মেয়েটা মরে গেল মাত্র সাত দিনের জ্বরে। ওষুধবদ্যি সবই করেছিল পালান। অসুস্থ শরীরে সাইকেল রিক্সা চালিয়ে যে ক'টা টাকা হয়, তার সব তো ঠেকেই শেষ হয়ে যেত। তবু শেষমেষ, মহাজনের হাতে পায়ে ধরে ক'টা টাকা ধার করে, কোনোক্রমে মেয়েটাকে সদর হাসপাতালেও নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ততদিনে বড্ড বেশি দেরি হয়ে গিয়েছিল। আর বাঁচানো গেল না মেয়েটাকে। মা-মরা মেয়েটা বড় অভাগা ছিল, কোনদিনও সেভাবে কারো ভালোবাসা পায়নি। কোনদিন পালানের কাছে আব্দার করে কিছু চায়ওনি। খাওয়া পড়া ছাড়া এই অভাবের সংসারে কিছু যে চাওয়া যায়, তাই জানত না হয়ত বোকা মেয়েটা। আহারে, মদের ঘোরে রাতে বাড়ি ফিরে এসে, অকারণে কত মারধোরই না করেছে নিষ্পাপ মেয়েটাকে। শুধু তো একটু ভাতই খেতে চাইত মেয়েটা খিদের পেটে, পালান এদিকে ঠেকে আকন্ঠ ধেনো মদ খেয়ে চোখ লাল করে বাড়ি ফিরত। আর খেতে চাইলেই, যত রাগ গিয়ে পড়ত মা মরা মেয়েটার ওপর। মার খেয়ে কত রাতে মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতেই খালি পেটে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ত। সেই মেয়েটার কি এমন অসুখ হয়েছিল কে জানে? অভিমানে বাপকেও বলেনি কখনো। না কি ভয়ে? মার ছাড়া কখনও কিছু তো দেয়নি পালান মেয়েটাকে। তবু হাসপাতালে, শেষদিকে বিছানার পাশে দাঁড়াতে, পালানের হাতটা আলতো করে ধরে থাকত মেয়েটা। জ্বরে বেহুঁশ, তবু চিনেছিল হয়ত বাপকে। কিছু কি বলতে চেয়েছিল? হবেও বা। পালানের ভীষণ কষ্ট হয় আজকাল মেয়েটার জন্য। কিছু তো কারো ক্ষতি করেনি ও কোনদিন, তবু যে কেন দশ বছরের মেয়েটাকে চলে যেতে হল অসময়ে? ওর মা নাম দিয়ছিল 'পারু'। বসে বসে এইসবই ভাবে পালান।
ওর মাও তো এভাবেই চলে গিয়েছিল একদিন বিষ খেয়ে, আজ থেকে পাঁচ বছর আগে। পালান তখন ছিল আরো রগচটা, রোজ সন্ধেয় মদ ছাড়া চলতই না। বৌটাকেও কি কম মেরেছে, কম কষ্ট দিয়েছে ও? চুল্লুর টাকা জোগাড়ের জন্য, টান মেরে খাবলে ছিঁড়ে নিয়েছিল বৌটার গলার সরু চেনটা, ওটাই ছিল বৌটার শেষ গয়না। মহাজনের কাছে সেটা বেচে দিয়ে, ঠেকের সব ধার শোধ করে, ইয়ার দোস্ত নিয়ে গলা অব্দি নেশা করে, নাচনিঘর হয়ে বেশি রাতে ঘরে ফিরে দেখে, বউটার মুখ দিয়ে তখন গ্যাঁজলা বেরোচ্ছে। নাঃ, তাকেও বাঁচাতে পারেনি ও। হাসপাতালে নিয়ে যাবার সময়, সেও তো চেপে ধরেছিল পালানের হাত, এভাবেই।
