পরানবাবুর আজকাল এমনিতেই খুব ভোরে ঘুম ভেঙে যায়।আস্তে আস্তে বয়সটা হচ্ছে তো।আগের মতো শরীরটা আর দেয়না।খিদে,ঘুম,স্মৃতি সবই আজকাল কেমন যেন মস্করা করতে শুরু করেছে।তার ওপর আজ মহালয়া।আজকের দিনে, ঠিক ভোর চারটেতে উঠে, রেডিওতে মহিষাসুরমর্দিনী শোনা চল্লিশ বছরের অভ্যেস।এবারেও তার ব্যতিক্রম হয়নি।গিন্নির অসুবিধা হবে বলে তিনি রেডিওটা নিয়ে স্টাডি রুমে চলে গেলেন।ছোট একটা টি মেকার কিনেছেন ক’বছর হলো।ভোরে উঠে আর তো কাউকে বিরক্ত করা চলেনা।ছেলে ,মেয়ের কলেজ ছুটি।বেশ বেলা অব্দি ঘুমোয়।গিন্নিকে পিরিত দেখাতে গেলে মুখঝামটা খাবার ভয়।টি মেকার টাই ভরসা।চা খেতে খেতে একটা বইয়ের পাতা উল্টানো তার চাইই।আজ অবশ্য মহালয়া।বীরেন্দ্র কৃষ্ণের চন্ডী পাঠ আর অপূর্ব সেই সব গান, ছোটবেলার স্মৃতি জাগিয়ে দিয়ে যায়।সেই আধজেগে ,ঘুমচোখে কানে এসে পড়া আর হৃদয়ে ঢুকে যাওয়া সেই অমোঘ শব্দোচ্চারণ আর মধুর গানগুলোর আকর্ষণ আজও একইরকম।মশারির ভেতর থেকে বাবা মার সঙ্গে মহালয়া শোনার স্মৃতি আজও অমলিন।আর একটা অনুভব,সকালের একটু ঠান্ডা হওয়া,নীল আকাশে পেঁজা তুলো মেঘ।পুজো এসে গেল।ব্যাস,এই তিনটি শব্দ যেকোন বয়সের বাঙালিকে যেভাবে আজও আলোড়িত করে ,তার আর কোন দ্বিতীয় উদাহরণ নেই।পরানবাবুর মনে পড়ে যাচ্ছিল বাবা, মা,আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবকে নিয়ে ছোটবেলার পাড়ার পুজোর সেই আনন্দউৎসবের কথা।সেইসব নিখাদ সরল আনন্দময় জীবনের উৎসবঘন এক একটা অধ্যায়ের স্মৃতি।আজ সেসব ছেড়ে তিনি অনেকদিন, অনেক দূরে চলে এসেছেন।আজ তিনি খুব একা,বন্ধুবান্ধবও খুব একটা নেই।আছে শুধু অফিসের কাজের দায়িত্ব,আছে পুজোয় ছুটি পাবার টালবাহানা।ছেলে মেয়ে তো আর যেতেই চায়না তার দেশের বাড়ি।গিন্নিও তথৈবচ।তাই মুখ ফুটে তিনি আর পুজোতে দেশের বাড়ি যাবার নাম করেন না।যা দু একদিন ছুটি জোটে,এই শহুরে রোশনাই আর দাপাদাপিময় পুজোতেই, তার বছর বছর পার হয়ে যায়।মন কিন্তু পড়ে থাকে সেই দেশের বাড়ির শৈশবের পুজোতেই।যাওয়া হয়না,কারো সঙ্গে দেখা হয়না,তবু মনের কোনে একটা আশা বড়ই জানান দেয়।একবার অন্তত নিজের দেশের বাড়ির পুজোয় আবার গিয়ে দাঁড়াবেন।