26 February 2018

পাড়ার খবর

গাছদাদুকে অবাক হয়ে দেখছি।একটা গাছের ডাল কোথ্থেকে কুড়িয়ে নিয়ে ঘুরছেন।না, ভয় পাবার কোনো কারণ নেই,মানুষের ওপর ওনার কোন রাগ নেই।তোমরা হয়তো ওনাকে দেখে ছিটগ্রস্থ ভাববে।আমরা জানি ,উনি গাছ পাগল লোক। রাস্তার আনাচে কানাচে সময় ও সুবিধা পেলেই ওই রিটায়ার্ড ভদ্রলোক গাছ পুঁতে চলেন। ওই ওনার ধ্যানজ্ঞান। তবে লাঠি কেন? অরে একি একটা প্রশ্ন হল ?গাছের পরম শত্রু হল গরু। মুখরোচক খাদ্যতালিকায় গরুরা সাধারণত অতি যত্নে ও অতি কষ্টে পোঁতা দামী কচি গাছকেই স্থান দেয়। গাছ দেখলেই হলো ,মুড়িয়ে একেবারে ন্যাড়া করে দেবে।দাদুর কত সাধনা যে এই করে বিফলে গিয়েছে।তাই ওনাকে রোজ সকালে  আর বিকেলে দেখবে লাঠি হাতে।ভর দেবার নয়,গরু তাড়াবার লাঠি।দাদুরা এমনিই হন বোধহয় ।কোনো একটা কিছু মাথায় চাপলে আর যাবার নয় ।তার যত্নেই জায়গাটা এখন ভরে গেছে ,সবুজে ভরে গেছে মাঠ।  বুক ভরে গেছে নির্মল বাতাস আর বাঁধভাঙা আনন্দে।এছাড়াও দাদুর নানা গুণ আছে।আজব আজব এক্সপেরিমেন্ট করতে ওনার জুড়ি নেই। মশার ওপর লঙ্কার গুঁড়ো ছড়ানো,তেলের সঙ্গে জলের মিশ খাওয়াতে পাতিলেবুর রস ও তেজপাতার ব‍্যবহার ইত‍্যাদি ওনার মহান কীর্তি।যদিও তিনি প্রায়ই দুঃখ করে বলেন তার বৈপ্লবিক আবিষ্কারগুলোর কেউ মূল্য বুঝল না।বয়ঃজ্যেষ্ঠ দের আসরে অবশ্য দাদুর খুবই প্রতিপত্তি এবং তার আবিষ্কার গুলোয় নানা রং চড়িয়ে সেখানে তিনি জাহির করেন। অবশ্য আড়ালে আবডালে ওদের কেউ কেউ ওনাকে বদ্ধ উন্মাদও বলে থাকেন। যাহোক গাছদাদুর লেটেস্ট এক্সপেরিমেন্ট সম্পর্কে কিছু খবর পাওয়া গেছে।এটা নাকি টপ সিক্রেট। দাদুর এক গুণমুগ্ধ ভক্তকে অনেক ধরেকরে যা জানা গেছে তা হল উনি কেবল্ টিভির তার আর কাপড় শুকানোর তার জয়েন করে,তারের অন্যদিকে হেডফোন লাগিয়ে অদ্ভুত অদ্ভুত সব শব্দ শুনতে পাচ্ছেন। অবশ্য তার আগে তিনি একটি ‘ সুপার সেনসিটিভ সার্কিট’ বসিয়ে নিয়েছেন হেডফোনে। একদিন তো তিনি নাকি পরিষ্কার শুনেছেন কে যেন বলছে “খিদে পেয়েছে, খিদে পেয়েছে’। এছাড়াও বাচ্চাদের কান্নার শব্দ,জল ঢালার শব্দ,জিভ ছোলার শব্দ তিনি শুনতে পেয়েছেন।
