ মুখ দেখে, ঘুম থেকে উঠেছিলুম! মনে পড়তে পরক্ষণেই ঢোঁক গিলে নিলুম, এ কথা ভুলেও বলা যাবে না। নিজেই গিলে নিলুম সেকথা। এখন বাড়িতে পৌঁছতে পারলে হয়। এসব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে, আইসক্রিমের বায়নারত ছেলেকে নিয়ে, গাড়ির শবদেহের পাশে এসে উপস্থিত হলুম। ঠক ঠকাঠক শব্দে ততক্ষণে কাজ শুরু হয়ে গেছে, চাকা সারিয়ে এনে ফিটিং হচ্ছে। পাঁচ মিনিটেই কাজ শেষ। সব কাজ সেরে, ডিকি বন্ধ করে, হাত টাত মুছে, ছেলেটি হেসে সামনে এসে বলল 'যান ,হয়ে গেছে।' ছেলেটির হাত দুটো ধরে, অজস্র ধন্যবাদ দিয়ে বললুম, 'ভাই ,তোমার নামটাই তো জানা হয়নি। টাকা দেবার সময় বলতে হবে কাল।' 'কোন কিছু দিতে হবে না, আমার চেনা দোকান। ক'টাকাই বা খরচা হয়েছে !’ 'তবু তোমার নামটা?' 'শেখ জামাল', বলে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে দিল সে। হাত নেড়ে চলে যেতে যেতে বলল, 'স্টেপনিতে হাওয়া দিয়ে রাখবেন এবার থেকে।' তার গাড়ি আমার হতভম্ব চোখের সামনে দিয়ে হুশ্ করে চলে গেল। মনে হল ‘জামাল’ নাম না হয়ে, অন্য কোন  নাম শুনলেই যেন বেশি খুশি হতুম। সেটাই সেদিন আমার গালে শেষ থাপ্পড় হয়ে নামল, আগের চেয়েও জোরে। মানুষ চিনিনা আমি, দেশটাকেও চিনিনি কিছুই। নিতান্তই একটা গোমুখ্যু হয়ে এতগুলো বছর পার করে দিলুম।  গাড়ি স্টার্ট দিলুম। দেখলুম, সারাদিনের সব গ্লানি ধুয়ে গেছে। হঠাৎ আইসক্রিম খেতে খেতে ছেলে বলে উঠল,'জানো বাপি,ঐ কাকুটাকে তো আমি চিনি।'

18 January 2019

ভেতরের কথা

কোনকিছুই ঠিকঠাক করে উঠতে পারছি না। সাজাতে পারিনি কিছুই, এমনকি নিজেকেও। ছাপোষা, মধ্যবিত্ত, মধ্যমেধার একটা জীবন টেনে নিয়ে চলেছি। যতদিন বাঁচব ,এর থেকে আর মুক্তি নেই।মুক্তি তো পেতেই চেয়েছিলুম। সেই ছোটবেলায় বাবার সঙ্গে মামাবাড়ির ছাদে ঘুঁড়ি ওড়াতে ওড়াতে ।আমারই ঘুঁড়ি দূর আকাশের বুকে উড়ে বেড়াচ্ছে, ঘুঁড়িটা যেন আমিই। কিন্তু সেই রাজত্ব বেশিক্ষন টিঁকল না, সুতো কেটে উড়ে গেলো আমার সাধের ঘুঁড়ি ,বুক ফাটিয়ে ভেসে গেল।একটু বড় হয়ে ছবি আঁকা শুরু করলুম।কিন্তু মনের পর্দায় যে রঙের সমারোহ, আমার ছোট্ট খাতার পাতায়, কিছুতেই তা এ জীবনে ফুটিয়ে তুলতে পারলুম না। এ আমার আর এক পরাজয়। শেষমেষ সব ছেড়ে লিখতে বসলুম। মনের মধ্যে ততদিনে জমে উঠেছে অনেক কথা, অনেক আবেগ, অভিমান । ডায়েরির পাতায় পাতায় সেসব লিখে ফেলতে লাগলুম , কিছু উড়িয়েও দিলুম ।ভাবতুম, উড়ে গেছে ,বেশ হয়েছে, কতই তো হারিয়ে যায় ।শুধু নিজের শিরায় শিরায় যা বয়ে চলে ,তাই আসলে নিজের ।তাই ক্ষইয়ে ক্ষইয়ে নিজেকে শেষ করে দিতে হয়,তবে শান্তি। এই আমার আসল কথা, ভেতরের কথা।আগুন আর জল নিয়েই আমার কারবার ।নিজেকে নিভিয়ে গড়ি। পরিশ্রুত হই ।সব কথা একদিন শেষ হবে। কেউ হাতের তেলোয় নিয়ে নাড়াচাড়া করবে ।বড্ড চঞ্চল আঁজলা ভরা সে জলটুকু হয়ত তার হাত গলে গড়িয়ে পড়ে যাবে। তবু তারার আকাশে ঝিকিমিকি থামবে না ,জানি সেই সব তারা একদিন বৃষ্টি হয়ে নামবেই।(সারাংশ)