(এরপর জানতে পুরো গল্পটি পড়তে হবে)
আমি আবেগ ও অনুভূতিপ্রবণ,ভাবুক আর সৃষ্টিশীল।জীবনের চলা,ওঠাপড়া আর অভিজ্ঞতা নিংড়োনো এই সব লেখা ।এ আমার পাগল মনের নিঃশেষিত প্রকাশ।
30 May 2020
সরলাবালা স্মৃতি লাইব্রেরী
রবিবার। সপ্তাহের এই একটা দিন, বৃষ্টির পরিচিত সবার সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। কিছু কথা বলবার অবশ্য সেভাবে কোন সুযোগ হয়না, লাইব্রেরিতে কথা বলা বারণ। ভেতরে ঢুকলেই, অসংখ্য প্রিয় বইয়ের সম্ভার, থাকে থাকে আলমারিগুলোতে সাজানো রয়েছে ।এর মধ্যে থেকে ,পছন্দসই বই বেছে নেওয়াটা সত্যিই কঠিন, কোনটা ছেড়ে কোনটা নিই।রবিবার নিয়ম করে, বৃষ্টির লাইব্রেরি যাবার আর একটা কারণ হল অয়ন, ওর সঙ্গেও দেখা হয় যে। আসার পথে কিছুটা সময় একসাথে পথ চলা , সাধারণ কিছু কথা হয়,ব্যাস। অয়ন কখনও তার নতুন কবিতা প'ড়ে শোনায়।কখনও বা কোন পত্রিকায় অয়নের লেখা ছাপা হলে , সবাই সেটা কাড়াকাড়ি ক’রে পড়ে। বৃষ্টি অবাক হয়ে শোনে।
বুদ্ধদেব গুহর 'বাবলি' উপন্যাসটা দুপুরে শু'য়ে শু'য়ে পড়ছিল বৃষ্টি । বই পড়তে পড়তে,ও এক নিজস্ব গোপন ভাবনার জগতে বিচরণ করে। উপন্যাসের কোন কোন চরিত্র যেন ও নিজে , আবার কোনটা যেন অয়ন। শুধু এই প্রেমের গল্পগুলো যদি বাস্তবেও সত্যি হত! যদি ওর দিকে অয়ন একটু ফিরে তাকাত! আর পাঁচজনের একজন করে নয়, যদি একটু আলাদা চোখে দেখত ! ওর বেস্টফ্রেন্ড শম্পা মজা করে বলে 'দিবানাপন'।এসব ভাবতে ভাবতেই, কখন যেন ওর চোখটা লেগে গিয়েছিল।
সেই সরলাবালা স্মৃতি লাইব্রেরি, সেই রোববার ।আজও সেই একই অবস্থা ,কোন আলমারি ছোঁয়ার উপায় নেই। আজ ও এসেছে, অয়নের লেখা বইটা নেবে বলে।অয়ন বসুর প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'রাতের বলভি', কেউ তুলে নেবার আগেই ওকে নিতে হবে। বৃষ্টি তিন দিন ধরে অপেক্ষা ক'রে রয়েছে, কবে রোববার আসবে, লাইব্রেরি খুলবে। তাই আজ সকাল-সকালই পৌঁছে গেছে লাইব্রেরিতে। লাইব্রেরি খুলতেই,ভিড় ঠেলে, প্রথম আলমারির কাছে গেল। সেখানে স্বপ্না, বুলিদি, শেখরদা সবাই বই খুঁজছে। ওদিকের আলমারিগুলোতে রাজা, অঞ্জন, শর্বরী আরো অনেকে। এরই মধ্যে, বৃষ্টি পাগলের মত খুঁজে চলেছে সেই বইটা।হঠাৎ ওর মনে হল, কেউ নিয়ে নেয়নি তো অয়নের বইটা? ভাবতেই হতাশ লাগল, আর খুঁজতে ইচ্ছে করল না। তিনটে আলমারি পরে শর্বরী দাঁড়িয়ে। ও’ও ঘেমে গেছে, তবু খুঁজে চলেছে ।না পেয়ে কেমন যেন কাঁদো-কাঁদো ভাব!