আর একজন দাদুর কথা লিখতে ইচ্ছে করছে।তাকে সকলে বলে ‘কানে তুলো দাদু'।নামটা কেমন যেন,তাই না?দাদুকে জানিও না যেন,চুপিচুপি বলে রাখি,ঐ নামটা আমরাই দিয়েছি।কেন জান?উনি সবসময় কানের ফুটোয় তুলো এঁটে রাখেন।এ যেন গবুচন্দ্র মন্ত্রীর মত,তাই না?আমরাও তো বলি,বুদ্ধি ঢাকতেই(নাকি বোকামি?)তার এই ব‍্যবস্থা ।অনেকে মজা করে বলে দাদু হলেন ইন্টারন্যাশনাল স্মাগলার।কানের ফুটোতেই ওয়ারলেস যন্ত্র বসানো আছে।সে যাই হোক,দাদু খুব ভাল মানুষ।আর একটা কথা বলতে ভুলে গেছি,কানে তুলো দাদু বাচ্চাদের খুব ভালবাসেন।বাচ্চারা সবসময় ওর সঙ্গে।আর কিছু না হোক,গোটা দশেক টাকা রোজ ওনাকে লজেন্স বিস্কুটের পিছনে গচ্চা দিতে হয়।তাতে অবশ্য তিনি বিন্দু মাত্র বিব্রত নন।
আর একজনের কথা বলি।সে হল পল্টু।পটকা টিঙটিঙে পল্টুর তেজ কিন্তু কম নয়।ঝগড়া হলে আস্তিন গুটিয়ে,জামার বোতাম খুলে ওই সবচেয়ে আগে এগিয়ে যায়।বলা বাহুল্য পরের ঘটনা পল্টুর পক্ষে মোটেই শুভ হয় না।হেঁপোরুগী পল্টুর পেছনে লাগে অনেকে,ব্যঙ্গ করতেও ছাড়ে না।আমার অবশ্য এইভাবে কারো দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে আঘাত দেবার ব্যাপারটা একেবারেই ভালো লাগে না।পল্টু কিন্তু খেলাধূলার অনেক খবর রাখে।আমরা মজা করে বলি 'এবার আপনাদের সামনে বক্তৃতা দিতে আসছেন স্বনামধন্য মহাকাপুরুষ শ্রীমান পল্টুকুমার।'এই গতকালের কথাই ধরনা।মাঠে একটা বড় রোলার পড়ে ছিল,পিচ রোলিং করার জন্য।হঠাৎ দেখি কে সেটাকে ক্লাবঘর পর্যন্ত প্রায় দুশো মিটার ঠেলে এনেছে।পল্টু জানাল সেই এটা করেছে।আমরা তো থ’।অনেক কষ্টে দুজনে মিলে আমরা সেটা ঠেলতে পারি।আর ও কিনা একাই!হঠাৎ ব্যায়ামবীর গবাদা আসতে ঘটনার নিষ্পত্তি হয়। আসলে গবাদাই ওটাকে এনেছে। পল্টু নিজের থেকেই হাত লাগিয়েছিল। তাতে অবশ্য সুবিধা হযনি কিছুই, বরং অসুবিধাই হয়েছে। কারণ গবাদাকে রোলার প্লাস পল্টু দুজনকেই ঠেলে আনতে হয়েছে। তবুও পল্টু তার অবদানের কথা তুলবেই।এই হল পল্টু।তারপর থেকে অনেকে পল্টুর পিছনে লেগে বলে 'পল্টুবাবু আমাদের বাড়িটা একটু ঠেলে রাস্তার মোড়ে নিয়ে আসবেন প্লিজ।' পল্টু ঠোঁটের কোনে একটু হাসি এনেই গম্ভীর হয়ে যায়।