দু দু'জন চলে যাবার পর, পালান এতদিনে বুঝতে পেরেছে, মেয়েরা আসলে যেতে চায় না সংসার ফেলে, আপনজন ছেড়ে। এত অত্যাচার সয়েও সংসারটাকে আগলে রাখতে চায়। পালান জানে,ওই ওদের দুজনকে শেষ করে দিয়েছে, চোখদুটো অপরাধবোধে ঝাপসা হয়ে আসে। আজকাল আর রিকশা টানতে পারে না ও, একটুতেই হাঁফ ধরে যায়। চুল্লুও ছেড়ে দিয়েছে ক'মাস হল, কিছু খেতে গেলেই আজকাল বমি হয়ে যায়। পালান বেশ জানে ওকেও বড় কোন রোগে ধরেছে, আর বেশিদিন নেই। শুধু চুপ করে বস্তির ছোট্ট ঘরটার বাইরের দাওয়ায় বসে, পুরোনো কথা ভাবতে ভাবতে ওর মনে হয়, ইস আগে যদি এটা বুঝত! পাশ দিয়ে নর্দমার কালো জল বয়ে যায়, সঙ্গে দুর্গন্ধ। কিন্তু তার মধ্যেই পালানের চোখে ভাসে মেয়ে আর মায়ের মুখ। মুখে একটা হালকা হাসি ফুটে উঠেই মিলিয়ে যায়। বিড়বিড় করে সারাদিন কি যে সব উল্টোপাল্টা বকে, আশপাশের বস্তিঘরের সবাই জানে পালানদার মাথাটা গেছে।
স্টেশনের দিক থেকে রাতে হেঁটে আসতে গিয়ে আজকাল পালানের বড় ভয় করে, এদিকটায় বড় অন্ধকার। পাশেই একটা বেল ফুলের গাছ, হাল্কা ফুলের গন্ধ ভেসে আসছে নাকে। আহ্ , কি সুন্দর! কি যেন আকর্ষণে গুটিগুটি এগিয়ে গেল ও। গাছটা আবার কবে হল এ তল্লাটে? আগে দেখেছে বলে খেয়াল করতে পারল না পালান। কি সুন্দর বেলফুল পড়ে আছে মাটিতে। ও হাতে তুলে নেয় ক'টা। বেলফুলের গন্ধে নাক ডুবিয়ে কি যেন স্বর্গীয় শান্তি পায়। ফুলগুলো জামার পকেটে ঢুকিয়ে এগোতে যাবে, হঠাৎ হাতটা আটকে যায় গাছের ডালে। হাতটা ছাড়িয়ে আনতে গিয়ে কি যেন মনে পড়ে যায় পালানের, অবাক হয়ে ফিরে তাকায়, চুপ করে দাঁড়িয়ে প'ড়ে অনুভব করতে চেষ্টা করে কোথায় যেন চেনা স্পর্শ, চেনা গন্ধ, চেনা অভিমান। এও কি হয়! গাছের ডালটায় হাত বোলাতে বোলাতে নিশ্চুপ ভাবে কাঁদতে থাকে পালান।
মানুষ কি মরে গাছ হয়ে যায়? গন্ধ ছড়ায়? গায়ে কাঁটা দেয় পালানের। এক ঝলক ঠান্ডা হাওয়া এসে গায়ে লাগে। মনে হয় গাছটা ওকে যেন কিছু বলতে চায়, জড়িয়ে ধরতে চায়। গাছের ভাষা বা গাছকে জড়াতে জানে না পালান। অনেক দেরি হয়ে গেছে। শুধু বাঁকা চাঁদের আবছা আলোয় গাছটার পাশে , বেঁকেচুরে মাটিতে পড়ে থাকে একটা অদ্ভুত ছায়া।
আমি আবেগ ও অনুভূতিপ্রবণ,ভাবুক আর সৃষ্টিশীল।জীবনের চলা,ওঠাপড়া আর অভিজ্ঞতা নিংড়োনো এই সব লেখা ।এ আমার পাগল মনের নিঃশেষিত প্রকাশ।
13 October 2018
4 October 2018
তোমার সবুজ সন্ধ্যায়