এমন সময় গোরাদা এসে হাজির ।দু'হাতে অনেক বই । হঠাৎ তারই মধ্যে চোখটা আটকে গেল বৃষ্টির।ঐ তো বইটা, 'রাতের বলভি'! বলতে চাইল 'বৃষ্টি সরকার, কার্ড নাম্বার একশো সাত। আমি নেব...' কিন্তু তার আগেই শর্বরী বলে উঠল, 'আমি অয়ন বসুর বইটা নেব। কার্ড নাম্বার একশো তিয়াত্তর'। বৃষ্টি অবাক হয়ে চেয়ে থাকে শর্বরীর মুখের দিকে । ওর আর কোন বই নেবার নেই ।গোরাদা শর্বরীর কার্ডটা হাতে নিয়ে, বইটা ইস্যু করছে। অয়ন যেন হারিয়ে যাচ্ছে,লুঠ হয়ে যাচ্ছে ওর থেকে। সমস্ত লাইব্রেরির সবকটা বই যেন ওর দিকে বিদ্রুপ করে হেসে উঠল।কখন যে শম্পা এসে ওর হাত ধরল আর আলতো চাপ দিল, ওর মনে নেই ,বুকটা ভেঙে গেছে ।
স্বপ্নটা দেখতে দেখতে কেঁদেই ফেলেছিল বৃষ্টি ।স্বপ্ন তো নয়,দুঃস্বপ্ন। সেদিনের পর থেকে, অয়নের প্রতি বৃষ্টির অনুরাগ-আকর্ষণ-মোহ সবই যেন আরও বেড়ে গেল। লাইব্রেরি থেকে ফেরার সময়, বাড়ী ফেরার পথেই পড়ে বৃষ্টির বাড়ি। রাস্তার শেষটুকু, গল্প করতে করতে দু'জনে একসঙ্গে হাঁটে।অয়ন সাইকেলে চাপে না,হেঁটেই যায়।এক এক দিন ওর নতুন লেখা কবিতাও দেয় বৃষ্টিকে, বাকি সবাই অন্য পথে চলে যাবার পর।অয়নের মনে হয় বৃষ্টির সঙ্গে পথ চলার সময়টা এত কম কেন?সেই প্রথম,আর সেই শেষ। আর এগোল না ওদের অব্যক্ত প্রেম।অয়ন তো পড়াশোনাতে বরাবরই ভাল ছিল, ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করতে না করতেই, এক রবিবার সবার হইহুল্লোড়-আনন্দের মধ্যে বৃষ্টি জানতে পারল,অয়ন টাটায় একটা ভাল কোম্পানিতে, চাকরি পেয়ে গেছে। কোনদিনও ও বিদায় দিতে পারবে না অয়নকে। অয়নও তো কোনদিন মুখ ফুটে, কিছু বলেনি । শুধু 'ফিরে আসব' সেই ছিল অয়নের শেষ কথা, মিথ্যে কথা। আর কোনদিনও কেউ ফেরেনি।
বৃষ্টিরও জীবন অবশ্য থেমে থাকেনি, পিসির দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়ের হঠাৎ ভাল লেগে যায় ওকে, বিয়ের কথাবার্তা চলতে থাকে। অন্যদিকে কবি-লেখক হিসেবে তখন অল্পস্বল্প নাম করেছে অয়ন, যে অয়নের কবিতা, ওর মুখ থেকে শুনত,বা হাতে লেখা চিরকুট পেত, এখন সেসব কাগজের পাতায় পড়তে হয়।বৃষ্টির মনটা উদাস হয়ে থাকে। অবশ্য বৃষ্টি আর বেশিদিন অয়নের কথা ভেবে, চোখের জল ফেলবার সময় পেল না। ক'দিনের মধ্যেই ওর বিয়ের ব্যবস্থা পাকা করে ফেলল, দুই পরিবারের লোকজন ।অয়ন নামের অধ্যায়টা ধীরে ধীরে শেষ হয়ে গেল বৃষ্টির জীবনের বই থেকে। বিয়ের পরে সাউথ ক্যালকাটা থেকে ওর আর সরলাবালা স্মৃতি লাইব্রেরিতে আসাও সম্ভব হত না ।তাই লাইব্রেরিটাও ওর জীবন থেকে বাদ পড়ে গেল বরাবরের মত।
