16 June 2018

কালো গাড়ি

মানুষের জীবনে অনেক রকম অদ্ভুত ঘটনা ঘটে ,কিন্তু এর মধ্যে এমন কিছু ঘটনা আছে যার কোন  ব্যাখ্যা দেওয়া যায় না।  ট্রাফিক সাবইন্সপেক্টর বালাজির ঘটনাটা সেরকমই। দক্ষিণ ভারতের উটিতে ট্রাফিক পুলিশ হিসেবে ,সে তার দায়িত্ব খুব ভালোভাবেই সামলাত। যদিও পাহাড়ী কুয়াশাময় রাস্তা, অসংখ্য গাড়ির ট্রাফিক আর পাশেই বিপদসঙ্কুল খাদ, তবুও নিষ্ঠাবান হিসেবে বালাজি উর্ধ্বতন কর্তাদের খুব বিশ্বাসভাজন ছিল। অক্টোবর মাসের এক সকালের শিফ্টে কমার্শিয়াল রোডের ট্র্যাফিক পোস্টে ডিউটি করছিল বালাজি। সকালের দিকে কুয়াশা সেদিন একটু কম ।গাড়ির ভিড়ও প্রায় নেই ,সেটা শুরু হবে সকাল সাড়ে সাতটা থেকে। বেশ রিল্যাক্সডই ছিল বালাজি।ক’টা ট্রাক পাশ করিয়ে সবে ও রাস্তার ডান দিকে একটু সরেছে, হঠাৎই সাঁ-আ-আ  করে একটা শব্দ শুনল। মুহুর্তের মধ্যে একটা কালো সেডান গাড়ি হুশশ্ করে ওর পাশ দিয়ে ওভারস্পিডে বেরিয়ে গিয়ে পাহাড়ি রাস্তার বাঁকে অদৃশ্য হয়ে গেল। এত স্পিড!পরের পোস্টে জানাতে হবে ব্যাপারটা।এরকম পাহাড়ি রাস্তায় যেকোনো সময় ভয়ানক দুর্ঘটনা ঘটে যাবে। কম করে একশ' স্পিডে গেছে গাড়িটা ।ভাবতে ভাবতেই পরের পোষ্টের সিংহাকে ওয়াকিতে ধরল বালাজি। -‘বালাবিগ টু লিম্বা, বালাবিগ টু লিম্বা, ডু ইউ কপি ?’ দু তিন বার কোড বলার পর জবাব আসল।তড়িঘড়ি ও সিংহাকে গাড়ির বর্ণনা দিল আর স্পিডট্র্যাপে গাড়িটাকে আটকানোর জন্য ব্যারিকেডের ব্যাবস্থা করতে বলল। -‘কালো গাড়ি, সেডান। টেন সেভেন্টি থ্রি।‘ -‘রজার’।সিংহা বুঝেছে বলে জানাল। এরপর ধীরে ধীরে স্বাভাবিকভাবেই ট্রাফিকের ভিড় বাড়তে থাকল, সকালের ঘটনাটা বালাজি প্রায় ভুলেই গেল। হঠাৎ ওর মোবাইলে একটা ফোন আসল, ওর সার্জেন্ট কৃষ্ণার। কৃষ্ণা রেগে বলল, -‘দারু পিয়া হ্যায় কেয়া,সুবে সুবে?’ -‘কেন,কি হয়েছে সাব?’ -‘কি হয়েছে বুঝতে পারছ না? কোন্ কালো গাড়িকে স্পিডট্র্যাপে ধরতে বলেছিলে সকাল সোয়া সাতটায়?’ -‘হ্যাঁ সাব, বলেছি তো। একটা কালো সেডান। ওভারস্পিডে ক্রস করল আমাকে কমার্শিয়াল রোডে। প্রায় একশো স্পিড হবে।কেন,সিংহাকে বললাম যে,ও আটকায়নি?’ -‘মিথ্যে কথা বলার জায়গা পাওনি? ওরকম কোন কালো গাড়ি ওদিকে যায়নি।‘ -‘কি বলছেন সাব?’ -‘ঠিকই বলছি। রং রিপোর্টিং।ইউ উইল বি পেনালাইজড।‘ বালা একটু অবাক হল ,যেভাবে গাড়িটা থোড়াইকেয়ার ভাবে পরের পোস্টের দিকে যাচ্ছিল , যা কিনা মাত্র দশ কিলোমিটার দূরে, তাতে সিংহার তা দেখার কথা।তাছাড়া কোন ডাইভার্শনও নেই মাঝখানে।গাড়িটা স্পিড কমাতে পারে, কিন্তু যেতে তাকে হবেই ওই পথে। মাঝে আর কোথায় লুকোবে !এক যদি কোন বাড়িতে ঢুকে থাকে। পথে অবশ্য হাতে গোনা কয়েকটা বাড়ি ছাড়া আর কিছুই নেই ,খবর নিলেই সব জানা যাবে। যাই হোক সার্জেন্টকে বালা জানাল, ‘ম্যায় ঠিক হি বোলা থা সাব।আর আমি ঠিকই দেখেছিলাম।ভগবান কি কসম।গাড়িটা প্রচন্ড স্পিডে আমাকে পেরিয়ে সিংহার বারো নম্বর পোস্টের দিকেই গেল।সিংহা কেন দেখতে পেলনা বুঝতে পারছি না,অদ্ভুত ব্যাপার!’ ঘন্টা খানেক বাদে ট্রাফিকের আরো কর্তারা এসে হাজির হল জিপে করে,সঙ্গে দুজন সার্জেন্ট বাইকে করে।