সেই ঢাকের বাদ্যি, সেই সাবেক পুজো, ধুনোর গন্ধ, সন্ধ্যারতি,সেই মায়ের চোখ,সেই চীকের অভ্রর চিকিমিকি, সানাইয়ের সুর,সেই সব মানুষজন আর সেই সব ছোট ছোট আনন্দ ভেসে আসে,ঘিরে ধরে ছোটবেলা। অনেক মনকেমন,অনেক আবেগ ভিড় করে আসে, নিজের একটা গোটা অস্তিত্ব। । মনে পড়ে,বন্ধুদের সঙ্গে ঠাকুর দেখতে যাওয়া,সেই আড্ডার আমেজ ,সেই অফুরন্ত আনন্দময় দিনগুলো। বন্ধুদের সঙ্গে, পাড়ার দাদাদের সঙ্গে, ঠাকুর বায়না করতে যাওয়া আর ঠাকুর আনতে যাওয়ার দিনগুলো । পঞ্চমীর দিন বিকেলে মুখে মুখে পাড়ার সব বাড়িতে রটে যেত “ঠাকুর এসে গেছে”। তারপর চালচিত্র সাজানো, অস্ত্র সাজানো, রঙিন কাগজের শিকলি বানানো, কত আনন্দ। মহা উৎসাহে বন্ধুদের সাথে, পাড়ার দাদাদের সাথে পুজোর ব্যবস্থাপনায় অংশ নেওয়া। একটু বড় হয়ে চাঁদা তোলার গুরুদায়িত্ব পেয়ে যাওয়া, সঙ্গে একটা পোস্ট ‘সহ-সম্পাদক’। নিজের নামটা লিস্টে দেখে সেদিন সে কি গর্ব। সেই সময়, সেই পাড়ার পুজোর স্যুভেনিরেই, সেই প্রথম লেখার সুযোগ, প্রথম আত্মপ্রকাশ ছাপার অক্ষরে। সেদিনের সেই নির্মল আনন্দের দিনগুলো আজ কোথায়!তখন পুজো এলেই বুকের মধ্যে ধুকপুকানিটা কেমন যেন বেড়ে যেত। পুজোর চারটে দিন বেশ তাড়াতাড়ি কেটে যেত, পুজোর শেষ দিকে আনন্দের সঙ্গে সঙ্গে একটা মন খারাপও মিশে থাকত, চোখ ফেটে জল এসে যেত। ন্যাড়া প্যান্ডেল, খালি বেদী,প্যান্ডেল থেকে ডেকোরেটরের লোকেরা কাপড় খুলতে শুরু করেছে, ইলেকট্রিসিয়ানরা লাইট খুলে নিচ্ছে ;এসব সহ্য হত না।দুঃখ, কষ্টেরও সেই বোধহয় প্রথম অনুভূতি- পুজো শেষ।
একবার মনে আছে, সেবার পুজোর চাঁদাপত্তর সেভাবে ওঠেনি। আগের বছরে যারা উদ্যোক্তা ছিল তাদেরই পকেট থেকে অনেক টাকা বেরিয়ে গেছে, তাই এবারে কেউ আর দায়িত্ব নিতে রাজি নয়। পুজো হবে নাই ঠিক। ছোটদের তো খুব মন খারাপ, বড়রাও মৃদুস্বরে নিজেদের মধ্যে আলোচনায় ব্যস্ত, চারিদিকে থমথমে ভাব। সেদিন মহালয়া, তখনো পুজো হবে নাই ঠিক। কেউ মেনে নিতে পারছে না, তবু উপায়ই বা কি? হঠাৎ তুমুল উৎসাহে ফুঁসে উঠল অশোক কাকু, সঙ্গে পেয়ে গেল আরো ক’জন যুবককে। কি, পুজো হবে না? পুজো হবেই। মহালয়ার দিনই চাঁদা তোলা শুরু হল, কাকুরা কজন কোমর বেঁধে নেমে পড়ল। ঠাকুর বায়না হল, কেউ কেউ পকেট থেকে বেশ কিছু জমানো টাকাও দিয়ে ফেলল,অশোককাকুর স্ত্রী, শর্মিলাকাকিমা তো নিজের গয়না পর্যন্ত বাঁধা দিয়ে,টাকা কটা তুলে দিল অশোককাকুর হাতে,সে কি আবেগ, উন্মাদনা। পরের দিনই ঠাকুরদালানে প্যান্ডেল বাঁধা শুরু হল, কি আনন্দ! পুজো তাহলে হবে।