প্রথম প্রেম
এই মাত্র একটি উষ্ণ কবিতা শুধু তোমাকেই লেখা হবে বলে, তাড়া তাড়া কাগজ আর মুঠো মুঠো তাজা আবেগ নিয়ে বসেছি। শুধু তোমারই জন্য এখানে অনেক ঝরাপাতা সাজিয়ে একটা অবুঝ কবিতা লেখার চেষ্টা চলছে। শুধু তোমাকে দেওয়া হবে বলে, এইমাত্র ইউক্যালিপটাসের সবচেয়ে সবুজ পাতাটিকে দ্রুত বেড়ে উঠতে নির্দেশ দেওয়া হল।এই বাড়ির বারান্দায় বসে শুধু তোমার কথা ভাবব বলে, যতসব লোহালক্কর আর পেষণযন্ত্রের চিন্তা মাছি তাড়ানোর মতো দূর দূর করে তাড়িয়ে দিই ।শুধু তোমার কথা লিখব বলে বিদায় করি রবীন্দ্র জীবনানন্দ শক্তির সব অনুভূতি অথবা বিশ্লেষণকে। তোমারই মুখে হাসি ফুটবে বলে টালা ব্রিজে জ্যাম ছেড়ে যায়, মোড়ে মোড়ে তেলেভাজার বদলে বিক্রি হয় কবিতার বই। বর্ষার বদলে হঠাৎই শীতকাল এসে পড়ে, আর বাজারে কোল্ড ক্রিমের দাম কমে যায় একেবারে। তোমারই কথা রাখব বলে, আমি শ্যামবাজারের বদলে কলেজ স্ট্রিটে বাস থেকে নেমে পড়ি, রাতে ঘুমের ওষুধ খেতে গিয়ে ভুলে খেয়ে ফেলি জ্বরের ওষুধ। মাত্র সাতটা ছুটি বাকি আছে জেনেও অফিসে আরো দুটো ছুটি নিয়ে ফেলি সম্পূর্ণ বিনা কারণে। শুধুমাত্র তোমার ছবি আঁকা হবে বলে হুসেন একশো একাত্তর তুলি থেকে পছন্দমতো তুশি বেছে নিতে ঘেমে যান।তোমাকেই দেওয়া হবে বলে, সম্পূর্ণ নতুন একটি রং সৃষ্টির জন্য নিউটন নেমে এসে গবেষণায় ডুবে যান রাত দুটোয় ।তোমাকে দেখার জন্য ঘরে ঘরে দরজা জানলা হাট করে খুলে, জ্যাঠা জেঠি ঠাকুমা ছোটকা বাচ্চা সব ছেলে মেয়ে হই হই করে চাতালে পা ঝুলিয়ে অপেক্ষা করে বসে থাকে, শুধুমাত্র তুমি আসবে বলে। শুধু তুমি আসবে বলে প্রধানমন্ত্রীর কনভয় ঘুরিয়ে দেওয়া হয় ময়রাডাঙা লেনে। প্রতিদিন বিকেলে, কবিতা লেখার বদলে,বালিশে হেলান দিয়ে জয় ভাবতে থাকেন তুমি ঠিক কি ভাবছ, কিম্বা লিখছ কিনা সবুজ কবিতা। তোমাকে শোনাবেন বলে নুসরত আলি সুফির বদলে নজরুলগীতি গেয়ে উঠে কেঁদে ফেলেন। তোমারই জন্য মঙ্গল অভিযান বন্ধ রেখে কিউরোসিটি রোবট তথ্য দিতে থাকে, কোন দিন সন্ধ্যায় তুমি কোন পোশাক পরেছ। ইন্টারনেট হ্যাকিংয়ে দেশ-বিদেশের প্রতিটি কম্পিউটারে ভেসে ওঠে শুধু তোমারই ছবি। ধর্মতলার আলো ঝলমলে সমস্ত দোকানে ,ক্রেতা বিক্রেতার ভিড় ছাপিয়ে ফিসফাস কানে আসে, তুমি আজ হলুদ তাঁতের শাড়ি পরেছ।টিভির প্রতিটি চ্যানেলের ব্রেকিং নিউজ,তুমি নাকি দুপুরে সরষে ইলিশ রাঁধতে গিয়ে হাত পুড়িয়ে ফেলে কেঁদে ফেলেছ। সাইকেল ,রিক্সা বা বাস ভর্তি লোকজন, সবখানে শুধু কথা তোমায় নিয়ে। তুমি শুয়ে আছো না বসে, বসার ঘরের সোফায় হেলান দিয়ে বুদ্ধদেব গুহ নাকি ম্যাগাজিনের পাঠিকা,সুমন না নচিকেতা, কার গান তোমার ভাল লাগে, এ নিয়ে আড্ডাবাজ ছেলে ছোকরারা দোটানায় পড়ে যায়। কারখানা থেকে ফিরে শ্রান্ত শ্রমিক বা হাট থেকে ফিরে আসা বিধ্বস্ত চাষা ঘরে ফিরে লুকিয়ে লুকিয়ে প্রতিবার তোমাকেই দেখে ফেলে। তাই শুধুমাত্র তোমাকেই বর্ণনা করতে গিয়ে ইডেনের প্রেসবক্সে বসে সমস্ত সাংবাদিক একসাথে লিখে ফেলেন প্রেমের কবিতা। তোমার কাছে পৌঁছতে নেতার উড়ান দিল্লির বদলে সোজা আমলাশোলে নেমে পড়ে।হোয়াইট হাউজে বসে রাষ্ট্রনেতারা চিন্তিতমুখে পরিবেশ চুক্তি করে ফেলেন, যাতে কোনদিনও না তুমি হারিয়ে যাও। পরমাণু বিজ্ঞানী আব্দুল কালাম রকেটের বদলে তোমারই মর্মর মূর্তি গড়ে ফেলে শিশুর মত আনন্দে চেঁচিয়ে ওঠেন। কিন্তু এরা কেউই, কোনদিনও, এই সমস্ত কাজে সফল হবেন না, যদি না আমি নিজেই বলে দিই, তুমি আসলে কে।
আমি নির্ঝর।অনেকে ডাকে ‘নীল’।কলেজে প্রথম দিন সুন্দরী মেয়েটির পাশে বসেছিলুম আমি। তার নোটস্ এর ডায়েরিতে লিখে দিয়েছিলুম এই কবিতা।
তুমি কি আমার সামান্য নদী ?
ছোট্ট জলধারা চুপিসাড়ে বয়ে যায়-
আর কারো নয়,
আমারই ঘুমঘোরে যদি -
সে আমাতে মিশে হারায় ?
থাকো আমার সামান্য নারী হয়ে ।
আরো কাছের হয়ে তোমার কপালে টিপ-
সে তো আমিই –
হতে চাই সামান্য পুরুষ সেই ।
লেখার সময় আগুপিছু কিছুই ভাবি নি। একটু অবশ্য ভয় করছিল, যদি সে জেনে ফেলে,কার কাজ ।কিন্তু তখন ছোট ছোট আনন্দ বুকে করে, চলার পথটুকু খুশির আবেগে ভাসিয়ে দেবার বয়স। কবিতা মাথায় এলে লিখে ফেলাটাই ছিল অভ্যাস । আর হাতের কাছে এমন একটি সুন্দরী বান্ধবী থাকতে কার না ইচ্ছে হবে ,তার কাছে সে প্রাণের ছাপ রেখে যেতে! তখনও তার নাম জানতুম না, কারণ আমাদের আলাপ হয়নি ভাল করে। আমি ছিলুম একটু ভীতু প্রকৃতির, কোনদিন কো-এডুকেশনে পড়ার সুযোগ হয়নি ।ছাপোষা সাধারন পরিবারের ছেলে,মেয়েরা আমার কাছে ছিল ভিনগ্রহের জীব ।পাশ দিয়ে কোন সুন্দরী হেঁটে যাবার সময়, মনে হত যেন হাওয়ার ধাক্কায় যেন পড়েই যাব। মনে হতো আমার চালচলন,কথাবার্তা, হাঁটাচলা সব বোকা বোকা লাগছে না তো! খুব অস্বস্তিতে পড়তুম কতবার ।
কবিতা লিখে যে ভালোবাসার জনকে মনের কথা জানানো যায়, সেদিন নিজে নিজেই সেটা আবিস্কার করে ফেললুম। অফ ক্লাসের ব্রেকে,সে যখন বই খাতা রেখেই চলে গেল কোথাও ,আর বলে গেল আমাকে , ‘আমার বই খাতাগুলো রইল, আমি একটু আসছি।‘ আমি ঘাড় নেড়েছিলাম এবং আশ্বস্ত হয়েছিলাম এই জন্য যে “হ্যাঁ” এই শব্দটাও আমাকে বলতে হয়নি বলে। কে জানে সেটুকুর মধ্যেও কোন আনস্মার্টনেস ঢুকে পড়ত কি না! আমি যে বরাবরই লাজুক প্রকৃতির, তারপর সমবয়সী সুন্দরী মেয়ের সামনে......। কিন্তু আমার কলম সে সব বোঝে না। সে তো মেশায় জলে আগুন। কিছু না ভেবে আবেগবশে হঠাৎ তার প্রাণের কথা সে যে লিখে ফেলবেই,এতে আর আশ্চর্য কি?তার নতুন ডায়েরির দ্বিতীয় পাতায় লিখে দিলুম এই কবিতা ।ডায়েরিটা অবশ্য খুলেছিলুম তার নাম জানতে।সেটা তখনই জানলুম – ‘বন্যা’।
সেই শুরু। পরের দিন আবার অফ পিরিয়ডে ,সে হঠাৎ আমাকে দেখে তার ডায়েরিটা এগিয়ে দিল।বুকটা ঢিপঢিপ করে উঠল, কি জানি কি শুনতে হবে। সারা রাত বিছানায় ছটফট করেছি নিজের কৃতকর্মের কথা ভেবে। লেখার সময় তো এত কিছু ভাবিনি, অথচ বাড়ি ফিরে ভয় আর অজানা আশঙ্কায় কেঁপেছিলুম। লেখাটা পড়ে সে কিভাবে নেবে! প্রথমে তো খারাপ চিন্তাগুলোই আসে, মনে হল সে ভীষণ রেগে যাবে ,একটা অচেনা অজানা ছেলে কলেজের প্রথম দিনে পাশে বসেই ,এমন একটা বেয়াড়া কাজ তার অনুমতি ছাড়াই করেছে বলে ।যদি সে সোজা আমার বাড়ি চলে আসে, কলেজ থেকে ঠিকানা জোগাড় করে! যদি প্রিন্সিপাল বা ক্লাসের সবাইকে বলে দেয়! বুক কেঁপে উঠেছিল। তারপর সে যখন খাতাটা আবার আমাকে ফেরত দিল তখন বুঝে উঠতে পারলুম না কি বলব ।আর কেনই বা দিল। ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলুম ‘এটা কি ?’ সে বলল ‘ কিছু না ,এমনি দিলাম।‘ তারপর সে তার নিজের জায়গায় ফিরে গেল আর আমিও আশেপাশের শ্যেনদৃষ্টি উপেক্ষা করে, সাবধানে ,নিজের জায়গায় বসে ডায়েরির সেই দ্বিতীয় পাতাটা খুললুম । সেখানে চমক, আরো একটা কবিতা লেখা হয়েছে তৃতীয় পাতায়।
তুমি বৃষ্টির কাছে ছিলে -
জলের ফোঁটার স্পর্শ তোমায় আমায় ,
তুমি হেঁটে গেলে সব রঙ ধুয়ে দিয়ে ।
পথের মাঝে তুমি -
পথের কাছে সব হারাতে পারি,
দিন কেটে যায় তোমাকে হাতড়িয়ে ।
মন তোমায় দিল ধরা -
তুমি ঘাসের কানে বার্তা আমায় দিলে,
চোখের আকাশ স্বপ্নে সেজে নিয়ে ।
শেষে তুমিই আমায় নিলে-
মনের গভীর সবুজ যে তাই হল,
তোমার হাতে হাতটি আমার পেয়ে।
বন্যাকে
এমন কিছু নয়, এইখানে বসে আমি সব দেখতে পাচ্ছি ,আর ওইখান থেকে তুমি সব শুনছো -এই আর কি। এমন কিছু নয়,তবুও কিছু থেকে যায়, স্কুলফেরত মেয়েদের দলে আর কোন নীল সাদা শাড়ির পাড়ে সে কথাই লেখা ছিল কিনা, এইসবই খুঁজে যাওয়া। খুঁজে যাওয়া সর্ষের মধ্যে ভূত আর তোমার ঠিকানা খুঁজে পেয়েও, বারবার হারিয়ে ফেলা ।তারপর, এই যে আমি ক্রমাগত ভুল করে চলেছি ,আর সেই সব ভুল আমাকে ভীষণ লজ্জায় ফেলে দেয় রাতে শোবার আগে ,বিশেষত যখন আমি ওষুধ খেতেও ভুলে যাই । প্রতিদিন এই ভাবেই জমে উঠছে অসংখ্য পাপ ,আর খুঁজে বেড়াচ্ছি সবুজ প্রজাপতি।অথচ এইখান দিয়েই, সাপের মতো কিলবিলিয়ে ছুটে চলেছে বি টি রোড আর তার সাথে গড়গড় করে গড়িয়ে যাচ্ছে , অফিস ফেরতা মানুষজন, পাদানিতে দাঁড়িয়ে যত ঝগড়ুটে, হাজার হাজার পেটফোলা ব্যাগ, হরলালকা প্যাকেট ,খৈনির ডিব্বা, রুমাল, গরম গরম খবর আর খাবার ,যত সব সস্তা কবিতা, লাভ লেটার আর ফালতু কিছু কল্পনা। এইখানে বসেই ঘাড় না ঘুরিয়েও, আমি দেখে ফেলেছি তোমার নগ্ন কুশপুতুল ,দেখে ফেলছি টিভির স্ক্রিনে, নিষিদ্ধ স্বপ্নে আবারও তোমায়, তোমার দমকে দমকে বেরিয়ে আসা হাসি আর তপ্ত নিশ্বাস। আর তোমার হিলতোলা জুতোর পেছনে আমার লাজুক চশমা যখন হ্যা হ্যা করতে করতে চলে গেল ,তখন আমি দেখেও কিছু করতে পারছি না। বিশেষ কিছু না যখন ফাঁকা ডাকবাক্সে হাত গলিয়ে আর কিছু নয় আমার তোবড়ানো আঙুলগুলোই বারবার বেরিয়ে আসে আর বিকেলবেলা জ্যান্ত আগুন বৃষ্টিতে যখন ধুয়ে যায় আমার রঙিন সব পালক, তখন তোমার দেওয়া সেই ‘শেষের কবিতা’র সঙ্গে কাটানো এক শীতার্ত সন্ধ্যের কথা মনে করে, আমি শান্তি পাই। শান্তি পাই গরম কফির কাপে, এই কলকাতার প্রতিটি রাস্তার ধুলো মেখে আর সম্পর্ক গুলো জোড়া দিতে দিতে এই যে আমি এগিয়ে চলেছি আর দেখতে পাচ্ছি লুকিয়ে থাকা ঘুঘু ,আর এই যে আমার কবিতার খাতায় জমে থাকা ধুলোর উপর আমি আঙুল দিয়ে লিখলাম তোমার নাম, আর এইসব ক্রিংক্রিং রিকশার ঘন্টি, জ্যাঠার গলাখাঁকারি আর কালী মন্দিরের ঘন্টা ছাপিয়েও, এই যে আমি তোমাকে বাংলা ব্যাকরন পড়িয়ে চলেছি ,তার কি হবে? এমন কিছু নয়, এইখানে বসে আমি লিখে চলেছি আর ওইখানে বসে তুমি পড়ে ফেলছ, এই আর কি।
তুমিই আমার প্রথম প্রেম, বন্যা। তুমি যে তোমার ওই হাত দুটো আমায় দিয়েছ, এ যে কত বড় দেওয়া তা তুমি নিজেও জান না। মনে হয়, তোমার হাত নিয়ে খেলা করতে করতে, কখন সময় কেটে যায়, আমি দুঃখ গ্লানি সব ভুলে যাই।আর বারবার সেই অপূর্ব সম্পর্ককে মনে পড়ে, যাকে আমরা প্রতিনিয়ত বুঝে চলেছি। যার নাম প্রেম, যা শুধু আনন্দ দেয়না, বদনামও দেয় আমাদের সমাজে। যা শুধু নিজেদের আবিষ্কার করতেই শেখায় না, অনেক বাধার জন্য প্রস্তুত হতেও শেখায় ।আর তুমি-আমি প্রতিদিনই তাই’ই শিখে চলেছি।তুমি যে তোমার সুন্দর চোখ দুটোর পলকহীন দৃষ্টি আমাকে দিয়েছ, তা নিয়ে আমি কি করব বুঝে উঠতে পারি না ।কখনো সখনো লজ্জায় পড়ে যাই। কিন্তু রোজই আমি হারিয়ে যাই তোমার দু চোখের মধ্যে। গভীর ,গভীরতর ভাবে হারিয়ে যাই তোমার দুই চোখের মাঝখানের টিপটার মধ্যে ।আর তখনই মনে হয় এই পৃথিবীতে আমি আর একা নই, আমারও একটা আশ্রয় আছে। সারাদিন কাজের শেষে যেখানে আমার মুক্তি অপেক্ষা করে আছে।তোমার সেই চোখদুটো আমারই দিকে চেয়ে আছে, অপেক্ষা করে আছে আমারই জন্য। আর হয়ত বা নতুন কোন দিনের জন্য, যে খুশির দিন এনে দেবার দায়িত্ব আমার। আর তখনই সেই দায়িত্ববোধ আমাকে চালিয়ে নিয়ে চলে।তুমি যে তোমার নরম ঠোঁট দুটোর স্পর্শ আমায় দিয়েছ, তা আমার কাছে স্বপ্নই ছিল ।একদিন কিভাবে যেন সেই স্বপ্ন সত্যি হয়ে গেল, আমি একটা অন্য জগতে পৌঁছে গেলুম,রোজকার জগৎ থেকে তা একদম আলাদা।সব লোকের সব দৃষ্টি, জল্পনা-কল্পনা, ঈর্ষা থেকে বেরিয়ে তোমার ঠোঁটের দিকে এগিয়ে চললুম আমি। অন্তরঙ্গভাবে সেই প্রশ্রয় তুমি দিয়েছ। সেখানে প্যাচপেচে গরম নেই ,প্রখর রোদ নেই , ভীড়বাসের ঠেলাঠেলি নেই, রোজকার জীবনের প্রতিযোগিতা নেই,হেরে যাওয়া নেই । শুধুমাত্র দুটো ঠোঁটের দিকে চেয়ে ,তোমার স্পর্শে ,আমি আবার নিজেকে ফিরে পেয়েছি। সবার দৃষ্টি থেকে বাইরে, সবার সব কথাবার্তার থেকে আড়ালে, শুধু ভালবাসার জন্য, তোমার সঙ্গে থাকতে চাই আমি। আমি যে কেবল তোমাকেই পেয়েছি তা তো শুধু নয়, আমি যে নিজেকেও পেয়েছি।
আমার কবিতার কোনখানে ঠিক জীবনের কথা লেখা ,বলতে পার? কোথাও কি লেখা আছে গড়ে তোলার কথা? এ তো ক্ষণিকের কথা মাত্র ।এইটুকুর বাইরেও আমার ভালোবাসা তোমাকে খুঁজে বেড়ায়, সারা রাস্তা চলেও যাকে ধরা যায় না, সারা জীবন ধরে পাশে বসে থাকলেও যাকে ছোঁয়া যায় না। সেই ভালোবাসাটুকু তুমি অন্তত চিনে নাও, যা শুধু আমার গভীর চেতনায় থাকে, যার জন্য আমি দিনে, রাতে তোমারই স্বপ্ন দেখি। সেদিন যখন আমি বাস থেকে নেমে গেলুম ,তখন তোমার মুখটা দেখেছিলুম। তোমার মুখে মন খারাপ ফুটে উঠেছিল ।আচ্ছা তুমি আমাকে আরো একটু কম ভালোবাসতে পার না ?তাহলে তো আর এত মন খারাপ হয় না ,এত কষ্ট পাও না! কিন্তু মনে হয়, এর চেয়ে বেশি হলেও এর চেয়ে আর কম ভালোবাসা সম্ভব নয় ।তার জন্য প্রয়োজন হলে আমি জেদী হতে পারি, একগুঁয়ে হতে পারি ,পাগল হতে পারি। সে তুমি যাই বলো না কেন।
কত দিন ধরে আমি তোমার প্রতীক্ষা করেছি, দরজায় কড়া নাড়ার প্রতীক্ষা করেছি। তুমি আসোনি ।আজ সকালে জ্বলন্ত সূর্যের দিকে তাকিয়ে থেকে ভেবেছি , আমার কি আর কিছুই করার নেই, মরমে মরা ছাড়া? আমার মনে হাজার হাজার স্বপ্ন খেলে বেড়ায় আর আমি তার কোন একটা সফল হবে ভেবে হাপিত্যেস করে বসে থাকি। তখনই আরো হাজার হাজার বেদনাময় অতীত আর বর্তমান এসে হামলা করে যায়, আর স্বপ্ন ছেড়ে বাস্তবে এসে পড়তে হয় আমাকে। আমি লজ্জায় মরে যাই, শামুকের মতো খোলার মধ্যে ঢুকে যাই।
কিন্তু চুপ করে বসে থাকার ছেলে তো আমি নই ।আমি খুঁজে বেড়াই সেই আগুনকে, যা তুমি আমার মনে ঢেলে দিয়েছিলে। সে আগুন কি জ্বলে জ্বলে শেষ হয়ে গেল? নাকি তুমি অকারণেই নিভিয়ে দিয়েছ তাকে। আমার মন বলছে ,তার অন্তত একটা ফুলকি আজও বেঁচে আছে,শুধু আমারই জন্য। আর তাকেই আমি সযত্নে তুলে নিলুম আমার তালুতে। আর তখনই তা হয়ে গেল একটা ঊজ্জ্বল নীল পালক আর আমি তাকে করে নিলুম আমার লেখার কলম। তাই দিয়েই লিখছি কবিতা। তুমি কোথায় ছিলে এতদিন, আমাকে একা রেখে? তবে আমি নিশ্চিত জানতুম ,যে তুমি একদিন আসবেই ।তাই এতদিন অপেক্ষা করেছিলুম।এবার আমার আগুন তুমি ফেরত দাও,কারণ শুধু তুমিই আমার হৃদয়ে আগুন জ্বালতে পার। আজ তোমাকে আমার প্রয়োজন। কোথায় রয়েছে তোমার ভালোবাসা?আমি যে হাত বাড়িয়ে আছি। সে কি সাত সাগরের পারে, নাকি সূর্য ডোবার পরেও, এক চিলতে ঘরের কোণে লুকিয়ে রয়েছে সে ? সে যেন প্রদীপের শিখার মত আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে আমার সমস্ত ঘর আলোকিত করে দেয়।আমার আর কিচ্ছু চাই না।একটা ব্যাঁকাট্যারা জীবন, একটা বাউন্ডুলে মন,রঙীন ক্যানভাস,স্মৃতির নুইয়ে ধরা ডাল,বেহিসেবি বসন্ত,প্রিয় শব্দের স্তুপ,মন ভাল করা বই আর ছুঁয়ে থাকা ‘তুমি’।
একদিন দেখে ফেললাম নীল আকাশে সাদা মেঘের গোপন মিলন আর হঠাৎ একটা কথা মনে পড়ে গেল , কোন জলের স্রোতে একটা পাতা পড়লে, সেটা তলিয়ে যেতে বা ছন্নছাড়া হয়ে ভেসে যেতে পারে। কিন্তু সেই স্রোতের মধ্যে আর একটা অন্য পাতা পড়লে ,তাকে ধরে সে স্থির হতে পারে। সে রকমই একটা পাতার খুব দরকার মনে হল আমার। আর পাশেই পড়েছিল নর-নারীর চুম্বনরত ছবি -একটা বিজ্ঞাপন ।মুহূর্তে বাস্তবে ফিরে এলাম আমি।তখনই তোমাকে টেক্স্ট মেসেজ লিখতে বসে মনে হল , কবিতার রক্ত জমাট বাঁধে না কখনও,আমার রক্তও যেন তাই হয়। শুধু এই জন্যই মাঝে মাঝে ভীষণ ভালো লাগে নিজেকে, ভালো লাগে পৃথিবীকে, ভালো লাগে প্রকৃতিকে। ভালোবেসে ফেলি সবাইকে, চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে "আমি ভালবাসি"। কতদিন বাঁচব আমি জানিনা, কিন্তু যতদিন বাঁচব জীবনকে জানা-বোঝার সুযোগ থেকে যেন বঞ্চিত না হই। নানাভাবে বাঁচতে ইচ্ছে করে, নানা অনুভূতি, অভিজ্ঞতা নিজের করে নিতে ইচ্ছে করে ।কিন্তু এই একটা জীবনে কত কিছু করা সম্ভব? এই যেমন চলে যেতে ইচ্ছে করে সারা পৃথিবীর দুর্গমতম প্রান্ত গুলোতে, সুন্দরতম জায়গা গুলোতে, মিশে যেতে ইচ্ছে করে মানুষের মধ্যে,সেনাবাহিনীর হয়ে মরণপণ যুদ্ধে লড়ে যেতে ইচ্ছে করে, সমাজের অন্যায় গুলোর বিরুদ্ধে ঘা দিতে,রুখে দাঁড়াতে ইচ্ছে করে,লিখে ফেলতে ইচ্ছে করে দারুন সব কবিতা, এঁকে ফেলতে ইচ্ছে করে নতুন ধরনের ছবি ,প্রচুর বই পড়তে ইচ্ছে করে, অনেক কিছু শিখতে ইচ্ছে করে,নতুন কিছু আবিষ্কার করে ফেলতে অথবা মাস্তানের উপর মাস্তানি করতে, দাগী অপরাধীদের ভীষণ শাস্তি দিতে, সারাদেশের মানুষের কাছে ভীষণ আদর্শ হতেও ইচ্ছে করে। কিন্তু এত কিছু এই একটা জীবনে করা সম্ভব নয়, এতভাবে বাঁচার পক্ষে জীবনটা বড়ই ছোট। তখনই মনটা খারাপ হয়ে যায়। জীবনটা শেষ হয়ে এলো, অথচ কত কিছু করার বাকি থেকে গেল ।কত পথে হেঁটে যাওয়া হলো না, কত মুখ চেনা হল না, কত কি দেখা হল না,কত ভুল শুধরোনো হলো না, আর হবেও না হয়তো। এই হল জীবনের ব্যর্থতা।
বন্যা, তোমাকে প্রাণমন সঁপে দিয়েছি I তোমার জন্য আমি সব করতে পারি, বোমাবাজি কিংবা পকেটমারি।তুমি আমার গাড়িভাড়া বাঁচানো,জমানো পয়সায় কুড়ি টাকা থেকে এক লাফে তিরিশ টাকা হয়ে যাওয়া এগরোল সাঁটালেও তাই আমি উদাস না হয়ে তারিয়ে তারিয়ে তোমার ঠোঁটে লেগে থাকা লাল সসের চেটে নেওয়া দেখতে থাকি। গভীর রাতে শুধু মাঝে মাঝে ভীষণ সুরসুর করে হিসি পায়, মনে হয় কলেজের ব্যাগটা জমানো পয়সার ওজনে এত ভারী হয়ে গেছে যে আর বইতে পারছিনা. ওটাকে ছুড়ে ফেলি, কিন্তু ওর স্ট্রাপ আমার কাঁধ বেয়ে গলায় উঠে আসে, আর হিসহিস করে জড়িয়ে ধরে আমার গলা। দমবন্ধ হয়ে আমার ঘুম ভেঙে যায়। এক গ্লাস জল খেয়ে আমার ফ্যাকাসে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে আবার তখন তোমার কথাই মনে পড়ে যায়। কারণ তুমিই আমার বেঁচে থাকার একমাত্র সুখ। ভাবি তোমার সঙ্গে হেঁটে চলে যাব কোদাইকানাল, বা প্যারাসুটে করে ঝাঁপিয়ে পড়ব তোমাকে জড়িয়ে এরোপ্লেন থেকে। অনেক রাস্তা পেরিয়ে অনেক মৃত্যু ডিঙ্গীয়ে তোমার জন্যে আমি মায়াচন্দন আনতে পারি। তোমাকে নিয়ে আমি উদ্দাম উল্লাস বা অবুঝ প্রেম সবটাই করতে পারি কয়েক মিলিসেকেণ্ডে। তোমার কাছে শুধু আমার একটাই চাহিদা। অনেক লড়ে , অনেক হেরে, কিছু জিতে, অনেক বেচে, আমার চারপাশের নেশাখোর, খিস্তিবাজ অন্ধকার ঠেলে ,তোমার কাছে শেষমেষ এসে পৌঁছলে, আমার পায়জামার দড়িটা খুঁজে দেবে তো?
বন্যার কথা
আমার নিঃসঙ্গ কান্নায়, মাঝরাতে সমস্ত দেওয়াল ভেঙে যায়, বৃষ্টি আসবে বলে, তুমি আসবে বলে। আমার অস্থির আবেগে, তোমার স্পর্শে ,স্বপ্নের প্রজাপতি হঠাৎ কাছে আসে ।আমার কানের উপর তিরতির করে তার মেঘলা পাখা দুটি কাঁপতে থাকে, কাঁদতে থাকে কখনো কখনো। আর হাত ফসকে কখন সে উড়ে যায় ,আমার কবিতার খাতায়। আমার বিমর্ষ বিকেলে, তোমার হাতে আমি হঠাৎ একদিন আবিষ্কার করে ফেলি, হারিয়ে যাওয়া ইউক্যালিপটাসের পাতা। তুমি আসবে বলে, হিসেব করতে বসে ,হঠাৎ খাতা খুলে বেরিয়ে পড়ে স্পষ্ট করে লেখা তোমার নাম ।তুমি আসবে বলে, আমার ঘুম ভোর পাঁচটাতেই শেষ হয় আর বারান্দায় অপেক্ষা করে আমি দাঁড়িয়ে থাকি, এক বুক বন্যা নিয়ে। তুমি আসবে বলে সিঁড়িতে প্রতিটি পায়ের শব্দ আমায় জাগিয়ে দিয়ে যায়। শেষ হয়ে এল, এমনকি এইসব দিনগুলোও, তবু এক ফোঁটা চুম্বন শিরায় শিরায় ছুটে চলে, এখনো, তুমি শুধু তুমি আসবে বলে।
নির্ঝর,তোমার কবিতা পড়ে আমার প্রশ্ন জাগে, তুমি কি বিষন্নতার কবি? অথবা বেদনার? কবিরা কি বেদনা ভালোবাসে ? আমি তেমন কবিতা লিখতে পারিনা, কিন্তু কবিতা আমি ভীষণ ভালোবাসি। আবার এমনও কবি আছে, যাকে তার চেয়েও বেশি ভালবাসি। তোমাকেই আমার পৃথিবীর সবচেয়ে আপন, সবচেয়ে বিশ্বস্ত বলে মনে হয়।তাই আমার প্রত্যেক দিনের প্রত্যেক মুহূর্তে তুমি রয়েছ আমার চেতনায়। তোমাকে আমি এত ভালবাসি,যে মনে হয়,এর থেকে আর বেশি ভালবাসা যায় না।তবুও,তুমি যতটুকু ভালোবাসা চাও তার সবটুকুই দিতে চাই।
আচ্ছা,প্রেম মানুষকে কি করে বলতো? নাহলে বাস্তববাদী বলে যার একটু নাম আছে, সেও কি না আবেগের ফাঁদে পড়ে গেল ! আমি অবশ্য তোমাকে বলতে পারবো না, তোমার কি কি দেখে আমি তোমাকে ভালোবেসেছি। শুধু মনে হয় যবে থেকে অনুভব করেছি তুমি আমাকে ভালোবাস, তখন থেকেই তোমার সব কিছু আমার ভালো লাগে। আমি তো শুধু তোমার বাহ্যিক অস্তিত্ত্বকে ভালোবাসিনি, তোমার সমগ্র সত্ত্বাকে ভালোবেসেছি ।
তোমাকে আমি এতই ভালবেসে ফেলেছিলাম, যে সে কথা তোমার কাছে আর প্রকাশ না করে পারছিলাম না ।তবে আমি খুব ভাল করেই বুঝতে পেরেছিলাম তুমি আমাকে ভালোবাসো ,আর আমি তোমার কাছে অবাঞ্ছিত নই। তবে আমার খুব লজ্জা করছিল, যখন তুমি বারবার জিজ্ঞেস করছিলে এটা কি? আমি তো আর তোমায় বলতে পারছিলাম না, এটা প্রেমপত্র ।আমি হয়ত একটু বেশিই লজ্জা পাই , আপাতত একটু বেশি লজ্জা পেলে ক্ষতি নেই ,লজ্জা তো নারীর ভূষণ-কি বল?