বছর দশেক পরের কথা ।অয়ন এখন যথেষ্ট নামকরা সাহিত্যিক।কত গল্প, উপন্যাস নিয়মিত প্রকাশ হয় বড় বড় সব পত্র পত্রিকায়।এ বছরই বেরোল ওর প্রথম উপন্যাস 'সরলাবালা স্মৃতি লাইব্রেরি', এক প্রথিতযশা পাবলিশিং হাউজ থেকে। অয়নের এই মহান কীর্তিতে উৎসাহিত হয়ে, ওর পুরোনো বন্ধুরা সবাই মিলে ঠিক করল ,ওকে একটা সংবর্ধনা দেবে। বইয়ের নাম যা, সেই সরলাবালা স্মৃতি লাইব্রেরিতেই অনুষ্ঠানটা হবে। অনুষ্ঠানের শেষে এক কপি বই, ইন্দ্রকে আলাদা করে দেয় অয়ন। বলে, 'বৃষ্টির কাছে পৌঁছতে হবে বইটা,পারবি?' এতদিন পরে বৃষ্টিকে কিছু দেওয়া,কিছু লেখা। সেই বৃষ্টি,যে ওর প্রথম যৌবনের, প্রথম প্রেমের মুগ্ধতা হয়ে, ঐ দিনগুলোতেই চিরকালের জন্য স্থির হয়ে রয়ে গেছে। অয়নের ভাল লাগা, ভালবাসা , আড়ালে লুকিয়ে বৃষ্টিকে দেখা,ওর না বলতে পারা অনেক কথা, জেগে ঘুমিয়ে সত্যি-স্বপ্ন-সবেতেই শুধু ছিল বৃষ্টি।অবশ্য, কোনদিন মুখ ফুটে বলতে পারেনি, তাই বৃষ্টিও জানতে পারেনি । আর সে সুযোগও পেল না বেশিদিন। বৃষ্টির বিয়ে হয়ে গেল হঠাৎই, বড় তাড়াতাড়ি। আসলে, নতুন চাকরি,নতুন শহরে নিজেকে খাপ খাওয়ানো, আর তার পরেই বৃষ্টিকে হারানো-সেইসময় সবকিছু এমন দ্রুত ঘটে যাওয়ায়, অয়ন ভীষণভাবে ক্ষতবিক্ষত হয়েছিল। বাঁধভাঙা ভালবাসা হারানোর যে কি যন্ত্রণা,সেটা তখন ও বুঝতে পেরেছিল। কিন্তু তখন বড় দেরি হয়ে গেছে।
অবশেষে একদিন বিকেলে হঠাৎ একটা ফোন এল অয়নের, ফেসবুক মেসেন্জার কল।নামটা দেখে 'বৃষ্টি সিনহা'।অয়ন তো অবাক এতদিন পরে, বৃষ্টির ফোন। তড়িঘড়ি দুরুদুরু বুকে ফোনটা রিসিভ করে । বলে,'আরে, তুমি? এতদিন পরে.....'।
20 May 2020
নেওয়ারি খুলিরহস্য