তোমাকে এই চিঠি যখন লিখছি, পশ্চিম আকাশে তখন অদ্ভুত গোলাপী আবেগ -কোন চোরা স্রোত যেন আগামীর পুব আকাশ থেকে তার রং মেখে ফেলে ,পাগল বিকেল একটা। এইমাত্র বৃষ্টি হয়েছে,জানো? এইমাত্র কবিতা পড়তে ভালো লাগলো না বলে, তোমার চিঠি আবারও পড়া শেষ করে বাইরে এসে দাঁড়িয়েছিলুম। যদিও এখানে ফুল ফোটে না, বারান্দার বাইরেই কাঁকুরে রুক্ষ মাটি আর এখন রাস্তার কাজ হচ্ছে বলে যত সব স্টোনচিপস, পিচের চাঙড়, রোড রোলার, মিক্সার, কালো দুঃস্বপ্নের ড্রাম আরো কত কি সব পড়ে রয়েছে। আজ ও অতীতের ব্যর্থতায় ভরা যত সব- হ্যা হ্যা করে তাকিয়ে আছে ।তবু কোথা থেকে ফুলের সুবাস ভেসে এসেছিল ঠিক, নইলে আমিই বা কেন লিখতে যাবো এই অসময়ের চিঠি? অবশ্য যদি তুমি বল একে চিঠি।যদি তুমি বল একে চিঠি, তবে তা ডাকটিকিট ছাড়াই হুশশ্ করে পাড়ি দেবে তোমার দোরগোড়ায় ঠিক ।আর সিক্ত হাতে তুমি কুড়িয়ে নিতেই আমার সব কথার ছুটি ।অথচ নতুন ভাব জমে ওঠে ,কবিতার ছটফটানি ঘিরে ধরে ,আমাকে এরা বসতে দেয় না নির্লিপ্ত। এই যেমন এইমাত্র বৃষ্টি শেষ করে বারান্দায় এসে বসে বিকেলের রঙ নিয়ে আমি সমস্যায় পড়ে যাই। তার রঙ প্রকৃতই গোলাপি নাকি নীলচে হলুদ সে ব্যাপারে আমি ঠিক বলতে পারি না। আর্দ্র সন্ধ্যাতারার নীরবতায় অথবা বিষন্ন পূর্ব দিগন্তে অভিমানের উষ্ণতায়, আমার চোখের তারায় তারায় যে সোনালী স্নান সারা হল ,সে রঙ আমি ঠিক বুঝতে পারি না ।কারণ তুমি জানো, আমি ছবিই আঁকিনি কোনদিন ।আর নইলে ধরে নাও আমি কালারব্লাইন্ড। রঙের ব্যাপারটা বিকেলের আকাশই জানে, আমি ও নিয়ে আর বর্ণনায় যাচ্ছি না ।
জানো, এইমাত্র সন্ধ্যা হচ্ছে। ভিজে পাতায় জলরঙের ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ার মতো, রঙ শুধু রঙ নিয়ে খেলা করে, কত রঙ হারিয়ে, মিশিয়ে ফেলে, তোমায় নিয়ে। এইমাত্র নাম না জানা সব পাখি, দল বেঁধে ফিরে গেল দিনের শেষে, মাথার ওপর দিয়ে ।ঠিক বোঝা গেল না কোথায়, কারণ দ্রুত, খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে কালচে সবুজ সন্ধ্যা। কোনোদিনই আমার কলকাতার বারান্দায় সন্ধ্যা আসে না। কারণ সামনের সব উঁচু বাড়ি আর ওপাশের যত বড় বড় গাছ ডালপালা মেলে দিয়ে এই রঙ বদল ঢেকে দেয় অনায়াসে। অথচ এইখানে, এই জঙ্গিপুরে, ভাল করে সন্ধ্যা দেখব বলে বেরিয়ে এসেছিলুম পিডব্লুডির রাস্তার ধারে ।এপাশে রাস্তাটা একটা বাঁক নিয়েছে আর তার ঠিক পরেই একটা কালভার্ট পেরোলেই, সামনে নদী। ভাবলুম সিগারেট খেতে খেতে রাস্তায় একটা চক্কর দিয়ে আসি ।এদিকে ওদিকে ছোট ছোট হ্যারিকেন জ্বলা দোকানে, ছড়ানো ছেটানো জটলা ।সব কাজের বিষয়, নাকি অকাজের আলোচনা?আজ সন্ধ্যায় তুমি কি পোশাক পড়েছ ,তোমাকে শাড়িতে মানায় ভালো নাকি জিনসে ?