বিভিন্ন কারণে মাঝে মাঝে তোমার সঙ্গে যখন কয়েকদিন দেখা হয় না ,প্রাণটা হাঁফিয়ে ওঠে। যখনই রাস্তায় বের হই, মনে হয়, এবার হয়ত দেখা হয়ে যাবে,বা অন্ততঃ ফোনে কথা হবে,তবে মনে শান্তি । ভেবে অবাক হচ্ছিলাম, কিইবা থাকতে পারে তোমার মধ্যে, যার জন্য পাগলের মত,চাতক পাখির মত অপেক্ষা করে থাকার শেষে, যেদিন তুমি আমার সামনে আস, ক’দিনের জমে থাকা সমস্ত অবসাদকে অমনি এক মুহূর্তে ভুলিয়ে দাও। তখনই মন বলত,হবে না কেন? এতেই তো রয়েছে আমার প্রিয়তমের প্রাণের পরশ , প্রেমের বন্ধন ।
সারাদিন যে আমি গল্প বা কবিতার বই পড়ি তা নয়, তোমার কথা ভাবি ।তোমাকে নিয়ে অনেক কিছু ভাবি ।কি কি ভাবি তা অবশ্য বলব না। তুমি ভাব না ? বিকেলে যখন আমি একা একা ছাদে ঘুরে বেড়াই, তখন মনে হয় তুমি যদি এখানে থাকতে, তবে অনেক অনেক কথা বলতাম,কিন্তু তুমি তখন কোথায় ? যদিও বাস্তবে নির্ঝরের সঙ্গে বন্যার সম্পর্কটা সামান্যই ,কিন্তু কোন এক বিশেষ নির্ঝরের সঙ্গে কোন এক বিশেষ বন্যার সম্পর্কটা যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ, তা নিশ্চয়ই অস্বীকার করতে পার না।
আজ তোমার কবিতার মধ্যে হারিয়ে গেলাম ।সত্যিই, তুমি কি সুন্দর কবিতা লেখ। আমিও চেষ্টা করি কিন্তু পারি না ঠিক তোমার মতো লিখতে। তুমি তোমার মনের কথা কবিতার মধ্যে প্রকাশ কর, কিন্তু তার হয়ত কোন দরকারই নেই। তোমাকে বোঝার জন্য, তোমার ভালবাসার জন এমনিই বুঝে নেবে, তোমার অজান্তে ,তার নিজের মনের গভীরে। তোমার কবিতাগুলোকে, তোমার অনুমতি ছাড়াই টুকরো টুকরো করলাম। জানিনা এ ব্যবহারে তুমি রাগ করবে কিনা। হয়তো ভাববে ,অহেতুক আধিপত্য বিস্তার করছি। তবু জানো, তোমার কবিতা ভেঙে শুধু অক্ষর পাইনি, পেয়েছি অনেক কিছু। তোমার অভিমান, আবেগ, ভালোবাসা, স্বীকারোক্তি, অভিযোগ, হারানো সুর- আরও আরও অনেক কিছু। ঠিক তোমার মধ্যে নিভৃতে প্রবেশ করে যেমন চৈতিবনে হাওয়ায় ঝরা ফুল পেয়েছি, লুকিয়ে কুড়িয়ে নিয়েছি আর সে আমার শুন্য বুকে ঝড় তুলেছে। তোমার কবিতায় শীতের শেষ রাতের নীল কুয়াশা মোড়া আকাশ আছে , ভোরের বাতাসে ডানা ঝাপটানো নরম পাখির ওম আছে আর শেষ বিকেলের পাগল করা দিগন্তব্যাপী আলো আছে। তোমার মত অশান্ত যুবকের মনের অবস্থা বোঝার মতো একজনই আছে, যে তোমার একান্ত নিজের হয়ে ধরা দেবে তোমার শুন্য বুকে, তোমাকে বুঝবে ।তোমার কবিতাকে কোলে তুলে নেবে, ঘন আবেশে ভরিয়ে জড়িয়ে ধরবে। সে হলাম আমি। তবে তোমাকে, তোমার কবিতাকে পুরো বুঝতে হয়ত আমি পারব না ,বোঝার চেষ্টা করাও উচিত নয়। শুধু যেটুকু বুঝেছি, জানিনা সঠিক বোঝার ক্ষমতা আমার হয়েছে কিনা, যার উত্তর একমাত্র তুমিই দিতে পার।
জানো,তোমার লেখা পড়লে আমার খুব বাঁচতে, বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে। তোমার লেখা পড়লে মনে হয় দুঃখেরও একটা মহানুভবতা আছে। উদাসী দুঃখকে ভয় করার নয়, দুঃখ ছাপিয়ে বোধ হয় কোন এক আনন্দ শেষ পর্যন্ত হৃদয়ের ঘরে জমা হয়। তোমাতেই আমার সব,তাই তুমি যখন তোমার বারান্দায় দাঁড়িয়ে দূরে, অনেক দূরে তোমার সাধের ইউক্যালিপটাস গাছের দিকে তাকিয়ে থাক,আমি তখন দুচোখ ভরে শুধু তোমায় দেখি। কদিন খালি তোমার কবিতাই পড়েছি ,তোমাকে তাই প্রতিবারই আরও কাছে পেয়েছি। ছেলেদের ধারণা, মেয়েদের জীবনের সবচেয়ে বেশি মূল্যবান বোধহয়, তার গয়নার বাক্সটি। তুমি জানো না নির্ঝর, আমার গয়নার বাক্সের চেয়েও তোমার কবিতার ঝাঁপিটা আমার কাছে অনেক অনেক বেশি দামী।
কি সুন্দর করে তুমি ভাবতে, কি সুন্দর করে বলতে, এমন করে আমাকে কেউ কখনো দেখেনি, দেখবেও না আর এ জীবনে। ভীষণ গর্বিত লাগে যখনই এ কথা ভাবি। তোমার কবিতা পড়লে মনে হয়, আমি চলে যাই কোথাও বহু দূরে কোন পাড়ভাঙ্গা নদীর ধারে, নাম না জানা পাখির ডাকে, গাছগাছালির নিস্তব্ধতায়, তোমার ভালোবাসার কালবৈশাখী ঝড়ে, সূর্যাস্তের গেরুয়া রঙে, তোমার হাতের তালুর মাঝে, তোমার নিজের হয়ে। মনে হয় আমার দুঃখী মনের সুখটা কেবল তোমার দুঃখী মনই বোঝে। হ্যাঁ,আমি দুঃখবিলাসী।
অনেকদিনের পোড়ো বাড়ি ভাঙা রাবিশ জমতে জমতে আমার মনে তৈরি হয়েছে একটা অন্ধকার দমবন্ধ পাহাড়।আর আজ দেখেছি সেই পাহাড়ের বুকে তোমার ঝর্ণাধারার উদ্দামতা। তাই তো বেঁচে আছি, প্রতিটি ভোরে নতুন সূর্য দেখব বলে, প্রতিটি মুহূর্তে নতুন করে প্রশ্বাস নেব বলে, পাড়ে উপছে পড়া সমুদ্রের প্রতিটি নতুন ঢেউয়ের উদ্দামতা দেখব বলে, তোমার সাথে পথ হাঁটব বলে, বেঁচে থাকবার জন্য বেঁচে থাকব বলে, অনেক অপেক্ষা করে তোমার কথা শুনতে পাব বলে, অন্ধকার আকাশের তারাভরা নিস্তব্ধতায় এই জীবনের মানে খুঁজব বলে, হঠাৎ নতুন করে বাঁচব বলে । এই পৃথিবীর পথ চলার ভালোবাসাটুকুর মধ্যেই আমাদের সবাইকে বাঁচতে হবে, তাই মনের কোণে জমিয়ে রাখতে চাই এমনই অফুরান ভালোবাসা। কোন বর্ষার দিনে একা জানালায় বসে ঘরের ভেতরের অন্ধকারকে ভুলে গিয়ে, ঘরের বাইরের এক টুকরো আলোকিত বারান্দার দিকে চেয়ে, জুঁই ফুলের গন্ধ ভরা বাতাসে মুখ তুলে, জীবনের আনন্দে মাতোয়ারা হব বলে । তবে আমার মনে হয় ভালো লাগা আর ভালোবাসা, সব কিছুরই একটা ক্লান্তি আছে । কোন কিছুরই বাড়াবাড়ি হলে ,তা মনের পেয়ালা উপছে পড়ে যায়।
সন্ধ্যার সময়, ছাদের পাঁচিলের ধারে দাঁড়িয়ে সূর্যের শেষ আলোয় স্নাত হয়ে, তোমার কথাই ভাবি। তুমি হেঁটে বেড়াচ্ছ, হাত নেড়ে নেড়ে কথা বলছ।অনেক কিছুই বলতে ইচ্ছে করে তোমাকে, কিন্তু ঠিকমত বলে উঠতে পারি না। অবশ্য তোমার মত করে বলা তো যাবে না, তবুও-।
গভীর রাতে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে মাঝে মাঝেই বেশ খুশি হই একথা ভেবে, যে তুমি বল, একমাত্র আমিই তোমার সব অনুভূতি বুঝি। তোমাকে শুধু আমিই জেনেছি সম্পূর্ণ ভাবে। কিন্তু পরমুহূর্তেই প্রথম ভোরের আবছা আলোয় টের পাই,তোমাকে আমি কিছুই জানিনা। আমি যে এত জানি ,সেটাই আমাকে জানিয়ে দিয়ে যায় ,যে আমি আসলে তোমাকে কিছুই জানি না ।তখনই হতাশা জাগে, অজানা ভয় জাগে। তবুও, তুমি যে আমাকে ভালোমতোই জানো, এইটুকুই পাওয়া ।তবু তোমার জন্য পাগল মনটার ভীষণ খারাপ লাগে, তোমার আমার জীবনের টুকরো টুকরো কথা মনে করে, কখনো একা একাই হাসি, কখনো কাঁদি, কখনো নিজেকেই বোঝাই নিজে। কদিন যদি তোমার সঙ্গে দেখা না হয়,তবুও, যখনই একটু অবকাশ পাই, ভাবি তুমি তো আমার আছ,সেই ভরসা আছে।জানো, ঘরে বা কলেজে, গান শুনতে শুনতে বা চান করতে করতে , তোমার কথা এই যে সবসময় ভাবি, আমার মনে হয় এর নামই ভালোবাসা। তোমার গভীর জীবনবোধ, বাঁচতে জানার ও বাঁচাতে জানার অভিপ্রায়, কিংবা বর্ষা নামার অনেক আগে মেঘ করা একটা মনের, সেই চরম আর্দ্র অনুভূতির কথা, এত সুন্দর সাবলীল ভাষায় তুমি লেখ কি করে, ভীষণ জানতে ইচ্ছে করে। তোমার লেখা কখনো ছেড়ো না তুমি। নিজের হৃদয়কে নিঃস্ব করে এক ব্যর্থ, শীতল মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে তিল তিল করে হারিয়ে যাওয়া কবিতার মত কখনোই যেন না হও তুমি নিজে। তোমাকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে, তোমাকে আমার বুকের মধ্যে আগলে রাখতে হবে ,আমার দুই হাতের মধ্যে, আমার সবুজ মনের মধ্যে তোমার না লেখা কবিতাকে আমার সব দিয়ে জাগিয়ে রাখতে হবে।সেই তো আমার জীবনের সার্থকতা।
বরাবরই আমি একটা জিনিসকে খুব ভয় পেয়ে এসেছি। তা হল কোন কিছুকে হারিয়ে ফেলা।তবুও হারিয়ে যাওয়াই আমার জীবনে ঘটেছে বহুবার, বহুভাবে। ছোটবেলায় এক বন্ধুকে খুব ভালবাসতাম, আমি যেন ওর আশাভরসা ছিলাম। ভুল হয়েছিল ওইখানেই, আমি নিজের চেয়েও ওকে বেশি বুঝে ফেলেছিলাম। নিজস্ব আনন্দ-দুঃখ, সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য এসবের কথা কখনোই ভাবি নি।কিন্তু যখন জানলাম আমি ওর সময় কাটানোর সামগ্রী, তখন অনেকটা পথ চলে এসেছি আমি। ফিরতি পথে ঠিকঠাক পা ফেলা হয়ে ওঠেনি আমার,তখন আমি নিজেই হারিয়ে ফেলেছি আমার নিজেকে। জানো, আমার পাশে তখন কেউ ছিলো না। রাগে, দুঃখে, অভিমানে আমার শেষ জীবন বাবা-মার হাতেই তুলে দিয়েছিলাম ,তাদের সিদ্ধান্তই শেষ সিদ্ধান্ত হবে ভেবেছিলাম ।গভীর রাতে আমার মন একটা কথাই বলেছিল, নিজের কাছে নিজেই আপন সবচেয়ে বেশি, মৃত্যু জীবনের সবচেয়ে সত্যি আর তার আগে বেঁচে থাকাটাই তার চেয়েও বেশি সত্যি। তারপর কেটে গেছে কয়েকটা বছর,হঠাৎ তোমার সাথে পরিচয়। তোমার সাথে আলাপের পর,সেদিন গোটা একটা দিন তোমার কথা চিন্তা করেছি। চারপাশের হইচইএর মধ্যে থেকেও আমি হারিয়ে গেছি তোমার মধ্যে। এতো প্রেম, এতো দিন কোথায় লুকিয়ে ছিল বলতো? তুমি এসে এত সহজে আমার সমস্ত ভালোবাসার একই সঙ্গে উৎস ও মোহনা হয়ে দাঁড়ালে ,তাই আমার আর নিজেকে সরিয়ে রাখা, লুকিয়ে রাখার কোন উপায় রইল না।
জেনো তোমার জন্য অনেক ভালোবাসা নিয়ে, শুধু তোমারই জন্য দেহ মনে ,চিরদিন আমি অপেক্ষা করব।শুধু তারাভরা রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে,মনের গোপন থেকে বারবার মনে হয়,কেন তুমি আমাকে এত কাছে টেনে নিয়ে ছিলে? যে ভালোবাসা আমার প্রার্থিত ছিল, কিন্তু যাকে আমি কোনদিনও পাব না বলেই জানতাম, সেই উজাড় করা ভালোবাসা কেন তুমি আমায় দিয়েছিলে? যদি কখনো তোমাকে হারাতে হয়, সেই ভয়ে আমার প্রায়ই রাতে ঘুম আসে না। হঠাৎ মাঝরাতে ঘুমের মধ্যে চমকে ওঠে তোমার সুন্দর সেই মিষ্টি হাসিটা ,বুকের মধ্যে ঝড় তোলে। তোমার সমস্ত অস্তিত্ত্ব রিমঝিমিয়ে বাজে আমার অনুভবে ।আজ সেই প্রথম দিনের কথা বারবারই মনে পড়ছে ।সমস্ত পুরনো কায়দার মধ্যে, কলেজের ভিড়ের মধ্যে, তুমি এসেছিলে এক নির্জলা নতুন পালকের মত নরম মন নিয়ে। সেদিনকার এই যে আমার সমস্ত ভালোলাগাকে ভালোবাসা বলে চিহ্নিত করেছিলে, সে কেবল তুমি। সেই আমার ডায়েরিতে তোমার প্রথম কবিতা লেখা । কতবার পড়েছি,ছুঁয়ে দেখেছি,ধন্য হয়েছি নিজে।ভেবেছি এ কি সত্যি?একটা কবিতা রক্ত-মাংসের শুধু আমার জন্য লেখা!তারপর আমিও লিখতে চেয়েছি,জানিনা তা কবিতা কিনা।শুধু দেখেছি সেই ডায়েরিকে, আমাদের দুজনের কবিতার মেলবন্ধনে ভরে উঠতে।অবাক হয়েছি,সে হয়েছে আমার এক অমূল্য সম্পদ।
আমি নিজের মনকে প্রানপনে চিরকালই বুঝিয়ে এসেছি, তুমি চিরকালই ভালো থাকবে- যেখানেই থাকো না কেন। সে আমার চোখের কাছেই হোক বা মনের ।তোমার কাছে আমার নিজের যে স্নিগ্ধতা লুকিয়ে আছে, গভীর রাতের উত্তুরে হাওয়া বা হিমশৈল ভালোবাসা জমে আছে,তা আর কোথাও নেই। তবু তো আজ আমি একা,এ ক’দিন তোমার আদর ভালোবাসা পেয়েছি,কিন্তু তুমি কি আমাকে বুঝেছ? আমি তো নদীর মত মত্ততার সঙ্গে সবকিছুকে ভাসিয়ে নিয়ে তীব্র বেগে সমুদ্রের বুকে আঘাত করতে চেয়েছিলাম। আমার নীল নির্ঝরের মনের গভীর ভিতরে, সৃষ্টিসুখ দিতে চেয়েছিলাম।অথচ,আমার ভালোবাসার আবেগের মাঝে তোমাকে না পেলে আমি কোথায় যাব,বল? আমি প্রতীক্ষা করতে জানি,তাই তো দিন গুনি ।তোমাকে দেখা ,না দেখায় বেঁচে থাকি।প্রকৃতি যেমন জানে প্রতীক্ষা করতে বর্ষার জন্য।তুমি জান না কিভাবে আমার এই দিনগুলো কেটেছে, কত রকম ভাবনা এসে জড় হয়েছে আমার মনে। কি জানি জীবন আমাকে কোথায় নিয়ে যাবে ?বাবা-মাকে আমি কিভাবে আটকে রাখব?
জানো নির্ঝর,তোমাকে দেখামাত্রই আমি সব দুঃখ ভুলে গেছি, নিজেকে আবার যেন চিনতে পেরেছি ,তোমার মাঝেই বেঁচে রয়েছে আমার ‘আমি’। একদিন তো জীবনের আবেগে ছুটে চলে ছিলাম অন্ধের মত,পৃথিবীতে আমারও যে একটা বিশেষ ভূমিকা আছে, তা জানতাম না। তোমাকে দেখার পরে বুঝলাম । জীবনে থামতে না জানলে, বৃষ্টি বা জ্যোৎস্না দেখা যায় না,দেখা যায় না নিজেকে, শোনা যায় না প্রকৃতির ফিসফিস কথা, পাওয়া যায় না দাম্পত্য আদরের ডানা ঝাপটানো মৌটুসীর গান। আমারও মনের দিকে যে কেউ চেয়ে আছে, সে কথাও জানা যায় না। নিজেকেই বোঝা যায় না। তাই তো জীবনে গতির মধ্যে যতির ভূমিকা অনেকটা। মাঝরাতে হঠাৎ করে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেলে দেখি ,আমি একলা একটা ছোট ঘরে শুয়ে আছি,আর বিগত বসন্তের পাতাঝরা গন্ধ বুকে নিয়ে মাতাল হয়ে গেছি।
তাইতো আজও সূর্যের সাথে দেখা হবার আগেই তোমাকে দেখতে পাই,শিউলীর গন্ধ পাবার আগেই তোমার সুরভী পাই, মিষ্টি নরম সকালবেলায় আজও তোমার পায়ের শব্দ পাই, শিশির ভেজা ভোরে তোমার ঠোঁটের পরশ পাই, আমার হাতের চুড়ির শব্দে তোমার হৃদয় শব্দ করে ওঠে, আমার পায়ের নুপুরে জড়িয়ে তোমাকেই বাঁধি। তোমারই বুকে নিবিড় সুখে, কখন যেন তোমায় জড়িয়ে ধরি এই অবেলায়। প্রথম সূর্য কিরণ গায়ে মেখে আকাশ যেমন আদিগন্ত মনে রোমাঞ্চিত হয়, আমি তেমন ভাবেই তোমার স্পর্শে ঝিরঝিরে বাতাসে, নগ্ন পল্লবীত মুকুলের মত শিহরিত হতে চাই।ঝরে যাবে জেনেও যে পাতা মুখরিত হয়, আমি তেমন ভাবে তোমার জন্য মুখর হতে চাই, আমার প্রতিবিম্বের চোখের তারায় আমি তোমাকে দেখতে চাই, আদ্রিয়াতিক সাগরের উত্তাল তরঙ্গের বুদবুদের মধ্যেও আমি তোমাকে দেখতে চাই, আমার প্রতিটি রক্তবিন্দুতে আমি তোমার উত্তাপ চাই, আমার নিজের করে পাবার জন্যই আমি......আমি তোমাকে চাই।
আমার আশার কথা জেনে আমাকে তোমার বড়ই স্বার্থপর মনে হচ্ছে,না? আমারও নিজেকে মাঝে মাঝে স্বার্থপর বলে মনে হয় ,মনে হয় নিজের সুখের কথাই আমি বারবার চিন্তা করে এসেছি, কি পেয়েছি, কি পাওয়া হল না, তার হিসেব নিকেশ করে চলেছি সারা জীবন,নিজের সিন্দুকের তাকগুলো বুঝি নিজেরই এক চিলতে সুখ দিয়ে ভরাবার জন্য! চিরদিনই হয়ত আমি অন্যকে দুঃখী করেছি, অথচ কোনদিন অন্য কারো দুঃখের খোঁজ পর্যন্ত রাখিনি। হয়ত কেউই কাউকে কিছু দিতে পারে না ,যা পাবার বা না পাবার তা নিজেকেই পেয়ে-না পেয়ে আনন্দিত বা দুঃখিত হতে হয় ।
জানো, আজ এই পড়ন্ত বিকেলে বা নিঃস্ব সন্ধ্যায় ,জানালার পাশে দাঁড়িয়ে, মাতলা হাওয়ার গন্ধে, আমার প্রায়ই বাঁধভাঙা আনন্দ হয় একথা ভেবে, যে আমি তোমার ভালোবাসা পেয়েছি, অনুপ্রেরণা পেয়েছি। প্রেম সম্পর্কে যখন থেকে বুঝতে শিখেছি, তখন থেকেই একজন মানসপ্রেমিক আমার চোখে ধরা দিত ।তাকে দেখতে চাইতাম সম্মানীয় ভাবে, দেখতে চাইতাম ভালোবাসার মূর্ত প্রতীক হিসেবে , দেখতে চাইতাম কর্তব্য জ্ঞান ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন অথচ কোন অসম্পূর্ণ পুরুষ হিসেবে। কারণ আমার মতে প্রত্যেক পুরুষেরই অসম্পূর্ণ হওয়া উচিত, নইলে নারীর মহিমা তাকে ভরাবে কি করে ?আমার সেই মানস প্রেমিকের প্রতিটি প্রকাশই তোমার মধ্যে দেখতে পাই, তাই আমি মুগ্ধ, আনন্দিত, কৃতজ্ঞও বটে ভগবানের কাছে। যদিও তোমার অসম্পূর্ণতা একদিন সম্পূর্ণতা পাবে, তবু , তবুও আজ আমি গর্বিত তোমাকেই স্বপ্নের প্রেমিক হিসেবে পেয়ে। জীবন জোয়ারে সময়ের তীব্র স্রোতে ভাসতে ভাসতে হয়ত কোন দিন, কোন সময়, কোন পরিস্থিতিতে, মোহনার বাঁকে দুজনে দুজনের থেকে দূরে সরে যাব ,তবুও তোমার এই পাগল প্রেমিকা সারা জীবন তোমার প্রতীক্ষায় থাকবে, আকাশের ধ্রুবতারা হয়ে।
যেদিন আমি থাকব না তোমার পাশে, যেদিন দাঁড়িয়ে থাকবে তুমি একলা দিনান্তবেলায়,দমকা জোলো হাওয়া উঠবে যেদিন হঠাৎ আর চুপিসারে কথা বলে যাবে অচেনা পাখি,সেদিন তুমি আমার কথা ভেব। আমি তোমার বুকের মাঝে সুখের চিহ্ন হয়ে, সেদিনও তোমার পাশে থাকব। যেদিন তোমার অভিমান হবে নিজের ওপর, অভিমান হবে আমার ওপর, যেদিন নিজেই নিজের মনকে কষ্ট দেবে, সেদিন একটি বার মনে কোরো, তোমার সুখেই চিরদিন আমি সুখী, দুখী আমি তোমারই দুঃখে। তুমি সেদিনও কি চাইবে আমায় কষ্ট দিতে? তুমি সেদিনও কি জানতে পারবে না, দূর্বা ঘাসের মতো নরম তোমার সবুজমাখা অবুঝ মনটা যে আমিই?
বন্যাহারা
তুমি কি ভেবেছ, তোমার বিরহে, তোমার জন্য আমি খাওয়া-দাওয়া সব ছেড়ে দিয়ে, দেবদাসের মতো এক মুখ দাড়ি নিয়ে মুখ খিস্তি আওড়াব ফুটপাতের চায়ের দোকানে? নাকি গাঁজার কল্কে হাতে করে খুঁজে বেড়াবো খুলে যাওয়া পায়জামার দড়ি? কি ভেবেছ তুমি? তোমার জন্য আমি যে কলঘরে অকারণ বীর্যপাত বা বেশ্যাপাড়া বা মদের দোকানে ঢুকে, সারা জীবনটা কাটিয়ে দেব, এমনটি ভেবো না ।তোমার জন্য আমি পাগল হতে পারব না, কিছুতেই তোমার বাড়ির সামনে হাঁ করে বসেও থাকব না কখন তোমার পশ্চাদ্দেশের একটুখানি দেখা যায়, অবশ্য লাথিও কষিয়ে দেব না (মনে মনে), বলব না যাঃ শালা। আর তখনই হয়ত তোমারই দোতলার বারান্দা থেকে আমার দিকে ছুঁড়ে দেওয়া হবে ফুটন্ত গরম জল আর আমাকে বেদনাক্লিষ্ট ভাবে ধীর পায়ে চলে যেতে হবে। কিন্তু আমি যে আমি তোমার জন্য হত্যে দিয়ে বসে থাকাকে ঘেন্না করি ।চলে তুমি যেতেই পার, যখন যেখানে খুশি। তোমার জন্য আমি কখনই লিখে ফেলব না প্রেম শোকে পাগল নামে এক হাজারটা সেকেলে কবিতা কিংবা রক্ত দিয়ে লেখা একটা ফিরে এসো গোছের চিঠি। ধর্মতলার মোড়ে তোমার কথা ভেবে হড়কে পড়ব না সদাব্যস্ত প্রাইভেট বাসের সামনে। আর বিকেল বেলা সেজেগুজে, যখন তুমি নতুন অ্যাকুরিয়ামের জন্য জীবন্ত মাছ কিনতে বেরোবে, তখন আমার বুক থেকে মোটেও বেরিয়ে আসবে না সারা জীবনের দীর্ঘশ্বাস। ফেলব না আমি এক ফোঁটাও চোখের জল, আর স্নান করে, বারান্দায় দাঁড়িয়ে তুমি যখন মেলে দেবে তোমার চুল, তখন আমি ফিরেও দেখব না তোমাকে আর। তোমাকে আমার মনেই থাকবে না, নানা কাজে তোমার কথা ভুলেই যাব একদিন, দেখো ঠিক। ভুলে তোমাকে যেতেই হবে, যেতেই পারি ,যখন যেখানে খুশি।শুধু আর একবার এমনই অবুঝ প্রেমিক হয়ে আমি জন্ম নেব, তখন তোমার বুকের কাছে আমাকে রেখ, কারণ আমি তো ভালোবাসতেই চেয়েছিলাম অথচ অকারণ ফিরে আসা বেদনার ফুল হয়ে, এ তো জানাই ছিল।সেই অবাক বিকেলে হঠাৎ কেঁপে ওঠা, সে কি তুমিই? তবে কেন চলে গেলে বৃষ্টির বাসরে ?কোনোদিন সে কথা জানা হল না কেন?