আজ বিকেলে গুলমাষ্টারের সঙ্গে অনেকক্ষণ গল্প হল। অবশ্য গল্পটা একতরফাই হল। আমরা ক’জন বন্ধু চুপচাপই ছিলাম।গুলমাষ্টার একাই বকবক করে তার বিশাল জ্ঞানভান্ডার আমাদের কাছে উজাড় করে দিচ্ছিল।নাম শুনেই বুঝতে পারছ যে তার বেশিরভাগই গুল। তার মধ্যে রামকুমার চট্টোপাধ্যায়ের কোলে বসে বিস্কুট খাবার গল্পটা পুরোনো হয়ে গেছে।এ ডিভিশনে ফুটবল খেলার গল্পটাও আজকাল চলে না।এখন চলছে যানবাহনের গল্প। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ গাড়ি নাকি লরী।গুলমাষ্টার এককালে নাকি খুব লরী চালিয়েছে।পটলা এরোপ্লেনের কথা তুলতে গুলমাষ্টার বলে উঠল 'এরোপ্লেনে তো ব্রেকই নেই।'আমরা অবাক।বাপ্পা আপত্তি তুলতেই ও বলল 'সে সব হল পুরোনো এরোপ্লেন। আজকাল এরোপ্লেনে ব্রেক থাকে না। রানওয়েই এমন ভাবে তৈরি যে ওখানে ব্রেক দেবার ব্যবস্থা আছে। যেকোন বিষয়েই গুলমাষ্টারের অগাধ জ্ঞান। চার্লি চ্যাপলিন কার নকল করত, মারাদোনা কোন সিনেমায় অভিনয় করেছিল,অনুপ জালোটার চুলটা পরচুলা কিনা, ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যুর পিছনে ভিনগ্রহের মদত কতটা এসব জানতে হলে শিগগির চলে এসো আমাদের পাড়ায়। গুলমাষ্টারের আরও নতুন নতুন গুল বেরিয়েছে,সস্তায় পাওয়া যাচ্ছে। সে নাকি সামনের মাসেই রাশিয়া চলে যাবে। ওখানে ওর কি কাকা না জ্যাঠা আছে। সেখানেই এবার থেকে থাকবে। অবশ্য এর আগেও একবার গিয়েছিল, হিন্দি ভাষা শেখাতে।মাইনেটা নাকি বড্ড কম দিত।লাখদুয়েক।তাই পোষায়নি।বোঝো।এবার গুলমাষ্টারের পরিচয়টা দিয়ে দিই।ও একটা জামা কাপড় ইস্ত্রির দোকান চালায়। যখন জামা কাপড়ে দাগ লাগিয়ে ফেলে, লোকজন ওকে খুব বকাবকি করে, কাপড়ের দাম আদায় করার ভয় দেখায়,তখন গুল মাষ্টার শুকানো মুখে ক্ষমা চেয়ে নেয় আর ওর মুখ চোখে একটা করুন ভাব ফুটে ওঠে। তখন আমাদেরই দুঃখ হয়। মনে মনে বলি এ পোড়া দেশ তোমার জন্য নয়, তুমি রাশিয়াতেই চলে যেও।দেখ তোমার গুলগুলো সত্যি হয়েই নেমে আসবে। আমার মনে হয় গুলমাষ্টারও সেই একই প্রার্থণা করে।
আসল লোকটার কথাই এখনো বলা হয়নি। সে হল জগাপাগলা।ওর মেন কাজ বড় রাস্তার মোড়ে ট্রাফিক পুলিশকে সাহায্য করা। ট্রাফিক পুলিশের অসুবিধা না সুবিধা কি হচ্ছিল বোঝা গেল না, কিন্তু সত্যি বলতে পাগলা জগার ট্রাফিক সেন্স কিন্তু ১৪ আনাই আছে, দেখলে অবাক হতে হয়। এবার ওর অন্য পরিচয়গুলো দিই। ফুটবল, ক্রিকেট থেকে শুরু করে সাঁতার, পড়াশোনা, মারামারি সবেতেই ও আছে।ও থাকবেই। তবে ফুটবল যখন খেলে,তখন ও একাই খেলে,মানে ওকে খেলতে দিতে হয়। কেউ যদি ওর পায়ের কাছে পড়েছে,তো তার পা খুলে যাবার জোগাড় হবে। মনে আছে পায়ের ব্যাথায় সাতদিন কষ্ট পেয়েছিলাম।