এ নিয়ে তারা কখনই একটা ঠিকঠাক সিদ্ধান্তে আসতে পারে না। তাই শেষমেশ তারা সবাই আমার কাছেই হাজির হয় ।এই সাহাপাড়ার সরকারি বাংলোর চাতালে বসে আমি তাদের বুঝিয়ে দিই এই সব বিষয়ের কোনটাই তোমাকে স্পর্শ করে না কেন। তুমি সন্ধ্যার রঙে চঞ্চল বা সকালের স্নিগ্ধতার রঙে সবুজ ,যাই হও না কেন যে কোন সম্পর্কে সে শুধু তুমিই। যেকোন সুগন্ধ, তা সে ফুলেরই হোক বা পার্ক এভিনিউএর, কোনোটাই বেমানান নয় তোমাকে নিয়ে। শেষকালে সেই কথা শুনে ওরা সবাই নিশ্চিন্ত মনে বাড়ি চলে যায় ।ওদিকে ব্যাডমিন্টন খেলা শেষ করে জাল-বাঁশ সব গুটিয়ে পাড়ার ছেলেগুলো হইহই করে বাড়ি যায়। আর তার ঠিক পরেই হঠাৎ দেখলম কোথাকার কালো রং আকাশ থেকে, বন-বাদাড়, মানুষজন আর যত সব রঙীন আস্ফালন মুড়ে দিয়ে ,অনেক অনেক রঙের বদলে এক তাল পিচের মত, মৃতপ্রায় সব ড্রাম থেকে বের হয়ে এসে লেপটে দিল আকাশের গায়ে,পথের গায়ে। এতে রঙ থাক না থাক, এই নিশ্চুপ নিশ্ছিদ্র অন্ধকার দেখাল রঙবদল কাকে বলে। বড় ভাল লাগছিল। জানোতো, অনেকদিন পরে এইভাবে অন্ধকারে একা বড় ভালো লাগছিল ।
এইমাত্র সিগারেটের ভুক্তাবশেষ দলে দিয়ে এসে বারান্দায় এসে বসেছিলুম। ভেতর থেকে চা দিয়ে যাবার কথা ।তাই এর মধ্যে চেয়ার টেবিল সব পাতা হয়ে গেছে। বসে বসে তোমার কথাই ভাবছিলুম। আসলে এই সন্ধ্যার একাকীত্বময় অচেনা ছবি ,এই স্বপ্নিল শান্ত অন্ধকার ,তোমাকে ছাড়া আর কাকে মনে করায় বলোতো ?বিশেষত আমি যখন একা আর আমার যখন সন্ধ্যার আকাশের মত তুমিও আছ। আমার এই কালো হেমৎপুরে, আমি তোমার চোখের তারায় ঠিকই ধরা দেব ,এই চিঠির হঠাৎ আলিঙ্গনে তোমার বুকে, কোনদিন কি এই চিঠির কথাগুলো কবিতা বা ছবি সৃষ্টির আনন্দের মতো দামী হয়ে, মাথা মুণ্ডু লেজ সমেত এক্বেবারে প্রবেশাধিকার পাবে ?
যাঃ,ঐ রে এইমাত্র লোডশেডিং হল ।ভাবনার রাশ ছিঁড়ে, আরো অনেক বেশি ভাবনায় ডুব দিল এই গোটা বারিকপুর অসহায় আমাকে নিয়ে। এ তল্লাটে অবশ্য সন্ধ্যার মুখে লোডশেডিং নিত্যকালের অভ্যাস। তবে ঐ যে ঝপ্ করে অন্ধকারে ঢেকে যাওয়া, এ বড় চমকে তোলা বিরক্তি। আর যা হোক সন্ধ্যার মত চুপিসারে, আদর করতে করতে ও তো আসতে পারে না ।তাই এই অন্ধকারে কোন আহামরিত্ব নেই। মানুষের দেওয়া আলো, মানুষেরই ফিরিয়ে নেওয়া।