মনে পড়ছে, অনেকদিন আগে আরব্য রজনীর গল্প পড়েছিলুম। এক হাজার একটা গল্প ছিল ওতে। সবকটা অবশ্য পড়া হয়ে ওঠেনি ।আমার আর বন্যার প্রেমের এক হাজার একতম দিনে সে আমাকে জানিয়ে দিল তার বিয়ে অন্যত্র ঠিক করেছেন তার বাবা। আমি তো যাকে বলে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। “আর মনে হয় তোমার সঙ্গে দেখা হবে না, তুমিও আর এসো না ।“ বন্যা গড়গড় করে বলে দিল । আমার অনেক প্রশ্নের সেদিন সে উত্তর দেয়নি, শুধু কবিতাগুলো ফিরিয়ে দেবার সময় ,তার চোখের কোনে একফোঁটা জল দেখেছিলুম। “আমি চলে যাচ্ছি “, বলে সে আমাকে ছেড়ে ধীরে ধীরে চলে গেল।যে বাসটা প্রথম এল তাতেই উঠে পড়ে ,দৃষ্টির বাইরে দ্রুত চলে গেল সে। আর তাকে দেখিনি , তার ফোনও বন্ধ ছিল সেদিনের পর থেকে। অনেক ভাবে যোগাযোগের চেষ্টা করেছি, কিন্তু সে সাড়া দেয়নি । আজও তাই জানা হল না , বন্যার চলে যাওয়ার প্রকৃত কারণ। সে কি আমার উপর আর ভরসা রাখতে পারল না? এই বিয়েতে তবে কি তারও সম্মতি রয়েছে ?সে কি আমার সঙ্গে এতদিন ভালোবাসার খেলা খেলে, আজ খেলার পাট চুকালো? সে কি সহজ সুবিধাবাদী ও বাস্তববাদী ?তাই তথাকথিত সু-পাত্রের গলায় মালা দিতে চলল?না কি সে কোন চাপের কাছে নতিস্বীকার করল?কিছুই বুঝতে পারলুম না। মনে হল আমার বুকে যেন এক মন পাথর চাপানো হয়েছে। কিছুতেই ওর শেষ কথাগুলো বিশ্বাস করতে পারছিলুম না । কিন্তু বিশ্বাস তো করতেই হবে ,বিশেষতঃ যখন আমি স্বপ্ন দেখছিলুম না ।কিন্তু এই দুর্দিনে দোষ দেব কাকে ?পড়াশোনার পাট চুকিয়ে ফেলি গ্র্যাজুয়েশনের পরেই ।তারপর নানা চেষ্টা,নানা শর্ট কোর্স করছি ,যাতে নাকি চাকরি আছে। অনেক পরীক্ষাও দিয়েছি। লাভ হয়নি কিছুই। আমার বেকারত্ব যেন আমার শিক্ষাগত যোগ্যতার থেকে মুখ ফিরিয়ে ছিল। তাই তো,আমার ভবিষ্যতের কোন স্থিরতা ছিল না।তাই বিয়ে করার মত অবস্থা ও অধিকার কোনটাই ছিল না। বন্যাকে কি দোষ দেওয়া যায়? ওরও বাড়িতে চাপাচাপি হচ্ছে ,আমার জন্য কতদিনই বা অপেক্ষা করে বসে থাকবে ! মনে হয়েছিল ও বোধহয় ঠিকই করেছে, ওর নিজের ভাবনা তো ওকে এখন থেকেই ভাবতে হবে ।বন্যা সুন্দরী, এ বাজারে সুন্দরীদের জন্য সুপাত্র অপেক্ষা করে থাকে। জীবনের সুখের পাশবালিশ আঁকড়ে ধরতে কোন মেয়েই বা না চায়! সুযোগ ছাড়াটা হবে সে ক্ষেত্রে বোকামি, বন্যার পক্ষে তো বটেই, তার বাড়ির লোকের পক্ষেও। কাকে দোষ দেব ঠিক করতে না পেরে সেদিন আমি বোকা বনে গেছিলুম। সেদিনের মত আঘাত আমি বোধহয় আর কোনদিনও পাইনি। তিলে তিলে মনের মধ্যে, যে বাগান তৈরী করেছিলুম ,যত্নে মনের মধ্যে লালন করেছিলুম, সে সব স্বপ্ন আর আশার প্রাসাদ এক মুহূর্তে ধুলিসাৎ হয়ে গেছিল।
সেই রাতটা ঘুম প্রায় হয়ইনি। শুয়ে শুয়ে ভাবছিলুম, এই অসমাপ্ত প্রেমের শেষে আমি কি করব? আমার জীবনটা তো নষ্ট হয়ে গেল। ভাবছিলুম ওর বিয়েতে হয়তো খুব আনন্দ হবে,আর কোনোদিন হয়ত দেখব স্বামীর হাত ধরে হাসিমুখে ও শ্বশুরবাড়ি চলে যাচ্ছে। খুব তাড়াতাড়ি আমার চোখের সামনে দিয়ে ওদের সুখের জুড়ি গাড়ি ঢ্যাংঢ্যাং করে চলে যাবে। আমি কিচ্ছু করতে পারব না ।একবার মনে হল ,আমার এর প্রতিবাদ করা উচিত ,পাত্রকে সব জানিয়ে বিয়েতে বিরত করা উচিত। কিন্তু শেষে ভাবলাম, সেই কাজগুলো করতে হলে, নিজেরও একটা স্থায়ী ব্যবস্থা থাকা চাই, চাই গলার জোর ,একটা ভদ্র রোজগার। কিন্তু বাস্তব ঘটনা হল, এ বাজারে মধ্যবিত্ত বেকারদের প্রেমের ফাঁদে পা দিলে পরিণাম একটাই- আশাভঙ্গ ।কবিতা লিখে প্রেম হয় ঠিকই,কিন্তু প্রেমাস্পদকে চিরকালের করে নেওয়া যায় না।কি যে করব?এসব ভাবতে ভাবতেই ভোরের দিকে ঘুমিয়ে পড়েছিলুম।
আধোঘুমের মধ্যে সারারাত কেঁদে কেঁদে বলেছিলুম ‘বন্যা, 'চলে যাচ্ছি' বললেই হল নাকি? আরো কত দিন পড়ে আছে,আমি যে তোমার মুখ চেয়ে আছি,তোমাকে এত ভালবাসি, তার কি উত্তর দেবে ?'চলে যাচ্ছি' বললেই বা কে তোমাকে যেতে দিচ্ছে ?কেনই বা চলে যেতে চাইছ, থাকো না আরো কটা দিন আমার প্রিয়তমা হয়ে।যেমন থেকে যাচ্ছে শ’য়ে শ’য়ে ছোট্ট ছোট্ট লড়াকু পিঁপড়ে,বেঁচে থাকার জন্য হাজার হাজার মাইল উড়ে যাচ্ছে পরিযায়ী পাখিদের ঝাঁক বা জঙ্গলের পর জঙ্গল কেটে শেষ হয়ে গেলেও হাতিদের দলে আপ্রাণ থেকে যাচ্ছে তাদের বাচ্চাটা। সেইরকমই থেকে যাও না,আরও কটা দিন।নইলে যে বড় একা হয়ে যাব আমি।নইলে যে এই পৃথিবীতে কোন ভালবাসাই আর টিঁকে থাকবে না একদিন।
প্লিজ ,এত তাড়াতাড়ি হাল ছেড়ে দিও না। না হয় আমার থাকলই কিছু দোষের,কিছু ভুলের,কিছু না পাওয়ার।আরও কত কিছু তো করার আছে,কত কিছু দেখার আছে,কত কিছু জানার আছে,বলার আছে। স্পেনের আলতামিরার গুহায় চুম্বন বা একসাথে বাইকে লন্ডন যাবার প্ল্যান না হয় ছেড়েই দিলাম ।এই যে এখন আকাশে বর্ষার মেঘ করেছে ,টুপটাপ বৃষ্টি হচ্ছে,আর বাইরে নিম গাছটার সবুজ সবুজ পাতার গা দিয়ে জলের ফোঁটাগুলো যেন একের পর এক মুক্তোর মত গড়িয়ে পড়ছে ,এসব কি প্রকৃতির অপার ভালবাসা নয় ? এসব তো এখনও আছে,তবে কেন তুমি নেই? শীতের শুরুতে আকাশটা যখন ঝকঝকে নীল হয়ে যায় আর মিঠে রোদে মনটা ভাল হয়ে যায়, যখন রাস্তার ধারে একটা সদ্যোজাত ছাগল ছানা অকারণে তিড়িংবিড়িং করে লাফায় বা চরম অবজ্ঞায় নর্দমার কোণেও যখন সবুজ চারাগাছটা মেলে দেয় তার দৃপ্ত দুটো পাতা , তখন মনে হয় একসঙ্গে ভালবাসার মানুষটার হাত ধরে থাকা কি সুন্দর।এই সুন্দর জীবন কি আমাদের দুজনের জন্য নয় ?এসব কি আমাকে একা একাই দেখে যেতে হবে ?তুমি কি সত্যিই চলে যাবে? কতদিন , আর কতদিন এভাবে 'চলে যাচ্ছি ' বলে চলে যাবে প্রিয়তমারা ?মুখে রক্ত তুলে সুখ কিনেছি আমি,কিছুতেই যেতে দেব না তোমাকে।
এভাবে চলে যেতে পার না বন্যা। তোমারই জন্য যে এই খরার দেশে ,আজও কষ্টেসৃষ্টে সন্ধ্যেবেলায় জুঁইফুল ফোটে, গন্ধ ছড়ায়।তুমি দেখবে না হাতে তুলে নিয়ে? সেই গন্ধ বুকে টেনে নেবে না ? তোমাকে যে প্রাণের থেকেও বেশি ভালবাসি আমি,এ কথা কি বলে দিতে হবে?তুমি কি বুঝতে পার না? মানুষে মানুষে এত হানাহানি, তবুও পৃথিবীর কোন দূর যুদ্ধপ্রান্তে বা কোন গরীব ঘরে অভুক্ত মা তার মুখের গ্রাস এখনও তুলে দেয় সন্তানের মুখে, এখনও মানুষ প্রিয়জনকে বুকে জড়িয়ে ধরে ভালোবাসে, সারা জীবন পাশে থাকার না বলা কথা এখনও চোখের একফোঁটা জল হয়ে অজান্তে নামে,এসব কি তুমি জানবে না,বুঝবে না? তোমার জন্য এই যে এত কবিতা,এত আবেগ,এত সব না বলা অবুঝ কথা,সে কি কিছু নয়? কিসের এত রাগ,দুঃখ, অভিমান ?কিসের হার মেনে নেওয়া?
এই যে বইয়ের মধ্যে থাকা শুকনো গোলাপ, কবেকার জমানো ট্রামের টিকিট, রাশিরাশি নিউজপ্রিন্টে শুধু তোমারই কথা , একলা দুপুরে স্বপ্নে সেই সব মন কেমন করা রাস্তা, ঠাকুমার পুরোনো টিনের বাক্স খুলে বেরিয়ে আসা ময়লা হয়ে যাওয়া ঠাকুরদার শেষ চিঠি, একা একা ছাদে উঠে, পূর্ণিমা রাতে সেই যে প্রথম কবিতা মনে আসা, আলমারি খুলে বাসি বেনারসির মধ্যে টাটকা চেনা গন্ধ, ঘেমো ভীড় বাসের হয়রানিতে হঠাৎ কানে এসে পড়া মান্না দের সেই গান বা হঠাৎ খুঁজে পেয়ে পড়ে ফেলা রবিঠাকুরের ‘ছিন্নপত্র’, এগুলো কি কিছুই নয় বন্যা? এসব তবে কার জন্য ?নাইবা হল সব পাওয়া,এইসব ছোট ছোট জিনিসগুলো,এইসব অসমাপ্ত কবিতা, তোমার আমার এই ভালবাসার জীবন,এসব ছেড়ে চলে যেও না।প্লিজ,যেও না।
বন্যা সেসব কথা শুনতে পায়নি, ভীষন বাস্তববাদী ছিল যে।এখন মনে হয়,হয়ত বা সুবিধাবাদীও ছিল। তাই বোধহয় আমাকে একঘেয়ে লাগত, হয়ত নিজেকেও।কখনও কখনও আমার এও মনে হয়,সত্যিই হয়ত বন্যার কিছু করার ছিল না। তবু আমি তাকে আজও ভালোবাসি ।আমার অনেক ভালবাসা চিরদিনের জন্য শুধুমাত্র তারই হয়ে গেছে । দূরে সরে গেলেও,আমি আজও তাকে ভুলতে পারিনা, কিন্তু ইচ্ছে করেই আর তার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে চাইনা, দূরত্বেরও একটা আলাদা অনুভুতি আছে । সামনে পেয়ে যা পারিনি, দূরে থাকায় তার মূল্যটা অনেক বেড়ে গেছে আমার কাছে। আমার তো বন্যার জন্য আজও বড় মন কেমন করে ,তাহলে ওর কাছে আমি কি করে একঘেয়ে, অপ্রয়োজনীয়,জোলো, বাসি হয়ে গেলাম? আমি ইচ্ছে করেই, নীরবতা দিয়ে বন্যার প্রতি আমার আবেগ আটকে রেখেছি। আমার অনুভূতিগুলো চিরকালের জন্য ,তার প্রতি স্থির হয়ে আছে। আজ সে অনেক দূরে ,দেখাও হয়না, হয়ত বা হবেও না কোনদিন ।তবু সেই দুঃখটাকেই ভুলে থাকার চেষ্টা করে চলেছি রোজ।
একে অপরকে আমরা শুধু কবিতাই দিয়েছি, উত্তর প্রত্যুত্তরে আমাদের কবিতার ডায়েরি আর ছড়ানো ছেটানো কাগজগুলো ভরে উঠেছিল ।জীবনের নানা উপলব্ধি পথ খুঁজে পেত সেখানে ,আমরা জীবনকে খুঁজে পেয়েছিলাম ।অথচ হঠাৎই বন্যা আমার থেকে চিরকালের মত দূরে সরে গেল,কারনটুকু পর্যন্ত বলে গেল না । কিন্তু এর জন্য কে দায়ী? আমি নিজে, সমাজের শাসন,নাকি সুবিধাবাদী মনোভাব?আজকাল একটা অপরাধবোধও কাজ করে আমার মনে।আমিও কি কখনও ওকে কষ্ট দিয়েছি,অজান্তে ? ওর চোখে সেদিন জল দেখেছিলাম। এর কারণ যদি আমি হই, তবে তার কোন ক্ষমা নেই । আমি নিজেকে হাজার কষ্ট দিলেও,বন্যার কোন কষ্ট আমার সইবে না।বন্যা যদি পারে তো আমাকে ভুলে যাক, কিন্তু নিজে কষ্ট যেন না পায় । কঠিন ,খুব কঠিন , তবু আমি সামলে নেব নিজেকে।শুধু, ওকে জোর করে অপেক্ষা করতে বলতে পারিনি । কারণ ওর জীবন আমি নষ্ট করতে পারবনা। এত সব অপেক্ষার শেষে কি আছে, কে জানে ? সুতরাং সে যে সম্ভাব্য বড় আঘাতকে ডেকে আনতে চায়নি আর এক অসম্ভব সুদিনের আশায়,এ বরং ভালই হয়েছে ।অনিশ্চয়তা যে কোন দিক থেকেই আসতে পারত।কোন ভরসা ছিল না স্বপ্ন দেখার বা দেখানোর। সত্যি কথাটা স্বপ্নকে যে কোন সময় ভেঙে দিতে পারত,আর সেই সত্যিটা শেষমেষ বন্যাই একদিন বলে দিল। আমার আজও মনে আছে, সে বলত, “ধরে রাখি খারাপটার কথা, এরপর ভাল হলে তো ভালই। “ শেষকালে সেটাই সত্যি হল,খারাপটা।
কয়েক বছর আগে যখন সবে ওঠা সূর্যের আলোর মত, প্রেমের একটা অনুভূতি মনের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল, তখন মনে হত যে জীবনের চার আনাই বুঝি প্রেম। তারপর বাস্তবে প্রেমের মুখোমুখি হলুম আমি ,তাকে আপন করে নেবার পর মন বলল, জীবনের অর্ধেকটাই প্রেম। সেই প্রেমে যখন আমার দেহ মন সব ডুবে গেল, জীবন সম্পর্কে নিশ্চিন্ত হলুম আমি আর জীবনকে ভালবাসতে শিখলুম, পৃথিবীকে ভালোবাসতে শিখলুম ।যখন গাছ থেকে একটা পাতা মাটিতে পড়লে মনে হত সুন্দর ,রোদে গা পুড়ে যাচ্ছে, বা বৃষ্টিতে ভিজছি,সঙ্গে ছাতা নেই, তখন মনে হত প্যাচপ্যাচে জল কাদা পেরিয়ে পার্কের বেঞ্চে, তার পাশে বসে থাকাটা কি সুন্দর । হঠাৎ তার চোখে চোখ রেখে মনে হত গোটা পৃথিবীটাই সুন্দর। সে সময় হঠাৎ একদিন মনে হয়েছিল জীবনের বারোআনাই প্রেম । আর আজ সেই প্রথম প্রেম ভেঙে যাবার পর ,অপরাহ্ণের গেরুয়া আলো চোখে মুখে ধরে রেখে একা আমি বসে আছি। আজ আমার কাছে জীবন যেন অর্থহীন, বোঝা বইবার ক্লান্তিতে আমার দিন শুরু হয়। রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বুঝি আমার মুখটা কি বিষন্ন আর করুন হয়ে উঠেছে ।সেই প্রেমহীন জীবনের কাঁটা বুকে ঢুকে যাওয়া সত্ত্বেও মনে হয়, জীবনের পুরোটাই প্রেম। প্রেমে খুশি আছে, বেদনা আছে- জীবনটাই আসলে প্রেম। প্রেম আছে, প্রেম থাকবে। সাময়িকভাবে তার আনন্দ-বেদনা নাড়া দেয়, কিন্তু আমরা কুড়িয়ে নিতে ভুলে যাই সেই সব ছোট ছোট অনুভূতিকেও ,যাদের আমরা পথের পাশে ফেলে রেখে চলে এসেছি।
কেন কে জানে,বন্যার মত একজন বাস্তববাদীর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল। অলি গলির অন্ধকার দিয়ে তার সঙ্গে অনেক পথ হারিয়ে, ঘোরার পর একদিন বড় রাস্তায় এসে পৌঁছলুম। তখনই দেখলুম তার সঙ্গে আমার দূরত্ব অনেক বেড়ে গেছে। কারণ একটাই, সে ছিল বাস্তববাদী ।যারা সেই মতে চলে, তাদের কাছে ছন্নছাড়া হওয়ার কোনো অর্থ নেই ,আবেগ তাড়িত হওয়া মানে পাগলামি আর কবিতা লেখা হল সময় নষ্ট। তাদের আমি চাইও না ।ঠিক এই লোক গুলো পৃথিবীটাকে একেবারে নিরস করে ফেলতে পারে। একটা ফুল হাতে পেলে যারা হয়তো তার সুগন্ধ ও সৌন্দর্য উপভোগ না করে, তার ব্যবচ্ছেদ করে দেখবে কোনটা পুংকেশরচক্র আর কোনটা গর্ভদন্ড। তারা আর যাই হোক, মানুষকে মানসিক প্রফুল্লতা এনে দিতে পারবে না, তাই তাদের থেকে দূরে সরে থাকতে চাই আমি। এও জানি, বাস্তব কঠোর। এখানে আবেগ আর মূল্যবোধের দিন ক্রমেই শেষ হয়ে আসছে। বাস্তবে যা চলে যায় ,কখনোই তা আর ফিরে আসে না ।তবু আমি স্বপ্ন দেখি। মনের সব কথা বলার পর ,অনেক আশা জাগিয়ে তোলার পর, হঠাৎ সে স্বপ্ন ভেঙে গেলে কি ভীষণ দুঃখ হয়; সেই দুঃখ আমি পেয়েছি। তাই বাস্তবে, আমি স্বপ্ন দেখি ঘৃণার,যৌনতার। বাস্তবে আমি স্বপ্ন দেখি ঠোঁটে ঠোঁট লাগিয়ে চুমু খেয়ে কোন মেয়েকে চুল ধরে টেনে মাটিতে ফেলে দেবার। নিশ্চয়ই সেই স্বপ্ন দেখার জন্য শখ করে কেউ বসে থাকে না। আমিও না। আমার ইচ্ছে হয় এইসব স্বপ্ন আর না-স্বপ্নকে ভেঙেচুরে, পিষে দিয়ে চলে যেতে, ভুলে যেতে এসবকে।
আমার একান্ত আপনার জনের বিষয়ে আমার আদৌ কোনো ভরসা নেই। আমি জানি সেই একজনকে আমি কোনদিনও পাবনা । যে একদিন আমার হবে ,সে হয়ত কোনদিনই আমার কবিতা বুঝবে না ,দিন আনি- দিন খাই ভালোবাসার রাতে লাল নাইটল্যাম্পের তলায় শুয়ে নীরবে কেঁদে যাবে আমার কবিতা ।সেই একজন হতে পারত বন্যা,অথচ তার খরস্রোতা নদীতে , পাতার নৌকা হয়েই আমি ডুবে গেলুম ।আমি তো চেয়েছিলুম বাড়ির পাশেই,আমার নিজের জন্য একটা কোপাই নদী,কিংবা একটা বেলুড়মঠ।নদীর ঝিরিঝিরি ভেসে যাওয়া দিয়ে মঠের নিস্তব্ধতা সাজাতাম ,ইচ্ছেমত।অথচ,সে তার কোন দাম দিল না।
আমার আর বন্যার কোনদিনই সবুজ হওয়া হয়ে উঠল না। তবু বলছি, দূর থেকেই বলছি ,কবিতার অনুরণন যে আমাকে পাগল করে তোলে, তা হয়ত বা সেই একদিন প্রকৃত বুঝতে পারবে , যেদিন হয়তো আমিই থাকব না। তখন কোন দুপুরবেলা হঠাৎ নীল আকাশে হারিয়ে যাওয়া ছোট্ট চিলটার দিকে তাকিয়ে, তার আমার কথা মনে পড়ে যাবে, আর তখনই ঠিক, তাকে কাঁদিয়ে যাবে আমার না লেখা কবিতা। যদিও কবি পরিচয়ে আমি বিন্দুমাত্র গর্বিত বোধ করি না,কারণ আমি আদৌ কোনদিনও কবি হতে চাই না। তবুও জানি,আমার না লেখা কবিতা সেই লিখবে-একদিন।
আমার কাছে ভালবাসার একটা শুরু আছে ঠিকই,কিন্তু কোন শেষ নেই।আমি জানি, আমি যেমনটি চাই তেমন ভালোবাসা এবং তেমন কাউকে আমি হয়ত আর পাব না ।কোথা থেকে যে কি হয়ে গেল, সত্যিকারের ভালোবাসা আমি হারালুম। আমি আবেগপ্রবণ ,যতটা ভালোবাসা কেউ দিতে পারে, তার চেয়েও বেশি চাই ।আবার ভয় হয়, আমার সমস্ত আবেগ আর ভালোবাসা আমি যার হাতেই দিতে যাব, হয়ত তার ছোট্ট হাতে তা ধরবে না। উপছে গড়িয়ে পড়ে যাবে, রাস্তায় গড়াগড়ি খাবে, সেই হৃদয়ের অমূল্য ধন। এজন্যই কাউকে আর হৃদয় দিতে সাহস হয় না।
শুধু আজও বসন্তকাল এলেই আমার বুক ধড়পড় করে।মন আনচান শুরু হয়।আসলে আমি সহজেই প্রেমে পড়ে যাই,পাগল মন তো ।এক ঝলক কোন সালোয়ার-কামিজ পরা মেয়ে আমাকে দেখলেই, বুক কেমন করে। মনে হয় ও বোধহয় আমাকে কিছু বলতে চায় ।কোন মেয়ের হঠাৎ মুখোমুখি হয়ে যাওয়া, বাসে পাশের সিটে কোন অচেনা মেয়ে বা পুকুরে চান করতে করতে সরকার বাবুর বাড়ির ছাদে একটা ছায়া- সবাই মনে হয় আমাকে কিছু বলতে চায়। আমার মনটা খুব নরম আর প্রেমিক প্রকৃতির। আমি কবিতাও লিখি। সব ফালতু কবিতা ,সব নিজের জন্য , নিজের করে সব মেয়েকে পাবার জন্য বানিয়ে বানিয়ে লেখা। লিখে ফেলে শান্তি, কিছু তো বলা হলো ।বাস্তবে বলতে গেলে তো জিভ শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাবে। কোন মেয়েকে জীবনে সব কথা গুছিয়ে বলতে পারব বলে তো মনে হয় না,ফোনে কথা বললেও কথা গুছিয়ে উঠতে পারিনা। একবার চেষ্টা করেছিলুম,পারিনি। শুধু হৃদয়ে ভীষণ অবুঝ প্রেম জেগে ওঠে, হজম হয়না, জেলুসিল আর কত খাব?প্রেমের চোটে ঘুম হয় না ,খিদে কমে যাচ্ছে। আর কতকাল খুঁজবো তোমায়? আসলে নীল রঙটাই যত নষ্টের গোড়া। আজকাল আর নীল রঙয়ের জামাটা পরিনা। আমাদের পাড়ার হারামি মনোজ ডাক্তারের গাড়িটাও নীল রঙয়ের। আমাকে কাঁদিয়ে চলে গেল বন্যা, ওর নীল ওড়নাটা চোখে ভাসে। নীল চোখের সুন্দরী ঐশ্বর্য রাই আমার দিকে কখনো তাকায় না ,কক্ষনো না।তাই নীল রঙটা ভাল না। নীল বলে একটা ছেলে -ভীষণ বোকা,ভীষণ ক্যাবলা।সবাই ওকে ঠকায়। ধুর ছাই।
তখন বৃষ্টি হত, আর ছাতার তলায় আমরা দুজনে চলে আসতুম হাতিবাগান থেকে শ্যামবাজার। বৃষ্টিতে ভিজছে দুজনেরই কাঁধ, বৃষ্টির জলের মরিয়া ফোঁটা এসে লাগছে চোখে মুখে। আমারও ছাতা ছিল, তবু ব্যাগ থেকে বার করিনি। এক ছাতার নীচে দুজনের হেঁটে আসার রোমাঞ্চ কি ছাড়া যায়? ইচ্ছে হত বৃষ্টির সব ফোঁটা যেন আমার গায়ে লাগে, ভিজতে দেবনা আমি আমার প্রিয়তমাকে, কিন্তু সেই বৃষ্টি আটকানো পাহাড় হয়ে ওঠা হল না আমার।
এখনও বৃষ্টি আসে। কিন্তু এই বৃষ্টির জল বাসি, পচা। ফিরে যাক এই বৃষ্টি। আমি চাই ,নতুন কোন বৃষ্টির রাস্তায় অশরীরী হব আমি , আর সবুজ বৃষ্টির জল গড়িয়ে পড়বে আমার চোখ মুখ গাল বেয়ে।অবেলার বৃষ্টি মেখে ইচ্ছে হয় গোটা ময়দান ঘুরে ভিক্টোরিয়ার পরীকে শোনাই,”তবু মনে রেখ,যদি দূরে যাই চলে--“।
তাহলেও না, তাহলেও আবার সেই দিনগুলোয় ফিরে যাওয়া যাবে না। আর আমার আমি হওয়া হয়ে উঠবে না, কিছুতেই না । ঠোঁটে লিপস্টিক ঘষলেও না, বুকে প্যাড লাগালেও না ,হাত নিশপিশ করলেও না। আমার ভবিষ্যৎ অন্ধকার, ভেবে আমারই ঘেন্না হয়। টাকা রোজগার করব কাঁড়ি কাঁড়ি , লোকের পকেট মেরে । দিনে তিনবার বিছানায় খুনসুটি করব। চায়ের কাপ ডিস ভাঙব দিনে দুবার। রাতে লাল নাইট ল্যাম্প জ্বেলে, সাদা নরম তুলোর মত বিছানায় শুয়ে পড়ব আর পাখা ঘোরাব ফুল স্পিডে। ভোরে উঠে আয়নায় নিজের মুখ দেখতেও লজ্জা পাব, পায়জামার দড়ি খুঁজে পাব না কিছুতেই, নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত থাকব সারাদিন। তিনবারের জায়গায় তেরোবার বাথরুমে যাব, আলু ভাজার প্যাকেট খুলে খেয়ে বেড়াব সারাদিন, ছড়াবও খুব- এই আমার স্বপ্ন ।শুধু এইটুকু, শুধু এইটুকুর জন্য নিজেকে বিসর্জন দিয়েছি , নিজের চেতনাকে প্রতিদিন মেরে ফেলছি। এ কার পেছনে ছুটছি আমি?