আর কেউ যদি গোল মিস্ করেছে  বা বাজে গোল খেয়েছে,তার আর নিস্তার নেই। গালাগাল, মারধোর সবই চলবে তার ওপরে।জগার গায়ে যা জোর,কে কি বলবে সাহস করে!অথচ ও নিজে গোল মিস্ করলে দোষটা অবশ্যই গিয়ে পড়বে পাঁচ হাত ,দশ হাত এমনকি মাঠের বাইরেরও কারোর না কারোর ওপর-নিশ্চিতভাবেই।লেখাপড়াতে ও খুবই ভাল, যদিও তিন বছর ধরে ক্লাস নাইনে পড়ছে।হল কি মাধ্যমিকের রেজাল্ট বের হতেই দেখি জগা হাসি হাসি মুখ করে বাড়ি থেকে বের হচ্ছে।ও নাকি মাধ্যমিক পাশ করেছে। যাকগে, কোন ডিভিশন? ফার্স্ট ডিভিশন, দুটো লেটার। আমরা তো হাঁ।ও হেসে বলল ওটা ওর বাড়ির পরীক্ষা। ওর এক পাগলা কাকা আছে।সে প্রতি বছর ওর মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক,বিএ,এম এ এসব পরীক্ষা নেয়। আমার মনে পড়ল গতবছর এইভাবে ও বিএ পাশ করে নিয়েছিল।আর এবার মাধ‍্যমিকের গন্ডীও পার হল।ওকে অভিনন্দন জানাতে ভুলিনি আমরা। সত্যিই এক বিরল সাফল্য। আর একটা গুণ আছে ওর,সকাল থেকে রাত, যতক্ষণ না ওর ঘুম পায়,ওর বাড়িতে টিভি চলে।কে দেখে জানিনা,তবে বেশ ভদ্রভাবেই চলে। কারণ ওদের বাড়ির ত্রিসীমানায় একটা কুকুরের লেজও চোখে পড়ে না। আমরা কোনমতে বেঁচে আছি, বেঁচে গেছেন কানেতুলো দাদু। দেখবে ঐ বিকট শব্দেও এবং উনি জগার পাশের বাড়িতে থাকা সত্ত্বেও গুনগুন করে গান ধরেন “সবারে করি আহ্বান…”। বাস্তবিক সবারে আমন্ত্রণ কোনদিনও করেন না।মেয়ের বিয়েতে আমাকে নেমন্তন্নই করেন নি। খুব রেগে আছি তাই, বাড়ির দরজায় সেদিন বড় বড় করে লিখে এসেছি 'কানেতুলো দাদু’। এখনও সে লেখা দাদু তুলতে পারেনি, বিশ্বাস না হলে এখনই দেখে এস গিয়ে।

24 February 2018

ছাদ


সকালবেলা  দাঁত  মাজতে  মাজতে  ছাতে উঠেছিলুম। এই  সময়  বেশ ফুরফুরে হাওয়া দেয়। গলির ওপারে কাকলিদের বাড়ির ছাতে কাকলিকেও দেখা যায়। দাঁত মাজতে মাজতে সে সবই দেখছিলুম। হঠাৎ একটা ক্যাম্বিস বল এসে ধপ্ করে মাথায় পড়ল। চারপাশে খুঁজেও কাউকে দেখতে পেলুম না। এই সাতসকালে কে আবার সখ করে ক্রিকেট খেলছে!তবে বলটা হাতে নিয়ে বেশ পছন্দ   হল। বিকেলে উঠোনে বেশ লাথানো যাবে,ফোকোটে পাওয়া যখন। ভেবে বলটা নিয়ে নামতে যাব , হঠাৎ কোথ্থকে কে যেন বলে উঠল "বেওয়ারিশ   ভেবে মালটা চুপচাপ ঝেড়ে দিচ্ছ গুরু "। অবাক হয়ে চারপাশে খুঁজেও কাউকে দেখতে পেলুম না। বিলুটা করছেনা তো ?