সবাই বালাকেই বকাঝকা করল ভুল রিপোর্ট দেবার জন্য। ওরকম কোন গাড়ি পেরোতেই পারেনা। ওর আগের, পরের গোটা পাঁচেক পোস্ট থেকে এরকম কোন গাড়ির খোঁজ পাওয়া যায়নি ,এমনকি সিসিটিভি ক্যামেরা থেকেও নয়। ডিউটি চেঞ্জ করিয়ে বালাজিকে কন্ট্রোল রুমে নিয়ে যাওয়া হল। সেখানে আবার চালানো হল সাতটা থেকে সাড়ে সাতটার মধ্যেকার সমস্ত ফুটেজ। কালো সেডানের কোন ছবি পাওয়া গেলনা, এমনকি কমার্শিয়াল রোডের সিসিটিভি ফুটেজেও নয় । -‘নো বালা,আই ডিডন্ট এক্সপেক্ট দিস ফ্রম ইউ। তুমি কি আজকাল ড্রিংক করা শুরু করেছ নাকি?’ বড় সাহেবের ধমকে বালাজির মুখটা চুন হয়ে গেল মনে ভয় হল, ডিউটি অবহেলা আর ভুল রিপোর্টের জন্য না ওর বিরুদ্ধে কোন ব্যাবস্থা নেয় বড়বাবু ! -‘কি বলছেন বড়সাহেব,আমি মদ খেয়েছি!’ বালা স্তম্ভিত হয়ে বলে। -‘না বালা, তোমার রিপোর্ট সম্পূর্ণ ভুল ছিল,তুমি কি করে এত ভুল দেখলে? ইউ মাস্ট গো থ্রু ব্রেথটেস্ট। আই অ্যাম সরি।‘ বালা কিন্তু ওর বয়ানে স্থির থাকল।ব্রেথ টেস্টে  পাশ করার পর, শেষে অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার নিরুপায় হয়ে অনুসন্ধানের আদেশ দিলেন।‘ওকে, একটা চান্স নেওয়া যাক।লেটস স্টার্ট রুটিন এনকোয়্যারি।‘ বালাকে নিয়ে একটা জিপে দুজন এএসআই আর  সার্জেন্ট কৃষ্ণার এনকোয়ারি  টিম বের হল। এত স্পিডে যদি গাড়িটা গিয়ে থাকে, তবে কি কোনো অ্যাক্সিডেন্ট হল? এনকোয়্যারি তো করতেই হবে ।বালাজি গাড়িটাকে যেদিকে যেতে দেখেছে, সেই পথে বেরিয়ে পড়ল জিপটা। কিন্তু কোন কালো গাড়ির সন্ধান পাওয়া গেলনা। এমনকি পথের বাঁক গুলোতেও কোন দুর্ঘটনা ঘটেনি। রাস্তায় যে কটা বাড়ি পড়ে তাতেও খোঁজ নেওয়া হল,কিন্তু কোন খবর পাওয়া গেল না। এমনকি চায়ের দোকানের লোকটাও অস্বীকার করল ঘটনাটা। বললো, ও তো সকাল ছটাতেই দোকান খুলেছিল। আকাশ থেকে পড়ল বালা,এমন হতেই পারেনা! গাড়িটা যে পথে এত স্পিডে গেল, চায়ের দোকানটাকে যেভাবেই হোক পেরোনোর কথা !একি অসম্ভব কথা শুনছে সে! ‘কি বলছ কি?তুমি মিথ্যেবাদী।‘ তর্কাতর্কি লেগে গেল দোকানীর সঙ্গে।‘আমি কেন মিথ্যে বলব, স্যার ?অত স্পিডে একটা গাড়ি চলে গেল, আমার দোকানের পাশ দিয়ে ,আর আমি দেখতে পাবো না! কোন শব্দ পাবো না! গাড়িটা কি উড়ে উড়ে গেল?’দোকানীর সাফাই। বালা তেড়ে গেল দোকানীর দিকে। ‘তুমি দেখোনি? ক’টায় দোকান খুলেছিলে আজ? মিথ্যুক কোথাকার।‘ এবার কৃষ্ণাই উল্টে রেগে গেল বালাজির ওপর।‘চুপ করো বালা, ভুল তুমি বলছো। তুমিই কি দেখতে কি না দেখেছো। এরকম কোন ওভার স্পিড গাড়ি আজ কোথাও কেউ দেখেনি,ক্যামেরাতেও ওঠেনি। একা তুমি কি করে দেখলে শুনি?’কৃষ্ণার বকুনি শুনে বালা একটু দমে গেলেও, কিছুতেই নিজের বয়ান ফিরিয়ে নিল না।ও পরিষ্কার দেখেছে, শুনেছে গাড়িটাকে চলে যেতে, অভিজ্ঞ চোখে বুঝেছেও গাড়িটার গতি কত ছিল। ও একশো শতাংশ নিশ্চিত ।এখনও চোখ বুজলে ও ঘটনাটা দেখতে পায়। কালো সেডানটা দৈত্যের মত হুস্স্ করে চলে গেল।  পরের বাঁকটাও নিল প্রায় একই স্পিডে।'হে-ই-ই'চেঁচিয়ে উঠেছিল বালা।কিন্তু ততক্ষণে গাড়িটা অনেক দূরে চলে গেছে। ও নিশ্চিত, কোথাও কারও কোনো একটা ভুল হচ্ছে। অত বড় গাড়িটা কি ভোজবাজির মত উবে গেল! এতদিন ধরে এত দায়িত্ব নিয়ে ও ট্রাফিক সামলেছে, আজ ওকে প্রথমবার ব্রেথটেস্ট দিতে হয়েছে।ও নাকি মদের ঘোরে ভুল দেখেছে!না, এই বদনাম ও কিছুতেই মেনে নেবে না। ওর কাকুতি মিনতিতে শেষে এনকোয়ারি আরও জোরদার হল। একটা জিপে রেসকিউ টিমের দুজনকে নিয়ে অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার নিজে হাজির হলেন।