জানো ,এই কল্যাণপুরে আমার এই অন্ধকার প্রেম ঘিরে ধরল আমায়, এইসব খোবলানো রাস্তা, কাঁকর, পিচের ভারী গন্ধ আর ট্রাকের আওয়াজ পেরিয়েও মন ছুঁয়ে গেল সন্ধ্যাজলের ভালোবাসায়। যেমন হারিয়ে যায় নিজের সব অহংকার ,কালিমা, এমনকি শরীরও। যেমন কালভার্টে আড্ডাবাজ ছেলে ছোকরা, বাস-লরি ভর্তি কেজো লোকজন, বিকিকিনির পসরা সাজানো ক্রেতা-বিক্রেতা, কত সহজে এই অন্ধকারে ম্লান হয়ে যায়। যেমন ম্লান হয়ে যায় সমস্ত রঙ, তোমার কাছে। আমি তাই এই সজীব অন্ধকারের অভিলাষ, এই বাক্যহীন কালো, তোমার হাতে হাতে ছুঁয়ে দিই, এই অবুঝ চিঠিতে। আর এইখানে, আমার এই কাজীপাড়া বা করিমপুরের অন্ধকার, এইমাত্র আমাকে সেই বৃষ্টিময় দিনগুলোর কথা মনে করিয়ে দেয়, যার জন্য অনেক বছর বেসামাল আমি তোমাকে এই মাত্র আঁকড়ে ধরে থিতু হই, অন্ধকার এই অনেক অন্ধকারের উষ্ণতাকে সাক্ষী রেখে।
জানো, এইমাত্র সন্ধ্যা হচ্ছে। ভিজে পাতায় জলরঙের ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ার মতো, রঙ শুধু রঙ নিয়ে খেলা করে, কত রঙ হারিয়ে, মিশিয়ে ফেলে, তোমায় নিয়ে। এইমাত্র নাম না জানা সব পাখি, দল বেঁধে ফিরে গেল দিনের শেষে, মাথার ওপর দিয়ে ।ঠিক বোঝা গেল না কোথায়, কারণ দ্রুত, খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে কালচে সবুজ সন্ধ্যা। কোনোদিনই আমার কলকাতার বারান্দায় সন্ধ্যা আসে না। কারণ সামনের সব উঁচু বাড়ি আর ওপাশের যত বড় বড় গাছ ডালপালা মেলে দিয়ে এই রঙ বদল ঢেকে দেয় অনায়াসে। অথচ এইখানে, এই জঙ্গিপুরে, ভাল করে সন্ধ্যা দেখব বলে বেরিয়ে এসেছিলুম পিডব্লুডির রাস্তার ধারে ।এপাশে রাস্তাটা একটা বাঁক নিয়েছে আর তার ঠিক পরেই একটা কালভার্ট পেরোলেই, সামনে নদী। ভাবলুম সিগারেট খেতে খেতে রাস্তায় একটা চক্কর দিয়ে আসি ।এদিকে ওদিকে ছোট ছোট হ্যারিকেন জ্বলা দোকানে, ছড়ানো ছেটানো জটলা ।সব কাজের বিষয়, নাকি অকাজের আলোচনা?আজ সন্ধ্যায় তুমি কি পোশাক পড়েছ ,তোমাকে শাড়িতে মানায় ভালো নাকি জিনসে ?এ নিয়ে তারা কখনই একটা ঠিকঠাক সিদ্ধান্তে আসতে পারে না। তাই শেষমেশ তারা সবাই আমার কাছেই হাজির হয় ।এই সাহাপাড়ার সরকারি বাংলোর চাতালে বসে আমি তাদের বুঝিয়ে দিই এই সব বিষয়ের কোনটাই তোমাকে স্পর্শ করে না কেন। তুমি সন্ধ্যার রঙে চঞ্চল বা সকালের স্নিগ্ধতার রঙে সবুজ ,যাই হও না কেন যে কোন সম্পর্কে সে শুধু তুমিই। যেকোন সুগন্ধ, তা সে ফুলেরই হোক বা পার্ক এভিনিউএর, কোনোটাই বেমানান নয় তোমাকে নিয়ে। শেষকালে সেই কথা শুনে ওরা সবাই নিশ্চিন্ত মনে বাড়ি চলে যায় ।ওদিকে ব্যাডমিন্টন খেলা শেষ করে জাল-বাঁশ সব গুটিয়ে পাড়ার ছেলেগুলো হইহই করে বাড়ি যায়। আর তার ঠিক পরেই হঠাৎ দেখলম কোথাকার কালো রং আকাশ থেকে, বন-বাদাড়, মানুষজন আর যত সব রঙীন আস্ফালন মুড়ে দিয়ে ,অনেক অনেক রঙের বদলে এক তাল পিচের মত, মৃতপ্রায় সব ড্রাম থেকে বের হয়ে এসে লেপটে দিল আকাশের গায়ে,পথের গায়ে। এতে রঙ থাক না থাক, এই নিশ্চুপ নিশ্ছিদ্র অন্ধকার দেখাল রঙবদল কাকে বলে। বড় ভাল লাগছিল। জানোতো, অনেকদিন পরে এইভাবে অন্ধকারে একা বড় ভালো লাগছিল ।