কোনকিছুই ঠিকঠাক করে উঠতে পারছি না। শৈশব থেকে আজকের যৌবনে, ঠিকানা বদলেছে অনেকবার, জীবনের বোধ আর অর্থও বদলেছে। কিন্তু সাজাতে পারিনি কিছুই, এমনকি নিজেকেও।আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছি শুধু বাঁচার মত বাঁচতে, কিন্তু পারিনি। স্রোতের টানে ভেসে গেছি, বিপরীতে চলতে পারিনি। শুধু ছায়ায় লুকিয়ে থেকেছি, রোদের তেজে দৃপ্ত হতে পারিনি। সাহসী ,প্রতিবাদী হতে পারিনি। সকলের মধ্যে, ভিড়ের মধ্যে মিশে গেছি, আলাদা হতে পারিনি। ছাপোষা, মধ্যবিত্ত, মধ্যমেধার একটা জীবন টেনে নিয়ে চলেছি। যতদিন বাঁচব ,এর থেকে আর মুক্তি নেই।
তবু মুক্তি তো পেতেই চেয়েছিলুম। সেই ছোটবেলায় বাবার সঙ্গে মামাবাড়ির ছাদে ঘুঁড়ি ওড়াতে ওড়াতে ।একদিন অনেক বেড়ে দিয়েছি, লাটাই প্রায় শেষ । ঘুঁড়িটা ছোট্ট হয়ে দেখা যাচ্ছে আকাশে । কি যে ভাল লেগেছিল সেদিন। আমারই ঘুঁড়ি দূর আকাশের বুকে উড়ে বেড়াচ্ছে, শাসন করছে, রোদে চকচক করছে আকাশের বুক চিরে ।হাতে ধরা সুতো ,ঘুঁড়িটা যেন আমিই। কিন্তু সেই রাজত্ব বেশিক্ষন টিঁকল না, স্বপ্ন চুরমার হয়ে জমিতে লুটিয়ে পড়ল সেই সুতো।লাট খেতে খেতে উড়ে ,দৃষ্টির বাইরে চলে গেল আমার সাধের ঘুঁড়ি ,বুক ফাটিয়ে ভেসে গেল আকাশে।হাতে থেকে গেল খালি লাটাই, আর বুকে সব হারানোর যন্ত্রণা।
একটু বড় হয়ে ছবি আঁকা শুরু করলুম। খাতার পাতায় পাতায় সৃষ্টি হত নতুন নতুন ছবি আর নানা রং গুলে, রঙিন বর্ণমালায় সেজে উঠত আমার প্যালেট । যদিও রঙের বন্যায় ভাসিয়ে দিতে চাইতুম ছবিগুলোকে ,কিন্তু পারতুম না ।মনের পর্দায় যে রঙের সমারোহ, আমার ছোট্ট খাতার পাতায়, কিছুতেই তা এ জীবনে ফুটিয়ে তুলতে পারলুম না। এ আমার ব্যর্থতা ।রঙ গড়িয়ে গড়িয়ে, জলে ধুয়ে ধুয়ে, কেবলই বুকে বয়ে যেত । তাকে তুলে আনতে পারতুম না বাস্তব জগতে।আসলে বাস্তব তো রঙহীন এক শূন্যতা। সেও এক পরাজয়।
শেষমেষ সব ছেড়ে লিখতে বসলুম। মনের মধ্যে ততদিনে জমে উঠেছে অনেক কথা, অনেক আবেগ, অভিমান আর ভালবাসা। সেসব উথলে উঠেছে, তাকে আর আটকে রাখা যাচ্ছে না। তাই ডায়েরির পাতায় পাতায় সেসব লিখে ফেলতে লাগলুম , কিছু উড়িয়েও দিলুম । উড়তে উড়তে নীল প্রজাপতি হয়ে অনেক দূরে হারিয়ে গেল সেইসব কবিতা।কখনো কখনো তাকে আর খুঁজে পেতুম না।ভাবতুম, উড়ে গেছে ,বেশ হয়েছে, কতই তো হারিয়ে যায় ।অবশ্য কিছু কিছু থেকেও যাবে আর তার জন্যই প্রাণপণে ,জীবনের সমস্ত আশা-আকাঙ্ক্ষা, ভালোবাসা, সদিচ্ছা আর শ্রেষ্ঠ শুভেচ্ছা নিয়ে লিখে চলেছি আমি, আর এইসব প্রাণময়, জীবনময়, আপন নিঃশেষিত, হৃদয়- নিঃসারিত প্রকাশ করে গেলেই আমার কাজ শেষ হবে ।
আসলে বুকের রক্ত ছাড়া আমার আর কিছুই নেই।নিজের বলে আসলে কিছুই নয়। নিজের শিরায় শিরায় যা বয়ে চলে যায়,তাই আসলে নিজের ।তাই ক্ষইয়ে ক্ষইয়ে নিজেকে শেষ করে দিতে হয়,তবে শান্তি। জীবনটা বড্ড ছোট আর পালিয়ে বেড়ানো। তাকেই ধরে বেঁধে এনে, প্রাণের কথা বলতে হয়। যাবার আগে সব বলে যেতে হবে ।এই রক্ত-মাংস তা জানে, এ কথা মিথ্যে নয়। এ আমার আসল কথা, ভেতরের কথা।আজও রাত ঘন হয়ে এলে গাঢ় অন্ধকারে নিজেই নিজের কাছে ভীষণ রকম অস্পষ্ট হয়ে যাই। দূরে, যতদূরে চোখ যায়, তাকাই । দেখি কালোর উন্মাদ আস্ফালন,বড় ভয় হয়।শিরশিরে ঠান্ডা ছড়িয়ে পড়ে হৃদয়ে।সবকিছু আরও মায়াবী হয়ে ওঠে,সব যেন আমারই অংশ ছিল।বড় একা লাগে,জাপটে ধরে শূন্যতা।অবাক হয়ে ভাবি,এত নিজের করে নিজেকে ভালবাসা যায়! অন্ধকার মেখে বসে থাকি, নিজের থেকে পালাব বলেই । জীবনে কত মায়া আছে,কত বাঁধন! তাই প্রতিমুহূর্তে উষ্ণতায় রাঙা হয়ে উঠতে চায় হৃদয়।জীবনে কথ আনন্দ আছে,সেসব আমি পেয়েছি। পেয়েছি অবিশ্যম্ভাবী দুঃখও।
মামাবাড়ির দুর্গাপুজোর কথা মনে পড়ে,সেই মা দুর্গার মুখ,সেই ঠাকুরবাড়ির ঝাড়ের আলোয়, চীকের অভ্রর চিকিমিকি,সেই সানাইয়ের সুর । পাড়ার দুর্গাপুজোর কথাও মনে পড়ে,বন্ধুদের সঙ্গে ঠাকুর দেখতে যাওয়া,সেই আড্ডার আমেজ ।পুজো এলেই বুকের মধ্যে ধুকপুকানিটা কেমন যেন বেড়ে যেত। পুজোটা কিভাবে কাটাব, কি কি আনন্দ করব ,কত প্ল্যান,কোন মজা যেন বাদ না পড়ে। পুজোর চার দিন বেশ তাড়াতাড়ি কেটে যেত। ঘণ্টায় ঘণ্টায় ,বেলায় বেলায়, শেষে এক একটা দিন চলে যেত ।সপ্তমীর দিন মনে হতো এইতো পুজো শুরু ,আবার পুজোর শেষ দিকে আনন্দের সঙ্গে সঙ্গে একটা মন খারাপও মিশে থাকত। পরম বিস্ময়ে দেখতুম আর পুজোকে ঠেকিয়ে রাখতে পারছি না, হাতের মুঠো আলগা হয়ে যাচ্ছে, পুজো শেষ হয়ে যাচ্ছে, শেষ হয়ে এল বলে ,শেষই হয়ে গেল। চোখ ফেটে জল এসে যেত। তবু মনখারাপটাকে প্রশ্রয় দিতুম না। কিন্তু যখন দেখতুম আমাদের ন্যাড়া প্যান্ডেল, খালি বেদী,প্যান্ডেল থেকে ডেকোরেটরের লোকরা কাপড় খুলতে শুরু করেছে, ইলেকট্রিসিয়ানরা লাইট খুলে নিচ্ছে ;এসব সহ্য করতে পারতুম না।দুঃখ, কষ্টর সেই বোধহয় প্রথম অনুভূতি- পুজো শেষ। কিন্তু শৈশবে সেই যে ষষ্ঠীর ভোরে মামাবাড়ির তক্তাপোষে শুয়ে হঠাৎ ঢাকের বাজনা শুনে ঘুম ভেঙে যাওয়া আর প্রচন্ডতম বাস্তবকে মনে পড়ে যাওয়া - আজ থেকে পুজো,সেই আনন্দটুকু আজও মনে আছে ।আমার আর সেই পুজো নেই, জীবনের যুদ্ধে কোন ছুটি নেই, বন্ধুদের সঙ্গে তেমন যোগাযোগ নেই, গোলাপি চুড়িদারের সেই মাতন আর নেই, সেই দিন চলে গেছে। ।শুধু পুজো এসে গেছে ,সেই আনন্দটুকু আজও একই রকম আছে ,দুর্গাপুজো রয়ে গেছে। নিজের ইচ্ছে অনিচ্ছের ওপরে, এখন এই নবআনন্দের পুজো। সবাইকে আনন্দে রাখার একটা বৃথা চেষ্টা ।
শুধু আনন্দ হলেই আজও কথা জমে ওঠে, জমে জমে আগুনের ফুলকি হয়ে খাতার বাইরে ছিটকে বেরোয় ,আকাশের তারা হয়ে যায়। সেই তারা সাজিয়ে সাজিয়ে আমার মনের আকাশ। সে যে বিশাল ,তার কোন শেষ নেই। আমার ছোট্ট বুকে তার জায়গা হয় না, তাই আমাকে সে ভাসিয়ে নিয়ে যায় । ভাসতে ভাসতে কোন তীরে গিয়ে উঠব, আমি জানি না।তবু আগুন আর জল নিয়েই আমার কারবার ।নিজেকে নিভিয়ে গড়ি। পরিশ্রুত হই ।
সব কথা একদিন শেষ হবে। তবুও আমার আকাশ থাকবে ,তার শেষ নেই। আমার তারা থাকবে ।হয়ত দেখা যাবে না, কিন্তু থাকবে। একটু মন কেমন থাকবে, কেউ বুঝবে, কেউ বুঝবে না ।কেউ হাতের তেলোয় নিয়ে নাড়াচাড়া করবে ।বড্ড চঞ্চল আঁজলা ভরা সে জলটুকু হয়ত তার হাতের ফাঁক গলে ,গড়িয়ে পড়ে যাবে। আমি হয়ত কিছুই করে উঠতে পারব না,ব্যর্থতায় ঢাকা পড়ে পড়ে একদিন শেষ হয়ে যাব, তবু তারার আকাশে ঝিকিমিকি থামবে না ,জানি সেই সব তারা একদিন বৃষ্টি হয়ে নামবেই।
দেখি নীল আকাশে, একলা একটা চিল পাক খেয়ে খেয়ে উড়ছে সারা দুপুর। ওর বাসা নেই,বিশ্রাম নেই।কাছে এসে পড়া মেঘ গুলো ওর ডানায় লেগে সরে সরে যাচ্ছে ও বড় একলা, ঠিক যেন আমি। যখন সবুজ গাছে ঘেরা জঙ্গলে গিয়ে দাঁড়াই ,মনে হয় আমার অতীত পাশে আছে। এই যে বিকেলের মিঠে হাওয়া, ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সূর্য ডোবার নেশা, তখন এক ছায়াময় অতিথি আসে আমার সবুজ মনে।আমি ছাড়া কেউ বোঝে না মনছোঁয়ার মানে।
বিকেলে জানলা দিয়ে গেরুয়া আলো এসে পড়ে খাটের কোনের দিকে। কেউ কি কোনদিন ওখানে এসে বসবে? আঙ্গুলে আঙ্গুল ছুঁয়ে তাকাবে আমার চোখের দিকে? সে শুধু তাকানো নয়,জীবনের মানে। কেন যে ভাল লাগে?কেন যে ভোলা যায় না?মাথার ভিতর তিল তিল করে গুমরে মরে ভাল ভাবে বেঁচে থাকা, ভালবেসে বেঁচে থাকার ইচ্ছেগুলো।এই সামান্য বেঁচে থাকার বাড়ির জানলা থেকে ,মনের বাড়ি অনেক দূর,দেখা যায় না। এই রাস্তা দিয়ে সেখানে যাওয়াও যায় না। বড় বড় বাড়িগুলো পেরিয়ে, মোড়ের মাথায় পৌঁছলেই সব ট্রামলাইন এসে কাটাকুটি করে দেয়।
বর্ষাধারা
বর্ষা,পুরোনো জামা কাপড় খাট বালিশ ঘরদোর এমনকি বিস্কুটের কৌটা পর্যন্ত ধুয়ে নিয়েছি তোমার দারুন স্রোতে। আমার কলমও তোমাতেই সিক্ত, তোমাকেই লিখে ফেলা হুটহাট কবিতা, ছুঁড়ে দেওয়া চলন্ত বাস থেকে বিশাল একটি ভাসমান চুমু শুধু তোমাকেই। এই আকাশ যখন কালো করেছে আর আমার জানলা দিয়ে আমি যখন দেখছি, নতুন জলধারায় ধুয়ে যাচ্ছে বাড়িঘর ,গাছপালা, ডিস এন্টেনা আর আমার ইউক্যালিপটাসও, তখন তোমারই কথা বারবার মনে পড়ছে। বারবার তোমাকেই চিঠি লিখছে এই মন, শুধু তুমি বর্ষা বলে। তুমি বর্ষা বলেই ফিরে ফিরে আস, ছুঁয়ে দাও সজীব আঙ্গুলের স্পর্শে, লিখে দাও আমার নাম ,তা সে যতই সেকেলে হোক না কেন। তুমি বর্ষা বলেই, পার্কে বৃষ্টির জল দাঁড়িয়ে গেলেও, এমনকি লোডশেডিংয়ে গোটা এলাকা অন্ধকারে ডুবে গেলেও, বৃষ্টি মাথায় ছাতা ছাড়া তুমি ঠিকই হাজির হও সন্ধ্যে ছটায়, শুধু আমারই কাছে। তুমি বর্ষা বলেই আমি দিস্তে দিস্তে পাতা ভরাই মহানন্দে, আর তুমি বর্ষা বলেই এই চিঠি ডাকটিকিট বা ই-মেইলের তোয়াক্কা করেনা। চিঠি লেখা চিরকালই কঠিন বর্ষা, তোমাকে মুখে কিছু বলার চেয়ে। মুখোমুখি হলে তো তোমার চোখের দিকে তাকিয়েই ভুলে যাই স্নান, কাল, এমনকি অফিসে ম্যানেজারের হুমকি পর্যন্ত। তোমার পায়ের চলার তালে হাঁটতে হাঁটতে বেওয়ারিশ হয়ে যায় মন আর পথচলতি মানুষজন যখন হাঁ করে তাকিয়ে থাকে আমাদের দিকে, তখন বেমক্কা ফালতু কথা ছাড়া আর কিছুই বলার থাকে না আমার। কিন্তু লেখার সময় মনে মনে ভীষণ সাজিয়ে গুছিয়ে উঠতে হয়, অগোছালো হাত পা-র ছুটে বেড়ানো শান্ত করতে হয়, ঠান্ডা করতে হয় মনটাকে। আয় আয় করে ডেকে, আদর করে বসিয়ে, তারপর তার কাছে জানতে চাই , বল লেখার মুড আছে তো? এরপরও লিখতে গিয়ে ভীষণ ঘেমে যাই। ভেবে কূলকিনারা পাই না যে, তোমার মত ভাষাডুবুরি কিভাবে নেবে এই চিঠি ,বিশেষত আমার যখন ভাষাই নেই তেমন। চিরকালই অগোছালো এই ভাষাহীন কবির লেখা কতই না ক্ষমা ঘেন্না করে পড়ে, মনে মনে হেসে ওঠ তুমি, ভেবে লজ্জা পাই। তবুও লিখতে তো তোমায় হবেই। মনে মনে ভীষণ ভাল লাগে, যখন তুমি বল যে আমারই চিঠির অপেক্ষায় তোমার দিন কাটে। তখনই বুঝি আর যা হোক তোমাকে লেখা যাবে না দায়সারা গোছের চিঠি।তবু, লিখব বললেই তো হল না। আমার বাঁ দিকের বুক পকেট ভীষণ গোলমাল পাকাতে থাকে, কারণ সে কিছুতেই এই নীল কালির কালো পেনটাকে আমার হাতে দিতে চায় না। লেখালেখিতে তার ভীষণ অরুচি, বিশেষত তার দাবী হল ,এই যখন নতুন কবিতা লেখা শেষ করে উঠলে, তখন আবার লেখালেখির মধ্যে যাবার দরকারটা কি? তার চেয়ে বরং পড় বুদ্ধদেবের নতুন উপন্যাস বা সুনীলের কবিতা, নয়তো টিভিতে শিবমহিমা। তাতেও না হলে, সোজা মোড়ের মাথায় গিয়ে নিতাইদার দোকান থেকে খেয়ে এস সর- পাউরুটি ।পকেট থেকে ফর্সা ফর্সা মেয়েরা কষ্টে-সৃষ্টে বেরিয়ে এসে দরমার দরজার আড়াল থেকে মুখ বাড়িয়ে হাঁ করে আমাকে দেখে যায় ,তাদের হাত থেকে নিস্তার পেতে, তখন আমি পকেট থেকে ধীরে ধীরে বের করি তোমার ছবি। তখনি সব ঝামেলা মিটে যায়,বুক পকেট থেকে হাতে তুলে নিই কালো পেনটাকে, অবশ্য তার আগে কথা দিতে হয়, বেধড়ক খাপছাড়া কিছু লিখতে পারব না তোমাকে। কিন্তু তখনই শেষ হয়ে যায় তোমাকে চিঠি লেখা। বিশেষত এই যে আমি যে তোমাকে অক্লেশে খুঁজে বের করি, বরানগরের বাসের ভিড়, ডেনিসের এক্সট্রাকটিভ মেটালার্জি বা সাইবেরিয়ার তুষারঝড়েও, যে তোমার ছবি টাঙিয়ে দেয় কবিতা বুড়োর ছবির পাশে, তার পক্ষে শুধু একখানা চিঠি লেখা যে তোমাকে কোন নীল বা সবুজ কালির তোয়াক্কা করেনা,এই কথাটা সকলকে বোঝাতে গিয়ে ,আমার খৈনির ডিব্বা খালি হয়ে যায়। তাই বছরগুলো পেরিয়ে গেলেও, বর্ষা তুমি তেমনই নতুন, তেমনই স্নাত ভোরের বৃষ্টিতে, তোমার কাছে তেমনই আমার আটকে পড়া। চারপাশে দ্রুত বেড়ে উঠলেও আগাছার প্রস্তরীভূত কঙ্কাল, এমনকি কবিতা লেখা কোনদিন শেষ হলেও, আমাদের সুতোর টান একই থাকে। ঝড়ে, রোদে, ভুলে ভরেও, দূরে থেকেও ছেঁড়ে না, কিছুতেই ছেঁড়ে না।
আমি ভগবান মানি না। আমি বিশ্বাস করি মানুষের অন্তর্নিহিত দেবত্বকে, আমি তাকেই পুজো করি। সেই পুজো একদিন প্রেম হয়ে গেল। সেই প্রেমের সূত্রপাত কিন্তু অদ্ভুত ভাবে। বাসে পাশাপাশি বসেছিলুম আমরা, কেউ কাউকে চিনতুম না। কিন্তু হঠাৎ ওয়েলিংটনের কাছে অবরোধ- জ্যামে পড়ল বাস আর ড্রাইভার বাস ঘুরিয়ে অন্য রাস্তা দিয়ে নিয়ে চলল।এদিকে আমি যাব কলেজস্ট্রীট। হঠাৎ বাসের রুট পরিবর্তনে দুজনেই বিপাকে পড়লাম এবং সেই বিপাকেই আমাদের প্রথম পরিচয়, প্রথম কথা বলা। একই স্টপে আমাদের দুজনকেই নামতে হল, তারপর পথ চলা পাশাপাশি। মেয়েটা স্মার্ট এবং সুন্দরী।জুলফি থেকে চুল নেমে ঘাড় অব্দি চলে এসেছে,নিখুঁত ধারালো ভ্রু, চোখদুটো টানা,স্বপ্নমাখা।কথা বলার ফাঁকে সে সবই মাঝেমাঝে দেখছিলাম বলে একটা রোমাঞ্চ লাগছিল,হার্টবিটও দ্রুততর হচ্ছিল। মনে হল সে যেন অনেক চেনা।এক সময় তার বাড়ির গলি এসে গেল ,তারপর দুজনে ছাড়াছাড়ি। মনকে সান্ত্বনা দিলুম ,আবার দেখা হবে। কিছু দুরে গিয়ে মনে হল এই যাঃ, নামটাই তো জিজ্ঞেস করা হল না !বড় ভুল করে ফেলেছি ।
এরপর একদিন তাকেই দেখলুম ফড়েপুকুরে কেকের দোকান থেকে বের হতে।দেখেই চিনে ফেলেছিলুম ,কিন্তু কথা বলব কিনা অথবা বললে কি কথা বলব, এসব ভাবতে ভাবতেই সে ট্রামে উঠে চলে গেল ।আর দেখিনি,দু মাস কেটে গেছে, বেকার কয়েকবার সেই ছেড়ে যাওয়া গলির কাছে গিয়ে এদিকে ওদিকে ঘুরেছি,দাঁড়িয়ে থেকেছি।মনে হয়েছে, ইস্,যদি বাড়িটা চিনে রাখতাম বা নামটা জেনে রাখতাম!তখনই হঠাৎ বইমেলায় আবার তার সঙ্গে দেখা। আমার বুকে যেন তখন দামামা বাজছে,গিয়ে কথা বললুম ।সেই বাসের কথা বলতেই সে চিনতে পারল,কিন্তু বেশি কথা হল না। আমার সঙ্গে আমার বন্ধুরা ছিল,তার সঙ্গে তার। স্বভাবতই দূরত্ব রইল ,কিন্তু চিনেছিল সে ঠিক ।আর নামটাও জানা হয়ে গেল সেদিন,'বর্ষা'।সেও কি আমাকে মনে রেখেছে? সেও কি আমার কথা মাঝে মাঝে ভাবে ?শুরু হল আবার অবুঝ রোমাঞ্চ। সেই রাতে ঘুম কম ,স্বপ্ন বেশী। খাতায় নাম নিয়ে আঁকিবুঁকি।
আজ হঠাৎই ,বন্যার সঙ্গে বিচ্ছেদের একবছর একমাস পরে, আবার একটা পাগলামি চেপে বসেছে,আর আমিও তাতে গা ভাসিয়ে দিয়েছি। বর্ষাকে দেখার পর থেকেই, কথা বলব বলে আমি অনেকদিন ধরে অপেক্ষা করে ছিলুম।বইমেলার পর সেদিন যখন কলেজের ফেস্টে ও বলেছিল , যে ওর অনেক কথা বলার আছে, তখন বর্ষা সরাসরি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে ছিল। আর তাই হয়ত বুঝেছিল যে আমিও কি ভীষণ রকম উদগ্রীব হয়ে আছি আমার মনের কথাগুলোও তাকে বলার জন্য। কালবৈশাখী ঝড়ের সময় মনটা ঝড়ের তোড়ে যেমন ভেসে যেতে চায়, বর্ষাকে দেখার পর ,তার সঙ্গে আবার দেখা করতে, কথা বলতে, তার কথা শুনতে আর তার ফাঁকে একসাথে অনেকটা পথ চলতেও আমার তেমনই ইচ্ছা হয়েছিল ।আসলে আমি হয়ত সেই না বলা কথার স্রোতে ভেসে যেতে চাইছিলুম, যা এনে দেবে আমার খুব কাছের একজনকে । এদিকে বর্ষা হয়ত তখন ভাবছে যে, আমি বোধহয় ওকে ভীষণ ভালোবাসি আর এই কথাটা বলার জন্যই হাপিত্যেশ করে বসে আছি। কিন্তু ভুল, ভীষণ রকম ভুল। আমি একথা বলতে বর্ষাকে ডাকিনি। কারণ আমি তাকে এ কথা বলতেই পারি না, কারণ আমি আদৌ বর্ষাকে ভালোবাসি না।
ভালোবাসা তো অনেক গভীর জিনিস। সে হলো মনের লুকোনো সম্পদ, আর সবচেয়ে বড় সম্পদ। তাকে এমনই হুটহাট হস্তান্তরিত করা যায় নাকি?ভালোবাসা নিয়ে খেলা করা আর যা হোক আমার পোষাবে না ,বিশেষ করে প্রথম আঘাতটা পাবার পরে।যে জিনিস যত গভীর, তাকে তত গভীরে গিয়ে উপলব্ধি করতে হয় ।তাকে কোন দু-একদিনের চোখে দেখা বা দু-পাঁচটা কথা বলা দিয়ে পুরো চেনা সম্ভব নয়। আসলে আমি তো বর্ষাকে ভালোবাসতেই চাই। আমি তো বর্ষার সঙ্গে মিশতে, ওকে পাশে পেতে, কাছে পেতেই চাই। আর বর্ষা? সে কি চায় তা কি আমার জানা হবে না ?
এর মাস দুই পরে আমি হঠাৎই একটা ভালো কোম্পানিতে ম্যানেজারের চাকরি পেয়ে গেলুম। যোগ্যতা তো ছিলই ,এতদিন ধরে শিকে ছিঁড়ছিল না কেবল। অবশেষে একটা হিল্লে হল আমার,ফলে আগের দুঃখের স্মৃতিগুলো মন থেকে মুছে ফেলতে চাইছিলুম । পুরোনো পালক ঝেড়ে ফেলে নতুন পালক গজানোর মত। সেই রাতেও ছটফট ,হাত নিশপিশ ,ঘুম কম। শেষ রাতে একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখলুম ।বন্যার সঙ্গে যে পার্কে যে বেঞ্চিতে প্রায়ই বসতাম, দেখি সেখানেই বসে আছি, একা। চারদিকে ধোঁয়াশা, অন্ধকার ভবিষ্যতের মত। হঠাৎ দেখি একদল বাচ্চা ছেলে মেয়ে খেলতে খেলতে সেখানে হাজির।তাদের প্রত্যেকের হাতে রয়েছে পুতুল। তাদের সেই নিষ্পাপ মুখগুলো দেখে মনে কি একটা শান্তির হালকা হাওয়া বয়ে গেল। ধীরে ধীরে বুঝতে পারলুম তাদের পুতুলগুলো আসলে ঠিক পুতুলের মত নয় ,তারাও প্রাণ ফিরে পেয়েছে ।আমার বেদনাক্লিষ্ট মন নিমেষে নেচে উঠল তাদের এই জেগে ওঠা দেখে।সেই নেশায় আমিও যেন শিশু হয়ে গেলুম। পুতুলদের কথা বোঝে তো কেবল শিশুরাই ,আর তাই এই শিশুদের জন্যই সব পুতুল একসঙ্গে জেগে উঠল।তাদের সঙ্গে খেলতে খেলতে আমি পৌঁছে গেলুম পুতুলদের রাজবাড়ির কাছে। সেখানে দেখলুম রাজবাড়ির বারান্দা আলো করে দাঁড়িয়ে আছে একটা ছোট্ট পুতুল ,সেই নাকি পুতুলদের রাজকন্যা ।কিন্তু সে কেন অন্য পুতুলদের মত প্রাণ ফিরে পায় নি? আমি জিজ্ঞেস করলুম, "তুমি কথা বলছ না কেন, রাজকন্যা ?"এই বলে যেই না তাকে আমি ছুঁলাম, অমনি সে পিটপিট করে তার চোখের পাতা মেলল। আমি তো মুগ্ধ চোখে চেয়ে আছি , আর তাই দেখে আনন্দে সে মেললো তার ডানা । তারপর পরীর মত উড়ে উড়ে আবার আমার সামনে এসে জিজ্ঞেস করল ,"তুমি কে? তুমি তো পুতুল নও!" আমি বললাম "না ,আমি শিশু। আমার ভেতরে সবটাই খাঁটি ।"শুনে সে খুশি হল। তার কাঁধ থেকে ডানা দুটো খসে পড়ল আর পুতুলজন্মের অবসান হল তার। তার হাত ধরে হেঁটে, আমরা ঢুকে গেলুম রাজবাড়ীর ভেতর অলিতে গলিতে । সেখানে আমি দেখলাম,এ কি, এ তো রাজবাড়ী নয় ! এ যে মানুষের বুকের ভেতরটা ।ওঃ, কী দুঃসহ! মানুষের বুকের ভেতরে এমন সব বিশ্রী জিনিস বাসা বেঁধে আছে!ভেতরের আগুনের জ্বালায় ফুটছে সবকিছু। কোথাও নিকষ কালো অন্ধকার ,সেখানে মানুষের কুমতলবগুলো পড়ে আছে ।মানুষের ধান্দাবাজি,কাপুরুষতা,নীচতা, ভন্ডামি সব রাজত্ব করছে এক একটা ঘরে।ঘৃণা আর জিঘাংসার সাম্রাজ্য পেরিয়ে দেখলুম, একটা ঘরে মনুষ্যত্বকে চাবুক মারা হচ্ছে ,সে নাকি অন্যায় আর অমানবিকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছিল।দেখলাম উদারতা, সততা আর ন্যায়বিচারকে বন্দী করে রেখে অত্যচার করা হচ্ছে।এসব দেখতে দেখতে আমি কেঁপে কেঁপে উঠছিলুম , আমি যে শিশু। এসব নোংরামি ,আঘাত-অপমান-অত্যাচারের রক্তাক্ত পরিণতি কি করে সহ্য করব? আমি বললুম, "রাজকন্যা ,এসব আমি দেখতে চাই না। আমাকে অন্য কোথাও নিয়ে চল।"সে তখন নিয়ে এল আমাকে একটা ছোট্ট ঘরে। সেখানে একটা প্রদীপ টিমটিম করে জ্বলছে, কিন্তু সেই ছোট্ট আলোতেই সারা বাড়িটা আলোকিত হয়ে উঠেছে।মনে হল এটাই পৃথিবীর সব থেকে সুন্দর ঘর ।আমি জিজ্ঞেস করলাম "এ কার ঘর, রাজকন্যা?" সে বলল ,"এই হলো মানুষের ভালোবাসার ঘর। মানুষের বুকের এক কোণে এক চিলতে ভালোবাসা আজও রয়ে গেছে । সেই ভালোবাসার ঘরই মিলন হল আমাদের। সেই রাজকন্যা ঢুকে গেল আমার হৃদয়ে, আর ভরিয়ে তুলল আমার সমস্ত সত্ত্বাকে ।ভালোবাসার আকর হলাম আমি।আর তখনই স্বপ্নটা ভেঙে গেল।
জানিনা,এই ভালোবাসা বুকে নিয়ে আমি এগিয়ে চলতে পারব কিনা।জানিনা ,ভালবেসে যেতে পারব কিনা এই পৃথিবীকে। ভালোবাসা তো কেড়ে নেওয়া হল আমার জীবন থেকে, যেদিন প্রিয়তমা চলে গেল আমার থেকে বহুদূরে, আর সেই সঙ্গে সে নিয়ে গেল আমার এত দিন ধরে তিলে তিলে গড়ে তোলা সেই আকরের অনেকটাই ।তাহলে আমি কি আবার নতুন করে শুরু করতে পারব?কেমন করে পারব? পৃথিবীতে নাকি কোন কিছুই অপরিহার্য নয় । মনে হয়েছিল নতুন করে শুরু করার ব্যাপারটা মোটেও কঠিন হবে না, কিন্তু বাস্তবে পারিনি । আমার মনে পড়ল, স্বপ্নের সেই ঘরটার কথা যেখানে মনুষ্যত্বকে চাবুক মারা হচ্ছিল আর চাবুক খাবার পর মনুষ্যত্বের কি হল?সে কি হয়ে গেল পাষানের মত প্রেমহীন ?আঘাত আর ভয় কি তাকে সরিয়ে দিল প্রেমের পথ থেকে?নাকি তার সেই প্রেম আর ভালোবাসার মন্ত্র এখনো কাজ করে চলেছে অন্তরের অন্তঃস্থলে ?যে রাতে এক চিলতে চাঁদের আলো এসে আলোয় আলো করে দেয় সমস্ত ছাদটা, সরিয়ে দেয় সবটুকু কালিমা, সেই রাতে কি মানুষের সুপ্ত প্রেমিকচেতনা ফিরে আসে না? যেদিন ঘুম থেকে উঠে, সকালের মিঠে আলোয়, একঝাঁক সাদা বককে নীল আকাশে উড়ে যেতে দেখি, সেই মুহূর্তে নিশ্চয়ই মনে স্থান পায় না কোন ইতরামি ,ভন্ডামি বা হীনমন্যতা । সেই মুহূর্তে আমি হয়ে যাই সত্যিকারের প্রেমিক । আর তখনই হতাশ দিনগুলো থেকে আমার উত্তরণ হতে থাকে আলোর দিকে,আনন্দময় দিনগুলোর দিকে।সারাজীবন ধরে যা লিখেছি, তা শুধু নীল পালকের কবিতা । কোনদিন সেই পালকের সোঁয়া ছাড়িয়ে , মাঝখানের কাঠিটা নিয়ে খেলা করিনি। কোন মেয়ের গালে সেই কাঠি বুলিয়ে দিয়ে বলিনি যে আমি তার সঙ্গে থাকতে চাই।আজ বলতে ইচ্ছা করছে। আসলে সব প্রেমই যে প্রথম প্রেম।
আজ ছোটবেলার কথা বড় মনে পড়ে ।মায়ের সঙ্গে স্কুল থেকে ফেরার কথা ,সেই সরকারপাড়ার ঢালু রাস্তা, সেইসব পুকুর ,পুকুরে বাবার সঙ্গে সাঁতার শেখাও মনে পড়ে। পুরোনো পাড়া, রাস্তাঘাট, বাড়িঘর মনে পড়ে ।মামাবাড়ির কথা মনে পড়ে, মামা বাড়িটা তো আজ আর নেই, শুধু মনে পড়ে মামা দিদার বড় ঘরটায় খাটে শুয়ে শুয়ে আধো অন্ধকারে জেগে ঘুমিয়ে স্পষ্ট দেখতে পেতুম ,পাতলা কাচের পদ্মফুল ল্যাম্পশেডের থেকে বিচ্ছুরিত নীল ছায়ালোক কত স্বপ্ন সৃষ্টি করছে। মাঝে মাঝে রাস্তা দিয়ে লরি যাবার শব্দে স্বপ্ন ভেঙে যেত। কত বড় বাড়ি ,বড় ছাদ,উঠোন,কত ঘর, কত শরিক। বড় রহস্যে ঘেরা ছিল দিনগুলো ,বড় প্রাণময় ছিল ।কত অবসরে, ছড়িয়ে ছিটিয়ে,ছোটবেলাটা কত আনন্দে কেটেছে।
নানা ছোট ছোট ঘটনা মনে পড়ে। একবার মল্লিকা মাসির হাত ধরে স্কুল থেকে ফেরার সময়, কেন জানি না খুব বায়না করেছিলুম, বুড়ির মাথার পাকা চুল কিনে দিতে হবে বলে ।মল্লিকা মাসির কাছে তো আর বেশি পয়সা থাকত না, সেই বা কি করবে! বাধ্য হয়ে বেচারা আঁচলের খুঁট থেকে গুনে গুনে জমানো কয়েনগুলো বের করে সেই বুড়ির মাথার পাকা চুল আমাকে কিনে দিল। আমিও লাফাতে লাফাতে মাসির হাত ধরে বাড়ি ফিরে এলুম। সেই মাসি ছিল বড় বিশ্বাসের ,বড় আপনার। আর একবার ,তখন আমি একটু বড়, দেখেছিলুম সরলাবুড়ির কয়লার ঝুড়ি বইতে খুব কষ্ট হচ্ছে ,ভারে একেবারে বেঁকে গেছে শরীরটা।আমার দেখে খুব কষ্ট হয়েছিল। এগিয়ে গিয়ে সেই ঝুড়ি নিজে বয়ে দিয়েছিলুম। বুড়ি খুশি হয়ে বলেছিল “বাবা, তুমি রাজা হও।“ খুব বেশি হয়ত উপকার করে যেতে পারিনি, সেই কয়লা বিক্রি হয়ে তার সেদিন ভাত জুটবে কিনা, তারও খোঁজ নিইনি ,তবুও ওই যে তার এক গাল ফোকলা হাসি আর আশীর্বাদ পেয়ে, ভালোবাসাটা বুঝতে পেরেছিলুম।
সেইরকমই, আমার কাছে জীবনের বেশ কিছু অনুভূতির দাম এত বেশি যে তারা আমাকে আবেগ-বিহ্বল করে তোলে মাঝে মাঝে। সবখানেই একটা সুতোর টান থেকে যায়। যতই দূরে থাকি না কেন, ভীষণ চেনা হয়ে চিরকালের জন্য গেঁথে থাকে সেই অনুভূতিগুলো , সেই স্মৃতিগুলো ।সেই ভালোবাসার টান আমাকে শান্তিতে থাকতে দেয় না। পাগল করে দেয়, তাড়িয়ে বেড়ায়,আর আমার জৈবিক দিন গুজরানের ফাঁকে ফাঁকে ভালবাসার দাম দিতে গিয়ে নিজেকেই পাছে হারিয়ে ফেলি, এই ভয়ে আমি নিজেই মাঝে মাঝে কেটে দিই সেই আবেগ নির্ভর স্মৃতির সুতোগুলো। মুক্তি পেয়ে আমি একটু হাঁফ ছেড়ে বাঁচি ।একটু অন্যরকম আমি হয়ে আমি আসলে বাঁচিয়ে রাখি আমাকেই। প্রতিবার তাই নিজেকে আবার নতুন করে খুঁজে পাই , নতুন করে নিজেকে ভালোবাসতে পারি,নতুন করে লিখতে পারি কবিতা। বর্ষার জলের মত জীবনে আসুক প্রেম, বদ্ধ জলাশয়ের মত নয় । জীবনে ভালবাসার গুরুত্ব প্রচন্ড বেশি উপলব্ধি করি বলেই বোধহয় আমি এই কথা বলতে পারি,এমনকি এই দূষিত জীবনে অভ্যস্ত হয়ে গেলেও।
বর্ষাকে
তার চোখের পাতায় হাঁটতে হাঁটতে, তার চোখের ভিতর তাকাই। বিশাল বড় গভীর তার চোখ আর সেখানে খেলা করে অশ্রুর সমুদ্র ।সেই সমুদ্রে আমি ভাসিয়ে দিই আমার ভেলা ,আর তার চোখের কোন বেয়ে ,গাল বেয়ে,তার ঠোঁটের দু'পাশ দিয়ে পড়তে থাকি।সে যখন তার কান্নাভেজা গলায় অস্ফুটে বলে, "সত্যি সত্যিই তুমি চলে যাবে ? "তখন তার ফুলে ফুলে ওঠা ঠোঁটে বসে আমি রাগে কাঁপতে থাকি ।কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছুই করতে হয় না আমাকে, কারন সে তার নরম আঙ্গুল দিয়ে দৃঢ়ভাবে মুছে ফেলে তার অশ্রু ,আর আমাকে তুলে নেয় তার আঙুলে ।তখন তার হাত বেয়ে, কাঁধ বেয়ে আমি চলে আসি তার বুকের কাছে। চোদ্দো বছর বয়সের স্মৃতি হঠাৎই সেখানে তোলপাড় তুলে দেয়-আর অনেক অনেক কথার ছুটোছুটি ,তাকে বারবার কেন পাগল করে দেয় ,আমি সব বুঝতে পারি ।তার হাল্কা দীর্ঘশ্বাস যখনই পড়ে ,উত্তেজনায় কাঁটা দেয় আমার গায়ে ।তার চঞ্চল মনের সিঁড়ি দিয়ে আমি নামতে থাকি , আর যত বন্ধ ঘরের তালা খুলে, শেষ পর্যন্ত আমি হঠাৎ পেয়ে যাই সেই জীবন প্রদীপ।স্নান সেরে যখন সে হেঁটে আসে -তার লম্বা চুলের গা বেয়ে আমি তার পিঠে ঝরতে থাকি একরাশ ক্লান্তি।তার দুপুর বেলার ঘুমে আমি হই সদ্যফোটা জুঁই,তার স্বপ্নবেলার সাজে আমি হই বেগুনি প্রজাপতি।সে ধরতে চায় আমায, আর তাই,শেষ পর্যন্ত নিজেকে বাঁচতে হবে বলে,শুধুমাত্র এই কারণে আমি তাকে বসে বসে খাই।
বর্ষা, যৌবন কি বোঝ?আমিও অবশ্য ঠিক বুঝি না,তবে নিজের মধ্যে একটা পরিবর্তনের কথা খুব বুঝতে পারি ।যেন মনে হয়, আমার অনেক কিছু করার আছে, অনেক কিছু বলার আছে।কাকে আবার,তোমাকে ।এই যে দেখছি ,মনে হচ্ছে তুমি যেন আমার সামনে বসে আছ, আর আমি একটা পালকের মধ্যিখানের কাঠিটা বুলিয়ে চলেছি তোমার গালে ।সত্যি বলছি ,ঠিক এইটাই দেখছি। এটাই কি প্রেম? লোকে বলে এটা প্রেমে পড়ার বয়স ।আমারও কি তাই হল? তোমার সবকিছু আমার ভালো লাগে, তোমার চোখ , কথাবার্তা, চালচলন সবকিছুই । তোমার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে ,লোকে কি ভাববে মনে করে চোখ নামিয়ে নিই। বাড়ি ফিরে তোমারই কথা ভাবি, অফিসের টেবিলে বসেও তোমারই কথা। ফরফর করে ফাইলের পাতাগুলো উড়ে যায় হাওয়ায় ,কাগজপত্র এলোমেলো হয়ে যায় ।আমি তোমার কথা ভাবি। আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে তোমার বিরাট অস্তিত্ব,আর তুমি ঘিরে ধর আমাকে। আমার অনেক কথা বলতে ইচ্ছে করে ।এই দেখা, না দেখা ,চেনা আর না চেনা , তাকে মিলিয়ে-মিশিয়ে আমারই মনে গড়ে তুলেছি তোমাকে,সে শুধু এক ব্যক্তি নয় ,সে এক ঈশ্বর।একটা আলোড়ন হয়ে যায় মনে। আমি ঠিক বুঝতে পারি না, এটাই প্রেম কিনা ।আসলে ভালো লাগা আর মনের ভিতর তাকে ধারণ করা,এই দুটোকে জোর করে লোকে 'প্রেম' বলে একটা ছোট্ট শব্দ দিয়ে সেরে ফেলেছে। কিন্তু আমি তা পারব না ।আমার এই আবেগের কোন সংজ্ঞা নেই। তোমার অনুভব আমার কাছে শুধু একটা শব্দ নয়, অনেক অনেক তার বিস্তৃতি।তাই এখনও আমি তোমাকে পুরো ভালবাসতে পারিনি,শুধু অনেক অনেক ভালবাসতে চাই।
গতকাল রাতে বাথরুমে ঢুকে হড়কে পড়ে গেলাম আমি ।আর ব্যাথায় কাতর পা নিয়ে ওঠার চেষ্টা করতে গিয়ে দেখলাম, বালতির জমা জলে আমার মুখটা দেখা যাচ্ছে, আর কি এক নিদারুন হতাশা ফুটে উঠেছে সেখানে। মনে হল,বেঁচে থাকা কি শুধু এই,শুধু ক্ষয়ে ক্ষয়ে শেষ হয়ে যাবার জন্য?