কিন্তু বিলুদের ছাদে কেউ নেই। রাকেশদের বাড়ি আরও দূরে। কিছুতেই কিছু মাথায় ঢুকল না। কে বলল তাহলে?হঠাৎ  জলের ট্যঙ্কের তলা থেকে গুঁড়ি মেরে ময়লা জামাকাপড় পরা বড় বড় চুলওলা একটা রোগাপটকা লোক বেরিয়ে এল। এসেই হ্যা হ্যা করে দাঁত বের করে এমন হাসতে লাগল যে পিত্তি জ্বলে যেতে বাধ্য। খুব রাগ হল। সাতসকালে এ ব্যাটা ছাদে এল কিকরে?নিশ্চই রাতে চুরির মতলবে এসেছিল। বাবাকে কথাটা বলতে যাব কিনা ভাবছি,হঠাৎ লোকটাই বলে উঠল “ ছি ছি,চুরি করা মহাপাপ। ওসব করা কি আমার সাজে!চেহারাটা অবশ্য চোরের মত হয়ে গেছে,কিন্তু বংশের ইজ্জতের সওয়াল আছে তো।" বলে ঘাড় বেঁকিয়ে হাসতে লাগল আর আমাকে নিরীক্ষণ করতে লাগল। “কি বংশ?”প্রশ্ন  করতে যাব, হঠাৎ এবারও টেলিপ্যাথিতে লোকটা মনের কথা জেনে ফেলে বলল “রায়বাহাদুর বিজয়কিশোরের বংশের একমাত্র বংশধর আমি গোলোককিশোর সিংহ”। বলে হাতের একটা কালচে মত দাগ না জড়ুল কি একটা দেখাল। সাতসকালে এমন পাগলের উৎপাত সহ্য হল না। বললাম “এখানে কি করছ তবে?সকালবেলা ?” লোকটা গম্ভীরভাবে বলল“এজ্ঞে হাওয়া খাচ্ছি”। “তো আমাদের ছাদে কেন?এটা কি হাওয়া খাবার জায়গা?”আমার রাগত প্রশ্ন । লোকটা খুব বিরক্ত হল কথাটা শুনে। তারপর ব্যাডমিন্টন-এর একটা ভাঙা র‍্যাকেট কুড়িয়ে নিয়ে কোমরে গুঁজে পাঁচিল টপকে পাইপ বেয়ে নামতে লাগল। একবার শুধু মাথাটা তুলে বলল “গুরু,তুমি আমাকে ছাদ দেখাচ্ছ?আমাদের যা ছাদ ছিল,তাতে তোমাদের মতো দশটা ছাদ ধরে যেত।সব ছাদের মায়া আমি ত্যাগ করেছি। ” তারপর কি মনে পড়ে যেতে আবার একটু উঠে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল “তোমার আমায় সকলের ছাদ তো ওই একটাই। সকালে যার রঙ লাল,দুপুরে আকাশি আর রাতে কাল। কটা ছাদ নেবে তুমি?”বলে কি সব বলতে বলতে নামতে লাগল। খুব রেগেমেগে কি সব গালাগালিও বোধহয় দিতে লাগল। কটা কথা কানে এল। “..… ছাদের জমিদারি পেয়েছে। ওর বাপের ছাদ?ছাদ সবার। সববার ছাদ। শা * ..…। ”বলতে বলতে নেমে গেল পাগলটা। আর কোনওদিন দেখিনি তাকে। কিন্তু ওর শেষ কথাগুলো এখনো ভুলতে পারিনি ..… আজ এই বিশ বছর পরেও।

22 February 2018

আর একটা পুজো