পাহাড়ের কোনো বাঁকে অ্যাক্সিডেন্ট হয়নি তো গাড়িটার! অভিজ্ঞ চোখে অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার সবকটা শার্প টার্ন ও দুর্ঘটনাপ্রবণ জায়গাগুলো চেক করাতে থাকলেন। হঠাৎ দৌড়ে আসল এএসআই বার্মাজি। -‘ইধার দেখো। ক্যা মিলা। ‘ ওর দেখানো আঙ্গুলের দিকে ছুটে চলল সবাই ।পাওয়া গেছে! বড় বড় সিলভার ওক গাছের পিছনে আঙুল দেখাল বার্মাজি। কাছে যেতেই সবার চক্ষু চড়কগাছ,কালো গাড়িটা গাছের জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে গেছে ।ধাক্কাও মেরেছে একটা বড় গাছে ।কিন্তু এ কি! গাড়িটার গায়ে এত শ্যাওলা, এত আগাছা কেন? গাড়িটা তো আজই অ্যাকসিডেন্ট করেছে !তবে কেন এত পুরনো জং-ধরা অবস্থা! গাড়িটার সারা গায়ে এত আগাছাই বা জন্মালো কি করে !  সাবধানে গাছে দড়ি বেঁধে ,ধরে ধরে খাদের গা বেয়ে নেমে গেল সবাই ,এরকম রেসকিউ মিশনে ওরা অভ্যস্ত। আগাছা পরিষ্কার করেও কালো কাচের ভেতর কিছু দেখা গেল না। দরজাও খুললো না ।গাড়ির সামনের দিক ঝুলে আছে খাদে, ওদিকে যাওয়া যাচ্ছে না। গাড়ির ভেতর কজন আটকে আছে ,তাও বোঝা যাচ্ছে না। জিপ থেকে কাঁচ ভাঙ্গার,দরজা খোলার সরন্জাম আনা হল ,ঝরঝর করে  ভেঙ্গে গেল কাঁচ। তখনই পচা দুর্গন্ধে দুজন বমি করে ফেলল ।দেখা গেল একটা পচা গলা মৃতদেহ ড্রাইভার সিটে আটকে আছে। চারিদিকে ভিড় জমে গেল।লোডার এনে গাড়িটা টেনে তোলা হল ,মৃতদেহ নিয়ে গেল পুলিশ। পুলিশের বড়কর্তারা এসে পৌছলেন।বিকেলে গোটা দুয়েক এনকোয়ারি বোর্ডেও যেতে হল বালাজিকে। জানতে পারল অ্যাক্সিডেন্টটা হয়েছে মাস ছয়েক আগে। ততদিন গাড়িটা ওখানেই গাছপালার আড়ালে থেকে গিয়েছিল, কেউ জানতে পারেনি। আগাছায় ধীরে ধীরে ঢাকা পড়ে গেছিল ।বালা প্রতিবাদ করে বলতে চাইল ,আজই তো গাড়িটা অ্যাক্সিডেন্ট করেছে, গাড়িটাকে ওভারস্পিডে  যেতে ও নিজের চোখে দেখেছে । তারপরেই তো ঘটনাটা ঘটেছে। পুলিশকর্তারা হেসে উঠলেন। এপ্রিল মাস থেকেই মিসিং ছিল শ্রীনিবাসন বলে ওই লোকটা। গাড়িতে ও একাই যাচ্ছিল । প্রচণ্ড গতি সামলাতে না পেরে, বাঁকের মুখে গাছে ধাক্কা মেরে, খাদে হারিয়ে গিয়েছিল শ্রীনিবাসন সমেত গাড়িটা,কেউ জানতেও পারেনি, হয়ত গভীর রাতে ঘটনাটা ঘটেছিল। ওর ভাই কিন্তু মিসিং ডায়েরি করেছিল সেইসময়েই। বালাজি থম্ মেরে গেল,ওর সবকিছু কেমন যেন গুলিয়ে যেতে লাগল, গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল।কি দেখেছে তবে ও? ছ’মাস আগে অ্যাক্সিডেন্ট হওয়া গাড়ি ও কিভাবে দেখলো আজ সকালে? যে গাড়ি ও দেখেছে সেটাই যে এই অ্যাক্সিডেন্টের গাড়িটা, তা নিশ্চিত। তাহলে? ব্যাখ্যা পায়না বালা। এনকোয়ারি বোর্ডের সবাই উদ্ধারকাজের জন্য ওদের সাবাসি দেয়। -‘ভেরি গুড জব ডান। উই আর প্রাউড অফ ইউ বালা।‘ তবু মুখে হাসি ফোটে না বালার, মনে হাজার প্রশ্ন,সব অসম্ভব মনে হচ্ছে।ফিরে যাবার সময় ওই গাড়িটার পাশ দিয়েই রাস্তা।অন্ধকার হয়ে এসেছে।ফরেন্সিক, এনকোয়ারি আজকের মত শেষ হয়ে গেছে। কালো গাড়িটা দুমড়েমুচড়ে পড়ে আছে থানার কোনটাতে। কেউ নেই আশেপাশে। এখনো কিছু শ্যাওলা, আগাছা লেগে আছে গাড়িটার গায়ে।হঠাৎ বালাজির মনে হলো গাড়ির বাঁদিকের ইন্ডিকেটরের হলুদ আলোটা একবার যেন  দপ্ করে জ্বলে উঠেই চিরকালের মতো স্তব্ধ হয়ে গেল।