তবুও, আমার খেয়াল খুশি আর আবেগ ,তা যতই যৌক্তিক বা অযৌক্তিক হোক না কেন,সেসব তোমার ওপর চাপিয়ে দেবার কোন অধিকার আমার নেই । তার মূল্য দিতে তুমি বাধ্য নয়। তুমি আমার কেউ নাও হতে পার, আমার কোন কিছুই বলার বা করার থাকবে না ।কিন্তু কতকাল,আর কতকাল শুধু হেরে যাব আমি?তাই তোমাকে আমার মনের কথাগুলো না জানিয়ে কিছুতেই শান্তি পাচ্ছি না ।বারবার চেঁচিয়ে বলতে ইচ্ছে করছে,”আমি যে ভালবাসতে চাই,এক্কেবারে। প্লিজ,আমাকে ভালবাসতে দাও…..।“
ভালবাসলে নিজের সবটুকু দিয়ে ভালোবাসতে হয়। হিসেব ,দেনা- পাওনা মনে রাখতে নেই। একটা অদ্ভুত শূন্যতা থাকে নিঃস্বার্থ ভালোবাসায়। প্রতিটা মুহূর্ত নিজেকে বিলিয়ে দেওয়া আর মনের চাহিদা নিজের মতো করে কুড়িয়ে নেওয়া। এ এক বেপরোয়া লাগামহীন আবেগে নিজেকে ছেড়ে দেওয়া। অনেকটা দেওয়ার পরেও যেখানে সব শেষ হয়ে যায় না।মনে হয়, আরো তো কিছু দেওয়ার আছে আমার। আরও অন্য কিছু আবেগ,অন্য জগতের।
সারা সপ্তাহ অফিসে কাজের চাপ।শুধু ছুটির দিনে কিছু অকাজও থাকে,যেমন তোমার ছবি লুকিয়ে দেখা বা চব্বিশ ঘন্টা চ্যাটিং করা। হয়ত বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করতে করতে তোমার কথা মনে পড়ায় ,অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছি আমি । বন্ধুরা চেঁচিয়ে আমার ঘোর ভেঙেছে, পেছনে লাগতেও ছাড়েনি ।অফিসে কাজ করার সময় এখন যখন তোমার কথা ভাবি, কাগজপত্র পেপারওয়েট চাপা দেওয়া থাকে। বাড়ি ফিরে ক্লান্ত দিনের শেষে, ঘুম ঘুম পেলে একটা ম্যাগাজিন নিয়ে শুয়ে পড়ি। অন্ধকারে ভরে যায় ঘর,তুমি সবটাই জুড়ে থাক,অন্ধকারে নেমে আসে মনের অস্ফুট চাহিদা। যেখানে বন্ধুদের চিৎকার নেই ,অফিসের বস নেই ,নেই কারও উপস্থিতি , তখন তুমি-আমি হিসেব না করে লীন হয়ে যাই। এই এত কিছু একটা মাত্র শব্দ দিয়ে পরিচিতি দিই কি করে? না ,শুধু প্রেম একে বলব না , বরং এসো, আমরা দুজনে মিলে এটাকে বর্ণনা করার চেষ্টা করি। আর সেই অবসরে ,আমার মন গিয়ে ঢুকবে তোমার মনে, ঠিক সেই মুহূর্ত থেকে তুমি আমাকে সেখানেই রেখে দিও। তাহলেই আমার জীবনের সার্থকতা ।সেদিনই এই ভালবাসা পূর্ণতা পাবে।
সুখ কি পাহাড়ের ওপারে?পৌছনো কি খুবই কঠিন? এর পরেও যদি তুমি আমাকে দুঃখ দাও? কিন্তু সে কি নতুন কিছু? নতুন করে তুমি আর কি দুঃখ দেবে আমাকে? আঘাতের দুঃখ ভুলতে জানি আমি।বর্ষা,তোমার কাছে কি এমন চেয়েছি? একটা নতুন কবিতা?একটা তাজা গোলাপ? নাকি একটা গোটা পার্কস্ট্রীট?শুধু তো খানিকটা মুখোমুখি সময়। বন্ধ জানলাগুলো খুলে একটুখানি তাকিয়ে থাকা। তুমি যদি সারাজীবন ধরে আমার পাশে থাকতে, আর আমাকে প্রতিদিনই নতুন করে আবিষ্কার করতে, তবে বড় ভালো হত। কিন্তু ভেবে দেখ,এই আমাকে বাদ দিয়ে এই কথাগুলো , হয়ত এক টুকরো কাগজে লেখা ফালতু কথা হয়েই উড়ে হারিয়ে যেত। তাই কি চাও? তুমি জান না,একমাত্র তোমাকে না পাবার দুঃখ-অভিমানেই ,না বলা কথাগুলোকে বাঁধন ছিঁড়ে মুক্ত করে দিয়েছি আমার মন থেকে তোমার মনে । কারণ তুমি সকলের থেকে আলাদা।তোমার- আমার হয়তো কোনদিনই সবুজ হওয়া হয়ে উঠবে না, তবু বলছি, দূর থেকেই বলছি ,তোমার অনুরণন যে আমাকে পাগল করে তোলে, তা হয়তো বা তুমিই প্রকৃত বুঝতে পারবে একদিন ,যেদিন আমিই হয়তো থাকব না। তখন কোন শীতের দুপুরবেলা হঠাৎ নীল আকাশে হারিয়ে যাওয়া ছোট্ট চিলটার দিকে তাকিয়ে, আমার কথা তোমার মনে পড়বে, আর তখনই দেখো ঠিক, তোমাকে কাঁদিয়ে যাবে আমার নীল পালক।আমি যে কে তোমার, তা চিঠি লিখে সময়ের কাছে দিয়ে দিও ,তাহলেই আমি স্বস্তি পাব।
আসলে,এই জগতের বাইরে গেলেই যত সুখ,যত শান্তি,যত আনন্দ।তবু যেতে পারি না । আমাদের মুখের হাসি কেড়ে নেওয়া হয় প্রতিক্ষনে,প্রতিদিনের লড়াইয়ে হারতে হারতে মুখ লুকোচ্ছে একটা গোটা জীবন। আমাদের কারোরই দুঃখ নিয়ে দিয়ে কিছুই পাওয়ার নেই,বরং কঠিন হল আনন্দ দেওয়াটা। সেই চ্যালেঞ্জটা কি তুমি নিতে পার না পৃথিবীর কাছে , সবার কাছে, আমার কাছে? যদি সত্যিই কিছু দিতে চাও,নেব।লুটেপুটে , চেটে,কুড়িয়ে নেব। ভালোবাসা,আর একটা কথা রাখা," আমি তোমার সঙ্গে আছি"।
জীবনের অচেতন অবয়বে যাপনের মুহূর্ত গুলো আলগা আলগা হয়ে কখন জমাট বাঁধে তা বোঝা যায় না,শুধু অন্ধকার আকাশের দিকে নিজেকে ছড়িয়ে দেওয়া যায় ।জানি,তোমারও একটুকরো রাতের আকাশ আছে ।সেইজন্যই তোমার পাশে পাশে হেঁটে যাওয়ার সময় বড় আপন মনে হয়। হয়ত কোথাও পৌঁছতে পারছিনা জেনেও,তোমার হাতটা ধরতে চাওয়ার তীব্র ইচ্ছে হয় বুকের ভেতর। আর এই গোপন মুখবন্ধ ইচ্ছেগুলো,এই ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাওয়া কবিতাগুলো যখন হঠাৎ করে একদিন সামনে এসে দাঁড়ায় , মনে হয় এবড়ো খেবড়ো ঘা খাওয়া জীবনটার গায়ে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের মত একটা ভাললাগা এখনও বেঁচে আছে।আর আছে একটা ঘন জঙ্গল আর একঝাঁক জোনাকি মাখা অন্ধকার।তারা ভরা আকাশের নীচে রয়েছে তোমার আমার বসতবাড়ি।আমার চোখে জমে আছে রাতজাগা ঘুম,তোমার চোখে জমা হয়েছি আমি। তুমি দেখতে পাচ্ছ ঐ ভেসে আসা বনজ্যোৎস্না ? তুমি দেখতে পাচ্ছ রাতভোরের ঐ তারাটাকে? বাতাসে মহাসাগরের শব্দ আমাদের ঘর অবধি শোনা যায়। তুমি একবার চোখ বন্ধ করো অন্ধকারে, দেখবে ভালবাসায় ভেতরটা কত আলো হয়ে আছে। স্বপ্নশেষে আমাদের যাত্রা শুরু করার সময় হল।
আজ ফেলে দিলাম সেই পুরনো কবিতাটা । পুরনো অক্ষরগুলো নিয়ে সেটা এখনই বিদেয় হলো ।আজ আবার নতুন করে লিখতে বসলুম। নতুন নতুন শব্দ, একঘেয়ে অক্ষরগুলো নতুন বৃষ্টির জলে ধুয়ে মুছে চকচকে। আজ তারাই ভরে দিল এই পাতা নতুন কথা বলবে বলে । পুরনো কবিতার কথাগুলো কোথায় হারিয়ে যাবে কে জানে ?হয়ত বা থেকে যাবে আমার মনে। যেমন করে থেকে গেছে ছোটবেলায় সেই শীতের রোদে পা ডুবিয়ে বসে থাকার সময়টা। তারপর সেই ছুটতে থাকা আর পিছনে ফেলে আসা এক একটা বছর শুধু নয়, এক একটা চিত্র। হঠাৎ তার মধ্যে থেকে বেরিয়ে এসে একা হয়ে গেলাম আমি,একসময় । কোনের বারান্দা ,অচেনা পাখির ডাক, দূর থেকে ভেসে আসা ট্রেনের শব্দ ,বাসনওলার টুংটাং এই সবকিছু নাছোড়বান্দা হয়ে ফিরিয়ে নিয়ে যায় ছোটবেলার অলিতে গলিতে। তবে এখন আর কেউ বলে না,” কিরে খেলতে যাবি ?”।মা বলে না “সন্ধ্যে হল ,পড়তে বস ।“ স্কুলে ছুটির ঘন্টা পড়ে না ,গোলাপরেউড়ি কেনারও বায়না নেই ।দূর থেকে দেখি ছেলেবেলা দৌড়চ্ছে, নির্ভেজাল এক আকাশ হাসি নিয়ে...... অন্য কারো ছেলেবেলা দেখি প্রাণ ভরে।কিছুই হারিয়ে যায়নি, কিছুই হারায় না ,সেই পুরনো কবিতাটাও নয়।
কিন্তু সত্যিই আমি পিছনে ফেলে এসেছি অনেক কিছু। কিছু স্মৃতি ,কিছু মানুষ সেই পুরনো পাতায় জ্বলজ্বল করে।পুরনো সব চিত্র ভেসে ওঠে মাঝে মাঝে। ভেসে ওঠে পুরনো মানুষগুলোর পুরনো অভিব্যক্তি, কথা বলা ,পুরনো আফশোষ, পুরনো দুঃখ, পুরনো আনন্দ । আর আমি অবাক হয়ে দেখি, কি অবলীলাক্রমে আমি ফেলে রেখে এলাম সেই সব স্মৃতি। কিন্তু শুধু স্মৃতি নয় ,কতগুলো মানুষকেও ফেলে রেখে এসেছি আমি অতীতে, তাদের মধ্যে অনেকেরই আজ অতীতের গন্ডী পেরিয়ে বাস্তবে আসার ক্ষমতা বা অধিকার নেই। তারা মিলিয়ে গেছে বৃষ্টির জলে, ধুয়ে মুছে কুলুঙ্গির ঝাপসা আলোয় অন্ধকার হয়ে গিয়েছে। আর বাকিদের সঙ্গে দেখা হয় না অনেকদিন। স্কুলজীবনের, কলেজ জীবনের কত বন্ধুদের সঙ্গেও দেখা হয়নি কত দিন হল। মানুষকে তো সবকিছুই ফেলে রেখে, এই জগত ছেড়ে চলে যেতে হয় ।কিছুই নাকি সঙ্গে যায় না। একমাত্র কৃতকর্মই তাড়া করে বেড়ায় তাকে। তাই সবকিছুই ফেলে রেখে যেতে হবে। কত মায়া, কত স্বপ্ন, নিমেষে ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে, এমনকি শরীরটাও সঙ্গে যাবে না। সবচেয়ে প্রিয়জনদেরও ফেলে আসতে হচ্ছে, ফেলে রেখে যেতে হবে,এমনকি প্রিয়তমাকেও।কারো ছাড় নেই। মানুষ তাই আঁকড়ে ধরে প্রিয় সব জিনিস গুলো। বেদম মার দিলেও ব্যাটারা হাতছাড়া করতে চায়না স্মৃতির সবুজ ডালটাকে ।আসলে আবেগ আর ভালবাসাটাকে কোনো দিনও ফেলে রেখে আসা যায় না কোথাও। চিরকাল তা বাঁচিয়ে রাখে বেঁচে থাকার ইচ্ছেটাকেই ,আর চারপাশ বদলে গেলেও ,সঙ্গে চলতে থাকে। কিছু কিছু জিনিস কোনদিন বদলায় না,যেমন মা।তাই এতদিনেও আমার সেই পুরোনো কবিতাগুলোর মৃত্যু হয়নি,যেগুলো কোনদিন লেখাই হয়নি ।
বর্ষা,জান কি, সময় জ্ঞান নেই ,পাত্র-পাত্রী বিচার নেই, নিজের সম্পর্কেও বড় বেশি বেপরোয়া; এমন কেউ হঠাৎ করে , মনের সব জীবনমরণ কথা তক্ষুনি বলে যাবে ভাবলে, তার পক্ষে রাত দুটোই ঠিক সময় ।আবেগ নেই, ভালোবাসা নেই, সৃজনশীলতা নেই, আর নেই একটা পাগল মন, এমন কেউ লিখলে,সে কথা কবিতাই হত না কখনো,সে ছবিতে রঙই থাকত না কোন,আর ফ্যাকাশে একঘেয়ে মেঘে ঢেকে, বিরক্তিতে ধুয়ে ধুয়ে, ক্ষয়ে ক্ষয়ে, শেষ হয়ে যেত সে লেখা। এ কাজ আমার দ্বারা হবে না ।এই গভীর রাতে রাস্তার উল্টো দিকের বাড়ির ছাদের ঘরে আলো জ্বলছে কিনা,সে বাড়িতে শুয়ে শুয়ে তুমি, অনেক ভাবনার গোপনে ডুব সাঁতার দিচ্ছ ,নাকি বিছানায় হেলান দিয়ে 'কোয়েলের কাছে' ,আর সত্যি সত্যিই সেখানে পৌঁছে গেলে কিনা, অনেক চেষ্টা করেও সেকথা জানার কোন উপায় নেই ।বারান্দা থেকে ঠিকমতো দেখা যায় না তোমার ঘর। ছাদে উঠে হয়তো এক চিলতে দেখা যাবে, কিন্তু তার জন্য মশারি থেকে বেরোতে হবে ,সাবধানে চটি পায়ে গলাতে হবে ,খুব আস্তে আস্তে খুলে ফেলতে হবে প্রথমে খিল, তারপর ছিটকিনি, তারপর গদরেজ লক্ ।এতসব করলে দরজাটা ঠিক বিরক্তি প্রকাশ করবে ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ করে। তাই সে ব্যাটাকে ঠেকনা দিয়ে রাখতে হবে ,যাতে পাশের ঘরে শব্দ না যায় ।কিন্তু শব্দ যাবেই, আমি জানি। বাবার ঘুম খুব পাতলা ,মাও ঠিক এই সময়েই জেগে যেতে পারে। এরপরে আরও আছে। মই বেয়ে উঠতে হবে উপরে। মইটা একদিক ঢক্ ঢক্ করে, শব্দ না করে সেও ছাড়বেনা ।রাতের এই অ্যাডভেঞ্চারে এরা কোন না কোন অবদান রাখতে বদ্ধপরিকর হবেই। আর শব্দ যা হবে, ভয় হয় তা সব বাধা পেরিয়ে ,ঠিক সময় সোজা বাবার কানে পৌঁছে যাবে। তারপরেও আধভাঙা দরজাটা খুলে, শেষে ছাদে উঠতে হবে আর ছাদে পা রাখা মাত্রই একটা দমকা হাওয়ায় দরজাটা আছড়ে বন্ধ হবে ,যেটা রাত দুটোয় যে কারোও ঘুম ভাঙানোর পক্ষে যথেষ্ট।এরা কেউই কোনকালে আমার বাধ্য ছিল না,হবেও না,বৃথা শাপশাপান্ত। এমতাবস্থায় ছাদে ত্রিশঙ্কু হব আমি, আমাকে নীচ থেকে বাবার অসংখ্য বকুনি শুনতে হবে, আর কিছুতেই বুঝিয়ে উঠতে পারব না ,আমি ঠিক কি কারনে এই মধ্যরাতে ছাদে উঠেছিলুম। তাই তোমার সেই দুর্গম ঘরের আলো জ্বলছে কিনা ,আর সেই ঘরে বেচারা তুমি আমার জন্য রাত জেগে বসে আছ কিনা, আর একটিমাত্র ঝোড়ো উড়ো কবিতা বুকে করে সতেরোতম বার গোগ্রাসে পড়ে ফেলছ কিনা, তার আভাস পাওয়া ,এখন আর তাই কিছুতেই সম্ভব নয়।কেন যে প্রিয় মানুষগুলোর কাছে পৌছনোই সবসময় এত কঠিন,কে জানে? সুতরাং মশারির বাইরে বেরই হবনা ঠিক করলুম।বসে বসে ফালতু সব কথা ভাবতে লাগলুম আর এইসব বিশেষ কথা যারা ভাবতে পারেনা, তাদের জন্য দীর্ঘশ্বাস ফেললুম।দেখলুম, এই অসীম ক্ষমতা কেবল ভূভারতে আমারই আছে ,নইলে এই রাত দুটোর সময় কেনই বা আমার ঘুম ভেঙে এইসব অসাধারন জরুরী কথা মনে পড়ে গেল? আর কেনই বা জানলা দিয়ে মৃদু হাওয়া ঢুকে আমার চুল এলোমেলো করে দিল?সে কি তুমি নও? নাকি তুমি ঘুমিয়েই পড়েছ তোমার আদরের ছাদের ঘরে, আমার নাম লেখা বালিশে শুয়ে? আর এই যে স্পষ্ট দেখছি চাঁদের আলো আর স্ট্রীটলাইট দুই'ই জানলার এক কোনা দিয়ে ঢুকে, তোমার ঘুমন্ত মুখের ওপর পড়তে চেয়েও পড়তে পারছে না,তার কি হবে? কানের কাছে সিলিং ফ্যানের একঘেয়ে শোঁ-শোঁ শব্দ আর আর বুকের ভেতর একফোঁটা দুঃখই হয়ত অগত্যা জেগে থাকবে। চিন্তা করার বা অবাক হবার কিছু নেই, এই রাতের অন্ধকারকে হারিয়ে আর তোমার ঘরের জানালার গরাদ পেরিয়ে এই ভাবনাটা, জানি ঠিক ঢুকে পড়বে হুড়মুড় করে সেই ঘরে,সেই ঠোঁটে, কোনো বাধা-নিষেধ না শুনে, সময় জ্ঞান ভুলে; আমারই মত বেপরোয়া ।
জীবনপথে
"এইখানে আবার দেখা হবে" ঠিক এক বছর আগে যা বলেছিলাম,এমনই রোদ ঝলমলে দামাল শীতের দিনে।"এইখানেই দেখা হবে, এই ইউক্যালিপটাস গাছের নীচে।"যদিও তুমি চলে গেছ, অথবা আমিই চলে গেছি তোমায় ছেড়ে,তবুও তোমায় মনে পড়েছে প্রতিটি ঝড়ের রাতে-প্রতিটি কান্নাময় বর্ষায় আমি তোমারই জন্য লিখেছি হৃদয় নিংড়োনো কবিতা। প্রতিটি না গাইতে পারা গান বা প্রতিটি না হওয়া তুলির টানে তোমাকেই খুঁজেছি।প্রতিটি পঁচিশে বৈশাখ তোমার ছবিও টাঙ্গাতে ভুলিনি কবিতাবুড়োর ছবির পাশে ।নেশার ঘোরে প্রতি সন্ধ্যায় তোমার কথা মনে পড়তেই আমি সোজা উঠে পড়েছি ন্যাড়া ছাদে, আবার কখনো তুমিই দাবি করেছ, গালাগাল দিয়েছ বা ঠেঙ্গানি দিয়ে বৃন্দাবন দেখিয়ে ছেড়েছ এমন এক পথে যেখানে প্রতিটি মোড়ের মাথাই মহানন্দে গিলে খেতে চেয়েছে আমায়। আমি হঠাৎ খেয়ালবশে খেলতে খেলতেই আমার জন্ম জন্মান্তরের সমস্ত ছায়া থেকে জন্ম দিয়েছি এই পৃথিবীর,আমি আঠারো বছর বয়স দিয়ে তৈরি করেছি তার পাহাড় পর্বত আর তেইশের কান্নায় বইয়ে দিয়েছি তার নদী। আমি সারা জীবনের স্বপ্ন দিয়ে গড়েছি প্রাণ আর সমস্ত তেজ দিয়ে গড়েছি আগ্নেয়গিরি ।আর যেইনা বিদ্যুতের চমক দিয়ে আমি লিখেছি তোমার নাম,অমনি সেই আগ্নেয়গিরি শুরু করেছে তার উদ্গিরন।আমি তার বিকট জ্বালামুখ বন্ধ করে রয়ে গেছি এক টুকরো জলাশয় হয়ে, ক্ষেতের পর ক্ষেত ফেটে গেছে, ফসল শুকিয়ে মরে গেছে আর আমি সেখানে দাঁড়িয়ে থেকেছি একা, হাড়ি মাথা কাকতাড়ুয়া হয়ে।প্রতিটি বন্যা বা ভূকম্পনের পরে আমি দ্রুত পৌঁছে গেছি হোলসেল হেলিকপ্টার। এমনকি ভোটের আসন রফার জন্য নেতার হাতে থেকে গেছি অবিচল টেলিফোন হয়ে। সেসব ভুলিনি বলেই আমি চলে গিয়েও ফিরে আসি, মরে গিয়েও বেঁচে থাকি,শুকিয়ে গিয়ে ,ঝরে গিয়েও আবার তাজা সবুজ হয়ে জন্ম নিই ইউক্যালিপটাসের পাতা। তোমার জন্য আমি ফুল এনেছি, মালা এনেছি, এনেছি চন্দন ।অথচ তোমার চোখে কোনদিনও কোন আবেগ আমি এনে দিতে পারিনি , আমার বেতনহীন মানিব্যাগ আর আমার এনামেলের থালায় করে।আমি কিছুই বাছিনি, তোমার বা অনাগতর,ইঁট অথবা পাথর ,কারো কথাই ভাবিনি ,কারো জন্যই আনিনি দৃষ্টি অথবা পিপাসা, আগুন অথবা অন্ধকার হতাশা। কাউকেই দিইনি রক্ত, এমনকি তোমাকেও নয়। আমি প্রতিটি বিভঙ্গে দেখেছি তোমাকে, প্রতিটি নিঃশব্দ একাকী সন্ধ্যায় তোমাকে হারিয়ে ফেলেছি, আর তুমি চলে গেছ অন্ধকারের ভিতর দিয়ে আরো একটি অন্ধকারে। আমি দেখেছি এক নিদারুণ বিতৃষ্ণা , প্রবল হিংসা, আর সেই সব কিছু থামিয়ে ফেলার মত যথেষ্ট বাস্তবতা। আমি ছড়িয়ে থাকা তেলে মিশিয়েছি জল ,আর নিভিয়েছি আগুন ।অথচ দেখি সমুদ্রতীরে তৈলাক্ত বালিতে ভেসে আসা শিশুর লাশ।অগ্নিবলয়ের আলোয় আমি দেখে ফেলি অনাহারী ভেঙেপড়া মানুষগুলোকে।আমি ফিরিনি, ফেরাতেও পারিনি, শত শত লাল-নীল-সবুজ, কাঁচা-পাকা,আলো-অন্ধকার-অন্ধত্ব ।অসংখ্য মুখের মাঝে আমি ভেসে গেছি ,যেমন ভেসেছে আমার বিবেক, আমার ভালবাসা। মানুষের জন্য শুধু রুটি নয় গোটা দেশটাকেই বিলিয়ে দিতে, সকলকে সঙ্গে নিয়ে বলে যেতে মুক্তির শেষ কথা, আমি পারিনি। আমি ভিখিরি শিশুটার হাতে কোনোদিনও তুলে দিইনি ভালোবাসা, এমনকি খুচরো পয়সাও। আমি ফেরাতে পারিনি, এমনকি নিজেকেও ।তবু, আজ এতদিন পরে, তুমি ভুলে যেওনা সেই বিগত রোদ ঝলমলে দিনের কথা। ভুলোনা সবুজের শেষ আলিঙ্গন, যখন আমাদের আবার দেখা হবে ।তোমার ঘরের জানলার কাছে ওই দেখ , আমার দামাল হাওয়া ধাক্কা দিচ্ছে, তোমায় দেখতে চাইছে দেখ, ওই আমার একটা বছর।
কালে কালে বয়স কম হল না।কেরিয়ারের লড়াই লড়তে লড়তে চেহারাটাই তামাটে হয়ে গেল।তবে শখ যায়নি,সুন্দরী মেয়ে দেখলে চোরাচাউনিতে আজও চাই।আর কিছু ব্যাথা আজও রয়ে গেছে, কিছু অভিমান, কিছু ভুল করে ফেলেছি ,কিছু সময় চলে গেছে।কিছু মানুষ চলে গেছে।শেষ প্রেমিকা আমাকে ফেলে রেখে বাসে চেপে চলে গেছে,গলি ঘুঁজি খুঁজেও আর পাইনি। শেষ পরীক্ষায় পাশ করতে পারিনি,শেষ দেখা দেখতে পাইনি কাউকে কাউকে।কিছু আফশোষ রয়ে গেছে,কিছু দীর্ঘশ্বাস।আর অনেক না পাওয়ার মধ্যে কিছু পাওয়াও রয়ে গেছে।বর্ষার আলতো হাতের ছোঁয়া,মায়ের হাতের আমঝোল বা বাবার ধমক "ঝড় উঠেছে রে,কোথাও বেরোবি না এখন।” আর রয়ে গেছে আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজেকে খোঁজার চেষ্টা।যেমন পার্ক স্ট্রীটের ফুটপাথে হাঁটতে গিয়ে এখনও খুঁজি টাটকা এসির গন্ধ,যেমন মামাবাড়ির কড়ী বরগা খড়খড়ী আর পঙ্খের কাজে খুঁজি ছোটবেলার স্মৃতি।আজ মনে হয় প্রত্যেকটা মানুষই আসলে ভেতরে ভেতরে ভীষন একা।ঝুপ করে সন্ধ্যা নামলে, পূর্ণীমা চাঁদের দিকে তাকালেই মনে হয় কোথায় যেন জেগে উঠছে আমার একাকীত্ব,আমার মনকেমন।কোথায় কি যেন ছিল,পাওয়া হয়নি।কোথায় কে যেন ছিল,দেখা হয়নি। অনেক দূর চলে এসেছি। সব পুরোনো দিনগুলোকে ছেড়ে, সব মায়ার বাঁধন কাটিয়ে, নিতান্ত স্বার্থপরের মত আজকের এই সুবিধাবাদী পৃথিবীতে চলে এসেছি। পিছনে পড়ে রয়েছে এঁদোগলি ,নর্দমা, নোনাধরা দেয়াল ,চেনা বন্ধু, পিছুডাক, কিছু মানুষ আর প্রিয় কলকাতা শহর। সেসবই আমার পিছু নেয়। তবু তো চলে যেতেই হয়, সূর্যাস্তের অনেক আগেই ফুরিয়ে যাবার মত।আমার এই ছেড়ে আসা, বড় হওয়া আর আজকের জীবনে পৌঁছে যাওয়া এ যেন হবারই ছিল। শুধু যখন আকুল বৃষ্টির পরে, সন্ধ্যার আকাশের বুক চিরে এক ঝাঁক পাখি ঘরে ফিরে যায়, মনে হয় আমারও কোথাও যাবার ছিল, যাওয়া হয়নি,কারো কোন কথা রাখার ছিল,রাখা হয়নি। নিতান্তই কেজো একটা কারণে ভুলে থেকেছি নিজেতে। অথচ কেউ হয়তো এখনো বসে আছে আমার পথ চেয়ে , হয়তো ভাবছে আমি ঠিক যাব । সেও যে একা।শহুরে আলোর রোশনাই যেন জোর করে একাকীত্ব অস্বীকার করাতে চায়।তবু সিগারেটের ধোঁয়ার মত নিংড়ে বের হয়ে আসে কান্না।দেখা যায়না,বোঝা যায়না।এত বড় সংসারে কেউ কাঁধে হাত রেখে বা চোখে চোখ রেখে বুঝতে আসেনা কারও মনকেমন।হঠাৎ আকাশ কালো করে বর্ষা আসে,গাছের ডাল নুইয়ে পড়ে মাটি ছুঁতে চায়।দলা পাকিয়ে ওঠে দীর্ঘশ্বাস,চোখে জল এসে যায়।মনে হয় কেউ় কি বুঝলো আমাকে ঠিকঠাক,এ জগতে কেউ কি অনুভব করল আমার এই ছোট্ট আবেগ,ছোট্ট উপস্থিতি?গভীরে কোথাও রক্তাক্ত হই,অভিমান জেগে ওঠে,মনে হয় আমি কি কেউ নই?কিচ্ছু নই?কেন আমি এত একা ,শুধু আমার পাগল মনটাকে নিয়ে?কেন আমি এত ক্ষুদ্র,অসহায়?হঠাৎই রবিঠাকুরের গানের দুটো লাইন চোখের জলে ভিজিয়ে দেয়,বলে কি করলে জীবনে?“প্রহর হল শেষ”।