ছোট-বড় সবাই মিলে,যে যেভাবে পারল, ঝাঁপিয়ে পড়ল , কাকিমারা ঝাঁপিয়ে পড়ল জোগাড়যন্ত্রে। পুজো হবে না, তা আবার হয় নাকি? বয়স্ক মানুষগুলোর চোখও সেদিন খুশিতে চিকচিক করে উঠেছিল। এমনই বাঙালির পুজোর আবেগ, এ যেন এক অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদ।
সেসবের আজকাল বড়ই অভাব অনুভূত হয়।আর তো সেসব ফিরে আসবে না।কিন্তু দুর্গাপুজো বার বার ফিরে আসে,আশা জাগিয়ে।এইবার বোধ হয় বাড়ি যাওয়া হবে।আর সেই সঙ্গে অনেক মনকেমন,অনেক স্মৃতিতে ডুব,চোখের কোনে একটু জল,অনেক অভিমান।মুখ ফুটে বলার সাহস নেই।সংসারে সবার নিজের নিজের পুজো প্ল্যান তৈরি।ছেলে মেয়ে কেউ যাবে না সেই ম্যাড়ম্যাড়ে পুজোতে,সবাই রুখে দাঁড়াবে।তাই এবারেও মিইয়ে যায় সারা বছর ধরে পুষে আসা সেই একটু আশা।নাঃ, আর দেখা হল না। কিন্তু শৈশবে সেই যে ষষ্ঠীর ভোরে বাড়ির তক্তাপোষে শুয়ে হঠাৎ ঢাকের বাজনা শুনে ঘুম ভেঙে যাওয়া আর প্রচন্ডতম বাস্তবকে মনে পড়ে যাওয়া - আজ থেকে পুজো,সেই আনন্দটুকু আজও মনে আছে। পরানবাবুর আর সেই পুজো নেই, অফিসে কোন ছুটি নেই, বন্ধুদের সঙ্গে তেমন যোগাযোগ নেই, গোলাপি চুড়িদারের সেই মাতন আর নেই, সেই দিন চলে গেছে। ।শুধু পুজো এসে গেছে ,সেই আনন্দটুকু আজও একই রকম আছে ,দুর্গাপুজো রয়ে গেছে। নিজের ইচ্ছে অনিচ্ছের ওপরে উঠে, এখন এই নবআনন্দের পুজো। সবাইকে আনন্দে রাখার একটা বৃথা চেষ্টা ।
বুকের কাছে হাতদুটো জোড়া করে পরানবাবু বিড়বিড় করে বলেন,”মা,এবারেও যাওয়া হল নাগো,দেখা হল না”।বড়বাবুকে হাতে পায়ে ধরে দুদিন ছুটি জোগাড় করেছিলেন। ভেবেছিলেন একবারটি যদি ঢুঁ মেরে আসা যায়।অঙ্কের নিয়মে হয় না জেনেও ভেবেছিলেন।আশা যে মরতে চায়না,অবশ্য সম্ভবও ছিলনা।টি এস এইচ টা অনেক বেড়েছে।ডাক্তার অনেক টেস্ট করছে।প্রোস্টেটও খুব ভোগাচ্ছে। বাড়িতে কেউ জানেনা,একটা খারাপ আভাস পেয়েছেন।কে জানে, সামনের বার থাকবেন কিনা।মার প্রতি খুব কষ্ট,অভিমান হয়।মা,সামনের বার হবে তো দেখা?চোখ ঝাপসা হয়ে আসে।শুধু ভাবতে থাকেন,সামনের বছর ঠিক যাবেন দেশের পুজোয়।তখন হয়ত দুপাশে থাকবেন মা আর বাবা।সেই ছোটবেলার মত।
চন্ডী পাঠে মহালয়ার রাত ভোর হয়।একটা দুটো শিউলি ঝরতে শুরু করে সিমেন্ট বাঁধানো চাতালে।
No comments:
Post a Comment