এইমাত্র সিগারেটের ভুক্তাবশেষ দলে দিয়ে এসে বারান্দায় এসে বসেছিলুম। ভেতর থেকে চা দিয়ে যাবার কথা ।তাই এর মধ্যে চেয়ার টেবিল সব পাতা হয়ে গেছে। বসে বসে তোমার কথাই ভাবছিলুম। আসলে এই সন্ধ্যার একাকীত্বময় অচেনা ছবি ,এই স্বপ্নিল শান্ত অন্ধকার ,তোমাকে ছাড়া আর কাকে মনে করায় বলোতো ?বিশেষত আমি যখন একা আর আমার যখন সন্ধ্যার আকাশের মত তুমিও আছ। আমার এই কালো হেমৎপুরে, আমি তোমার চোখের তারায় ঠিকই ধরা দেব ,এই চিঠির হঠাৎ আলিঙ্গনে তোমার বুকে, কোনদিন কি এই চিঠির কথাগুলো কবিতা বা ছবি সৃষ্টির আনন্দের মতো দামী হয়ে, মাথা মুণ্ডু লেজ সমেত এক্বেবারে প্রবেশাধিকার পাবে ?
যাঃ,ঐ রে এইমাত্র লোডশেডিং হল ।ভাবনার রাশ ছিঁড়ে, আরো অনেক বেশি ভাবনায় ডুব দিল এই গোটা বারিকপুর অসহায় আমাকে নিয়ে। এ তল্লাটে অবশ্য সন্ধ্যার মুখে লোডশেডিং নিত্যকালের অভ্যাস। তবে ঐ যে ঝপ্ করে অন্ধকারে ঢেকে যাওয়া, এ বড় চমকে তোলা বিরক্তি। আর যা হোক সন্ধ্যার মত চুপিসারে, আদর করতে করতে ও তো আসতে পারে না ।তাই এই অন্ধকারে কোন আহামরিত্ব নেই। মানুষের দেওয়া আলো, মানুষেরই ফিরিয়ে নেওয়া।
জানো ,এই কল্যাণপুরে আমার এই অন্ধকার প্রেম ঘিরে ধরল আমায়, এইসব খোবলানো রাস্তা, কাঁকর, পিচের ভারী গন্ধ আর ট্রাকের আওয়াজ পেরিয়েও মন ছুঁয়ে গেল সন্ধ্যাজলের ভালোবাসায়। যেমন হারিয়ে যায় নিজের সব অহংকার ,কালিমা, এমনকি শরীরও। যেমন কালভার্টে আড্ডাবাজ ছেলে ছোকরা, বাস-লরি ভর্তি কেজো লোকজন, বিকিকিনির পসরা সাজানো ক্রেতা-বিক্রেতা, কত সহজে এই অন্ধকারে ম্লান হয়ে যায়। যেমন ম্লান হয়ে যায় সমস্ত রঙ, তোমার কাছে। আমি তাই এই সজীব অন্ধকারের অভিলাষ, এই বাক্যহীন কালো, তোমার হাতে হাতে ছুঁয়ে দিই, এই অবুঝ চিঠিতে। আর এইখানে, আমার এই কাজীপাড়া বা করিমপুরের অন্ধকার, এইমাত্র আমাকে সেই বৃষ্টিময় দিনগুলোর কথা মনে করিয়ে দেয়, যার জন্য অনেক বছর বেসামাল আমি তোমাকে এই মাত্র আঁকড়ে ধরে থিতু হই, অন্ধকার এই অনেক অন্ধকারের উষ্ণতাকে সাক্ষী রেখে।
পাড়াতুতো পার্ক