10 June 2018

ফিস্ ফাস্

রোজ ভোরে ঘুম ভাঙার মুহূর্তে শব্দটা শুনছেন কুশলবাবু। এটা আগে হত না, মানে এই সিটি দেবার শব্দটা আরকি। ক'দিন ভেবেছিলেন, ছেলেটাই করছে বোধহয়, বকাবকিও করেছিলেন। 'কি রে, খুব সিটি দিতে শিখে গেছিস, না?' 'আমি? সিটি ?কখন দিলাম?' 'কখন আবার ?ন্যাকামো হচ্ছে? ভোরবেলা নিজের কানে শুনলাম।' 'কি যা তা বলছ?' 'যা তা বলছি? খুব উন্নতি হয়েছে তোর আজকাল। রাস্তাঘাটে মেয়ে দেখে ,সিটি দিতেও শিখে গেছিস। আর কি কি শিখেছিস, শুনি?' 'আরে, বলছি তো আমি করিনি।' কুশলবাবু বুঝলেন, ছেলে কিছুতেই স্বীকার করবে না। তার ওপর গিন্নি এসে যথারীতি ছেলের পক্ষ নিলেন, 'কি ফালতু বকছো ছেলেটাকে।অত ভোরবেলা ও ওঠে ?পড়ে পড়ে ঘুমোয়,জান না ?' সেটা অবশ্য ঠিক। ছেলেটার কলেজ এখন ছুটি বলে, বেশ বেলা অব্দি ঘুমোয় । অগত্যা রণে ভঙ্গ দিলেন কুশলবাবু।পরেরদিন দেখলেন, ঠিকই, সে বেচারা ঘুমিয়ে আছে, তবুও শব্দটা তিনি সবেমাত্র শুনেছেন। বুঝলেন পাড়ার কোন বখাটে ছেলের কান্ড। রোজ সিটি বাজিয়ে ঘুম ভাঙ্গানোটা তার মোটেই পছন্দ হলো না ।কিন্তু তক্কে তক্কে থেকেও কাউকে ধরতে পারলেন না ,সিটি মারা চললই। শেষে একদিন বিরক্ত হয়ে গিন্নিকেই দুষলেন, "রোজ সকালে প্রেসার কুকারে কি এত রান্না কর,শুনি?রোজ ঘুম ভেঙে যাচ্ছে।" গিন্নি মুখঝামটা দিলেন, "ফের বাজে বকছ?আমার আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই ,যে অত সকালে প্রেসার কুকার চাপাব!' 'তাহলে প্রেসারে সিটি পড়ে কেন?' 'আবার সিটি নিয়ে পড়েছ?আর পারি না বাপু। তোমার কানটা দেখাও এবার, বুঝেছ?' কুশলবাবুর মনে হল,তাই তো। সমস্যাটা তার নিজের কানে নয় তো? গোলমালটা হল কদিন পর। এবার ভোরে তিনি সিটির বদলে ফোন রিং হবার শব্দ শুনলেন।মহা জ্বালাতন। বাড়িতে গোটাতিনেক মোবাইল, সবকটা চেক করা হল। যথারীতি আবার ছেলেই ধমকটা খেল। 'কিরে সকাল-সকাল কার ফোন এলো রে তোর ?' 'আমার ফোন? কই না তো ।' 'আবার মিথ্যে কথা। যতসব বদমাশ বন্ধু জুটিয়েছে। সকালবেলা ফোন করে ডিস্টার্ব করা। বাড়িসুদ্ধ লোকের ঘুম ভাঙানো ।' 'কি উল্টোপাল্টা বকছো? আমার ফোন তো সুইচড অফ থাকে। আমি ঘুমোনোর সময়, রোজ বন্ধ করে শুই।' 'ও তাই বুঝি? দেখি ফোনটা।' দেখা গেল, সত্যি ফোনটা সুইচড অফ। তবু বিশ্বাস হল না।জোরজার করে ফোনটা নিয়ে ,অন করে ,চেক করে দেখা গেল, সত্যিই কিন্তু ফোনে কল আসেনি।শুধু ছেলের কেন,কোন ফোনেই ফোন আসেনি।গিন্নির ফোন ঘাঁটতে গিয়ে ফিলতু কয়েকটা গালাগালিও খেতে হল,'যত্ত সব সন্দেহ বাতিক।বুড়ো বয়েসে ভিমরতি।ছ্যাঃ'। সেসব হজম ক'রে কুশলবাবু মনে মনে ভাবতে লাগলেন,তাহলে কার ফোন বাজল? ল্যান্ডফোন তো বাড়ীতে নেই, তবে কি পাশের বাড়ি?তাও খোঁজ নেওয়া হল। আবার কি তিনি কানে ভুল শুনলেন? খুব চিন্তায় পড়ে গেলেন। কালই ডাক্তার দেখাবেনবলে, ঠিক করলেন।শুনেছেন টিনিটিস না কি সব হয় ,কানে কম শুনলে।শেষকালে এই অদ্ভুত ব্যামো তারই হল নাকি? কিন্তু পরের দিনে আরেক সমস্যা। সেদিন তিনি কাদের সব ফিসফাস করতে শুনলেন। কারা যেন কি সব শলা-পরামর্শ করছে, হাল্কা গানের সুরও ভেসে এল। ঘুম তো  যথারীতি গেল ভেঙে । কুশলবাবু এবার বেশ দোটানায় পড়ে গেলেন, এটা তার মনের সমস্যা না কানের? তিনি স্বপ্ন দেখে, স্বপ্নের মধ্যেই শব্দ শুনছেন না তো? নাকি কেউ কিছু তাকে বলতে চাইছে? কোন অশরীরী টশরীরী। ফিসফাস করে কারা তাকে কি শোনাচ্ছে, অনেকক্ষণ কান খাড়া করেও তিনি কিছু বুঝতে পারেননি । আর কাউকে কিছু বলতে সাহস হল না। ইএনটি ডাক্তার ,বাল্যবন্ধু অমিতের কাছে গেলেন। 