স্কুল লাইফের কথা মনে পড়ে, ক্লাস ফাইভে পড়া পর্যন্ত ,স্কুলে পশুপতিদা ছিলেন ছাত্রদের খুব প্রিয় ।তিনি ছিলেন সবার শুধু শিক্ষক নন,ঠিক যেন বাবার মত। এতটাই আপনজন ছিলেন, আমরা তাকে 'তুমি' করে বলতাম। সস্নেহে গালে দাড়ি ঘষে দিতেন তিনি। কোলে করে আদর পর্যন্ত করতেন। ছোটবেলার সেই স্মৃতি এখনও আমার চোখে ভেসে ওঠে। তাকে দেখে তথাকথিত শিক্ষকের ছবি মুছে যেত আমাদের মন থেকে , সেখানে ভেসে উঠতেন পরমাত্মীয়, ভালোবাসার আধার পশুপতিদা।সেই স্যারই একদিন সাংসারিক কলহে বিপর্যস্ত হয়ে, আত্মহত্যা করলেন ।স্কুলে তার মৃতদেহ এনে রাখা হল। আমার শুধু মনে আছে সেই সেদিনের শোকমিছিলের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে গেট অবধি চলে এসেছি, দারোয়ান বাচ্চাদের বের হতে দেবে না ,আর আমার বন্ধু সুশোভন বলে উঠেছে "হ্যাঁ রে ,স্যারকে কি ওরা পুড়িয়ে দেবে?" সেই কথাটুকুর মধ্যে যে ব্যাথা ছিল, যে বেদনাভরা আকুতি ছিল ,তা আর কখনো দেখিনি।সে ভালবাসা ছিল একেবারে নিখাদ। ছোটবেলার কথা মনে পড়লেই মনটা খুব চঞ্চল হয়ে ওঠে।স্কুলে যখন পড়তাম মনে আছে এক একদিন প্রার্থনায় এক একটা গান গাওয়া হত। ছাত্ররা করিডোরে বা খোলা ছাদে দাঁড়িয়ে সেই সব গান গাইতাম। শিক্ষকরাও গলা মেলাতেন আর আমাদের দেখভাল করতেন।মনে আছে একদিন আমরা সবাই গাইছি দ্বিজেন্দ্রলালের 'ধনধান্য পুষ্প ভরা'।হারমোনিয়াম বাজাচ্ছেন গানের শিক্ষক অমলদা। অসাধারণ এই গানটা অন্য সব প্রার্থনাসঙ্গীতের চেয়ে আমাকে বেশী আকৃষ্ট করত আর গাইতেও খুব ভাল লাগত। দেশাত্মবোধ মাথাচাড়া দিত গানের কথা আর সুরের জন্য ।বুকের ভেতর কেমন একটা চিনচিনে অনুভূতি হত,ভীষন উদ্বুদ্ধ লাগত,ভীষন মন কেমন করত ,হৃদয় দিয়ে গানটাকে বোঝার চেষ্টা করতাম ।যাই হোক সেদিন ধনধান্য গান গাওয়া হয়ে গেছে ,সব ছাত্ররা স্যারেদের তত্ত্বাবধানে যার যার ক্লাসে ফিরে যাচ্ছি। হঠাৎ দেখলাম রাগী এবং রাশভারী সন্তোষদা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন, গানের রেশটা তখনও বোধহয় তার সারা শরীরে ভর করে আছে। তার আগের দিনই ভারত জিতেছে বিশ্বকাপ ক্রিকেট, কপিল দেবের নেতৃত্বে। আমরাও সবাই রাতে বাজি ফাটিয়েছি, মশাল দৌড় দেখেছি ,সে এক দারুণ আনন্দ উন্মাদনা ।স্যারের সামনে দিয়ে যেতে গিয়ে দেখি দীর্ঘকায় কঠিন রাগী সন্তোষদার দুচোখ দিয়ে জলের ধারা নেমে আসছে, আর উনি হাত দিয়ে তা মুছে নিচ্ছেন। সন্তোষদা কাঁদছেন। তখন বুঝিনি ।এখন বড় হয়ে যখন 'ধনধান্য পুষ্পভরা' শুনি আর সেই ছোট বেলার মত বুকের মধ্যে চিনচিন করে ওঠে দেশাত্মবোধ আর তার সঙ্গে আসে এক ভীষণ উপলব্ধি, যেটা তখন আসত না, দেশপ্রেমের সেই পাগল করা বোধে, আজ আমারও চোখ জলে ভরে যায় ।তখন সেই দিনের সেই কান্নার মানে আমি বুঝতে পারি। সেইসব সোনালী দিন চলে গেছে, আর আসবেও না জানি । শুধু মাঝে মাঝে আজকাল যেন আরো বেশি করে সেইসব টুকরো টুকরো স্মৃতি ফিরে আসে। তখনই মনটা ভারি ভালো হয়ে যায়। সেইটুকুই এই জীবনের পাওয়া ,এই যা।এই ভালবাসার মানুষগুলো ছাড়া আর তো কিছু নেই,কেউ নেই।
আমি যদি চাকরি না করতুম, আর বাঁধাধরা কোন কাজের গণ্ডির মধ্যে বাঁধা না থাকতুম, তাহলে আমি হয়ত অন্য অনেক কিছু করতে পারতুম। তাতে অবশ্য খাবার বা প্রেমিকা জুটত কিনা নিশ্চিত করে বলতে পারি না ;তবে মনের আর প্রাণের ইচ্ছের বিকাশের একটা রাস্তা খুঁজে পেতুম নিশ্চিত। সারাদিন ইচ্ছেকে ভাসিয়ে দিতুম ডানায়, কখনো সে কবিতা লিখত, কখনো বা ছবি আঁকত। দেয়ালে আজগুবি নকশা করত বা হারমোনিয়ামে গলা সাধত। এর পরেও অবশ্য অনেক সময় থাকত, নিজের ভুলগুলো শুধরে নিতেও পারতুম। ভুল তো কতই করি ।আসলে সময় চাই, সময়, নিজেকে বদলে ফেলার জন্য। মোড়ক বদল আরকি ।চাকরি না করলে বা অবসরে জীবন কাটালে অন্যান্য কিছু অসুবিধাও হতো ঠিকই, তবে প্রাণশক্তিটা বাড়ত, আকাশ -বাতাস- পৃথিবী -প্রকৃতির সুখটুকু উপভোগ করে নিতে পারতুম। কেন জানিনা সেটা হবার নয়।কে যে এই নিয়মখানা করেছে, তাকে বড় দুষতে ইচ্ছে হয় ।সময়টাই আসলে আলাদা।কোথাও মানুষ উদয়াস্ত পরিশ্রম করে সেইদিনের খাবারটা জোগাবে বলে ;আবার কোথাও আরও বড় সাম্রাজ্য, আরও বড় প্রাসাদের মালিক হবে বলে।
সেই পুরনো লজেন্স বা নকুলদানার দোকান ,সেই সাইকেল সারাইয়ের গুমটি, সেই পাড়ার চেনা রক, চেনা মাঠ- পুকুর, কিছুই আজ আর তেমনটি নেই। অনেক খুঁজেও খুঁজে পাই না কোথাও। সেই ছোট্টবেলার 'আমি'টার সাথে তারা সবাই হারিয়ে গেছে। রাস্তা দিয়ে হেঁকে গেছে স্বপ্নের ফেরিওয়ালা, চলে গেছে গলির মোড় ঘুরে চোখের আড়ালে। আমার যাওয়া হয়নি সেই ডাকে সাড়া দিয়ে।আমি ঘরে বসে বসে স্রেফ ফুরিয়ে গেছি। আর কখনো ফিরে যাওয়া যাবে না সেখানে ।এই সাধারন, প্রয়োজনের বাঁচায়, চোখে জমেছে আজ কুয়াশার মতো ঝাপসা শূন্যতা।
কোথাও পৌঁছতে পারিনি, পৌঁছানো যায় না ।সব স্মৃতি টেনে ধরে মন, টেনে ধরে চলমান পা, যেতে দেয় না। মায়ার বাঁধনে আটকা পড়তেই হয়। টালাব্রিজে জ্যাম লেগে যায়, বাসের ভিড়ে প্রাণ ওষ্ঠাগত, ট্রামের টুংটাং শব্দ, চেনা শহুরে গন্ধের মধ্যেই বেলফুলের মালার পাগল করা গন্ধ ,পুরোনো সুটকেস খুলে বেরিয়ে পড়ে সেই জামাটা, পুরনো অ্যালবামের পাতায় হঠাৎ ভীষণ চেনা ছবি, মানুষগুলোকে মনে পড়ে যাওয়া—এসবই টেনে ধরে আমার পা,এসব নিয়েই আটকে আছি আজকের আমি। এইগুলোই আমার জীবন, আমার কবিতা। এইসব হারিয়ে পাওয়া এক একটা মুহূর্তই তো আসল বাঁচা। পেরিয়ে চলে গেছে শেষ ট্রেন ,পড়ে রয়েছি শুধু আমি- একা- নিঃশেষিত নীল। মাঝে পেরিয়ে গেছে অনেকগুলো বছর।
আজ আর লোডশেডিং হয় না, অন্ধকারে চাঁদের আলো মেখে বন্ধুদের সঙ্গে কাটানো পরম প্রিয় সময় গুলো আজ আর নেই। হ্যারিকেনের আলোয় পড়তে বসা ,লম্ফর আলোয় দেখা মার মুখ, অফিস থেকে বাড়ি ফিরে এসে বাবার সেই ডাক, সেসব চঞ্চল মুহূর্তগুলো স্মৃতির পাতায় আজও আটকে আছে ।হিসেবের খাতা আজও মেলেনি, মিলিয়েই বা কি হবে? অনুভূতিগুলোই তো বাস্তবে আর নেই ,জাস্ট নেই।বছর ঘুরতে চলল, তবুও কেন যে পাঁচিলের ধারের ইউক্যালিপটাস গাছটা এখনো একইভাবে বোকার মতো দাঁড়িয়ে থেকে, তোমার কথাই মনে করিয়ে দিচ্ছে, কে জানে?
রাস্তারা সব শেষ হয়ে গেছে, ঠান্ডা হাওয়া আর আগের মত আদর করে না ,মিঠে বৃষ্টির ছাঁট ভালোবেসে আর জানলা ঠেলে ঢুকে আসে না , মেঘে মুখ লুকিয়েছে চেনা সূর্য , ফেটে যাচ্ছে লক্ষ লক্ষ অচেনা বুদবুদ ।মনে পড়ে, মামাবাড়ির টগর গাছে সন্ধ্যার একলা অন্ধকারে জোনাকিরা বেঁচে থাকত এখানে ওখানে,ওরাই ছিল আমার সাথী,আলো দেখাত।তারপর রাতভোর শুয়ে শুয়ে শুধু পাতাখসার শব্দ আর ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শুনতুম।আজ সেসব পাগলের মত কত খুঁজেছি, পাইনি ।জানলার ফাঁক দিয়ে আলতো আলোর ক্যালাইডোস্কোপের নকশা কবে হারিয়ে গেছে চিরকালের জন্য, ধ্বংসাবশেষও ধুয়ে মুছে সাফ ।মানুষ বড় বেশি সময়ের দাস। সময়কে বাগে রাখতে পারিনা আমরা -সেই অক্ষমতার কোন ক্ষমা নেই। ঘড়ির কাঁটার বড্ড তাড়া,কাউকে রেয়াত করে না।সে বড় অসহায়তা -একমাত্র মৃত্যুতেই বোধ হয় তার শেষ।সময়ের শব্দ খুব মৃদু। যেন , অগোচরেই বয়ে চায়। অথচ সে আড়ালে আবডালে অক্লান্ত জাল বুনে যায়। আবার কখনো কখনো পাখির ডানা ঝাপটানোর মতো সে ছুটে আসে আমার কাছে,কিছু চায়,মাটিতে ঝরে পড়া প্রতিটি অশ্রুবিন্দুর কাছে কিছু চায়। আর তার আসার শব্দের গায়ে লেখা থাকে, কোন না কোন দুঃখের দীর্ঘশ্বাস। জিত তো সময়েরই।সে দিয়ে ফেরে অগনিত যন্ত্রণা,রক্তপাত,মৃত্যু। কেউ তাকে ঠেকিয়ে রাখতে পারে না।তাই আমি আমার সুসজ্জিত একাকিত্বের কাছে জমা রেখেছি নিজের ভাগের সুসময়টুকু, তাকে যেতে দেব না কিছুতেই।
কিন্তু পৃথিবী একদিন ছিল না,একদিন থাকবেও না।কোথায় রইবে কোটি কোটি জীবনের এই সব ইতিহাস,ভাসমান দ্রুতপ্রসারিত মহাবিশ্বে?
শুধু বুকের মাঝখান দিয়ে বয়ে চলেছে একটা ঝরনা, পাহাড় থেকে নেমে আসার স্বপ্ন,হয়ত কিছু সত্যি নয় জেনেও বিশ্বাস করার মরিয়া ইচ্ছে।তীব্র বেগে সবকিছু কাঁপিয়ে সে আছড়ে পড়তে চাইছে ,যেখানে কোন শেষ নেই, সেই কুয়াশায় চলে যেতে চাইছে। তাই তো জেগে আছে এই পাগল মনটা, এখনো খুঁজে চলে একটা 'আমি' আর একটা 'আমি' কে, আর একটা জীবনকে। কিছুতেই চাই না, নাম না লেখা চিঠির মতো এ গলি, ও গলি ঘুরে,রাস্তা হারিয়ে,কাউকে খুঁজে না পেয়ে সময়ের রাজপথে অদৃশ্য হয়ে যেতে।
হঠাৎ আসা আবেগ, না বোঝা অনুভূতি আর না লেখা কবিতা নিয়ে ,আলাদা একটা না ছোঁয়া পৃথিবী আছে। সেখানেও পৌঁছতে হয়, তার কথা বুঝতে হয় ।অথচ আমার রোজনামচার জীবনে হঠাৎ ঝুপ্ করে সন্ধ্যা নেমে আসলে সবেমাত্র পাশে চলা চেনা মানুষটাও হুট্ করে পথচলতি মানুষের ভিড়ে হঠাৎ হারিয়ে যায়, আমি দেখেও কিছু করতে পারিনা। এই সব হারিয়ে যাওয়ার মধ্যেও যে একটা অন্যরকম বাঁচা আছে, তার বর্ণমালা আমি শিখতে পারিনি ।আবছায়া পুরোনো পাড়া, বেঁকে যাওয়া চেনা রাস্তার চেনা দোকানপাট আজও আমাকে দেখতে চায় , কথা বলতে চায় ।সেই রাস্তা তাই আমার জন্য আজও থমকে আছে। অনেক দূর চলে গিয়েও আমাকে তাই আবার ফিরে আসতে হয় এখানে।
যেখানে নিজেকেই নিজে ভালো করে দেখতে পাই না, সেখানেই আসলে নিজেকে সত্যিকারের চেনা যায়। নিজেকে কুড়িয়ে বাড়িয়ে নতুন করে গড়া যায়। অথচ দেখি ওড়ার ইচ্ছেগুলো ,শুরু করার ইচ্ছেগুলো বাজারে সস্তায় বিক্রি হয়,তাও কেউ কেনে না, ছুঁয়েও দেখেনা। চলনসই একটা জীবন খাড়া করে, সমস্ত যন্ত্রণায় ইচ্ছেগুলোকে মাড়িয়ে, আমি চলে এসেছি স্বপ্নের মেঘলা সিঁড়ি থেকে বহু দূরে , আর ফিরে তাকিয়েও সেই মেঘপিয়নকে খুঁজে পেলাম না।
বর্ষার কথা
আছ তুমি কাছে দূরে ,আছ তুমি মাথার ভিতরে শুধু বদলে যায় দিন তারিখ ,অস্থির হাত ঘড়ি ।বদলে যায় মলাট , নতুন কবিতার বইয়ের পাতা উল্টোতে শুরু করেছ তুমি, শুধু তোমারই জন্য। ঝড়ের রাতে অসম্ভব চমক ,পাগল করে দেয় অন্য কাউকে, অন্য কোনখানে। ফিরে আসে স্মৃতি,খেলা করে মন নিয়ে,বেজে ওঠে চেনা সুর অন্য কোথাও, অন্য কোনখানে ।অন্য কেউ লিখে ফেলে প্রেম মহাকাব্য, অন্য কারো জন্য।হুস করে দুটো মিনিবাস, নিঃশব্দ দুপুরে রেলিঙে হেলান দিয়ে,অন্য কোন না গাওয়া গান,পার্কের বেঞ্চে বা ফুটপাতের বাদামওয়ালা , বৃষ্টি ভেজা সকালে রেডিওতে বন্দেমাতরম,রাত জাগা চোখ,ডায়েরির প্রথম পাতা, উদ্ভ্রান্ত বিকেল ,মনে পড়ে স্রোতের মত, হারিয়ে যায়, ফিরে আসে, আবারও ফিরে আসে-অন্য কোথাও, অন্য কারো জন্য, অন্য কেউ।অন্ধকারে, নির্জন ক্যানভাসে যখন আঁকা হচ্ছে কেবলই রাত ,ক্ষয়ে ক্ষয়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে তোমার আমার চাঁদ,তখন এই নাও হাত। অসীম শূন্যে বিন্দুবিন্দু আলোর আভাস হয়ে, ঘুমিয়ে পোড়ো না, জেনো তোমারই জন্য জেগে আছে বিগ ব্যাং। আবার তুফান, ধ্বংস, শেষ হয়ে যাবে পাপবিদ্ধ পৃথিবী, শেষ হয়ে যাবে চেনা গলি, চেনা গুমটি, অসহ্য মিনিবাস ।তোমার আমার বুকে যখন ড্রিল করে রক্ত চুষে নিচ্ছে হানাদার,তখন এই নাও হাত ,কারণ অন্য কোথাও, অন্য কোন গ্যালাক্সিতে জেগে উঠছে প্রেম।
জানো নির্ঝর,আমি প্রতিদিন ভোরবেলা আবছা আলোয় ছাদের পাঁচিলের ধারে দাঁড়াই। সারা দিনের মধ্যে এই সময়টুকু, শুধু এই সময়টুকুই একমাত্র আমার নিজের সময়, একান্তই নিজস্ব। এই সময়ের ওপর আর কারোর দাবী নেই। ছাদে দাঁড়িয়ে সকাল হওয়া দেখতে দেখতে আমি অনেক কিছু ভাবি।অনেক অতীতের কথা, অনেক ভবিষ্যতের ছক কষা। ভাবতে ভাবতেই পাঁচিলের ওপর বসা অবাধ্য কাককে মাঝে মাঝে হুশহুশ করে তাড়াই।সে সময় ইচ্ছে করে, আমার অলস মনের আলসেমিতে যে দুঃখের করুণ কাকটা বারে বারে মানা না শুনে উড়ে এসে বসে,তাকেও যদি এমনভাবে হুসস্ হুসস্ করে তাড়াতে পারতাম, তাহলে বোধহয় খুব ভালো হত। প্রত্যেক মানুষের জীবনে কিছু কিছু পুরোনো কথা থাকে ,যা সে ভুলে যেতে চায়। আবার কোন বিস্মৃতপ্রায় উষ্ণ অনুভূতি দুহাতে বুকের মধ্যে পরম আশ্লেষে জড়িয়ে ধরে, উজ্জ্বল উদ্ভাসিত করে রাখতে চায়।দিনের এই সময়টায় আমি এইসব বহুবর্ণ উলের লাছির মত নরম কথাগুলো নিয়ে মনের আঙুলে পরম মমতায় নাড়াচাড়া করি।
সকালের মিঠে রোদ ভেদ করে একরাশ ঠান্ডা হাওয়া এসে নিবিড় আলিঙ্গনে ভরিয়ে দিয়ে গেল।হয়ত অনেক দূরে পৌঁছে, এই হাওয়া এই মুহূর্তে তোমারও চুল এলোমেলো করে দিচ্ছে। আমারও সব ভাবনা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। মনে হল প্রত্যেক মানুষের জীবনেই কখনো কখনো এমন ভীষণ ভালো লাগা হঠাৎ হঠাৎ ভীরু বৃষ্টির মত এসে মনের জানালায় করাঘাত করে যায়। ঠিক সেই মুহূর্তে সে যে কোনোদিনও অসুখী ছিল, কোনোদিনও অসুখী হতে পারে, একবারের জন্যও মনে আসে না।ছাদে দাঁড়িয়ে ঠিক সেই মুহূর্তে মনটা এক্কেবারে ভাল হয়ে যায়।
মনে হয়, আমার দুঃখী মনের সুখটা কেবল তোমার দুঃখী মনকেই বোঝে, তাই তো বেঁচে আছি। আমার জীবনে তুমি এসেছিলে অল্প দিনের জন্য, রেখে গেছ অমূল্য স্মৃতি। আজ ইচ্ছে করেই নিজেকে হারাতে চাইছ,আমাকে ফিরিয়ে দিতে চাইছ। অল্পদিনের জন্য, যা সামান্যই থাকে ,সেই অসামান্যটুকু হারানোর দুঃখ যে কি, তা আমার মতো করে আর কেউ জানেনি। অবশ্য যারা ইচ্ছে করে হারায় , তাদের খুঁজে পাওয়া চিরদিনই ভারি মুশকিল।যদি তেমন দিন সত্যিই আসে,আমি তোমাকে জোর করব না,তখন তোমার স্মৃতিই হবে আমার এই ক্ষুদ্র জীবনের পরম প্রাপ্তি। ছোটবেলা থেকে জেনে এসেছি মৃত্যুর জন্য একটা জীবন দরকার, কিন্তু তোমার দেওয়া স্মৃতিটুকু আঁকড়ে ধরে রাখবার জন্য, আজ মনেপ্রাণে আমার অনেক অনেক জীবন দরকার হবে। তোমার শুধু একটি বিরহের জন্য আমাকে অসংখ্য বার মৃত্যুবরণ করতে হবে।
আজ এই বৃষ্টিভেজা সকালে এই স্নিগ্ধ আকাশ,এই ফিসফিসে নিবিড় পরিপূর্ণতায় , তোমার কথা মনে করিয়ে দিল। একটা অচেনা পাখি এসে ছাদের পাঁচিলের কোণে খুব সন্তর্পনে বসল, পরক্ষণেই পছন্দ না হতে উড়ে কোথায় চলে গেল।রেখে গেল শুধু ডানা ঝাপটানোর শব্দ। মনটা হু হু করে উঠল। নিজেকে বড় একা মনে হতে লাগল, মনের মধ্যে থেকে একটা চাপা কষ্ট উঠে আসতে লাগল, মনে হল জীবনে কষ্টই হয়ত আমার বেশি।
কিন্তু শুধু কষ্ট পেয়েছি একথা বললে মিথ্যা বলা হবে, আনন্দও পেয়েছি অনেক। সেই উজ্জ্বল দুপুরে, তোমার পাশে নিস্তব্ধ ভাবে বসে থাকার মত, তোমার হাতের নরম উষ্ণতার মত ,সেই পূর্ণ পাওয়ার আনন্দ তো আর কোথাও পাওয়া যাবে না, কখনো কখনো কোন সুগন্ধি সুক্ষণে এমন আনন্দ হঠাৎ হঠাৎ এসে আমাদের রোজকার সস্তা চাওয়া পাওয়ার দম্ভকে এক দারুণ দুর্লভ বোধের চিন্তায় জর্জরিত করে দিয়ে যায়। আমার কেবলই মনে হয় সেই ভীরু ভালোবাসা বোধহয় সবচেয়ে আলাদা, যে কেউই তা পেতে পারে না। যে ভালোবাসা দাম্ভিক, যে ভালবাসা সহজেই পাওয়া যায়, তাতে কোন গর্ব নেই।
আমার ভয় হয়, তোমাকে আমি কিছু দিতে পারব কিনা, একথা ভেবে।তুমি জানোনা তোমার অজানিতে, আমি আমার সমস্ত কিছু তোমায় দিয়ে ফেলেছি। তোমাকে আমি এ জীবনে যা দিয়েছি, তুমি বিশ্বাস করবে কিনা জানিনা,তা কেবল তোমাকে দিয়েই ফুরিয়ে গেছে।এ এমন এক জিনিস,যা বার বার বিভিন্ন জনকে দেওয়া যায় না,এ কেবল একজনকে একবারই দেওয়া যায়।এ কথা যদি তুমি নিবিড় রাতে একান্তে কোনদিনও বুঝতে, তাহলে আমার নিজেকে খুব হাল্কা লাগত। মাঝে মাঝে দুঃখ হয়, তোমাকে বোধহয় জাগতিক দেওয়ার মতো কিছুই দিতে পারলাম না।তাই বলছি যা দিতে পারতাম,যা দেওয়া উচিত ছিল ,তা দিতে পারিনি বলে ভুল বুঝো না। শুধু ভয় হয়,যা দিয়েছি, তার দাম বুঝতে বুঝিবা ভুল করলে।
জীবন বড় বিচিত্র। কোন একজন কোন একটা কারণে, তার নিজের স্বার্থে, একমাত্র ভালোবাসার জনকে তার নিজের জীবন থেকে ঠেলে দূরে সরিয়ে দিতে পারে, আবার কোন একজন শুধু ভালোবাসার জন্যই ভালোবাসার জনকে বাকি সবকিছু ছেড়ে নিজের বুকে সারা জীবন আগলে রাখতেও পারে, এই আর কি। আমি আবেগ বিহ্বল কিনা এখন নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছ,কিন্তু আমি কি খুব সেকেলে? অবশ্য ভালোবাসা তোমার কাছে পিটুইটারির খেলা হতে পারে, কিন্তু আমরা বোকারা তাকে প্রেমই বলব। তুমিও তো ভালবেসেছিলে একজনকে, যে শেষ পর্যন্ত তোমার হতে পারেনি । যাই হোক তুমি যে তাকে আজও ভালোবাসো ,জেনে খুব ভালো লাগল।
তুমি এখন অনেক দুরে, জানিনা তোমার মন কোথায় পড়ে আছে। ট্রেনের জানালা দিয়ে বাইরে গেছে ভেসে, নাকি তোমার মনের অনেক গভীরে দানা বাঁধছে। সত্যিই ভাবতে অবাক লাগছে, তুমি এখন অনেক দুরে, প্রতি মুহূর্তে আরও একটু করে দূরে সরে যাচ্ছ। তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করলেও আর দেখতে পাব না। তুমি কি হোটেলে খাচ্ছ? যদি নিজে রান্না করো তবে সাবধান, আর যেন হাত পুড়িয়ে ফেলো না । তোমাকে নিয়ে তো আমার চিন্তার শেষ নেই। জানো, এখানে আজ থেকে হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হয়েছে। মনে হয়, এবার শীত পড়বে কলকাতায়। কিন্তু তুমি কোথায়? ছাদের ঘরে জানলায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দুপুর বেলা তোমার বাড়ির দিকে তাকিয়ে ছিলাম। গলির মুখে আড্ডাবাজ ছেলেছোকরার জটলা, ওপাশে কাদের বাড়িতে যেন চটুল হিন্দি গান বাজছে, বড় সাধারন সব।অসাধারণ ছিলে তো শুধু তুমি। বারবার তোমার বারান্দার দিকেই চোখ চলে যাচ্ছিল,তুমি নেই ওখানে।বড়ই ম্যাড়মেড়ে,ফ্যাকাশে বারান্দা।
এবার বল,তোমার নতুন চাকরি কেমন লাগছে? কিভাবে অফিস গেলে? স্নান করেছ আজ? ঠান্ডায় আবার এদিক ওদিক বেশী ঘুরে বেড়িও না যেন। তুমি যা, তোমাকে বিশ্বাস নেই। সাবধানে থাকবে বুঝলে? মনে রাখবে ,তুমি ওখানে সম্পূর্ণ নতুন আর একা। অফিস থেকে ফিরে, হাত পা ধুয়ে, খাবার খাবে। আমি নেই ভেবে, রাজত্ব খুলে বোসো না যেন। ক্লান্ত লাগলে শুয়ে পোড়ো, লেখালেখি করতে হবে না। কি হল, কোন উত্তর দিচ্ছ না কেন? বইপত্র সব ছড়িয়ে ফেলেছ বুঝি বিছানার উপর?সব গুছিয়ে, পরিষ্কার করে রাখবে, স্নান করার আগে। নীল গেঞ্জিটা একটু ধুয়ে দেবে, প্রচন্ড ময়লা হয়েছে। কালকে বাড়ি আসতে হবে, তখন যেন তাড়াহুড়ো না হয়। আগে থেকে সব গুছিয়ে রাখবে।শেভ করে, জিনিসপত্র ধুয়ে, ঠিক করে আবার তুলে রাখবে। তাড়া লাগিয়ে গাল কেটে বোসো না যেন। তোমার মত অসাবধান তো দুটো নেই! ওহ্, মনে পড়ে গেল, পর্দা গুলো ফেলে জানলা-দরজা সব ভালো করে বন্ধ করে, ফ্যান লাইটের সুইচ অফ করতে ভুল হয় না যেন।
তুমি আসবে,তাই নিজেকে আয়নার সামনে সাজাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। খুব সুন্দর করে সাজতে ইচ্ছে করল ।মুখে হালকা পারফিউম ছড়িয়ে দিলাম। খুব সযত্নে হলুদ শাড়ি, হলুদ ব্লাউজ, হলুদ টিপ কপালে বসাতে গিয়ে নিজের প্রসারিত মুখটি যেন উজ্জ্বল দীপশিখা হয়ে উঠল।হঠাৎ নিজেকে খুব নিবিড় ভাবে চুমু খেতে ইচ্ছা করল। কিন্তু নিজেকে তো নিজে চুমু খাওয়া যায় না, একথা ভেবে ছাদে চলে এলাম আমার ‘আদম’ তোমার পথের দিকে চেয়ে তোমার ‘ইভ’। তুমি যদি আস, তোমার মাঝে নিজেকে ভুলে যেতাম ,তোমার কাঁধে মাথা দিয়ে ঘুমিয়ে পড়তাম। তুমি তোমার হাতের স্পর্শে আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দিতে, আলতো করে কপালে এঁকে দিতে ভালোবাসার চুমু। আর ঠিক তখনই আমার ঘুম ভেঙে যেত।মনে পড়ে যেত,তুমি তো আসবে না। খুঁজে পেতাম না তোমার চওড়া কাঁধ, আদরের স্পর্শ খুঁজতে, অজান্তে চলে যাওয়া হাত কপাল থেকে আলগা চুল এর পরিবর্তে ফিরিয়ে আনত ক’ফোঁটা চোখের জল।নির্ঝর, তুমি জানো না, মেয়েদের মনের গোপন কোন প্রান্তে, এক বিশ্বস্ত চওড়া কাঁধের ওপর মাথা রাখার ইচ্ছেটা গভীরে প্রোথিত থাকে, থাকবেও চিরকাল।তাই তোমার কাঁধে মাথা রেখে কেঁদে ওঠে মন।
যেই তোমার পুনেতে চাকরি হল,অমনি যেন অন্ধকার আবার নড়েচড়ে বসল আমার জীবনে। মুহূর্তের মধ্যে সব ওলট-পালট হয়ে গেল। সব কল্পনা সাজানো, তারা যে কোথায় গেল? প্রায় গুছিয়ে নিয়েছি সব,তখনই আবারও সব সারা ঘরময় থৈথৈ হয়ে গেল। রামধনু রং, ভালবাসা তুলি ,মন আর্ট পেপার, পেঁজা তুলো কল্পনা, সব সিলিংয়ে উড়তে লাগল।তা হোক,তবুও আমি খুশি হয়েছি তোমার সাফল্যে ।জানো,বাকি সব জিনিসই গোছানো, শুধু সেই ভোরের স্বপ্ন? সেটাকেই তো বোঝানো,গোছানো যায় না।আমার চোখের তারায় কোথাও তারা নেই।
আজ তোমারই ছবি আঁকতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু বহু চেষ্টা করেও, পারলাম না। অনেক অনেক বার মুছলাম,তবু ঠিক তোমার মত তুমিটাকে গড়ে তুলতে পারলাম না। আমি মনে হয় আঁকতেই পারি না। স্বপ্নে রঙ না ছড়িয়ে গেলে, শুধু কল্পনার তুলি বুলিয়ে আর বাজারের সাধারণ রং দিয়ে তোমাকে কখনোই আঁকা যাবে না।