পরানবাবুর আজকাল এমনিতেই খুব ভোরে ঘুম ভেঙে যায়।আস্তে আস্তে বয়সটা হচ্ছে তো।আগের মতো শরীরটা আর দেয়না।খিদে,ঘুম,স্মৃতি সবই আজকাল কেমন যেন মস্করা করতে শুরু করেছে।তার ওপর আজ মহালয়া।আজকের দিনে, ঠিক ভোর চারটেতে উঠে, রেডিওতে মহিষাসুরমর্দিনী শোনা চল্লিশ বছরের অভ্যেস।এবারেও তার ব্যতিক্রম হয়নি।গিন্নির অসুবিধা হবে বলে তিনি রেডিওটা নিয়ে স্টাডি রুমে চলে গেলেন।ছোট একটা টি মেকার কিনেছেন ক’বছর হলো।ভোরে উঠে আর তো কাউকে বিরক্ত করা চলেনা।ছেলে ,মেয়ের কলেজ ছুটি।বেশ বেলা অব্দি ঘুমোয়।গিন্নিকে পিরিত দেখাতে গেলে মুখঝামটা খাবার ভয়।টি মেকার টাই ভরসা।চা খেতে খেতে একটা বইয়ের পাতা উল্টানো তার চাইই।আজ অবশ্য মহালয়া।বীরেন্দ্র কৃষ্ণের চন্ডী পাঠ আর অপূর্ব  সেই সব গান, ছোটবেলার স্মৃতি জাগিয়ে দিয়ে যায়।সেই আধজেগে ,ঘুমচোখে কানে এসে পড়া আর হৃদয়ে ঢুকে যাওয়া সেই অমোঘ শব্দোচ্চারণ আর মধুর গানগুলোর আকর্ষণ আজও একইরকম।মশারির ভেতর থেকে বাবা মার সঙ্গে মহালয়া শোনার স্মৃতি আজও অমলিন।আর একটা অনুভব,সকালের একটু ঠান্ডা হওয়া,নীল আকাশে পেঁজা তুলো মেঘ।পুজো এসে গেল।ব্যাস,এই তিনটি শব্দ যেকোন বয়সের বাঙালিকে যেভাবে আজও আলোড়িত করে ,তার আর কোন দ্বিতীয় উদাহরণ নেই।পরানবাবুর মনে পড়ে যাচ্ছিল বাবা, মা,আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবকে নিয়ে ছোটবেলার পাড়ার পুজোর সেই আনন্দউৎসবের কথা।সেইসব নিখাদ সরল আনন্দময় জীবনের উৎসবঘন এক একটা অধ্যায়ের স্মৃতি।আজ সেসব ছেড়ে তিনি অনেকদিন, অনেক দূরে চলে এসেছেন।আজ তিনি খুব একা,বন্ধুবান্ধবও খুব একটা নেই।আছে শুধু অফিসের কাজের দায়িত্ব,আছে পুজোয় ছুটি পাবার টালবাহানা।ছেলে মেয়ে তো আর যেতেই চায়না তার দেশের বাড়ি।গিন্নিও তথৈবচ।তাই মুখ ফুটে তিনি আর পুজোতে দেশের বাড়ি যাবার নাম করেন না।যা দু একদিন ছুটি জোটে,এই শহুরে রোশনাই আর দাপাদাপিময় পুজোতেই, তার বছর বছর পার হয়ে যায়।মন কিন্তু পড়ে থাকে সেই দেশের বাড়ির শৈশবের পুজোতেই।যাওয়া হয়না,কারো সঙ্গে দেখা হয়না,তবু মনের কোনে একটা আশা বড়ই জানান দেয়।একবার অন্তত নিজের দেশের বাড়ির পুজোয় আবার গিয়ে দাঁড়াবেন।