'কিরে কুশু, কি মনে করে?' 'আর বলিস না, কানটা মনে হচ্ছে গেছে।' 'মানে?' 'মানে আবার কি? সকালবেলা ঘুম ভাঙতে না ভাঙতেই ,যত সব অদ্ভুত অদ্ভুত শব্দ শুনছি।' 'কিরকম শব্দ বলতো?' 'আরে, কখনো সিটি পড়ছে, কখনো ফোনে রিং হচ্ছে। আবার কখনো বা শনশন ঝড় বইছে। মাথা খারাপ হবার জোগাড়।' 'বুঝেছি, দাঁড়া, কানটা দেখতে দে।' অমিত নানা টেস্ট করল,একটা হেডফোন পরিয়েও শব্দ শুনতে বলল। তারপর বলল,'তোর কানের উপর কখনো বোম ফেটেছিল কি ?বা খুব জোরে কোন শব্দ?' 'কই,না তো। সেরকম কিছু মনে পড়ছে না।তবে কালীপুজোয়, চকলেট বোম তো কতই ফাটিয়েছি।' 'আরে সে বলছি না ।ঠিক আছে, শোন,তোকে আরো কটা টেস্ট লিখে দিচ্ছি। আর একটা হিয়ারিং এড,তোকে পড়তে হবে। কানের শব্দগুলো কাটাকুটি করার জন্য। দেরি করিস না ।নইলে,শ্রবণশক্তি আরো কমে যাবে।' 'তার মানে, তুই বলছিস, আমি কালা হয়ে যেতে পারি?' 'সেসব নয়। এই টেস্টগুলো কর না। আর একজনের নাম্বার দিচ্ছি, হিয়ারিং এডের ব্যাপারে কথা বলে নিস ।আর এই ওষুধগুলো খাবি, টেনশন করবি না।' কুশলবাবু চলে আসেন। ফোন করে জানলেন, হিয়ারিং এডের অনেক দাম, টেস্টগুলো করাতেও মেলা খরচ। এত খরচায় যেতে কুশলবাবুর বড় বাধলো। ছেলেটা এখনও বেকার, তার হাতে ফালতু খরচ করার মতো টাকাও বিশেষ নেই ।তার চেয়ে বরং ফ্রিতে গান, ফিসফাস, রিংটোন শোনাচ্ছে; চলুক না। সারাদিন তো কোন অসুবিধে নেই, শুধু ভোরবেলা ঘুম ভাঙার যন্ত্রণা,এই যা।ও  কদিনেই সয়ে যাবে ।তাছাড়া তার মনে মনে একটা স্পষ্ট বিশ্বাস বা অনুভূতি হচ্ছে, তার স্বর্গত বাবা-মাই বোধহয় তার কানে ফিসফিস করে কিছু বলতে চাইছেন। কোন গোপন জমিজমার কাগজ বা টাকাপয়সার সন্ধান দিতে চাইছেন না তো? মনটা তার আশার দোলাচলে দুলে ওঠে। মনে মনে একটু ভালোও লাগে ,বিশ্বাস করতে শুরু করেন,না, এটা কানের কোন অসুখ নয়- কারো কথা বা কারো মনের ভাবই তিনি শুনতে পাচ্ছেন বোধহয়,হয়তো নিজের বাবা-মারই ।এখন থেকে রোজ শুতে যাবার সময় মনে মনে তৈরি হয়েই শোন,কাল ভোরে উঠে নতুন কি শুনবেন। যাই শুনুন, শুনে বুঝতে হবে।টেনশনে ভাল ঘুম হয় না। আবার ফিসফাস, রিংটোনও বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না ,এমনকি সিটিও গোটা দুই তিন এর বেশি নয়। ঘুমটা ভেঙে গেলেই দফারফা। সব শব্দ গায়েব। ওপারের মানুষগুলোর সঙ্গে যোগাযোগের বাঁধনটা কেটে যায়, তখনই মনটা খারাপ হয়ে যায়। আবার পরের দিনের প্রতীক্ষা। বেশ কাটছিল দিনগুলো। গিন্নি বা ছেলেদের কাউকে কিছু আর বলেননি। টেস্টগুলো করাননি, অমিতের দেওয়া ঘুমের ওষুধগুলোও খাননি। হিয়ারিং এইড তো কখনোই নয়,এই সুযোগ কেউ ছাড়ে ?কানে ঠুলি পড়লে তো সব শেষ।না,তাকে শুনতেই হবে। বাবা মা হোক বা কোন অজানা আত্মা বা স্বয়ং ভগবান ,কিছু তো একদিন বলবেনই। অপেক্ষায় দিন কাটে । একদিন ভোরবেলা কলের জল পড়ার শব্দ পেতেই ঘুমটা ভাঙল। দেখলেন সত্যিই কলে জল এসেছে। তাহলে কি তিনি আর স্বপ্নে ফিসফাস শুনছেন না? মনটা খারাপ হয়ে গেল। পরের দিনও তাই । ওভারফ্লো পাইপের জলের শব্দ। সেদিন তো তিনি ভালো করে কারো সঙ্গে কথাই বলতে পারলেন না ।