গভীর রাতে কখনও ঘুম ভেঙে যায়। বিছানায় শুয়ে জানলার বাইরে অসংখ্য তারাভরা আকাশের দিকে চেয়ে ভাবি, তুমি তখন কি করছ? ভাবতে ভাল লাগে তুমিও হয়ত তোমার বলভিতে জানলার ঠিক পাশে দাঁড়িয়ে জানলার শিকে হাত রেখে এদিকেই তাকিয়ে আছ আর আমারই কথা ভাবছ।আবার ফিরে এলাম ছাদের পাঁচিলের ধারে। নিশ্চুপ অন্ধকারে ঢাকা প্রতিটি রাতে, এ আমার একান্ত নিজস্ব সময়, যার উপর কারো দাবি থাকে না। এই বৃষ্টি ভেজা রাত,এই ফিসফিসে জলসা বাতাস, ঝরা পাতার শব্দ, আর কোথাও কিছু নেই ।এইসব চুরমার করে দেয় ,ভেঙে দেয় আমায়। চোখ পড়ে তোমার ছাদে,দু একটা গাছ- এর বেশি কিছু নেই।তুমিই তো নেই।আবার একা হয়ে যাই মধ্যরাতে, আচমকা ভেসে আসে কোন পাখির কান্না,অথবা একঘেয়ে সমুদ্রের গর্জন । সেসব তাড়া করে ফেরে আমাকে, চলন্ত সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে আমার নাকে এসে পড়ে ভেজা নিম পাতার গন্ধ। ঝড়ের কাছে সব ফেলে রেখে এসেছি বলে, ক্যাকটাসটাও বিদ্রুপ করে হাসে আমাকে দেখে।আমি জীবনভোর শুধু ছুটে বেড়াই। ঘরে ফেরা হয়নি আমার,শুধু ঝড় বৃষ্টির শব্দে ভয়ে আমি এখনও ছুটে আসি তোমার কাছে ,তুমি কি শুনতে পাচ্ছ? তোমার বাড়ির এক ফালি বারান্দায় বসে দেখছ কি আসন্ন বর্ষার উদ্দামতা ?নাকি দেখছ তোমার প্রিয় ইউক্যালিপটাসকে ? নাকি চশমা চোখে দারুন ব্যক্তিত্ব নিয়ে, কবিতা লিখছ?আমি যে পারিনা তোমার মত।শুধু ইচ্ছে করছে তোমাকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতে, সার্থক করতে এ জীবন, গর্বের ভারে মরে যেতে। ঘুমের ভিতর তোমাকেই ফিরে পাই বারবার, কিন্তু ঘুম ভেঙে মেলাতে পারি না। ভীরু বৃষ্টির মতো তুমি দরজায় করাঘাত করলে,এসে জানলার ঠিক পাশেই বসলে। স্থির দৃষ্টিতে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইলে, যেন ঝাউবনের ওপারে সমুদ্র দেখছ, বালিয়াড়িতে কেউ কোথাও নেই আর তুমি বসে বসে ঢেউ গুনছো।ইচ্ছে করছে, তুমি কোন বটগাছ হয়ে যাও, বা একটা চিল,অনেক উঁচু থেকে আমাকে দেখো,দেখতেই থাকো,থোড়াই কেয়ার দুনিয়াকে। আর আমি বসে বসে তোমায় দেখতে দেব। কল্পনায় তোমাকে এভাবে আবিষ্কার করে খুব আনন্দ পেলাম। সেই আনন্দ যা কখনো হঠাৎ এসে ,আমাদের সস্তা চাওয়া পাওয়াকে হারিয়ে দেয়। কিন্তু না, স্বপ্ন ভেঙে গেলে, তোমাকে মেলাতে পারিনা তোমার ছবিতে। কোথায় যেন ফাঁক থেকে যায় । শুধু চাই,সমুদ্রের ঢেউ আসার মত বা প্রথম দমকা ঝড়ের মত, তুমি গোপন থাক আমার কাছে , আমার একান্ত ভাবনার কাছে।আমার মধ্যরাতের অন্ধকারে তাই তুমি আমার গভীর গোপনে নিজস্ব। আমার ঘরের আয়না তুমি, আমার চান ঘরের গান, আমার চিত্রপটের ছবি ,যা একান্তে ডাক দিয়ে যায় শুধুই তোমাকে।
হয়তো সেদিন সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে, যেদিন আমি ছাইরঙা একঘেয়েমি জীবন ছেড়ে একেবারে হারিয়ে যাব,ঠিক তোমার কাছে। সেই রক্তিম গোধূলি আজও আমায় পিছু ডাকে ।তোমার রাতের আকাশে ধ্রুবতারা হয়ে ,আমি ঠিক হারিয়ে যাব।তুমিও তখন হয়ত ডুবে থাকবে সুখনিদ্রায়, টের পাবে না কিছু ।ঠিক তখনই তোমার পাশ থেকে হারিয়ে যাবে হলুদ বসন্ত পাখি, তোমাকে ফেলে রেখে। ঠিক যেমনভাবে হারিয়েছিলাম তোমার আমার লুকোচুরি খেলায়, চিলেকোঠার ঘরে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম একাই, সেই অসম খেলায় আমি হেরে গেছি আগেই । সেই যখন ঘুম ভাঙল দেখি বেলা পড়ে গেছে ,পাখিরা ফিরছে বাসায়। মন কেমন করেছিল কারো জন্য। কেউ তো আর নেই আমার,তুমি ছাড়া। অথচ তোমার চাঁদ ভাসি বারান্দায়,নিবিড় সুগন্ধ আর সঙ্গীতে,শুধু আমিই নেই। আর কখনোই জানি থাকব না।ভোরের আবছা আলোয় আবার যখন ঘুম ভেঙে যাবে ,তুমি কিছুতেই খুঁজে পাবে না জানলার পাশে, গাছের ডালে প্রতিদিন বসে থাকা অচেনা পাখিটাকে।কারখানার ভোঁ বাজবে, স্তব্ধতাকে চমকে দিয়ে তোমার ঘোর ভাঙাবে। হঠাৎ ঘরে ঢুকে পড়া অযাচিত ভ্রমর গুনগুনিয়ে শুনিয়ে যাবে আমি নেই। চমকে উঠে আকাশের প্রচন্ড রোদেলা বেলাকে প্রশ্ন করবে আমি কোথায়? ভোরের বাতাস কে খুঁজতে পাঠাবে আমায়। জোনাকির মৃদু ঝলকে, ঘরের কোনে অন্ধকারে বসে খুঁজবে আমাকে। বাসের ভীড়ের ভেতরে বা পথচলতি কলকাতার রাস্তাঘাটে দেখবে সবাই আছে, শুধু আমি নেই। পথ হারিয়ে চলে আসবে অসম্ভব রেল লাইনে, আপন মনে হেঁটে যাবে অনেকটা, তবুও পাবেনা আমায়। সেই অন্ধকার পথে, দিনে রাতে সবাইকে হয়তো পাবে, কিন্তু খুঁজে পাওয়া চিরদিনই মুশকিল হবে সেই পাখিটিকে,যে ইচ্ছে করেই হারাবে। তোমার জীবনে আগামী দিনে প্রেম হয়ত নতুন রূপে ধরা দেবে, বয়ে নিয়ে আসবে অফুরন্ত আবেগ। তোমার থাকবে কল্পনার নীল আকাশ, কিন্তু আমার জীবনে তা শেষ পর্যন্ত মিলিয়ে যাবে পানা পুকুরের পাশে পড়ে থাকা নীল ওড়না হয়ে।
আজ ঘরটা একটু অগোছালো থাক, যা তোমার পছন্দ। হাঁপিয়ে উঠেছি তোমার সাথে তাল মেলাতে ।টেবিলের ওপর এলোমেলো বইয়ের স্তুপ,রঙের শিশি উল্টোনো। এইমাত্র বিছানাটা গোছালাম, পরক্ষণেই কাগজে ছড়াছড়ি, পেন পেনসিল যেখানে সেখানে, অ্যাস্ট্রেতে আধজ্বলা সিগারেট। তখনই হঠাৎ হুকুম এল, ‘এক গ্লাস জল দাও’। জল ভরেছি সবে, অমনি বলবে ‘না, না ,গরম চা বানাও এককাপ’। তাই রান্না ঘরে সবে ঢুকেছি আবার বলছ, ‘কোথায় ফেললে রেজারটা?’ অনেক খোঁজাখুঁজি করে পাওয়া গেল পেনস্ট্যান্ডে। এবার বোধহয় সাবানের দরকার অথবা তোয়ালে। এরপর জামা পছন্দে গেল কিছু সময়। ঠিক যাবার সময় জামার বোতাম ফেললে ছিঁড়ে ,ছুঁচে সুতো পরাতে ঘেমে স্নান হয়ে যাই আর তুমি হেসেই বাঁচ না। অবশ্য সুতোটা ঢুকলো, যখন তুমি অফিসে বেরিয়ে গেলে। রান্নাঘরে গেলাম ।ঠিক তখনই ফোন,তোমায় চলন্ত বাসে উঠতে হয়েছে, অবশ্য তা তোমার পছন্দ। অফিসে পৌঁছে আবার ফোন, আরো কত কথা। মনে মনে ভাবি কি কাজ কর কে জানে? সারাদিন সরষে ইলিশ রাঁধবার ব্যবস্থা করি।বাজারে গেলাম, ফিরে দেখি দরজা বন্ধ করে যাই নি। ঘরের মধ্যে টিভি চালিয়ে বিছানা ওলট-পালট করে, কালি মুখে মেখে, কাগজ ছড়িয়ে, জানলার ঠিক পাশে বসে আছে পাশের বাড়ির দুষ্টু বাচ্চাটা, ঠিক তোমারই মত। রান্না করতে গিয়ে হাত পুড়ে যায়। কেঁদে ফেলি। অবাক হয়ে দেখে ছোট ছেলেটা এক ছুটে পালায় নিজের বাড়ি। যাবার আগে তোমার গানের সিডি,কবিতার বই সব ওলট-পালট করে দিয়ে যায়। আবার তোমার ফোন।বললে’ আমি আসছি’। সব গোছাতে পারি না,মন খারাপ হয়ে যায়।বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকি তোমার অপেক্ষায়। অনেক কথা জমে আছে সারাদিন ।কিন্তু অবাক হই তখনই ,এসেই যখন হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে যাও ধর্মতলার সেই রেস্তোঁরায়, কলেজ লাইফে যেখানে দিনের পর দিন আড্ডা মারতাম, অগোছালো জীবন কাটাতাম। মজার ছিল দিনগুলো ,সুখের ছিল। আবার সেই দিনগুলোকে মনে পড়ে। তাই তোমার জন্য আজ অগোছালোই থাকব, যা তোমারই পছন্দ।
কিন্তু না,সব স্বপ্ন,সব মিথ্যে,তুমি সত্যিই নেই।কি যে আর করি,আমার সময় কাটেনা। বিকেলগুলো কাটিয়ে দিই গান শুনে, ছবি এঁকে বা তোমার নাম ধরে ভালোবেসে। আমার একমাত্র সাথী আমার কুড়িয়ে বাড়িয়ে পাওয়া ‘তুমি’। যে তুমি শুধুই আমার,আর কারো না। আর আমার ‘আমি’ যাকে কেউ কখনো দেখতে পায়নি, দেখতে পাবেও না কোনদিন, সেই পাগল প্রেমিকা যে শুধু তোমার ‘তুমি’টার। তাইতো তোমাকে কখনই শরীরের কাছে পেতে চাই না, মনের কাছে চাই। যে মনের গহন, গভীর, গোপন ঘরে তোমার পূজা হয়। শরীরের প্রেমে ক্লেশ থাকে, গ্লানি থাকে। অশরীরী প্রেমই সারাজীবন টিঁকে থাকে। জানিনা তুমি একথা কিভাবে নেবে। নিজের মনের কথা অপরের কাছে বলে মানুষ হালকা হয়। কিন্তু আমার যে কেউ নেই, যাকে আমি আমার মনের কথা বলব। তুমি তো অনেক দূরে চলে গেছ,ফোনে কথা বলেও আশ মেটেনা, মনের ছবিতে রং লাগাতে পারি না, চারিদিকে কৃত্রিম রাতের অন্ধকার। আমার একবারও সেই বছরশেষের আসন্ন বিদায়ের কথা মনে আসেনি, হয়তো ভুলেই গেছিলাম বিদায়ী দিনটির কথা। বিদায়ের পালা দরজায় কড়া নেড়ে গেছে,নামহীন সম্পর্কটুকু বন্দী পাখির মত ডানা ঝাপটিয়েছে, সীমাবদ্ধ চার দেওয়ালের গণ্ডি ছেড়ে, অসীমের বুকে পাড়ি দেবার জন্য। কিন্তু আমার সামান্য ভুলেই সে পারেনি স্বাধীন হতে, এ ব্যাপারে আমি যেমন অসচেতন, তেমনি স্বার্থপরও বটে। তাই তো আজ তুমি জোর করলেও, আমি বিদায় দেব না আমার বর্ষ প্রেমিককে,হও না আমার জন্ম-জন্মান্তরের প্রেমিক ।তুমি যত ভাবেই বিদায় নিতে চাও না কেন, তবু আমি তোমাকেই চাই।
আজ তুমি চলে যাচ্ছ। আমারও তোমাকে এগিয়ে দিয়ে আসার কথা ছিল হাওড়া ষ্টেশন অব্দি। হয়তো যেতে পারতাম, আরো কিছু পথ তোমার সাথে থাকতে পারতাম। কিন্তু পরমুহুর্তেই মনে হল, পথের মাঝে থেমে যেতে হবে যে আমায়। এর চেয়ে দুঃখের আর কি আছে বল, যখন তুমি সবার অলক্ষ্যে আমার হাতটা ছুঁয়ে ,চলন্ত ট্রেনে উঠে যাবে। ‘আসি’ র বদলে ভুল করে বলে ফেলবে ‘যাই’। আমার উষ্ণ আশ্চর্য ভালোবাসা প্ল্যাটফর্মের নানারঙা আলোর দ্রুতগামী জ্বলন্ত আগুনে ধুয়ে মুছে যাবে,এ আমি সহ্য করতে পারব না। হুসেনের জলরঙা ছবির মত অপসারিত হয়ে, পরমুহুর্তেই অন্ধকারে ঢাকা পড়ে যাবে। ছুটি নেবে তুমি আমার কাছে। শত শত মানুষের ভীড়,ধোঁয়া-ধুলো, আওয়াজ, চিৎকার সবকিছু থেকে নিঃশব্দে চুরি করে নেবে আমার সবকিছু। আমার দুচোখ ভিজে যাবে জলে, ঠোঁট দুটো কেঁপে উঠবে, চৌচির হয়ে ফেটে যাবে বুকটা। মন বলে উঠবে ‘ছুটি দেবোনা তোমাকে’। আর বুকের মধ্যে থেকে একটি নাম নিঃশব্দে শরীর ছেড়ে বেরিয়ে আসবে ‘ নির্ঝর’। সারাটা পথের আনন্দ উচ্ছলতার মাঝে আমার মন গভীর দুঃখে শ্রাবণের দুপুরের মতো বেদনার ছায়াপথে হারিয়ে যাবে ।
সমস্ত আনন্দেরই বুকের কোরকের মধ্যে দুঃখের বিশুদ্ধ গন্ধ লুকিয়ে থাকে, মানুষের প্রত্যেক আনন্দকেই মানুষ খেকো বাঘের মতন অনুসরণ করে দুঃখ, আনন্দখেকো দুঃখ। আমি চাই না তোমার আমার সম্পর্কের সময়সীমার বাধকতা, আবার যদি আমার একঘেয়ে ভালবাসায় তুমি যদি বিরক্ত হও?এ ব্যাপারে আমি তোমার নতুনত্বের কাছে হার মেনেছি । জানিনা তুমি আবার কবে আসবে। পোস্ত পটল, সর্ষে ইলিশ, কাঁচা সম্বর দেওয়া মুসুর ডাল ,পাবদা মাছের ঝাল বেঁধে সোনা রঙের তাঁতের শাড়ি পড়ে কপালে কুমকুমের টিপ দিয়ে , আলগা খোপা বাঁধতে যাব, ঠিক তখনই তুমি এসে পড়বে আমার মনের ঘরে ।তাই না?
শেষ কথা
এইসব ফ্যাকাশে, প্রেমহীন দিনগুলো গুনে গুনে তিনশো তেষট্টিটা, অথচ একটা ,একটা মাত্র দিন খুব কাছের, আবেগ অথবা অভিমানের। একশো আটটা প্রদীপ জ্বেলে এইমাত্র পুজো শেষ হল, একাশি বছরের জীবন কাটিয়ে চলে গেলেন সেজ দাদু, বারো মাসের বছর কখন চোদ্দো বা আঠেরোয় পৌঁছে যায়, তা আমরা জেনেও জানি না ,অথচ একটা একটামাত্র তুমি আমার চেতনায় জ্বলে ওঠ, নিঃসঙ্গ শীতের রাতে। তুমি আঠেরো বছর কাটিয়ে সাবালক হয়েছ, তেরো বছর বয়সে তোমার প্রথম প্রেম, সতেরো বছরে তোমার প্রথম শিহরণ আর তেইশটা বছর কাটার আগেই হয়ত তোমার বিয়ে।অথচ একটা, একটাই তোমার সেই দামাল একুশ বছর বয়স। কফি হাউজের বাষট্টিটা টেবিল খুঁজেও আর আমাকে পাবে না, রেললাইন ধরে হেঁটে চলা বাইশটা দিনের মতো হয়তো আসবে না আর একটাও দিন।লাইব্রেরীতে সাতশো বই খুঁজে, কোনদিনও পাবে না আমার লেখা বইখানি। কলকাতার পথে, ঘাটে ,পার্কে, দোকানে থাকবে সবাই, থাকব না শুধু আমি। দিনের মধ্যে ছয় সাত বার তোমার জানলায় চোখ পড়ে যাওয়া কিংবা লুকিয়ে পড়া তোমার চিঠি এখন শুধুই স্মৃতি। নিরানব্বইটা আলিঙ্গনের জন্য ব্যাথাতুর ঠোঁট, ফেলে আসা সাতটা ডায়েরি, বারোটা কবিতা, চারটে সিনেমার টিকিট, নটা বাসের, কুড়িটা বরফি তোমার ছাদে, বাইশটা বখাটে ছেলে তোমার পিছনে, কিন্তু একটা মাত্র প্রেমিক তোমার, একটামাত্র।
চারদিকে গুমোট গরম,বিরক্তিকর।সেই একইভাবে দিনগুলোও কেটে যাচ্ছে ।নানা রকম ভাবে কেটে যাচ্ছে।কিন্তু ভীষণই মনে হচ্ছে, সেরকম কিছুই ঘটছে না, এসে পড়ছে না কোনো বন্ধু বা আত্মীয়, অবাক করা আনন্দজনক কোন খবরও থাকছে না ,এমনকি রাস্তায় হুট্ করে দেখাও হয়ে যাচ্ছে না পুরোনো প্রেমিকা বন্যার সঙ্গে।দিনগুলো কেটে যাচ্ছে একেবারে কিচ্ছু না ঘটিয়েই। যদিও চারপাশে দুর্বোধ্য অনেক কিছুই ঘটছে, তবুও আমার মনে হচ্ছে, করা হচ্ছে না বা বলা হচ্ছে না গুরুত্বপূর্ণ কোনকিছুই। অন্ততঃ মিটিয়ে ফেলা যাচ্ছে না একটাও পুরোনো ফয়সালা। কর্মক্ষেত্রে নানা নতুন লোকের সঙ্গে অবশ্য পরিচয় হচ্ছে, প্রত্যেককেই ভাল লাগছে আর মনের মধ্যে প্রত্যেকের অস্তিত্বই স্পষ্ট হয়ে বসে যাচ্ছে। কাউকেই ভোলা যাচ্ছে না, এমনকি যে লোকটা খুব একটা ভালো নয় বলে অন্যরা বলেছিল, তাকেও ভালো লাগছে, মনে থাকছে, শুধু এই জন্যই যে ,এও একটা ধরন। তাছাড়া কোন মানুষই পুরো ভালো বা পুরো খারাপ হয় না, খারাপ লোকের মধ্যেও খুঁজলে কিন্তু কিছু কিছু ভাল গুণ দেখতে পাওয়া যাবে । আমরা ভুলে যাই,জীবনের যাত্রাপথে ,গন্তব্যে পৌছোনটাই বড় কথা নয়, যাত্রাপথটাকে উপভোগ করা আর তার ছোট ছোট অসংখ্য জিনিসকে মনের খোরাক করে নেওয়াটাই বড়।কারণ গন্তব্যের শেষটা নয়,পথ চলার মধ্যবর্তী আনন্দ আর অভিজ্ঞতাটাই আসল।
এইমাত্র কড়কড় করে মেঘ ডাকল, বৃষ্টি এখনই শুরু হবে। কিন্তু কারখানার এই দূষিত পরিবেশে, ধোঁয়া আর ধুলোর মধ্যে বৃষ্টি দেখতে ভালো লাগে না।মনে হয় ,এখন যদি থাকতাম হিমালয়ের কোলে কোন ফুলের বাগানের মধ্যে ,একটা কাঁচের বাড়িতে বা পাহাড়ের ঢালে বয়ে চলা কোন ঝর্ণার পাথরের খাঁজে ,অথবা দিগন্তব্যাপী সবুজ ধান ক্ষেতের মধ্যে একটা খড়ের গাদায় হেলান দিয়ে শুয়ে, তবে বৃষ্টি দেখতে বেশ লাগত। সেই সঙ্গে অনেক মন কেমন এসে জমা হত, অনেক কথাও। কিন্তু এই দূষণক্লান্ত পরিবেশের মধ্যে বৃষ্টি এসে সেই মনের আরাম দেয় না।তাই কথারাও আসে না।তাই বাড়িতে আমি একা, ভীষন একা ,একেবারে একা। হরেক রকম বই পড়া, খবরের কাগজ পড়া, গান শোনা, টিভি দেখা, সব একা একা। হাসি, কাঁদি, কিছুতেই সময় কাটে না। মাঝে মাঝে একাকিত্বের জন্য চোখ ফেটে কান্না আসে, নিজেই দেখি নিজের কান্না ,নিজেই মুছে ফেলি । আমার ভীষণ প্রিয় কলকাতা শহরের আনাচে কানাচে ছুটে বেড়াতে চায় মন। কিন্তু আমাকে একা বাড়িতে বিষন্ন ফেলে রেখে, তখন মিলেনিয়াম পার্কে অন্য কারো প্রেম জমে ওঠে।প্রতি রাতে শেষ ট্রেন হুইসিল দিয়ে চলে যায়,ফেলে যায় আমায়।অফিস থেকে ফিরে ক্লান্ত চোখে,শরীরে ঘুমিয়ে পড়ি,আবারও কিচ্ছু করে ওঠা হয় না।চোখে জল এসে যায় অভিমানে। এই ভাবেই প্রতি সন্ধ্যাতেই সুখের দিনগুলোকে শেষ ট্রেনের মত মিস করে চলেছি ।প্রতিবারই সেই একই আফশোষ। তোমার ফোন এলে কষ্টটা বরং আরো বেড়ে যায়, কে আমাকে তোমার খোঁজ দেবে? অনেকদিন কবিতা লিখি না, এই চাপের মধ্যে কবিতা হয়না। কবিতা সৃষ্টির মত, মনে কোন আনন্দ হয়নি , বড়ই নীরস জীবনটা।এখন কবিতা শুধু পড়তে চেষ্টা করি, তাও বেশিক্ষণ ভালো লাগেনা ।কত ভালোলাগা কবিতা এইটুকু মনের পরিসরে জায়গা দিতে পারি না ।খুব খারাপ লাগে, কিন্তু জানি ,জীবন এরকমই। কতটুকুর জায়গা হয়, কতটাই বা হাত গলে পড়ে যায়।
বৃষ্টি শুরু হল।বিকেলের মন কেমন করা বৃষ্টি। একরাশ মেঘের মধ্যে দিয়ে উড়ছে ঘরে ফেরা পাখিদের দল। তাদের ডানা আজ ভারি। তাদের দলে আজ আমিও আছি,আমার শরীরের সমস্ত কোষে সেই ঘরে ফেরার আকুতি।বুকে উঠে আসছে একরাশ সোঁদা গন্ধ।কোন এক না জানা গাছের শিকড় ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছে আমার সারা শরীর জুড়ে। আমার ভাষা তখন প্রকৃতির ভাষা। ভাষারা চিরকালই বড় একলা, অবুঝ মনের মত নিঃসঙ্গ। সেই একাকী মন ছুটে চলে গায়ে মাটি- কাদা-বৃষ্টি মেখে। হঠাৎ করেই ভিজে যায়। নুইয়ে পড়ে বৃষ্টির শব্দে। সেই শব্দ শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল, ভালোবাসার যদি কোন রূপ থাকতো ,তাহলে তা যেন এই দামাল ঝড়ের রুপই হয়। বিকেলে খোলা মাঠে একা আমাকে এসে যে জানিয়ে দিয়ে যাবে ,সে আছে এবং থাকবে। চুপিচুপি কোন মনের কথা, প্রাণের কথা সেই ঝড়ের মুখ থেকেই ঝরে পড়বে হৃদয়ের সবচেয়ে দামি সম্পদের মতো ,অথচ যা বিলিয়ে দিতে একটুও দ্বিধা নেই ,লজ্জা নেই, শঙ্কা বা অহংকার নেই । ভালোবাসার যদি কোন রং থাকত , তবে তা হত সূর্যাস্তের গেরুয়া রং। দিনের শেষে যে রঙ কোন বিভেদ মানে না, আকাশের প্রতিটি কোণে তার প্রকাশ জানিয়ে দিয়ে তবে সে বিদায় নেয়। আমাদেরও শুধু সেই রংয়েই হারিয়ে যেতে হবে একদিন ,'হলুদ বসন্ত' পাখির সবচেয়ে নীল পালকটির মত।
ভালোবাসার যেমনই প্রকাশ হোক না কেন, তা আমার হাতের তালুর মতই চেনা , আমার সহজ জীবনবোধ ,সাবলীল আবেগের সঙ্গে কোথাও তার বিরোধ নেই ।সে যে আমিই। তাই ভালোবাসা আমার কাছে জীবনের সবচেয়ে দামী অংশ, সবচেয়ে সত্য,সর্বদা অটুট এবং খুবই স্বাভাবিক ।তা নিয়ে আমার কোন মাথা ব্যাথা নেই। ভালোবাসার যদি কোন রূপ থাকত ,তা সেই অল্প চেনা বর্ষাতেই প্রকাশিত হত,আর তো কেউ কখনো নেই আমার। ভালোবাসা যদি ভুল হয় তো সেই , ভালোবাসা যদি জীবনের পরম প্রাপ্তি হয়, তা হলেও সেই। সে একই সঙ্গে ভালোবাসার শুরু এবং শেষ, মায়া এবং বাস্তব ,প্রকাশ এবং প্রলয়। সেই আমার উন্মাদনা ও আবেগ, আমার পিটুইটারির খেলা । তার জন্যই আমার দেহ মনের সমস্ত স্পর্শ সংরক্ষিত ,কেবল সেই তা অনুভব করতে পারবে একদিন।অথচ, তারই কাছে থাকতে পারছি না,ইচ্ছে না হলেও বাধ্য হয়েছি তাকে কলকাতার পথচলতি ফুটপাতের কাছে ছেড়ে আসতে।সেখানে আমার কোনো জোর নেই, ভিড়ে হারিয়ে যাবার পর কত সহজেই, তার প্রতি আমার সব দাবী হারিয়ে যায়। কিন্তু,সে কাছে থাকুক বা দূরে , তার সংজ্ঞা ,তার স্মৃতি, আমার মনের সবচেয়ে দামি ঘরে তালাবন্ধ হয়ে আছে ,আর সেই ঘরের ভেতরে প্রবেশাধিকার শুধুমাত্র আমার।একথাই আমাকে আজ শান্তিতে রেখেছে, জীবনের সমস্ত ওঠা-পড়া,দুঃখ ,অভিমান একাকিত্বে পাশে থেকেছে, উৎসাহ দিয়েছে , বলেছে আমার নাম আর আমার সমস্ত আবেগ, চেতনা আর বোধের মূল্য আছে ,প্রাণ আছে- আছে ভালবাসার টান, যা কখনই শেষ হয়ে যেতে পারে না ।
বৃষ্টি শেষ হল,বর্ষা নয়। আকাশ নীল, সজীব হয়ে উঠেছে ।আমি তবুও খুঁজে চলেছি নিজেকে নতুন করে পাবার জন্য, যেমন সবুজ ধান ক্ষেতের পাশ দিয়ে দৌড়ে যাবার সময় কোন কিশোর নিজেকে খুঁজে পায়। তবু কেন আমি ধান ক্ষেতের মধ্যে বোকার মত দাঁড়িয়ে থাকা সেই কাকতাড়ুয়া হয়েই জীবনটা কাটিয়ে দিচ্ছি ,কে জানে? আমি ভগবান মানি না ,তবে যে পদ্ধতিতে মানুষের সৃষ্টি ,সেই সূত্র ধরেই বলছি, জীবন আমায় যে গভীর অতল দৃষ্টি দিয়েছে, যে পালকের মত মন দিয়েছে, তা সবার চেয়ে দামী ,যে আবেগ দিয়েছে , সৃষ্টিশীলতা দিয়েছে, লেখার হাত দিয়েছে,তা তো শুধু সেই আপনার জনকে সারা জীবন ধরে বুঝব বলেই। এইসবই জীবনের অপরূপ প্রকাশ, মানুষের পরিপূর্ণতা কেবল এই জীবনবোধই আনতে পারে।
সব কথা বলা শেষ হল।বৃষ্টিশেষের ঠান্ডা হাওয়ায় বারান্দায় দাঁড়িয়ে মনটা বোধহয় শান্তি পেল একটু।তারই মধ্যে দেখতে পেলাম ইউক্যালিপটাসের পাতাগুলো সবুজ থেকে আরো সবুজ হয়েছে।চারিদিকে সতেজ যৌবনের প্রথম পরশ,আর তারই মধ্যে বেঁচে আছে একটা পাগলমন। সেই মন ফিরে যেতে চায় মাতৃগর্ভে বা শূন্যতায়। দূরের তারার দিকে তাকাই। ওখানে বিশ্বাস আছে। ওখানে হেরে গিয়েও কেউ হারিয়ে যায় না। টুকরো টুকরো আলোর বিন্দু,কিন্তু কি বিশাল তার বিস্তৃতি।সে হল আশার আলো।রিভলভিং স্টেজের উল্টো পিঠেই আছে সব পেয়েছির জগৎ,শুধু দৃশ্যান্তরের অপেক্ষা।পরম দুঃখ আর আনন্দগুলো নিজেদের মধ্যে কথা বলে যায়।আমার তো শুধু রয়ে গেল বিক্ষিপ্ত একটা জীবন আর টুকরো টুকরো বেঁচে থাকা, যতক্ষণ না মঞ্চের ড্রপসিন পড়ে যায়।