পাড়ার এক কোণে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে একটা মলিন, উপেক্ষিত পার্ক। দিন গুনছে। পাড়ার ঝাঁ চকচকে সব বাড়ির ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে তাল রাখতে না পেরে ,যে কোন দিন পড়ে যাবে প্রোমোটারের লোলুপ চোখে। তবুও আছে, অনেকেই না চাইলেও আছে।
তারই এক কোণে একটা ইউক্যালিপটাস গাছ। অনেক ঘটনার সাক্ষী ।কত বছর আগে কেউ যেন দাঁড়াতে বলেছিল বিকেলে ওই গাছটার নীচে। তখন তো মোবাইল ছিল না হাতে হাতে, হাতচিঠিই ছিল শুধু। সে সবই হাতবদল হত নীরবে সেই ইউক্যালিপটাস গাছের নীচে। সে সব দিন আর নেই, নেই সেইসব ছেলেমেয়েরাও। সব স্মৃতি হারিয়ে গেছে বা খেলো হয়ে গেছে ।পার্কের কোণে কোণে জমেছে জঞ্জাল। কিন্তু এত জন্জাল জমা হলেও গাছটা আজও সদর্পে দাঁড়িয়ে আছে সবুজ সবুজ পাতা নিয়ে ।বোকার মত দাঁড়িয়ে আছে। আর কোন মনের চিঠিই হাত বদল হবে না এই গাছ তলায়, এমনকি গোটা পার্কে কোথাও আজ আর জমে ওঠে না ছোট্ট এক টুকরো প্রেম। কারো এক দন্ড সময় নেই, অবসরে বেঞ্চিতে বসে দুটো মনের কথা বলে যাবার। বেঞ্চিগুলোও তাই অবহেলায়, ধুলোয় ঢেকে গেছে ।হয়তো কোন এক সোনালী অতীতের কথা ভেবে ভেবে মন খারাপ করছে ।সন্ধে নামলেই অন্ধকারে ডুবে গিয়ে, মদখোর আর সমাজবিরোধীদের গোপন আস্তানায় পরিণত হয়ে যাবার আগের মুহূর্তে, পার্কটাও বোধহয় দীর্ঘশ্বাস ফেলে,হয়তো ক'ফোঁটা চোখের জল গড়িয়ে পড়ে, কেউ দেখতে পায়না।শুধু হিম গড়িয়ে পড়ে আকাশ থেকে।
এই পার্কেরই আর এক কোণে বেড়ার ধারে বেড়ে উঠেছিল একটা শিউলি গাছ ।রাস্তা দিয়ে যেতে গিয়ে দেখা যেত কত শিউলি ফুল পড়ে আছে গাছের নীচে, রাস্তায়। ডালটাও বেঁকে এসেছিল রাস্তার দিকে,যেন আলাপ করতে চাইত।যেন চাইত ওর ফুল সবাই কুড়িয়ে নিক। কত ছেলে বুড়ো মাঝে মাঝেই কুড়িয়ে নিত তাজা শিউলি ফুল আর ভাবত পুজো এসে গেল ।এই ভাবেই এই গাছটাও নীরবে প্রতিবছর পুজো এসে যাবার বার্তা দিয়ে যেত, সেই সঙ্গে একটু মন কেমন ।কোথায় যেন, কি যেন, কে যেন আছে, অনেকদিন দেখা হয়নি ,কথা হয়নি ।সেই নির্বিবাদী শিউলি গাছটাকেও একদিন রাতে কে যেন কেটে দিয়ে গেল ।ওর অপরাধ ওইভাবে বেঁকে বাইরে রাস্তার উপর এসে পড়াটা ।কারো দোকান বা নিরাপদ পথ চলা বিঘ্নিত হয়েছিল হয়ত। একদিন সকালে দেখা গেল শিউলি গাছটা আর নেই। সেই থেকে রোজ ভোরে আর শিউলি ফুল পড়ে থাকে না চলার পথে। বড্ড ম্যাড়মেড়ে হয়ে গেল জায়গাটা ,এমনকি পুজোর আগমনীটাও। কেউ আর হাত ধরে, ভালোবেসে ,পিঠে হাত বুলিয়ে বলে দেয় না "দ্যাখ, পুজো এসে গেল"।
