4 October 2018

তোমার সবুজ সন্ধ্যায়

তোমাকে এই চিঠি যখন লিখছি, পশ্চিম আকাশে তখন অদ্ভুত গোলাপী আবেগ -কোন চোরা স্রোত যেন আগামীর পুব আকাশ থেকে তার রং মেখে ফেলে ,পাগল বিকেল একটা। এইমাত্র বৃষ্টি হয়েছে,জানো? এইমাত্র কবিতা পড়তে ভালো লাগলো না বলে, তোমার চিঠি আবারও পড়া শেষ করে বাইরে এসে দাঁড়িয়েছিলুম। যদিও এখানে ফুল ফোটে না, বারান্দার বাইরেই কাঁকুরে রুক্ষ মাটি আর এখন রাস্তার কাজ হচ্ছে বলে যত সব স্টোনচিপস, পিচের চাঙড়, রোড রোলার, মিক্সার, কালো দুঃস্বপ্নের ড্রাম আরো কত কি সব পড়ে রয়েছে। আজ ও অতীতের ব্যর্থতায় ভরা যত সব- হ্যা হ্যা করে তাকিয়ে আছে ।তবু কোথা থেকে ফুলের সুবাস ভেসে এসেছিল ঠিক, নইলে আমিই বা কেন লিখতে যাবো এই অসময়ের চিঠি? অবশ্য যদি তুমি বল একে চিঠি।যদি তুমি বল একে চিঠি, তবে তা ডাকটিকিট ছাড়াই হুশশ্ করে পাড়ি দেবে তোমার দোরগোড়ায় ঠিক ।আর সিক্ত হাতে তুমি কুড়িয়ে নিতেই আমার সব কথার ছুটি ।অথচ নতুন ভাব জমে ওঠে ,কবিতার ছটফটানি ঘিরে ধরে ,আমাকে এরা বসতে দেয় না নির্লিপ্ত। এই যেমন এইমাত্র বৃষ্টি শেষ করে বারান্দায় এসে বসে বিকেলের রঙ নিয়ে আমি সমস্যায় পড়ে যাই। তার রঙ প্রকৃতই গোলাপি নাকি নীলচে হলুদ সে ব্যাপারে আমি ঠিক বলতে পারি না। আর্দ্র সন্ধ্যাতারার নীরবতায় অথবা বিষন্ন পূর্ব দিগন্তে অভিমানের উষ্ণতায়, আমার চোখের তারায় তারায় যে সোনালী স্নান সারা হল ,সে রঙ আমি ঠিক বুঝতে পারি না ।কারণ তুমি জানো, আমি ছবিই আঁকিনি কোনদিন ।আর নইলে ধরে নাও আমি কালারব্লাইন্ড। রঙের ব্যাপারটা বিকেলের আকাশই জানে, আমি ও নিয়ে আর বর্ণনায় যাচ্ছি না ।
জানো, এইমাত্র সন্ধ্যা হচ্ছে। ভিজে পাতায় জলরঙের ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ার মতো, রঙ শুধু রঙ নিয়ে খেলা করে, কত রঙ হারিয়ে, মিশিয়ে ফেলে, তোমায় নিয়ে। এইমাত্র নাম না জানা সব পাখি, দল বেঁধে ফিরে গেল দিনের শেষে, মাথার ওপর দিয়ে ।ঠিক বোঝা গেল না কোথায়, কারণ দ্রুত, খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে কালচে সবুজ সন্ধ্যা। কোনোদিনই আমার কলকাতার বারান্দায় সন্ধ্যা আসে না। কারণ সামনের সব উঁচু বাড়ি আর ওপাশের যত বড় বড় গাছ ডালপালা মেলে দিয়ে এই রঙ বদল ঢেকে দেয় অনায়াসে। অথচ এইখানে, এই জঙ্গিপুরে, ভাল করে সন্ধ্যা দেখব বলে বেরিয়ে এসেছিলুম পিডব্লুডির রাস্তার ধারে ।এপাশে রাস্তাটা একটা বাঁক নিয়েছে আর তার ঠিক পরেই একটা কালভার্ট পেরোলেই, সামনে নদী। ভাবলুম সিগারেট খেতে খেতে রাস্তায় একটা চক্কর দিয়ে আসি ।এদিকে ওদিকে ছোট ছোট হ্যারিকেন জ্বলা দোকানে, ছড়ানো ছেটানো জটলা ।সব কাজের বিষয়, নাকি অকাজের আলোচনা?আজ সন্ধ্যায় তুমি কি পোশাক পড়েছ ,তোমাকে শাড়িতে মানায় ভালো নাকি জিনসে ?এ নিয়ে তারা কখনই একটা ঠিকঠাক সিদ্ধান্তে আসতে পারে না। তাই শেষমেশ তারা সবাই আমার কাছেই হাজির হয় ।