অল্প জানা হলেও বর্ষাকে কোনদিনও ভুলব না ,ভুলতে চাইও না। তারই সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে আমার জুতোর সুকতলা তিনবার বদলাতে হয়েছে,অফিসে ম্যানেজারের চোখরাঙানি সইতে হয়েছে, মাত্র সাতটা ছুটি বাকি থাকতেও দুটো ছুটি নিয়ে ফেলেছি সম্পূর্ণ বিনা কারণে , এমনকি সাইকেলের রিম বেঁকিয়ে ফেলে কড়কড়ে ছাব্বিশ টাকা পর্যন্ত গুনতে হয়েছে মুরারী মিস্ত্রির কাছে। অপ্রস্তুতে পড়তে হয়েছে বন্ধুদের মাঝে, ধরা পড়তে হয়েছে এমনকি বাবা-মার কাছেও। তবু তাকে ছাড়িনি। বেদম মার খেয়েও তারই সঙ্গে থেকে গিয়েছি, থেকে যাব, তাকে রেখে দেব আমার মনে ।কিছুতেই যেতে পারবে না সে, এই বন্দীদশা চিরকালের ।এখানেই আমাদের সবুজ হওয়া। তবু শেষমেষ প্রত্যেকদিন তাকে বিদায় দিতেই হয়। সন্ধ্যে নামার আগে, সূর্যের শেষ আলোর গেরুয়া স্নিগ্ধতার রং সাদা চোখে মুখে মেখে নিয়ে, তাকে হারাতে হয়।এ তো জীবনযুদ্ধে হার নয়,এ শুধু তার মনের কোণে নতুন করে জায়গা পাব বলেই, আর হঠাৎ এক বর্ষার দিনে আকুল কান্নায় তাকে আবারও মনে পড়বে বলে।সেইখান থেকেই আমার আবার নতুন পথচলা শুরু হয়। পেছনে পড়ে থাকে সমস্ত স্বার্থান্বেষীদের কাতরোক্তি, লোভী আর হিংসুটেদের বড় লোলুপ চোখ, হিংসার রক্তাক্ত ছুরি।সমস্ত বিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে , মলিকুলার ফিউশন আর ফিশনকে মাড়িয়ে চলি আমি, সমস্ত পাহাড়ের মধ্য দিয়ে আমি খুঁড়ে ফেলি সুড়ঙ্গ, এমনকি সমুদ্রের তলা থেকে কুড়িয়ে আনি মুক্তোঝিনুক, শুধু একজনকেই দেব বলে। এইভাবেই চলতে থাকে আমার জীবনযাপন। সবাইকে পেরিয়ে নিমেষে চলে যাই অজানা লক্ষ্যে আলোর পথ ধরে, অমোঘ চোখের ডাকে।আমার চলা একদিন শেষ হবে, যেদিন জীবনের লক্ষ্যে আমার জন্য অপেক্ষা করে থাকবে শুধু আমারই একটুকরো সবুজ দিন। সেই সবুজ বৃষ্টিতে আমি বুক পেতে দেব।আমার চোখ, মুখ, গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে,আমার সারা শরীর ভিজিয়ে , সেদিন আমার সবুজ হবার পালা ,সেদিনও আমার চোখে থাকবে নীল পালকের স্বপ্ন।সেই নীল পালক বিছানো পৃথিবীর অবাক ডানায় ভর দিয়ে ঢেউ ভাঙা বন্দরে,মন বেহাত হয়ে যাবে। আলিঙ্গনের উষ্ণতার খোঁজে শিশুর মত বিশুদ্ধ ভাবে বসে থাকব আকাশের দিকে চেয়ে । অবহেলায় মনের আনাচে কানাচে জমে ওঠা শ্যাওলা মেখে আমারই মাটির সঙ্গে মিশে যাব আমি। পৃথিবীর আপন করে নেওয়া গন্ধ আমাকে একলা করে দেবে। ভেবেছিলুম ঘুমের প্রশান্তিমাখা মুখ নিয়ে,সেই স্বপ্নের গোধুলী রঙে ভীষণ নরম হয়ে বসব তোমার কাছে। কথা বলব। অথচ কলে জল আসার শব্দে যখন আমার ঘুম ভাঙল,দেখলুম দেরী হয়ে গেছে।একটা কাজল ধ্যাবড়ানো মোটা রেখা বেয়ে সন্ধ্যে নামছে। আমি হেরে গেছি জানো। দিনের শেষ আলো ওবেলার উঠোনে আলগোছে ঝুঁকে পড়ে। আমার দুচোখে তখন মন খারাপের জল জমে,নদী জানতে পারে না।
কিন্তু সেই নদীকে তো বাঁচতে হবে,তাকে তো আমায় হারাতেই হবে। সেদিন সে শেষবারের মতো আমাকে হারাবে, এমনকি আমিও হারাবো তাকে । আমি আমার হৃদয়ের নিঃশেষিত আবেগ আর অস্তিত্ত্ব,তার হাতে দিয়ে যেতে পারিনি , শুধু তারই হতে পারিনি, তাকে কাছে টেনে নিতে পারিনি ।এই পথে চলতে চলতে, আমি আমার সীমিত হাতের তালুতে তাকে ধরে রাখতে পারিনি, আমার ছোট্ট ঘরের কোণে দুধেল বিছানায় তাকে নিয়ে যেতে চাইনি, এ আমার ব্যার্থতা নয়, এ হলো এই পথের ইতিহাস।তাই সে চলে গেছে তার নিজের ছন্দে, সুরে, জীবনবোধে ।সে যেন নদী হয়ে বয়ে চলে গেছে আমার তৃষিত বালুচর সবুজে ভরিয়ে দিয়ে।সে স্থান-কাল-পাত্র, জীবন-মরণ, পার্থিব-অপার্থিবের হাতের পুতুল নয়,সে চিরন্তনী বহমান,সে আবেগ সঞ্চারী চেতনার নদী, সে যে বর্ষাজলের ধারা।
অনেক কিছু ফেলে আসার দুঃখ এসে বড়ই আঘাত করে। বারবার মনে হয়, সেসব কেন আর কখনো ফিরে পাবোনা ?কেন তারা হারিয়ে যাবে চিরকালের মতো? শুধু স্মৃতির পাতায় তারা মাঝেমধ্যে চকচক করে ওঠে , মনে পড়ে ,আর তখনই মনটা খারাপ হয়ে যায়। হারিয়ে আমি আজও ফেলছি অনেক কিছুই ,সেই দামাল প্রেমকে হারিয়ে ফেলছি ধীরে ধীরে কিন্তু দ্রুতগতিতে। জীবনযুদ্ধে হারতে হারতে প্রতিদিনের চেনা শহরটার সঙ্গেই আর তাল রাখতে পারছি না ,ক্রমশই দূরে সরে যাচ্ছি আমার প্রিয় শহর, প্রিয় বন্ধুদের আর প্রিয়তমা বর্ষার থেকে।সরে যেতেই হবে ,দূরে থাকতে থাকতে পারিপার্শ্বিকের স্মৃতিতে এভাবেই ক্রমশ ফিকে হয়ে যাব আমি, আমার স্মৃতিতে প্রিয় সবকিছু। শুধু কোন এক বর্ষার দিন রাস্তার দিকে তাকিয়ে ,বৃষ্টিতে কাক ভেজা কোন একটা লোককে চলে যেতে দেখে, হয়তো ভীষণ কান্না পাবে , কলকাতার থেকে অনেক দূরে থাকলেও। এ কথা ভাবলেই বড় দুঃখ হয়, হারিয়ে ফেলার ভয় হয়, এবং হারিয়ে আমি সত্যিই ফেলছি। তবু প্রেম, আবেগ, এইসব স্মৃতি,এগুলোকেই যত্ন করে ধরে রাখতে চাই ।তাই আমার ভালোবাসা ঠিক এখানেই শেষ হয়ে গেছে ।
আমি যে কে এই পৃথিবীর, তা সময়ের চিঠিতে লেখা থেকে যাবে,এইটুকুই স্বস্তি।আমার তাই কোন দুঃখ নেই,কারণ পাওয়া এবং হারানো এ দুই'ই আমার কাছে ভালবাসার রূপ। ভালবাসা হল মোমবাতির আলোয় দেখা চেনা মুখ , ভালোবাসা হল বুক দিয়ে ধরে নেওয়া বৃষ্টির ফোঁটা, ভালোবাসা হল ইউক্যালিপটাস গাছ, বিদায় দেবার চোখের জল আর হেরে বাড়ি ফিরে শাওয়ারের জলে স্নানের সময় মিশে যাওয়া সারা জীবনের কান্না।ভালবাসা কখনো কফি হাউজের কোণের টেবিল,বাগবাজার বাটার সামনে প্রতীক্ষা, এমনকি ভালোবাসা আমার কাছে স্বপ্নে দেখা মানবীর সঙ্গে দেখা না হওয়া পুরো সতেরোটা বছর। তবু আজও যখন মনে পড়ে বর্ষার কথা, তখন মন কেমন করে ,মন ছুটে চলে যায় ,কিন্তু কখনই বাস্তবিক শারীরিকভাবে তার কাছে যাওয়া যায়না, সে থেকে যায় চিরকালের জন্য অধরা।আমিও অবশ্য হতে পারিনি তার মনের কল্পিত প্রেমিক পুরুষ। আমি জানি আমার মধ্যে এমন কিছু নেই, যা তার চিরনতুন মনের অসম্ভব আবেগ আর জটিল ভালোবাসার বিমূর্ত্ত প্রতীক হতে পারে।
আমি বড় বেশী আবেগপ্রবন, কিন্তু আমি নিজেকে আবেগে ভেসে যেতে দিইনা ,সংযত করে রাখি ।প্রয়োজনে কঠোর হই। নিজের আবেগ আর হৃদয়ের উন্মাদনা গুলোকে মেরে ফেলে মাঝে মাঝে আমি নিজেকেই বাঁচিয়ে দিই, নইলে আমি শান্তি পেতাম না ।আমি জানি এবং দেখেছি দূরত্ব বাড়ে এবং ঠিক তাই ।হারিয়ে ফেলা সত্যিই ভীষণ দুঃখের, ভীষন কষ্টের ।কিন্তু এই কষ্ট পেতে চাই না বলেও তা পেতেই হয়, পেতে হয়েছে এবং হবেও। যেমন এখন পেতে হল ।এইসব ফ্যাকাশে দুরছাই দিনগুলোই দেখে যেতে হবে বাকি জীবনটা। কিন্তু তা সত্বেও আমি তো ঠিক বেঁচে আছি ।কবিতা লেখা হয়ত বন্ধ হয়েছে ,কিন্তু জীবন এগিয়ে চলেছে।শুধু একটা অভিমান,এতদিন পরেও সেই ছদ্মবেশিনী একইরকম অচেনা,অজানা।এ শুধু চলে যাবার সময় আমার দুঃখময় উপলব্ধি নয়,এ আমার হৃদয়ের গভীর থেকে বেরিয়ে আসা এক দীর্ঘশ্বাস।অনেক কিছু জানা হলনা,আর হয়ত কোনদিনও হবেনা।একদিন আসবে,যখন আর কোনদিনও দেখা হবে না,কালের গহ্বরে হারিয়ে অনেক অনেক দূর চলে যাব আমরা, সেইসঙ্গে এইসব প্রশ্নও মিলিয়ে যাবে চিরকালের মত।যা করতে পারলাম না,যা বলতে পারলাম না,যে চিঠি কোনদিনও তার হাতে পৌঁছল না,তা শেষপর্যন্ত হয়ত ভালোর জন্যই হয়েছে।আমার দুঃখ এই দূরত্বের জন্য,এই জীবনযাপন,এই সমাজব্যবস্থার জন্য,যা বদলাবার আগেই সম্পর্কগুলো হারিয়ে ফেলব আমি,জীবনটা এতই ছোট আর দ্রুত। এই চলে যাবার যদি ক্ষমা থাকে কোন,মনে মনে ক্ষমাপ্রার্থী আমি।আমি জানি,আমি নই, আমি হতে পারিনি , সেই আদর্শ প্রেমিক পুরুষ হতে। থাকি না আমি সেই অন্যরকম অসম্পূর্ণ পুরুষ হয়ে ,শুধু আমার কবিতার পরিচয়ের মধ্য দিয়ে ?এই সামান্য অথচ সারাজীবনের মনের কথাটা সবচেয়ে আগে একমাত্র সেই স্বপনচারিণীই বুঝতে পারবে, যখন আমি থাকব না তার চোখের মাঝে। সেদিন সেই প্রেমকাহিনী হবে তো লেখা?
হেরে গেলেও তো একটা মানুষ বেঁচে থাকে। অনেক প্রত্যাখানের শেষেও তো কেউ ভালোবাসার উত্তাপে বারবার পুড়ে যেতে চায়।সেকি শুধুমাত্র,সে বোকা বলেই?কি জানি,হয়ত বোকা বলেই আমি সারারাত জেগে যাবতীয় ভালবাসাবাসি জড়িয়ে শুয়ে থাকতাম।
আজও মনে পড়ে, সেদিন বিকেল, আমার প্রথম প্রেম ভেঙে গেছে ।শেষমেশ দেখা করে সব চিঠিচাপাঠি ফিরিয়ে দেবার দিন। দেখতে পেলাম হলদে শাড়ি পড়ে বন্যা আসছে ,চোখ মুখ অন্যরকম ।অনেক কেঁদেছিল নাকি? সে এগিয়ে আসছে, বুকের কাছে ধরা আমারই উপহার দেওয়া 'শেষের কবিতা' বইটা। সে বলল, "মানুষটাই যখন নেই, তখন আর উপহারগুলো রেখে কি লাভ ?এই নাও, সব ফিরিয়ে দিলাম।" শেষের কবিতা বইয়ের প্রথম পাতায় আমারই লেখা কবিতার ধৃষ্টতা, ভেতরে অসংখ্য কবিতা, চিঠি। সব কি ফিরিয়ে দেওয়া যায়? সে দ্রুত বাস ধরে চলে গেল। আমার হাতে থেকে গেল "শেষের কবিতা"। সেদিন সেই মুহূর্তে আমার গলায় নয়, মনে ভেসে আসছিল একটাই গান ,"তুমি রবে নীরবে, হৃদয়ে মম"।তারপর থেকে আজ অবধি যখনই গানটা গুনগুন করে গাই,আমার চোখে ভেসে ওঠে এক ধূসর বিকেলবেলা।জীবনের সবচেয়ে দামী সঞ্চয় অক্লেশে ফিরিয়ে দিয়ে, নিঃস্ব হয়ে দুদিকে চলে যাচ্ছে দুজনে,যারা আর কখনও ফিরে আসতে পারবে না একে অপরের কাছে ,যার চেয়ে বেশী ভাল কেউ কখনও বাসেনি তাদের।
শীতকাল কাউকে কোথাও পৌঁছে দেয় না ।এই যে শীতের শুরুতে আমার বর্ষার সঙ্গে প্রথম আলাপ ,মধ্যভাগে প্রেম আর শেষ শীতে এই যে আমি একা একা দেবদাসের মতো বসে মাথা চুলকোচ্ছি, এর থেকে আজ এইটাই মনে হয়।প্রথম শীতের স্বভাবের মধ্যে একদিন তাকে বাসে প্রথম দেখি। আমার যাবার কথা ছিল কলেজস্ট্রিট- বই কিনতে। মন্ত্রমুগ্ধের মতো আমিও তার পেছনে নেমে গেলাম। প্রথম দিন তার সঙ্গে কিভাবে কথা বলব তা বুঝতে পারিনি।
সেদিন আলাপ করা আর আমাদের মরসুমি প্রেমের ইতি, মাঝে মাত্র কটা মাস। একদিন ,শীতের আর্তিতে কাঁপতে কাঁপতে আমি দেখলাম, আমি আবার একা হয়ে গেছি,সময় শেষে একরকম বাধ্য হয়েই ,বর্ষা নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে।আসলে বিচ্ছেদ যে আসন্ন ছিল। কিন্তু আমি একদিন সত্যিই, তার সাথী হতে চেয়েছিলাম।মনে পড়ছে,সেদিন অটো করে ফিরছি বাড়ি থেকে,আবার অনেকদিন পর বাড়ি আসতে পারব,অটোতে এফএমে বাজছে রফির 'কেয়া হুয়া,তেরা ওয়াদা'।বড্ড মন কেমন করছে তোমার জন্য,তোমার পাড়ার সামনে দিয়ে যাচ্ছে অটোটা,সব কথা ভীড় করে মনে পড়ে যাচ্ছে। 'ও দিন জিন্দেগিকা আখরি দিন হোগা', চোখ ফেটে তখন জল বেরিয়ে আসছে।
শীতকাল চলে যেতে বসেছে, ফুল ঝরে গেছে ডালিয়া, চন্দ্রমল্লিকা, অ্যাসটারের। বর্ষাও চলে গেছে দুরে,হয়ে গেছে অধরা,ঠিক প্রথম দিনের মতই। এই মাঝরাতে তাই ভীষণ জলতেষ্টা, ভীষণ জড়িয়ে ধরা শেষ রাতের কম্বলের উত্তাপকে। ভীষণ মনে পড়ছে সেই পথ চলা , টুকরো টুকরো কথা, অমলিন হাসি।নাঃ, আর হলো না এ জীবনে। নইলে কেন বারবার হেরে যাই আমি?
এরপরে বোঝাবার মত রাত্রি নেই ,এরপরে দুঃখ বোঝাবার কিছু নেই ,নেই একাকীত্ব বোঝাবার। এর চেয়ে বড় বিষ কিছু হয়না, এর থেকে বড় আঘাত আর হয়না ।এই মনকেমনের জবাব এলো না এবং সেই দিন হলো ,সেই রাত হল, সেই পথ চলতে হল একা।
আজ এই শহরটাও আমারই মত বোকা বনে গেছে,অন্য কারো কাছে ঠকেছে হয়তো। ওরও বুকের কাছে অনেক দুঃখ,অভিমান জমেছে,গঙ্গার জলে ধুয়ে যেতে পারেনি। এখনো পড়ন্ত বেলায় দু একটা একলা পাখি উড়ে আসে ওর বুকের কাছে। চুপ করে বসে থাকে,ওদের কারো কোথাও যাবার নেই।তখন শহর উপুড় করে দেয় তার জমে ওঠা সমস্ত কান্না।বড়বাজারের ভীড় ঠেলে,কোথা থেকে ছাতিমতলার একলা পাখির ডাক ভেসে আসে।কখনও আবার ট্রামের আওয়াজ,ফেরিওয়ালার হাঁক,ট্রাফিকে হঠাৎ রবীন্দ্রসঙ্গীত,ফুটপাথে পথকুকুরের পাশে শুয়ে থাকা পথশিশুর কান্না,ফোনের রিংটোনে রূপমের গান সবকিছু একসাথে জট পাকিয়ে আবছা হয়ে আসে চশমার কাঁচ।
এই রোজকার একঘেয়ে কান্নার চেয়ে ভাল ছিল দিন আনি দিন খাই, এর চেয়ে ভাল ছিল প্রথম দিন রাত্তিরে ধেবড়ে যাওয়া কাজল মুছে আবার নতুন করে কাজল পরা, এর চেয়ে ভালো ছিল কোমর জড়িয়ে উদ্দাম নাচা অচেনা কারো সঙ্গে আর পরেরদিন অন্ধকার ঘরে খুনসুটি করা অন্য কারো সঙ্গে। এর চেয়ে অনেক ভালো ছিল কোনদিন কবিতাই না লেখা, কোনদিন স্বপ্নই না দেখা।সাবানের ফেনার রামধনুতে তাই আর স্বপ্ন দেখব না।
সবাই চলে যাচ্ছে, এবারে আমিও হয়ত সেই এঁদো গলির বখাটে মেয়েটার হাতের খেলনা হয়ে যাব।তার টেলিকলার অমোঘ কন্ঠস্বরের দাস হয়ে যাব। তাকে দেখিনি, চিনিও না ,তার সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানিনা,ফেবু প্রেমও চাই না। সে কেলে মোটকু পাঁচ ফুটিয়া না মডেলিং করা সেক্সি স্বপ্নসুন্দরী, তাও জানিনা।একঘেয়ে জীবন থেকে মুক্তি, উচ্ছল আকর্ষণীয় কথা, হালকা গরম নিশ্বাস, কপালে জমা ঘাম, শরীরজুড়ে সুড়সুড়ি । যৌবনের তাড়না , যৌনতার নেশা? সে আমাকে ভেঙে বদলে দেবে। বদলে যাবে কি সৌন্দর্যেরও মানে? কোনটা শেষকথা জীবনে? মনের চাহিদা, আবেগ, কবিতা , প্রেম এসব কোথায় হারিয়ে যাবে? বাস্তব কি এত নিষ্ঠুর? আমার দাম শুধু শরীরে, যৌবনে ?তারপর কি হবে ?ভালবাসার জকে হারিয়ে ফেললে ,আর কি নিয়ে বাঁচব আমি?একটা স্থায়ী পরিচয় কি আমার পাওয়া যাবে না? মানুষ? তাই বা বলি কী করে?আমার নিজস্ব বলে কোন সত্ত্বা নেই, কোন মত নেই, বিচার নেই, বুদ্ধি নেই? আমি কি চলেছি তালেগোলে ,ভুলে ভালে? এই ক্ষয়িষ্ণু সমাজে আমার কোন ভূমি নেই ,ভূমিকা নেই ? আমার শুধু একটা নাম আছে। ওটা বদলাবে না ।কিন্তু ওটার কোন মূল্য নেই ।ঘাড়ে চেপে থাকবে ফাঁকা শুকনো একটা জন্জাল-মৃত্যু পর্যন্ত।যে নামের ঠিক মানে পর্যন্ত আমি জানি না। ঐ নামের আমি যোগ্য কিনা তাও জানিনা। ঐ নামটা আমি খাব , না মাথায় দেব ,নাকি ছুঁড়ে ফেলে দেব, তাও জানিনা।ফেলে দেবই বা কোথায় তাও জানিনা।
এতে লোকে হয়তো আমাকে ঘেন্না করবে। লোকে আমার গায়ে থুতু দিক, তবু জীবন নিয়ে নতুন করে জুয়া আমি খেলব না ।আমি জুয়া খেলবো শুধু খেলার মেজাজে ।সেখানে আবেগ থাকবেনা, চুম্বন থাকবে না, হাতের মধ্যে আঙুল নিয়ে খেলা থাকবে না। আমায় ঘেন্না করো সবাই, কারণ আমি নিজেই নিজেকে ঘেন্না করি। কারণ আমি লোক ঠকাই, কারণ আমিও আজ বাস্তববাদী, কারণ আমি আবেগের মূল্য ভুলে গেছি, কারণ আমি পথ চলতে ইচ্ছাকৃতভাবে হড়কে যেতে চাইনা, মনের মধ্যে আগুন চেপে রেখে সঙ্গিনীর সঙ্গে ন্যাকামিতে ভরা গল্প চালাতে চাইনা।কথাটা ঠিকই, শীতকাল কাউকে কোথাও পৌঁছে দেয় না। শুধু পাতাঝরা বিকেলে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পথ হারিয়ে দেয়, প্রতিবারই।
বাসের জানলা দিয়ে হু হু করে ঠান্ডা হাওয়া ঢুকে আসছে,আর কানে কানে বলছে ‘সে নেই,সে নেই’। মাথার চুলগুলো আমার এলোমেলো হয়ে পড়ছে বারবার। আর জানলা দিয়ে দ্রুত, খুব দ্রুত পিছিয়ে যাচ্ছে কলেজ স্ট্রিট। এ সেই কলেজস্ট্রিট, যেখানে আমাদের প্রথম দেখা শুধু নয়, জীবনের অনেক দুরন্ত বিকেলও কেটেছে ,এখানেই অনেক না বলা কথা পথ খুঁজে নিয়েছে, আবার অনেক চোখের জল চিরকালের জন্য থেমে থেকেছে এখানে । আর আজ এখানেই আমি চিরকালের মত ফেলে রেখে এলাম আমার শেষ প্রেমিকা বর্ষাকে। ওর সঙ্গে আমার সম্পর্কটা ছিল প্রেমেরই। কিন্তু আমরা একে বলতাম বন্ধুত্ব, কখনো বলতাম মনের সম্পর্ক। কোনো স্থায়ী নাম ছিল না এই সম্পর্কের ।আমরা নিজেরাই জানতাম না যে ঠিক কি করছি, আর সে তাগিদও ছিল না । অবাক হয়ে ভাবছিলাম , এই কয়েকটা মাস কিভাবে কাটিয়ে দিলাম। আমরা কি করিনি! কফি শপ বা পার্কে গিয়ে অদ্ভুতভাবে বিকেলগুলো কাটিয়েছি, রাস্তার মধ্যে মেতে উঠেছি দুষ্টুমি, খুনসুটিতে,দুজনে হারিয়ে গেছি দুজনের মধ্যে ।আমাদের মধ্যে সীমারেখার বাঁধন ছিল না কোন, শুধু খুশিতে, চাঞ্চল্যে কেটে গেছে দিনগুলো। কিন্তু আমি আর বর্ষা দুজনেই জানতাম,মেনেও নিয়েছিলাম বর্ষশেষের আসন্ন বিচ্ছেদ। সম্পর্কের গভীরতা তৈরি হতে দিতে চাইনি, কিন্তু না চাইলেও হয়ে গেছে। আমাদের মিলন যে হবেনা কোনদিন, এ কথা প্রথম থেকেই ঠিক ছিল।এ যেন ছিল একটা খেলা,একটা অলিখিত চুক্তি। অন্ধকারে রেললাইন ধরে মৃত্যুর দিকে পিছন করে এবং প্রতিবার বেঁচে ফিরে আসার মত।এই উদ্দাম হেঁটে চলার কোন মানে ছিল না,কোন গন্তব্য ছিল না।
বর্ষার সঙ্গে আমার পরিচয় ,আর দেখতে দেখতে কেটে গেছে গোটা বছরটা, ঘটনাবহুল। দুঃখ, রাগ, অভিমান , আবেগ আর আনন্দে।হঠাৎই আমার পুনেতে চাকরি হয়ে গেল। সেখানেই থাকতে হল । শুধু মাঝে মাঝে বাড়ি ফিরতে পারতাম,তাও ঘন ঘন নয়।বাদ সাধল দূরত্ব আর খরচ ।তাই চেনা শহর ,চেনা প্রেমিকার সঙ্গে যোগাযোগটা গেল কমে। সম্পর্কটা হালকা হয়ে এলো,দেখা-সাক্ষাৎ,ফোনালাপ গেল কমে। এসে গেল আমাদের বিদায় নেবার পালা,যা কথা ছিল,ঠিক সেইমত । আমি বুঝতে পারলাম যে এই একটা বছর যে উচ্ছ্বাস আর আনন্দে কাটিয়েছি, তার তুলনা হয় না ।আবেগময় কিছু মুহূর্তের চপল খুনসুটিতে মেতে ওঠা সময়গুলো, আমার সারা জীবন স্মৃতি হয়ে থাকবে। এটাই হয়ত আমার চিরকালের সোনালী পাওয়া। এই নামহীন সম্পর্ক এই জীবনের এক মূল্যবান রত্ন ,এক সেরা অনুভব ।তাকে ভুলতে পারব না আমি, কোনদিনও। বর্ষাকে অনেক শুভেচ্ছা জানিয়ে, তাকে বিদায় জানাতে সত্যিই আমার কষ্ট হয়েছিল। আগের দিন সারারাত বিছানায় ছটফট করেছিলাম।কিন্তু বর্ষা ?ওর কথা তো জানা হল না?ও কেমন থাকবে? বিদায় কালে আমার একটাই সান্তনা থাকবে, যদি ও আমাকে ভুলে না যায়।কিন্তু তা কি হবে? তারও সেই স্মৃতি কি ভরা থাকবে? আমি আর ভাবতে পারছি না। সেই সুন্দর দিনগুলোর সুখস্মৃতিই হোক আমাদের একে অপরকে দেওয়া শ্রেষ্ঠ উপহার।তবু,তবু প্রকৃত প্রেমকে কখনও শোবার ঘরের বিছানায় টেনে নিয়ে যাওয়া যায় না,যেতে চাইনা। সে থাকে চিরপবিত্র।তাই দূরে চলে যাবার মধ্যে যে ভীষণ আবেগ লুকিয়ে আছে, যে পাগল করা ভালবাসার মন কেমন করা আছে, তাতেই ভালোবাসার গুরুত্ব শতগুণ বেড়ে যায়। আরো ভালবেসে ফেলি সেই অবিনশ্বরীকে।
বাসটা শ্যাম বাজারের মোড়ে এসে পৌঁছলো।কত স্মৃতি এই জায়গাটার সঙ্গে জড়িয়ে ,কত আবেগ-বিহ্বল সময় কেটেছে প্রতীক্ষায়, কত উদ্দাম পথচলা ।আমার চোখ জলে ভরে এল ।কিন্তু কথা তো রাখতেই হবে, সর্বনাশা পরিণতিহীন সম্পর্কের ইতি টানতেই হবে। নামহীন সম্পর্ক যে সম্পর্কের নাম। তাই বিদায় নিতেই হল ।বিদায়,বর্ষপ্রেমিকা,বিদায়।
আমার শূন্য দৃষ্টির মাঝেই কন্ডাক্টরের ঘন্টি পড়ল, বাস ছাড়বে। ‘যাও’ বলে তার কর্কষ নির্দেশ শুনে মনে পড়ল,আমাকেও যেতে হবে।
কত শান্ত সকাল, দুরন্ত দুপুর, অস্থির বিকেল ,আলোকময় সন্ধ্যা আর স্বপ্নের রাত কাটিয়েছি। তোমার জন্য কত সবুজ কবিতা লিখেছি, তোমার আমার নাম না জানা কত নীলাভ সুখ, কত সাদা পাতায় আমার হৃদয় ভরে দিয়েছি। কতদিন মাঝরাতে উঠে পড়ে, তোমারই স্বপ্ন দেখেছি আর কত সময় কাটিয়েছি একসাথে পথে পথে। কখনো অন্ধকার গলি, কখনো বা নিস্তব্ধ রেল লাইন ধরে কত শ্রাবণের পথে ভিজেছি, অকারণ কত শীতের শিশির মাড়িয়ে চলে গেছি উদভ্রান্ত কামনায়। কতবার তোমার কথা রেখে, চলন্ত বাস থেকে নেমে পড়েছি রোদমাখা ফুটপাতে। কখনো বা কফি হাউজের এক ফালি টেবিলের ,কোন মূল্যবান সামান্য সময়টুকুও চলে গেছে তোমার সঙ্গে। কত কাজ ফাঁকি দিয়ে, কত পাশ ফেল, কত বকুনি, ধরা পড়া ,কত অকারণ অভিমান, চোখের কোনে জমে ওঠা কত বরফ বৃষ্টি ,তবু তোমার ঠোঁটের কোনে এক চিলতে পৃথিবী, একটুখানি কবিতা তোমার চাহনিতে, এইটুকুই। তোমার সাথে কত সিনেমা, ভিক্টোরিয়া,অসংখ্য নলবন, দুরন্ত দুষ্টুমি পেরে উঠত না আমাদের সঙ্গে।আবার
কখনও মাঝরাতে ছাদে উঠে চেয়ে থেকেছি তোমার ছাদের দিকে উতলা। কত দিন তোমার জানলায় ছুটে গিয়েছে অস্থির মন, অদম্য আবেগ, তোমার আসা যাওয়ার পথ চেয়ে কত কবিতার জন্ম মৃত্যু সন্তানাদি হয়ে গেল, কত ফুল চিঁড়েচ্যাপ্টা ,কত ট্রেনের টিকিট বেপাত্তা,কত শেষ না হওয়া কবিতার মুখে মুখে প্রাণ পেয়ে যাওয়া, কত মানিব্যাগের হা-হুতাশ, কত প্রেম বাথরুমে শেষ হয়ে যাওয়া,সেই প্রথমবারের প্রকৃত কষ্ট, তোমার ছবিতে মুখ গুঁজে কত কান্না, কত শত রাত অকারণ জাগা, ঘুম ভেঙে দেখা কত স্বপ্ন ,অস্থির সময়ে হৃদয়ে তিলে তিলে ভেঙে ভেঙে শেষ হয়ে যাওয়া, ধীরে ধীরে পেরিয়ে আসা যৌবন ,পাতা ঝরে যাওয়া। সেই সব অফুরন্ত দিন, দুরন্ত সময়, অনির্দিষ্ট রাস্তা,বাস-ট্যাক্সি বিহীন কলকাতার বনধের রাজপথ,আর শুধু তুমি আর আমি, বাকি সব বন্ধ। আজ তা স্মৃতির পাতা, আজও সেই এপ্রিল মাস ,সেই ভিড় বাস, জ্বলেপুড়ে যাওয়া শরীরে আজও সেই মিষ্টি চেনা হওয়া, সেই টালা ব্রিজের জ্যাম আর সেই আমার সামনে তুমি, সেই বর্ষা। আজও তোমার সাথে থাকতে চাই কিছুটা সময়, কিছু কথা ,কিছু পথ হাঁটা পাশাপাশি, কিছু না বলা কথা আজও, কিছুটা বসন্ত কেবিন বা মিলেনিয়াম পার্ক, তুমি যেখানে যাবার বায়না করবে, আজ হাতে অনেক সময় , আজ আমি আরো সবুজ, আরো গভীরভাবে তোমাকে কিছু দিতে চাই, কিন্তু কোথায় তুমি বর্ষা? কোথায় তোমার সেই হলুদ শাড়ি? ভিড় বাসে তো সকলেই আছে ,শুধু নেমে গেছ তুমি, সাউথ সিটি অথবা ময়দান অথবা.........।