সবাই চলে যাবে, আমিও। পিছুটানগুলোও শেষ হয়ে যাবে একে একে। শুধু ওরা যে ছিল একদিন, এই স্মৃতিটাই বড় অবুঝ। এটাই থেকে যাবে হয়তো আরো কটা বছর।
তারই এক কোণে একটা ইউক্যালিপটাস গাছ। অনেক ঘটনার সাক্ষী ।কত বছর আগে কেউ যেন দাঁড়াতে বলেছিল বিকেলে ওই গাছটার নীচে। তখন তো মোবাইল ছিল না হাতে হাতে, হাতচিঠিই ছিল শুধু। সে সবই হাতবদল হত নীরবে সেই ইউক্যালিপটাস গাছের নীচে। সে সব দিন আর নেই, নেই সেইসব ছেলেমেয়েরাও। সব স্মৃতি হারিয়ে গেছে বা খেলো হয়ে গেছে ।পার্কের কোণে কোণে জমেছে জঞ্জাল। কিন্তু এত জন্জাল জমা হলেও গাছটা আজও সদর্পে দাঁড়িয়ে আছে সবুজ সবুজ পাতা নিয়ে ।বোকার মত দাঁড়িয়ে আছে। আর কোন মনের চিঠিই হাত বদল হবে না এই গাছ তলায়, এমনকি গোটা পার্কে কোথাও আজ আর জমে ওঠে না ছোট্ট এক টুকরো প্রেম। কারো এক দন্ড সময় নেই, অবসরে বেঞ্চিতে বসে দুটো মনের কথা বলে যাবার। বেঞ্চিগুলোও তাই অবহেলায়, ধুলোয় ঢেকে গেছে ।হয়তো কোন এক সোনালী অতীতের কথা ভেবে ভেবে মন খারাপ করছে ।সন্ধে নামলেই অন্ধকারে ডুবে গিয়ে, মদখোর আর সমাজবিরোধীদের গোপন আস্তানায় পরিণত হয়ে যাবার আগের মুহূর্তে, পার্কটাও বোধহয় দীর্ঘশ্বাস ফেলে,হয়তো ক'ফোঁটা চোখের জল গড়িয়ে পড়ে, কেউ দেখতে পায়না।শুধু হিম গড়িয়ে পড়ে আকাশ থেকে।
এই পার্কেরই আর এক কোণে বেড়ার ধারে বেড়ে উঠেছিল একটা শিউলি গাছ ।রাস্তা দিয়ে যেতে গিয়ে দেখা যেত কত শিউলি ফুল পড়ে আছে গাছের নীচে, রাস্তায়। ডালটাও বেঁকে এসেছিল রাস্তার দিকে,যেন আলাপ করতে চাইত।যেন চাইত ওর ফুল সবাই কুড়িয়ে নিক। কত ছেলে বুড়ো মাঝে মাঝেই কুড়িয়ে নিত তাজা শিউলি ফুল আর ভাবত পুজো এসে গেল ।এই ভাবেই এই গাছটাও নীরবে প্রতিবছর পুজো এসে যাবার বার্তা দিয়ে যেত, সেই সঙ্গে একটু মন কেমন ।কোথায় যেন, কি যেন, কে যেন আছে, অনেকদিন দেখা হয়নি ,কথা হয়নি ।সেই নির্বিবাদী শিউলি গাছটাকেও একদিন রাতে কে যেন কেটে দিয়ে গেল ।ওর অপরাধ ওইভাবে বেঁকে বাইরে রাস্তার উপর এসে পড়াটা ।কারো দোকান বা নিরাপদ পথ চলা বিঘ্নিত হয়েছিল হয়ত। একদিন সকালে দেখা গেল শিউলি গাছটা আর নেই। সেই থেকে রোজ ভোরে আর শিউলি ফুল পড়ে থাকে না চলার পথে। বড্ড ম্যাড়মেড়ে হয়ে গেল জায়গাটা ,এমনকি পুজোর আগমনীটাও। কেউ আর হাত ধরে, ভালোবেসে ,পিঠে হাত বুলিয়ে বলে দেয় না "দ্যাখ, পুজো এসে গেল"।
সবাই চলে যাবে, আমিও। পিছুটানগুলোও শেষ হয়ে যাবে একে একে। শুধু ওরা যে ছিল একদিন, এই স্মৃতিটাই বড় অবুঝ। এটাই থেকে যাবে হয়তো আরো কটা বছর।
Subscribe to:
Posts (Atom)