এই সাহাপাড়ার সরকারি বাংলোর চাতালে বসে আমি তাদের বুঝিয়ে দিই এই সব বিষয়ের কোনটাই তোমাকে স্পর্শ করে না কেন। তুমি সন্ধ্যার রঙে চঞ্চল বা সকালের স্নিগ্ধতার রঙে সবুজ ,যাই হও না কেন  যে কোন সম্পর্কে সে শুধু তুমিই। যেকোন সুগন্ধ, তা সে ফুলেরই হোক বা পার্ক এভিনিউএর, কোনোটাই বেমানান নয় তোমাকে নিয়ে। শেষকালে সেই কথা শুনে ওরা সবাই নিশ্চিন্ত মনে বাড়ি চলে যায় ।ওদিকে ব্যাডমিন্টন খেলা শেষ করে জাল-বাঁশ সব গুটিয়ে পাড়ার ছেলেগুলো হইহই করে বাড়ি যায়। আর তার ঠিক পরেই হঠাৎ দেখলম কোথাকার কালো রং আকাশ থেকে, বন-বাদাড়, মানুষজন আর যত সব রঙীন আস্ফালন মুড়ে দিয়ে ,অনেক অনেক রঙের বদলে এক তাল পিচের মত, মৃতপ্রায় সব ড্রাম থেকে বের হয়ে এসে লেপটে দিল আকাশের গায়ে,পথের গায়ে। এতে রঙ থাক না থাক, এই নিশ্চুপ নিশ্ছিদ্র অন্ধকার দেখাল রঙবদল কাকে বলে। বড় ভাল লাগছিল। জানোতো, অনেকদিন পরে এইভাবে অন্ধকারে একা বড় ভালো লাগছিল ।
এইমাত্র সিগারেটের ভুক্তাবশেষ দলে দিয়ে এসে বারান্দায় এসে বসেছিলুম। ভেতর থেকে চা দিয়ে যাবার কথা ।তাই এর মধ্যে চেয়ার টেবিল সব পাতা হয়ে গেছে। বসে বসে তোমার কথাই ভাবছিলুম। আসলে এই সন্ধ্যার একাকীত্বময় অচেনা ছবি ,এই স্বপ্নিল শান্ত অন্ধকার ,তোমাকে ছাড়া আর কাকে মনে করায় বলোতো ?বিশেষত আমি যখন একা আর আমার যখন সন্ধ্যার আকাশের মত তুমিও আছ। আমার এই কালো হেমৎপুরে, আমি তোমার চোখের তারায় ঠিকই ধরা দেব ,এই চিঠির হঠাৎ আলিঙ্গনে তোমার বুকে, কোনদিন কি এই চিঠির কথাগুলো কবিতা বা ছবি সৃষ্টির আনন্দের মতো দামী হয়ে, মাথা মুণ্ডু লেজ সমেত এক্বেবারে প্রবেশাধিকার পাবে ?
যাঃ,ঐ রে এইমাত্র লোডশেডিং হল ।ভাবনার রাশ ছিঁড়ে, আরো অনেক বেশি ভাবনায় ডুব দিল এই গোটা বারিকপুর অসহায় আমাকে নিয়ে। এ তল্লাটে অবশ্য সন্ধ্যার মুখে লোডশেডিং নিত্যকালের অভ্যাস। তবে ঐ যে ঝপ্ করে অন্ধকারে ঢেকে যাওয়া, এ বড় চমকে তোলা বিরক্তি। আর যা হোক সন্ধ্যার মত চুপিসারে, আদর করতে করতে ও তো আসতে পারে না ।তাই এই অন্ধকারে কোন আহামরিত্ব নেই। মানুষের দেওয়া আলো, মানুষেরই ফিরিয়ে নেওয়া।
 জানো ,এই কল্যাণপুরে আমার এই অন্ধকার প্রেম ঘিরে ধরল আমায়, এইসব খোবলানো রাস্তা, কাঁকর, পিচের ভারী গন্ধ আর ট্রাকের আওয়াজ পেরিয়েও মন ছুঁয়ে গেল সন্ধ্যাজলের ভালোবাসায়। যেমন হারিয়ে যায় নিজের সব অহংকার ,কালিমা, এমনকি শরীরও। যেমন কালভার্টে আড্ডাবাজ ছেলে ছোকরা, বাস-লরি ভর্তি কেজো লোকজন, বিকিকিনির পসরা সাজানো ক্রেতা-বিক্রেতা, কত সহজে এই অন্ধকারে ম্লান হয়ে যায়। যেমন ম্লান হয়ে যায় সমস্ত রঙ, তোমার কাছে। আমি তাই এই সজীব অন্ধকারের অভিলাষ, এই বাক্যহীন কালো, তোমার হাতে হাতে ছুঁয়ে দিই, এই অবুঝ চিঠিতে। আর এইখানে, আমার এই কাজীপাড়া বা করিমপুরের অন্ধকার, এইমাত্র আমাকে সেই বৃষ্টিময় দিনগুলোর কথা মনে করিয়ে দেয়, যার জন্য অনেক বছর বেসামাল আমি তোমাকে এই মাত্র আঁকড়ে ধরে থিতু হই, অন্ধকার এই অনেক অন্ধকারের উষ্ণতাকে সাক্ষী রেখে।

No comments:

Post a Comment