সোহম তার বন্ধু ঋষিতকে গিফ্ট দেওয়ার জন্য অ্যান্টিক শপ থেকে একটি লাপিস লাজুলির খুলি কেনে।খুলিটা অদ্ভুত, উপরে নানারকম সংকেত খোদাই করা। ওদেরই আরেক বন্ধু সুমন্ত্র ওটা কেনার জন্য প্রলুব্ধ হয়ে ওঠে। ঋষিতের বাড়িতে খুলিটা নিয়ে নানা রকম অদ্ভুত ঘটনা ঘটতে থাকে ।ও ভয়ে খুলিটা ফেরত দিয়ে দেয় সোহমকে। সুমন্ত্র খুলিটার জন্য টাকা অফার করে, সোহম রাজি হয়না। মেজকাকাকে সোহম খুলিটা দেখায়। মেজকাও বলে নেওয়ারি লামাদের টোটেম এটা ,খুবই দামী এবং অদ্ভুত।রন্জনা লিপি ও সাংকেতিক মন্ত্রগুলো অন্ধকারে সবুজ আলোতে জ্বলে। নানা রকম টেস্ট করার ব্যবস্থা হয়।খুলিটার রহস্য বুঝতে দুজনে আপ্রাণ চেষ্টা করে। ফেরার পথে সোহমের একটা হুমকি ফোন আসে,গুন্ডাটা খুলিটা দিয়ে দিতে ব'লে। ট্যাক্সিতে উঠে ও বিপদে পড়ে। খুলিটার জন্য ট্যাক্সিওয়ালা আক্রমন করে।বাঁচতে ট্যাক্সি থেকে লাফ দিয়ে ও প্রাণে বেঁচে যায়।মেজকাকে বাঁচাতে, সে রাত ও মেজকার বাড়িতেই থেকে যায়।নানা সন্দেহজনক মানুষের উপস্থিতি, আশঙ্কাতে ওরা দুজনে সারারাত জেগে পাহারা দেয়।অনেক পড়াশোনা, নেট-বই ঘাঁটাঘাঁটিও ক'রে, বুঝতে পারে এটা তিব্বতি লামাদের তন্ত্র-মন্ত্রের আচার ব্যবহারে দেবতাকে নৈবেদ্য দেবার খুবই পবিত্র জিনিস। কিন্তু লামার খুলিটা কি পাথরের ভেতরে আছে,খটখট শব্দ হচ্ছে কেন নাড়ালে?আর খোদাই-করা লিপিগুলোর মাঝখানে একটা সাদা দাগ কেন ? লিপির পাঠোদ্ধারও করতে পারেনা কেউ। রেফার করা হয় লন্ডনের কোর্টাল্ড ইন্সটিটিউটে। পরের দিন আবার হুমকি ফোন আসে সোহমের । এবার সোহম বুঝে যায় যে ফোনটা সুমন্ত্র করছে।ও মাথা নত করে না,ওর এক সিআইডির বন্ধুকে ব্যাপারটা জানিয়ে দেয় ।মেজকার সঙ্গে সোহম যায় প্রথমে ইন্ডিয়ান মিউজিয়াম।সেখান থেকে ফেরার পথে গার্ড বলে আপনাদের ব্যাগটা একজন পাল্টিয়ে নেবার চেষ্টা করেছিল । আর্কিওলজিক্যাল সার্ভেতে থ্রিডি স্ক্যান ,কার্বন ডেটিং করতে যায়।কিউরেটর,আর্কিওলজিস্ট সবাই বলে খুলিটা দারুন মূল্যবান, মিউজিয়ামে ডোনেট করে দিতে ।স্ক্যানে ধরা পড়ে পাথরের খুলিটার মধ্যে আরও একটা সত্যি কারের মড়ার খুলি আছে। বৌদ্ধ লামার কি? কিন্তু পূর্ণবয়স্ক মানুষের খুলি এত ছোট হল কি ক'রে? কয়েকজন আড়ালে যেন ফলো করে ওদের।এরপর ওরা যায় ন্যাশনাল লাইব্রেরীতে ।সেখানে জানতে পারে এটা মেডিসিন বুদ্ধের মন্ত্রঃপূত খুলি। ওদিকে পুলিশের ধাতানি খেয়ে, সুমন্ত্র ফোন করে ক্ষমা চেয়ে নেয়। সোহম খুলিটা নিজের বাড়ি নিয়ে আসে ।