মনটা ভার। বাবা-মা এসেও চলে গেলেন, সেই কথাটা তো শোনা হল না। কেন বন্ধ ফিসফাস, গান, রিংটোন ,সিটি ?তিনি কি কোন অন্যায় করেছেন? ভীষণ মনোকষ্টে ভুগলেন সারাদিন। বিকেলে ওভারফ্লো পাইপের নিচে দুটো পাপোশ পেতে দিলেন ,যাতে ওই বাজে শব্দে ঘুম না ভাঙ্গে। এদিনও রাতে ভাল ঘুম হয়নি আশঙ্কায়। কি বলছেন শুনতে হবেই ।গান হলে তাই শুনবেন ,তার বাবা যৌবনে কোনদিন সিটি মেরেছেন কিনা, তা তার জানা নেই। যদি মেরেও থাকেন ,বেশ করেছেন। বাবা হলেন বাবা ।যা করছেন করুন ,মা-বাবার ফালতু আলাপ হলেও তিনি ওনাদের হারিয়েছেন; আবার ফিরে পাবার সুযোগ কিছুতেই ছাড়বেন না। কিন্তু সেদিন ভোরেও কোন শব্দ শুনলেন না ,কাগজওলার ঘণ্টি ছাড়া। সেটা অবশ্য তিনি জেগেই শুনেছেন, মটকা মেরে পড়ে থাকা অবস্থায় ।ভোরে ঘুম ভাঙ্গাটা খুব একটা একঘেয়ে,জোলো আর বৈচিত্র্যহীন বিষয় হয়ে গেল ।একটা সুন্দর অনুভূতি পেয়েও হারাতে হল কুশলবাবুকে। তিনি জানেন না ,এটা যদি কানের অসুখ হয়ে থাকে, সে কি আপনিই সেরে গেল? আর তাহলে তা ফিরেই বা আসবে কিভাবে? আর যদি তিনি অশরীরীর কথা শুনেছেন ,তাদেরই বা মান ভাঙানো যাবে কিভাবে? এসব কথা তো কাউকে বলা যাবেনা, কেউ বিশ্বাস করবে না। জ্ঞানী বন্ধুরা টিনিটিসই বলবে। আসল রহস্য কেউ বুঝবে না । আবার গেলেন অমিতের কাছে । 'কিরে কান কেমন আছে? ঘুম ঠিকঠাক হচ্ছে তো?' 'আরে, রাখ তোর ঘুম ।কানে তো আর সেই শব্দগুলো শুনতেই পাচ্ছি না।' 'পাচ্ছিস না? বাহ্ , তাহলে তো ভালো হয়ে গেছে, সেরে গেছে। ওষুধে কাজ দিয়েছে ,বল।' 'ধুর,আমি তো ওষুধ খাইইনি। তবু সেরে গেল?' 'অনেক সময় টিনিটিস এমনিই সেরে যায়। তাহলে আর কি? এবার এনজয় লাইফ।' 'ইয়ার্কি মারছিস? আমি শব্দগুলো শুনতে পাচ্ছি না কেন? কেন বন্ধ হয়ে গেল ফিসফাস?' 'মানে?' অমিতের মুখটা হাঁ হয়ে ঝুলে যায়। 'মানে ,আবার সেই সব শব্দগুলো, সেইসব ফিসফাস আমি শুনতে চাই।' 'কি বলছিসটা কি ? কানের অসুখটা সেরে গেছে বলে তুই খুশি নোস?' 'নই'ই তো, কত কথা বাকি ছিল রে। কিছুই শোনা হল না ! কি করে যে আবার হবে এই অসুখ?' অমিতের মুখে আর কথা সরে না। এরকম অদ্ভুত কথা সে আগে কখনো শোনেনি ।রোগী ,তার রোগ ফেরত আনার জন্য, ডাক্তারকে তম্বি করছে। ওর বেশ কিছুক্ষণ লাগল ব্যাপারটা বিশ্বাস করতে। কুশলবাবু বুঝলেন, যা গেছে, তা আর ফিরে আসবে না ।সে জিনিস ফিরিয়ে আনার ক্ষমতা কারো নেই ।আর কথা না বাড়িয়ে,তিনি চেম্বার ছেড়ে বেরিয়ে পড়লেন। মনটা সেই থেকে ভেঙে গেছে ।দিনগুলো আবার আগের মতোই নীরস ।কেউ নেই, কোথ্থাও নেই ।শুধু সিলিং ফ্যানের একঘেয়ে শোঁ শোঁ শব্দ। জীবনটা বড়ই পানসে, শুধু দিন গোনা। কুশলবাবু ঠিক করলেন আর কদিনই বা। গিন্নির তো সবেতেই শাসন আর মুখঝামটা, মৃত্যুর পর গিন্নিকে এরকমই কানে কানে ফিসফিস করে জ্বালাবেন খুব, মজাটা টের পাওয়াবেন।এমনকি প্রাণপ্রিয় ছেলেকেও, যে তার সঙ্গে ভাল করে কথাই বলে না কোনদিন ।মৃত্যুর পর না বলতে পারা কথাগুলো আশ মিটিয়ে বলে যাবেন সবাইকে।

9 June 2018

ঠিকানা নেই


বেলুনে নিজের নাম ঠিকানা লিখে উড়িয়ে দিল দেবাঙ্গন। এটা ওর একটা অদ্ভুত নেশা। বেলুন ওড়ানোর ব্যাপারটা ওর কাছে এখন জলভাত। নীল আকাশে উড়তে উড়তে গ্যাসবেলুনের দূরে ভেসে যাওয়া দেখতে  দারুন লাগে ওর।মনে হয় ওও যদি এরকম উড়তে পারত!