সেই ঢাকের বাদ্যি, সেই সাবেক পুজো, ধুনোর গন্ধ, সন্ধ্যারতি,সেই মায়ের চোখ,সেই  চীকের অভ্রর চিকিমিকি, সানাইয়ের সুর,সেই সব মানুষজন আর সেই সব ছোট ছোট আনন্দ ভেসে আসে,ঘিরে ধরে ছোটবেলা। অনেক মনকেমন,অনেক আবেগ ভিড় করে আসে, নিজের একটা গোটা অস্তিত্ব। । মনে পড়ে,বন্ধুদের সঙ্গে ঠাকুর দেখতে যাওয়া,সেই  আড্ডার আমেজ ,সেই অফুরন্ত আনন্দময় দিনগুলো। বন্ধুদের সঙ্গে, পাড়ার দাদাদের সঙ্গে,  ঠাকুর বায়না করতে যাওয়া  আর ঠাকুর আনতে যাওয়ার দিনগুলো । পঞ্চমীর দিন বিকেলে  মুখে মুখে  পাড়ার সব বাড়িতে রটে যেত “ঠাকুর এসে গেছে”।  তারপর চালচিত্র সাজানো, অস্ত্র সাজানো, রঙিন কাগজের শিকলি বানানো, কত আনন্দ।  মহা উৎসাহে  বন্ধুদের সাথে, পাড়ার দাদাদের সাথে পুজোর ব্যবস্থাপনায় অংশ নেওয়া। একটু বড় হয়ে চাঁদা তোলার গুরুদায়িত্ব পেয়ে যাওয়া,  সঙ্গে একটা পোস্ট ‘সহ-সম্পাদক’।  নিজের নামটা লিস্টে দেখে সেদিন সে কি গর্ব।  সেই সময়, সেই পাড়ার পুজোর স্যুভেনিরেই, সেই প্রথম লেখার সুযোগ, প্রথম আত্মপ্রকাশ ছাপার অক্ষরে। সেদিনের সেই নির্মল আনন্দের দিনগুলো আজ কোথায়!তখন পুজো এলেই বুকের মধ্যে  ধুকপুকানিটা কেমন যেন বেড়ে যেত। পুজোর চারটে দিন বেশ তাড়াতাড়ি কেটে  যেত, পুজোর শেষ দিকে আনন্দের সঙ্গে সঙ্গে একটা মন খারাপও মিশে থাকত, চোখ ফেটে জল এসে যেত। ন্যাড়া প্যান্ডেল, খালি বেদী,প্যান্ডেল থেকে ডেকোরেটরের লোকেরা কাপড় খুলতে শুরু করেছে, ইলেকট্রিসিয়ানরা লাইট খুলে নিচ্ছে ;এসব সহ্য হত না।দুঃখ, কষ্টেরও সেই বোধহয় প্রথম অনুভূতি- পুজো শেষ।
একবার মনে আছে, সেবার পুজোর চাঁদাপত্তর সেভাবে ওঠেনি। আগের বছরে যারা উদ্যোক্তা ছিল তাদেরই পকেট থেকে অনেক টাকা বেরিয়ে গেছে, তাই এবারে কেউ আর দায়িত্ব নিতে রাজি নয়। পুজো হবে নাই ঠিক। ছোটদের তো খুব মন খারাপ, বড়রাও মৃদুস্বরে নিজেদের মধ্যে আলোচনায় ব্যস্ত, চারিদিকে থমথমে ভাব। সেদিন মহালয়া, তখনো পুজো হবে নাই ঠিক। কেউ মেনে নিতে পারছে না, তবু উপায়ই বা কি? হঠাৎ তুমুল উৎসাহে ফুঁসে উঠল অশোক কাকু, সঙ্গে পেয়ে গেল আরো ক’জন যুবককে। কি, পুজো হবে না? পুজো হবেই। মহালয়ার দিনই চাঁদা তোলা শুরু হল, কাকুরা কজন কোমর বেঁধে নেমে পড়ল। ঠাকুর বায়না হল, কেউ কেউ পকেট থেকে বেশ কিছু জমানো টাকাও দিয়ে ফেলল,অশোককাকুর স্ত্রী, শর্মিলাকাকিমা তো নিজের গয়না পর্যন্ত বাঁধা দিয়ে,টাকা কটা তুলে দিল অশোককাকুর হাতে,সে কি আবেগ, উন্মাদনা। পরের দিনই ঠাকুরদালানে প্যান্ডেল বাঁধা শুরু হল, কি আনন্দ! পুজো তাহলে হবে।