তখনই শোনে ওর ছেলেকেও স্কুল থেকে কিডন্যাপ করার প্ল্যান করেছিল সুমন্ত্র। সোহম খুলিটার ওপর গোল সাদা স্পটটায় একটা কাঠের টুকরো দিয়ে আঘাত করতে 'ওঁ' শব্দ বের হয়। স্ক্যান রিপোর্ট বলে, এটা পাঁচশো বছরের পুরনো পূর্ণবয়স্ক লামার খুলি।কিন্তু খুলি বা দেহ ছোট করার কি গুপ্তবিদ্যা জানা ছিল নেওয়ারি লামাদের?ওদিকে, ঋষিত ফোন করে জানায় ওকেও হুমকি দিয়ে ফোন করেছিল কেউ। পরের দিন মেজকার বাড়িতে গিয়ে সোহম লন্ডন থেকে ডক্টর ব্যাংক্রফ্টের মেল পায়। লিপিটার পাঠোদ্ধার করে,জানা গেছে এই লিপি ওষুধ সংক্রান্ত। রোগ সংক্রমণ প্রতিরোধ করার জন্য বৈশর্য্যতন্ত্রের মন্ত্র খোদাই করা।একশো আট বার মন্ত্রপাঠ,খুলিতে আঘাত করে 'ওঁ' শব্দের প্রক্রিয়ার পর সেই মন্ত্রঃপূত জল পান করলে, ভাইরাল ফিভার সেরে যাবে ।সদবীর নিলামে দশ হাজার পাউন্ড দাম ওঠার কথা খুলিটার ।ব্রিটিশ মিউজিয়ামও চেয়ে পাঠায়। কিন্তু সোহম ইন্ডিয়ান মিউজিয়ামেই ডোনেট ক'রে দেয়। দেবার মুহূর্তে সুমন্ত্র ঘরে ঢোকে। বলে এতদিনেও আসল জিনিসটা ধরতে পারেনি কেউ।খুলিটা মাটি থেকে একহাত ওপরে রেখে, মাঝের গোল জায়গাটায় একশো আট বার আঘাত করে সুমন্ত্র। করতেই খট্ করে পাথরের খুলিটা আড়াআড়ি খুলে যায়,আর ভেতরের আসল লামার মন্ত্রঃপূত খুলিটা বেরিয়ে আসে।এটা দিয়েই প্রক্রিয়াটা করার কথা।সোহম বুঝতে পারে সুমন্ত্রও কম যায় না।ওদের মিটমাট হয়ে যায়।
3 May 2020
তোমার সঙ্গে একা
তুমি কথা বলছ না আমার সাথে , আমারও কিছু বলার নেই তোমাকে। শুধু নির্বাক তাকিয়ে থাকা ছাড়া। তুমি সুখী হয়েছ ? না ,জানতে চাইনি আমি। কি হবে জেনে? তখন যদি তুমিও সেই একই প্রশ্ন কর, কি বলব আমি? তার চেয়ে বৃষ্টির তোড়ে ভেসে যাক না অতীত। স্থান-কাল-পাত্র নিরপেক্ষ হোক না আমাদের অসীম শূন্যতার মিলন। শূন্যের সঙ্গে শূন্য যোগ দেওয়া ছাড়া,এ তো আর কিছু নয় ।
তোমার সঙ্গে কিছুটা সময়, সে যেন অনন্ত জীবন। এ যেন এক গভীর আত্মবীক্ষণের গ্লানি এনে দেয়। কি পেয়েছি, কি পাইনি, কি হতে পারত, হিসেবের সময় এটা নয়। এ শুধু তোমার সঙ্গে একা থাকার সময়, আমার সঙ্গেও।