মা অবশ্য মাঝেমাঝেই বকাঝকা করে, ‘এ তোর কি রকম নেশা দেব? বেলুন ওড়ানো?’ ‘কেন মা,আকাশে রঙীন বেলুনের ভেসে যাওয়া দেখতে কি দারুন লাগে না?’ ‘সে সব তো ঠিক আছে,কিন্তু পড়াশোনার দিকে এবার একটু নজর দে । রেজাল্ট না শেষে খারাপ হয়, তোর এই অদ্ভুত শখের পেছনে।‘মা একটু চিন্তিত হয়। ‘তুমি কিচ্ছু ভেবো না মা, রেজাল্ট আমার ভালই হবে।জানো,কত হট এয়ার বেলুন ওড়ানোর ক্লাব আছে? একসঙ্গে বেলুন ওড়ানোর কম্পিটিশনও হয়।আমাকে কেন যেতে দাও না মা!‘ ‘অত জানিনা বাপু।ওসব খুব ভয়ের জিনিস। এ যে কি বাজে নেশা হল তোর!’, বলে মা চলে যায়।
বাবা কিন্তু মাঝেমাঝেই বেলুন রাইডের ওপর নানা বই, তাছাড়া নিউমার্কেট থেকে এরোস্ট্যাট,বেলুনিং এসব নানা দামী দামী বিদেশী ম্যাগাজিন এনে দেয় ওকে। নেটে সার্চ করেও অনেক কিছু জানতে পারে দেবাঙ্গণ, ইউটিউব ভিডিও তো আছেই। টাইগার বেলুনে চড়ে ও নিজেও একদিন ভেসে পড়বে আকাশে,দিনরাত এই স্বপ্নই দেখে দেবাঙ্গন ।দিল্লি মুম্বাইতে তো কত বেলুন সাফারি আছে, বাবাকে কতবার বলেছে নিয়ে যাবার জন্য। কিন্তু মা এত ভয় পায়! একবার শুধু রাজস্থানে বেড়াতে গিয়ে পুষ্করে ,বেলুন ওড়া দেখেছিল। আকাশ ছেয়ে গেছিল নানা রঙের হট এয়ার বেলুনে, শুধু মার জন্য চাপা হল না ।কিন্তু সেই থেকে বেলুন ওড়ানোটাই ওর ধ্যান-জ্ঞান হয়ে গেল । এখানে অত বড় হট এয়ার বেলুন কোথায় পাবে? এডভার্টাইজিং বেলুনগুলোরও অনেক দাম। তাই ছোট হিলিয়াম বেলুনই সই। গ্যাস ভরার কিটও কিনে নিয়েছে দেবাঙ্গণ । বাবার আস্কারা আর দেবাঙ্গনের নিজের পকেটমানি থেকে,বাপ-বেটা দু’য়ে মিলে, বেশ কসরত করে পুরো জিনিসটা শিখে ফেলেছে। এখন অবশ্য ও নিজে নিজেই সব করতে পারে। আজ যে বেলুনটা ছেড়েছিল সেটা একটু বড়। ভেতরে হিলিয়াম গ্যাসও ভরেছে তাই বেশি,তবে হিসেব করে। উপরে উঠে বাইরের হাওয়ার চাপ কমে গেলে ,ভেতরের গ্যাসের চাপে বেলুনটা এমনিতেই বড় আর গোল হয়ে যাবে। বেলুনের গায়ে ছোট্ট চিঠি আর নিজের নাম ঠিকানা লিখে, আকাশে ছেড়ে দিতে অদ্ভুত একটা রোমাঞ্চ আর ভাললাগা গ্রাস করে ওকে,যেন ওই ভেসে যাচ্ছে।কেউ যদি কোনদিন পায় ওই বেলুনটা ,তার বাড়ির ছাদে।কি দারুন হবে! কতদূর দেশে যেতে পারে বেলুনটা ...??? কল্পনার রাজ্যে পাড়ি দিত  দেবাঙ্গন ।কিন্তু গত ক’বছরে অন্তত গোটাপঞ্চাশ ছোট-বড় বেলুন ছাড়লেও, কোনটারই কোন উত্তর আসেনি। হয়তো বেশি দূরে যেতে পারেনি ,বা কারও হাতে পড়ার আগেই নষ্ট হয়ে গেছে বেলুনগুলো। তাই এবারে পিভিসির বড় বেলুন, দামও পড়েছে ভালই। এটাও অনলাইনে কিনতে হয়েছে।সাধারণ যে বেলুনগুলো বিক্রি হয়, তা এতই পাতলা যে বাতাসের চাপ আর ভেতরের গ্যাসের ধাক্কা বেশিক্ষণ সইতে পারে না। দেখা যাক এই দামী বেলুনটা কতদূর যেতে পারে। আরো ক’টা ছাড়তে হবে এই রকমই ,ঠিক করে নিল দেবাঙ্গন।
কিন্তু দিন যায়,মাস যায়, কোন উত্তর আসে না কেন? বেলুনগুলো ভেসে ভেসে যায় কোথায়, ভোজবাজির মত উবে যায় নাকি? দূরে,অনেক দূরে পাড়ি জমাতে পারে না একটাও!দেবাঙ্গনের মনটা আকুল হয়।
‘তোর বেলুন নিশ্চয়ই কেউ পাবে,একদিন না একদিন।হাল ছাড়িস না,দেব।‘ বাবা ওকে উৎসাহ দেয়।‘কিন্তু বাবা,বেলুনের লেখাগুলো মুছে যায় না তো রোদ-বৃষ্টিতে?’ ‘সেজন্যই তো তোকে পাইলট ব্ল্যাকটা এনে দিলাম। ওর লেখা নষ্ট হবে না সহজে।‘ ‘ওটা দিয়েই তো আজকাল লিখি,বাবা।‘ ‘তাহলে অপেক্ষা কর,উত্তর আসবেই ’,বাবা বলে। ‘আসলে বেশিরভাগ সময় হাওয়ার গতি-প্রকৃতি দক্ষিণের দিকে থাকে।তুই তো জানিস,আকাশের স্ট্রাটোস্ফিয়ার লেভেলে উঠে বেলুনের ওপর বায়ুচাপ একটু কমলে ও পাড়ি দিতে থাকে।আমার মনে হচ্ছে সব বঙ্গোপসাগরের দিকে চলে যাচ্ছে।স্থলভাগে না পড়লে কে তোর চিঠির উত্তর দেবে?’ দেবাঙ্গন,বাবার কথা মতো পড়াশোনা করে জানতে পারে, একমাত্র বর্ষাকালে  বাতাস একটু ভেতরের দিকে বয়।স্যাটেলাইট ইমেজ দেখে, বাতাসের গতিপ্রকৃতি ও এখন পড়তে শিখে গেছে।সেইসব মাথায় রেখেই আজকাল বেলুনগুলো ছাড়ে ও।বাবাই উৎসাহ দেয় পুরো ব্যাপারটায়,বুঝিয়েও দেয়। বাবা বলে, ‘দেব, যখন যেটা করবি, প্রাণ দিয়ে করবি, ভালোবেসে করবি। দেখবি, তাহলেই ফল পাবি।‘ দেব বলে, ‘আমি বড় হয়ে জিওফিজিসিস্ট হব বাবা।‘ বাবা খুশি হয়ে বলে, ‘যা খুশি হ না,কে বারণ করেছে।শুধু অ্যাভারেজ স্টুডেন্ট হোস না।তোকে সব বিষয়ে মহাপন্ডিত হতে হবে না।শুধু যে বিষয়টা তোর ভাল লাগে,সেটার সব খুঁটিনাটি জানতে থাক,কোর্সে না থাকলেও ডিটেলসে জান।ঐ বিষয়টায় তোর চেয়ে বেশি কেউ যেন না জানে।পৃথিবীতে এখন স্পেশালিস্টদেরই কদর রে।‘ দেব বলে,’বাবা তুমি কখনও বেলুন উড়িয়েছ?’ ‘আমাদের ছোটবেলায় আমরাও অনেক ফানুস ওড়ানো দেখেছি, সেও তো হট এয়ার বেলুনই।‘ বাবা বলে। ‘তুমি নিজে ওড়াতে না কেন বাবা?’, দেবাঙ্গণ জিজ্ঞেস করেছিল। ‘আমারও খুব ইচ্ছে হতো, জানিস। কিন্তু কি করব বল, ছোটবেলাতেই বাবা মরে গেল। তোর মতো এতো আরামে আমার ছোটবেলাটা কাটেনি রে। না খেয়ে, না দেয়ে অনেক কষ্টে কেটেছে। আর ফানুস তো ওড়াত বড়লোকরা ।আমি শুধু আড়াল থেকে দেখতাম। বিশ্বকর্মা পুজোর দিন, কালীপুজোর দিন, অস্ট্রেলিয়ান রঙিন কাগজে তৈরী, কি সুন্দর সুন্দর নকশা করা,সব বড় বড় ফানুস ওড়ানো হতো।আকাশে উঠে গিয়ে ,ছোট হতে হতে, দূরে কোথায় হারিয়ে যেত। দেখতে আমারও ভাল লাগত, জানিস। কিন্তু নিজে কেনার সাধ্য ছিল না।‘ বাবা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
মাস ছয়েক পরের কথা। দেবাঙ্গনের রেজাল্ট বেরিয়েছে।রেজাল্ট তো ওর বরাবরই ভাল হয়।তার মধ্যে ভূগোলে এবারেও ও টপার,ওর প্রিয় সাবজেক্ট। হঠাৎই একদিন বিকেলে স্কুল থেকে ফিরে, লেটারবক্সে ও দেখে ওরই নামে একটা চিঠি এসেছে। চিঠিটা পেয়েই, দেবাঙ্গনের বুকটা আনন্দে ভরে উঠল।অবশেষে,ওর বেলুন চিঠির উত্তর এল তাহলে,তাও আবার সুদূর ভুবনেশ্বর থেকে। রোজই ফাঁকা ডাকবাক্সে হাত ঢুকিয়ে কত নিরাশ হতে হয়েছে। কত রাতে ঘুমের মধ্যেও ‘বেলুন আসছে, বেলুন আসছে’, বলে চেঁচিয়ে উঠেছে। আজ চিঠিটা পেয়ে এবং অচেনা নামের প্রেরক দেখে ও খুশিতে পাগল হয়ে উঠেছিল ।চিঠিটা খুলে দেখে ঠিক তাই ,ভুবনেশ্বর থেকে বিষ্ণু ওকে চিঠি লিখেছে,ওরই বয়সী। বেলুনটা কলকাতা থেকে ভুবনেশ্বর উড়ে চলে গিয়েছিল! ভাবতে পারেনা দেবাঙ্গন ।মনটা খুশিতে পাগল হয়ে উঠেছিল, আনন্দে চোখে জলও এসে গেল।ছুটতে ছুটতে মাকে গিয়ে প্রথম খবরটা দিল ও।‘মা চিঠি এসেছে।বেলুনটা একজন পেয়েছে।‘ মা খুশি হয়ে বলল, ‘তাই নাকি? কি লিখেছে রে?’ দেবাঙ্গণ বলল ‘বলছি, পুরোটা পড়িনি।আগে বাবাকে খবরটা দিয়ে দিই? ফোন করব মা?’ মা বলল, ‘বাবা তো এখন অফিসে, আসলে বলিস এখন।‘ কিন্তু আর তোর সয়না দেবাঙ্গনের। মোবাইলে ফোন করে বাবাকে। বাবাও শুনে মহা খুশি ,‘ভুবনেশ্বর? তোকে বলেছিলাম না,বর্ষার শুরুতে দক্ষিণ পশ্চিম মৌসুমী হাওয়া কেরলে ঢুকলেই, বেলুন দেশের ভিতরের দিকে উড়ে যাবে।দেখলি তো’,বাবাও উত্তেজিত হয়ে বলে। 
ঘরে এসে চিঠিটা ভাল করে পড়তে শুরু করল দেবাঙ্গণ । প্রতিটা লাইন যেন গিলে খেতে চাইছিল ও। বিষ্ণু নাকি খুব আনন্দ পেয়েছে  এই বেলুনটা পেয়ে ,আর ও দেবাঙ্গনের বন্ধু হতে চায়,ওকে আসতে লিখেছে।কিন্তু এ কি লিখেছে বিষ্ণু চিঠির শেষটাতে ?লিখেছে ওর নাকি ব্রেন ক্যান্সার হয়েছে,হসপিটালে শুয়ে আছে। সিস্টারই দিয়েছে ওকে বেলুনটা। 
বিষ্ণুর জন্য মনটা খারাপ হয়ে গেল দেবাঙ্গনের,এত উচ্ছ্বাস,এত আনন্দ নিমেষে উধাও।ও  বুঝতে পারেনা কি করে বিষ্ণুর সঙ্গে যোগাযোগ করবে। বেলুন পৌঁছবে হয়তো অন্য কোন ঠিকানায়, চিঠি পৌঁছতে যদি দেরি হয়ে যায়!