ছোট-বড় সবাই মিলে,যে যেভাবে পারল, ঝাঁপিয়ে পড়ল , কাকিমারা ঝাঁপিয়ে পড়ল জোগাড়যন্ত্রে। পুজো হবে না, তা আবার হয় নাকি? বয়স্ক মানুষগুলোর চোখও সেদিন  খুশিতে চিকচিক করে উঠেছিল। এমনই বাঙালির পুজোর আবেগ, এ যেন এক অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদ।
সেসবের আজকাল বড়ই অভাব অনুভূত হয়।আর তো সেসব ফিরে আসবে না।কিন্তু দুর্গাপুজো বার বার ফিরে আসে,আশা জাগিয়ে।এইবার বোধ হয় বাড়ি যাওয়া হবে।আর সেই সঙ্গে অনেক মনকেমন,অনেক স্মৃতিতে ডুব,চোখের কোনে একটু জল,অনেক অভিমান।মুখ ফুটে বলার সাহস নেই।সংসারে সবার নিজের নিজের পুজো প্ল্যান তৈরি।ছেলে মেয়ে কেউ যাবে না সেই ম্যাড়ম্যাড়ে পুজোতে,সবাই রুখে দাঁড়াবে।তাই এবারেও মিইয়ে যায় সারা বছর ধরে পুষে আসা সেই একটু আশা।নাঃ, আর দেখা হল না। কিন্তু শৈশবে সেই যে ষষ্ঠীর ভোরে  বাড়ির তক্তাপোষে শুয়ে হঠাৎ ঢাকের বাজনা শুনে ঘুম ভেঙে যাওয়া আর প্রচন্ডতম বাস্তবকে মনে পড়ে যাওয়া - আজ থেকে পুজো,সেই আনন্দটুকু আজও মনে আছে। পরানবাবুর আর সেই পুজো নেই, অফিসে কোন ছুটি নেই, বন্ধুদের সঙ্গে তেমন যোগাযোগ নেই, গোলাপি চুড়িদারের সেই মাতন আর নেই, সেই দিন চলে গেছে। ।শুধু পুজো এসে গেছে ,সেই আনন্দটুকু আজও একই রকম আছে ,দুর্গাপুজো রয়ে গেছে। নিজের ইচ্ছে অনিচ্ছের ওপরে উঠে, এখন এই নবআনন্দের পুজো। সবাইকে আনন্দে রাখার একটা  বৃথা চেষ্টা ।
বুকের কাছে হাতদুটো জোড়া করে পরানবাবু বিড়বিড় করে বলেন,”মা,এবারেও যাওয়া হল নাগো,দেখা হল না”।বড়বাবুকে হাতে পায়ে ধরে দুদিন ছুটি জোগাড় করেছিলেন। ভেবেছিলেন একবারটি যদি ঢুঁ মেরে আসা যায়।অঙ্কের নিয়মে হয় না জেনেও ভেবেছিলেন।আশা যে মরতে চায়না,অবশ্য সম্ভবও ছিলনা।টি এস এইচ টা অনেক বেড়েছে।ডাক্তার অনেক টেস্ট করছে।প্রোস্টেটও খুব ভোগাচ্ছে। বাড়িতে কেউ জানেনা,একটা খারাপ আভাস পেয়েছেন।কে জানে, সামনের বার থাকবেন কিনা।মার প্রতি খুব কষ্ট,অভিমান হয়।মা,সামনের বার হবে তো দেখা?চোখ ঝাপসা হয়ে আসে।শুধু ভাবতে থাকেন,সামনের বছর ঠিক যাবেন দেশের পুজোয়।তখন হয়ত দুপাশে থাকবেন মা আর বাবা।সেই ছোটবেলার মত।
চন্ডী পাঠে মহালয়ার রাত ভোর হয়।একটা দুটো শিউলি ঝরতে শুরু করে সিমেন্ট বাঁধানো চাতালে।