13 October 2018

চেনা গাছ

মেয়েটা মরে গেল মাত্র সাত দিনের জ্বরে। ওষুধবদ্যি সবই করেছিল পালান। অসুস্থ শরীরে সাইকেল রিক্সা চালিয়ে যে ক'টা টাকা হয়, তার সব তো ঠেকেই শেষ হয়ে যেত। তবু শেষমেষ, মহাজনের হাতে পায়ে ধরে ক'টা টাকা ধার করে, কোনোক্রমে মেয়েটাকে সদর হাসপাতালেও নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ততদিনে বড্ড বেশি দেরি হয়ে গিয়েছিল। আর বাঁচানো গেল না মেয়েটাকে। মা-মরা মেয়েটা বড় অভাগা ছিল, কোনদিনও সেভাবে কারো ভালোবাসা পায়নি। কোনদিন পালানের কাছে আব্দার করে কিছু চায়ওনি। খাওয়া পড়া ছাড়া এই অভাবের সংসারে কিছু যে চাওয়া যায়, তাই জানত না হয়ত বোকা মেয়েটা। আহারে, মদের ঘোরে রাতে বাড়ি ফিরে এসে, অকারণে কত মারধোরই না করেছে নিষ্পাপ মেয়েটাকে। শুধু তো একটু ভাতই খেতে চাইত মেয়েটা খিদের পেটে, পালান এদিকে ঠেকে আকন্ঠ ধেনো মদ খেয়ে চোখ লাল করে বাড়ি ফিরত। আর খেতে চাইলেই, যত রাগ গিয়ে পড়ত মা মরা মেয়েটার ওপর। মার খেয়ে কত রাতে মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতেই খালি পেটে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ত। সেই মেয়েটার কি এমন অসুখ হয়েছিল কে জানে? অভিমানে বাপকেও বলেনি কখনো। না কি ভয়ে? মার ছাড়া কখনও কিছু তো দেয়নি পালান মেয়েটাকে। তবু হাসপাতালে, শেষদিকে বিছানার পাশে দাঁড়াতে, পালানের হাতটা আলতো করে ধরে থাকত মেয়েটা। জ্বরে বেহুঁশ, তবু চিনেছিল হয়ত বাপকে। কিছু কি বলতে চেয়েছিল? হবেও বা। পালানের ভীষণ কষ্ট হয় আজকাল মেয়েটার জন্য। কিছু তো কারো ক্ষতি করেনি ও কোনদিন, তবু যে কেন দশ বছরের মেয়েটাকে চলে যেতে হল অসময়ে? ওর মা নাম দিয়ছিল 'পারু'। বসে বসে এইসবই ভাবে পালান। ওর মাও তো এভাবেই চলে গিয়েছিল একদিন বিষ খেয়ে, আজ থেকে পাঁচ বছর আগে। পালান তখন ছিল আরো রগচটা, রোজ সন্ধেয় মদ ছাড়া চলতই না। বৌটাকেও কি কম মেরেছে, কম কষ্ট দিয়েছে ও? চুল্লুর টাকা জোগাড়ের জন্য, টান মেরে খাবলে ছিঁড়ে নিয়েছিল বৌটার গলার সরু চেনটা, ওটাই ছিল বৌটার শেষ গয়না। মহাজনের কাছে সেটা বেচে দিয়ে, ঠেকের সব ধার শোধ করে, ইয়ার দোস্ত নিয়ে গলা অব্দি নেশা করে, নাচনিঘর হয়ে বেশি রাতে ঘরে ফিরে দেখে, বউটার মুখ দিয়ে তখন গ্যাঁজলা বেরোচ্ছে। নাঃ, তাকেও বাঁচাতে পারেনি ও। হাসপাতালে নিয়ে যাবার সময়, সেও তো চেপে ধরেছিল পালানের হাত, এভাবেই। দু দু'জন চলে যাবার পর, পালান এতদিনে বুঝতে পেরেছে, মেয়েরা আসলে যেতে চায় না সংসার ফেলে, আপনজন ছেড়ে। এত অত্যাচার সয়েও সংসারটাকে আগলে রাখতে চায়। পালান জানে,ওই ওদের দুজনকে শেষ করে দিয়েছে, চোখদুটো অপরাধবোধে ঝাপসা হয়ে আসে। আজকাল আর রিকশা টানতে পারে না ও, একটুতেই হাঁফ ধরে যায়। চুল্লুও ছেড়ে দিয়েছে ক'মাস হল, কিছু খেতে গেলেই আজকাল বমি হয়ে যায়। পালান বেশ জানে ওকেও বড় কোন রোগে ধরেছে, আর বেশিদিন নেই। শুধু চুপ করে বস্তির ছোট্ট ঘরটার বাইরের দাওয়ায় বসে, পুরোনো কথা ভাবতে ভাবতে ওর মনে হয়, ইস আগে যদি এটা বুঝত! পাশ দিয়ে নর্দমার কালো জল বয়ে যায়, সঙ্গে দুর্গন্ধ। কিন্তু তার মধ্যেই পালানের চোখে ভাসে মেয়ে আর মায়ের মুখ। মুখে একটা হালকা হাসি ফুটে উঠেই মিলিয়ে যায়। বিড়বিড় করে সারাদিন কি যে সব উল্টোপাল্টা বকে, আশপাশের বস্তিঘরের সবাই জানে পালানদার মাথাটা গেছে। স্টেশনের দিক থেকে রাতে হেঁটে আসতে গিয়ে আজকাল পালানের বড় ভয় করে, এদিকটায় বড় অন্ধকার। পাশেই একটা বেল ফুলের গাছ, হাল্কা ফুলের গন্ধ ভেসে আসছে নাকে। আহ্ , কি সুন্দর! কি যেন আকর্ষণে গুটিগুটি এগিয়ে গেল ও। গাছটা আবার কবে হল এ তল্লাটে? আগে দেখেছে বলে খেয়াল করতে পারল না পালান। কি সুন্দর বেলফুল পড়ে আছে মাটিতে। ও হাতে তুলে নেয় ক'টা। বেলফুলের গন্ধে নাক ডুবিয়ে কি যেন স্বর্গীয় শান্তি পায়। ফুলগুলো জামার পকেটে ঢুকিয়ে এগোতে যাবে, হঠাৎ হাতটা আটকে যায় গাছের ডালে। হাতটা ছাড়িয়ে আনতে গিয়ে কি যেন মনে পড়ে যায় পালানের, অবাক হয়ে ফিরে তাকায়, চুপ করে দাঁড়িয়ে প'ড়ে অনুভব করতে চেষ্টা করে কোথায় যেন চেনা স্পর্শ, চেনা গন্ধ, চেনা অভিমান। এও কি হয়! গাছের ডালটায় হাত বোলাতে বোলাতে নিশ্চুপ ভাবে কাঁদতে থাকে পালান। মানুষ কি মরে গাছ হয়ে যায়? গন্ধ ছড়ায়? গায়ে কাঁটা দেয় পালানের। এক ঝলক ঠান্ডা হাওয়া এসে গায়ে লাগে। মনে হয় গাছটা ওকে যেন কিছু বলতে চায়, জড়িয়ে ধরতে চায়। গাছের ভাষা বা গাছকে জড়াতে জানে না পালান। অনেক দেরি হয়ে গেছে। শুধু বাঁকা চাঁদের আবছা আলোয় গাছটার পাশে , বেঁকেচুরে মাটিতে পড়ে থাকে একটা অদ্ভুত ছায়া।

No comments:

Post a Comment