গঙ্গার ধারে দু’জনে দাঁড়িয়ে আছি, সূর্য অস্ত যাচ্ছে ।শহরের ক্যানভাস আকাশের মায়াবী আলোয় ভরে যাচ্ছে। আমার বুকটাও ভরে উঠছে। শুধু অনেক বছর ধরে অপেক্ষা করার পর, শেষ তুলির টান বা শেষ কবিতার লাইন, আজ শেষবার সৃষ্টি করে নিঃশেষ হয়ে যাব আমি। আমার আর কিছুই বলার থাকবে না, তোমারও না। সূর্য ডুবে গেলে, সন্ধ্যার অন্ধকারে চারিদিক ডুবে যাবে। আমরা আবার যে যার পথে ফিরে যাব। আর হয়তো কোনদিন দেখা হবে না। শুধু থেকে যাবে কিছু স্মৃতি, দুজনে পাশাপাশি পথ হাঁটার সেই সময়টার কথা ভেবে অকারণ হাহুতাশ করবে একটা পাগল মন। সিগারেটের ধোঁয়ার মতো বের হয়ে আসবে সারা জীবনের আফশোস।
চারিদিকে ব্যস্ত মানুষের ভিড়, স্ট্রীটলাইট গুলো জ্বলে উঠল। নির্বাক সন্ধ্যাবেলায় প্রিয় কবিতার বইয়ের পাতা উল্টোচ্ছ তুমি। আমি তার শেষ কবিতা মনে মনে লিখে ফেলছি, আর কোনদিন কবিতা লিখব না। জীবন ঢেকে দিচ্ছে আমার এই তিরিশ বছরের সব না পাওয়ার অভিযোগ আর পরাজয়ের লজ্জাকে। তুমি সেই পরম নৈঃশব্দের আদরে,প্রশ্রয়ে, আমার সারা জীবনের সমস্ত কান্নাকে ধুইয়ে দিয়ে চলে যাচ্ছ এক অসীম জীবনবোধে।
যাবার আগে তুমি ফিরে তাকালে একবার। ঠিক যেমন ফিরে তাকিয়ে ছিলে কৈশোরের সেই প্রথম দেখার দিনটাতে। হাতে হাত ছুঁয়ো না, বড় শীত করে ।শুধু চোখের মিলনে আজ অনেক ইতিহাসের পাতা লেখা হয়ে গেছে,সেই আমার কাছে যথেষ্ট। অনেক মেঘ, মনকেমন করে উড়ে এসেছে, আশ্রয় না পেয়ে আবার ফিরে চলে গেছে ঘরভাঙ্গা পাখির মত। তুমিও চলে যাচ্ছ, ঠিক সেদিনের মত। সেই জেব্রাক্রসিং, সেই ট্রাফিক সিগন্যাল, চলন্ত বাস থেকে নেমে সেই উড়ন্ত চুমু লুফে নেওয়া ।রাস্তা পেরোলেই তুমি, কিন্তু পারলাম কি পৌঁছতে ? মাঝে বয়ে গেল কিছু গঙ্গার জল, কিছু ধোঁয়া-ধুলো-ঘামের গন্ধ,কয়েকটা নির্বোধ লাভলেটার আর একটা গোটা কলকাতা শহর ।জীবন কিছুই নেয়নি আমার থেকে, বরং অনেক ফিরিয়ে দিয়েছে। আমিও সেইসব নিয়েই আছি,তাই তোমার চলে যাওয়ার দিকে আর তাকিয়ে থাকব না। দীর্ঘশ্বাস? শুধু সেটাই হয়তো লুকোতে পারব না।আর তুমি? তোমার চোখের কোনও কি ভিজে উঠল একবার? তুমিও কি নিজেকেই বোঝাচ্ছ? আর তা জানার উপায় নেই ।ঠোঁটদুটো অস্ফুটে কিছু বলতে চেয়ে, কেঁপে কেঁপে থেমে যায়।
সমস্ত নৈঃশব্দ, সমস্ত সময় আর আমার ‘আমি’ কে নিয়ে কালো সন্ধ্যার ড্রপসিনের ওপারে চলে যাচ্ছ তুমি, একা।
Subscribe to:
Posts (Atom)